১. যখন সংসারে দেখার মত কিছুই থাকে না, তখন মানুষ ঈশ্বর এর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
২. জদি কোন ঘটনার মানুষ ভয়প্রাপ্ত হয় তবে তার পরাজয়ই হয়। আর জে মানুষ সব হারিয়েও শান্ত আর একাগ্র থাকে সেই জয়ী।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
৩. বাস্তবে না পরিচয় মানুষের দেহের সাথে যুক্ত থাকে না তো সম্পর্কের ভিত্তি তার দেহের সাথে যুক্ত থাকে। মানুষের স্বভাব, তার আচরণ আর তার কার্যই তার পরিচয়।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
৪. দান তাকেই বলে জাতে দানী হারায় আর যাচক প্রাপ্তি লাভ করে। কিন্তু বলিদান সেটাই হয় যা দানী দেয় আর সমস্ত জগৎ প্রাপ্ত করে।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
৫. সমুদ্র হোক বা সংসার যে ধর্মের নৌকা প্রস্তুত করে সে ঠিক পার হয়ে যায়।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
৬. সময় কখনও মানুষের নির্দেশিত পথে চলে না, মানুষকে সময়ের নির্দেশিত পথে চলতে হয়।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
৭. প্রত্যেক স্ত্রী-লোক মাতা দূর্গার আরেক রূপ হয়। যে স্ত্রী লোকের সম্মান করে না, তার সামর্থই বৃথা।
-(মহারথী অর্জুন)
৮. ধর্মের উপদেশ দেয়া যায়, আদেশ কিছুতেই দেয়া যায় না। সকলকে নিজের ধর্ম স্বয়ং নিশ্চিত করতে হয়।
-(বেদব্যাস)
৯. যে বস্তু সহজেই লাভ করা যায়, সে বস্তুর প্রতি মানুষের মূল্যবোধ থাকে না।
-(মহামন্ত্রী বিদুর)
১০. চরিত্রের পরিক্ষা তখনই হয়, যখন অপরিচিত কারো সংস্পর্শে আসা হয়।
-(মহামহিম ভীষ্ম)
১১. জয়ের জন্য বলের চেয়ে অধিক ছলের প্রয়োজন।
-(শকুনি)
১২. সুগন্ধ, দুরগন্ধ ও মানুষের স্বভাব কখনো গোপন থাকে না।
-(শকুনি)
১৩. পরিস্থিতিকে যদি নিজের অনূকুলে না আনতে পার, তবে তাকে শত্রুর প্রতিকুল বানিয়ে ফেলো।
-(শকুনি)
১৪. যারা শত্রুর শত্রু হয়, তাদের সাথে বন্ধুত করতে হয়।
-(শকুনি)
১৫. যেখানে বল কাজ করে না, সেখানে ছল কাজ করে।
-(শকুনি)
১৬. বিরোধিতা শক্তির প্রমাণ হয় না। শক্তিমান সেই যে সহনশীল, সহ্য করতে পারে। যখন হৃদয় থেকে ক্রোধ আর বিরোধিতা দূর হয়ে যায়, তখন সহনশক্তি ধর্মের শক্তিতে পরিণত হয়।
ক্রোধ থেকে প্রতিশোধের জন্ম হয় আর ধর্ম থেকে ন্যায় জন্মায়। তোমার জীবনেও যদি এমন সময় আসে, যখন তোমার উপর কোন অন্যায় হয় তবে ন্যায় করার পূর্বে নিজের ক্রোধের উপর অঙ্কুশ অবশ্যই রেখো।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
১৭. মনুষ্য এই ভ্রমে থাকে যে সকল নির্ণয় সে স্বয়ং করছে। কিন্তু চোখে আবেগের অবকুন্ঠন বেঁধে যারা আছে তারা স্বয়ং নির্ণয় কি করে করতে পারে? বাস্তবে সব নির্ণয় নিয়তিই করে।
-(বেদব্যাস)
১৮. যে বৃক্ষ তিক্ত-ফল দান করে সে বৃক্ষকে উৎপাটন করে মধুর ফল প্রদানকারী বৃক্ষকে রোপন করতে হয়। ওই বৃক্ষকেই অধিক খাদ্য গ্রহন করিয়ে বা শাখা প্রশাখাকে কাট-ছাট করলে মধুর ফল পাওয়া যায় না।
ভবিষ্যৎকে শুদ্ধ করার জন্য এই অশুদ্ধ বর্তমানকে ধ্বংস করা অনিবার্য। ভবিষ্যতের উদীয়মান সূর্যের প্রথম কিরনকে দেখো। যা সবার জন্য প্রতিক্ষা করছে।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
১৯. অধিকতর আত্মা নিজের দেহকেই সব কিছু বলে গণ্য করে, স্বয়ং দেহ থেকে যে ভিন্ন তা জানতেই পারে না শরীরের যে দুঃখ, সুখ, স্বাদ। গন্ধ আদির অনুভব হয় তাকেই নিজের অনুভব মেনে নেয়, আর পরিবর্তনের প্রয়াসই করে না।
যে আত্মা পরিবর্তনের প্রচেষ্টাই করে না, নিরন্তর অধর্ম করে চলে তাকে জাগ্রত করার জন্য দন্ড দেয়া অনিবার্য। তুমিও এটা জেনে নাও যে তুমিও কোন শরীর নও, কেবল মাত্র এক আত্মা।
এই পৃথিবীতে পরিলক্ষিত সকল মানুষ তা নয় যা তুমি ওদের গণ্য করছ, কিছু সময়ের জন্য এরা শরীরে বসবাস করছে মাত্র। এদের শরীরের মৃত্যু হবে কিন্তু এরা সবাই অমর। সে পুনরায় নতুন শরীর ধারন করবে।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
২০. প্রেম উন্নতি দেয়, উচিৎ অনুচিতের জ্ঞান দেয়। প্রেম আর মোহের মাঝে পার্থক্য থাকে। বাস্তবে যা প্রেম, তা কোন মোহ নয়। প্রেমের জন্ম করুণা থেকে হয়, আর মোহের জন্ম অহংকার থেকে। প্রেম মুক্তি দেয়, মোহ আবদ্ধ করে। প্রেম ধর্ম, আর মোহ অধর্ম।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
২১. নির্ণয় নেয়ার মুহুর্তে আমরা সর্বদা কোন অন্য ব্যক্তির উপদেশ, সুচনা বঞ্চনা বা পরামর্শকে আধার করে থাকি।
আর আমাদের ভবিষ্যতের আধার হয়ে থাকে আমাদের আজকের নেয়া সিদ্ধান্ত। তাহলে কি আমাদের ভবিষ্যৎ অন্য ব্যক্তির পরামর্শ, কোন অন্য ব্যক্তির দেয়া উপদেশের ফল? তবে কি আমাদের সম্পূর্ণ জীবন কোন অন্য ব্যাক্তির বুদ্ধির পরিনাম? আমরা কি কখনও বিচার করেছি?
সবাই জানে যে ভিন্ন ভিন্ন লোক একই পরিস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকে। মন্দিরে দাড়ানো ভক্ত বলে দান করা উচিৎ। আর চোর বলে যদি সুযোগ পাওয়া যায় তবে ঐ মূর্তির গয়না চুরি করা উচিৎ। ধার্মিক হৃদয় ধার্মিক উপদেশ দিয়ে থাকে আর অধর্ম-ভরা হৃদয় অর্ধামিক পরামর্শ দেয়।
এই ধর্মময় উপদেশ পরামর্শ স্বীকার করলে মানুষ সুখের দিকে যায়। কিন্তু এইরকম পরামর্শ স্বীকার করার আগে স্বয়ং নিজের হৃদয়ে ধর্মকে স্থাপন করা কি অনেক বেশি জরুরী নয়? স্বয়ং বিচার করুন।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
২২. মানুষের সব সম্পর্কের আধার হল প্রত্যাশা। পতি কেমন হবে- যে আমার জীবন সুখ আর সুবিধায় ভরে দিবে। পত্নী কেমন হবে- যে সর্বদা আমার প্রতি সমর্পিত থাকবে।
সন্তান কেমন হবে- যে আমার সেবা করবে, আমার আদেশ মেনে চলবে। মানুষ প্রেম তাকেই দিতে পারে, যে তার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে। আর প্রত্যাশার নিয়তিই হচ্ছে ভঙ্গ হওয়া। কিভাবে? কারন- প্রবল ইচ্ছা থাকলেও কোন মানুষ কারোর সকল প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারে না।
আর তার থেকেই জন্ম নেয় সংঘর্ষ। সকল সম্পর্ক সংঘর্ষে পরিবর্তিত হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ যদি প্রত্যাশাকে সম্পর্কের আধার না বানায়, আর স্বীকার করে যে, কেবল সম্পর্কই মূল আধার। তবে কি জীবন আপনা থেকেই সুখ আর শান্তিতে ভরে যাবে না। স্বয়ং বিচার করে দেখুন।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
২৩. যখনই মানুষের জীবনে কোন বিরূপ পরিস্থিতি আসে মানুষ তখনই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে। ঈশ্বরের সম্মুখে মিনতি করে যেন সে পরিস্থিতি থেকে নিস্তার পায়।
কিন্তু এই প্রার্থনার বাস্তবিকরূপ কেমন হয়? সেটা কি আমরা কখনও বিবেচনা করেছি? প্রার্থনার অর্থ হল নিজের সমস্ত আকাঙ্খা, সমস্ত চিন্তা, সমস্ত সংকল্প, সমস্ত পরিকল্পনা ঈশ্বরের চরনে দান করা।
অর্থাৎ নিজের কর্মেল ফল কি হবে সেই নিয়ে চিন্তা না করে ধর্মের অনুরূপ কর্ম করা। ঈশ্বরের পরিকল্পনাকেই নিয়তি বলে মেনে নেয়া সেটাই তো প্রার্থনা, তাই না? কিন্তু ঈশ্বরের সমস্ত পরিকল্পনা বোজাটা সম্ভব কি? সেসব পরিকল্পনা তো আমাদের কর্মের পরিনামস্বরূপ প্রকাশ পায় সর্বদা।
কিন্তু যদি কেউ সবকর্মকেই ত্যাগ করে, সেটা কি প্রকৃত প্রার্থনা? বাস্তবে কর্মই জীবন আর ফলের প্রতি মোহ না করাই সত্যিকারের প্রার্থনা। যে প্রার্থনা কর্মের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, মানুষকে কার্যই করতে না দেয়, সেটা প্রার্থনা না পরাজয়? স্বয়ং বিচার করুন।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
২৪. যখন নিজের কোন ভাল কাজের বদলে দুঃখ লাভ হয়, অথবা কেউ দুঃস্কর্ম করেও সুখ লাভ করে, তাহলে মন অবশ্যই এ ভাবতে বসে যে, তাহলে ভাল কাজ করা, ধর্মের পথে চলার তাৎপর্যটা কি?
কিন্তু দুরাত্মাকে কি ভোগ করতে হয় সেটাও দেখুন। দুঃস্কর্ম যে করে তার মন সর্বদা চঞ্চল থাকে, ব্যাকুল হতে থাকে, মনে সর্বদা নতুন নতুন সংঘর্ষ উৎপন্ন হয়। অবিশ্বাস তাকে সারাজীবন ছোটাতে থাকে, একে কি সুখ বলে? যে ব্যাক্তি ধর্মের পথে চলে সর্বদা সুকর্মে লিপ্ত থাকে।
সৎ চরিত্রের অধিকারী হৃদয় বর্সদা শান্ত থাকে। পরিস্থিতি তার জীবনের সুখের বাধা হয়ে দ্বারায় না। সমাজে তার সম্মান আর মনের সন্তোষ অক্ষেত থাকে সর্বদা।
অর্থাৎ ভালো ব্যাবহার ভবিষ্যতে সুখের পথ দেখায় না, ভালো ব্যাবহার নিজেই সুখ দেয়। অপরদিকে দুরব্যাবহার ভবিষ্যতে দুঃখের পথ দেখায় না, অধর্ম সেই মুহুর্তে দুঃখকে উৎপন্ন করে। ধর্ম থেকে সুখ পাওয়া যায় না, ধর্মই স্বয়ং সুখ।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
২৫. ভবিষ্যৎ তো প্রতিদিন, প্রতিক্ষনে নির্মিত হয়। ভবিষ্যৎ যে কিছু নয়। মানুষের আজকের নির্ণয় ও কর্মের পরিনাম আগামীর ভবিষ্যৎ। আপনি যদি আজ কোন নির্ণয় করে সন্তোষ বোধ করেন, তবে বিশ্বাস রাখুন ভবিষ্যতে অবশ্যই তার থেকে সুখ লাভ হবে।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
২৬. যে স্বাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আহারকেই ত্যাগ করে বাস্তবে তার মন থেকে স্বাদের লালসা কখনোই যায় না। তার দু-প্রকারের হানি হয়। প্রথমত সে দুর্বল হয়ে পরে। যার কারণে পরমাত্মাকে প্রাপ্ত করার জন্য যে প্রসেচষ্টা অনিবার্য তা সে করতে সক্ষম হয় না।
আর দ্বীতিয়ত- সর্বদাই তার মন স্বাদ গ্রহণের লালশায় পূর্ণ থাকে। এই হেতু আহার ত্যাগের চাইতে উত্তম কার্য স্বাদ গ্রহণের লালশাকেই ত্যাগ করে ফেলঅ।
কর্মযোগী নিজের মনের সমস্ত লালশাকে নিষ্কাশন করে, জীবনেকে কর্তব্য মনে করে কার্য অবশ্যই করে, সেই কার্যে আবদ্ধ হয় না। অর্থাৎ যে ব্যাক্তি নিজের কার্য থেকে আশা বা আকাঙ্খরা রাখে না তারই কার্য পূর্ণ হয়।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
২৭. ভয় কী?
মানুষের জীবনে ভয়ের বসত করে সর্বদাই, কখনও সম্পত্তি নাশের ভয়, কখনও অপমানের ভয়, কখনও আপন জনের সাথে বিচ্ছেদের ভয়। এ কারণেই ভয়ের অস্তিত্ব সবার একই রকম মনে হয়।
কখনও কি বিবেচনা করেছেন- যে কোনো পরিস্থিতি বা বস্তু ভয়ের জন্ম দেয়। তার থেকে বাস্তবে দুঃখ তৈরি হয়? না এমন কোন নিয়ম নেই, আর সবার অভিজ্ঞতা তো এই বলে- ভয় ধারন করলেই ভবিষ্যতের দুঃখের নিবারণ কমে।
ভয় কেবল আগামি দুঃখের কল্পনা মাত্র। বাস্তবের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ভয় আর কিছু নয়, কেবল কল্পনা মাত্র। ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া কি খুব কঠিন কাজ? অবশ্যই বিচার করে দেখুন।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
২৮. পূর্ব পুরুষদের ইচ্ছা, আশা, মহৎ আকাঙ্খা, ক্রোধ, বিবাধ, প্রতিশোধ এ সব কিছুর ভার নতুন প্রজন্মকে বহন করতে হয়। মাতা-পিতা নিজের সন্তানকে দিতে তো চান বিশ্বের সমস্ত সুখ, কিন্তু দিয়ে ফেলেন নিজের জমানো পীরার সত্তা।
দিতে চান অমৃত, কিন্তু সাথে সাথে বিষের ঘড়াও পূর্ণ করে দিয়ে জান। আপনি বিচার করুন আপনি আপনার সন্তানকে কি দিয়েছেন জীবনে? অবশ্যই প্রেম, জ্ঞান, সম্পত্তি এসব দিয়ে থাকবেন।
কিন্তু তার সাথে সাথে ওদের মনে বিষ দেননি তো? পূর্ব শর্ত দিয়ে ভালমন্দের পূর্ব পরিকল্পিত ব্যাখ্যা দেন নি তো? ব্যাক্তির সাথে ব্যাক্তির, সমাজের সাথে সমাজের রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের এ সংঘর্ষ পূর্ব ব্যাখ্যার থেকে নির্মিত নয় কি? হত্যা, মৃত্যু, রক্তপাত,
এসব কি পূর্বব্যাখ্যা প্রেমের প্রকাশের সাথে ঘৃনার অন্ধকার ও উপহার দেন। অন্ধকার মনের হোক,হৃদয়ের হোক বা বাস্তবিক হোক, তার থেকে কেবল ভয়ের উৎপত্তি হয়। কেবল ভয়। স্বয়ং বিচার করুন।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
২৯. কখনও কখণও কোন ঘটনা মানুষের জীবনের সকল পরিকল্পনা ভেঙ্গে দেয়। আর মানুষ সেই আঘাতকেই জীবনের কেন্দ্র বানিয়ে নেয়। কিন্তু ভবিষ্যৎ কি মানুষের পরিকল্পনার আধারে নির্মিত হয় না।
যেভাবে কোন উচু পর্বতে যে ব্যাক্তি সর্বপ্রথম চড়ে সেই পর্বতের পাদদেশে বসে সে যা পরিকল্পনা করে সেই পরিকল্পনাই কি তাকে পর্বতের শিখরে পৌছে দিতে পারে? না, বাস্তবে যত উপরে ওঠে তত নিত্যনতুন পরীক্ষা নতুন বিরম্বনা নতুন ধরনের অবরোধের সম্মুখীন হয়।
প্রত্যেক পদে তার পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতে হয়। প্রত্যেক পদে তাকে পরিকল্পনা বদলাতে হয়। না হলে যদি পুরাতন পরিকল্পনা তাকে ক্ষাদের দিকে ঠেলে দেয়। সে পর্বতকে নিজের যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে না। কেবল নিজেকে পর্বতের যোগ্য তৈরি করার চেষ্টা করতে পারে।
আচ্ছা জীবনের ক্ষেত্রে তো এমনি হয়, তাই না? যখন মানুষ তার কোন একটি ক্ষেত্রে বাঁধা, কোন একটি অবরোধকে জীবনের কেন্দ্র বানিয়ে নেয়, নিজের জীবনের গতিই থামিয়ে দেয়, তখন সে তার জীবনে সফল হতে পারে না। পারে না সুখ আর শন্তি প্রাপ্ত করতে। অর্থাৎ জীবনকে নিজের যোগ্য করে তোলার বদলে স্বয়ং নিজেকে জীবনের যোগ্য গড়ে তোলাই কি সাফল্য আর সুখের একমাত্র মার্গ নয়? স্বয়ং বিচার করুন।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
৩০. সন্তানদের ভবিষ্যৎ সুখে ভরিয়ে তোলার চেষ্টা। এই তো প্রত্যেক মাতা-পিতার প্রথম কর্তব্য। যাদের আপনি এই সংসারে এনেছেন, যাদের কর্মের দ্বারা আপনারও পরিচয় পাবে ভবিষ্যতে।
তাদের ভবিষ্যৎ সুখদায়ক করার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ আর কিইবা হতে পারে? কিন্তু সুখ আর সুরক্ষা এসব কি মানুষের কর্ম থেকেই প্রাপ্ত হয় না?
মাতা-পিতার দেয়া ভাল বা মন্দ সংস্কার বা তাদের সুরক্ষা এসব কি মানুষের কর্ম থেকেই প্রাপ্ত হয় না? মাতা-পিতার দেয়া ভাল বা মন্দ সংস্কার বা তাদের দেয়া যোগ্য অথবা অযোগ্য শিক্ষা এ সবই কি আজকের সমস্ত কর্মের মূল নয়?
সংস্কার আর শিক্ষা থেকে তৈরি হয় মানুষের চরিত্র। অর্থাৎ মাতা-পিতা যেমন তার সন্তানদের চরিত্র নির্মাণ করেন তেমনই হয় তার ভবিষ্যৎ। কিন্তু তবুও অধিকতর মাতা-পিতা নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার চিন্তায় তাদের চরিত্র নির্মাণের কার্যের কথা ভুলেই জান।
বস্তুত যে মাতাপিতা কেবল নিজের সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেন তার চরিত্রের নির্মাণ করেন সেই সন্তানের প্রশস্তি বিশ্বসংসার করে। স্বয়ং বিচার করুন।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
৩১. সমাজে সর্বদাই স্ত্রী- লোকদের সাথে অন্যায় হয়। মানব সমাজ স্ত্রী- লোককে সর্বদা শোষণ, অন্যায় আর অপমান দিয়েছে।
আপনারা নিজেদের আশেপাশে দেখুন, সমগ্র ইতিহাসকে দেখুন এই একই রূপ দেখা যাবে যে পুরুষের ঈর্শা, অহংকার, বৈরিতা, লালসা, এই সব কুচিন্তার পরিনাম স্ত্রী-লোকই ভোগ করে। যুদ্ধ পুরুষ করে আর পরাজিত নগরে স্ত্রী-লোকের সাথে বলাৎকার করা হয়।
পুরুষ মদ্যপান ও দূতক্রীরায় নিজের সম্পত্তি হারায়, আর স্ত্রী- লোকদের ভাগ্যে নেমে আসে ক্ষুধা। পুরুষের অহংকার ক্ষুন্ন হয় আর স্ত্রী লোকের স্বাধীনতা ও সুখে বাঁধা উৎপন্ন হয়ে যায়।
পুরুষ জীবনে পরাজিত হয়ে পরিবারকে ত্যাগ করে আর স্ত্রী নিজের সন্তানদের ক্ষুধা নিবারনের তারনে সংঘর্ষ করতে থাকে। সমগ্র সংসারের দুঃখের হিসাব করুন স্পষ্ট দেখতে পাবেন যে পুরুষের তুলনায় স্ত্রী-লোক অধিকতর দুঃখ ভোগ করে।
এ কোন প্রকারের সমাজ রচনা করেছি আমরা? যেখানে মনুষ্যজাতীর অর্ধেক ভাগ অপর অর্ধেক ভাগকে নিরন্তর পদদলিত করছে। আর সেই পদলিত স্ত্রী-লোক মানুষের ভবিষ্যতের জন্মদায়িনী?
সৃষ্টিকে দেখুন- নতুন বৃক্ষকে জন্মদানকারী বীজের আসপাশে ঈশ্বর ফুলের পাপরী নির্মাণ করেছেন। তাকে রং ও সুগন্ধ দিয়ে ভরে দিয়েছেন। যেখানে ভবিষ্যতের জন্ম হয় সেখানে তো কেবল মাত্র সৌন্দর্য, কেবল সুখ সন্তোষ ও সম্মান হওয়া আবশ্যক নয় কি? কিন্তু সমাজ স্ত্রী- লোককে দুঃখ দিয়ে সমস্ত ভবিষ্যৎকে দুঃখ দ্বরা পূর্ণ করতে থাকে।
প্রহার, শোষণ, পীরা এই সবে ঝলসে যাওয়া স্ত্রী- লোক স্বাস্থবান সুখী সন্তানের জন্ম কোন প্রকারে দেবে? অর্থাৎ যে যে সময় কোন স্ত্রী- লোকের অপমান হয়, কোন স্ত্রী-লোক এর উপর শোষণ হয়,
কোন নারীর কেশ আকর্ষন করা হয় সেই সময় কোন না কোন রূপে এক যুদ্ধের জন্ম হয়। কোন না কোনভাবে মহাভারতের আরম্ভ হয়। স্বয়ং বিচার করুন। বারংবার বিচার করুন।।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
৩২. সুখের কামনা যে করে তার সুখ লাভ হয় না, যে সুখ চিনতে পারে তারই সুখ লাভ হয়। তুমি যদি এটা জেনে যাও যে তোমার জন্য সুখ কি, তবে তুমি সুখ অবশ্যই পাবে।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
৩৩. যে কেবল নিজের পীরাকে আপন করে জীবন কাটায়, সে শক্তিহীন হয়ে পরে। কিন্তু যে ব্যাক্তি সমগ্র সমাজের পীরাকে আপন হৃদয়ে ধারণ করে জীবন কাটায়, সে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
৩৪. সুখ তো উপলব্ধী করার বস্তু, প্রাপ্ত করার বস্তু নয়। যে ব্যাক্তি বস্তুকে সুখ বলে মানে বাস্তবে তার সুখ প্রাপ্ত হয় না। যে সত্তা অথবা সম্পত্তিকে সুখ বলে গন্য করে সে অবশ্যই নিজের জন্য বিনাশকে আমন্ত্রণ জানায়।
-(ভগবান শ্রীকৃষ্ণ)
একাদশী কী? একাদশী পালনের নিয়ম, একাদশী মাহাত্ম্য
কৃষ্ণ ভুলি যেই জীব অনাদি বহির্মুখ।
অতএব মায়া তারে দেয় সংসারদুঃখ।।
শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে জীব অনাদিকাল ধরে জড়া প্রকৃতির প্রতি আকৃষ্ট রয়েছে। তাই মায়া তাকে এ জড় জগতে নানা প্রকার দুঃখ প্রদান করছে। পরম করুণাময় ভগবান কৃষ্ণস্মৃতি জাগরিত করতে মায়াগ্রস্ত জীবের কল্যাণে বেদপুরাণ আদি শাস্ত্রগ্রন্থাবলী দান করেছেন। ভক্তি হচ্ছে ভগবানকে জানার ও ভগবৎ প্রীতি সাধনের একমাত্র সহজ উপায়। শাস্ত্রে যে চৌষট্রি প্রকার ভক্ত্যাঙ্গের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে একাদশী ব্রত সর্বোত্তম।
শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ আদি নবধা ভক্তির পরই দশম ভক্ত্যাঙ্গরূপে একাদশীর স্থান। এই তিথিকে হরিবাসর বলা হয়। তাই ভক্তি লাভেচ্ছু সকলেই একাদশী ব্রত পালনের পরম উপযোগীতার কথা বিভিন্ন পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। একাদশী তিথি সকলের অভীষ্ট প্রদানকারী। এই ব্রত পালনে সমস্ত প্রকার পাপ বিনষ্ট, সর্বসৌভাগ্য ও শ্রীকৃষ্ণের প্রীতি বিধান হয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আট থেকে আশি বছর বয়স পর্যন্ত যেকোন ব্যক্তিরই ভক্তিসহকারে পবিত্র একাদশী ব্রত পালন করা কর্তব্য।
সঙ্কটজনক অবস্থা বা জন্মমৃত্যুর অশৌচে কখনও একাদশী পরিত্যাগ করতে নেই। একাদশীতে শ্রাদ্ধ উপস্থিত হলে সেইদিন না করে দ্বাদশীতে শ্রাদ্ধ করা উচিত। শুধু বৈষ্ণবেরাই নয়, শিবের উপাসক, সূর্য-চন্দ্র-ইন্দ্রাদি যেকোন দেবোপাসক, সকলেরই কর্তব্য একাদশী ব্রত পালন করা। দুর্লভ মানবজীবন লাভ করেও এই ব্রত অনুষ্ঠান না করলে বহু দুঃখে-কষ্টে চুরাশি লক্ষ যোনি ভ্রমণ করতে হয়
আরও পড়ুনঃ সকল একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
অহংকারবশত একাদশী ব্রত ত্যাগ করলে যমযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। যে ব্যাক্তি এই ব্রতকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, জীবিত হয়েও সে মৃতের সমান। কেউ যদি বলে “একাদশী পালনের দরকারটা কি?” সে নিশ্চয় কুন্তিপাক নরকের যাত্রী। যারা একাদশী পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে শনির কোপে তারা বিনষ্ট হয়। একাদশীকে উপেক্ষা করে তীর্থ স্থান আদি অন্য ব্রত পালনকারীর অবস্থা গাছের গোড়া কেটে পাতায় জল দানের মতোই।
একাদশী বাদ দিয়ে যারা দেহধর্মে অধিক আগ্রহ দেখায়, ধর্মের নামে পাপরাশিতে তাদের উদর পূর্ণ হয়। কলহ-বিবাদের কারণেও একাদশী দিনে উপবাস করলে অজ্ঞাত সুকৃতি সঞ্চিত হয়। পুণ্যপ্রদায়িনী সর্বশ্রেষ্ঠ এই ব্রত শ্রীহরির অতি প্রিয়। একাদশী ব্রত পালনে যে ফল লাভ হয়, অশ্বমেধ, রাজসূয় ও বাজপেয় যজ্ঞদ্বারাও তা হয় না। দেবরাজ ইন্দ্রও যথাবিধি একাদশী পালনকারীকে সম্মান করেন। একাদশী ব্রতে ভাগবত শ্রবণে পৃথিবী দানের ফল লাভ হয়। অনাহার থেকে হরিনাম, হরিকথা, রাত্রিজাগরণে একাদশী পালন করা কর্তব্য।
কেউ যদি একাদশী ব্রতে শুধু উপবাস করে তাতে বহু ফল পাওয়া যায়। শুদ্ধ ভক্তেরা এই দিনে একাদশ ইন্দ্রিয়কে শ্রীকৃষ্ণে সমর্পণ করেন। একাদশীতে শস্যমধ্যে সমস্ত পাপ অবস্থান করে। তাই চাল, ডাল, আটা, ময়দা, সুজি, সরিষা আদি জাতীয় খাদ্যদ্রব্য একাদশী দিনে বর্জন করা উচিত। নির্জলা উপবাসে অসমর্থ ব্যক্তি জল, দুধ, ফল-মূল, এমনকি আলু, পেপে, কলা, ঘিয়ে বা বাদাম তেল অথবা সূর্যমুখী তেলে রান্না অনুকল্প প্রসাদ রূপে গ্রহণ করতে পারেন। রবিশস্য (ধান, গম, ভুট্রা, ডাল ও সরিষা) ও সোয়াবিন তেল অবশ্যই বর্জনীয়। দশমী বিদ্ধা একাদশীর দিন বাদ দিয়ে দ্বাদশী বিদ্ধা একাদশী ব্রত পালন করতে হয়।
(দশমী বিদ্ধা একাদশী কি? জানতে এখানে ক্লিক করুন)
একাদশীতে সূর্যোদয়ের পূর্বে বা সুর্যোদয়কালে ( ১ঘন্টা ৩৬ মিনিটের মধ্যে) যদি দশমী স্পর্শ হয়, তাকে দশমী বিদ্ধা বলে জেনে পরদিন একাদশীব্রত পালন করতে হয়। মহাদ্বাদশীর আগমন হলে একাদশীর উপবাস ব্রতটি মহাদ্বাদশীতেই করতে হয়। একাদশী ব্রত করে পরের দিন উপযুক্ত সময়ে শস্যজাতীয় প্রসাদ গ্রহণ করে পারণ করতে হয়। শাস্ত্রবিধি না মেনে নিজের মনগড়া একাদশী ব্রত করলে কোন ফল লাভ হয় না। দৈববশত যদি কখনও একাদশী ভঙ্গ হয়ে যায়, তবে ক্ষমা ভিক্ষা করে পুনরায় ব্রত পালন করতে হয়।
ভোরে শয্যা ত্যাগ করে শুচিশুদ্ধ হয়ে শ্রীহরির মঙ্গল আরতিতে অংশগ্রহণ করতে হয়। শ্রীহরির পাদপদ্মে প্রার্থনা করতে হয়, “হে শ্রীকৃষ্ণ, আজ যেন এই মঙ্গলময়ী পবিত্র একাদশী সুন্দরভাবে পালন করতে পারি, আপনি আমাকে কৃপা করুন।” একাদশীতে গায়ে তেল মাখা, সাবান মাখা, পরনিন্দা-পরচর্চা, মিথ্যাভাষণ, ক্রোধ, দিবানিদ্রা, সাংসারিক আলাপাদি বর্জনীয়। এই দিন গঙ্গা আদি তীর্থে স্নান করতে হয়। মন্দির মার্জন, শ্রীহরির পূজার্চনা, স্তবস্তুতি, গীতা-ভাগবত পাঠ আলোচনায় বেশি করে সময় অতিবাহিত করতে হয়।
এই তিথিতে গোবিন্দের লীলা স্মরণ এবং তাঁর দিব্য নাম শ্রবণ করাই হচ্ছে সর্বোত্তম। শ্রীল প্রভুপাদ ভক্তদের একাদশীতে পঁশিচ মালা বা যথেষ্ট সময় পেলে আরো বেশি জপ করার নির্দেশ দিয়েছেন। একাদশীর দিন ক্ষৌরকর্মাদি নিষিদ্ধ। একাদশী ব্রত পালনে ধর্ম অর্থ, কাম, মোক্ষ আদি বহু অনিত্য ফলের উল্লেখ শাস্ত্রে থাকলেও শ্রীহরিভক্তি বা কৃষ্ণপ্রেম লাভই এই ব্রত পালনের মুখ্য উদ্দেশ্য। ভক্তগণ শ্রীহরির সন্তোষ বিধানের জন্যই এই ব্রত পালন করেন। পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, বরাহপুরাণ, স্কন্দপুরাণ ও বৈষ্ণবস্মৃতিরাজ শ্রীহরিভক্তিবিলাস আদি গ্রন্থে এ সকল কথা বর্ণিত আছে।
বছরে ছাব্বিশটি একাদশী আসে। সাধারণত বার মাসে চব্বিশটি একাদশী। এইগুলি হচ্ছে-
১. উৎপন্না একাদশী - ২. মোক্ষদা একাদশী
৩. সফলা একাদশী , - ৪. পুত্রদা একাদশী
৫. ষটতিলা একাদশী - ৬. জয় একাদশী
৭. বিজয়া একাদশী - ৮. আমলকী একাদশী
৯. পাপমোচনী একাদশী - ১০. কামদা একাদশী
১১. বরুথিনী একাদশী - ১২. মোহিনী একাদশী
১৩. অপরা একাদশী - ১৪. নির্জলা একাদশী
১৫. যোগিনী একাদশী - ১৬. শয়ন একাদশী
১৭. কামিকা একাদশী - ১৮. পবিত্রা একাদশী
১৯. অন্নদা একাদশী - ২০. পরিবর্তিনী বা পার্শ্ব একাদশী
২১. ইন্দিরা একাদশী - ২২. পাশাঙ্কুশা একাদশী
২৩. রমা একাদশী - ২৪. উত্থান একাদশী
কিন্তু যে বৎসর পুরুষোত্তমাস, অধিমাস বা মলমাস থাকে, সেই বৎসর পদ্মিনী ও পরমা নামে আরও দুটি একাদশীর আবির্ভাব হয়। যারা যথাবিধি একাদশী উপবাসে অসমর্থ অথবা ব্রতদিনে সাধুসঙ্গে হরিকথা শ্রবণে অসমর্থ, তারা এই একাদশী মাহাত্ম্য পাঠ বা শ্রবণ করলে অসীম সৌভাগ্যের অধিকারী হবেন।
পদ্মপুরাণে একাদশী প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। একসময় জৈমিনি ঋষি তাঁর গুরুদেব মহর্ষি ব্যাসদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে গুরুদেব! একাদশী কি? একাদশীতে কেন উপবাস করতে হয়? একাদশী ব্রত করলে কি লাভ? একাদশী ব্রত না করলে কি ক্ষতি? এ সব বিষয়ে আপনি দয়া করে বলুন।
মহর্ষি ব্যাসদেব তখন বলতে লাগলেন-সৃষ্টির প্রারম্ভে পরমেশ্বর ভগবান এই জড় সংসারে স্থাবর জঙ্গম সৃষ্টি করলেন। মর্ত্যলোকবাসী মানুষদের শাসনের জন্য একটি পাপপুরুষ নির্মাণ করলেন। সেই পাপপুরুষের অঙ্গগুলি বিভিন্ন পাপ দিয়েই নির্মিত হল। পাপপুরুষের মাথাটি ব্রহ্মহত্যা পাপ দিয়ে, চক্ষুদুটি মদ্যপান, মুখ স্বর্ণ অপহরণ, দুই কর্ণ-গুরুপত্নী গমন, দুই নাসিকা-স্ত্রীহত্যা, দুই বাহু-গোহত্যা পাপ, গ্রীবা-ধন অপহরণ, গলদেশ-ভ্রুণহত্যা, বক্ষ-পরস্ত্রী-গমন,উদর-আত্মীয়স্বজন বধ, নাভি-শরণাগত বধ, কোমর-আত্মশ্লাঘা, দুই উরু-গুরুনিন্দা, শিশ্ন-কন্যা বিক্রি, মলদ্বার-গুপ্তকথা প্রকাশ পাপ, দুই পা-পিতৃহত্যা, শরীরের রোম-সমস্ত উপপাতক।
এভাবে বিভিন্ন সমস্ত পাপ দ্বারা ভয়ঙ্কর পাপপুরুষ নির্মিত হল। পাপপুরুষের ভয়ঙ্কর রূপ দর্শন করে ভগবান শ্রীবিষ্ণু মর্ত্যের মানব জাতির দুঃখমোচন করবার কথা চিন্তা করতে লাগলেন। একদিন গরুড়ের পিঠে চড়ে ভগবান চললেন যমরাজের মন্দিরে। ভগবানকে যমরাজ উপযুক্ত স্বর্ণ সিংহাসনে বসিয়ে পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে যথাবিধি তাঁর পূজা করলেন। যমরাজের সঙ্গে কথোপকথনকালে ভগবান শুনতে পেলেন দক্ষিণ দিক থেকে অসংখ্য জিবের আর্তক্রন্দন ধ্বনি। প্রশ্ন করলেন-এ আর্তক্রন্দন কেন?
যমরাজ বললেন, হে প্রভু, মর্ত্যের পাপী মানুষেরা নিজ কর্মদোষে নরকযাতনা ভোগ করছে। সেই যাতনার আর্ত চীৎকার শোনা যাচ্ছে। যন্ত্রণাকাতর পাপাচারী জীবদের দর্শন করে করুণাময় ভগবান চিন্তা করলেন-আমিই সমস্ত প্রজা সৃষ্টি করেছি, আমার সামনেই ওরা কর্মদোষে দুষ্ট হয়ে নরক যাতনা ভোগ করছে, এখন আমিই এদের সদগতির ব্যবস্থা করব। ভগবান শ্রীহরি সেই পাপাচারীদের সামনে একাদশী তিথি রূপে এক দেবীমুর্তিতে প্রকাশিত হলেন। সেই পাপীদেরকে একাদশী ব্রত আচরণ করালেন। একাদশী ব্রতের ফলে তারা সর্বপাপ মুক্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ বৈকুন্ঠ ধামে গমন করল।
শ্রীব্যাসদেব বললেন, হে জৈমিনি! শ্রীহরির প্রকাশ এই একাদশী সমস্ত সুকর্মের মধ্যে শ্রেষ্ট এবং সমস্ত ব্রতের মধ্যে উত্তম ব্রত। কিছুদিন পরে ভগবানের সৃষ্ট পাপপুরুষ এসে শ্রীহরির কাছে করজোড়ে কাতর প্রার্থনা জানাতে লাগল-হে ভগবান! আমি আপনার প্রজা! আমাকে যারা আশ্রয় করে থাকে, তাদের কর্ম অনুযায়ী তাদের দুঃখ দান করাই আমার কাজ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি একাদশীর প্রভাবে আমি কিছুই করতে পারছি না, বরং ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছি। কেননা একাদশী ব্রতের ফলে প্রায় সব পাপাচারীরা বৈকুন্ঠের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছে।
হে ভগবান, এখন আমার কি হবে? আমি কাকে আশ্রয় করে থাকব? সবাই যদি বৈকুন্ঠে চলে যায়, তবে এই মর্ত্য জগতের কি হবে? আপনি বা কার সঙ্গে এই মর্ত্যে ক্রীড়া করবেন? পাপপুরুষ প্রার্থনা করতে লাগল- হে ভগবান, যদি আপনার এই সৃষ্ট বিশ্বে ক্রীড়া করবার ইচ্ছা থাকে তবে, আমার দুঃখ দুর করুন। একাদশী তিথির ভয় থেকে আমাকে রক্ষা করুন। হে কৈটভনাশন, আমি একমাত্র একাদশীর ভয়ে ভীত হয়ে পলায়ন করছি। মানুষ, পশুপাখী, কীট-পতঙ্গ, জল-স্থল, বন-প্রান্তর, পর্বত-সমুদ্র, বৃক্ষ, নদী, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল সর্বত্রই আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু একাদশীর প্রভাবে কোথাও নির্ভয় স্থান পাচ্ছি না দেখে আজ আপনার শরণাপন্ন হয়েছি।
হে ভগবান, এখন দেখছি, আপনার সৃষ্ট অনন্ত কোটি ব্রহ্মান্ডের মধ্যে একাদশীই প্রাধান্য লাভ করেছে, সেইজন্য আমি কোথাও আশ্রয় পেতে পারছি না। আপনি কৃপা করে আমাকে একটি নির্ভয় স্থান প্রদান করুন। পাপপুরুষের প্রার্থনা শুনে ভগবান শ্রীহরি বলতে লাগলেন- হে পাপপুরুষ! তুমি দুঃখ করো না। যখন একাদশী তিথি এই ত্রিভুবনকে পবিত্র করতে আবির্ভুত হবে, তখন তুমি অন্ন ও রবিশস্য মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করবে। তা হলে আমার মূর্তি একাদশী তোমাকে বধ করতে পারবে না।
ভদ্রশীলের কাহিনীঃ পুরাকালে গালব নামে এক মহান মুনি নর্মদা নদীর তীরে বাস করতেন। তাঁর ভদ্রশীল নামে এক বিষ্ণুভক্ত পুত্র ছিল। সে ছোটবেলা থেকে বিষ্ণুমূর্তি বানিয়ে পূজা করত। বালক হয়েও লোককে বিষ্ণুপূজার উপদেশ ও একাদশী পালন করতে নির্দেশ দিত, নিজেও পালন করত। পিতা একাদিন জিজ্ঞাসা করেন। আচ্ছা ভদ্রশীল! তুমি অতি ভাগ্যবান। তুমি বলো তো, রোজ শ্রীহরির পূজা করা, একাদশ তিথি পালন করা- এরূপ ভক্তি কিভাবে তোমার উদয় হল?”
উত্তরে ভদ্রশীল বলতে লাগল- বাবা! আমি পূর্বজন্মের কথা ভুলিনি। আগের জন্মে যমপুরীতে গিয়েছিলাম। সেখানে যমরাজ আমাকে এ বিষয়ে উপদেশ করেছিলেন। পিতা অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে বললেন- ভদ্রশীল, তুমি পূর্বে কে ছিলে? যমরাজ তোমাকে কি বলেছিল, সব কিছুই আমাকে বলো। ভদ্রশীল বলল- বাবা! আমি পূর্বে চন্দ্রবংশের একা রাজা ছিলাম। তখন আমার নাম ছিল ধর্মকীর্তি।
ভগবান দত্তাত্রেয় আমার গুরু ছিলেন। নয় হাজার বছর আমি পৃথিবী শাসন করেছিলাম। বহু ধর্ম-কর্ম করেছিলাম। পরে যখন আমার অনেক ধনসম্পদ হল তখন আমি পাগলের মতো অধর্ম করতে লাগলাম। কতগুলি পাষন্ড ব্যক্তির সেঙ্গ আলাপ করতাম। আর কেবল কথা আলাপের ফলেই আমার বহু দিনের অর্জিত পুণ্য নষ্ট হয়ে গেল। আমিও পাষন্ডী হলে গেলাম। সব প্রজারাও অধর্ম করতে লাগল। প্রজাদের প্রত্যেকের অধর্মের ছয় ভাগের এক ভাগ রাজাকেই গ্রহণ করতে হয়। তারপর একদিন আমি সৈন্যদের সঙ্গে বনে মৃগয়া করতে গেলাম।
বহু পশু বধ করলাম। তারপর আমি ক্ষুধঅ তৃষ্ণায় কাতর ও ক্লান্ত হয়ে রেবা নদীর তীরে গেলাম। প্রখর রোদে তপ্ত হয়ে নদীতে স্নান করলাম। কিন্তু তারপর আমার কোন সেনাকে দেখতে না পেয়ে চিন্তিত ও অতিশয় ক্ষুধার্ত হলাম। অন্ধকার হয়ে এল। আমি পথ ঠিক করতে পারলাম না। তারপর এক জায়গায় গিয়ে কয়েকজন তীর্থবাসীকে দেখলাম। জানলাম তারা একাদশী ব্রত করেছে। তারা সারাদিন কিছু খায়নি, জলপান পর্যন্তও করেনি। আমি তাদের সঙ্গে পড়ে রাত্রি জাগরণ করলাম। কিন্তু ক্লান্তি ক্ষুধা পিপাসায় কাতর হয়ে রাত্রি জাগরণের পর আমার মৃত্যু হল।
তখন দেখলাম বড় বড় দাঁত বিশিষ্ট দুজন ভয়ংকর যমদুত এসে আমাকে দড়ি দিয়ে বাঁধল। আর ক্লেশময় পথ দিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে চলল। তারপর যমপুরীতে পৌছালাম। যমরাজও দেখতে তখন ভয়ংকর। যমরাজ চিত্রগুপ্তকে ডেকে আমাকে দেখিয়ে বললেন-পন্ডিত! এই ব্যক্তির যেরূপ শিক্ষাবিধান তুমি তা বলো। চিত্রগুপ্ত কিছুক্ষণ বিচার করে ধর্মরাজ যমকে বললেন-হে ধর্মপাল! এই ব্যক্তি পাপকর্মেই রত ছিল সত্য, কিন্তু তবুও একাদশীর উপবাসের জন্য সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হয়েছে।
তীর্থবাস ও রাত্রি-জাগরণও করেছে। তাই ওর সব পাপ নষ্ট হয়েছে। চিত্রগুপ্ত এই কথা বললে যমরাজ খুব চমকে উঠলেন, তিনি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভুমিতে দন্ডবৎ প্রণাম জানিয়ে আমাকে পূজা করতে লাগলেন। তারপর তাঁর দূতদের আহ্বান করে বলতে লাগলেন- হে দূতগণ! তোমরা ভাল করে আমার কথা শোনো। তোমাদের মঙ্গলজনক কথা আমি বলছি। যে সব মানুষ মর্ধরত, তোমরা তাদেরকে এখানে আনবে না। যাঁরা শ্রীহরির ভক্ত, পবিত্র, একাদশীব্রত পরায়ণ, জিতেন্দ্রিয় এবং যাঁদের মুখে সর্বদা ‘হে নারায়ণ, হে গোবিন্দ, হে কৃষ্ণ, হে হরি, উচ্চারিত হয়, যাঁরা সকল লোকের হিতকারী ও শান্তিপ্রিয়, তাদেরকে তোমরা দূর থেকেই পরিত্যাগ করবে।
কারণ, সেই সব ব্যক্তিকে আমার শিক্ষা দেবার অধিকার নেই। যাঁরা সর্বদা হরিনামে আক্ত, সর্বদা হরিকথা শ্রবণে আগ্রহী, যাঁরা পাষন্ডগণের সঙ্গ করে না, ভক্তদের শ্রদ্ধা করে, সাধুসেবা অতিথিসেবা পরায়ণ, তাঁদেরকে পরিত্যাগ করবে।
হে দূতগণ! তোমরা শুধু তাদেরকেই আমার কাছে ধরে আনবে যারা উগ্রস্বভাব, ভক্তদের অনিষ্ট করে, লোকদের সঙ্গে কলহ বাধায়, একাদশী ব্রত পালনে একান্ত পরাঙ্মুখ, পরনিন্দুক, ব্রাহ্মণের ধনে লোভ, পরতন্ত্র, হরিভক্তি বিমূখ, যারা ভগবদ্ বিগ্রহ দেখে শ্রদ্ধাবত হয় না, মন্দির দর্শনে যাদের আগ্রহ নেই, অন্যের অপবাদ করে বেড়ায়, তাদের সবাইকে বেঁধে এখানে নিয়ে আসবে।’
যমরাজের মুখে এসব কথা শুনে আমি পাপকর্মের জন্য অত্যন্ত অনুশোচনা করতে থাকি। তারপর আমি সূর্যের মতো উজ্জ্বল দেহ লাভ করলাম। একটি দিব্য বিমানে চড়িয়ে আমাকে যমরাজ দিব্যলোকে পাঠিয়ে দিলেন। কোটি কল্প সেখানে অবস্থান করার পর এই পৃথিবীতে এসে সদাচারী মহান ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার জাতিস্মরতা হেতু এসব ঘটনা আমার হৃদয়ে জাগ্রত আছে।
আমি পূর্বে একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য জানতাম না। অনিচ্ছাকৃতভাবে যখন একাদশী পালনে এত ফল লাভ করেছি। তাহলে ভক্তি সহকারে একাদশী ব্রত উপবাস করলে কি প্রকার ফল লাভ হয় তা জানি না। তাই বৈকুন্ঠধামে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছায় আমি পবিত্র একাদশীব্রত ও প্রতিদিন বিষ্ণুপূজা করব এবং অন্যদেরও এসব পালন করতে উৎসাহী করব। পুত্রের কথা শুনে গালব মুন অতি সন্তুষ্ট হয়ে ভাবলেন, আমার বংশে এই পরম বিষ্ণুভক্তের জন্ম হয়েছে, তাই আমার জন্ম সফল, আমার বংশও পবিত্র হল।--------হরে কৃষ্ণ-------
প্রসাদ হচ্ছে ভগবানের কৃপা, এই মনোভাব নিয়ে আমাদের পারমার্থিক উন্নতির জন্য শুদ্ধ ভক্তের কাছ থেকে প্রসাদ গ্রহণ করা উচিত।
১. মনে রাখবে, কৃষ্ণ আর কৃষ্ণপ্রসাদ অভিন্ন। তা স্মরণ করতে ‘শরীর অবিদ্যাজাল, প্রার্থনা উচ্চারণ করতে হবে।
২. খেতে বা পান করতে ডান হাত ব্যবহার করতে হবে।
৩. এই প্রসাদ কৃষ্ণ আস্বাদন করেছেন তা ভাবতে হবে। (কৃষ্ণ যে কৃপা পূর্বক আমাদের
প্রসাদ দিয়েছেন তা চিন্তা করতে হবে, সেই সঙ্গে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রাসাদ গ্রহণলীলাও আমরা স্মরণ করতে পারি।)
৪. শ্রীকৃষ্ণ আর তার প্রসাদের গুণ কীর্তন ব্যতীত কোন কথা বলা উচিত নয়।
৫. প্রসাদ ফেলবেন না। প্রসাদে যেন পা না লাগে।
৬. প্রসাদ পাওয়ার পূর্বে ও পরে হাত, পা ও মুখ ধোওয়া উচিত।
৭. আহারের ১ ঘন্টা পূর্বে এক গ্লাস জল পান করবেন, অথবা আহারের কিছু পরে, আহারের সময় পান করবে না, একান্ত প্রয়োজনে গরম কিছু পান করা যেতে পারে।
৮. শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন- তোমার পেটের ১/৪ ভাগ জল দিয়ে ভর্তি
করবে, ১/২ বাগ খাদ্য দিয়ে, আর বাকী ১/৪ ভাগ বাতাস দিয়ে পূরণ করতে হবে। অতিরিক্ত খাওয়া যাবে না।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ।
শ্রীঅদ্বৈত গদাধর শ্রীবাসাদি গৌর ভক্তবৃন্দ।।
শ্রীকৃষ্ণের প্রকাশ এই পঞ্চতত্ত্বের মধ্যে। শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে বিস্তারিত করতে পারেন। কেবলমাত্র শ্রীকৃষ্ণই নন, সিদ্ধ যোগীমাত্রেই নিজেকে বিস্তারিত করতে পারেন। তবে শ্রীকৃষ্ণের মতো এত বেশি নয়। ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে বলা আছে —’ যত্র যোগেশ্বরঃ হরিঃ’। তিনি যোগের সর্বশ্রেষ্ঠ স্তরে বিরাজমান। যৌগিক বিদ্যার চরমে তিনি। তাই এই যে পঞ্চতত্ত্বের বিস্তার —শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ শ্রীঅদ্বৈত গদাধর শ্রীবাসাদি গৌর ভক্তবৃন্দ —এই পাঁচটি রূপে অভিব্যক্ত হয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ।
পরম শক্তিমান ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে পঞ্চ শক্তিতে প্রকাশ করেন পাঁচটি পারমার্থিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। ভগবানের এই পঞ্চতত্ত্বে কোন পারমার্থিক ভেদ নেই। তাঁরা পঞ্চতত্ত্ব হলেও এক ও অদ্বিতীয় তত্ত্ব। তাঁদের ভক্তরূপ, ভক্তস্বরূপ, ভক্ত-অবতার, শুদ্ধভক্ত ও ভক্তশক্তি বলে।
অদ্বয়তত্ত্বের এই বিবিধ পঞ্চ শক্তির মধ্যে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু হচ্ছেন আদি অবতারী পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং। শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবানের প্রথম স্বাংশ প্রকাশ। অদ্বৈত প্রভু হচ্ছেন ভগবানের অবতার। চৈতন্য, নিত্যানন্দ ও অদ্বৈত, এই তিন তত্ত্ব, পরমব্রহ্ম বা বিষ্ণুতত্ত্ব । গদাধর ভগবানের অন্তরঙ্গা শক্তির প্রতীক। আর শ্রীবাস হলেন তটস্হা শক্তির প্রতিক—শুদ্ধ ভক্ত । গদাধর ও শ্রীবাস বিষ্ণুতত্ত্বের অন্তর্গত হলেও, পরমেশ্বর ভগবানের অধীন, বিশেষ শক্তি। তাঁরা শক্তিমান থেকে ভিন্ন নয়।
এছাড়া ভগবানের আর একটা শক্তি আছে, সেটা হলো বহিরঙ্গা শক্তি । বহিরঙ্গা শক্তি ঐ পঞ্চতত্ত্বের মধ্যে নেই। বহিরঙ্গা শক্তি মানে যা দিয়ে এই জড় জগতটা প্রকাশিত হয়েছে।
অংশ প্রকাশ হলেন প্রত্যক্ষ আর অবতার হলেন পরোক্ষ। যখন অংশের অংশ প্রকাশিত হয় তাকে বলা হয় ‘কলা’। তাই, শ্রীঅদ্বৈত প্রভু প্রত্যক্ষ প্রকাশ নন।
ঠিক যেমন প্রথমে একটি মোমবাতি থেকে অন্য একটি বাতি জ্বালানো হল, আবার দ্বিতীয়টা থেকে আর একটা বাতি জ্বালানো যাবে। তৃতীয়টা থেকে আবার একটা। ঠিক তেমনি, ভগবানের অংশ প্রকাশ কিংবা অবতার যাই হোক, সবই হল ঐ বাতির মতো । আদি বাতিটা হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু ভগবানের একটি বিস্তার রূপ থেকে অন্য একটি বিস্তার রূপে শক্তি যে কম থাকে তা ঠিক নয়। বাতির আলো সব কটিতেই সমান থাকে।
শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর ক্ষমতা মর্যাদা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর থেকে কম কিছু নয়। যে কোনও অবতারের কিংবা অংশ প্রকাশের সমান শক্তি থাকে। শক্তির প্রকাশ বিভিন্ন। ঠিক যেমন, শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামচন্দ্র, উভয়ই হলেন পরম পুরুষোত্তম ভগবান। তবে একজন হলেন আদি পুরুষ। শ্রীকৃষ্ণ সেই আদি পরম পুরুষ এবং রামচন্দ্র হলেন তাঁর বিস্তার। কেন ? কারন শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের গুণগুলি পরিপূর্ণ ভাবে ব্যক্ত করেছেন আর রামচন্দ্র আংশিকভাবে । শ্রীরামচন্দ্র নিজেকে পরম পুরুষোত্তম ভগবান রূপে প্রকাশ না করে আদর্শ রাজারূপে অভিব্যক্ত করেন এবং এই জগতের নীতিবোধ নিয়েই ব্যাপৃত ছিলেন। আর শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং পরম পুরুষোত্তম ভগবান বলে জড় জগতের সব নীতির ঊর্ধ্বে নিজেকে প্রকটিত করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ হলেন পরিপূর্ণ স্বয়ং ভগবান।
শ্রীরামচন্দ্র শুধু সীতাদেবীকে বিবাহ করছিলেন। পক্ষান্তরে, শ্রীকৃষ্ণ ১৬১০৮ টি বিবাহ করেছিলেন। এর মধ্যে ১৬১০০ জনকে দানবের বন্দীত্ব থেকে উদ্ধার করেন এবং সামাজিক সমস্যার কারনে তাদের প্রার্থনার প্রেক্ষিতে তিনি তাদের বিবাহ করতে সম্মত হন। শ্রীকৃষ্ণ সবার প্রতি কৃপাময়। তিনি ষোল হাজার কেন ষোল লক্ষ বিবাহ করতে পারেন। তা না হলে তিনি ভগবান হলেন কিভাবে?
অপ্রাকৃত রস আস্বাদনের উদ্দেশ্যে তাঁরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন প্রকাশ মাত্র। উপাস্য ও উপাসকের মধ্যে অপ্রাকৃত রস বিনিময় নিয়েই সমগ্র ভক্তিতত্ব।
এই চিন্ময় দিব্য রসাস্বাদনহীন ভগবদ্ভজন সম্পুর্ন অর্থহীন। বিশুদ্ধ সত্ত্বে অধিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে স্বয়ং লীলা পুরুষোত্তম ভগবান উপলব্ধি করা দুরূহ। স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান হওয়া সত্ত্বেও মহাপ্রভু কখনও নিজেকে কৃষ্ণরূপে প্রকাশ করেন নি। বরং জীবকুলকে কৃষ্ণ ভজন শিক্ষা দিবার উদ্দেশ্যে তিনি মহান ভক্তরূপে পার্ষদসহ আবির্ভূত হয়েছিলেন।
পঞ্চতত্ত্ব কীর্তনের মর্ম বুঝতে হলে এইগুলি উপলব্ধি করতে হবে। এই সবই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শক্তির প্রকাশ বিভিন্ন রূপে। তাই বলা যায় পঞ্চতত্ত্বে শ্রীকৃষ্ণেরই প্রকাশ। তাই পরমেশ্বরের অভিব্যক্তি রূপে তাঁদের প্রণতি জানাতে হবে।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে
পূজার পর হিন্দুরা কেন প্রতিমা বিসর্জন করে জলে ফেলে দেয় ? প্রশ্নটি অনেকের কাছ থেকে শুনতে হয়। এত টাকা দিয়ে প্রতিমা তৈরি করিয়ে কেন আবার সেটাকে বিসর্জন করতে হয় ?
এর উত্তর হচ্ছে:- সনাতন ধর্ম বিশ্বাস করে, “মানুষের দেহ পাঁচটি উপাদান দিয়ে তৈরি”। যথাঃ আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল ও মাটি। তাই মৃত্যুর পর এই দেহ আগুনে দাহ করা হয় অথবা মাটি দেওয়া হয়। অর্থাৎ যে উপাদান দিয়ে এই দেহ তৈরি, মৃত্যুর পর আবার সেই একই উপাদানে মিশে যায়।
তেমনি প্রতিমার ক্ষেত্রেও তাই, মাটি দিয়ে তৈরি। মাটির প্রাণহীন মূর্তিতে প্রান প্রতিষ্ঠা করলে সেটি প্রতিমা হয়। আর পূজা শেষে দেবীকে বিদায়ের পর সেই প্রতিমাটি আবার প্রাণহীন মূর্তি হয়ে যায়। আর তাই তাকে আবার পঞ্চতত্ত্বের একটি জলেই বিসর্জন দেওয়া হয়।
ঈশ্বর সর্বত্রই বিরাজিত। প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি প্রাণীর মধ্যই তিনি আছেন। তবে, পঞ্চ উপাদানে গড়া এই মানব দেহের প্রতীকী হিসেবেই আমরা পূজার সময় প্রতিমা তৈরি করি মাটি দিয়ে। পরবর্তীতে সেই মাটির প্রতিমায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে তাকে ঈশ্বর জ্ঞানে পূজা করি।
এই প্রতিমা পূজার সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে বিসর্জন। জলের মাধ্যমেই যেন মাটির প্রতিমা পুনরায় প্রকৃতিতে মিশে যায়, সেই জন্যই আমরা গঙ্গার জলে প্রতিমা বিসর্জন দেই। আমাদের হৃদয়ে যে নিরাকার ঈশ্বর রয়েছে, উপসনার নিমিত্তে মাটির প্রতিমা তৈরি করে তাকে “সাকার রূপ”দেওয়া হয়। পূজা শেষে পুনরায় সেই “সাকার রূপ”কে বিসর্জন দিয়ে নিরাকার ঈশ্বরকে হৃদয়ে স্থান দেওয়া হয়। সেই কারণেই দুর্গা পূজার সময় যখন প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় তখন মায়ের প্রতি আমাদের প্রার্থনা থাকে, “মা, তুমি আবার এসো আমাদের মাঝে। এই একটি বছর তুমি থাকবে আমাদের হৃদয়ে । আবার, বছর পরে তোমার প্রতিমা গড়ে আমরা সাড়ম্বরে তোমার পূজা করবো।”
যে জন্ম নিয়েছে, তার মৃত্যু অনিবার্য ৷ এটাই প্রকৃতির শাশ্বত নিয়ম ৷ ঠিক তেমনি যাকে আবাহন করা হয়, তার বিসর্জনও অনিবার্য ৷ বিসর্জনের মাধ্যমেই “পুনরায় আগমনের” আশা সঞ্চারিত হয় ৷ এই সকল কারনেই আমরা প্রতি বছর হৃদয়স্থ ঈশ্বরের মাটির প্রতিমা গড়ে তাকে বাহ্যিক ভাবে পূজা করি এবং পূজা শেষে বিসর্জনের মাধ্যমে তাকে আবার হৃদয়ে স্থানান্তরিত করি। এটিই প্রতিমা পূজা ও প্রতিমা বিসর্জনের মূল তাৎপর্য।