Post date: Sep 11, 2013 2:59:1 AM
শহীদুল জহিরের নাম আমি শুনি তার মৃত্যুর পর। তার লিখা যে বইটি প্রথম আমার হাতে আসে, সেটি "হচ্ছে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা"।
"উনিশ শ পঁচাশি সনে একদিন লক্ষ্মীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সাথে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট করে ছিড়ে যায়"
উপন্যাসের শুরুটাই বলে দেয় লেখক হিসেবে এই ভদ্রলোকের জাত কতটা আলাদা।
শহিদুল জহিরের লিখার একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, ইনি গল্পের ভেতর কোন আলাদা প্যারা তৈরি করেন না। তার উপন্যাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটিই অনুচ্ছেদ। খুব দীর্ঘ বাক্য দিয়ে প্রতিটা গল্প সাজানো। সন্দেহ নেই, শহীদুল জহির গল্প লিখেছেন শুধু মনোযোগী পাঠকের জন্য, চা আর মুড়ি খেতে খেতে বইপড়া লোকের জন্যে নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, এত কষ্ট করে মানুষ তার লিখা পড়বে কেন? পড়বে, কারণ তিনি গল্পের মধ্যে চমক তৈরি করতে ভালোবাসেন। আসলে চমক শুধু গল্পে নয়, প্রতিটা লাইনের বিন্যাসেই। তার লিখায় ফ্ল্যাশব্যাক, আর অদ্ভুত অপরিচিত উপমার যুগল সহাবস্থান পাঠককে বিস্মিত করবে নিশ্চিতভাবেই।
জহির সাহেব ব্যক্তিজীবনে সরকারি আমলা ছিলেন। গল্পে কি তার কোন প্রভাব পড়েছে? মনে হয় না। তিনি কেমন যেন একটা ঘোরের ভেতর থেকে গল্প বলে যান। একটা একঘেয়ে, একটানা সুর। মনে হয়, গল্পের চরিত্রের কার কি হলো তাতে তার কিচ্ছু এসে যায় না। উনি শুধু ধারাভাষ্য দিচ্ছেন। নিরাবেগ, নিরাসক্ত ভাষ্য। আর সেজন্যই পাঠক ধাক্কা খায়। ঠিক যেই ভঙ্গিমায় শহিদুল জহির আবদুল মজিদের স্যান্ডেল ছেড়ার কথা বলেন, সেই একইরকম শীতলকন্ঠে বলে দেন পাক আর্মির হাতে নিহত আলতাফ হোসেনের লাশের দৃশ্যকল্প--
"আলতাফ হোসেন গুলি খেয়ে পানিতে পড়েছিল, না পানিতে পড়ার পর গুলি খায় -- তা মহল্লার লোকেরা প্রথমে বুঝতে পারে না। ...... তখন তারা আবার সর্বত্র অনুসন্ধান করে আলতাফ হোসেনের মাথার চাঁদিতে চুলের ভেতর সরু ক্ষতটা আবিষ্কার করে, কিন্তু তারা গুলির নির্গমন পথ দেখে না, তারা নিশ্চিত হয় যে গুলিতে আলতাফ হোসেন প্রাণ হারিয়েছে সেই গুলিটিকে তার দেহ বেরুতে দেয় নাই। এতে মৃত আলতাফ হোসেনের কি লাভ হয়েছে সে কথা মহল্লার লোকেরা বলে না, তারা শুধু বলে, গুলি ঢুকছে, কিন্তু বাইরয়া পারেনিকা।"
ঠিক এইজন্যেই গল্পটা পড়তে গিয়ে আমি বারবার অবাক হয়েছি। একটা লোকের বীভৎস মৃত্যু হয়েছে, অথচ লেখক এমনভাবে বলে যাচ্ছেন, যেন লোকটা মরেছে, এটা কোন ব্যাপারই না, বরং ও ব্যাটা মরার পর পাড়ার মানুষ তাকে নিয়ে কিরকম আপাত অর্থহীন সংলাপে লিপ্ত হয়েছে, সেটাই তার গল্পের ফোকাস।
আর লেখকের এইরকম নির্লিপ্তভঙ্গির জন্যই কিনা জানিনা, গল্পের চরিত্রগুলোর উপর আমার কেমন অদ্ভুত একটা মায়া পড়ে যায়।