জোসেফ স্ট্যালিন, তরলীকৃত মার্ক্সবাদ ও হেনরি লেফেভ্রের পরা-মার্ক্সবাদ



বিংশ শতকের প্রথমার্ধে পরাবাস্তববাদীদের(surrealist) যে বিপ্লবী জজবা ছিলো তার উপস্থিতি তাঁদের নিয়ে যেকোন আলোচনাতেই কদাচিৎ হাজির থাকে। মরিস ব্লাঁশো অনেকটা ঠাট্টা করেই বলছেন যে পরাবাস্তবাদীরা সম্ভবত চেয়েছিলো বিপ্লবের পরে প্রতিটা মানুষ পরাবাস্তববাদী হয়ে উঠবে। পরাবাস্তববাদীদের এইরকম তীব্র আশাবাদের কারণেই হয়তো দল বেধে আন্দ্রে ব্রেতোঁর নেতৃত্বে তাঁরা ১৯২৭ সালে ফ্রেঞ্চ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। হেনরি লেফেভ্রে(Henry Lefabvre) অবশ্য পার্টিতে যোগ দেন একটু দেরিতে, ১৯২৮ সালে। (ব্রেতোঁ পরাবাস্তববাদের দ্বিতীয় মেনিফেস্টোতে অবশ্য লেফেবভ্রে সহ পিয়েরে মোরাঞ্জ ও জর্জ পলিতজার অর্থাৎ যারা Philosophies দলের সাথে যুক্ত ছিলেন তাঁদের তুলোধুনা করেন। ব্রেতোঁর অভিযোগ তাঁরা 'মার্ক্সবাদ' থেকে সরে গেছেন)।


১৯২৪ সালে হেনরি লেফেভ্রে আন্দ্রে ব্রেতোঁ মারফত হেগেলের চিন্তার সাথে পরিচিত হন। ইতোমধ্যেই লেফেভ্রে অনেকটা 'অস্তিবাদী'(Existentialist) ছিলেন। সব মিলিয়ে লেফেভ্রে'তে মার্ক্সবাদের সাথে আরো যুক্ত আছে অস্তিবাদ ও পরাবাস্তববাদ। কিন্তু একই সাথে এটাও মাথায় রাখা দরকার যে প্রথমত ফনডেন(Fondane) যেরকম করে নেতিকে বুঝতে চাচ্ছেন তাতে পুরোপুরি সায় উনি দিচ্ছেন না। দ্বিতীয়ত, পরাবাস্তববাদীরা স্বপ্নের জগতে যেরকম জোর দিতে চান তা করতে লেফেভ্রে রাজি নন।

যাইহোক, লেফেভ্রে জোর দিচ্ছেন alienation ও অন্তরাত্মার অন্তঃবিভাজনে যা পরাবাস্তবাদী ও অস্তিবাদী উদ্বেগেরই বহিঃপ্রকাশ। এই জোর দেয়াই লেফেভ্রেকে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির চিন্তা প্রক্রিয়ার বাইরে নিয়ে যায়, যারা কিনা লেনিনের ম্যাটেরিয়ালিজম ও এম্পিরিও-ক্রিটিসিজম (১৯০৯) বইকে বাইবেল জ্ঞান করত। এই বইয়ে লেনিন কনশাসনেসকে ম্যাটেরিয়াল রিয়েলিটির প্রতিফলন আকারেই দেখছেন। কিন্তু নোটবুকস অন হেগেল'স ডায়ালেক্টিক্স(Notebooks on Hegel's dialectics) বইয়ে লেনিন কনশাসনেসকে আরো দ্বান্দিকভাবে পাঠ করছেন। এই বই লেফেভ্রে অনুবাদ করেন। লেফেভ্রের মতে, কনশাসনেস (consciousness) কোন অটোনোমাস সাবস্টেন্স(autonomous substance) না। আবার নিছক জগতের প্রতিফলনও না। বরং কনশাসনেস একটা বাস্তবতা যার মানুষের সাথেই জন্ম হয়, তার বিকাশ হয় এবং ঐ মানুষের সাথেই মারা যায়। কনশাসনেস ইন্ডিভিজুয়ালেরই হয়, কখনো কালেক্টিভের হয়না।


১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয় লেফেভ্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বই (যদি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ না হয়ে থাকে) দ্বান্দিক বস্তুবাদ(Dialectical Materialism)। এর মধ্যেই উনি পার করে ফেলেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ বিশটি বছর। কমিন্টার্নের দ্বান্দিক বস্তুবাদের সাথে লেফেভ্রের দ্বান্দিক বস্তুবাদকে গুলিয়ে ফেলা যাবেনা। লেফেভ্রে মনে করতেন মার্ক্সবাদ পার্টির কৌশল ঠিক করার কোন অনড় মতবাদ বা হাতিয়ার নয়। বরং মার্ক্সবাদ হচ্ছে তত্ত্ব ও চর্চার এক গতিময় আন্দোলন। এই বইটাকে অনেকেই পড়েন জোসেফ স্ট্যালিনের লেখার প্রত্যুত্তর হিসেবে। ঐতিহাসিকভাবে বিবেচনা করলে এটা অনেকটাই তাই।


১৯৩৮ সালে ডায়ালেক্টিকাল এন্ড হিস্টোরিকাল ম্যাটেরিয়ালিজম নামে সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান জোসেফ স্ট্যালিনের একটা আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। এইখানে স্ট্যালিন দ্বান্দিক বস্তুবাদকে মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী পার্টির বৈশ্বিক চেহারা হিসেবে ঘোষণা করেন। স্ট্যালিন মূলত এঙ্গেলসের প্রকৃতির দ্বান্দিকতা(Dialectics of Nature) ও এন্টি-ড্যুরিংয়ের সংকীর্ণ ইন্টারপ্রেটেশন দেন। স্ট্যালিন প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা ও যান্ত্রিক বস্তুবাদী চিন্তা-ভাবনাকে একত্রিত করেন। কনশাসনেস নিয়ে স্ট্যালিনের পূর্বানুমান জগতের প্রতিফলন স্বরূপ যা নিয়ে ইতোপূর্বেই আলোচনা হয়েছে। স্ট্যালিনের উদ্দেশ্য ছিল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মত করে সমাজের ইতিহাসের বিজ্ঞান নির্মাণের।


লেফেভ্রের দ্বান্দিক বস্তুবাদ প্রকাশিত হওয়ার আগে লেফেভ্রে ও গুটারম্যান পার্টির তোপের মুখে পড়েছিল। লেনিনের নোটবুকস অন হেগেল'স ডায়ালেক্টিক্স অনুবাদ করতে গিয়ে তাঁরা দেখাচ্ছিলেন কিভাবে লেনিনের ডায়ালেক্টিক্স ভাবনায় হেগেল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। এই অনুবাদ এবং দ্বান্দিক বস্তুবাদ (১৯৩৯) বইতে কিভাবে পরিণত মার্ক্স ও লেনিনে এক নতুন হেগেল হাজির হচ্ছে তার বয়ান নির্মাণ করছেন লেফেভ্রে। দ্বান্দিক বস্তুবাদ বইতে লেফেভ্রে বেশি জোর দিচ্ছেন হেগেলের Science of Logic বইতে। বইয়ের শুরুতেই উনি দেখাবেন লজিকে হেগেলের ডায়ালেক্টিক্স কিভাবে কাজ করে তা। এই অংশে হেগেলের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি দেখান কিভাবে হেগেল কান্টের ফর্ম(form) আর কন্টেন্টের(content) দ্বৈততা থেকে বের হয়ে যান। প্রশংসা করলেও হেগেলের কাজের সীমানাও ঠিক করে দেন তিনি। পদ্ধতি হিসেবে ডায়ালেক্টিকাল লজিক(Dialectical Logic) কার্যকর হলেও হেগেলের প্রকল্প আসলে ব্যর্থ হয়ে যায়। বইয়ের দ্বিতীয় অংশের পাটাতনও ঠিক হয়ে যায় হেগেলের সমালোচনার মধ্যে দিয়ে। এই অংশে লেফেভ্রে মার্ক্স ও হেগেলের সম্পর্ক বিচার করেন। তাঁর মতে, বইতে। বইয়ের শুরুতেই উনি দেখাবেন লজিকে হেগেলের ডায়ালেক্টিক্স কিভাবে কাজ করে তা। এই অংশে হেগেলের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনি দেখান কিভাবে হেগেল কান্টের ফর্ম(form) আর কন্টেন্টের(content) দ্বৈততা থেকে বের হয়ে যান। প্রশংসা করলেও হেগেলের কাজের সীমানাও ঠিক করে দেন তিনি। পদ্ধতি হিসেবে ডায়ালেক্টিকাল লজিক(Dialectical Logic) কার্যকর হলেও হেগেলের প্রকল্প আসলে ব্যর্থ হয়ে যায়। বইয়ের দ্বিতীয় অংশের পাটাতনও ঠিক হয়ে যায় হেগেলের সমালোচনার মধ্যে দিয়ে। এই অংশে লেফেভ্রে মার্ক্স ও হেগেলের সম্পর্ক বিচার করেন। তাঁর মতে, মার্ক্স-হেগেল সম্পর্কের আসলে দুইটা ধাপ আছে। প্রথম দিককার কাজে বিশেষ করে মার্ক্সের ইকোনোমিক-ফিলোসফিকাল ম্যানুস্ক্রিপ্টস (১৮৪৪) ও জার্মান ইডিওলজি (১৮৪৫-৪৬) বইয়ে তিনি ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিত নির্মাণ করেন। এই সময়েও মার্ক্স হেগেলের Science of Logic নিয়ে নেতিমূলক ধারনা পোষণ করতেন বলে লেফেভ্রে মনে করেন। Poverty of Philosophyকমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো'তে তিনি এটাকে একেবারে বাতিলের খাতায় ফেলে দেন এই বলে যে হেগেলের প্রস্তাবনা পুরোদস্তুর বিমূর্ত। এটাকে আসলে মানবতার বস্তুবাদী চিন্তার সাথে খাপ খাওয়ানো যায়না। ১৮৫৮ সালে এঙ্গেলসকে লেখা মার্ক্সের এক চিঠির মাধ্যমে জানা যায় যে A Contribution to the Critique of Political Economy বইয়ের ভূমিকা ও ক্যাপিটাল লেখার সময়ে মার্ক্স আরেকবার হেগেলের লজিকে ফেরত যান। লেফেভ্রে মনে করেন এই সময়টাতেই মার্ক্স হেগেলের লজিককে তাঁর প্রকল্পের সাথে অঙ্গীভূত করতে সমর্থ হন। এই শেষের কাজগুলিতে ভাববাদ ও বস্তুবাদের শুধু মিলনই ঘটেনি বরং মার্ক্স এই দুইকেই অতিক্রম(transcend) করে গেছেন।


এই স্তরে এসে মার্ক্স এমনতর দ্বান্দিক বস্তুবাদের কথা বলছেন যা ভাববাদের বাহ্যিক কোন প্রতিপক্ষ নয়(যেরকমটা স্ট্যালিন মনে করেন)। উপরন্তু এই দ্বান্দিক বস্তুবাদ হেগেল ও খোদ মার্ক্সের ভাববাদ নিয়ে প্রথম দিককার পর্যালোচনাকে অতিক্রম করে যায়। এটা সবচাইতে বেশি খাটে ক্যাপিটাল বইয়ের ক্ষেত্রে।


পাদটীকাঃ এটি কোন মৌলিক লেখা নয়। ইংরেজি ভাষায় রচিত/অনূদিত কয়েকটি বই ঘেটে, বাংলায় অনুবাদ করে ও তার সাথে কিছু মন্তব্য জুড়ে দিয়ে লেখা হয়েছে।


তথ্যসূত্রঃ


১। Dialectical Materialism by Henry Lefebvre (Translated by John Sturrock)


২। French Hegel: From Surrealism to Postmodernism by Bruce Baugh


৩। A companion to Dada and Surrealism by David Hopkins


প্রথম প্রকাশঃ ১৪ই জুন, ২০১৯

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/bodhichittaju/posts/1886148511485711

https://www.facebook.com/notes/429498791351360/