বিকলাঙ্গ শব্দ

(শার্লট || এপ্রিল ২, ২০২০)

১. ভুলভাবে সাজানো চেম্বার


বেশ কিছুক্ষণ ধরে মুরাদ অপেক্ষা করছে, সিরিয়াল শেষই হচ্ছে না। বসে থাকতে থাকতে চারপাশে কোথায় কী আছে – মোটামুটি মুখস্থ হয়ে গেছে। পূর্বদিকটায় একটা জানালা, সুন্দর রোদ আসে। তার ঠিক উল্টোদিকে পশ্চিমপাশে একটা বিশাল ছবি টাঙানো; খ্যাতনামা এক শিল্পীর কোনো শিল্প-টিল্প হবে হয়তো। মুরাদের কোনো দিনই শিল্পের বোধটা আসলো না। নগ্ন পুরুষের পাশে অর্ধনগ্ন নারীর আধ-শোয়া ছবি এঁকে মানবজাতির কী কল্যাণ সাধন হয়েছে – সে বলতে পারে না। কিন্তু আলো-ছায়ার খেলা সে বোঝে। যেমন এই মুহূর্তে ছবিটার রঙ ঠিকমত বোঝা যাচ্ছে না – সূর্যের আলো সরাসরি এসে পড়ছে ছবির ওপর। কীরকম রুচিহীন মানুষ ছবিটাকে এই পাশের দেয়ালে টাঙিয়েছে, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। জায়গার যদি অভাবই থাকে এতোটা, তবে ছবি টাঙানোরই বা কী দরকার ছিলো?

দক্ষিণ পাশটায় আরেকটা জানালা। বাঙালির এই একটা সমস্যা – দক্ষিণ পাশটা খোলা রাখতেই হবে। দক্ষিণের বাতাস না খেলে পেটের ভাত ঠিকমত হজম হয় না কারো। কিন্তু ডাক্তারের রুমটা উত্তর পাশে পড়েছে। সেই বেচারী বাতাস খায় কী করে – সেটাও চিন্তার বিষয়। তবে আজকালকার সব চেম্বারগুলিই সেন্ট্রালি এয়ার কন্ডিশনড। বড়লোক রোগীদের কত প্রকারে আরাম দিয়ে চেম্বারে নিয়ে আসা যায় – সেটা ভাবতে ভাবতে ডাক্তাররা আজকাল রোগীর নাক-কান-গলা দেখে, সাঁড়াশি দিয়ে দাঁত তোলে।

তবে মুরাদ কোনো দাঁতের ডাক্তারের কাছে আসে নি। উনাকে ডাক্তারও বলা যায় না, উনি সাইকোলজিস্ট। বহুকাল আগে খুব প্রিয় একজন মানুষ তাকে সাইকায়াট্রিস্ট আর সাইকোলজিস্টের মধ্যকার পার্থক্য বুঝিয়েছিল। সবটুকু মনে নেই, বয়স বেড়েছে। শুধু মনে আছে সাইকায়াট্রিস্টরা ওষুধ লিখে দিতে পারে, সাইকোলজিস্টরা পারে না। মুরাদের ওষুধের দরকার নেই। ওর বহুবছরের একটা সমস্যা সমাধান করা দরকার। কিন্তু আদৌ কি সমস্যার সমাধান হবে? মুরাদের জানা নেই। সে চিন্তা আপাতত বাদ থাকুক।

বাংলার মানুষ সাইকোলজিস্টদের “ডাক্তার” বলেই সম্বোধন করে। তাই-ই সই। ডাক্তার শব্দটা অপেক্ষাকৃত কম জটিল – জিহ্বায় আরাম লাগে। সে যাই হোক, ডাক্তারদের মতই এই সাইকোলজিস্টের একজন রিসেপশনিস্ট রয়েছে। চেম্বারের রিসেপশনিস্টরা শুধু রোগীদের রিসিভই করে না। এরা একাধারে একাউন্টেন্ট এবং ম্যানেজারও বটে। ডাক্তাররা নিজ হাতে আজকাল টাকা ধরেন না। রিসেপশনিস্টরাই এই কারবার সামলায়। এই রিসেপশনিস্ট কিছুটা দারোয়ানের ভূমিকাও পালন করছে দেখা যাচ্ছে। সিরিয়ালের বাইরে কেউ সাইকোলজিস্ট সাহেবার সাথে দেখা করতে গেলে সে জীবন দিয়ে তাকে ঠেকাবে মনে হচ্ছে। রোগীদের জামা-কাপড়ের অবস্থা বুঝে তার ব্যবহারের ভোল পাল্টে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। দরিদ্র মানুষ সাধারণত সাইকোলজিস্টদের কাছে আসে না। পেটে ভাত নেই, মাথার ব্যারাম নিয়ে ভাবার সময় কই? কিছু উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষ বোধ হয় আজকাল সাইকোলজিক্যাল হেলথ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। তারাই সবচেয়ে নীচুস্তরের রোগী এখানে। রিসেপশনিস্ট মেয়েটা এমন একজনকে বলেই বসলো – “ম্যাডামের রেগুলার রোগীরাই আগে যেতে পারছে না, আপনি কীভাবে যাবেন? বেশি তাড়া থাকলে চলে যান। আমার সময় নষ্ট করবেন না!” তবে মেয়েটির বাজে ব্যবহার খারাপ লাগছে না। সে দেখতে বেশ সুন্দরী। সুন্দরীদের একটু অহঙ্কার থাকেই। তার উপর অভিজাত এলাকার একটা চেম্বারে কাজ করে – একটু দেমাগ থাকাটা একেবারেই অস্বাভাবিক না।

তবে মেয়েটি যে পরিমাণ সুন্দরী, তার কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করার কথা। নাকি বাংলাদেশের মেয়েদের গড় সৌন্দর্য বেড়ে গেছে? কে জানে? মুরাদ দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলো। গত সপ্তাহেই দেশে ফিরেছে। দেশের বাইরে ছিলো – শুনলেই মনে হয় আমেরিকা, ইয়োরোপ বা অস্ট্রেলিয়া কাঁপিয়ে এসেছে। কিন্তু ঘটনা বাস্তবিক এরকম না। মুরাদ নেপালে ছিলো কয়েক বছর, তারপর ইন্দোনেশিয়ায় বাকি সময়টা। প্রায় এগারো বছর পর এসে অনেক কিছুই নতুন মনে হচ্ছে দেশে। এর মাঝে প্রচুর উন্নতির জোয়ার বয়ে গেছে নাকি - শোনা যাচ্ছে সবার কাছ থেকে।

একটা মাছি ঘুরঘুর করছে। বেশিরভাগ সময়ই উড়ছে রিসেপশনিস্ট মেয়েটার টেবিলে রাখা ফুলগুলোর ওপর দিয়ে। ফুলগুলো দেখতে বেশ সুন্দর, কিন্তু মুরাদের জানা নেই ওগুলোর কী নাম। এটাও মুরাদের আরেকটা সমস্যা। গাছ, ফুল, ফল – অনেক কিছুরই নাম দেখা যায় সাধারণত তার অজানা। কী হবে জেনে? দেখতে সুন্দর, গন্ধ বেশ – আর কিছু কি জানাটা আসলেই দরকার? ভেবে পায় নি কখনো সে।

“মিঃ মুরাদ, আপনি এখন ভেতরে যেতে পারেন।” রিসেপশনিস্ট বলে উঠলো।

মুরাদের পেটে অনেকক্ষণ ধরে একটা চাপা অস্বস্তি গুড়গুড় করছিল। এখন পুরোদমে নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো। মুরাদ ফুসফুস ভরে একটা প্রশ্বাস নিয়ে সিট ছেড়ে উঠলো। সিটটা বেশ আরামদায়কই ছিলো, এতক্ষণ টের পায় নি সে। বেয়াদব পশ্চাৎদেশটা এখন অনুনয় করছে, আরেকটু বসে গেলে ভালো হতো না?

পকেট থেকে ছোটো চিরুনিটা বের করে চুল আঁচড়ে নিলো মুরাদ, সঙ্গে দাঁড়িটাও। দেখতে একসময় বেশ সুদর্শন ছিলো সে। সুন্দর মুখখানা এখন দাঁড়ির পিছনে আশ্রয় নিয়েছে। চামড়া পুড়ে খানিকটা তামাটে রঙ ধারণ করেছে। এখানে আসার আগে সে বহুবছরের পুরোনো হালকা বেগুনি রঙের ফুলহাতা শার্টটা বের করে পরে এসেছে। কেমন যেন বোঁটকা গন্ধ বেরুচ্ছে শার্টটা থেকে। তবুও এই শার্ট তার পরতেই হতো। বড় ভালোবাসার শার্ট।

বিশাল নিঃশ্বাস ছেড়ে সে দরজার নব ঘুরালো।

“আসতে পারি, ডক্টর?”


২. একজন মেজাজী সাইকোলজিস্ট


মৌসুমী চশমার ফাঁক দিয়ে তাকালো। তার ভালো নাম শায়লা জামান। সাইকোলজিতে মাস্টার্স শেষ করে পিএইচডিও করে এসেছে। তাই ডক্টর বললে খারাপ লাগে না তার।

“আসুন।” ভালো করে তাকাতে তাকাতে বললো সে।

“ভালো আছেন ডক্টর?”

মৌসুমী চিনতে পেরেছে লোকটাকে। কিন্তু তার পিএইচডির প্রফেসর বলেছিলো, যতই চেনা-পরিচয় থাকুক না কেন, প্রফেশনালি ব্যবহার করতে হবে। রোগীর নয়, রোগের ট্রিটমেন্ট করতে হবে। মৌসুমী ঠিক করলো – সে যথাসম্ভব প্রফেশনাল থাকবে।

“আরে, মুরাদ যে! বসুন, বসুন। অনেকদিন পর দেখা। চা খাবেন?”

“নাহ। অনেকের মতই চা খাওয়ার অভ্যেসটাও বহুদিন ধরে আমাকে ছেড়ে গেছে।” এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বললো মুরাদ।

“তাই নাকি? বলেন কী? যাই হোক। আপনার সম্পর্কে কিছু বলুন। জানতে পারলে আপনার সমস্যা বোঝাটা আমার জন্য সুবিধাজনক হবে।”

“আমার কাছের মানুষজন তো আমার সম্পর্কে সবকিছুই জানে। তারপরও তো তারা আমার সমস্যা বুঝতে পারে না।”

“আপনার কাছের মানুষেরা তো আর সাইকোলজিস্ট নয় নিশ্চয়ই। ভরসা রাখুন আমার ওপর। বলতে পারেন সবকিছু। কোনো গোপন কিছুও যদি হয়, এই রুমের বাইরে যাবে না কোনো কথা, কথা দিচ্ছি। নির্ভয়ে বলতে পারেন।”

মুরাদ হাসলো। অল্প হেসে বললো – “নির্ভয়ে তো বলতে পারবো না ডক্টর। কথা বলা নিয়েই আমার যত ভয়, যত সংশয়।”

মৌসুমীও কিছুটা হাসার চেষ্টা করলো। হাসলে যদি পরিস্থিতি একটু সহজ হয়। সাইকোলজিস্টদের অনেক ট্রিক থাকে। রোগীর মানসিকতার সাথে মিশে যাওয়া, রোগীর কথায় সিম্প্যাথি নয়, এম্প্যাথি দেখানো, রোগীর প্রিয় মানুষ হয়ে যাওয়া - সাইকোলজিস্টদের কিছু সাধারণ ম্যাজিক।

“বেশ তো। তাহলে সভয়েই বলুন। কিন্তু আপনার কথা অন্য কেউ জেনে যাবে, সেই ভয়টা শুধু পাবেন না। মেয়েদের পেটে কথা থাকে না – এটা পুরোপুরি সত্য না। তাছাড়া, আমি কিন্তু শ্রোতা হিসেবেও বেশ ভালো।”

“আপনি একজন সাইকোলজিস্ট। আপনার কথাবার্তা এতো হালকা কেন? রোগীরা কীভাবে আপনাকে মেনে নেয়, বলুন তো?”

মৌসুমীর মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে সে। ছোটোবেলা থেকেই বেশ জেদী আর বদমেজাজী। সাইকোলজি পড়াটা তার একদমই ঠিক হয় নি।

“আচ্ছা, আমার হালকা কথা আপনাকে শুনতে হবে না। আপনি আপনার কথা বলুন, শুনি।” রাগটা একটু সংবরণ করে বললো মৌসুমী। প্রফেশনালিজমটা ধরে রাখা খুব কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে ওর জন্য।

মুরাদ ভালো করে ঘরটা দেখলো। নানান রকম মানুষের মাথার, মস্তিষ্কের ছবি টাঙানো। মৌসুমীর পেছনের দেয়াল জুড়ে একগাদা সার্টিফিকেট বাঁধাই করে ঝুলানো। এই ঘরেও পূর্বপাশে একটা জানালা রয়েছে। তবে এবার ছবিগুলো জানালার পাশে।

“আমার কথা বলবো? কতটুকু বলবো? আমার জন্য আপনার সময় বরাদ্দ রাখা চল্লিশ মিনিট। তার এক সেকেন্ডও তো বেশি আমাকে আপনি দেবেন না, তাই না?”

মৌসুমীর মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাটা, তুই এতোক্ষণ আজেবাজে কথাগুলো না বললে তো চল্লিশ মিনিটই যথেষ্ট ছিলো!

“আপনার যতক্ষণ সময় চাই, আপনি বলুন। আপনার জন্য সময়ের কোনো সীমা নেই। আপনি শুরু করুন।”

মুরাদ আবার বড় করে প্রশ্বাস নিলো। সে প্রস্তুত হচ্ছে কথা বলার জন্য, মৌসুমী বুঝতে পারলো।

৩. বন্যা নামের মেয়েটা


“আমি বড় হয়েছি ঢাকার বাইরে, একটা মফস্বল শহরে। বন্ধুবান্ধব তেমন একটা কখনোই ছিলো না আমার। ছোটোবেলা থেকেই আমি অনেকটা পছন্দবিলাসী। যাকে পছন্দ হয়, তার জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারি। যাকে পছন্দ হয় না, তার সাথে কথাও বলতে যাই না।” মুরাদ একটু থামলো।

“আমাকে তাহলে আপনার পছন্দ হয়েছে?” বিরতি দেখে মৌসুমী বলে বসলো।

“আপনি যে প্রচুর অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় কথা বলেন, আপনি জানেন?” বিরক্ত হয়ে মুরাদ বলেই ফেললো।

মৌসুমী রেগে যাচ্ছে। এই লোকটা কি তার কাউন্সেলিং নিতে এসেছে, নাকি অপমান করতে? তার গালে লাল আভা দেখা গেলো। রেগে গেলে সে একটু লাল হয়ে যায়। অপমানিত হলেও হয়।

“আচ্ছা, দুঃখিত। আমি আর কিছু বলবো না। আপনি বলুন।”

“শুনুন, আপনি পছন্দ-অপছন্দের উর্ধ্বে। আপনাকে আমি ভিজিটর’স ফি দেবো। আপনার সময় আজকে আমি টাকা দিয়ে কিনেছি। আপনি শুনতে না চাইলেও আমি বলবো।”

কথায় কথায় টাকার কথা শোনা মৌসুমীর একদম পছন্দ না। তারপরও সে চুপ করে রইলো।

“আপনার শার্টটা বেশ সুন্দর।” নীরবতার দেয়াল ভাঙতে বলে বসলো মৌসুমী।

“জ্বী, ধন্যবাদ। শার্টটা আমার স্ত্রী আমাকে দিয়েছিলো আমাদের প্রথম অ্যানিভার্সারিতে।” নির্বিকারভাবে বললো মুরাদ।

মৌসুমীর এবার একটু অস্বস্তি লাগলো। “ওহহ!” টেবিলে রাখা পেপার ওয়েটটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বললো সে।

“যাক গে, যেটা বলছিলাম: আমি ছোটোবেলা থেকেই প্রচুর বই পড়তাম। শরৎ, মানিক, বিভূতিভূষণ, রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, তারপর জহির রায়হান, ওয়ালিউল্লাহ, হুমায়ুন আহমেদ – সবার বই পড়েছি আমি, জানেন? মার্কসবাদ, লেনিন, মাও সে তুং – সব পড়েছি। প্রচুর গানও শুনতাম। মান্না দে, ভূপেন হাজারিকা, হেমন্ত, কিশোর কুমার, অতুল প্রসাদ -কোনটা শুনি নি! তারপর অঞ্জন, সুমন, নচিকেতা, কিংবা ধরুন লালন, হাসন, রামপ্রসাদ – সব শুনেছি। বিটলস, রোলিং স্টোন, পিংক ফ্লয়েড – কোনোকিছু বাদ দিই নি। খুব বড়লোক কোনো ফ্যামিলিতে জন্ম হয় নি আমার। পাশের বাসার এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে নিতাম সব গানের ক্যাসেট। পাড়ার লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়তাম।”

মুরাদ আবার শ্বাস নিয়ে বলা শুরু করলো।

“খেলাধুলায় হয়তো ভালোই হতাম। কিন্তু ছোটোবেলার সেই খেলার সাথীদের সাথে মতের মিল হতো না। ওদের ফিলোসফি আমার ঠিক পছন্দ হতো না। আপনি হয়তো ভাবছেন, ছোটো ছোটো ছেলেপিলের আবার ফিলোসফি কীসের? থাকে, ছোটো শিশুদেরও ফিলোসফি থাকে। হয়তো কীভাবে কোন্ পরিবেশে বড় হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে ওদের চিন্তা-ভাবনা কেমন হবে। অথবা বাবা-মায়ের মধ্যেকার সম্পর্ক কেমন – তাও বলে দেয় বাচ্চারা কেমন হবে। সে যাই হোক, আমার ওদের পছন্দ হতো না। আমি মিশতাম না। আমার কেবল একজনই বন্ধু ছিলো – সজীব। সেও আমার মতই বই পড়তো। কিন্তু ওদের বাড়িতে গান শোনা নিষেধ ছিলো। ও গান শুনতো না।

তারপর মনে করুন, মফস্বল থেকে যখন ঢাকায় আসলাম প্রথম, সে আরেক ঘটনা। তখন ভার্সিটির অ্যাডমিশন টেস্টের কোচিং মৌসুম। আমি থাকতাম ফার্মগেটের এক মেসে। সেখানে আরো তিনজন ছিলো আমার রুমমেট। শুভ, আল-আমিন, আর তৌহিদ। সবাই ওরা ভর্তি কোচিং করতো। ওদের মধ্যে শুভ ছেলেটাকে আমার পছন্দ হতো কেবল। বাকিরা কেমন যেন ছিলো। সবাই একসাথেই টাকা দিয়ে বাজার করতাম, কাজের বুয়া খালা এসে রান্না করে দিতো। রান্না হলে মাছের মাথাটা কিংবা মুরগির রানের পিসটা আল-আমিন বা তৌহিদ মেরে দিতো। আমার খাবারের প্রতি ফ্যাসিনেশন ছিলো না কোনোদিনই। কিন্তু এই কাড়াকাড়ির ফিলোসফিটাই আমাকে বড় কষ্ট দিতো। ও হ্যাঁ, ততদিনে সজীবের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।

বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। তবে এই শুভ আর আমি – দুই জনই চান্স পেলাম ঢাকা ভার্সিটিতে। আর বাকি দু’জন যেখান থেকে এসেছিলো, সেখানেই চলে গেলো। ধরে নিলাম, সত্যের জয় হলো, আর অসত্যের পরাজয়!”

কথা বলতে বলতে কাশি শুরু হলো মুরাদের। প্রচন্ড কাশি। মৌসুমী পানি এগিয়ে দিলো। চড়ুই পাখির মতন পানি গিলে গলা ভিজিয়ে আবার শুরু করলো মুরাদ।

“কিন্তু আমার সাথে শুভর দূরত্ব শুরু হয়ে গেলো। ও ভর্তি হলো অন্য ডিপার্টমেন্টে, সিট পেলো অন্য হলে। আমি কষ্ট পাই নি। এরকম আমি আগেও দেখেছি। দূরত্বটাকে আমি স্বাভাবিকভাবেই নিই। সন্তান দূরে চলে গেলে বাবা-মাও একসময় দূরে সরে যায়। বন্ধু? সে তো দূরে সরবেই। চোখের আড়াল হলে মনের আড়াল হয় – শুধু বইয়ে পড়ি নি, বাস্তবেও দেখেছি, শিখেছি।

ফাইনান্সে ভর্তি হলাম। ক্লাস শুরু হলো। এক বছর পরে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, আমার বন্ধু আসলে একজনও হয় নি পুরো ব্যাচে। জানেন, থার্ড ইয়ারের একজন আপু ছিলেন, যিনি আমার মতন বই পড়েন, গান শোনেন, জীবন নিয়ে চিন্তা করেন। উনার সাথে আমার সখ্যতা হলো। কিন্তু ব্যাচমেট বলেন আর সিনিয়র – সবাই কথা শোনাতে লাগলো আমাকে। ওই আপুর নাম ছিলো বন্যা। আমি ডিপার্টমেন্টের করিডোর দিয়ে হেঁটে গেলে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে সবাই বলতো – ওই দ্যাখ, বন্যার জামাই যায়। টয়লেটের দেয়ালে আমাকে আর বন্যা আপুকে নিয়ে বাজে বাজে কথা লেখা থাকতো। আমি অনেক ইমোশনাল হয়ে পড়তাম। বন্যা আপু আমাকে বোঝাতেন অনেক। মানুষ অনেক কিছুই বলে। তখনই বলে, যখন নিজেকে ইনফেরিয়র মনে করে। ওই মানুষগুলোর প্রতি সহমর্মিতা থাকতে পারে, কিন্তু ক্রোধ বা ক্ষোভ থাকলে হবে না। বন্যা আপু যখন বোঝাতেন, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতন শুনতাম। কেবল ওই সময়টাতেই বুঝতাম। কিন্তু পরে ঠিকই আবার রাগ উঠতো।

একদিন ফোর্থ ইয়ারের বড় ভাইয়েরা তাদের রুমে ডাকলো। একই হলে থাকতাম আমি। বুঝলাম, অবস্থা ভালো না। ভয়ে ভয়ে গেলাম তাদের রুমে। বন্যা আপুকে একটা ছেলে পছন্দ করতো। সে একটু নেতা গোছের ছিলো। ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করতো সে। আমাকে সে আর তার বন্ধুরা মিলে মনের সুখে অনেকক্ষণ পেটালো। ক্লান্ত হয়ে গেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার পেটালো। কোমরের বেল্ট খুলে পেটালো, মশারি খাটানোর লোহার রড বাঁকিয়ে ফেললো। আমি মেঝেতে পড়ে ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলাম। দেখলাম একটা খাটের নিচে ক্রিকেট খেলার দুইটা স্ট্যাম্পও পড়ে আছে। কপাল ভালো, স্ট্যাম্পগুলোর কথা তাদের মনে ছিলো না। আরো মিনিট দশেক পরে আমার জ্ঞান হারালাম, কিছুই মনে নেই তারপর আর।

যতদূর শুনেছি, মৃতপ্রায় অবস্থায় আমার কিছু সহপাঠী আমাকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে দেয়। আমি আটদিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ছিলাম। ভাগ্যক্রমে বাম হাতটা ছাড়া আর কোথাও হাড়-গোড় তেমন একটা ভাঙে নি। বাবা-মা ঢাকায় চলে এসেছিলেন সেবা-শুশ্রূষা করতে। কান্না সামলাতে সামলাতে মা বেশি একটা সেবা করতে পারেন নি যদিও। শরীরে কিছুটা জোর ফিরে এলে হলে চলে যাই আবার। বাবা নিষেধ করলেন, বললেন আলাদা বাসা নিয়ে থাকতে। শুনলাম না। হলে ফিরেই ঘটনাটা জানলাম।

বন্যা আপু মেয়েদের হলের ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিলেন। মানুষের কথা তিনি ঠিকই হজম করতে পারতেন, কিন্তু আমার এই দুরবস্থা উনি মেনে নিতে পারেন নি। আমি তখন জ্ঞানহীন, হাসপাতালের বিছানায়। ঘটনা শুনে আমি নিশ্চুপ ছিলাম, কোনো কথা বলি নি। চোখ থেকে পানি পড়ে নি এক ফোঁটাও, ভ্রূ কুঁচকে যায় নি একবিন্দুও। নির্লিপ্ত থেকে বন্যা আপুকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়েছিলাম আমি।”

মুরাদ চুপ হয়ে গেলো। কী যেন চিন্তা করছে সে। মৌসুমীর মনে হলো, মুরাদ নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। মুরাদকে ফিরিয়ে আনতে সে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা, বন্যাকে কি আপনি ভালোবেসেছিলেন?” মুরাদ শক্ত হয়ে গেলো।

“আপনাকে অবিবেচকের মতন কথা বলতে নিষেধ করেছি না? বন্যা আপুকে আমি ভালোবাসতাম, এখনো বাসি। তবে আপনাদের সমাজে প্রচলিত ভালোবাসার যেই সংজ্ঞা, তা দিয়ে আমার এই ভালোবাসাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। তাকে আমি প্রেমিকার মতন ভালোবাসি নি, বড় বোন ভেবেও ভালোবাসি নি। বেসেছি আমার মতন একজন মানুষ ভেবে, যে প্রকৃতি নিয়ে চিন্তা করে, জীবন নিয়ে চিন্তা করে, ভাষা নিয়ে চিন্তা করে।”

মৌসুমী আবারো অপমানিত বোধ করতে শুরু করলো, কিন্তু কিছু বললো না।

৪. অব্যক্ত অনুভূতি


মুরাদ বলতে লাগলো।

“আপনাকে একটা সিক্রেট বলি, হ্যাঁ? কী মনে হয় আপনার? এই যে আমার কোনো বন্ধু নেই, তার কারণ কী? আপনি কি ভাবেন, যে আমি কখনো চাই নি আমার কোনো বন্ধু হোক? কিংবা আমি এগিয়ে যাই নি কখনো বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে? গিয়েছি। আমার অনুভূতি বোঝাতে চেয়েছি। দুঃখ পেয়ে চলে এসেছি। ছেলে বা মেয়ে – বন্ধু হিসেবে যে কেউই হতে পারতো। প্রেম করতে চাই নি। বন্ধু্ত্ব চেয়েছি। কিন্তু পাই নি। পাই নি কারণ কেউ আমার কথা বোঝে নি। আমি আমার কথা কাউকে বোঝাতে পারি নি। ছোটোবেলায় ফুটবল খেলতে গিয়ে এক ছেলের পায়ে ব্যথা দিই আমি, পায়ে সম্ভবত এখনো কোনো একটা ত্রুটি বয়ে বেড়াচ্ছে সে। ওকে বা ওর বাবা-মাকে আমি কখনোই বোঝাতে পারি নি, যে আমি ইচ্ছে করে মারি নি। বাংলা ভাষায় আমি বেশ পারদর্শী। কিন্তু আমি এমন কোনো শব্দ খুঁজে পাই নি, যা দ্বারা বোঝানো যাবে যে, আমার অনিচ্ছাকৃত অপরাধটির জন্য আমার বুকে যে পরিমাণ ব্যাথা জমেছে, তা আপনাদের ছেলের পায়ের ব্যাথার থেকেও অনেক তীব্র।”

“কিন্তু এটা তো ভাষার সমস্যা না। আপনি মাত্রই তো আমাকে বলে বোঝাতে পারলেন আপনার অনুতপ্ততা কোন্ পর্যায়ে ছিলো। সমস্যা বাবা-মায়ের, সন্তানের ক্ষতি যে করেছে, তাকে তাঁরা কখনো মাফ করতে পারবেন না – এটা স্বাভাবিক

“কিন্তু, আপনি কি বুঝতে পেরেছেন, আমার অনুতপ্ততাটা আসলে সত্য নাকি মিথ্যা? আপনি কি বুঝতে পারছেন আমি বানিয়ে বলছি, নাকি সত্যি বলছি? এটা নিয়েই বন্যা আপুর সাথে আমার ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা হতো। ভাষা যে আসলে বিকলাঙ্গ, তার কি আরো প্রমাণ লাগবে?

বন্যা আপু মারা যাবার দেড় বছর পর নতুন একটা ব্যাচ আসে ভার্সিটিতে। ওই ব্যাচে নিশা নামে একটা মেয়ে ছিলো। মেয়েটা ছিল অসম্ভব রূপবতী। এমন রূপবতী মেয়ের সাথে আমাকে মানায় না, জানি। মেয়েটা যখন কথা বলতো, মনে হতো একসঙ্গে শ’খানেক প্রজাপতি ডানা ঝাপটে উড়ছে। মেয়েটার খিলখিল হাসি শুনলে মনে হতো জলপ্রপাতের অবিরাম ধারা ধুয়ে দিচ্ছে আমাকে। সে অনেক হাসি-খুশি, ভার্সিটির সবাই তাকে পছন্দ করে। সে নাচে-গানে-আবৃত্তি-অভিনয় সবকিছুতে চ্যাম্পিয়ন। খুবই জনপ্রিয় – থাকে না এরকম স্টুডেন্ট সব ভার্সিটিতেই? আর আমি ছিলাম চুপচাপ, বিশাল সমুদ্রসৈকতের এক কোণায় পড়ে থাকা অবহেলিত এক নুড়ি। আমাকে চোখে পড়বার কোনো কারণই ছিলো না।

নিশাকে পাবো না কখনো, সে সত্যটা আমি প্রথম থেকেই জানতাম। কিন্তু ওকে দু’চোখ ভরে দেখার অধিকার তো কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। আমি ওর পিছে পিছে হাঁটতাম। ক্যান্টিনের এক কোণায় বসে বসে ওকে দেখতাম। কালচারাল প্রোগ্রামে সামনের সারিতে বসে ওর গান শুনতাম, নাচ দেখতাম। নিশা বুদ্ধিমতী মেয়ে। ও ঠিকই মাস ছয়েক পরে খেয়াল করে, আমি ওকে ফলো করি। ও নিজে থেকেই একদিন আমার সাথে কথা বলতে আসে। আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, জানেন? ওই যে, বলে না, মেরুদন্ড বেয়ে একটা শিরশিরে ভাব নেমে যায়? ঠিক ওরকম। পুরো জড়সড় হয়ে বসে ছিলা, নিশা এসে খুব স্মার্টলি বললো, “ভাইয়া, আমি দেখেছি, আপনি আমাকে ফলো করেন। আর করবেন না। আমার এগুলো একদম ভালো লাগে না। আর আপনার সাথে আমার কিছু হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আপনি হ্যাংলার মত সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে, আমি দেখেছি। আপনার চাহনির মধ্যে শোভন কোনো ব্যাপার নেই। কেমন যেন একটা খাই খাই ভাব। একটা সভ্য ঘরের ছেলে আর যাই হোক, এভাবে তাকিয়ে থাকে না। আশা করি, বুঝতে পেরেছেন।”

আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু নিশা বোঝে নি। আমি খুব চেয়েছিলাম ওকে বলি, দেখো নিশা, মানুষ একজন আরেকজনের কথাই ঠিকমত বুঝতে পারে না। আর তুমি চাহনি দেখে বুঝে নিলে আমি মানুষ কেমন? আমার প্রেম সত্য, আমার উদ্দেশ্য সৎ। কিন্তু আমি কীভাবে বোঝাতাম? আমি যে সিনেমার সংলাপ আওড়াচ্ছি না, মন থেকে বলছি – এটা কোন্ ভাষার কোন‌্ শব্দ ব্যবহার করলে প্রকাশ করা যাবে, বলুন তো ডক্টর?” হঠাৎ মনে হলো মুরাদের, ওর দম ফুরিয়ে গেছে। বিকট আওয়াজ করে আবার কাশি শুরু হলো। কাশির প্রকোপ একটু কমে আসার পর সামনে রাখা পানির গ্লাস থেকে এক চুমুক পানি খেলো মুরাদ।



৫. শব্দের পঙ্গুত্ব


মৌসুমীর মনে হলো, ও কিছুটা বুঝতে পারছে মুরাদের সমস্যা। এটাকে সাইকোলজির ভাষায় অ্যালেক্সিথিমিয়া (Alexithymia) বলে। এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের অনুভূতি সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না।

“দেখুন মিঃ মুরাদ, আপনি যে সমস্যায় আছেন, এই সমস্যায় বিশ্বের বহু মানুষ আক্রান্ত। এর সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা আছে, ট্রিটমেন্ট মেথডও আছে। আপনি চাইলে আমরা সেসব নিয়ে আলোচনা করতে পারি।”

“আপনি মনে করছেন, এটা আমার সমস্যা। আপনার কাছে একবারের জন্যও মনে হলো না সমস্যাটা আমার নয়, সমস্যাটা ভাষার, সমস্যাটা শব্দের?”

“তা কেন হবে? বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ রোজ তাদের মনের ভাব প্রকাশ করছে কোনো না কোনো ভাষায়। যদি শব্দের দ্বারা পুরো অনুভূতি প্রকাশ না করা যায়, তার সাপ্লিমেন্ট হিসেবে আমাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ তো থাকেই। আপনার হাত নাড়ানো, চোখের ইশারা, বসার কিংবা দাঁড়ানোর ভঙ্গি – এ সবকিছু বলে দেয় আপনি কতটুকু সিরিয়াস, কিংবা অনেস্ট। আপনি যে সমস্যার কথা বলছেন, এরকম তো কোনো সমস্যা আসে নি আগে কখনো। যদি আসতোই, তাহলে ভাষাবিদরা নিশ্চয়ই বসে থাকতো না।”

“একটা সমস্যা কখনো সামনে আসে নি তার মানে তো এই না যে সমস্যাটা পৃথিবীতে বিরাজ করে না, তাই না? আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজের কথা বলছেন? আমি যদি পাকা অভিনেতা হই, তাহলে কি আপনি বুঝবেন, আমি সত্য বলছি, না মিথ্যা? কিংবা আপনি যদি ধরেই নেন আমি অভিনয় করছি, তাহলে আমার বডি ল্যাঙ্গুয়েজের কোনো তাৎপর্য থাকলো কি? আপনাকে আরো একটা ঘটনা বলি।

নিশার ব্যাপারটার পর আমি বুঝে নিলাম, প্রেমে পড়া বারণ। আমি অনার্স শেষ করলাম। বড়সড় একটা টেলেকম কোম্পানিতে চাকরি নিলাম। খুব অল্প সময়েই আমার একধাপ প্রোমোশন হয়ে গেলো। বাবা-মা বিয়ে ঠিক করিয়ে দিলেন। বিয়ে করলাম। মেয়েটা খুব সুন্দরী, অনেক শিক্ষিত, ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট এক কথায়। যখন বিয়ে হয়, তখন মাস্টার্স করছে সে। সমস্যা একটাই, ওর মেজাজটা ছিলো একটু খিটখিটে।

বিয়ের প্রথম দুই বছরটা ছিলো আমার জীবনের সেরা সময়। মেয়েটা আমার কথা শুনতে চাইতো, বুঝতোও মনে হয়। বলতে গেলে, জীবনে প্রথম ভালোবাসতে শিখলাম ওর কাছ থেকেই। ওকে ছাড়া কখনো জীবন কাটাতে হবে, ভাবতেও পারতাম না। কিন্তু সমস্যা হলো, সমস্যার সাথে আমার বন্ধুত্ব। আর সবার মত সমস্যা কখনো আমাকে ছেড়ে যায় নি!

আমি অফিসে অনেক সময় কাটাতাম। কাজে ডুবে থাকতাম। কলিগরা নিচে নামতো চা-সিগারেট খেতে, আমি নামতাম না। পাঁচ বছর চাকরি করে আমি তিনটা প্রমোশন পাই, এর মধ্যে দু’টোই ছিলো আমার বিয়ের পরে। আমার উপরের মহলের কর্তারা খুবই খুশি ছিলো আমার কাজে-কর্মে।

খুশি ছিলো না কেবল আমার স্ত্রী। তার কাছে শুধুই মনে হতো, আমি তাকে সময় দিতাম না। তার কোনো আবেগের মূল্য নেই আমার কাছে। তার কোনো সুখের অস্তিত্ব নেই সংসারে। এমন সব অভিযোগে বিষাক্ত হয়ে উঠেছিলো আমার জীবন। প্রচুর জ্ঞান আমার, অনেক কিছুই জানি। কিন্তু কোনো যুক্তিতেই বোঝাতে পারতাম না ওকে, যে ওর ধারণা অমূলক, ওর যুক্তিগুলো ভিত্তিহীন। একদিন কোনো এক মহিলা কলিগের গাড়িতে করে আমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিলে সেটা নিয়ে শুরু হয় ঝগড়া। কেন আমি রাত করে বাড়ি ফিরছি মহিলা কলিগটির সাথে মেলামেশা করে? সেই সাথে জড়ো হলো পুরোনো দিনের যত অভিযোগ। সেই ঝগড়ার আজ অবধি কোনো মীমাংসা হয় নি।

আমি কোনো ভাবেই ওকে বোঝাতে পারলাম না, আমি অফিসে যা পরিশ্রম দিই, আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই দিই। ওকে আমি কম সময় দিচ্ছি ভবিষ্যতের সময়টাকে রঙিন করার জন্যে। অফিসের শত ব্যস্ততার মাঝেও এক ফাঁকে মানিব্যাগে রাখা ওর ছবিটা আমি দেখি, দেখে প্রাণ ফিরে পাই। আমার যা কিছু সম্বল, সবই হারাবার, হারাবার নয় শুধু সে।”

গলা ধরে এলো মুরাদের। একটু থেমে আবার বলা শুরু করলো, “আমি পারি নি ওকে বোঝাতে সেদিন। আমার যে অনুভূতি, সেটা আমি অনেক চেষ্টা করেছি ব্যক্ত করার। আমি অনেক হাতড়েও খুঁজে পাই নি যে শব্দটাকে আমার দরকার। আমি ওকে কতটা ভালোবাসি, বোঝাতে পারি নি। ওর ভুল বোঝার কারণে আমি কতটা কষ্ট পাচ্ছি, বোঝাতে পারি নি। আমার হৃদয় কাঁচের মতন ভেঙেচুরে যাচ্ছিলো, বোঝাতে পারি নি। আমার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে নি ঠিকই। কিন্তু আমার মনের ভেতর রক্তের নদী বয়ে যাচ্ছিলো – সে কথা আমি ভাষায় কী করে বোঝাবো? কথা বলতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু আটকে যাচ্ছিলো আল-জিহ্বায় এসে। আমি অসহায়ের মতন তাকিয়ে তাকিয়ে কেবল ওর কথাগুলো শুনছিলাম। আসলে শুনছিলাম কি? ও চিৎকার করছিলো, কিন্তু আমার পৃথিবী ততক্ষণে ঘোলা হয়ে গিয়েছিলো। আমি কিছু দেখতে পারছিলাম না, কিছু শুনতে পারছিলাম না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলাম। আমি অসহায়, আমার অনুভূতিগুলো অসহায় – কারণ আমার ভাষা অসহায়, আমার শব্দগুলো বিকলাঙ্গ। আমি ধ্বংস করে দিতে চাচ্ছিলাম আমার চারপাশটাকে, কিন্তু আমি অথর্ব হয়ে পড়ে থাকলাম – চলৎশক্তিরহিত এক অসহায় স্বামী।”

মৌসুমীর চোখ ছলছল করে উঠলো। “এখন যেভাবে বলছেন, কথাগুলো এভাবে বললে হয়তো সে বুঝতে পারতো।”

“আপনার কি মনে হয়, আমি চেষ্টা করি নি? আপনি সাইকোলজিস্ট হয়ে যদি না বোঝেন, তাহলে সাধারণ মানুষ কীভাবে বুঝবে? বারবার আমি আপনার কাছে আমাদের সংসার ভিক্ষা চেয়েছি, দিয়েছেন আপনি?”

মৌসুমী এ ভয়টাই পাচ্ছিলো শুরু থেকে। মুরাদ তাদের বিয়ে নিয়ে কথা তুলবে, ক্ষমা চাইবার চেষ্টা করবে, কিংবা মৌসুমীকেই দোষী প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন এগুলো আলোচনা করবার কোনো মানেই হয় না।

মুরাদ বলতে লাগলো, “আপনি আমাদের বাসা ছেড়ে বেরিয়ে আসলেন। আমি আপনার বাবা-মাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। তাঁরাও বুঝতে চাইলো না। আপনার সাথে কোনোরকম কথা বলার আমি সুযোগ পেলাম না। উল্টো আপনি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিলেন। লেটারটা পেয়ে বজ্রাহতের মতন দাঁড়িয়ে ছিলাম বহুক্ষণ। সাইন না করেই দেশ ত্যাগ করলাম। বহু জায়গা ঘুরে দেখলাম, জানেন? বহু পাহাড়, নদী, সমুদ্র। বিশাল জলাশয়ের টলটলে স্ফটিকের মত দেখতে জলে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আর ভাবতাম, সমস্যা কি আমারই? আমিই কি উন্মাদ? মনে শান্তি নিয়ে আসার প্রচুর চেষ্টা করলাম। অনেক জ্ঞানী-গুণীকে আমার এ সমস্যার কথা বললাম, ভাষার সীমবদ্ধতার কথা জানালাম। কেউ কোনো সদু্ত্তর দিতে পারলো না। সৃষ্টির সেরা জীবের যোগাযোগের মাধ্যমই যদি এতোটা ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাহলে অন্য জীবের কী অবস্থা, ভাবুন তো একবার! তবে শুনেছি, কয়েকটা প্রজাতির ঈল মাছ নাকি ইলেক্ট্রিকাল সিগনাল দিয়ে কমিউনিকেট করে।”

জ্ঞানের কচকচানি ভালো লাগছে না আর। “তা দেশে ফিরলেন কী মনে করে?” মুরাদের দৃষ্টিকে আড়াল করে চোখ মুছে জিজ্ঞেস করলো মৌসুমী, “ভালোই তো ছিলেন বিদেশের মাটিতে। সুন্দর পরিবেশে খুব ভালোভাবে বাঁচতে শুরু করেছিলেন।”

“বেঁচে থাকাই যদি জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়, তাহলে মানুষ হয়ে জন্মাতাম না। তেলাপোকা হয়ে পৃথিবীতে আসতাম। মানুষ হয়ে যেহেতু জন্মেছিই, আমার কথাগুলো বলতেই হবে তোমাকে। ভুল কিছু ধারণা নিয়ে তুমি জীবন পার করবে, সে হতে পারে না। আর আমার না বোঝানো কথাগুলো ফাঁসির দড়ির মতন আমার গলা চেপে ধরে রাখবে – তাও হতে পারে না।

আমার ফুসফুসের মেয়াদকাল পার হয়ে গেছে, মৌসুমী। কতদিন সাপোর্ট দেবে, জানি না।” – একটু থেমে মুরাদ বললো, “আমি ক্ষমা চাইতে আসি নি। তোমার কোনো দোষ ছিলো না আমাদের ভুল বোঝাবুঝিতে। আমি শুধু বলতে এসেছি, দোষ আমারও ছিলো না। দোষ ভাষার। আমাদের পূর্বপুরুষেরা অনেক কষ্ট করে ভাষার নিয়ম-কানুন, ব্যাকরণ ঠিক করেছে। কিন্তু এই ভাষা পঙ্গু। এই শব্দগুলো পঙ্গু। এরা পারে না অনুভূতি প্রকাশ করতে। এরা শুধু বিশৃঙ্খলা তৈরি করে, এরা কোনো শান্তি আনে না। যদি সত্যিই মনের ভাব প্রকাশ করতে হয়, লাগবে ইলেক্ট্রিক সিগনাল। মনে করো, তোমার হাতে হাত রেখে তোমার ইলেক্ট্রিক পালস আমার দেহে প্রবেশ করবে, আর আমি বুঝে যাবো, তুমি কী চিন্তা করছো, কী বলতে চাইছো।”

“তুমি না, আপনি করে বলুন।” মৌসুমী আবেগ সামলে প্রফেশনাল হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেই যাচ্ছে।

“ও হ্যাঁ। আপনি! বুঝতে পেরেছেন, আমি কী বলতে চাইছি?”

“বুঝতে পেরেছি। আপনার কী হয়েছে? ফুসফুস নিয়ে কী যেন বলছিলেন?”

“সে আপনার না জানলেও চলবে। বলুন, আমার সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারলেন?”

“না। আপনার সমস্যার সমাধান করতে পারবে সায়েন্স ফিকশন রাইটাররা, আমি না।”

“ঠিক আছে। আমার বলা শেষ। আমি চলি।”

মৌসুমী একটু অন্যদিকে ফিরে জানালার দিকে মুখ করে বললো, “কোথায় থাকছেন?”

“সেটাও আপনার না জানলে চলবে। ভালো থাকবেন।”

মুরাদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। দরজার দিকে পা বাড়াতেই মৌসুমী জিজ্ঞেস করে উঠলো, “শুধু এতোটুকুই বলতে এসেছিলে?”

মুরাদ আবার ঘুরে দাঁড়ালো। মৌসুমীকে আপাদমস্তক দেখলো, প্রাণভরে দেখলো। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে একবার মৌসুমীকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো ওর, শেষবারের মতন জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়েছিলো। কিন্তু একথাগুলো সে বোঝাবে কেমন করে? কোন্ শব্দে একই সাথে বোঝানো যাবে ওর ভালোবাসা আর অভিমান? ওর জীবনের মতন শব্দগুলোও সব অসহায়। ভাষা যেখানে ব্যর্থ অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে, মুরাদের পক্ষে কীইবা করার থাকে আর? ইলিয়াডের একটা অংশ মনে পড়লো - “Any moment might be our last. Everything is more beautiful because we all are helpless. You will never be lovelier than you are now. We will never be here again.”

মুরাদ এসব কিছুই বললো না। কিংবা বলতে পারলো না। বিকলাঙ্গ শব্দ দিয়ে এসব বলা সম্ভব না।

মৃদু হেসে শুধু বললো, “চলি তাহলে।”

|| নটে গাছটি মুড়োলো ||


[Published in Ekush Kothon (Newsletter of Ekush BSO, UNCC), Vol. 1, No. 1, May 2020]