লোডশেডিং
রণদীপ নস্কর
■■■■
লোডশেডিং
রণদীপ নস্কর
■■■■
শেষ বিকেলের আকাশে যখনই কেউ গাঢ় নীল কালি-মাখা তুলিখানা ডোবাত, যখনই মাথার
ওপরে উড়ে যেত বাদুড়-প্যাঁচার সিল্যুয়েট— আমরা বুঝতাম, অন্ধকারের পালা শুরু হল।
নারকেলপাতার শিরা বেয়ে, কার্ণিশ ঘেঁষে সন্ধে নামত; আর নামত আমাদের সাহসের পারা।
সন্ধে মানেই অবধারিত লোডশেডিং। আর কে না জানে, সন্ধের অন্ধকারে পুকুরঘাটের পথের
ধারে বসে থাকে মানুষের মতো দেখতে যেসব লোক, তাদের পা-গুলো উল্টো। চিলেকোঠার
দিকে পা বাড়ালেই স্যাঁত করে সরে যায় কারুর ছায়া। জুতমতো কান পাতলে ঝিঁঝিঁর শব্দ ছাপিয়ে
ভেসে আসে কারুর চোরা ফিসফিস। বারান্দা থেকে রান্নাঘরের দিকে যাওয়ার সময় অকস্মাৎ
নৈঃশব্দ্য চিরে দেয় কার ডুকরে-কান্নার শব্দ, অথবা কুটিল হা-হা-হি-হি। আমাদের বীরত্বের
বেলুনে পিন ফুটিয়ে দেওয়ার জন্য একটি শব্দই যথেষ্ট ছিল: লোডশেডিং।
শৈশবের স্মৃতি লিখতে বসলে তাতে বারংবার উঁকি দিয়ে যায় লোডশেডিং। যেভাবে রেলিঙের
ফাঁকে খেলা করত কালিঝুলি মাখা হ্যারিকেনের আলো— তেমনই স্মৃতিপটে লোডশেডিং-পরবর্তী
ছবিগুলো দু-একবার কেঁপে-কেঁপে ফিরে আসে। শূন্য দশকের গোড়ার দিকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে
বড় হয়েছি, লোডশেডিং ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তবে, অন্ধকার যে আলোর জন্ম দেয়,আজ
এই মধ্য-বিশে দাঁড়িয়ে কখনো সেই উপলব্ধি হত না যদি-না শৈশব কাটত অমন দৈনন্দিন
আলো-আঁধারিতে। লোডশেডিং অনেকগুলো স্মৃতির জন্ম দিয়ে গেছে। যৌথ পরিবারে বড়
হয়েছি, বাড়ির কনিষ্ঠতম সদস্য, ফলে আদরযত্ন আমার ভাগে কিছু বেশিই বরাদ্দ ছিল, তাতে
সন্দেহের অবকাশ নেই। হ্যারিকেনের নিবু -নিবু আলোয় উঠোনের পাশে লম্বা দাওয়ায় বসতাম
দাদা-দিদিদের সঙ্গে, কাকিমা-জেঠিমারা গল্প বলত। কখনো উমনো-ঝুমনো, কখনো একানড়ে;
কখনো বা নেহাতই পাড়ার কাউকে ভূতে ধরার আখ্যান। গল্প এখন যতই আজগুবি ঠেকুক, ওই
ম্রিয়মাণ আলোয় সেসব গল্পকেই ধ্রুব সত্য মনে হত। বাঁ-দিকে উঠোন পেরিয়ে তাকাতে বুক
কাঁপত, মনে হত পেঁপেগাছের মাথায় এক পা আর পাশের বাড়ির টালির চালে এক পা দিয়ে
দাঁড়িয়ে রয়েছে কোনো অতিলৌকিক প্রেত।
শৈশবের স্মৃতি লিখতে বসলে তাতে বারংবার উঁকি দিয়ে যায় লোডশেডিং। যেভাবে রেলিঙের ফাঁকে খেলা করত কালিঝুলি মাখা হ্যারিকেনের আলো— তেমনই স্মৃতিপটে লোডশেডিং-পরবর্তী ছবিগুলো দু-একবার কেঁপে-কেঁপে ফিরে আসে। বাঁ-দিকে উঠোন পেরিয়ে তাকাতে বুক কাঁপত, মনে হত পেঁপেগাছের মাথায় এক পা আর পাশের বাড়ির টালির চালে এক পা দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কোনো অতিলৌকিক প্রেত।
রাত বাড়ত। মা-কাকিমাদের ব্যস্ততাও। রান্না বসাতে হবে, বাবা-জেঠু-কাকুরা ফিরবে কাজের
জায়গা থেকে। আমার তখনো ইস্কুল জোরকদমে শুরু হয়নি। দাদা-দিদিরা ডুবে যেত
পড়াশোনায়, কেউ মুখস্থ করছে নামতা, কেউ আওড়ে চলেছে কিশলয়, কেউ-বা ক্লাস সেভেনের
ভৌতবিজ্ঞান। আর এসব থেকে বহু দূরে আমি সদ্য-আবিষ্কৃত আতঙ্কগুলির সঙ্গে সমঝোতা
চালানোর চেষ্টা করছি নিকষ আঁধারে। অন্ধকারের অচেনা জগৎ থেকে বার্তাবাহকের মতো ভেসে
আসছে সবুজ জোনাকির দল। হ্যারিকেন যত কমে আসছে, তত স্পষ্ট হচ্ছে জোনাকির ঝাঁক।
মাথার ওপর কালপুরুষ, তার পায়ের কাছে স্পষ্ট লুব্ধক। পাশের কচুবন থেকে সমানে ভেসে
আসছে ব্যাঙের ডাক, আর পুকুরের ওপরে ইতি-উতি ভেসে বেড়াচ্ছে জোনাকি। প্রতিটা বাড়ির
ছাদে কুপি-হ্যারিকেন-লণ্ঠন জ্বেলে, হাতপাখা টানতে টানতে বসেছে আড্ডার আসর। উঁচু থেকে,
অনেক উঁচু থেকে দেখলে একেকটি বাড়িকেও অবিকল একেকটি জোনাকির মতো লাগে।
রাত ঘনিয়ে আসে। গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে দশটা ঘণ্টা পড়ার কিছু পরে ফিরে আসে বৈদ্যুতিন
আলো। তখন খানিক আগের আঁধার-ঘেরা জগৎটিকে পূর্বজন্মের স্মৃ তি মনে হয়। দেওয়ালের
ছায়া আচমকা মুছে যায়, যেভাবে সাঁৎ করে সরে যেত সিঁড়ির কোণে ছায়ামূ র্তি। আজ প্রায়
দু-দশক আগে যখন সেইসব দিন ফিরে দেখি, লোডশেডিংকে বড় একাকী মানুষের সময় মনে
হয়। মনে হয়, যাবতীয় সাঁঝচর জীব বড় একা— সে পুকুরপাড়ের প্রেতিনীই হোক, অথবা
ঘরফেরতা বাদুড়। কেউ দল বেঁধে আসে না। মানুষের আড্ডায় তারা ভয় দেখাতে নয়, খানিক
সঙ্গ খুঁজতেই আসে। পাছে তার উপস্থিতিতে কেউ চমকে যায়, তাই দূরে, খানিক আড়াল থেকে
চোখ রাখে মানুষের ওপর। আর বোকা মানুষ তাদেরকেই দূরে সরিয়ে রাখার জন্য আলো জ্বেলে
গা ঘেঁষে বসে। লোডশেডিং একাকী মনুষ্যেতরদের একাতর করে দিয়ে মানুষকে করেছিল যৌথ।
আজ চারপাশে ঝকমকে আলো বটে, আর মানুষের সেই যৌথতা নেই। নেই সেই সংবদ্ধতা।
উল্টোদিকে, ঘাড়ঝোলা কতকগুলো মানুষকে ক্লান্ত হাঁটতে দেখে অবিকল পুকুরপাড়ের ভূতেদের
কথা মনে পড়ে।
একা। মিসফিট। বিষণ্ণ।
স্কুলজীবন পাঠভবন ডানকুনিতে, মৌলানা আজাদ কলেজ থেকে সমাজতত্ত্ব নিয়ে স্নাতকস্তরের পড়াশোনা। তারপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিল্ম স্টাডিজে স্নাতকোত্তর। ফিল্ম দেখতে, বই পড়তে ভালো লাগে। ফিচার ফিল্ম বানানোর ইচ্ছেয় দিন গুজরান হয়।