পিছুটানের ইতিকথা
সাম্য চক্রবর্তী
■■■■
পিছুটানের ইতিকথা
সাম্য চক্রবর্তী
■■■■
বাঙালির রোজকেরে জীবনে ‘পিছুটান’ শব্দটা একটা জায়গা করে নিয়েছে। আজকের দিনে এই শব্দটাই যেন নস্ট্যালজিয়ার মূর্ত রূপ। কিন্তু এই পিছুটানের মধ্যেকার ‘টান’-ও সময় সময় পিছু হঠ্তে বাধ্য হয়, যদি তার মধ্যে ইমোশন, জোড়তাল দিতে দিতে এসে হানা দেয়। তখন তা সাময়িক অস্বস্তি আর দোলাচলের জন্মদাতা। দিনকয়েক আগেই ভূমেন গুহের ‘আলেখ্য:জীবনানন্দ’-এর মুখবন্ধে পড়েছিলাম যে, "বয়েস যখন অনেক বেড়ে যায়, এবং হাতের কাজও ফুরিয়ে আসে, তখন মানুষকে গল্প বলায় পেয়ে বসে। যার জীবনে বলবার মতো গল্প জমে আছে, সে সেই সব গল্প খুব আন্তরিকতার সঙ্গে বলে; যার নেই, সে অন্যের কাছ থেকে ধার করে এনে বলে।" আমার বয়েস অনেক বেড়ে যায়নি বা হাতের কাজও ফুরিয়ে আসেনি, কিন্তু ধার করা গল্প তো বলতেই পারি।
ঘটনা একশ শতাংশ খাঁটি, জল মেশানো নেই। তার মধ্যেকার গন্ধও বর্তমান, কিন্তু কালের স্রোতে তা ‘গল্প’। দাদু-ঠাম্মার সঙ্গে বাবা-মায়ের বাঙাল ভাষায় কথা অনেক পরে এসে একটু-আধটু বুঝতে পারতাম। বেশিরভাগই বাংলাদেশের গল্প। '৭১-এর যুদ্ধ, বাংলাদেশ থেকে লুকিয়ে পালিয়ে আসা, ভিটে মাটি ছাড়ার কষ্ট এইসবই। প্রথমে তো ভাবতাম, '৭১-এর যুদ্ধের সময়ে দাদু-ঠাম্মা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ইন্ডিয়ায় এসেছিল। এই ভুল ধারণা অনেক পরে ভেঙেছে,যখন একটু ক্রোনোলজি ঘাঁটাঘাঁটি করলাম।
দাদু বাংলাদেশে বাজিতপুর শহরের খুব পরিচিত ব্যবসায়ী ছিলেন, সবার চুনীঠাকুর। বাজিতপুরের টাউন এলাকাতেই বিরাট বাড়ি, বাড়ির মধ্যেই মুদির দোকান। দোকানটা একটা ল্যান্ডমার্ক মতন ছিল শুনেছি। '১৯ সালে গিয়ে দেখেও এসেছিলাম, তখন ভাবতাম চুনীঠাকুর বোধহয় নিজের পায়ে কুড়ুলটা না মারলেই পারতেন। এমন বাড়ি কেউ হাতছাড়া করে নইলে!
আর এত ভালো প্রতিবেশী থাকতেও! ঠাম্মার কাছেই যুদ্ধের সময়কার একটা গল্প শুনেছিলাম। রাজাকার বাহিনীর কয়েকজন এসে একবার চুনীঠাকুরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল খানসেনাদের কাছে। সেই দলের প্রধান ছিল মুসা মিঞা। তার আবার দোকানে পাওনা ছিল, কিন্তু তাও চুনীঠাকুর তাকে ফেরাননি। কিন্তু তাদের ওপরে আল্লাহ্-র যে ধর্মবাণী আরোপিত হয়েছিল (বিধর্মী ছাঁটাইয়ের) তাকেও তো ফেলে দেওয়া যায়না। তাই যিনি ধার দিলেন, তাঁর ধার শোধ করা তাঁকে মুক্তি দিয়ে। কিন্তু এখানে পালিত হয় সেই প্রতিবেশী ধর্ম। চুনীঠাকুরের গায়ে হাত উঠেছে শুনে, আল্লাহ্-র বাণীকে তুড়ি মেরে সরিয়ে চুনীঠাকুরকে বাঁচিয়ে ছিলেন আনিস চাচা (আনিসুর রহমান) আর নয়জন মুনিশ। আর শাস্তি হিসেবে মুসা মিঞার এক কানও কেটে দিয়েছিলেন, তারপর থেকে সেই চত্তরে 'কানকাটা মুসা' বলেই নাকি ডাকত সবাই।
আমি গিয়ে ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরলে তারপর একটা বুকফাটা কান্না। এভাবেই যায় মানুষ। মুহূর্তের এক-টুক মাত্র। তার সঙ্গেই চলে যায়, সমস্ত জীবনের সংঘর্ষ, সমস্ত স্মৃতি, অর্জিত-সহজাত সমস্ত বৈশিষ্ট্য, মেধা, বিশ্বাস।
ইন্ডিয়ায় আসার পর প্রথম থেকেই চুনীঠাকুর আর ঠাম্মার শোবার ঘর আলাদা ছিল। ঠাম্মার ঘরের সানসেটগুলোতে অনেকগুলো পুরোনো ট্রাঙ্ক, সব দেশের জিনিসে বোঝাই। একবার ছোটপিসিকে জিজ্ঞেস করায় বলেছিল, একটা ট্রাঙ্কের মধ্যে ঠাম্মার ছেলের স্মৃতি আছে। ঠিক কেমন? ঠাম্মার প্রথম সন্তান, আমার সম্পর্কের বড়োজেঠু, এইট-এ পড়ার সময় পেটে ব্যথায় মারা গিয়েছিলেন। বাবা, পিসির কাছেও শুনেছি, রাতে ঠাম্মার পাশে শুয়েও শুনেছি, একদিন আগেই ঠাম্মার এক মেয়ে, পেটব্যথাতেই মারা গিয়েছিল। পরদিন বড়োজেঠুর বিকেলে খেলা থেকে এসে পেটে যন্ত্রণা। ঠাম্মা হাত-পা ধুইয়ে শুইয়ে দেওয়ার পর, একাধিক ডাক্তার আসলেও, সেই যন্ত্রণা কমাতে পারেনি কেউ। পরদিন ভোরের দিকে মারা গিয়েছিলেন বড়োজেঠু। তার আগে নাকি ঠাম্মাকে বলেছিলেন, "মা, ক্ষমা কোরো, তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না, প্রার্থনা কোরো আবার যেন তোমার কোলেই জন্ম নিই।"
পরপর দুই সন্তান হারানোর ক্ষয়, ক্ষতি, ক্ষত আদৌ পুরোপুরি নিরাময় হয় কিনা, একমাত্র সেই মায়ের কাছেই থাকে এ প্রশ্নের উত্তর। তবে পরে একটা আশ্চর্য ঘটনা জানা গিয়েছিল। বড়োজেঠুর ঠিক আগেই, ঠাম্মার যে মেয়ে মারা গিয়েছিল, তখন ঠাম্মার বোন নাকি শুনেছিলেন, বড়োজেঠু তার ওই বোনকে বলছেন, "চলে গেলি? যা তাহলে, আমিও আসছি।"
হিস্টিরিয়া আক্রান্ত বলে দাগিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। আর কার্য-কারণ সম্পর্ক খোঁজা? বৃথা! প্রথমে স্বামীর ওপর হামলা, তারপরে দুই সন্তানের মৃত্যু (ঠাম্মার কাছে আজও অপমৃত্যু), জমিনের শিকড় নড়বড়ে হতে শুরু করেছিল তখন থেকেই বলতে গেলে। একটা সন্দেহ মতন জন্মেছিল নিজের ভিটে কে নিয়ে, সেই জায়গা আদৌ মঙ্গল কিনা থাকবার জন্য। ইন্ডিয়া আসার পেছনে আসলে ছিল ঠাম্মার জেদ-ই। কিন্তু আবারও, সেটাকে জেদ বলা যায় কিনা তাও নিজের মধ্যে একটা প্রশ্ন!
নোয়া পিসির কাছে আমি শুনেছিলাম, ইন্ডিয়াতে আসবার পরও কখনো ঠামুন আইসক্রিম খাননি আর সিনেমা দ্যাখেননি।
বড়োজেঠু সিনেমা দেখতে ভালবাসত, আর তার বোন আইসক্রিম খেত খুব। বড়োজেঠুর মারা যাওয়ার পর আমার মেজপিসি, সেজপিসি, নোয়াপিসি, তারপরে বাবা। বাবা হওয়ার খবর শুনে বড়োপিসি ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে কোথায় ছুট দিয়েছিল, ‘বড়দা এসেছে, বড়দা এসেছে’ বলে। আর টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গিয়ে হাত-পাও কাটিয়েছিল। সবার কাছেই বড়োজেঠু ফিরে এসেছিল। আর ঠাম্মার কাছে, তার প্রথম সন্তান তাঁকে আর যাই হোক, ঠকায়নি বা ফাঁকিও দেয়নি, ঠিকই কথা রেখেছিল। বড়োপিসির সংসার বাংলাদেশে চৌমুহনীতে, কিন্তু ভিডিও কলেও বাবাকে তিনি আজও ‘বড়দা’ বলেই ডাকেন।
চুনীঠাকুর যেদিন চলে গেলেন,আমি তখন সদ্য ইলেভেনে উঠেছি। তার কিছুদিন আগে নোয়াপিসির কাছে তিনি পায়রার মাংস খেতে চেয়েছিলেন। আর নোয়াপিসির সেইদিনই মনটা কেমন করে উঠল, আর পায়রার মাংস নিয়ে চলে এলেন, দু-টুকরো খাওয়ানোর পরেই একটা হেঁচকি, আর কিচ্ছু নেই। ইংরেজিতে Nothingness, Absolute Zero! ঠাম্মার মেয়েও চলে যাওয়ার আগে আইসক্রিম খেতে চেয়েছিল। তাকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, যে দোকান খুললে এনে দেওয়া হবে। সেই সময় আর আসেনি যদিও। সেই কথাই কি নোয়াপিসির মনে পড়েছিল? জানিনা। জিজ্ঞেসও করেছিলাম, উত্তর পাইনি।
ডাক্তার যখন চুনীঠাকুরকে দেখে ঘাড় নেড়ে চলে গেলেন, বাড়িতে যখন কান্নাকাটির রোল উঠল, তখনও ঠাম্মা বিশ্বাস করেননি, সামনে গিয়ে ডাকছেন তাঁকে, "এইযে, ডাকছে যে সবাই, শুনছেন?"
আমি গিয়ে ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরলে তারপর একটা বুকফাটা কান্না। এভাবেই যায় মানুষ। মুহূর্তের এক-টুক মাত্র। তার সঙ্গেই চলে যায়, সমস্ত জীবনের সংঘর্ষ, সমস্ত স্মৃতি, অর্জিত-সহজাত সমস্ত বৈশিষ্ট্য মেধা, বিশ্বাস। তাই চুনীঠাকুরেরও সঙ্গে গেল ময়মনসিংহে তাঁর নেতাজিকে স্বচক্ষে দেখা, আর নেতাজির প্লেন-ক্র্যাশে মারা না যাওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস।
এখন ঠাম্মাকে দেখি, কিভাবে একটুকরো জমিনকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চান। বাংলাদেশে যাওয়ার কথা মুখেও আনতে চাননা। প্রচন্ড গরমে, ঝড়-বৃষ্টিতে নিজের ওই জানলার কাঁচ ভাঙা ঘরই তাঁর শেষ আশ্রয়। যেই ঘরে প্রথম সন্তানের জামা আঁকড়ে ডুকরে কাঁদাও যায় অগোচরে, আর রাত্রে চুনীঠাকুরের ঘরের বিছানায় তাকিয়ে ঘুমিয়েও পড়া যায়।
সাম্য চক্রবর্তী বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের প্রথম বর্ষের পড়ুয়া। অবসর কাটে বাড়িতে একটি ছোট্ট লাইব্রেরি তৈরির শখে, কিসলোস্কি, কিয়ারোস্তামি দেখে আর ক্রিকেট খেলে। গাঁয়ের মাটি আর ভাষা আঁকড়ে রাখতে ভীষণই উদগ্রীব।