শীতলক্ষ্যার ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক গুরুত্ব
শীতলক্ষ্যা নদী শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলাদেশের পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলের মানুষের জন্য জল ও জীবনের উৎস ছিল। এ নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলো নারায়ণগঞ্জসহ আশেপাশের অঞ্চলের শিল্পায়ন ও নগরায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ইতিহাস জানায়, শীতলক্ষ্যার জলে নৌযান চলাচল ও পণ্যবহন বহু শতক আগে থেকেই ছিল। নদীর তীরে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির সঙ্গে নদীর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
দূষণের শুরুর অবস্থা
কিন্তু গত কয়েক দশকে শীতলক্ষ্যার চিত্র একেবারে পালটে গেছে। নারায়ণগঞ্জসহ আশেপাশের শিল্পাঞ্চল থেকে বর্জ্য জল সরাসরি নদীতে প্রবাহিত হওয়ায় নদীর পানি ধীরে ধীরে বিষাক্ত হতে শুরু করে। গার্মেন্টস, ডাইং ফ্যাক্টরি, কেমিক্যাল শিল্পসহ বিভিন্ন কারখানা থেকে নিষ্কাশিত দূষিত পানি নদীর প্রবাহকে তীব্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এসব বর্জ্যের কারণে নদীর পানি এখন কালচে, ঘোলা এবং দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে পড়েছে।
শুধু তাই নয়, নদীর তীরে গৃহস্থালি আবর্জনা ফেলা, অবৈধ দখল ও নদীর খনন না করায় শীতলক্ষ্যার জলবাহী ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। নদীর অনেক জায়গায় ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমে গিয়ে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে।
দূষণের প্রধান কারণ
শিল্প বর্জ্য
নারায়ণগঞ্জে ৩১৮টি শিল্পকারখানা থেকে প্রতিদিন ১৫ কোটি লিটার অপরিশোধিত বর্জ্য (ডাইং, কেমিক্যাল, পলিথিন)।
৫,০০০+ শিল্পপ্রতিষ্ঠান (সিদ্ধিরগঞ্জ, ডেমরা, শ্যামপুর) বর্জ্য নিষ্কাশন করে।
ইটিপি (ETP) প্ল্যান্ট থাকলেও ৯০% প্রতিষ্ঠান সেগুলো চালায় না।
গৃহস্থালি বর্জ্য: নর্দমা ও খালের মাধ্যমে প্রতিদিন কয়েক কোটি লিটার পয়ঃনিষ্কাশন মিশছে।
কম স্রোত: শুষ্ক মৌসুমে দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়।
এ নিয়ে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন
নদীর জীববৈচিত্র্য সংকট ও পরিবেশগত প্রভাব
শীতলক্ষ্যার পানিতে দ্রবীভূত বিষাক্ত পদার্থ ও বর্জ্যের উপস্থিতিতে নদীর জীববৈচিত্র্য মারাত্মক সংকটে পড়ে। মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে। মৎস্য আহরণ ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে, যা স্থানীয় মৎসজীবীদের জীবিকা নির্বাহেও প্রভাব ফেলেছে। দূষিত পানির কারণে নদীর আশেপাশের কৃষিজমিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এছাড়াও, শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণের ফলে জনস্বাস্থ্যের ওপরও মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা নানা ধরনের ত্বক রোগ, শ্বাসকষ্ট ও পাচনতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। নদীর দূষিত পানি ব্যবহার ও গোসল জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ।
প্রশাসনিক উদ্যোগ ও জনসচেতনতা
বর্তমানে শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণ রোধে বিভিন্ন সরকারি ও বিচারিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। বাংলাদেশ হাইকোর্ট শীতলক্ষ্যা নদীর দূষণ রোধে একটি বিশেষ পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। বিআইডব্লিউটিএ ও পরিবেশ অধিদফতর নদীর দূষণ কমানোর জন্য নিয়মিত মনিটরিং এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করছে।
তবে স্থানীয় প্রশাসনের সক্ষমতা ও শিল্প মালিকদের অংশগ্রহণ না হলে নদীকে রক্ষা করা কঠিন হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পরিবেশকর্মীরা নদী পরিচর্যা, বর্জ্য নিষ্পত্তি ও নদী দূষণ রোধে জনমাধ্যম ও সমাজকে বিভিন্ন ভাবে সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানাচ্ছেন।
ইটিপি প্লান্ট ব্যবহার না করে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে
নদীতে পড়ছে কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি
করণীয়
শীতলক্ষ্যা নদীকে স্বাভাবিক গতিতে ফিরিয়ে আনার জন্য দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট স্থাপন বাধ্যতামূলক করা, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, নদী পাড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, নিয়মিত নদীর খনন কাজ করা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবী। একইসঙ্গে, নদী রক্ষায় সরকার, শিল্প মালিক, পরিবেশবিদ ও স্থানীয় জনগণের সমন্বিত প্রয়াস প্রয়োজন।
ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
নদী যদি আজকের দূষণ থেকে রক্ষা না পায়, তবে শীতলক্ষ্যা হয়তো শিগগিরই মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত হবে। যা শুধু নারায়ণগঞ্জ বা ঢাকা অঞ্চলের জন্য নয়, গোটা দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্যও ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে। তাই শীতলক্ষ্যা নদীর করুণ অবস্থা আমাদের সবাইকে জেগে উঠতে ও নদী রক্ষায় দৃঢ় প্রত্যয়ে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা উচিত।