ছাদ জুড়ে ঔদ্ধত্য
অর্ণব চক্রবর্তী
■■■■
ছাদ জুড়ে ঔদ্ধত্য
অর্ণব চক্রবর্তী
■■■■
পৃথিবীর একটা ছাদ আছে। সেখানে সূর্য চাঁদ গ্যালাক্সি অচেনা কোনো গ্রহ ইত্যাদি দিয়ে সাজানো। সিলিং এর রঙ ঘন নীল। ওখানেও কোনো এশিয়ান পেন্টস বা বার্জার আছে নিশ্চই। এইবার সেই পৃথিবীর মধ্যে আমাদের বাড়িগুলোরও সব নিজস্ব ছাদ। ত্রেতা যুগে রাম বা লঙ্কার রাবণ মহারাজের ছাদগুলো নিশ্চই খুব সাজানো থাকত, ধনুক বান ঢাল তরোয়াল দিয়ে টেরেস ডেকোরেশন করা হত, আজকের হাইরাইজ কমপ্লেক্স গুলোতে আবার গিজোবো কিউরেটেড বাগান, স্ক্রিন দেয়া মুভি জোন, সেখানে মুকেশ খান্নার মহাভারত দেখে আজকের বিভীষণ এর দল, সাথে মাশরুম কাবাব আর গ্লেন লিভেট। ওই হাইরাইজ-এর ছাদের নিচে আজকে সব বিভীষণ রাবণ কিচক। তারা খারাপ, এ কথা বলার ধৃষ্টতা আমার নেই, তওবা তওবা। আমি বরং প্লেনের টিকিট কেটে অযোধ্যা যাব, ইন্ডিগো, প্লেন ছাড়ার আগে সবাই মিলে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠব - জয় যোগিলালা, থুড়ি রাম লালা।
আমাদের বাড়ি দোতলা ছিল, কিন্তু একটাই মাত্র ঘর যার উপরে সিমেন্টের ঢালাই, বাকি অংশ টিনের ছাদ। অতএব ছাদের বিলাসিতার কোন সুযোগ ছিল না আমার শৈশব ও কৈশোরে। আমি ছাদের পুরো বেনিফিট নিয়েছিলাম, যে বছর তেড়ে মিটিওর শাওয়ার হলো, রঞ্জনের তিনতলার বাড়ির চিলেকোঠার ছাদের উপর উঠে আমরা সোজা শুয়ে শুয়ে জ্যোতিষ্কের আনাগোনা দেখেছিলাম। আজ আমরা নিজেদের ভিটে মাটি ছেড়ে ফ্ল্যাটে এসেছি, সেখানে নানা তোড়জোড় করে বাঁশের খুঁটি লাগিয়ে নাইলনের দড়ি লাগানো হয়েছে, সেখানে গ্রীষ্মে তিনতলার ফ্ল্যাটের বাচ্চার হাফপ্যান্টের পাশে দোতলার মাসিমার শায়া শুকোয়। ছোটবেলার উপন্যাস ও ছবিগুলো আমাকে জানিয়েছিল, বোধহয় সুনীলবাবুর উপন্যাস বা বিকাশবাবুর ছবি, ছাদ ভালবাসার জন্ম দেয়, সেখানে শুরু হয় লায়লা মজনুর জীবনের গাথা, কিন্তু আমাদের ছাদে রোদ্দুর শ্যাওলার সাথে লুকোচুরি খেলে, বিকেলে তিন বাড়ি দূরের মাসিমা তার নাতির হাফপ্যান্ট আর নিজের পেটিকোট ক্লিপ থেকে খুলে প্লাস্টিকের ব্যাগে পোরেন, ব্যাস , এই টুকুই। আমার ছাদ কোন রোমান্টিসিজমের জন্ম দিতে পারেনি। কারণ আমাদের ছাদের অধিকারের পিছনে ইয়েমাই-এর ন্যুব্জ করে দেয়া চাপ ছিল। আমি ছাদে উঠিনি বহুদিন কারণ আমার ছাদ থেকে সাউথ সিটির ছাদ দেখা যায়, যার মাথায় রাজার মুকুটের হিরের মত লাল তীব্র আলো জ্বলে আর নেভে, আমার শঙ্কিত বেড়ে ওঠা, আমার হেরে যাওয়া বর্ণমালার লিপি, আমার রক্তের শর্করা ও অনিয়মিত হৃদস্পন্দন আমাকে অত উচু ছাদের দিকে চাইতে বারণ করে।
আমি ছাদের পুরো বেনিফিট নিয়েছিলাম, যে বছর তেড়ে মিটিওর শাওয়ার হলো, রঞ্জনের তিনতলার বাড়ির চিলেকোঠার ছাদের উপর উঠে আমরা সোজা শুয়ে শুয়ে জ্যোতিষ্কের আনাগোনা দেখেছিলাম। আজ আমরা নিজেদের ভিটে মাটি ছেড়ে ফ্ল্যাটে এসেছি, সেখানে নানা তোড়জোড় করে বাঁশের খুঁটি লাগিয়ে নাইলনের দড়ি লাগানো হয়েছে, সেখানে গ্রীষ্মে তিনতলার ফ্ল্যাটের বাচ্চার হাফপ্যান্টের পাশে দোতলার মাসিমার শায়া শুকোয়।
আমি বরং মানুষের নিজস্ব ছাদের কথা ভাবি। যেখানে সে যত্নে করে একটা অ্যাডেনিয়াম আর একটা অ্যালোভেরা নিজের সামর্থের মধ্যে বপন করে, বাঁচিয়ে রাখে, মনে মনে ভাবে, কিছু অক্সিজেন ফিরিয়ে দিলাম আমার বাতাসে। সেখানে আমাদের একটা জয়ের ভাবনা সূচিত হয়। ছাদ আমাদের বড্ড জরুরি, সেই ছাদ আমরা আমাদের মনে তৈরি করে নিজেকে লড়াইয়ের ময়দানে রাখতে চাইছি, সেখানে শ্যাওলার পাশে শিশির থাকবে, প্রেমের পাশে প্রত্যাখ্যান থাকবে, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার থেকে এগিয়ে থাকবে মাথা উঁচু করে জীবনকে আলিঙ্গন করার সাহস। আমার কোন ছাদ চাই না, আমার ছাদের নিচে মাথা উঁচু করে বাঁচার ঔদ্ধত্য চাই। সবাই জেগে থাকুক ছাদ হীন বা ছাদ সহ।
লেখক পরিচিতি
জীবনানন্দের রূপসী বাংলা পাঠ্যটি বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালবাসার অভিমুখ বদলে দিলেও, বাড়ির বিজ্ঞান চাপে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করে নানা ঘাটের জল খেয়ে এখন একটি তথ্য প্রযুক্তি সংস্থায় থিতু। কিন্তু থিতু বল্লেই তো থিতু হওয়া যায় না, চারদিকে যা ঘটে চলেছে, তার প্রভাব শিল্প সাহিত্যের মধ্যে পড়তে বাধ্য। সেই চাপের সাথে যুঝতে এবং দুটো কথা নিশ্চিন্তে বলার আরেক মাধ্যম ছবিকেও সাথে নিয়েছে । ছোটবেলার পাড়ার ক্লাবের রবিবারের অঙ্কন প্রশিক্ষণ কাজে লেগে গেছে। আর্ট ছাড়া এই পৃথিবী মিথ্যে, আর সেই আর্ট মানুষকে শক্তি দেবে, প্রতিবাদের ভাষা দেবে, মানুষের যন্ত্রণার পাশে থাকার অঙ্গীকার করাবে, এই বিশ্বাসে আস্থা রাখতে চায় অর্ণব। অর্ণব মুক্ত চিন্তা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর আর্টের সর্বত্র গামিতায় বিশ্বাস রাখে ও সেই বিশ্বাস নিয়ে থিতু হয়ে থাকে।