অপরাজিতা ভট্টাচার্য 


হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলা


স্মৃতির সরণি বেয়ে ছোটবেলায় ফিরে গেলে দেখা যায়, বেশ অনেকখানি মন সেখানে ফেলে এসেছি। কলকাতার বাইরের সেই ছোট্ট মফস্বল শহরটাতে। সেখানকার রূপ-রস-গন্ধ এখনো আমার মনে এক গভীর, নরম জায়গা করে আছে।

          ছোটবেলার কথা ভাবলে প্রথমেই মনে পড়ে আমাদের তিনতলার সেই একচিলতে ফ্ল্যাট বাড়িটা। এক ফালি বারান্দা, লোহার রেলিং-এর উপর গ্রিল দিয়ে ঘেরা। তাতে ছোটো ছোটো টব এ হলদে-বেগুনি রেশমের মত ফুল ফুটত। পুব দিকের খোলা জানলা দিয়ে পুরনো স্কুলবাড়িটার গা ঘেঁষে একটা লম্বা নারকেল গাছ ছিল। হাওয়া দিলে তার পাতাগুলো কেমন অদ্ভুত দেখাত, রাতের অন্ধকারে ওদিকে তাকালে গা ছম-ছম করত যেন ।

           মেইন গেটের বাইরে নীচে রাস্তা দিয়ে জয়ন্ত কাকুর বই-খাতার দোকান, ইস্তিরির গুমটি, আর বিশাল ফটক দিয়ে ঘেরা দক্ষিণ দিকের খোলা মাঠটা, আজও ছবির মত মনে পড়ে। বাবার সাথে সাইকেল এর সামনের ছোট সিট-এ বসে সেসব রাস্তা-ঘাট , বাজার-চত্তর, গঙ্গার তীর চষে ফেলেছিলাম প্রায়।

             বর্ষাকালে, রথের সময়টা বেশ একটা আনন্দের ঢেউ উঠত। ছোটো ছোটো একতলা, দোতলা এমন কি তিনতলা অবধি রথ আসত আমার জন্য। তাকে ফুল আর wrapping পেপার দিয়ে সাজিয়ে মাটির জগন্নাথ বসিয়ে উঁচু-নীচু পাথুরে রাস্তার উপর টানা হত। সে দু-পা না যেতেই জগন্নাথ যেত উল্টে। রথের সময় আবাসনে পিকনিক হত। সন্ধ্যাবেলায় ছাদে বসে জিলিপি-পাঁপড় ভাজা খাওয়ার স্বাদ-ই ছিল আলাদা।

             তখন আমরা kindergarten-এ nursery rhymes শিখ্তাম আর দিনভর সেগুলো আওড়াতাম। দেয়ালের চক দিয়ে আঁক কেটে কাঠের স্কেল দিয়ে মিছিমিছি রেলিঙ্ গুলোকে পেটাতাম।

             সেখানকার ফুলে-ফলে লতায় পাতায় একটা অদ্ভুত গন্ধ মিশে থাকত। একটা ভীষণ তৃপ্তি ছিল জায়গাটার প্রতি। যত দূরেই যাই না কেন সবথেকে সুখের, সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা ওটাই আমার কাছে।

                সেখানকার বাতাস ছিলো অন্যরকম। কলকাতার নিশ্বাস বন্ধ করা দমকা হাওয়ার মতো নয়। রাতের খোলা আকাশের দিকে তাকালে বহুধা বিস্তৃত অনন্ত জগত যেন চকিতে ছুঁয়ে যেত। নিশুতি রাতে শেয়ালের একটানা চিৎকার কানে আসত । তারপর গরম লেপের ভিতরে শুয়ে কড়িকাঠের ঘড়ির টিক-টিক  শব্দ  শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়তাম টেরই পাওয়া যেতো না।


পিছন ফিরে হঠাৎ দেখি

ইচ্ছেপুরে ওই যে কে?

রয়েছে দেখি মনের সুখে

হাসছে কেমন খিলখিলিয়ে ।


ফুরিয়ে গেছে তোমার সাথে

আমার যতো খুনশুটিরা,

চলতে গিয়ে  থমকে গেল

স্বপ্ন রঙিন কল্পকেরা।


যাচ্ছো কোথায়?

চলো আমায় নিয়ে

ইচ্ছে মত বেড়াই ঘুরে ঘুরে,

তেপান্তরের ইচ্ছেটুকু নিয়ে -

ইচ্ছেহারা অবাক অচিনপুরে।