মেডুসা’র হাসি


[গ্রীক পুরাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মেডুসার জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে বেশ কয়েকটা ভাষ্য পাওয়া যায়। এখানে সেখানে তাকে শুরু থেকে গর্গন (যাদের মাথায় চুলের পরিবর্তে সাপ রয়েছে। গ্রীক পুরাণে তিন বোনকে গর্গন হিসেবে পাওয়া যায়। এরা হচ্ছে স্থেনো, ইউরেয়াল ও মেডুসা) হিসেবেই দেখানো হয়েছে। অন্যান্য জায়গায় ভীষণ সুন্দরী এক নারী হিসেবেই তার উল্লেখ পাওয়া যায়। হেলেন সিক্সুর(Hélène Cixous) জন্য এই ভাষ্য গুরুত্বপূর্ণ। মেডুসা অদ্বিতীয় রূপবতী থেকে গর্গনে রূপান্তরিত হওয়ার সাথে দু’জনের নাম যুক্ত। এরমধ্যে একজন হচ্ছেন সমুদ্র, ভূমিকম্প ও অশ্বদেবতা পোসাইডন। তিনি প্রাচীন গ্রীসের ১২ জন অলিম্পিয়ানদের মধ্যে একজন। অন্যজন যিনি যুক্ত তিনি হচ্ছেন দেবী এথিনা। এথেন্সের এই অন্যতম রক্ষাকর্তার মন্দিরে পোসাইডন মেডুসাকে ধর্ষণ করে (এক্ষেত্রেও বেশ কয়েকটা ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য পাওয়া যায়)। এতে করে এথিনা ক্ষেপে যান এবং পোসাইডনকে অভিশাপ দেয়ার বদলে মেডুসাকে অভিশপ্ত করেন। এই অভিশাপের ফলে দুইটা ঘটনা ঘটে। প্রথমত মেডুসা গর্গনে রূপান্তরিত হয়। দ্বিতীয়ত, মেডুসা এমন এক চাহুনী প্রাপ্ত হন যা যে-কাউকে পাথরে পরিণত করে ফেলে। অর্থাৎ মেডুসার চোখে চোখ রাখা মাত্র যে কেউ অনড় পাথরে পরিণত হবে। মেডুসা বধের ঘটনার সাথে জিউসপুত্র পার্সিয়াসের (Demigod- আধা ইশ্বর, আধা মানব) নাম প্রায় সকল ভাষ্যেই উচ্চারিত। পার্সিয়াস মেডুসার দেহ থেকে মস্তক আলাদা করেন ও ধড়হীন মস্তককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন।


হেলেন সিক্সু, নারীবাদী বয়ানে উত্তর-গড়নবাদী ইন্টারভেনশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ও চিন্তক। হেলেন সিক্সু বর্গ হিসেবে ‘এক’ নারীর কল্পনা থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন। এর কৌশল হিসেবে উনি বেছে নিয়েছেন মেডুসাকে। সিক্সুর কাজে অন্যান্যদের মধ্যে জ্যাক দেরিদা ও মরিস ব্লাঁশো ও জ্যাক লাকাঁর গভীর প্রভাব রয়েছে। পড়বার কালে এই ত্রয়ীকে পাশে রেখে পাঠ করলে সুবিধা হবে। সিক্সুর সাথে এক আলাপকালে জ্যাক দেরিদা তাঁর সম্পর্কে বলেন যে “ হেলেনের লেখা দুনিয়া জুড়ে অনূদিত হয়েছে। অথচ তারপরও ওর লেখা আসলে অনুবাদ করা যায়না। আমরা দু’জন ফরাসী লেখক যাদের মধ্যে এক অদ্ভুত সম্পর্ক রয়েছে। অথবা, ফরাসী ভাষার সাথে আমাদের একটা অদ্ভুত সম্পর্ক রয়েছে। অন্য অনেকে ফরাসীর চাইতে আমাদের লেখা সবচাইতে বেশি অনূদিত হয়েছে কিন্তু আমাদের লেখা অনুবাদ করাই সবচাইতে বেশি অসম্ভব। যাদের সাংস্কৃতিক শিকড় ফ্রান্সে প্রোথিত তাঁদের চাইতে আমরা ফরাসী ভাষায় আরো বেশি প্রোথিত।”


হেলেন সিক্সুর “The Laugh of the Medusa” লেখাটির ওপর একটি আলাপ আয়োজন করার আমাদের বেশ আগ্রহ ছিল। কিন্তু নানাবিধ কারণে তা হয়ে ওঠেনি।এখানে Raquelle K. Bostow এর “Helene Cixous and the myth of Medusa” লেখার Dangerous claims অংশ থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।]


নারীদেহ নিয়ে নতুন লেখা আর নতুন অর্থশাস্ত্রের ডাক দিচ্ছেন হেলেন সিক্সু। অর্থাৎ মানুষে মানুষে যোগাযোগের জন্য এক নতুন পথের ডাক যা পুরুষতন্ত্রের অধিকারসুলভ, ঔপনিবেশিক ও ঠিকাদারী প্রবণতা থেকে বের করে নিয়ে আসবে। এটা করার জন্য তিনি ডেকে আনছেন মেডুসা’কে। মেডুসাকে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে একজন বিয়োগান্তক সুন্দরী হিসেবে যে কি-না পোসাইডন দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে, এথেনার দ্বারা শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছে, এবং পার্সিয়াসের দ্বারা বিজিত হয়েছে। মেডুসাকে মৃত্যুর আরেক রূপ আর বিয়োগান্তক সুন্দরী হিসেবে যেভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তা একটা ভুল পাঠ। মুকুটের মতন সাপ আর বিধ্বংসী চাহুনী মেডুসাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি হিসেবে হাজির করে। সে যৌন আবেদন ও ক্ষমতার প্রতীক, শিল্পের উদ্দীপনার যোগানদাতা, একজন নারীবাদী, ও খোজাকরণের(castration) হুমকি হিসেবে শতাব্দীর পর শতাব্দী পার করে দিয়েছে। এই চরিত্র অধ্যয়ন করতে গিয়ে গার্বার এবং ভিকার্স দেখাচ্ছেন যে, হোমার, দান্তে, শেক্সপীয়ার, গ্যেটে, ও শেলীর মত কেন্দ্রীয় (Canonical) লেখকরা মেডুসার গল্প টেনে এনেছেন এবং একই সাথে তাকে দোষারোপ যেমন করেছে, গুণগানও করেছে। মেডুসার শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে তার সর্পময় চুল। শিশ্ন ও গুপ্তকেশের রূপক হিসেবে এই চুলকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মেডুসার মাথাকে বানিয়ে তোলা হয়েছে খোজা করে দেয় এমন এক রূপক স্ত্রীযোনিদ্বার হিসেবে। পাথরে রূপান্তর ও হত্যা করার ক্ষমতার কারণেই পার্সিয়াস মেডুসাকে ভয় পেয়েছিল। পরবর্তীতে, এই শরীরকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্যেই সে এটাকে নিজ প্রয়োজনের সাপেক্ষে উপযোগী করে নেয়।


গ্রীক পুরাণে, ধড়হীন মেডুসার মস্তক পার্সিয়াস রেখে দিয়েছিল তার শত্রুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। পরবর্তীতে, এই সর্পময় মস্তক সে দেবী এথিনাকে দিয়ে দেয়। এথিনাও এটাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। “সর্বপ্রথম এবং সবচাইতে প্রাচীন রক্ষাকবজের প্রতীক হিসেবে মেডুসার মস্তকের ব্যবহার দেখা যায়। কখনো লৌহবর্মে, কখনো ঢালের উপরে খোদাইকৃত মস্তকের হদিস পাওয়া যায়। আক্ষরিক অর্থেই শয়তান-প্রতিপক্ষকে দূরে ঠেলে রাখার জন্যই এই খোদাই” (গার্বার ও ভিকার্স ২)। মেডুসার এই ঝামেলাময় ক্ষমতা তাকে এমন এক বিপদজনক দশায় এনে দাঁড় করায় যা দিনশেষে তার নাশের কারণ হয়ে ওঠে। যদিও তার ভয়ংকর এই ক্ষমতাই তার শরীরি মৃত্যুকে অতিক্রম করাকে সম্ভব করে তোলে। পুরাণের মধ্যেই নানা মাত্রার ব্যাখ্যা ও পুনঃব্যাখ্যার মাধ্যমে তার জীবিত থাকাটা সম্ভব হয়ে ওঠে।


সিক্সু নারীদেহকে বিপদজনক হিসেবে পাঠ করার যে স্বাভাবিক প্রবণতা তা থেকে বের করে নিয়ে আসার জন্য মেডুসার মাধ্যমে ভয় ও যৌনভিন্নতার সম্পর্কের পাক খুলে দেন। Femme Fatale মেডুসা পুরুষ চাহুনীর (male gaze) ভ্রান্তির প্রতিরূপ মাত্র। যে পুরুষ চাহুনি, খোজাভীতি অথবা পরিচয় এবং কর্তৃত্ব হারানোর ভয় থেকেই জন্ম নেয়। নারীর নিত্য পরিচয় (essential identity) এর ওপরের জোর না দিয়ে সিক্সু ঠিক উল্টোটা করেন। “Le Rire” এর শুরুর একটা অনুচ্ছেদে সিক্সু নারী ও তার অনুরুপ Female sexuality কে Learned ক্যাটেগরি হিসেবে চিহ্নিত করেন ও তার ওপরে জোর দেন। সিক্সুর প্রবন্ধ নারীকে সমশ্রেনীভুক্ত হিসেবে স্বাভাবিকীকরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। উনি এটাকে বলবেন বিপদজনক বর্গঃ


“প্রথমত এটা বলতেই হবে যে সার্বিক অথবা প্রতিনিধিস্থানীয় কোন নারী নেই। তাঁদের মধ্যে কি কি মিলের জায়গা আছে তা আমি বলবো। কিন্তু আমাকে যেটা বিমুগ্ধ করে সেটা হচ্ছে তাঁদের প্রতিটা আলাদা আলাদা গঠনের সীমাহীন প্রাচুর্য্য। আপনি কোন একাট্টা Female sexuality’র কথা বলতে পারবেননা যা সমশ্রেনীভুক্ত ও যাকে কোডের মাধ্যমে শ্রেনীভুক্ত করা যায়।” (“The Laugh”, 876)


১৯৭৫ সালের এই প্রবন্ধে সিক্সু মেডুসাকে পুনঃলিপিবদ্ধ করেন এবং তার হাসির ওপরে জোর দেন। এরকম একজন নিষ্পিষ্ট নারী কিভাবে এই হাসি রপ্ত করলেন? অন্য শরীরের ভয়কে চারিদিক থেকে আটকে ফেলার জন্য এবং এই ভয়কে পরাজিত ও অধিগ্রহণ করবার বাসনায় রূপান্তরিত করার যে পাঠ রয়েছে সিক্সু তার থেকে বেরিয়ে যান। নারীদেহ সংক্রান্ত সকল ভুল পাঠকে অতিক্রম করে যেতে মেডুসা মুগ্ধতা ও উপহাস ব্যক্ত করে।সিক্সু এমন এক “ফেমিনিন” বাসনার কথা বলেন যা হারানোর ভয় অথবা “অপরকে” “সত্ত্বায়” নামিয়ে আনার ওপরে দাঁড়িয়ে থাকেনা। বরং, তিনি এক Amour autre (অপর প্রেম) এর কথা বলেন, অথবা ভিন্নতা বা অন্যতার কাছে উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার কথা বলেন। সিক্সু মেডুসাকে এইরকম ফেমিনিন অর্থশাস্ত্রের অবয়ব/শরীরি রূপ (embodiment) হিসেবে পাঠ করবেন যা একধরণের পুলকের অভিজ্ঞতা দেয়। অথবা, অপরের সংস্পর্শে আসার ফলে তীব্র বুদ্ধিবৃত্তিক ও শরীরি আনন্দ দেয় যা লিঙ্গ, লিঙ্গীয় সম্পর্ক ও যৌনতার সংজ্ঞাকে (আমরা যদি সিক্সুর এপিগ্রাফে বর্ণের রাজনীতির প্রসঙ্গটির খুব মন দিয়ে পড়ি তবে দেখতে পাবো এমনকি বর্ণের সংজ্ঞাকেও) প্রশ্নবিদ্ধ করে।


এই প্রবন্ধটি ১৯৭৫ এ প্রকাশিত হওয়ার সময়েও মেডুসা বর্তমানের মূর্তি হিসেবেই হাজির থাকে। “Le Rire de la Méduse” ২০১০ এ পুনঃপ্রকাশিত হলে, সিক্সু মেডুসাকে কুইয়ার শরীর হিসেবে পুনঃউপস্থাপন করেন। যে শরীর প্রথাগত পুরুষালি/নারীসুলভ দিকোটিক ধারণা থেকে বিচ্যুত।

“সাহিত্যের মত, মেডুসা সবসময়ই কুইয়ার হিসেবেই হাজির ছিল। কুইয়ার একটা মোচড়, একটা টুইস্ট। মেডুসার চুল হল একগোছা টুইস্ট। মোড় ঘুরিয়ে দেয়াই ওর কাজ। অর্থাৎ সোজা রাস্তায় না যাওয়া” (Méduse en Sorbonne” ১৪৪-১৪৫)। প্যারিস-সর্বোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ফ্রেডরিক রিগার্ডকে দেয়া এই সাক্ষাৎকার “Le Rire de la Méduse” এর ওপরে লিখিত রচনাগুলির শেষ অন্তর্ভুক্তি। এখানে সিক্সু মেডুসা’র ওপরে তার নিজের কাজকে কুইয়ার হিসেবে ঠাহর করছেন। ঠাহর করছেন একটা শরীর হিসেবে যা সীমানা সরিয়ে দিবে ও সামাজিক প্রত্যাশাকে চ্যালেঞ্জ করবে। মেডুসাকে একটা কুইয়ার শরীর হিসেবে সিক্সুর যে কল্পনা তা “woman” ও “feminine” এর অর্থকে উন্মুক্ত করে দেয়। একই সাথে নিজের ও সকল প্রকারের শরীরের মধ্যকার অন্যতা আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে আনন্দ উপলব্ধি করতে (নারীর) যৌনতাকে ক্ষমতায়িত করে।


অথচ, প্রাথমিক প্রকাশের ৩৫ বছর পর, এই প্রবন্ধ থেকে যেই শরীরি অসমসত্ত্বতা(heterogeneity) ও মুক্তি নিঃসৃত হয় তা অনেকাংশেই রুদ্ধ হয়ে গেছে। Le Rire de la Méduse et autres ironies (২০১০) এ লিখিত মুখবন্ধে মেডুসার সাথে কথোপকথন তুলে ধরেন যা এই মনোভাব প্রকাশ করেঃ

“ সে নিজের মুকুটকে থিতু করে, গেড়ে বসে, বিদ্ধ করে এবং তারপরঃ নারীরা আজ কোথায়? আমি বললাম- ২০০৩ এ , আমি জন্মেছিলাম ও বেড়ে উঠেছিলাম কোরিয়ায়। মুকুটের অধিকারী বলল আমরা সেখানে গিয়েছিলাম ১৯৭০ এ। ঠিক তারপরে লাতিন আমাকে ডাকলো। এবং এইসব দিনগুলিতে আমি ক্যালিফর্নিয়াতে বাস করি। আমেরিকায় এটা মেডুসার কাল। এশিয়ার বাতাসে দ্রুত ছুটে যেতে আমি কখনো থামিনা। ফ্রান্সে কি অবস্থা? আমি বলি, তোমার আমার জানালায় ফিরে আসা দরকার। এখানকার বাতাস ভর্তি অনাকাঙ্ক্ষিত গন্ধ। আমরা আটকে গেছি। আমরা বেশি হাসি না” (“Un effet d’épine rose” ৩৩)।


সিক্সুর মেডুসা যে হাসিতে উৎসাহ জুগিয়েছিল, ফ্রান্সে এবং অন্য কোথায় তা যদি এখন কমে গিয়ে থাকে তবে কি শরীরি সেই নিপীড়ন আবার ফিরে এসেছে যা মেডুসাকে পুনঃলিখনের মাধ্যমে সিক্সু দূরীভূত করতে চেয়েছিলেন? পপ্যুলার কালচারে নারীর যৌনতার ক্ষমতায়িত রূপ হিসেবে femme fatale কি বেদখল হয়ে গেছে?


টীকা-

Femme Fatale: ফরাসী অভিব্যক্তি। এমন এক বিধ্বংসী নারী যে অপরকে তাঁর দিকে আকৃষ্ট করে কিন্তু দিনশেষে, যে আকৃষ্ট হয়, তার ধ্বংস ডেকে আনে।


হদিস- http://dangerouswomenproject.org/.../11/28/helene-cixous/...


প্রথম প্রকাশঃ ১২ই নভেম্বর, ২০১৯

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/404914550901170/