scribbling

কবি খিল্লি

ধুর, আজকাল আর কবিতা-টবিতা পড়তে ভাল লাগে না। কোত্থেকে লাগবে বাওয়া? আজকাল কি কবিতার আর সেই মজাটা আছে? সব একেবারে হাওয়া। একদল নাম-কা-ওয়াস্তে ইম্প্রেসনিস্ট আর তথাকথিত আঁতেলদের চাপে আস্তে আস্তে কবিতার সৌন্দর্য্যটাই তো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তো কেউ যদি আমায় এসে বলে, “দাদা জানেন তো, আজকাল কেউই কবিতা লিখতে পারে না”, তাহলে আমি বলব, “সম্পূর্ণ ভুল কথা। প্রশ্নটা কবিতা লিখতে পারা আর না পারার নয়, প্রশ্নটা কবিতা লিখতে দেবার আর না দেবার।” সেই রবীন্দ্রোত্তর যুগে জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, শক্তি চট্টোপাধ্যায় – এনারা আধুনিক কবিতাটাকে যে স্তরে তুলে দিয়েছিলেন, পরবর্তী কালের লেখক সম্প্রদায় সেই মানটাকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। আর বাজারে যা চলবে, তাই আপনাকে লিখতে হবে, নইলে কপালে জুটবে লবডঙ্কা। রবিবাবুর নস্ট্যালজিয়া থেকে জনগণকে বের করে নিয়ে এসে প্রকাশকের দল তাদের সামনে রেখে দিল তথাকথিত আধুনিক কবিতার এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি, আর তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হল, “দেখ শালারা, যা খেতে দিচ্ছি খা, নয়ত আর কিছু পাবি না।” এইভাবে দুটো জেনারেশন কেটে গেল। ফলতঃ কবিতার মধ্যে থেকে সৌন্দর্য্য, সমঞ্জস, এবং সর্বোপরি জাগতিক আবেদন বলে জিনিসগুলোই আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল আর কবিতার নামে রয়ে গেল গদ্যের নীরস কচকচি।কবিতা শুধুমাত্র নিজস্ব মনোভাব গুলোকে একটা আপেক্ষিকতার রাংতায় মুড়ে জনসাধারণের সামনে পেশ করার নিছকই একটা রাস্তা হয়ে গেল। সহজভাবে বলতে গেলে, “আমার লেখা আমি লিখেছি, এবার বোঝার কাজ তোদের।” ব্যাস, সমস্ত সমীকরণ একেবারে ঘেঁটে ঘ হয়ে কবিতার মজা ফ্যাতাড়ুর মত ফৎ-ফৎ করে উড়ে পালিয়ে গেল।


একটা উদাহরণ দিই। ধরুন আপনাকে বলা হল, “পশ্চিমের আকাশে সূর্যাস্ত দেখে আপনার কি মনে হয় ?” এই উত্তরটা “রস” আর “কষ” দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যাক।


রসের উদাহরণ:


তমসবরণ লাজে,

সিন্দুরপ্রভ সাজে,

ঘরে ফেরা ওই পাখিদের গান

বুকের মাঝারে লয়ে,


আসন্ন গোধূলি লগ্ন,

পিলুর রাগেতে মগ্ন,

ধূসর আকাশে মেঘের ভেলা

নীরবে চলেছে বয়ে।


এবারে কষের উদাহরণ:


অনেকটা লাল হয়ে এসেছে আকাশের ওদিকটা।

যেন বিষণ্ণতার বুক চিরে

এক ঝলক রক্ত কেউ ছড়িয়ে দিয়েছে পশ্চিমের গায়ে।

পাখিদের গানটা কি কেউ শুনতে পাচ্ছো ?

ও তো গান নয়, দিনান্তে ব্যর্থতার চিৎকার।

কান পেতে শোনো,

ওই চিৎকারের মাঝেই হয়ত লুকিয়ে আছে কালকের দিনটার আহ্বান।

যেন বিষণ্ণ ব্যর্থতার রক্তের দাগটা মুছিয়ে দিতে পারে

কাল সকালের সিঁদুর খেলা।


এই আপনার সামনে দুটো আইটেম রাখলাম। আজকাল তো আর পাত পেড়ে খাওয়ার যুগ নেই, সকলেই ঠ্যাঙে ভর দিয়ে বুফে-তে লাইন দিয়ে এটা সেটা চেখে দেখতে অভ্যস্ত। ঠিক সেই জন্যই আপনাদেরকেও জোর করে কিছু গেলাতে চাইছি না। দুটোই থাকল, আপনারাই দেখে এবং চেখে বলুন কোনটা আপনাদের উপাদেয় লাগল। কিন্তু কি জানেন, সেই ছোটবেলায় বর্ণপরিচয়ের পাতায় “জল পড়ে, পাতা নড়ে” পড়ে চোখের সামনে বাস্তবিকই একটা ছবি ফুটে উঠত, আর সেই বাস্তবটাও কিন্তু একটা সৌন্দর্য্যময় ভূমিকায় উপস্থাপিত হত, যাতে নীরস গদ্যোচিত কচকচানির প্যাকেট করে সিল মারা গুঁড়ো মিট মশলার অপপ্রয়োগ থাকত না। ফলে তার স্বাদ থাকত অক্ষুণ্ণ।


এই অনেক বকে ফেলেছি। আশাকরি যা বলতে চেয়েছি, আপনারা বুঝে গেছেন। আর না বুঝলে আমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না। এই, এই এখানেই আমাকে পেয়ে যাবেন। আজ পালাই। কয়েকটা আধুনিক কবির মাথা চেবাতে হবে। অনেক কাজ। পরে দেখা হবে।