এ দুনিয়ায় নীটশেই মূলত আমার আপনজন
জর্জ বাতাই
“নীটশের লেখালেখিতে ছড়িয়ে আছে তাঁর রক্ত । ঠিক যতটা রক্তাক্ত হয়েছেন নীটশে লিখতে গিয়ে ঠিক ততটাই রক্ত ঝরাতে হবে তাকে বুঝতে গেলে, তাঁর সমালোচনা করতে গেলে”।
- জর্জ বাতাই
১৯৩৬-৩৭ এর শীতে মার্টিন হাইডেগার যখন ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে নীটশের ওপরে বক্তৃতা দিচ্ছেন, জর্জ বাতাই ও তাঁর কাছের কিছু বন্ধু মিলে বের করছেন আসেফালের দ্বিতীয় সংখ্যা। অন্যান্যদের মধ্যে তাঁর সাথে যুক্ত ছিলেন শিল্পী আন্দ্রে মেসো, দার্শনিক জঁ ভাহ্ল ও পিয়ের ক্লসৌস্কি। এই সংখ্যার শিরোনাম ছিলো “নীটশে ও ফ্যাসীবাদীরা”। এই সংখ্যার প্রচ্ছদ হিসেবে একজন মাথা ও যৌনাঙ্গ বিহীন মানুষের আদল আঁকেন মেসো। আসেফাল শব্দের মানেই হচ্ছে যার মাথা নেই। এই মাথাহীন মানুষ একই সাথে ‘অতিমানব’ ও ‘ঈশ্বরের মৃত্যুর’ ইশারা। এই সংখ্যার উদ্দেশ্য ছিলো নীটশেকে ফ্যাসীবাদীদের হাত থেকে উদ্ধার করা। এলিজাবেথ ফর্স্টার সহ আরো বেশ কয়েকজনকে বাতাই এই সংখ্যায় তাঁর লেখায় তীব্র আক্রমণ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন জর্জ লুকাস, আলফ্রেড রোজেনবার্গ ও আলফ্রেড বাম্লার। বাতাই মনে করেন এরা সবাই উলটাপালটা ব্যাখ্যা করে নীটশের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন। নীটশের উদ্ধৃতিকে কন্টেক্সটের বাইরে নিয়ে গেছেন ও তাঁর চিন্তাকে পুরোদস্তুর নষ্ট করেছেন। বাতাইরা শুধু ফ্যাসীবাদীদের হাত থেকে নীটশেকে উদ্ধারই করছেন না। বরং তাঁরা এক বিশেষ নীটশের নির্মাণ করছেন আসেফালের এই সংখ্যায়। নীটশের চিন্তা নিয়ে তাঁরা বলছেন যে এটা এমন কোন চিন্তা না যা আপনি প্রয়োগ করতে পারবেন, অথবা কৌশলগত ভাবে ব্যবহার করতে পারবেন।
যুদ্ধের সময়ে লেখা বাতাইর ব্যক্তিগত ডায়েরী থেকে জানা যায় নীটশে ছিলো বাতাই'র লাইফলাইন। নীটশের কাজ বাতাইকে তীব্র ব্যথা-বেদনার মধ্য দিয়ে নিয়ে গেছে। অন নীটশে বইয়ে বাতাই লিখছেন “এ দুনিয়ায় নীটশেই মূলত আমার আপনজন”। যুদ্ধ চলাকালীন সময় বাতাই অন নীটশে লিখেছেন। ডায়েরী ঘেটে জানা যায় সময়টা ছিলো ১৯৪৪ এর ফেব্রুয়ারী থেকে আগস্ট এর মধ্যে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো ১৯৪৪ সালের অক্টোবর মাসে নীটশের শততম জন্মদিনে বইটি বের করার।
বাতাই'র লেখা নীটশের মতই এফোরিস্টিক (aphoristic) প্রকৃতির। এমনভাবে রচিত যেন একটা গভীর ব্যক্তিগত অনুসন্ধানে ব্যস্ত এর লেখক। বাতাই, ক্লসৌস্কি ও ব্লাঁশোদের নীটশে-পাঠ ফুকোকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। বিশেষ করে বাতাই'র এই বই। ফুকো প্রথাগত দর্শনকে কেবল দর্শনের ইতিহাস চর্চা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ফুকোর দর্শন চর্চা একরকম এক্সপেরিমেন্টেশনের মত। এই এক্সপেরিমেন্টেশনের উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের কাছ থেকে নিজেকে ছিড়ে ফেলা যাতে, নতুন কেউ হয়ে ওঠা যায় ও নতুন চিন্তা তৈরী করা যায়।
বাতাই, নীটশের সাথে তাঁর সম্পর্ককে বলছে এক অসম্ভব সম্পর্ক। নীটশের চিন্তার সাথে যুক্ত হওয়ার এক নিরন্তর ও মর্মান্তিক সংগ্রামের এই সম্পর্ক। নীটশের লেখালেখিতে বাতাইর সবচাইতে আগ্রহের জায়গা ছিলো “God is dead” এ। আরও বড় পরিসরে চিন্তা করলে নীটশেতে ‘মন্দ(evil)’ যেভাবে হাজির আছে তাতে বাতাইর ঝোঁক ছিলো বেশি। আসলেই এই মন্দের উর্দ্ধে যাওয়া যায় কিনা তা বাতাইর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা ছিলো।বলা যায়, নীটশে পাঠে যেখানে ‘Will to power’ এ মনযোগ দেয়া হয় সেখান থেকে ‘ডেথ অফ গড’ এ মনযোগ ফেরানোও বাতাই’র উদ্দেশ্য ছিলো।
এক্সপেন্ডিচার-স্যাক্রিফাইস-লাফটার, পুরো বাতাই জুড়েই ছড়িয়ে আছে নীটশে। যখন নীটশেকে উদ্ধৃত করা হচ্ছেনা, যখন তাঁর নামও নেয়া হচ্ছেনা তখনো নীটশে হাজির বাতাই’র লেখালেখিতে। তারপরেও বাতাই’র কাজে নীটশের প্রচুর উদ্ধৃতি রয়েছে। নীটশে থেকে যে যে উদ্ধৃতি বাতাই নিচ্ছেন তাতে ‘সময়’ এর ‘অভিজ্ঞতা’র প্রসংগ থেকেছে মূল ফোকাস বিন্দু। যেই অভিজ্ঞতা আবার সত্ত্বার বিনাশ ঘটায়।
On Nietzsche বইয়ের ভূমিকাতে সিলভিয়া লত্রিঞ্জার বলছেন যে জর্জ বাতাই, হাইডেগার বা সার্ত্রের মত কোন ‘গতানুগতিক’ দার্শনিক ছিলেন না। ভাষা নিয়ে বাতাই যথেষ্ট সন্দেহবাতিকগ্রস্থ ছিলেন। উনার যাপনের সাথে সংগতিপূর্ণ নয় এমন কোন ধারণা বাতাই নির্মাণ করেন নাই। অতএব On Nietzsche বইকে প্রথাগত কমেন্ট্রির বই হিসেবে পড়া উচিৎ হবেনা। নীটশেতে বাতাই নিজেকে যেভাবে খুঁজে পেয়েছে তারই দলিল 'নীটশে সম্বন্ধে'।
১৯২২-২৩ সালে রাশিয়ার দার্শনিক লেভ শেস্তভকে তাঁর নিজের বই The Idea of the Good in Tolstoy and Nietzsche ফরাসীতে অনুবাদে সহযোগিতা করেন বাতাই। এই সময় থেকেই বাতাই'র সাথে নীটশের এক বন্ধন রচিত হয় যা আমৃত্য অটুট ছিলো। বাতাই'র সাথে নীটশের সম্পর্ককে তিনভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে পড়বে ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত যতদিন বাতাই আসেফাল দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। এই সময়ে বাতাই নীটশেকে কাধে নিয়ে ক্রিশ্চিয়ানিটির বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধ চালিয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়কে। এই সময়ে নীটশের সাথে বাতাইর সবচাইতে ঘনিষ্ট সময় কেটেছে। লিখেছেন On Nietzsche। তৃতীয় ধাপে পড়বে ৫০ এর দশক। এই সময়টাতে উনি সার্বভৌমত্ব আর স্টালিনীয় রেজিম নিয়ে বেশ কয়েকটা আর্টিকেল লিখেছেন। বাতাই’র মৃত্যুর পরে Sovereignty (১৯৯৩) শিরোনামে প্রকাশিত বইয়ে এই আর্টিকেলগুলি একত্রিত করা হয়েছে।
পাদটীকাঃ এটি একটি দীর্ঘ অমৌলিক লেখার প্রথমাংশ। সকল কিস্তি প্রকাশ করার পরে, বোধিচিত্তের একাডেমিয়াতে লেখাটি যখন তোলা হবে তখন তথ্যসূত্র উল্লেখ করে দেয়া হবে
প্রথম প্রকাশঃ ২৭শে জুন, ২০১৯
লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/bodhichittaju/photos/1907090446058184