খেলার জগতে
দীপান্বিতা ভট্টাচার্য্য
■■■■
খেলার জগতে
দীপান্বিতা ভট্টাচার্য্য
■■■■
ছোট থেকেই আমরা ভাইবোনেরা সারা বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতাম দুর্গা পুজো শেষ হলেই আমাদের গ্রামের বাড়িতে কালী পুজো। অন্যথা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও পুজোর কিছু দিন একসঙ্গে গল্প - খেলায় মজে দিন কেটে যেত। মহালয়া আসলেই সবাই যখন দুর্গা পুজোর আয়োজন করে আমরা হিসেবে করে ফেলি, কালী পুজোর আর এক মাস। ঠামা মনে করিয়ে দেয়, “পরের অমাবস্যাতে মায়ের পুজো”। পুজোর কটা দিন একসঙ্গে হলে আমাদের আর পায় কে! হৈ-হুল্লোড়ে কখন যে নিমেষের মধ্যে দিন কেটে যেত আমরা বুঝতেই পারতাম না। এ খেলা সে খেলায় আমাদের দিন কেটে যেত - কিছু স্কুলে শিখে আসা, আবার কিছু আমরা নিজেরাই তৈরী করে নিতাম।
বড়োরা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে সারা দুপুর উঠোন জুড়ে চলতো কুমির ডাঙ্গা, কানামাছি বা খামারে বাঁশের টুকরো দিয়ে উইকেট তৈরী করে ক্রিকেট। বাড়িতে সদর দরজা দিয়ে ঢুকলেই সামনে উঠোন, তার দুই দিকে ঘেরা দাওয়া, ডান হাতে রান্নার চালা। এই নকশার এখন অনেকটাই বদল হয়েছে তবে ছোটো বেলায় ওই উঠোন, দাওয়ায় ওঠার সিঁড়ি আর রান্নাঘরের উঁচু মেঝেই হয়ে উঠতো আমাদের কুমির ডাঙার মঞ্চ। উঠোন ব্যাপী জলের মাঝে কুমিরের অসুবিধা করে দেওয়ার জন্য কখনো আবার বস্তা বা কাপড় পেতে অস্থায়ী দ্বীপ বানিয়ে নেওয়া হতো। এক এক করে সবার পালা হতো কুমির হওয়ার, আর বাকিদের কাজ সেই কুমিরের কাছে ধরা না পরে এ ডাঙা থেকে ও ডাঙা চলে যাওয়া। এ খেলায় ইচ্ছামতো নিয়ম বানিয়ে নেওয়া যায় - কতক্ষণ এক ডাঙায় থাকা যাবে, কিভাবে পরের কুমির স্থির হবে কিংবা জলে পা না দিয়ে এক লাফে আর এক ডাঙায় পৌঁছে গেলে কুমির কাউকে ধরতে পারে কিনা, এরকম নানা বিষয়। তবে একটা নিয়ম আবশ্যক, খেলা শুরু হওয়ার সময় সুর করে গাইতে হবে: কুমির তোমার জলে নেমেছি!
বড়োরা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে সারা দুপুর উঠোন জুড়ে চলতো কুমির ডাঙ্গা, কানামাছি বা খামারে বাঁশের টুকরো দিয়ে উইকেট তৈরী করে ক্রিকেট। বাড়িতে সদর দরজা দিয়ে ঢুকলেই সামনে উঠোন, তার দুই দিকে ঘেরা দাওয়া, ডান হাতে রান্নার চালা। এই নকশার এখন অনেকটাই বদল হয়েছে তবে ছোটো বেলায় ওই উঠোন, দাওয়ায় ওঠার সিঁড়ি আর রান্নাঘরের উঁচু মেঝেই হয়ে উঠতো আমাদের কুমির ডাঙার মঞ্চ।
এছাড়াও, খামার-উঠোন ছেড়ে ঘরের মধ্যে বসত খেলার আসর। কাগজ পেন খাতা নিয়ে শুরু হতো চোর - পুলিশ - ডাকাত - বাবু, কিলার কিলার, নেম - প্লেস - এনিম্যাল - থিং, বা মুখে মুখে আটলাস , চাইনিস বা ইন্ডিয়ান উইসপার, ‘দামশারাড্স’, অন্তাক্ষরী। এই তালিকায় নতুন যুক্ত হয়েছে লুডো, উনো আর কিছু তাসের খেলা। এর মধ্যে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় চোর-পুলিশ-ডাকাত-বাবু আর কিলার - কিলার। খেলার আগেই তার অনেক তোড়জোড়। কাগজ কেটে চিট বানাতে হবে, সেই কাগজ সমান ভাবে কাটা চাই নাহলে পুলিশ বা ডাকাতের পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। এ খেলার প্রধান চরিত্র বাবু আর পুলিশ, বাকিদের মধ্যে কেউ বা চোর, ডাকাত, পকেটমার । প্রয়োজনে কিছু নাম আমরা নিজেরাই লিখে নিতাম - তারা ‘দুধ-ভাত’। এক এক করে সব চিট ফেলা হবে (ফেলার কায়দা তেই খেলার ভাগ্য ঠিক হয়ে যেতে পারে অনেকসময়) তারপর সবাই একটা করে কাগজ তুলে নিলে, বাবু নিজের পরিচয় জানিয়ে এবং অনায়াসে ১০০০ নম্বর সংগ্রহ করে পুলিশ কে আদেশ দেবে চোর/ডাকাত বা অন্য কাউকে ধরার। ধরা পরে গেলে বা পুলিশ ধরতে না পারলে সেই রাউন্ডে তার ০। কিলার - কিলার খেলাও অনেকটা একই রকম, তবে এখানে বাবু আর পুলিশের বদলে আছে কিলার আর পুলিশ। খেলার সময় সবাই নিজের পাওয়া পরিচয় গোপন করে রাখবে। তার মধ্যে থেকে কিলার এর কাজ পুলিশের আড়ালে বাকিদের নানা ছলে মেরে ফেলা। আর পুলিশের কাজ সময় মতো কে কিলার তা খুঁজে বের করা। এখানে কে পুলিশ কে কিলার সমস্তটা গোপন রেখে এক অদ্ভুত সন্দেহের উত্তেজনা তৈরী হয়ে। কতবার তো কিলার প্রথম নিক্ষেপেই অজান্তে পুলিশকে মেরে নিজের পরিচয় প্রকাশ করে ফেলেছে!
দীপান্বিতা ভট্টাচার্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্রী। বাংলা ও ইংরেজিতে কল্পকাহিনী এবং অ-কল্পকাহিনী অনুবাদ করতে এবং মানুষের গল্প অন্বেষণে আগ্রহী।