ফ্রান্সের চিন্তাজগতে হেগেলীয় বাঁকঃ ভাহ্‌ল-কোয়েরে-কোজেভে-ইপ্পোলিৎ



ফ্রান্সে হেগেলের চিন্তার চাঙ্গা হওয়ার উপরে অনেকাংশে সমকালের কন্টিনেন্টাল ফিলোসফি দাঁড়ায় আছে । জঁ ভাহ্‌ল (Jean Wahl) আর আলেক্সান্দ্রে কোয়েরে (Alexandre Koyré), এই দুইজনার কাজের আগে ফ্রান্সের সমকালীন কন্টিনেন্টাল দার্শনিকেরা হেগেলের গুরুত্ব ঠিকঠাক ঠাওর করতে পারে নাই। ১৯২৯ সালে ভাহল তাঁর 'হেগেলের দর্শনে অসুখী চেতনা' (unhappy conscience in Hegel's philosophy) বইটা প্রকাশ করেন। পরে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচিত হইলে তৎকালের ফরাসি চিন্তার মূল প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন কাজ ছিল এইটা। এই লেখা সার্ত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ ফরাসী চিন্তকদের ভাবনায় দারুন প্রভাব রাখছিল সেইসময়।


অন্য যেই চিন্তক তৎকালের ফ্রান্সে হেগেলের চিন্তা নিয়ে ভাবিত ছিলেন তিনি হইলেন আলেক্সান্দ্রে কোয়েরে (Alexandre Koyré)। যদিও হেগেল নিয়ে বিস্তৃত লেখেন নাই, কিন্তু কয়খানা গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখছিলেন। এই যেমনঃ Hegel at Jena (১৯৩৪-৩৫)। ফেনোমেনোলজি অব স্পিরিটের আগের হেগেলের চিন্তা যার অনুবাদ ফান্সে তখনও হয়নাই তার পোক্ত বোঝাপড়া পাওয়া যায় কোয়েরের কাজে। উনার আমন্ত্রণেই এক্যোল নরমেল সুপিরিয়রে ১৯৩৩ থেকে ৩৯ সাল অবধি হেগেলের উপর লেকচার দেন আলেক্সান্দ্রে কোজেভে(Alexandre Kojève)।


আলেক্সান্দ্রে কোজেভ ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত হেগেলের ফেনোমেনোলজি অফ স্পিরিট নিয়ে ধারাবাহিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যাকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সের জ্ঞানজগতে হেগেলের এক নতুন আবিভার্ব ঘটে। কেউ কেউ এটাকে ফ্রান্সে ‘হেগেলের রেনেসাঁ’ হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন । ফেনোমেনোলজি অব স্পিরিটের উপর কোজেভের লেকচারগুলো প্রভু-দাস দ্বন্দকে বিখ্যাত করে তুলেছে। হেগেলের চিন্তাকে নৃবৈজ্ঞানিক ভিত্তি দেওয়ার চেষ্টা দেখা যায় এই লেকচারগুলোতে। কোজেভ হেগেলের মধ্যে মার্ক্সের চেয়েও অধিক মৌলিক 'কর্মকাণ্ডের তত্ত্ব' ও 'ঐতিহাসিক প্রগতি' খুঁজে পেয়েছিলেন। এই লেকচারের নোটগুলো একত্রে ১৯৪৭ সালে বই আকারে বের হয়। পরে Introduction to the Reading of Hegel এই নামে ইংরেজি অনুবাদ বের হয়। ইংরেজি অনুবাদের সম্পাদক ছিল হেগেলের ইতিহাসের সমাপ্তির ধারণার রাজনৈতিক ভাষ্য নির্মাতা ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার শিক্ষক আলান বুম। তবে ইংরেজি সংস্করণে 'হেগেলের দর্শনে মৃত্যুর ধারণা' এই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি দেয়া হয়নাই। কোজেভের এই প্রবন্ধরে ফোকাস করে জর্জ বাতাই'র 'হেগেল, মৃত্যু ও স্যাক্রিফাইস' প্রবন্ধ লেখা হয়েছিল। দেরিদার Writing and Difference বইয়ের From Restricted to General Economy: A Hegelianism without Reserve লেখাটায় বাতাই'র হেগেল পাঠের যে দেরিদীয় পাঠ পাওয়া যায় সেখানে কোজেভের প্রবন্ধটার যথেষ্ট ভূমিকা রইছে।


জর্জ বাতাই [Georges Bataille], মরিস ব্লাঁশো [Maurice Blanchot], মরিস মার্লো-পটি [Maurice Merleau-Ponty], আন্দ্রে ব্রেতোঁ [Andre Breton], জাক লাকাঁ [Lacan], রেমন্ড অ্যারন[Raymond Aron], হেনরি কোবেন [Henry Cobin], ফুকো, দেরিদা সহ পরবর্তীকালে যারা ফ্রান্সের তত্ত্বজগতের দিকপাল হয়ে ওঠেন, তাঁদের প্রায় সকলেই এই বক্তৃতামালায় হাজির হতেন। জঁ ইপ্পোলিৎ তাঁদের মধ্যে একজন। ফরাসী চিন্তা জগতে হেগেল পাঠকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিতকরণে কোজেভের পরেই ইপ্পোলিতের অবস্থান। আলেক্সান্দ্রে কোজেভ যেখানে মানবিক আর প্রাকৃতিক জগতকে সত্তাগতভাবে স্বতন্ত্র এলাকা হিসেবে বিবেচনা করেন, জঁ এপ্পোলিত সেখানে সময়কে বিবেচনা করেন এক পরম হিসেবে যেইটা উভয় এলাকাকে শাসন করে। জঁ ভাহল ও আলেক্সান্দ্রে কোয়েরেকে পূর্ণ শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেনঃ আমার প্রথম সম্বিৎ আসে ভাহলের থেকে। ভাহলের 'হেগেলের দর্শনে অসুখী চেতনা' (unhappy conscience in Hegel's philosophy) পড়াটা আমার কাছে ছিল ওহী আসবার মতোন ব্যাপার।

আলেক্সান্দ্রে কোজেভ


যদিও ভাহ্‌ল ও কোয়েরের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে হেগেলের দর্শনের পুনর্মূল্যায়নের যাত্রা শুরু হয়েছে, তবে জঁ ইপ্পোলিৎ ও কোজেভই ফ্রান্সে হেগেল পাঠে রেনেসাঁ ঘটান। জঁ ইপ্পোলিতের জন্ম ফ্রান্সের জুজ্যাকে। গ্র্যাজুয়েশনের পর তিনি হেগেলের নিবিড় পাঠে নিবিষ্ট হন। হেগেলের ফেনোমেনোলজি অফ স্পিরিট পড়ার জন্যে জার্মান ভাষা শেখেন এবং ১৯৩৯ সনে নিজেই এই বইয়ের অনুবাদ বের করেন। এই অনূদিত বই ও জুড়ে দেয়া নিজস্ব মন্তব্যই পরবর্তীকালে তার লেখা ফেনোমেনোলজি অফ স্পিরিট -এর Genesis and Structure of Hegel's "Phenomenology of Spirit বইয়ের পাটাতন হিসেবে কাজ করে। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৯ সালে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে ইপ্পোলিৎ ‘ইউনিভার্সিটি অফ স্ট্রসবার্গ’ এর অধ্যাপক হন। ১৯৪৯ সালে সর্বোনে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই পদেই থাকেন। ১৯৫২ সালে ইপ্পোলিৎ তাঁর লজিক এন্ড এক্সিস্টেন্স বইটি প্রকাশ করেন।


এপ্পোলিৎ তাঁর ১৯৫৩ সালের Logic and existence বইতে ফেনোমেনোলজি ও লজিকের মধ্যে সম্পর্ককে হেগেলীয়/হেগেলবাদের 'সর্বাধিক দুর্বোধ্য দ্বান্দিক সিন্থেসিস' হিসেবে মূল্যায়িত করেছেন। হেগেলের নৃবৈজ্ঞানিক পাঠ কোজেভকে বিখ্যাত করেছিল। ফেনোমেনোলজি ও লজিকের সম্পর্কের এপ্পোলিতের নন-রিডাকশনিস্ট পাঠ দারুণভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয় কোজেভের হেগেল-পাঠকে। মার্টিন হাইডেগার তাঁর 'মানবতাবাদের প্রতি সাড়া/চিঠি'র মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যে যে ফরাসি মানবতাবাদ-বিরুদ্ধ আগুন জ্বালাইছিলেন তাতে হাওয়ার জোগান দিয়েছে এপ্পোলিতের এই লজিক অ্যান্ড এক্সিটেন্স। এই বই আলথুসের, দেল্যুজ, ফুকো, দেরিদাসহ যারাই এপ্পোলিতের কাছে দীক্ষা নিছেন তাদেরকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে।


ধারণা করা হয় পরবর্তীকালের উত্তর-কাঠামোবাদ বলে পরিচিত মতবাদ দাঁড় হওয়ার পেছনে এই বইয়ের বড় ভূমিকা ছিলো। এখানে ইপ্পোলিৎ হেগেলের লজিকের সাথে হেগেলেরই ফেনোমেনোলজির আন্তঃসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। এটা করতে গিয়ে, ভাষা, সত্ত ও ভিন্নতার প্রশ্নগুলি উঠে আসে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে নব্য ফরাসী দর্শন, চিন্তার জগতে যে ছাপ ফেলে তা মূলত এই প্রশ্নগুলিকে ঘিরেই। এই বইয়ের উপরে লেখা দেল্যুজের রিভিয়্যুতে এই বইয়ের সেন্ট্রালিটি এবং গুরুত্বের একটা চমকপ্রদ ইংগিত পাওয়া যায়।


বাল্টিমোরে ১৯৬৬ সালের যেই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে উত্তর-কাঠামোবাদ হাজির হচ্ছে তা সম্পর্কে কম বেশি সবাই ওয়াকিবহাল। এই সম্মেলনে হাজির ছিলেন রোলাঁ বার্থ, জাক লাকাঁ, জাক দেরিদা, লুসিয়ঁ গোল্ডমান, জঁ-পল ভেরনা এবং ত্রিস্তান তোদোরব সহ আরো অনেকে। মিশেল ফুকো অবশ্য এই সম্মেলনে ছিলেন না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে

জঁ ইপ্পোলিত [Jean Hyppolite] ফরাসি তরফে এই সভা আঞ্জাম করিয়াছিলেন।



জুডিথ বাটলারের কাজে উত্তর-কাঠামোবাদী চিন্তার, বিশেষ করে দেরিদা ও ফুকোর, বড় রকম প্রভাব থাকলেও তিনি শুরু করেছিলেন উত্তর কাঠামোবাদের সমালোচনা করে। ওঁনার ভাষায়, উনি এক রকম এটাকে “রেজিস্ট” করেছেন। 'বাসনার কর্তারাঃ বিংশ শতকের ফ্রান্সের চিন্তায় হেগেলীয় প্রতিবিম্ব' আসলে ছিল জুডিথ বাটলারের ডক্টরাল থিসিস। ১৯৮৭ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়। ফেনোমেনোলজি গ্রন্থে হেগেলের বাসনার তৈয়ার থেকে আরম্ভ করে কোজেভ, এপ্পোলিৎ, সার্ত্রে, লাকাঁ, দেল্যুজ ও ফুকোতে সেইটার অধিকার - এই ট্রাজেক্টরি বা অরবিটের সন্ধান করবার চাইছেন বাটলার এইখানে। ফুকো আর হেগেলের নৈকট্য/আত্মীয়তার আলাপে তিনি আবার ফিরছেন তাঁর ১৯৯৭ সালের The Psychic Life of Power: Theories in Subjection বইতে। যুগপৎভাবে কর্তাসত্তা তৈরি ও নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ অধীনতার দো-ধারী এই সংশ্লেষ নিয়ে ফুকোর যে ভাবনা সেটা কিছু আকারে আগে থেকেই রূপায়িত দেখতে পাই হেগেলের জামিনদারের মুক্তির আলাপে।


উত্তর-কাঠামোবাদী চিন্তার বোঝাবুঝির জন্য কোজেভে ও ইপ্পোলিৎ কর্তৃক হেগেলের পূনঃমূল্যায়ন ও ফ্রান্সে হেগেলের ‘রেনেসাঁ’র নিবিড় পাঠ প্রয়োজন। (কাঠামোবাদী ও) উত্তর কাঠামোবাদী চিন্তার সাথে এর যে সম্পর্ক তা আরো খতিয়ে দেখা দরকার। উত্তর কাঠামোবাদী চিন্তা-ধারা আরো ভালোভাবে

বুঝতে গেলে কোনোভাবে ফ্রান্সের এই ‘হেগেল-কান্ড’ ও জঁ ইপ্পোলিৎকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া চলেনা।


তথ্যসূত্রঃ



প্রথম প্রকাশঃ ২৫শে জুলাই, ২০১৮

সর্বশেষ সংশোধনঃ ২৫শে জুলাই, ২০১৮

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/825588474864229/