ও মিস, আসব ?
শ্রীরঞ্জনী মজুমদার
■■■■
ও মিস, আসব ?
শ্রীরঞ্জনী মজুমদার
■■■■
আজ যাকে নিয়ে এই লেখাটি লিখছি, সে আমার থেকে মাত্র কয়েক বছরের ছোট। ওই ৩ বা ৪ বছর হবে? আমার জ্ঞান ও বোধ বুদ্ধির যা বয়স, তার-ও তাই। ওর নাম স্মৃতি। অবসরে হোক বা চলতি বাসে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে যখন শহরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে যাই, সে আমায় নানান রকম গল্প বলে, ছবি দেখায়। তবে মজার ব্যাপার হল যে সব ছবি সব গল্প একসময়ে ছিল বাস্তব। এবং সেসব গল্প কোথাও না কোথাও আমারই । আজ সেরকমই একটা গল্প সবাইকে জানাতে ইচ্ছে হল। এই গল্পের কেন্দ্রস্থল আমার "ইস্কুলবাড়ি"। আমি এখন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। দেড় বছর হয়ে গেছে স্কুল থেকে পাশ করে গেছি। সকালে প্রার্থনা, পর পর ক্লাস, তার ফাঁকে গল্প-আড্ডা-দুষ্টুমি, টিফিনের স্বাধীনতা এই সব কিছু দেড় বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। সহপাঠীরাও নিজেদের জীবন গুছিয়ে নিয়েছে। একটু অগোছালো ভাবে আমিও গুছিয়ে নিয়েছি। জীবনের নিয়মে নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করলেও এতদিনে ভালো করেই বুঝে গেছি যে স্কুলের চৌকাঠ আমি পেরোতে পারিনি। মনের মণিকোঠায় আমি এখনো 12A ক্লাসরুমটার পিছনের দিকের একটা বেঞ্চিতে বসে আছি। স্কুলের স্মৃতি নিয়ে তো একটা সপ্তখণ্ডের বই লিখে ফেলতে পারি বলে আমার ধারণা। আমার স্কুল আমার সবচেয়ে প্রিয় বাড়ি এবং সেখানে যাদের সাথে ছিলাম তারাও আমার পরিবার। নিজের বাড়িতে সব মানুষেরই একটা নিজস্ব আস্তানা থাকে, যেখানে সে সবচেয়ে আরামে থাকে । আমার বাড়িতে আমার সবচেয়ে আরামের জায়গা ছিল স্কুলের গানের ঘর বা Music Room। স্কুল জীবনের অর্ধেকের বেশি ওখানেই কেটেছে আমার, ক্লাসে খুব একটা খুঁজে পাওয়া যেতো না আমায়। মিউজিক রুমের বাইরে ছিল একটা ছোট্ট ফাঁকা দালান, তার একদিকে একটা আলমারি সেই আলমারির গায়ে একটা আয়না। সেই আয়না যেখানে স্কুলের ছোট্ট ছোট্ট মুখগুলো কোনো লৌকিকতা ছাড়া কোনো জটিলতা ছাড়াই নিজেদের মতো সেজে নিত ফাঁকতালে। কালো কাঠের আলমারির আয়নায় নিজের মুখটা , চুলটা একবার দেখেই দালানের একপাশে জুতো খুলতাম। সেই জুতোয় আবার কাগজের টুকরোয় নিজের নাম লিখে রাখতাম। পাছে গুলিয়ে যায়? জুতো খুলে হাতে গানের খাতা গুঁজে নীল সবুজ মেশানো চেক চেক পর্দা সরিয়ে উঁকি মেরে আস্তে করে মুখ টা ঢুকিয়ে কান-এঁটো-করা হাসি নিয়ে মিসকে জিজ্ঞেস করতাম, "ও মিস আসব?" হলুদ রঙের টেবিলের ওপর হারমোনিয়াম রাখা, তার পিছনে কাঠের চেয়ারে বসে থাকা আমার সবথেকে পছন্দের মানুষটি। আমার মিউজিক মিস। হালকা রঙের শাড়ি, কপালে বড় গোল টিপ, চোখে চশমা, হাতে রুমাল, চওড়া করে আঁচল গোছানো, চেয়ারের হাতলের উপর ডান হাতের কনুইটা রেখে ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা গালে বা ঠোঁটে দিয়ে মিস কিছু একটা ভাবছিলেন। ব্যাগ, দুখানা ফোন, রেজিষ্টার, স্বরলিপি, গীতবিতান সব পাশের টেবিলে রাখা। আমার ডাকটা শুনে আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়েই মুখে একটা মজার বিরক্তি দেখিয়ে অন্য দিকে তাকাতেন, আর হেসে হেসে বলতেন "ওই এলেন ওস্তাদ।"এক গাল হেসে মিসের সামনে শতরঞ্জিতে ধপাস করে বসে পড়তাম। ব্যাস তারপর শুরু হতো গান আর মিসের থেকে গল্প শোনা। আরও একটা মজার ব্যাপার ছিল, আমি নিজেকে বলতাম ব্ল্যাক স্পট। কারণ একটা অদ্ভুত ব্যাপার হতো, মিসের যদি কিছু পছন্দ না হতো, যেমন অন্য কেউ কোনো সুর হয়তো ভুল গেয়েছে, বা চন্দ্রপ্রকাশ কাকু হল থেকে সিনথেসাইজার মিউজিক রুমে রেখে যায়নি, বা যেকোনো কিছু যেটা মিসের পছন্দ হয়নি, মিস সব ছেড়ে, সবাইকে ছেড়ে শুধু আমার দিকে তাকাতেন। যেন আমিই কিছু একটা গণ্ডগোল পাকিয়েছি, সব আমার দোষ। তাই ঠিক অংকের খাতায় যেমন কালো বিন্দু সবচেয়ে স্পষ্ট হয়, আমিও নিজের নাম দিলাম ব্ল্যাক স্পট।
ওই ঘরটার প্রত্যেকটা জিনিস, প্রত্যেকটা কোণ, সমস্ত কিছু আমার বড্ড প্রিয়। এমনকি অন্যমনস্ক হয়ে শতরঞ্জির যে কটা সুতো আমি ছিঁড়েছি সেইগুলোও আমার প্রিয়। সারাক্ষণ যেন ঐ ঘরটাতে থাকলেই ভালো হয়। কখনও ক্লাস, কখনও রিহার্সাল, কখনও জুনিয়রদের গান তোলানো, কখনও বা এমনিই অফ পিরিয়ডে এসে মিসের সাথে গল্প করা। মিসের থেকে যেমন দরকারে বকাও খেয়েছি, তেমনই রাজ্যের অভিযোগ মিসের কাছে এসেই করেছি। কোথায় কে বকেছে, কেন বকেছে, আমার কিসে খারাপ লেগেছে , দুঃখ হয়েছে মিসকে সব বলা চাই, আর মিসও সবটা শুনতেন এবং সবসময় পাশে দাঁড়াতেন। এখন যে জীবনে আছি সেটা আমার কাছে দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে । এই সময় দাঁড়িয়ে আমি সত্যিই মিসের থেকে আবার বকা খেতে চাই আর মিসকে দুনিয়ার অভিযোগ করতে চাই। স্কুলে পড়াকালীন যখন টিফিনের ব্রেকে রিহার্সাল হতো, মিস নিয়ম করে রোজ জিজ্ঞেস করতেন, "টিফিন খেয়ে এসেছ তো?" কারণ উনি জানতেন যে আমার না খেয়ে থাকার একটা রোগ ছিল। কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যখন পারতাম না, যাতায়াতের অসুবিধার জন্য, মিস যে কতবার মাকে ব্যক্তিগত ভাবে ফোন করেছেন তার ইয়ত্তা নেই, যাতে আমায় স্কুলে নিয়ে আসা হয়। ভানুসিংহের পদাবলীর মহড়ায় একবার আমার জ্বর আসে। মিস তখন আমায় মাটি থেকে তুলে ডেস্কের ওপরে বসিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে ঠাণ্ডা কম লাগে। আবার এটাও মনে আছে যে মিস যখন খুব রেগে যেতেন তখন মিসের কথা আটকে যেত । আমার সব বিপদ থেকে বাঁচার জায়গা ছিল মিউজিক রুম আর বাঁচাবার মানুষ ছিলেন মিস। কিছু কিছু মুহূর্ত কোনোদিনও ভুলব না, ভুলতে চাইও না। যেমন "তোমরা একটু প্র্যাকটিস করো আমি চা খেয়ে আসছি" বলে মিস চলে যেতেন আর আমরা গেছো বাঁদরের দল বেশ ভালো রকম আড্ডার আসর বসাতাম। তারপর যখন হেসে গড়িয়ে উল্টে যাচ্ছি তখন দেখতে পেতাম মিস দরজার কাছে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে, এবং আবার সেই আমার দিকেই তাকিয়ে , "এটা কী গান হচ্ছে শুনি?" কখনও বা আমার হাতে চাবি দিয়ে বলতেন "হয়ে গেলে লাইট অফ করে তালা দিয়ে চাবিটা দিয়ে দিও আমায়"— মানে আমায় যদি আকবরের মোগল খাজানাও কেউ দিতো তাও হয়তো আমি এত খুশি হতাম না যতটা চাবি পেয়ে হতাম। কেমন যেন নিজেকে দায়িত্বশীল মনে হতো। এখন আবার "সারা জীবন দিল আলো সূর্য গ্রহ চাঁদ", "এক সূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন", "বিশ্ববিদ্যাতীর্থপ্রাঙ্গণ" এই গান গুলো বারবার শিখতে ইচ্ছে করে। এখন মিসের ওই গাল ধরে আদর করে দেওয়া, বকুনি দেওয়া, ওই positive support, বাহবা, অনুপ্রেরণা , সবটা বড্ড মনে পড়ে। স্কুল থেকে পাশ করে যাওয়ার পরেও মিসের জন্যই আরেকবার স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার কয়েকটা ছোট্ট বোনকে স্কুলের ইন্টার স্কুল প্রতিযোগিতার জন্য একটু সাহায্য করতে। ২৬/৭/২০২৩...সেই শেষবার গিয়েছিলাম ঐ ঘরটায়... ঝুলিতে একরাশ স্মৃতি ভরে এনেছিলাম। মিস সেদিনও ছাড়েননি এমনি এমনি। ভালোবেসে হাতে টাকা দিয়ে বলেছিলেন "নিজের পছন্দমতো কিছু একটা খাবে। গানটা ছেড়ো না যেন, আর মাঝে মাঝে এসো দেখা করতে"।
এখনও আমি ওই ঘর, দালান, আয়না ছেড়ে বেরোতে পারিনি। এখনও যখন কেউ বকে , কোনোকিছু খুব খারাপ হয় আমার মনে হয় সাদা জামা লাল স্কার্টটা গলিয়ে চলে যাই মিউজিক রুমে। মিসকে গিয়ে সব বলি, উনি সব ঠিক করে দেবেন। যখনই ভেঙে পড়েছি মিস সাহস দিয়েছেন।
স্কুলের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মিস একটা কথা বলেছিলেন আমায়। কেউ যদি তোমার সাথে ইচ্ছে করে অন্যায় করে, এবং সে যদি তোমার থেকে বয়সে বড় হয় তাহলে সে নিজেই তার সম্মানের জায়গাটা নিজেই ধরে রাখতে পারেনি, তাই তুমি যদি প্রতিবাদ করো তাহলে তা কখনোই তাকে অপমান করা হয়না, সেটাকে আত্মসম্মান রক্ষা করা বলে, তাতে কোনো ভুল নেই। সবসময় চুপ করে থাকলে হবে না। মিসের এই কথাটা এখন আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করি।
যাই হোক, যা মনে হচ্ছে আমি এবার সত্যিই একটা বই লিখে ফেলব। শেষে যেটা বলতে চাই সেটা হল যে মিসকে আমি খুব, খুব, খুব ভালবাসি আর অনেকটা শ্রদ্ধা, সম্মান করি। মিউজিক রুমেই মিস একবার আদর করে মিস গুহকে বলেছিলেন “এই ওস্তাদ আমাকে বড্ড জ্বালায় শ্যামলী দি, কী করি বলো তো! এ কি কলেজেও প্রফেসরদের এরকম জ্বালাবে নাকি?" আমি বলেছিলাম "না মিস আমি শুধু আপনাকেই জ্বালাব”। তখন মিস বলেছিলেন “কী জানি? ওসব সবাই বলে, স্কুলের পরে সবাই বদলে যায়, সবাই মিসেদের ভুলে যায়" তখন আমার আরও একজন খুব প্রিয় শিক্ষিকা , মিস শ্যামলী গুহ, আমায় বলেছিলেন " শ্রীরঞ্জনী, শ্রীরঞ্জনী-ই থাকবে, ও বদলাবে না" ... এই কথাটার মান আমি যেন রাখতে পারি আমায় সেটাই আশীর্বাদ করবেন মিস। দেখেছো কাণ্ড! এতকিছু বললাম মিসের নামটা বাদ দিয়ে!? আমার মিউজিক মিসের নাম শ্রীমতি সুতপা সেন।
ব্যাস, কন্ডাক্টর চিৎকার করছে, আমার গন্তব্য এসে গেছে বাস থেকে নামতে হবে। আমার স্মৃতিচারণ এখানেই থামাতে হবে । বাস থেকে নেমে, বিরক্তিসহকারে কলেজে ঢুকে , সেই প্রাণহীন ক্লাসে ঢোকার আগে জিজ্ঞেস করলাম , "Ma’am may I come in?" ... কেউ পাত্তাই দিল না প্রশ্নটাতে... যেন কারুর কিছুই আসে যায় না। আর দিলেও খুব তাচ্ছিল্যের সাথে না তাকিয়ে একবার ঘাড় নেড়ে দেওয়া… সত্যি বলতে আমিও যেন কারুর দিকে তাকিয়ে বা কাউকে উদ্দেশ্য করে একটা উত্তর পাওয়ার আশায় প্রশ্নটা করিইনি .. করতে হয় তাই করেছি.....কিন্তু তাও মুচকি হাসতে হাসতে ক্লাসে ঢুকলাম। হাসছি কেন? হাসছি কারণ কোথাও না কোথাও, অন্তরের কোনো একটা লুকোনো কুলুঙ্গীতে আমি যেন আবার পর্দার ফাঁক থেকে মুখটা ঢুকিয়ে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলাম, "ও মিস আসব?"...
■■■■
শ্রীরঞ্জনী মজুমদার উত্তর হাওড়ার বাসিন্দা, বর্তমানে হেরিটেজ ল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। বিষয়: আইন। অবসর সময়ে গানে সুরে মত্ত থাকতে, গল্প ও কবিতা লিখতে, কখনও বা আঁকতে ও গল্পের বই পড়তে ভালবাসে। যেকোনো পরিস্থিতিতে তার মুখে হাসি ফোটাতে পারে বৃষ্টি ও স্কুলের স্মৃতি। আর পারেন রবীন্দ্রনাথ ।