পাইন গ্যাপ : যেখানে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত
পাইন গ্যাপ : যেখানে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত
রহস্যমণ্ডিত ঘেরা আমাদের গ্যালাক্সি। আচ্ছা বিশাল গ্যালাক্সি এর কথা না হয় বাদই দিলাম। আসুন পৃথিবীর কথাই ধরা যাক। আমাদের এই ছোট্ট গ্রহেই লুকিয়ে আছে হাজারো রহস্য। যেই রহস্য উন্মোচনে এবং তা নিয়ে মানুষ প্রতিনিয়ত হচ্ছে উতলা। তাদের মনে জন্ম নিচ্ছে হাজারো প্রশ্নের। আচ্ছা সেই রহস্যময় জায়গাগুলো যদি হয় মানবসৃষ্ট? তাহলে তা নিয়ে তো জল্পনা কল্পনার শেষই থাকে না। এরিয়া ৫১ এর ভেতরের রহস্য না জানলেও নাম শুনে থাকবেন না তা হয়তো বলা বাহুল্য। যেখানে নির্দিষ্ট কিছু মানুষ ছাড়া প্রবেশ পুরোপুরি নিষিদ্ধ। যে এরিয়ার উপর দিয়ে নিষিদ্ধ বিমান চলাচল। যদি বলি ঠিক তেমনই আরো একটি জায়গা অস্ট্রেলিয়াতে অবস্থিত? আশা করি অবাক হবেন না। হ্যাঁ, আজ আমরা কথা বলবো অস্ট্রেলিয়ার সবথেকে গোপন জায়গা 'পাইন গ্যাপ' (Pine Gap) নিয়ে।
পাইন গ্যাপ অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম শ্রেণীবদ্ধ এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সাইটগুলোর মধ্যে একটি। এটি অস্ট্রেলিয়ার একদম কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত। টেরিটরির উত্তর অঞ্চল অ্যালিস স্প্রিংস শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত।
১৯৬৬ সালে অস্ট্রেলিয়া এবং মার্কিন সরকার অবিস্মরণীয়ভাবে অ্যালিস স্প্রিংসের ঠিক বাইরে প্রতিষ্ঠা করে 'Joint defence space research faculty' বা 'যৌথ প্রতিরক্ষা মহাকাশ গবেষণা অনুষদ'। যা পাইন গ্যাপ নামে পরিচিত। শুনে হয়তো অবাক হতে পারেন যে সম্ভবত পাইন গ্যাপ আমেরিকার বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থা।
শুরুর দিকে শুধুমাত্র রান্না এবং পরিস্কারের কাজের জন্য অস্ট্রেলিয়ান কর্মীদের নিযুক্ত করা হলেও বর্তমানে কয়েকশ অস্ট্রেলিয়ান এবং আমেরিকান কর্মী এই গোপন স্থাপনার সাথে জড়িত আছে বলে জানা যায়।
দ্য ইন্টারসেপ্টের সহযোগিতায় অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের প্রকাশিত একটি তদন্তে প্রথমবারের মতো পাইন গ্যাপের কার্যকারিতা সম্পর্কে বিস্তৃতি বিবরণ প্রদান করে।
বেসটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রাউন্ড স্টেশন যেখান থেকে আমেরিকার গুপ্তচর বা Spy Satellite গুলো পরিচালিত হয় এবং যা বিভিন্ন মহাকাশ ঘুরে যোগাযোগ পর্যবেক্ষণ করে। ইংল্যান্ডের এনএসএ(NSA) মেইনউইথ হিল(Mainwith Hill) এর সাথে একত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুটো মিশন পরিকল্পনা করে। যার প্রথমটির নাম ছিল M7600। যার সাথে যুক্ত ছিল দুইটি আমেরিকান Spy Satellites এবং ২০০৫ সালে এর একটি গোপন নথিতে বলা হয় 'Continuous coverage of the majority of the Eurasian landman and Africa' অর্থাৎ ইউরেশিয় এবং আফ্রিকার বেশ কিছু অংশে এই Spy satellite দ্বারা গোপন অভিযান চালানো হয়। যদিও এই উদ্যোগটি পরবর্তীতে M8300 নামে দ্বিতীয় একটি মিশনে পরিবর্তন করা হয়। যেখানে চারটি স্যাটেলাইট যুক্ত ছিল এবং যা পূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব ইউরোপ এবং আটলান্টিক মহাসাগর অঞ্চলগুলোকে আচ্ছাদন করে রেখেছিল।
উপগ্রহ বা স্যাটেলাইটগুলোকে 'Geosynchronous' নামে অভিহিত করা হয়। যে স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ২০,০০০ মাইলের বেশি উপরে অবস্থান করবে এবং স্থলভাগের ওয়্যারলেস যোগাযোগগুলো পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম এমন সকল যন্ত্রাংশে সজ্জিত। দলিল অনুযায়ী পাইন গ্যাপ বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক যোগাযোগ সংগ্রহ করে। এছাড়া লক্ষ্যবস্তু দেশগুলোর ক্ষেপণাস্ত্র বা অস্ত্র পরীক্ষার তথ্য সংগ্রহ বলে জানা যায়।
পাইন গ্যাপের বাইরের আকাশে ইঙ্গিত করা রয়েছে ৩৮টি রাডার ডিশ (Radar Dish)। এরমধ্যে অনেকগুলো গলফ বলের মতো শেলের ভেতর লুকানো।
২০১৩ সালে এনএসএ-র একটি গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়, 'Plays significant role is supporting both intelligence activities and military operations'। এর মূল কাজগুলোর একটি হলো ভূ-রাজনৈতিক তথ্য সংগ্রহ করা যা বিমান হামলাগুলোকে চিহ্নিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অস্ট্রেলিয়ান বেসের একটি বিশেষ বিভাগ এখানে রয়েছে যা 'জিওপিট' (Geopit) নামে পরিচিত। এটি ভৌগলিক অবস্থান সম্পাদন করার জন্য এর সয়াহক সরঞ্জামে সজ্জিত।
অসামান্য ভাইলোক। আসুন এবার একটু বিভ্রান্তিকর তথ্যের দিকে আসি। যে তথ্যটি দিয়েছেন মেলবর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক রিচার্ড ট্যান্টার(Richard Tanter)। যিনি দীর্ঘদিন ধরে পাইন গ্যাপ নিয়ে পড়াশোনা চালান। তিনি বলেন প্রশান্ত মহাসাগর থেকে আফ্রিকার প্রান্ত পর্যন্ত সারা বিশ্বের ব্যবহৃত লোকের সেলফোনের তথ্য রয়েছে পাইন গ্যাপের কাছে। ভাবুন তো একবার আপনার ফোনের গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য যা শেয়ার করার মতো না সে সকল তথ্য আছে তাদের কাছে!
১৯৬০ দশকের শেষের দিকে নির্মিত এ ঘাঁটি একসময় কেবলমাত্র রাশিয়া, চীন, পাকিস্তান, জাপান, কোরিয়া এবং ভারতের মতো দেশগুলোতে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা এবং অন্যান্য সামরিক সংক্রান্ত তদারকিগুলোতে নজরদারি করতো। এখন তার থেকে আরো বেশি কিছু করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ট্যান্টার। ১৯৮৪ সালে বব হক (Bob Hawke) তাঁর পাইন গ্যাপের উপর সংসদে বিবৃতিতে বলেছিলেন যে এটি কোনও সামরিক ঘাঁটি নয় এবং এটি কোনও অস্ত্র সঞ্চয় বা উত্পাদন করে না। তিনি বলেন -
"সঞ্চালিত কার্যাদিগুলির মধ্যে হল ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ সম্পর্কিত মহাকাশ উপগ্রহগুলির কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি সরবরাহ করা এবং পারমাণবিক বিস্ফোরণের ঘটনা সম্পর্কে তথ্য সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে।"
বব হকের সাথে বিরোধী দলীয় নেতা বিল হেইডেন (Bill Hayden) পাইন গ্যাপের গোপন কক্ষে প্রবেশকারী একমাত্র অস্ট্রেলিয়ান। চিত্রসূত্র: The Sydney Morning Herald
২০১৩ সালে Sydney Morning Herald এ জানানো হয় পাইন গ্যাপ বিতর্কিত মার্কিন ড্রোন হামলার সাথে জড়িত ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এর সহযোগীরা সন্দেহভাজন জঙ্গিদের শনাক্ত এবং শনাক্ত করার পর নিয়মিত তাদের উপর নজর রাখে। ২০১৩ সালে এটি প্রকাশিত হয়েছিল যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে আল-কায়েদা এবং তালেবান নেতাদের বিরুদ্ধে মার্কিন বিতর্কিত ড্রোন হামলায় পাইন গ্যাপ মূল ভূমিকা পালন করেছিল, পূর্বদিকে হ্যান্ড-হোল্ড রেডিও এবং মোবাইল ফোন সহ রেডিও সংকেতগুলোর যথাযথ ভৌগোলিক অবস্থানটি শনাক্ত করেছিল মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে এশিয়া জুড়ে (চীন, উত্তর কোরিয়া এবং রাশিয়া)।
আফগানিস্তানে আল-কায়েদা এবং তালেবান নেতাদের বিরুদ্ধে মার্কিন বিতর্কিত ড্রোন হামলার ধ্বংসচিত্র। চিত্রসূত্র: The Intercept
২০১৬ সালে প্রকাশিত A defense white paper এ বলা হয়েছিল পাইন গ্যাপ অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ও নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি যাচাইকরণে অবদান রাখার সময় সন্ত্রাসবাদ, গণ-ধ্বংসের অস্ত্রের বিস্তার এবং সামরিক ও অস্ত্রের বিকাশের মতো গোয়েন্দা অগ্রাধিকার সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহ করেছিল।
তবে এখানে কিছু রহস্যজনক ঘটনার ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে বলে শুনা যায়। বেশ কিছু বছর ধরে কিছু প্রতিবেদনে পাইন গ্যাপে ভিন্ন গ্রহের দৃশ্যধারনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। দুজন পুলিপ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেকগুলো রেডম (Radome) এর একটিতে এলিয়েনরা আলোকপাত করেছিল বলে ব্যাখ্যা করেন। এগুলো কি আদও সত্য নাকি ভিত্তিহীন মন গড়া কথা তা জানা নেই করোরই ! তবে পাইন গ্যাপে যে
রহস্যমণ্ডিত এবং গোপন স্থান তা বলার বাহুল্য রাখে না। এটুকু নিঃসন্দেহে বলাই যায় যে অস্ট্রেলিয়া কিংবা আমেরিকার সরকার স্বীকার না করলেও পাইন গ্যাপে রয়েছে আরও বিস্তৃত মিশন এবং আরো শক্তিশালী ক্ষমতা।