scribbling

অনুপ্রেরণা

কলেজে রোজকার মত আজও দুপুরের দিকটায় লাউঞ্জে এককাপ চা নিয়ে বসে আছি, আর সাথে একটু হালকা আড্ডা-আলোচনা চলছে । কলেজে নতুন ছাত্রদের ভর্তির মরশুম চলছে, আর সেই নিয়েই আমাদের মধ্যে কথাবার্তা চলছে । ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়তে গেলে শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে কর্মক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা থাকাটা কতটা জরুরি, সেই নিয়েই বিতর্ক চলছে । এমন সময় আমার এক সহশিক্ষক আমাকে প্রশ্ন করলেন, "আচ্ছা অভীক, তুমি তো কর্পোরেটে দারুণ ভাবেই জমিয়ে বসেছিলে । হঠাৎ সব ছেড়ে দিলে কেন ?"

"ওই আর কি, ঠিক জমছিল না" - এই বলে প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গেলাম । আসলে কারণগুলো তো অনেক, আর সেগুলো সকলের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে নাও হতে পারে । তাই উত্তরটা না দেওয়াই সমীচীন বলে মনে করলাম । কিন্তু প্রশ্নটা আমাকে একধাক্কায় নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়েছিল খুব সযত্নলালিত অতীতের সামনে, যেটা একান্তভাবে শুধুই আমার ।


প্রথমেই মনে পড়ল ২০১১ সালের কথা, যখন অনেক টাকা মাইনের লোভনীয় কর্পোরেটের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে পাকাপাকিভাবে শিক্ষকতার পথে পা বাড়াই । অনেকেই তখন হেসেছিল, পিছনে পাগল বলেছিল, ব্যঙ্গ করেছিল । কিন্তু কোনটাই গায়ে মাখিনি । কারণ আমার সেই সিদ্ধান্তটা নিতান্তই সাময়িক ছিল না । ছোটবেলায় মেদিনীপুরে থাকার সময় কিছু মানুষের সান্নিধ্যে এসে বুঝেছিলাম জীবনে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সামনে টাকা-পয়সাটা কতখানি নগণ্য । তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন আমার শিক্ষক । সেজন্য ছুটিতে যখনই কলকাতা যেতাম, টুক করে একবার মেদিনীপুরে গিয়ে আমার সেই স্যারদের সাথে একবার দেখা করে আসতাম । ওনাদের সাথে বসে গল্প করতাম, পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম । মাঝে চাকরি ছাড়া, আবার নতুন করে পড়তে ঢোকা, এই সবের মধ্যে বেশ কয়েক বছর মেদিনীপুরে যাওয়া হয়ে ওঠেনি । শেষে ২০১৩ সালে বন্ধুর মেয়ের অন্নপ্রাশনের দৌলতে সেই সুযোগটা হল ।


সকাল ১১টা নাগাদ স্টেশনে নেমেই একটা রিকশা নিয়ে সটান চলে গেলাম আমার ইংরেজি শিক্ষক দেবীপ্রসাদ স্যারের বাড়ি । বাড়ির সামনে নেমে কিছুক্ষণ বাড়িটার দিকে চেয়ে রইলাম । ছোটবেলায় এই বাড়িতেই সরস্বতী পুজোর সময় কত হুল্লোড় করেছি, শয়তানি করার জন্য স্যারের হাতে কত মার খেয়েছি, মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর পরে জেঠিমা (স্যারের স্ত্রী) কত মিষ্টি খাইয়েছেন - সব স্মৃতিগুলো যেন এক লহমায় চোখের সামনে ভেসে উঠল । আমি দরজায় কড়া নাড়তেই জেঠিমা এসে দরজা খুলে দিলেন ।

"ওমা, অভীক এসেছিস ? কতদিন পরে এলি রে ? কেমন আছিস ? দাড়ি কাটিসনি কেন, কেমন ভূতের মত দেখাচ্ছে ?" জেঠিমার প্রশ্নবাণ শেষ হতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, "স্যারকে দেখছি না, উনি কোথায় ?"

প্রশ্নটা করতেই জেঠিমার মুখ একেবারে কালো হয়ে গেল । "তোর স্যার প্রায় ৫-৬ মাস আগে বাথরুমে পড়ে গিয়ে প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছেন । বিছানায় শুয়ে আছেন, উঠতে পারেন না রে । আয় আমার সাথে ।"

কথাগুলো কানে যেতেই আমার আর যেন কিছু ভাবার মত পরিস্থিতি ছিল না । যন্ত্রচালিতের মত জেঠিমার পিছুপিছু গিয়ে হাজির হলাম স্যারের ঘরে । সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ মানুষটি যেন বিছানায় মিশে গিয়েছেন । স্যালাইন চলছে, আরও অনেক যন্ত্রপাতির মাঝে স্যার শুয়ে আছেন । আমি ওনার মাথার পাশে বসে ধীরগলায় ডাকলাম, "স্যার, আমি এসেছি ।" স্যার আলতো করে চোখ খুলে আমাকে দেখার চেষ্টা করলেন । কাঁপাকাঁপা ঠোঁটে কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন, বুঝতে পারছিলাম না । জেঠিমা পাশ থেকে ধরা গলায় বললেন,

"তোর স্যার আর ঠিক করে কথা বলতে পারেন না রে ।"

ভিতর থেকে একটা অসহ্য যন্ত্রণা আমাকে মুচড়ে দিচ্ছিল । আমি নিজেকে একটু শক্ত রেখে স্যারের মাথায় হাত বুলিয়ে একটু হেসে জিজ্ঞেস করলাম, "স্যার, আমায় চিনতে পারছেন ?" উনি আমার দিকে তাকিয়ে একটা নির্বাক হাসি হাসলেন । বুঝলাম, উনি আমায় চিনতে পেরেছেন । অনেক কষ্টে একটা হাত নাড়িয়ে আমায় কাছে ডাকলেন । জিজ্ঞেস করলেন, "কি করছিস ?"

আমি বললাম, "আমি PhD করছি স্যার, ঠিক করেছি পড়াব ।"

আমার এই কথাটা বলার পরে যে জিনিসটা হল, সেটা ভাষায় বিবরণ করা মুশকিল । যে মানুষটা বিছানা থেকে উঠতে পারেন না, তিনি সর্বশক্তি দিয়ে নিজের দু'হাত তুলে আমাকে জড়িয়ে ধরে ভাঙাভাঙা স্বরে বলতে লাগলেন, "টিচার হবি ? তুই টিচার হবি ? হোস বাবা, খুব ভাল টিচার হোস, খুউব ভাল টিচার হোস ।" ওনার সেই মুখের বিস্তৃত হাসিটা কখন যে ওনারই চোখের জলে ভিজে গিয়েছিল, বুঝতে পারিনি । আমি ওনাকে ধরে আস্তে আস্তে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওনার পাশে বসে রইলাম । উনি জেঠিমার দিকে তাকিয়ে সেই ভাঙাভাঙা অস্ফুটস্বরে বলে যাচ্ছিলেন, "শুনছ, অভীক টিচার হবে, অভীক আমার মত টিচার হবে, আমার শান্তি", আর ওনার চোখ দিয়ে ক্রমাগত জল গড়িয়ে পড়ছিল । সেই শেষবারের মতই ওনাকে দেখেছিলাম ।


এই ভালোবাসার কি মূল্য হয় ? কর্পোরেটের মোটা অংকের মাইনে দিয়ে কি এই বিশ্বাসের মূল্যায়ন হয় ? আমি এর উত্তর জানি না । কিন্তু এইটুকু জানি, যে ভালোবাসা আর বিশ্বাস ওনার মত শিক্ষকেরা আমার উপর রেখেছিলেন, সেটাকে ভাঙার মত শক্তি অথবা স্পর্ধা আমার নেই । ওনাদের এই অনুপ্রেরণার উপর ভরসা করেই আজ শিক্ষকতা করছি । জানি, হয়ত ওঁদের মত কোনদিনই হতে পারব না, কিন্তু ওনারা আমার মধ্যে বেঁচে থাকবেন, আমার শিক্ষকতার মধ্যেই বেঁচে থাকবেন ।



প্রকাশিত: সববাংলায় [Link]

(Image Source: https://pbs.twimg.com/media/EhJ2DMtVoAIg2DE.png)