একটি গল্প, সময়ের মতো পুরোনো
মেহুলী মান্না
■■■■
একটি গল্প, সময়ের মতো পুরোনো
মেহুলী মান্না
■■■■
জীবন যদি এক গানের মতো হয়, তাহলে স্মৃতি হল সেই গানের স্বরলিপি। কখনো কিছু স্বরলিপি আমরা ভুলে যাই আবার কিছু সুর,কথা মনে থেকে যায় অনেক দিন। স্মৃতির পথ বেয়ে, স্বরলিপি গুলো ফিরে দেখা এক অদ্ভুত সফর - সে সফর সবসময় আনন্দের নয়, তবুও ফেলে আসা দিন গুলো মনে করলে এক সুন্দর শান্তি অনুভব করি । আমার এই প্রশান্ত নস্টালজিয়া ভাগ করে নেওয়ার আশায়, আমি এমন এক জিনিসের কথা লিখবো যা আমার সমস্ত ছেলেবেলা জুড়ে বিস্তৃত এবং সেটির কথা মনে করলে আমি আজও আনন্দ পাই।
আদিতে আমাদের পরিবার কলকাতার পাশে হাওড়া জেলায় অবস্থিত ছিল। কাজের খোঁজে আমার দাদু সেখান থেকে তমলুক চলে গিয়েছিলেন । গাড়িতে কলকাতা থেকে তমলুকের দূরত্ব দু-তিন ঘন্টা। দাদু সেখানে তাঁর ব্যবসা স্থাপন করেছিলেন। ফেরার সময় তিনি সঙ্গে নিয়ে আসেন এক পেন্ডুলাম ঘড়ি, ইংরেজিতে জেক বলে গ্রান্ডফাদার ক্লক। সেই ঘড়ির কোথাই আজ এখানে লিখব।
পেন্ডুলাম ঘড়িটা দেয়ালে টাঙানো থাকতো। ধূসর কালো রঙের কেস, মাথাটা ত্রিকোণ ছাদের মতো, তার নিচেই গাঢ় জলপাই রঙের মূল ঘড়ি রাখা, তার নিচে পেন্ডুলাম। আমার দাদু , (যদিও আমি তাঁকে কখনো এই নাম ডাকার সুযোগ পাইনি ) আমার জন্মের বহু বছর আগেই তমলুক চলে যান, তাই ছোটবেলা থেকেই ঘড়িটা দেখে পুরোনো মনে হতো। ঘড়িটার যে কি গুরুত্ব তা আমি বুঝতে পারতাম না, সেটা যে দুর্লভ ( যদিও সম্পূর্ণ ভাবে না কারণ এখনো এরম ঘড়ি চরা দামে বাজারে বিক্রি হয়, ভিনটেজ নাম ) এবং প্রাচীন; এমনটা হয়তো রোজ দেখার অভ্যাসে। আর্থিক মূল্য ছাড়াও, আমার শিশু মন এর আবেগের মান বুঝেতে পারেনি। কিন্তু আজ, চোখ বন্ধ করলে যখন স্মৃতিরা দেখা দেয়, সেই ঘড়িটার দৃশ্য ফিরে আসে বার বার, সঙ্গে তার আওয়াজ।
কখনো কখনো ঘড়ির আওয়াজে ভয় পেয়ে আমার পড়ার ঘোর কেটে যেত। আবার এও মনে হতো যে সারা বাড়িতে শুধু ঘড়িটাই জেগে আছে আমার সাথে আর নিয়ম করে সময়ের খবর দিচ্ছে, এই ভেবে একরকম আশ্বাস পেতাম।
পেন্ডুলাম ঘড়ির রুটিন আওয়াজটা যেন আমার সমস্ত স্মৃতির আবহ সংগীত। এখনো চোখ বুজলে ‘ডিং -ডং’ শব্দ শুনতে পাই এক সুরের মতো। মনে পরে গরমের ছুটির তপ্ত দুপুরে সবাই ঘুমোচ্ছে, শুধু আমি জেগে, কিভাবে সময় কাটতো মনে নেই কিন্তু মনে আছে আধঘন্টা অন্তর ঘড়ির ‘ডিং -ডং’ আওয়াজ। তখন কিছু মনে না হলেও, এখন এই শব্দই মনে করিয়ে দেয় গ্রীষ্মের দুপুর, অন্ধকার ঘর, খট-খট আওয়াজ করা সিলিং পাখা - এই নস্টালজিয়া। আরেকটু বোরো হতেই, পড়াশোনার চাপ বাড়তে থাকলো, কাজ শেষ করতে অনেকসময় রাত জাগতে আরাম্ভ করলাম, (বাড়ির অন্যদের চাইতে বেশি) । রাত বাড়লে আমাদের বাড়িটা অদ্ভুত ভাবে নিস্তব্ধ হয়ে উঠতো। মূল শহরের বাইরে বলে এই নিস্তব্ধতা যেন আরো ভীষণ মনে হত। রাত জাগা এই রাত্রিগুলোতে ঘড়ির আওয়াজটা আরো স্পষ্ট শোনা যেত, যেন ঘড়ি ছাড়িয়ে, দেয়াল ডিঙিয়ে একদম আমার ঘরে চলে এসেছে। কখনো কখনো ঘড়ির আওয়াজে ভয় পেয়ে আমার পড়ার ঘোর কেটে যেত। আবার এও মনে হতো যে সারা বাড়িতে শুধু ঘড়িটাই জেগে আছে আমার সাথে আর নিয়ম করে সময়ের খবর দিচ্ছে, এই ভেবে একরকম আশ্বাস পেতাম।
ভাবতে অবাক লাগে কিভাবে এই একঘেয়ে একটা শব্দের সাথে কত রকমের স্মৃতি মিশে আছে। ছেলেবেলার অনেক কিছুর মধ্যে, এই শব্দ রয়ে গেছে আমার সাথে, আশা করি থেকে যাবে আরো অনেক দিন । শুনেছি শব্দ আর গন্ধ হলো স্মৃতির প্রধান দুই উপকরণ। আমি মনে করি এটা সত্য, কারণ সেই পুরোনো পেন্ডুলাম ঘড়ির ‘ডিং-ডং’-এর মধ্যেই জড়িয়ে আছে আমার ছোটবেলার অনেকটা অংশ আর আমি।
Translated from English by Dipanwita Bhattacharyya