রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের সাথে বিজ্ঞানমনস্কতার একটা বিরোধ চলে সর্বদাই । যেমন মনস্তত্ত্ববাদ বিষয়টিকে চৈনিক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দশকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, অথবা বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার পরিবর্তন বিষয়টিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকানরা কোনোদিনই গুরুত্ব দেয় নি । ঠিক এই রকমই একটি বিষয় হ'ল "Cybernatics" । মার্ক্সবাদ এবং লেনিনবাদের সাথে সমান্তরাল অবস্থানরহিত হওয়ার কারণে এই বিষয়টিকে "বুর্জোয়াদের অপবিজ্ঞান" আখ্যাপ্রদান করা হয় । ১৯৫০ সালের শুরুর দিকে সোভিয়েত রাশিয়া এই তত্ত্বের তীব্র রাজনৈতিক বিরোধিতা করলেও ১৯৫৪ সালে বৈজ্ঞানিক আনাতোলি কিতোভের হাত ধরে জন্ম হয় এক নতুন লগ্নের, যাকে বলা হয়ে থাকে "Cybernatic Physiology", অথবা "যান্ত্রিক দেহতত্ত্ব"-এর আদিলগ্ন । বহু বিবর্তনের সীমানা অতিক্রম করে সেই তত্ত্ব আজ এসে ঢুকে পড়েছে "Digisexuality"-র যুগে । এই তত্ত্বটিকে তুলনা করা যেতে পারে ফরাসি দার্শনিক মাইকেল ফুকোর "Desubjectivation", অর্থাৎ "বহিরঙ্গের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে যে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা" - এই বিষয়টির সাথে । "scientia sexualis" এবং "ars erotica"-র মধ্যে বিবাদটিকেও ব্যাখ্যা করা যেতে পারে "Digisexuality"-র অন্তর্নিহিত "Desubjectivation" দিয়েই । ব্যাপারটা অনেকটা জর্জ বার্নার্ড শ-এর রচিত পিগম্যালিয়নের মতই, যেখানে সে নিজের সৃষ্টির প্রেমে পড়ে যায়, এবং দেবীর আশীর্বাদে সেই প্রাণহীন মর্মর স্থাপত্যে ঘটে প্রাণসঞ্চার । ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান - সব পেরিয়ে এই বিষয়টির অবতারণা হ'তে শুরু করল ললিতকলার অলিতেগলিতে । স্বভাবতঃই এই পুরো ব্যাপারটার প্রভাব এসে পড়তে থাকে দেশ-বিদেশের সাহিত্য, নাটক, এবং চলচ্চিত্রের মধ্যে । সেইরকম দুটো সিনেমা নিয়েই এই ব্যাপারটা আলোচনা করা যাক ।
প্রথমেই ধরে নেওয়া যাক ১৯৫৮ সালে মুক্তি পাওয়া ঋত্বিক ঘটকের "অযান্ত্রিক" চলচ্চিত্রটিকে । ভারতীয় সিনেমার পর্দায় মানুষ এবং যন্ত্রের এক বড়ই আশ্চর্য এবং চমকপ্রদ সহাবস্থান দেখা গিয়েছিল এই চলচ্চিত্রে । মায়ের মারা যাওয়ার দিনটিতে বিমলের জীবনে আসে জগদ্দল । বিমলের নিঃসঙ্গ জীবনে জগদ্দল হয়ে উঠেছিল একমাত্র সম্বল । তার সাথেই বিমল নিজের জীবনের সমস্ত হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়েছিল, আর জগদ্দলও ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠেছিল বিমলের পরিপূরক । জগদ্দলের গায়ে কাদা ছুঁড়লে বিমল রেগে যায়, তাকে নতুন বৌয়ের মত পাশে নিয়ে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ছবি তোলে, অবসরকালে তার সাথে সুখ-দুঃখের গল্প করে, আর তাকে অবজ্ঞা করলে সে নিজের হেডলাইট দিয়ে বিমলের মাথায় চাঁটি মারে । নিষ্প্রাণের সাথে প্রাণের সঙ্গম - এ যেন মার্ক্সকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সোশালিস্ট রিয়ালিজমের মুক্ত বিহঙ্গের ডাক বিদ্রূপায়িত ক্যাপিটালিজমের আকাশে, যে আকাশে দ্বিপ্রহরের সূর্য্যের মত বিদ্যমান "মর্ডার্ন টাইমস" । এই গল্প তো ফেটিশিজম-এর ইঙ্গিতও দিয়ে যায়, যা ডিজিসেক্সচুয়ালিটি-র এক মূর্ত রূপ । কিন্তু এই ফেটিশিজম-এর অন্যদিকে মার্কসের "Commodity Fetishism" কথাটির প্রতিফলন ফুটে ওঠে, যখন পাগল ভিখারির গামলার উপর দিয়ে ট্রাক বেরিয়ে যায়, আর তার পাশ দিয়ে ধীরগতিতে এগিয়ে চলা ক্লান্ত বিমল - ঠিক যেন নির্দয় ক্যাপিটালিজমের নিচে পদদলিত সোশালিজমের রক্তাক্ত শরীর । মনে পড়ে, "রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে? ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া" । এইভাবেই ওর্সন ওয়েলসের মতই ডিপ ফোকাসে বিমল-জগদ্দলের সম্পর্কের বিভিন্ন দিকগুলি একএক করে ফুটে উঠতে থাকে । কিন্তু জগদ্দলের জীবনকালের শেষ প্রান্তে তাকে ভেঙে ফেলার সময় তার আর্তনাদ, আর তার সাথে বিমলের পিছনে ক্রুশের ছায়া বুঝিয়ে দিতে চায় তাদের প্রেমকাহিনীর উপসংহার । কিন্তু ছোট্ট সেই শিশুর হাতে জগদ্দলের পড়ে থাকা হর্ণ এবং সেই পাগল ভিখারীর এক নতুন গামলার প্রেমে পড়ে যাওয়া - প্রমাণিত হয় ডিজিসেক্সচুয়ালিটির অবিনশ্বরতা, যা ফুকোর কথামতই "Desubjectified" । জীবনের সাথে প্রেমের বৃত্তটির সম্পূর্ণতাপ্রাপ্তিতে কিতোভের "Digisexuality" এবং এডওয়ার্ড টেইলরের "Animism" যেন মিশে যায় এক বিন্দুতে ।
এই "Digisexuality" বিষয়টির অন্যতম দিক হ'ল মৃন্ময় সৃষ্টিকে চিন্ময়রূপে কল্পনা করা । এডওয়ার্ড টেইলরের "Animism" থেকেই ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এই মনস্তাত্ত্বিক দিকটার । ঠিক যেমন এক নাবালক তরুণ নিজের না-দেখা পিতাকে খুঁজে নিতে চেয়েছিল এক যান্ত্রিক দানবের মধ্যে । খুঁজে নিতে চেয়েছিল একটু নিরাপত্তা, একটু শান্তির আশ্রয়, হয়ত একটু ভালবাসা । সিনেমাটি আমাদের খুবই পরিচিত জেমস ক্যামেরন পরিচালিত "Terminator 2" । এক বিপদঘন মুহূর্তে জন কনরের জীবনে আবির্ভাব হয় ভবিষ্যৎ থেকে ফিরে আসা এক রোবটের, যার কাজই ছিল জন এবং তার মা সারাহ কনরকে রক্ষা করা । প্রথমদিকে সেই রোবটকে বিশ্বাস না করলেও জনের কথায় একটু একটু করে সারাহ তাকে বিশ্বাস করতে শুরু করে । জনের সঙ্গে বিবাদকালে সারাহ বলে ওঠে, "It's 'It', not 'Him'" । সারাহর কথায় সুস্পষ্ট মৃন্ময় এবং চিন্ময়রূপের সেই বিরোধ । কিন্তু রাতে সেই রোবটকে অতন্দ্র পাহারায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেই সারাহই মনে মনে বলে ওঠে, "তুমি জনের কোন ক্ষতি হ'তে দেবে না, কখনও বকবে না, কখনও মাতাল অবস্থায় ওর উপরে হাত তুলবে না ।" জন তাকে শেখায় হাসতে, প্রতিজ্ঞা করতে, "Hasta La Vista, Baby" বলতে - ভুলে যায় যে টার্মিনেটর তাদের একজন নয়, ভুলে যায় সে যন্ত্র । আর সেই যান্ত্রিক দানবও জনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নিজেকে বিরত রাখে নরসংহার থেকে, চেষ্টা করে নিজের ধাতব চেহারায় হাসি ফুটিয়ে তোলার । প্রখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ কার্ল জাং-এর "Father Archetype"-এর জ্বলন্ত এক নিদর্শন হয়ে উঠতে থাকে টার্মিনেটর । অন্যদিকে জন এবং সারাহর চরিত্রদুটির বিবর্তন ঘটে চলে বিভিন্ন গলিপথের মাধ্যমে । কখনও শপিং মলের গলিতে আচমকা শেষ হয়ে যায় জনের ছেলেবেলা, কখনও বা মানসিক হাসপাতালের গলিতে সারাহ স্বপ্নে ফিরে পেতে চায় নিজের হারিয়ে যাওয়া মাতৃত্ত্বের মুহূর্তগুলো । এই চরিত্রায়নের মধ্যে দিয়েই অবচেতনে বার বার যেন অজস্র অসঙ্গতির মধ্যেও সঙ্গতি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে যাই আমরা, ঠিক যেন ব্লুমা জায়গার্নিকের "Dissonance Effect" । শেষ মুহূর্তে, টার্মিনেটরের বিদায়লগ্নে জনের কান্না মনে করিয়ে দেয় জর্জ বার্নার্ড শ-এর রচিত পিগম্যালিয়নকেই, কারণ ভবিষ্যতের গর্ভে জনের হাতেই তো তার সৃষ্টি । সারাহর ক্লান্ত হাতে টার্মিনেটরের হাত পরিপূর্ণ করে কার্ল জাং-এর "Family Archetype", যা হয়ত এই গল্পের পরিপ্রেক্ষিতে "Digisexuality"-র হাত ধরে "Desubjectified" করে দেয় সেই যান্ত্রিক দানবকে ।
বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে গেলে দুটি সিনেমার যুগপৎ তির্যক এবং সমান্তরালে অবস্থান । বিমলের চরিত্রটির ক্ষেত্রে শৈশব, যৌবন, এবং বার্ধক্য - তিনটি স্তরই ফুটে ওঠে জগদ্দলের সাথে তার সম্পর্কের মাধ্যমে । অন্যদিকে জন এবং সারাহর চরিত্রের বিবর্তন ঘটে টার্মিনেটরের সংস্পর্শে আসবার পরেই । কিন্তু জগদ্দল তো বিমলের কাছে "Anima Archetype", যা জগদ্দলের অবচেতন মনের প্রতিচ্ছবি, তার আত্মার প্রতীক । টার্মিনেটর তো তা নয় । সে তো "Outlaw Archetype", যার মধ্যে অপরিসীম পাশবিকতা, যে নিয়ম মানে না, যে নিজের কার্যসিদ্ধির জন্য ধ্বংসলীলায় মত্ত হতে পারে । তাই দুজনের সমীকরণ একে অপরের থেকে ভীষণভাবে আলাদা । কিন্তু এই ভিন্নতার মধ্যেও "Digisexuality"-র অন্তর্নিহিত "Desubjectivation" বিষয়টা দুজনকে নিয়ে আসে একই বিন্দুতে । দুজনেই নিঃসঙ্গ দুই মানুষের জীবনে এনে দিয়েছিল আশার আলো । হোক না সে আলো ক্ষণিকের, তাতে ক্ষতি কি ? মৃন্ময়তার গন্ডি পেরিয়ে চিন্ময়তাপ্রাপ্তি ঘটেছিল দুজনেরই । তাই তো বিদায়লগ্নে বিমলের নীরব হাহাকার এবং জনের নীরব অশ্রুর ভাষা বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না । নিছক যন্ত্র হয়েও তারা মানুষের আত্মাকে স্পর্শ করতে পেরেছিল, হতে পেরেছিল তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী । মানবিক যান্ত্রিকতার এই গল্প তো শেষ হওয়ার নয়, এই গল্প চিরন্তন । ছোট্ট সেই শিশুর হাতে অযান্ত্রিক জগদ্দলের হর্ণটা তাই হয়ত বারবার বলতে চাইছিল, "I will be Back" ।
প্রকাশিত: সাত্ত্বিকী ২০২৪ [Link]
(Image Source: https://moviemahal.net/wp-content/uploads/2014/10/ajantrik.jpg)
(Image Source: https://i.ytimg.com/vi/EyQc6fZjaUE/maxresdefault.jpg)