ছাদের ঘরে ছাদ
সমবৃতা চক্রবর্তী
■■■■
ছাদের ঘরে ছাদ
সমবৃতা চক্রবর্তী
■■■■
ছেলেবেলার বেশিরভাগ দিনই কেটেছে মামাবাড়িতে। বেহালার গলি তস্য গলির ভেতর দিয়ে পৌঁছতে হয়ে সেনবাড়ি। দাদুরা চার ভাই, তিন বোন— বোনেদের সব শহরের নানা জায়গায় বিয়ে হয়ে গেলেও, বাকি পরিবারের ঠেক ৮৮/৬ সত্যেন রায় রোড। জুতোর বাক্সের মত চৌকো আকার, সময়ের যাতায়াতে বাইরের দেয়ালের জায়গায় জায়গায় প্লাস্টার খসে গেছে, বাঁদিকের জলের পাইপ বেয়ে উঠে গেছে এক লতানো গাছ— স্মৃতিকে উল্টো পথে চালালে এই ছবিটাই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। ছেলেবেলার মামাবাড়ি চিরদিনই ঠাকুমার ঝুলির রঙে রাঙানো। বাইরের কোলাপসিবল গেটে চেপে দোল খেতে খেতে নিজেকে পক্ষীরাজের পিঠে রাজকুমার ভেবেছি, পিছনের বাগানে খেলতে খেলতে বাগান হয়ে উঠেছে আফ্রিকা আর আমি শঙ্কর। একতলা থেকে দোতলা, দোতলা থেকে ছাদ, সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে নতুন নতুন গল্প বানানোই ছিল আমার অনেক দুপুরের ঘুমপাড়ানি গান। কিন্তু, আর সবকিছুর মধ্যেও, মামাবাড়ির ছাদ ছিল আমার কাছে আসল রূপকথার রাজ্য।
বেহালাবাড়ির ছাদটা আমার বড়ই প্রিয়। ও বাড়িতে কত বছর কাটিয়েছি, এরকম কোনো বিকেল মনে পড়েনা যেটা ওই ছাদে কাটেনি আমার। প্রতিদিন সূর্য যখন শুতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করত, আমি পৌঁছে যেতাম ছাদে। ছোট্ট পায়ে সিঁড়ি টপকে ছাদ, মাথার উপর খোলা আকাশ, দিগন্ত থেকে দিগন্তে যেন চিত হয়ে শুয়ে আছে। বড় রাস্তার অনেক ভেতরে বাড়ি, মেইন রাস্তার কোলাহলের চেয়ে অনেক দূরে। এই নিস্তব্ধতা আরামদায়ক, ওই নিস্তব্ধতাকেই নিজের সঙ্গী করে নিলাম। ছাদের এক কোণে একরত্তি চিলেকোঠার ঘর। ঘরটা ভারী মজার। বইয়ের তাক ঠাসা— তার মধ্যে রঙিন মলাটের রুশ লোকগাথা এবং লাল মলাটের রাজনৈতিক বই-ই বেশি। ঘরের দুই দেয়ালে দুটো রং চটে যাওয়া বিশ্বের মানচিত্র। মাঝের দেয়ালে একটা ক্যাবিনেটে মাসির আইনের বই, ইটের মতো শক্ত এবং দাঁত বের করা। ক্যাবিনেটের উপর পুরোনো আমলের ডায়াল ঘোরানো ফোন। চলত না, লাইন অনেক বছর আগেই কেটে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই ফোনের ডায়াল কিরিক শব্দে ঘুরিয়ে রিসিভার তুলে কায়দা মেরে "হ্যালো" বলার আনন্দ বোধহয় মেলায় বুড়ির চুল খাওয়ার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। ঘরের মাঝামাঝি একটা চৌকি, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা বারো মাস একটাই তোষক পাতা থাকত, মাঝে মাঝে তুলে ধুয়ে আবার পেতে দেওয়া হত। খটখটে গ্রীষ্মের দুপুরে যখন সেই ফুল-ছাপ তোষকের উপর গাইডারের তিমুর আন্ড ফ্রেন্ডস গিলতে গিলতে ঘুমিয়ে পড়তাম, সন্ধ্যে নামার আগে দাদু এসে কোলে করে নিচে নিয়ে যেত।
ফুলদিদুনের ফুলবাগানের কোণার দিকে এক মাটির কলসিতে জল রাখা থাকত পাখিদের জন্যে। নানা রকমের রঙিন কিংবা বেঁটে কিংবা ফুলকো পাখি আসত জল খেতে, আমি একটু দূর থেকে খোলা ছাদের উপর ঘাপটি মেরে বসে দেখতাম। মাঝে মাঝে আঁকার খাতা আর রং পেন্সিল নিয়ে গিয়ে পাখি আঁকতে চেষ্টা করতাম, কিন্তু বাড়ির বড়রা আমার খাতায় আঁকা পাখি আর বুদবুদের তফাৎ ঠিক সমঝে উঠতে পারত না।
ছাদটা বেশ খোলামেলা। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদে পড়লে, বাঁ-হাতে ফুলদিদুনের ছোট্ট ফুলের বাগান। সেই ফুলবাগানে মাঝে মাঝে জল দিয়ে দু-টাকার লজেন্সও পেয়েছি, আবার বদমায়েশি করতে গিয়ে ফুল ছিঁড়ে ফেলে আলতো কানমলাও জুটেছে। ডানহাতে একটা সিঁড়ি, সিঁড়ি বেয়ে উঠলে ওপরের ছাদ, তার উপর জলের ট্যাংক। গরমের গনগনে রোদের নীচে জলের ট্যাংক চিড়বিড় করত, আবার শীতের খিনখিনে হাওয়ায় জবুথবু হয়ে বসে রইতো পৌষ-মাঘ। ছাদের দেয়াল ঘেঁষে দুদিকে দুটো কাপড় কাচার ঘর, কল খুললেই পাহাড়ি নদীর স্রোতে পাঁচ মিনিটে সারা ঘর জলে থৈ-থৈ। সেই থৈ-থৈ জলে দাঁড়িয়েই পড়ন্ত দুপুরে মণিদিদুন কাপড় কাচত— ছপ-ছপ-ঠাস-ঠাস। আমি খেলে বেড়াতাম ছাদে, এমাথা থেকে ওমাথা। নিজের সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করতাম। খেলনাবাটি সাজিয়ে বিদেশী রেস্তোরাঁ খোলার অভিনয় করতাম। আদরের পুতুল 'সুইটি'-কে নিয়ে চিলেকোঠার ঘরের ছাউনির নিচে বসে অ্যালিসের গল্প শোনাতাম। মাঝে মাঝে ছোড়দি কলেজের পড়ার মাঝে হাওয়া খেতে আসত, আমরা লাল চক দিয়ে ছাদের টালির উপর খোপ কেটে এক্কা-দোক্কা খেলতাম। ফুলদিদুনের ফুলবাগানের কোণার দিকে একটা মাটির কলসিতে জল রাখা থাকত পাখিদের জন্যে। নানা রকমের রঙিন কিংবা বেঁটে কিংবা ফুলকো পাখি আসত জল খেতে, আমি একটু দূর থেকে খোলা ছাদের উপর ঘাপটি মেরে বসে দেখতাম। মাঝে মাঝে আঁকার খাতা আর রং পেন্সিল নিয়ে গিয়ে পাখি আঁকতে চেষ্টা করতাম, কিন্তু বাড়ির বড়রা আমার খাতায় আঁকা পাখি আর বুদবুদের তফাৎ ঠিক সমঝে উঠতে পারত না।
এরই মধ্যে মণিদিদুনের কাপড় কাচা হতো, ছাদের এমাথা থেকে ওমাথা দড়ি টাঙানো, তার উপর ঝুলত ভিজে সপসপে শাড়ি, প্যান্ডলুন, ফতুয়া, শার্ট, প্রভৃতি। দুপুরের শেষ রোদ পড়ত তখন ছাদের উপর, তেরছা করে, আপনমনে শুকিয়ে দিত জামাকাপড়। আমি তখন পায়ের বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে ছাদের রেলিংয়ের উপর দিয়ে উঁকি দিয়ে বাড়ির পিছনের মাঠের ফুটবল খেলা দেখছি। ছেলেগুলো পাড়ার, রোজ এইসময়ে নিজেদের মধ্যে দল ভাগ করে একটা আধ-ফাঁপা বল পেটাতো, গোলপোস্টের জন্যে উল্টো দিকের কনস্ট্রাকশন সাইট থেকে তোলা চারটে ইট মজুত থাকতো রোজ। বলের হাওয়া কমার সাথে সাথে চারিদিকে আলোও কমে আসত, সূর্য ধীরে ধীরে আকাশের গা বেয়ে নীচে নামতে থাকতো। মণিদিদুনের কাপড় ততক্ষণে প্রায় শুকিয়েই এসেছে, সূর্যাস্তের গন্ধের সাথে মিশে যেতে ভেজা গুড়ো সাবানের শেষ সুবাস। মাথার উপরে তখন পাখিদের অস্থির চলাচল, সবার বাসায় ফেরার তাড়া। কিচিরমিচির গান রেডিওর প্লেব্যাকের মতো চলতে থাকত। মণিদিদুন এসে কাপড় তুলতে তুলতে সূর্য প্রায় ঢলে পড়েছে। আস্তে আস্তে বাড়ির সব আলো জ্বলে উঠত, পাড়ার বাকি সব বাড়ির জানলাতেও ধরা দিত ভেতরের আলোর ঝিকিমিকি। আস্তে আস্তে নীচ থেকে ভেসে আসত জীবনযাপনের শব্দ। ওইতো, নিচের তলায় জলের ঝরঝর তারপর ঝপাৎ ঝপাৎ। ফুলদাদু নিশ্চই অফিস থেকে ফিরে গা ধুতে ঢুকেছে। আর ওইতো, সন্ধ্যে ছটার সিরিয়ালটার আবহসঙ্গীত না? ছোটদিদু নিশ্চয়ই এতক্ষণে ঘরের কাজ সেরে টিভিটার সামনে বসতে পারল। এইসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে ছাদেই ঘুরে বেড়াতাম, জানতাম, এক্ষুনি ডাক পড়বে নীচ থেকে— দিদু বলবে,
"আয়, ঘরে আয়, সন্ধ্যাটা দেবো, আর বাইরে থাকিস না, মা নিশ্চয়ই অফিস থেকে ফিরেছে এতক্ষণে এসে একটা ফোন কর ও-বাড়িতে, দেখ দাদাই তোর জন্যে মিটিং থেকে ফেরার পথে জলভরা তালশাস নিয়ে এসছে পান্না থেকে, বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণটা নিয়ে একটু বস যা গে— তোর 'প'-টা কেমন প্যাটফাটা লিখিস এখনো, ইইইশ সিরিয়ালটা মিস হয়ে গেল মনে হচ্ছে, আচ্ছা নামার সময়ে কিন্তু দরজার হুড়কোটা টেনে আসিস।"
■■■■
Sambrita Chakraborty is currently pursuing her third year in Bachelor of Arts (Honours) degree in History, under Jadavpur University. An avid reader and a film buff, her ideal day consists of relaxing with a copy of Terry Pratchett and a warm cup of tea. Her area of interest spans archaeological studies and ancient civilizations, especially the ancient Egyptian civilization.