একটি বাড়ির স্মারক
সুনন্দিনী মুখোপাধ্যায়
■■■■
একটি বাড়ির স্মারক
সুনন্দিনী মুখোপাধ্যায়
■■■■
“Home is where I'd go
Cause home is where you'd be
Home is all I know
Home is all I see”
- Caleb Kanayo
জীবনের প্রতি পর্যায় বাড়ি বলতে আমাদের যে ধারণা তা যেন আরো জটিল হয়ে ওঠে। কখনো সেটা চার দেওয়ালের ঘর, সুখস্মৃতির আস্তানা, আবার অন্য সময় অলীক - বিশেষত যখন সেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। তখন মনের এক কোণে ওকে বেঁধে বয়ে নিয়ে যেতে হয়ে, পুরোনো সুটকেসের মতো। আমার এই সুটকেসেরই দু-চার কথা বলি এখানে।
মা যে স্কুলে চাকরি করত, সেখান থেকেই আমাদের জন্য একটা বাড়ি বরাদ্দ করে দেওয়া হয়েছিল। সেই বাড়িতেই আমার জন্ম। শহরটা বিখ্যাত ছিল তার বনের জন্য। জীবনের ২১টা বছর, এই ছিল আমার সমস্ত পৃথিবী - অবাধ সবুজের মধ্যে বড়ো হয়ে ওঠা। তারপর একদিন সেই ঘর ছেড়ে যাওয়ার দিন এলো। মা চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিল। ওই কোয়ার্টারটা এবার অন্য কারও বাড়ি হবে। তাই আমিও আমার ছেলেবেলাকে যত্ন করে গুছিয়ে রাখলাম মনের গভীর অবচেতনে আর চলে এলাম পিছনে ফিরে না তাকিয়েই ।
আমাদের ছিল একটা সুন্দর সতেজ বাগান। শীত আসতেই বাগানটা নিছক হিমালয়ের ‘ভ্যালি অফ ফলোয়ার্স’কে টক্কর দিতে প্রস্তুত হয়ে উঠত। তখন ইন্টারনেট ছিল না বলেই আমি অতি আনন্দের একটা ছোটবেলা পেয়েছি। এখন যেই ছোট স্ক্রিনের দিকে চেয়ে থাকতে হয়, তার বদলে ছিল রোদে পোড়া দুপুর। শরতে শান্ত পাতা ঝরার শব্দ গুন্ গুন্ করতো বাগানে আর মাঝে মাঝে সেই সুর এসে উঁকি দিতো আমাদের ছোট্ট ঘরে। এখনো কাজের ফাঁকে সেই সুর আমার কানে ভেসে আসে। কিন্তু সবচেয়ে মনে পড়ে ভেজা মাটির গন্ধ; আর সাদা প্লাস্টিকের পাইপ হাতে বাবা ফুলের বাগানে জল দিচ্ছে এই স্বস্তি-দেওয়া দৃশ্য। শীতের বিকেলের পড়ন্ত রোদে গা দিয়ে আমার বন্ধুর সঙ্গে মাদুর পেতে বাগানে বড়দিনের গাছটার পাশে শুয়ে থাকতাম। কি জানি সেই সবুজ, বড় গাছটার পাশে এখন কে শুয়ে থাকে? আদৌ কি আর শুয়ে থাকে কেউ, আমার প্রিয়, প্রিয় গাছটার পাশে? আমরাই লাগিয়েছিলাম ওখানে, এখন সে একা দাঁড়িয়ে।
আমি শিখেছি পোস্ত ফুল লাজুক ভারী; মৌমাছি এসে বসলে তবে ফুটবে খালি, শিখেছি গোলাপ পাপড়ি ভোরে জল রেখে দেয়, শিখেছি লজ্জাবতী লতা সবচেয়ে ধৈর্যশীল। আর শিখেছি যত দূরেই চলে যাই, সবুজ বাগান এখনো ঘুম পাড়িয়ে যায়।
আমি সমস্ত বই পড়ে যা না শিখেছি তার চেয়ে বেশি শিখেছি আমি বাড়ির বাগান থেকে। আমি শিখেছি পোস্ত ফুল লাজুক ভারী; মৌমাছি এসে বসলে তবে ফুটবে খালি, শিখেছি গোলাপ পাপড়ি ভোরে জল রেখে দেয়, শিখেছি লজ্জাবতী লতা সবচেয়ে ধৈর্যশীল। আর শিখেছি যত দূরেই চলে যাই, সবুজ বাগান এখনো ঘুম পাড়িয়ে যায়, আমি শিখেছি একমাত্র যত্ন দিয়েই বড়ো হওয়া যায়, শিখেছি একটা বেকুব সবুজ মাটির টুকরোর স্মৃতি এক ঝাঁক ব্যস্ত মানুষের ভিড়ে একজনকে একেবারে বেমানান করে দেয়। ৮ বছর পেরিয়ে গেছে, তবু বাড়ি নিয়ে আজও যা স্বপ্ন দেখি সবই সেই বেকুব সবুজ মাটির টুকরো ঘিরে।
কিন্তু আকাশ ছাড়া মাটি কী? যখন শরতের নীল আকাশ রাঙিয়ে দিতো আমাদের বাগানটাকে, আমি লাল আকাশ দেখে মুগ্ধ হয়েছি, বোধহয় ওর মধ্যে এক অদ্ভুত চমৎকারের প্রত্যাশা ছিল। আমাদের শহরটা গাছে ঢাকা হলেও ছিল ইন্ডাস্ট্রিয়াল, ডিকেন্সের কোকটাউনের মতো। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম ফ্যাক্টরির দৈনিক ঘন্টার আওয়াজে, জানতাম কখন আকাশে ধোঁয়া ঢালা হবে। ছোটবেলায় আমি বুঝতাম না কী করে দূষণ রাতের আকাশ লাল করে দেয়। তাই, কল্পনা করতাম, এ বোধহয় বৃষ্টির আগাম ঘোষণা। পাখিরা ডাকতো ভোরের বিভ্রমে, কিন্তু আমার জন্য ওরা আমারি সঙ্গী, বৃষ্টির অপেক্ষায়। পরে অনেক সময় আমি ভেবেছি ওই লাল আকাশ হয়তো আমায় সব শিখিয়েছে, শুধু ভালোবাসা ছাড়া। শান্ত আকাশ দেখেও আমি শুধু ঝড়ের প্রত্যাশা করেছি। তবে আমার কোনো অনুশোচনা নেই - কার না ভালো লাগে শুকনো পাতার মধ্যে বয়ে যাবে বৃষ্টির ধারা আর আমার জানলায় পাহাড়ের ছবি এঁকে দেবে। কখনো বেশ বৃষ্টি হতো, হয়তো শুধু ওই ছোট্ট মেয়েটাকে খুশি করতে আর স্বপ্নে আমি বৃষ্টির নাচ করতাম। এখন আর ওরকম বৃষ্টি হয় না, পাখিরাও জাগে না আগের মতো। কিন্তু এখনো আকাশে লাল মেঘ জড়ো হলে, আমি আশা করি কোথায় বুঝি ঝড় উঠছে, যেই ঝড়ের তেজে আমার সব তেষ্টা মিটে যাবে।
এমনই আমার নিজের গান আছে মাটির আর আগুনের, যা সময়ের দূরত্বে ম্লান হয়ে যায় না। এ একরকমের জটিল সম্পর্ক; কিংবা হয়তো জটিল নয় একেবারেই। চলে আসার পর আমি আর ফিরে দেখিনি সেই জায়গা যেখানে আমি জন্মেছিলাম। শহরটাকে শীঘ্রই বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা হবে, নতুন ‘সিভিক ডেভেলপমেন্টের’ নামে। হতে পারে শোক প্রকাশের অভাবে আমি বাড়িটাকে আমার শরীরে, মনে বহন করে যাব, আর কোনো একদিন হয়তো আমি ঘুম থেকে উঠে দেখবো আমি সেই ছোট্ট বাড়িতেই আছি, সেই সবুজ মাঠে, লাল আকাশের নিচে আর সবকিছুর মধ্যে।
Translated from English by Dipanwita Bhattacharyya
■■■■
সুনন্দিনী মুখার্জী পশ্চিম বাংলায় অবস্থিত একজন শিক্ষিকা এবং গবেষনার কাজ করতে আগ্রহী। তাঁর লেখা কবিতা পূর্বে অনলাইন ‘কাফে ডিসেনাস’, ‘কোল্ডনূন: ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ট্রাভেল রাইটিং এন্ড ট্রাভেলিং কাল্চার্স’ এবং ‘ঢাকা ট্রিবিউন’-এ ছাপা হয়েছে। অনুবাদ কাজেও তিনি আগ্রহী এবং ২০২১ সালে বী বুকস থেকে তার কাজ প্রকাশিত হয়। সুনন্দিনী মুখার্জী বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি করেন।