Declaration No. 440
Dated 4th December, 1985.
ভাষার জন্মের পর থেকে অনেক লোকের অনেক কথা অনেক ভাবে বলা হয়েছে―বলা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও অনেক লোকের অনেক কথা তার নিজের ভাবে আজও বলা হয়নি, বলা হচ্ছে না। একটু আধটু যা বলা হচ্ছে তা অনেকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়নি, পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না। তেমনি কথা বলবার জন্য অদল-বদল, তেমনি কথা শোন-বার জন্য অদল-বদল, তেমনি কথার বাহক এই অদল-বদল।
টনি হ্যারিসন
মহাশ্বেতা দেবী (কোলকাতা)
নিলীনা আব্রাহাম (কোচিন)
কে, টি, সরকার (মাদ্রাজ)
মালা মিত্র
প্রতিনিধি―
এন, বালা
১০৪, দরিয়াগঞ্জ (দিল্লী)
প্রদীপ বিশ্বাস (শ্রীনগর)
অদল-বদল কাৰ্য্যালয়
এ-ই ৫১৩ সল্টলেক সিটি
কলিকাতা-৭০০০৬৪
ফোন: ৩৭-০১৪৮ | দাম-তিন টাকা
মহাশ্বেতা দেবী
তপশীলী, আদিবাসী ও এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ ১
বীরেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়
লৌকিক উৎসব বাংলার সামাজিক ঐক্যের প্রাণ-প্রতিম ৭
মণীন্দ্রনাথ বিশ্বাস
চাষী ও পাটচাষ ২৭
কুমারী চুনী কোটাল
আত্মকথা ১২
আশরাফ, সিদ্দিকী
(১) একবার ধ্যানে বসে ১৮
(২) তোমাকে বদলানো ১৮
গৌর পাল
আমার কোলকাতা ১৯
টনি হ্যারিসন
লঙ্ ডিসট্যান্স ২০
বিমল বিশ্বাস
দূরত্ব অসীম ২১
দেবদুলাল মিস্বী
আমার বাবা ২২
হৃষীকেশ দাস
অবশেষে প্রয়োজন ২২
অমলেন্দু বিশ্বাস
একটি লড়াকু যুবকের গল্প ২৩
সি, রাধাকৃষ্ণন
সময় হল ২৪
শ্রীনিষাদ
বেওফা ৩২
প্রচ্ছদ―পূর্ণেন্দু পত্রী
এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবুও পত্র-পত্রিকার জন্ম (এবং মৃত্যুও) এমনই বেশী যে নতুন পত্রিকা প্রকাশের জন্য কৈফিয়ৎ দেওয়া যেমন অবান্তর তেমনি অপরিহার্য্য।
যত মত তত পত্রিকা বা চিন্তাক্ষেত্রে "রেজিমেন্টেশান” প্রতিরোধের জন্যই পত্র পত্রিকার সংখ্যা প্রাণপণে বাড়াতে হবে এ কৈফিয়ৎ আমাদের নয়। কারণ নিছক সংখ্যা সংস্কৃতির গুণগত মান বাড়ায়-এমন ধারণা আমরা পোষণ করি না।
এ প্রসঙ্গে আমাদের বলবার এই যে।―
যেমন আমাদের অর্থনৈতিক জীবন তেমনি আমাদের চিন্তার জগতও কেমন যেন সুপরিকল্পিত রূপে রঙ-বেরঙের রাঙতা মোড়া খেলনার মোহে আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কর্মে চিন্তায় ভাবনায় এগিয়ে নিয়ে যাবার মত সার্থক সৃষ্টির বদলে আজকের অনেক অনেক লেখা আমাদের চেতনায় এক অনুস্থ সংস্কৃতিহীনতা সঞ্চারিত করে দিচ্ছে। এমনকি অনেক ক্ষুদ্র পত্র-পত্রিকার লেখকরাও এর প্রভাবমুক্ত হতে পারছেন না।
যে দু-একটি ক্ষুদ্র সাময়িক পত্রিকা তাদের বন্ধ মুষ্টি তুলে নতুন সৃষ্টির আকাশকে স্পর্শ করার চেষ্টা করছেন বিকৃতরুচি বাজার-সাহিত্যের উত্তাল প্লাবনে তাদের শিশু-বৃষ্টি অলক্ষে তলিয়ে যাচ্ছে।
এই পশ্চাৎভূমি সম্পর্কে আমরা সচেতন। আমরা চাই―
এই ক্ষুদ্র সাহিত্য-পত্রে বলিষ্ঠ সমাজ চেতনা রূপ পাক।
যে শোষিত ঘৃণিতদের সমাজই শুধু নয় তথাকথিত মহৎ চিরন্তন সাহিত্যও অস্পৃশ্য করে রেখেছে, এই পত্রিকায় তাদের লেখা গৌরব নিয়ে স্থান পাক।
এই দুদিনের মাঝেও যারা সাহিত্য সৃষ্টি মাধ্যমে জীবনকে অর্থবহ করার চেষ্টা করছেন এই পত্রিকা তাদের মঞ্চ হয়ে উঠুক।
এই পত্রিকার পাতায় চাষী, বৈজ্ঞানিক, মজুর, দার্শনিক, ছাত্র, শিক্ষক ও আরও অনেকের লেখায় ভরে উঠুক।
সারা পৃথিবীর বঙ্গভাষাভাষী মানুষের শুভকামনা ও সহযোগিতা আমাদের শক্তি দিক।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায় কবি বেনজামিন মোলয়েজকে ফাঁসী দেওয়া হল বিচারের প্রহসন সেরে। কারণ বর্ণ-বিদ্বেষ অথবা বর্ণ-বিদ্বেষের প্রতিবাদ।-স্বাধীনতা-লিপ্স, মোলয়েজ বর্ণ-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে কবিতা লিখতেন। সম্ভবতঃ সে কবিতার শক্তি ছিল অসির চাইতেও বেশী-তাই একজন কালো রঙের পুলিষকে মারবার অজুহাতে কবি মোলয়েজের প্রাণ নিয়ে নেয়া হল।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতাদের সাথে ভারতীয় নেতা ও বুদ্ধিজীবিরাও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ধিক্কার দিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার "অ্যাপারথেড'য়ে বিশ্বাসী সাদা চামড়ার সরকারকে। ক্ষুদ্রাকার জীবনী লেখা হল। প্রবন্ধ লেখা হল, কবিরা কবিতা রচনা করলেন। পত্র-পত্রিকার সম্পাদকীয় স্তম্ভ ভরে গেল।
দক্ষিণ বিহারের পিপারিয়ায় শিশু নর-নারী মিলিয়ে এক ভজন মানুষকে হত্যা করা হল। যাদের হত্যা করা হল তারা লেখক ছিল না, কবি ছিল না, স্বাধীনতার অর্থও তারা বুঝতো না। ছিল নিরক্ষর, দরিদ্র, মুক। স্বাধীন দেশে জীবনের জন্য তারা সরকারের দিকে চেয়ে থাকতো। সাংবাদিক সংবাদ পাঠালেন, সংবাদপত্রে সে সংবাদ পরিবেশিত হল। পাঠকেরা বুঝলেন ও শিহরিত হলেন। কিন্তু হত্যা-কারীদের ধিক্কার দিয়ে একটা প্রবন্ধ লেখা হল না, একটা কবিতা রচিত হল না, একটা সম্পাদকীয় স্তম্ভ লেখা হল না। কারণ কিন্তু ছিল একই-সেই বর্ণ-বিদ্বেষ।
মানুষের মনে একই রকম ঘটনার দুই রকমের প্রতি-ক্রিয়ার কারণ সম্ভবতঃ এই, যে বিদেশের বর্ণ-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো, ধিক্কার দেওয়া যত সহজ ও মহত্ত্ব-প্রকাশক, নিজের দেশে তেমনি প্রতিবাদ জানানো, ধিক্কার দেওয়া তত সহজ ও মহত্ত্বপ্রকাশক নয়।
রাজনৈতিকদের কথা বাদই দিলাম ওরা হাওয়া দেখে পাল তোলে; দেশের কোন্ দৃপ্ত বুদ্ধিজীবিকে নিয়ে আমরা বড়াই করবো!
বিমলা হরির বয়স ছিল চব্বিশ। সে কাঁচড়াপাড়ার এক গরিব হরিজন মেয়ে। ডেঙাপাড়া মেথর কলোনির বাসিন্দা। কল্যাণী কর্ম বিনিয়োগ কেন্দ্রে ও ১৯৭৯ সালে নাম লেখায়। আজ আর তার ডাক আসার জন্য বসে থাকার দরকার নাই। বিমলার সমস্যা ও নিজেই সমাধান করেছে আত্মহত্যা করে। ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডেঙাপাড়ায় গিয়েছিলাম তরুণ, সাহসী সমাজসেবী হরিজন তরুণ রাজেন্দ্র বাশফোরের নির্মম হত্যার পর। তখন বিমলাকে কি দেখেছিলাম? মনে করতে পারি না। কাঁচড়াপাড়ার হরিজন বসতিগুলিতে চুলুর ঠেক বসিয়ে যে মস্তানরা দাপটে রাজত্ব করছিল, "চোলাই কারবার বন্ধ করো" বলে, রাজেন্দ্র তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় দুঃসাহসে। হরিজন কল্যাণ সমিতি অনেক কিছুর জন্য লড়ছে, চোলাই কারবার তার অন্যতম। ডেঙাপাড়ার হরিজন প্রাথমিক স্কুল ভেঙে পড়ছে, পথ বলতে কিছু নেই, কাঁচা নর্দমাগুলো ভয়ানক অস্বাস্থ্যকর, দারিদ্র্য আর সরকারী ও পৌর ঔদা-সিন্যের নগ্ন ছবি চারদিকে। অথচ কাঁচড়াপাড়ায় হাজার হাজার হরিজন থাকে। তাদের বসতি হয় রেলের জমিতে, নয় পৌরসভাধীন এলাকায়। ওরা নিজেদের জীবন বদলাতে চায়, সত্যিই চায়। কিন্তু অন্যেরা তো চায় যে ওরা ওই ভাবে পচে মরুক। বিমলা হরিও বাঁচতে চেয়েছিল। চার বছর ও অপেক্ষাও করেছিল। এক্সচেঞ্জে ওর ডাক এল না। কখনোই আসে না।
আমার হাতের সামনে যে তালিকা, তাতে কল্যাণী, বারাকপুর ও নৈহাটি এক্সচেঞ্জের নাম লেখানো পঁয়তাল্লিশ জন হরিজনের নাম আছে। অনেকে ১৯৭৮-এ নাম লিখিয়ে-ছেন, আজও সাড়া পাননি।
পুরুলিয়া হল যেমন গরিব, তেমন পিছিয়ে থাকা জেলা। পশ্চিমরঙ্গের সবচেয়ে অবহেলিত জেলা। জেলার মধ্যে বান্দোয়ান ও. মানবাজার-২ আবার তার মধ্যেও অবহেলিত দুই ব্লক। ওখানেই থাকে হতভাগ্য খেড়িয়া, বিরহড়, পাহাড়ীয়া, সাঁওতালরা। ওই দুটি ব্লকে আজও কোনো পাকা রাস্তা নেই যাতে সদরে যাওয়া চলে। মানবাজার-২তে তো কোথাও যেতে হলেই মাইল মাইল পায়ে হাঁটতে হয়। স্বাধীনতার পঁয়ত্রিশ বছরেও পুরুলিয়া নগ্ন ঔদাসিন্যে অব-হেলিত। যে সব জায়গার নাম করলাম, ওগুলি প্রধানতঃ আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা। সাঁওতালরা অবশ্যই ওদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগামী এবং ওদের মধ্যে শিক্ষার হারও তুলনায় বেশি। ওদের মধ্যে সমাজ ও রাজনীতি চেতনাও বেশি। চুরকু গ্রামে থাকেন স্বাধীনতাসংগ্রামী বৃদ্ধ কানুরাম শবর। উনি একটা বৃত্তি পান বটে, কিন্তু এই খেড়িয়াশবর বৃদ্ধের ছেলেরা পুরুলিয়া এক্সচেঞ্জের বান্দোয়ান শাখা থেকে কোনো ডাক পায়নি।
বান্দোয়ান এক্সচেঞ্জে নাম লেখানো পঞ্চান্ন জনের তালিকা দেখছি। কয়েকজন গ্রাজুয়েটও। সাঁওতাল জীবন চন্দ্র মুরস্ ১৯৭০ সালে নাম লেখায়। ১৯৭৫ থেকে লেখানো অনেক নামও আছে। সাঁওতাল গ্রাজুয়েট হতে পারে, এক্সচেঞ্জে নাম লেখাতে পারে, তবু কাজের সুযোগ সে পায় না। নাম লেখানো ছেলেমেয়েদের গ্রামে প্রাথমিক স্কুল খোলা হয়, শিক্ষক নেয়া হয়, শিক্ষাপ্রাপ্ত আদিবাসী কিন্তু বেকারই থেকে যায়। তারপর বহু বছর ব্যর্থ প্রতীক্ষার পর ওরা শিক্ষাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলার তুলনায় মেদিনীপুর অনেক বেশি রাজনীতিক ঘূর্ণাবর্তর মধ্য দিয়ে গেছে। দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুরে অনেক আদিবাসী। এখানে আছেন সাঁওতাল, মুণ্ডা, ভূমিজ, লোধা, হো, মাহালী, কোড়া, বাইগা ও অন্যরা। দারিদ্রের কারণে গরিবরা ভাতকাপড়ের বিনি-ময়ে শিশুদের গরুবাগালী কাজে পাঠান। বর্তমান রাজ্য সরকার গ্রামে গ্রামে প্রাথমিক স্কুল খুলেছেন বটে, তবে জন-সংখ্যা অনুপাতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা খুবই কম। তা সত্ত্বেও যখন কোনো গরিব ছেলে বা মেয়ে বৃত্তি পরীক্ষা দেয়, তাতে পরিবারকে অনেকটা স্বার্থত্যাগ করতে হয়। কেননা ওই 'ছেলেমেয়েদের রোজগার থাকে না শিক্ষাকালে। যখন লোধা জাতির' গান্ধী মল্লিক ডালকাটি গ্রাম থেকে, বা কৃষ্ণ-প্রসাদ ভক্তা চাকুয়া গ্রাম থেকে অষ্টম বা নবম শ্রেণী অবধি পড়ে, ঝাড়গ্রাম এক্সচেঞ্জে নাম লেখায়, ততদিনে তারা চাকরি পাবার বয়সে পৌঁছেছে। ওদের মতো আর যারা আছে, সকলেরি মনে হয় যে পড়ার জন্য পারিবারিক দায়দায়িত্ব অনেক অবহেলা করা হয়েছে, এখন কাজ পাওয়া দরকার। গান্ধীর নাম ১৯৭৬ থেকে এবং কৃষ্ণপ্রসাদের নাম ১৯৭৮ থেকে লেখানো আছে।
ঝাড়গ্রাম, বেলদা, মেদিনীপুর ও খড়গপুর এক্সচেঞ্জে লেখানো ১৭৭ জন শিক্ষাপ্রাপ্ত কুর্মী, সাঁওতাল, মুণ্ডা, লোধা ও মাহালি ছেলের নাম আমার সামনে। মাহালিরা সংখ্যায় খুবই কম। ১৯৭৫ থেকে লেখানো অন্তত একশোটি নাম দেখছি। তার মধ্যে ছয়জন মাহালি হতভাগ্যের নামও আছে।
মুর্শিদাবাদের পরমেশ্বর মারান্ডি সাঁওতাল। এই উৎ-সাহী সমাজকর্মী যুবকটি বহরমপুরের কৃষি আয়কর আপিসে কর্মী এবং স্বীয় সংগঠনের মাধ্যমে নানা কাজ করে। মুর্শিদাবাদ জেলা হিসেবেই অত্যন্ত উপেক্ষিত, অতি অনুন্নত। পর্যটন স্থান হিসেবে এর যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল, সে বিষয়ে চূড়ান্ত অবহেলা। বিখ্যাত হাজারদুয়ারী প্রাসাদের যথো-পযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ, উপযুক্ত কর্মী নিয়োগ, অন্তত সেখানে পৌঁছবার পথঘাটের ব্যবস্থা, এজন্য জেলাবাসী আজও অপেক্ষা করে বসে আছে। সাঁওতালরা কবে কেমন করে মুর্শিদাবাদে এল, তা জানবার জন্যই পরমেশ্বর প্রথমে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। জেলার বেশ কিছু সাঁওতাল দীর্ঘ-কাল ধরেই ক্রীশ্চান। তাদের মধ্যে শিক্ষার হারও যথেষ্ট উন্নত। 'ভাবলে অবাক লাগে, দুঃখও হয়, আজও আমাদের সমাজে অনেকে আদিবাসী মানেই সাঁওতাল বলেন। কত শুনেছি যে বীরসা মুণ্ডা সাঁওতাল বিদ্রোহ করেছিলেন। প্রতিবেশীকে আমরা এত কম চিনি কেন?
পরমেশ্বরের পাঠানো এক্সচেঞ্জে নাম লেখানো শিক্ষাপ্রাপ্ত সাঁওতাল ছেলেমেয়েদের একশো নয়টি নামের তালিকা দেখছি, মূর্শিদাবাদের এক্সচেঞ্জগুলি এঁদের কোনদিন ডাকে নি। ধোবাগুড়িয়া গ্রামের সুরেন মুর্মুর নাম ১৯৭৪ সালে লেখানো। বহু ছেলে, বহু মেয়ের নাম ১৯৭৫ থেকে লেখানো আছে।
পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, কাঁচড়াপাড়া, মুর্শিদাবাদ, এ তো সামান্য কয়েকটি মাত্র। বলা চলে বিন্দু পরিমাণ, ওই সব জেলা ও অন্য জেলাতে সিন্ধু পরিমাণ এক্সচেঞ্জে নাম লেখানো আদিবাসী ও তপশীলী নিশ্চয় আছেন।
এই সব নাম যাঁদের, তেমন কয়েক শত জনকে তো আমি চিনি। চিনি বলেই ওদের বেকারত্বের ব্যাপারটা আমার কাছে খুব সত্যি।
স্বীকার করছি যে সারা পশ্চিমবাংলায় বেকারি আজ এক নিদারুণ, ভয়ংকর সমস্যা। যুব সমাজের সামনে এক বিরাট অন্ধকার অনিশ্চয়তা। যাঁরা তপশীলী বা আদিবাসী নন্, তাঁদের সমস্যা নিশ্চয় বিশাল, অপার। একথাও সত্যি যে সংরক্ষিত পদের বিরুদ্ধে অনেক চিঠিপত্র খবরের কাগজে দেখি।
মজা হচ্ছে, "এই সব আসন সংরক্ষিত”, এ ঘোষণা কিন্তু সত্যি সত্যি আদিবাসীর বেকার সমস্যার সমাধানে কোনো সাহায্য বলতে গেলে করছে না। আদিবাসীর শিক্ষালাভের সুযোগটা দেখুন। প্রাথমিক পর্যায়ের পর যে পড়বে, মাধ্য-মিক বা কলেজ তার গ্রাম থেকে অনেক দূরে। আবাসিক ব্যবস্থা এত কম, যে সেজন্যও সে পড়তে পারে না। তারপর সমীক্ষা করলে দেখা যাবে, বাণিজ্যিক বা বিজ্ঞান শাখায় আদিবাসী শিক্ষার্থী খুব কম। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উচ্চতরো শিক্ষা, বা প্রযুক্তি শাখায়, তার কাছে স্বপ্ন। পশ্চিমবঙ্গে কয়জন আদিবাসী বি. এস. সি./এম. এস. সি./বি. কম। এম. কম./ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার/বিজ্ঞানী হয়েছেন? অথবা হাই স্কুলে শিক্ষক/শিক্ষিকা, বা কলেজে অধ্যাপক/অধ্যাপিকা কয়জন?
তাই যে সব চাকরিতে স্নাতক/স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দর-কার, বিশেষ করে স্পেশালাইজড ষ্টাডিতে, সেখানে সংরক্ষিত পদের ঘোষণাটি আদিবাসী ক্ষেত্রে প্রহসনমাত্র। কোন্ আদিবাসী মেরিন বায়োলজিষ্ট, নিউক্লিয়ার ফিজিসিষ্ট বা হেমাটোলজিষ্ট পদে চাকরি পান? ওঁরা তো বাণিজ্যিক পাঠক্রমেও বলতে গেলে পড়েন না, সুযোগই পান না। ইক-নমিক্স, অ্যাকাউন্টেন্সি বা বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়ছেন, এমন আদিবাসী কোথায়?
সাধারণত আদিবাসীর শিক্ষা প্রাথমিক স্কুলেই শেষ হয়। বড় জোর ছয় ক্লাস, নয়তো আট ক্লাস। লোধা বা মাহালি কচিৎ মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক অবধি পৌঁছান। সাঁও-তাল, ওঁরাও, মুণ্ডা বা ভূমিজ হয়তো মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করতে চেষ্টা করেন। যখন পারেন না, সে তো দারিদ্রেরই কারণে। সাঁওতালরা সব চেয়ে অগ্রণী। তাঁরা যদি ব সামান্য কয়জন বি. এ. বা এম এ পড়েন, তাও আর্টসে, বিজ্ঞানে বা অন্য বিষয়ে নয়। তাই যখন চাকুরি যাঁরা দেবেন, সেই সংস্থা আদিবাসী ডাক্তার, ইঞ্জি-নিয়ার, টেকনিশিয়ান, চেয়ে বিজ্ঞাপন দেন, একশোর মধ্যে নিরানব্বই ভাগ ক্ষেত্রে "আদিবাসী যোগ্য প্রার্থী পাওয়া গেল না” বলে বাইরে থেকে লোক নিতে হয়। যে কোনো নির-পেক্ষ সমীক্ষায় প্রমাণ হবে ভালো মাইনের প্রতিযোগিতামূলক চাকরিতে আদিবাসী প্রার্থী বাস্তবে পাওয়া যায় না।
অবশ্যই এমন চাকরিও আছে যাতে আদিবাসী ও তপ-শীলী প্রার্থী পরীক্ষায় বসতে পারেন। ব্যাঙ্ক ও সরকারী অফিসে কেরানীর কাজ যেমন। এ সব চাকরির বিজ্ঞাপন যখন বেরোয়, তখন সুদূর গ্রামে বসে তার খবর পাওয়াও কঠিন, এবং খবর পেলেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কর্ম পূরণ ও দাখিল (সহস্র নিয়ম মেনে) করাও কঠিন। আদিবাসীর জন্যে এখানেও পদ সংরক্ষিত আছে। কিন্তু জেলার এক্সচেঞ্জ সে সব খবর রাখেন না। আমি জেনে খুব অবাক হয়েছি যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আদিবাসী কল্যাণ মন্ত্রকে খোদ রাইটার্স বিল্ডিংয়ে একটি আদিবাসী এম্লয়মেন্ট সেল্ আছে। এই সেল্ কি কাজ করে, আদিবাসীদের চাকরি পেতে কি সাহায্য করে, তা কেউ জানে না।
এই সেলের তো উচিত, প্রথমত রেজিষ্টার্ড আদিবাসী সংগঠনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ করা। আদিবাসীদের বিভিন্ন সংগঠনই বেকার ও এক্সচেঞ্জে নাম লেখানো ছেলেমেয়ের তালিকা জোগাতে সক্ষম। তারপর এই সেলের উচিত, কোথায় আদিবাসীর জন্য চাকরি খালি আছে সে খবর (ক) সংগঠনগুলির কাছে পৌঁছানো, (খ) জেলার এক্স চেঞ্জকে নাম পাঠাতে চাপ দেয়া।
ব্যাঙ্কের রেক্রুটমেন্ট বিভাগে আমি জানতে চেয়েছিলাম, আপনারা আদিবাসীর জঙ্গ যে সংরক্ষিত পদ রাখেন, তাতে আদিবাসী কিভাবে নিয়োগ করেন। তিনি বললেন, যে তাঁকে না কি কয়েকটি আদিবাসী সংগঠনের নাম তালিকা দেয়া আছে, তিনি সেখানে জানান। জানতে চাইলাম, ও ভাবে কোনো আদিবাসীকে কোনোদিন চাকরি পেতে দেখে-ছেন কি না। তিনি মাথা নাড়লেন। কোথা থেকে তাঁর কাছে সংগঠনের তালিকা এপ, সে সব সংগঠনের ঠিকানা কি, আর কোনো কথাই বের করতে পারিনি। সরকারের আদিবাসী এমপ্লয়মেন্ট সেল্ এ বিষয়ে কি বলেন? রাই-টার্সের ওই সেল্ কাদের নিয়ন্ত্রণে? ওই সেলের সাহায্যে রাইটার্স বিল্ডিঙে বা কতজন আদিবাসী কাজ পান, সবই আমরা জানতে ইচ্ছা করি।
জেলার এক্সচেঞ্জগুলিকে তো চাপ দিয়ে জানতে চাওয়া উচিত, যে ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৩ মার্চ, এই এক দশকে ওই সব এক্সচেঞ্জে কতগুলি আদিবাসী সংরক্ষিত পদের খবর ছিল, এবং সঠিক কতজন আদিবাসী চাকরি পেয়েছেন।
এটা কেমন কথা, যে আট-নয়-দশ বছরেও আদিবাসী এক্সচেঞ্জ থেকে ডাক পান না? আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত চাকরিগুলি কারা পাচ্ছেন? যা শোনা যাচ্ছে, তা কি সত্যি?
শোনা যাচ্ছে এবং দেখা যাচ্ছে যে তপশীলী ও আদিবাসীর পক্ষে জাতি পরিচয়পত্র পাওয়া এখন খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ি য়েছে। এবং প্রায়ই শোনা যাচ্ছে যে ঘুষ দিয়ে অন্যেরা তপ শীলী বা আদিবাসী সার্টিফিকেট নিচ্ছেন এবং সংরক্ষিত পদে চাকরি পাচ্ছেন। এক্সচেঞ্জগুলিও এখন চরম দুর্নীতির কেন্দ্র। টাকার লেনদেন না হলে ডাক আসবে না, এ তো জেলায় জেলায় শুনি।
সংরক্ষণ নীতি অতীব উদার। কয়েকটি চাকরির উদা-হরণ দিই। হিন্দুস্থান এয়ারোনটিকস্ লিমিটেড চেয়েছেন মেডিক্যাল অফিসার (সার্জন) এবং সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার। দ্বিতীয় চাকরিটিতে MIG এয়ারক্রাফট-এর ১ থেকে ১০০ -অবধি খুঁটিনাটি জানা আবশ্যিক।
ইফকো চান সিকিউরিটি সুপারভাইজার। যে কোন বিষয়ে স্নাতক চাই, চাই সেনাবিভাগে অন্তত ৫ বছরের অভিজ্ঞতা এবং কোন শিল্প কারখানায় উক্ত যোগ্যতায় কাজ করবার অভিজ্ঞতা থাকলে আরো ভালো।
কেরো স্ক্র্যাপ নিগম চান অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার/জুনিয়র ম্যানেজার/ফিনান্স ও অ্যাকাউন্টস্ একজিকিউটিভ। এর জন্য ভারত সরকারের চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস্ ফার্যের সদস্য তো হতেই হবে, আরো মহাভারত আছে।
এখন দেশ জোড়া লক্ষ লক্ষ বেকার যখন দেখেন যে সব কাজেই কিছু পদ "সংরক্ষিত”, স্বভাবতই চাকরি না পাবার হতাশা থেকে তাঁদের মনে শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে "সংরক্ষিত” ব্যাপারটি বিষয়ে ক্ষোভ জন্মায়, সেটা স্বাভাবিকও।
এ সব কাজ প্রতিযোগিতামুলক। বিজ্ঞাপিত সত্তর ভাগ কাজ তাঁরাই পান, যাঁদের অভিভাবকরা তাঁদের দামী স্কুল-কলেজ স্পেশালাইজড ধারায় পড়িয়ে বর্তমান ক্ষুধিত বর্বর সময়ে ক্ষুরের ফলার উপর দিয়ে দৌড়বার জন্য তৈরী করে দিয়েছেন। এ কথাও খুব সত্য, যে বড় বড় ফল কারখানায় এমন সব চকরিতে যাঁরা ঢুকছেন, তাঁরা প্রায়শ আদিবাসী নন, এবং বিহারের শিল্পাঞ্চলে আদিবাসীকে টাকা থাইয়ে তার উত্তরাধিকারী সেজে সেই শ্রমিক অবসর নিলে তার ছেলে/মেয়ে বা অন্য ন্যাযা উত্তরাধিকারী যে কাজ পেতে পারত, তাতে অনন্ত জাতি কত ঢুকে ঘাচ্ছেন, কেউ তার হিসাব রাখবে না কেননা এই দুষ্টচক্রে বহু বাঘ সিংহ ও ইউ নিয়ন নেতা জড়িত। জামসেদপুর টেলকোতে কত আদি-বাসী নেবার কথা এবং প্রকৃত আদিবাসী কতজন নিযুক্ত আছেন? এ কথা কি সত্যি, (পশ্চিমবঙ্গ হরিজন কল্যাণ সমিতি যা বলছেন), হরিজনদের জন্য যে চতুর্থ শ্রেণীর কাজ, সেই মেথর, ক্লীনার, জমাদার পদে বহু অন্য জাতি ঢুকে বসে আছেন। তাঁরা নালা নর্দমায় বা পায়খানায় ঝাঁটা ধরেন না। সে কাজ সামান্য হরিজনরাই করছে, এঁরা না কি তৃতীয় শ্রেণীতে চলে যাচ্ছেন, যাবেন।
"সংরক্ষিত পদ” দেখে যাঁরা ক্ষুদ্ধ, তাঁরা নিশ্চিন্ত হোন। বেশির ভাগ চাকরি এমন, যে অন্য জাতিকেও ভীষণ ভাবে তৈরী হয়ে পরীক্ষা ও ইন্টারভিউ দিতে হয়, এবং এ কথা কে না জানে যে পিছনে "দাদা" না থাকলে কোনো কাজই মেলা মুশকিল।
আদিবাসীর অস্তিত্ব কি রকম পশ্চিমবঙ্গে? বেঁচে থাকার তেল-শুন-লাকড়ি ফুট ফরাক, এর জন্যই যে প্রতি-যোগিতা, সে ভীষণ রণে হার মেনে তাঁরা নামাল খাটতে যান। তিনি যে স্কুলে পড়েছেন, তাতে তিনি এমন শিক্ষা লাভ করেন নি, যা তাঁকে ও রকম কোনো বড় কাজে প্রাণী হিসেবে তৈরী করে।
সোজা কথা, কি কেন্দ্রীয় সরকারে, কি রাজ্য সরকারে আদিবাসী প্রার্থী এখন অবধি অধিকাংশই চতুর্থ শ্রেণীতে কাজ পাবার উপযুক্ত। আজকাল একটি অভিযোগ সকল জাতি নির্বিশেষে জেলায় জেলায় শোনো যায়, যে স্থানীয় রাজনীতিক ক্ষমতাশালী “দাদাকে খুশি” করতে পারলে তবেই আঞ্চলিক এক্সচেঞ্জ থেকে ডাক আসবে এবং এক্সচেঞ্জ আপিস থেকে কর্মদানকারী সংস্থা অবধি "খুশি করার” ব্যবস্থা খুবই চালু। যদি কোনো আদিবাসী কপাল জোরে ব্যাঙ্ক বা আপিসে চাকরি পেলও, সে চাকরিতে চোকার ও থাকার-জন্যে তাকে পার্টিমদত পুষ্ট ইউনিয়ন দাদাদের "খুশি” রাখতে হবে। এর মধ্যে কি কোনো সত্যতা নেই? কয়েকটি ঘটনার বিষয়ে চিঠি তো আমার হাতেই আছে।
শোনা যায় যে পুরুলিয়া ও মেদিনীপুরের একাংশে ঝাড়-খণ্ডী হাওয়া আছে। এবং এ কথাও সত্যি যে রাজ্য সরকার বড় দরের মস্তান, ঠিকাদার, অসাধু ব্যবসায়ী, কালোবাজারী-তেলের ভীলার, অত্যাচারী পুলিশ, জাল বর্গা রেকর্ড, সব সইতে পারেন, "ঝাড়খণ্ড” নাম সইতে পারেন না। ভালো, খুব ভালো। তবে এ কথাটাও তো ভাবতে হয় যে পুরুলিয়ার বংশীর মতো কোনো শিক্ষাপ্রাপ্ত, নাম লেখানো তপশীলী বা আদিবাসীকে যদি তেরো বছরেও এক্সচেঞ্জ থেকে ডাকা না হয়, তাদের মনে হবে যে তারা ইচ্ছাকৃত নির্মম ঔদাসীন্যের ফলে অবহেলিত হচ্ছে। তখন তারা কেন বিক্ষুব্ধ হবে না? বিক্ষোভের কারণ তো অপসারণ করলেই হয়।
রাজ্য সরকারের নীতি যদি সংখ্যালঘিষ্ঠ আদিবাসীদের প্রতি বিশেষ সংবেদনশীল হয় (যা শোনা যায়), তাহলে চার থেকে আট ক্লাস পড়া লোধা বা খেড়িয়া কেন বনরক্ষী কাজের জন্যেও বিবেচিত হয় না? তারপর বিগত সাত/আট বছরে ঘোষিত আদিবাসী এলাকায় যে হাজার হাজার প্রাধমিক শিক্ষক/শিক্ষিকা নিযুক্ত হয়েছেন, তার বাস্তব চিত্র কেমন? কতগুলি ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন, এক্সচেঞ্জে নাম লেখানো আদিবাসী ওই সব চাকরি পেয়েছেন? বহু অ-আদিবাসীও বলেছেন, "উপযুক্ত আদিবাসী প্রার্থী নেই বলে অন্য জাতি থেকে লোক নেয়া হল' এটি অনেক সময়েই মিথ্যা দ্বারা সত্যকে ঢেকে রাখা।
এ রাজ্যের শিক্ষাপ্রাপ্ত আদিবাসীদের বিষয়ে ঈর্ষা করার কোনো ভিত্তি নেই। যাঁরা জানেন না, তাঁরা মনে করেন যে ওরা হল রাজ্য সরকারের আদরের সন্তান। দুর্গম, দূরবর্তী আদিবাসী এলাকায় কষ্ট করে ঘুরলেই এ ধারণা মুছে যাবে। দেশের অগণিত বেকাররা ক্ষুদ্ধ, আদিবাসীরা চাকরি ক্ষেত্রে সংরক্ষিত পদ পাচ্ছে। বাস্তব ঘটনা হল, তা তো তারা পাচ্ছেই না, বরঞ্চ অনেক ক্ষেত্রে যে কাজ তার যোগ্য, সে কাজের বেলাও সে সংরক্ষিত পদের সুবিধা পাচ্ছে না। লোধা ও মাহালিদের লেখাপড়া শেখা ও এক্সচেঞ্জে নাম লেখানোর অভিজ্ঞতা এমন নৈরাশ্যজনক যে লেখাপড়া ব্যাপারটাতেই ওরা আগ্রহ হারায়। পুরুলিয়ার বান্দোয়ান মহুকুমার যে সাঁওতাল মেয়েরা মাধ্যমিক অবধি পড়েছে, বা পাশ করেছে, তারা পড়েছে উভয় সঙ্কটে। চাকরি পাবার সুবিধে নেই, কোনো কার্যকরী প্রশিক্ষণ মাধ্যমে ওরা স্বয়ম্ভর হবে এমন ব্যবস্থা রাজ্য সরকার করেন নি। এতটা লেখা-পড়া শিখে দিনমজুর হিসেবে খাটতে ওরা যেমন চায় না, তেমনি জমিমালিক ওদের নিয়োগ করতে নারাজ। যারা লেখাপড়া জানে, অরা ন্যায্য মজুরির দাবী তুলতে পারে। স্কুলে শিক্ষাসমাপ্তি আদিবাসীর ক্ষেত্রে একটা প্রতিবন্ধক, তার সহায়তা নয়।
গোমস্তাপ্রসাদ সরেন লিখেছে, "তালিকাটা দেখুন। ওদের সাহায্য করতে চেষ্টা করুন। ওরা অনেকেই পুরুলিয়া থেকে অনেক দূরে জংলা বা পাহাড়ী এলাকায় থাকে। পথঘাট নেই। রেডিও বিরল, ওরা খবরের কাগজও রাখে না। ডাক ব্যবস্থায় চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা, ফলে কাজের চিঠি এলেও তা সময়ে ওদের হাতে পৌঁছয় না। এখন এক্সচেঞ্জ-গুলি দুর্নীতির ডিপো। এদের প্রতি উদাসীন। পরেও ডাক পায় না। এক্সচেঞ্জ এবং রাজনীতিক দলগুলি ওরা এক্সচেয়ে কার্ড রিনিউ করার ওরা কি করবে, কোথায় যাবে?"
গোমস্তার প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আমি শুধু জানি যে আদিবাসী ও তপশীলীদের বেকারির সমস্থা এক ভয়াবহ সমন্ত্রা। কলকাতায় সব চেয়ে বেশি কাজের খবর থাকে। কলকাতার এক্সচোগুলি জেলার এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে আদিবাসী তপশীলী সংরক্ষিত কোটা পূরণের জন্ম তালিকা চাইবে, এমনটিই হওয়া উচিত, তা হয় না। আদিবাসী কলকাতায় বাস করে না, জেলায় বাস করে। সে খবর পায় না। কলকাতায় যে আদিবাসী-স্তপশীলী সংরক্ষিত কোটার বিজ্ঞাপিত হয়, সেগুলি কারা পায়? রাই-টার্সের আদিবাসী কর্মবিনিয়োগ সেল কি সরকারী খরচে রাখা এক দারুস্কৃত জগন্নাথ মাত্র?
জেলায় এক্সচেঞ্জগুলি এদের কোনো সাহায্য করে না। সমগ্র অবস্থাটি আদিবাসী ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষা লাভে কোনো উদ্যম যোগায় না। যে কোনো সরকারের পক্ষেই আদি-বাসীকে খানিক শিক্ষাদান, তারপর তাকে বছরের পর বছর বেকার ফেলে রাখা বিপজ্জনক। এর ফলে প্রথমে মনে জমে হতাশা, হাতাশা থেকে জন্ম নেয় ক্রোধ ফলে ওদের ও সরু কারের মধ্যে যে ব্যবধান, তা বাড়তে থাকে। চার দশক ধরে আদিবাসী স্বার্থ যেভাবে উপেক্ষিত হয়েছে, যে আদিবাসীরা দৃঢ় বিশ্বাস করে, যে রাজা আসবে, রাজা যাবে, কিন্তু তাদের স্বার্থ কিসে রক্ষা হয়, সে কথা কেউ ভেবে দেখবে না।
(ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি/১. ৭. ১৯৮৩ প্রকাশিত। বঙ্গানুবাদঃ লেখক)।
_________
বর্তিকার সৌজন্যে