ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের রয়্যাল লাইব্রেরীর বাগানে অবস্থিত সোরেন কিয়ের্কেগার্দের ভাষ্কর্য


অস্তিবাদঃ একটি মুখবন্ধ

জঁ ভাহ্‌



[১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে নিউ রিপাবলিক পত্রিকায় দার্শনিক জঁ ভাহ্‌(Jean Wahl)-এর “Existentialism: A Preface” শিরোনামের লেখাটি প্রকাশিত হয়। বিংশ শতকের ফরাসী চিন্তাপ্রবাহে যে নানান দিক এসে মিলিত হয়েছে তার একটা হদিস করবার জন্য এই লেখাটি বেশ কাজের হবে ভেবে অনুবাদ করে দেয়া হয়েছে। একই সাথে ফ্রান্সের চিন্তাচর্চায় কিয়ের্কেগার্দের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি ও অস্তিবাদের সিলসিলার খোঁজ করতেও এই লেখাটি সহায়তা করবে বলে আমরা আশাবাদী। তথাকথিত উত্তর-আধুনিক চিন্তকেরা সহ বাকি যারা বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফ্রান্সে দর্শন চর্চা করেছেন তাঁদের চিন্তার নানাবিধ সূত্রগুলি যে আসমানী নয়, হঠাৎ করে একদিন মারফতি জ্ঞান হিসেবে নাজেল হয়নাই তাও কিছুটা আন্দাজ করা যাবে। মূল লেখার হদিস লেখার শেষে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে।]



প্যারিসে, গ্রিনউইচ গ্রামে এবং এমনকি ম্যানহাটনের কেন্দ্রেও অস্তিত্ব এবং অস্তিবাদ নিয়ে বেশ আলাপ চলছে। প্যারিসের ক্যাফে দ্যু ফ্লো (Cafe de Flore)-তে অস্তিবাদীরা জড়ো হন। Librairie Gallimard প্রকাশনী কর্তৃক অস্তিত্বের ওপরে ধারাবাহিকভাবে কিছু বই প্রকাশিত হচ্ছে। প্যারিসে অ্যাকশন (Action) পত্রিকায় একজন কমিউনিস্ট অস্তিবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে লিখছেন। লন্ডনে হরিযন (Horizon) পত্রিকা ফ্রান্সের অস্তিবাদী নাটকের ওপরে প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যেই অডেনের লেখা একটা প্রবন্ধ অস্তিত্বের একটি দিক ও উৎস হিসেবে কিয়ের্কেগার্দকে আমেরিকার জনপরিসরে পরিচিত করে তুলেছে।


একদা কিয়ের্কেগার্দ নামে এক লোক হেগেলের ধারণাগুলি নিয়ে গভীরভাবে অসন্তুষ্টি বোধ করছিলেন। হেগেল দেখিয়েছিলেন যে সত্য হচ্ছে সমগ্র। সেটা শিল্পে, সমাজে বা ইতিহাসে হোক। বিশেষের সমগ্রের বাইরেও একটা পরম সমগ্র আছে যা সকল কিছুকে ধারণ করে। কিন্তু কিয়ের্কেগার্দ বলছেনঃ “আমি কোন সমগ্রের অংশ না, আমি একিভূত হইনি, হইনি অন্তর্ভুক্ত। যেই সমগ্র তুমি কল্পনা করো তাতে রাখতে গিয়ে তুমি আমায় নেতি/নাই করো। আমি কে? সত্তদের সাপেক্ষে অনুভূতির এক তীব্রতা হচ্ছি আমি। বিশেষ করে সেই স্বর্গীয় সত্তার সাপেক্ষে, যে আমার বাসনাকে, আমার জ্ঞানকে উস্‌কে দেয়। ইশ্বর অর্থাৎ পরম অপরের সাথে আমি একরকম আত্মবিনাশী সম্পর্কে জড়াতে চাই।” কিয়ের্কেগার্দের আরেকটি ধারণা হচ্ছে যে, হেগেলের যুক্তিবাদী প্রকল্প সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দেয়। এবং আমাদের কর্মকে এমন এক জগতে বুঝে ওঠা সম্ভব যেখানে সম্ভাবনা হাজির থাকে। ইন্ডিভিজ্যুয়ালিটিকে সমাজ, যুক্তি, নীতিবোধ থেকে পৃথক করে এবং সম্ভাবনাকে বাস্তবতা থেকে আলাদা হিসেবে দাঁড় করান কিয়ের্কেগার্দ।


তো আর একবার “To be or not to be”ই প্রশ্ন হয়ে পড়ে। আমরা এটা বলে যেতে পারি যে অনেক মহান ব্যক্তিই অস্তিবাদী ছিলেন। অথবা কিয়ের্কেগার্দের সুরে আমরা বলতে পারি নিজেদের অজান্তেই অস্তিমান (existent men) ছিলেন যারা। আমরা এটার ইশারা দিয়েছি যে হ্যামলেট অস্তিমান (existent) ছিলেন। প্যাস্কেলও তাই। প্রায় অপরিচিত ফরাসী দার্শনিক লিকুইয়েরও অস্তিমান ছিলেন। এমনকি কার্লাইলও (কিন্তু চলুন আমরা কার্লাইলকে অলক্ষ্য স্থানে রাখি। আজকাল লোকে কার্লাইলকে খুব একটা পছন্দ করেনা। আমি করি)। মেলভিলও এই দলে পড়বেন। কিয়ের্কেগার্দ বলছেন, এমনকি সক্রেটিসও অস্তিমান মানুষ ছিলেন। আমরা এই তালিকায় সক্রেটিসের জানি দুশমন নীটশেকেও যুক্ত করতে পারি। এখন আমরা থামবো। এই জন্য যে আমরা দেখাতে পারবো প্লেটো, দেকার্ত, কান্টের মত মহান দার্শনিকদের দর্শনের ভিত্তিমূল হাতড়ালে খুঁজে পাওয়া যাবে অস্তিবাদী প্রত্যাদেশ।


এরপরে আসে দ্বিতীয় অঙ্কঃ কিয়ের্কেগার্দের জন্য, অস্তিত্ব ও ইশ্বর (তূরীয় ও পরম অপর) একই সাথে গাঁথা। কিয়ের্কেগার্দে আমরা যে প্রবণতাগুলি দেখতে পাই তার আর বেশি তত্ত্বায়িত ও সাধারণীকৃত প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় জার্মান দার্শনিক কার্ল ইয়েস্পার্স (Karl Jaspers)-এর দর্শনে। ঈশ্বর বা যশু খ্রিস্টের সাথে সম্পর্কের প্রশ্নে আর থেমে নেই। বরং এমন এক দুর্বোধ্য অলক্ষ্যের সাথে সম্পর্কের প্রশ্ন যাকে আমরা অনুভব করতে পারি, কিন্তু কোনদিনই ধরতে পারি না। পাই কেবল আংশিক ও ফেরারি মুহুর্তে যাতে করে শেষমেষ আমরা একরকম বিপর্যয়ের মুখে পড়ি ।


আরেকজন জার্মান দার্শনিক হাইডেগার ইশ্বরকে বাতিল করেন এবং এ নিয়ে তিনি বেশ দুঃখিত। কিন্তু দুঃখিত হওয়াটাই একটা অস্তিবাদী অনুভূতি। আমরা একা হয়ে গেছি, পরিত্যাক্ত হয়েছি। ইশ্বর যিনি কিনা নিজেই অস্তিত্বশীল নন তিনি আমাদের পরিত্যাগ করেনি। কিন্তু পরিত্যাক্ত ও নিক্ষিপ্ত হয়েছি in se (এটা নিয়ে যেকেউ প্রশ্ন তুলতে পারে)। যাই হোক আমরা একধরনের লোকোত্তর বা তূরীয় গমন অর্জন করি, যা অস্তিত্বশীল নয় এমন কোন ইশ্বরের দিকে আমাদের নিয়ে যায়না। বরং নিয়ে যায় জগতের দিকে, ভবিষ্যতের দিকে। আমরা জগতের বাইরের সত্ত হিসেবে নিজেদের জল্পনা-কল্পনা করতে পারিনা। আমরা যদি ছাড়িয়ে যাই, তবে জগতের মাঝেই অতিক্রম করে বা ছাড়িয়ে (transcend) যাই।


আমরা জগতের মধ্যেই তো আছি। এটা সাধারণ জ্ঞানের বিষয় মনে হয়। কিন্তু কার্যত খুব কম সংখ্যক দার্শনিকই এটার ওপরে জোর দিয়েছিলেন। দেকার্ত শুরু করছেন জগতের বাস্তবিকতাকে খারিজ করার মধ্যে দিয়ে। কান্ট জগতের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। হাইডেগারের মতে আমাদের সারসত্তকে জগত থেকে পৃথক করা যাবেনা। আমরা জগতের কাছে উন্মুক্ত। লাইব্‌নিজ বলেছিলেন যে মোনাডের (monads) কোন জানালা নেই। কিন্তু হাইডেগারের মতে ব্যক্তির কোন জানালা নেই, কারণ তারা মূলত বাহির।


হাইডেগারের জন্য, মানুষ মূলত সে সত্ত যে নিজের অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। এই অর্থে, সে এমন এক সত্ত যে দর্শন-করে (philosophize) নিজের সত্তর কারণেই। এইযে অস্তিত্বকে প্রশ্নের দিকে ঠেলে দেয়া (যেটা একই সাথে হাইডেগার যেটাকে বলছেন অস্তিত্বের বোধগম্যতা), এটা সত্তর নিজেকেই বিপদ ও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়ার নামান্তর।


এইযে ব্যক্তিসত্তর ঝুঁকির মুখে থাকার ধারণা, এটা আমাদেরকে হাইডেগারের দর্শনে যে দ্বিতীয় ছাড়িয়ে যাওয়ার ইশারা তার দিকে নিয়ে যায়। অর্থাৎ ভবিষ্যতের দিকে অতিক্রম করে যাওয়া। কিয়ের্কেগার্দে সম্ভাবনা প্রসঙ্গে যা আমরা দেখতে পাই এখানে আমরা আবারো তার ওপরে জোর খুঁজে পাই। মানুষ এমন এক সত্ত যে নিজেকে সবসময়ই নিজের সম্ভাবনাগুলির দিকে পরিচালিত করে। সে সবসময়ই নিজের থেকে এগিয়ে থাকে। তো, আমরা বলতে পারি এদিক থেকে বিবেচনা করলে অস্তিত্বের কাল আসলে ভবিষ্যত থেকে শুরু হয়। অস্তিত্ব হচ্ছে তা-ই যাকে অস্তিত্বশীল হতেই হবে। এই অর্থে আমরা এটাও বলতে পারি যে, জগতের সমগ্রতার আভাস সকল সত্যিকারের দার্শনিক প্রশ্নের মধ্যেই আছে। এই প্রশ্নগুলির মধ্যে ব্যক্তির নিয়তি সংকটাপন্ন। কিন্তু এই সম্ভাবনাগুলি কোন বিমূর্ত সম্ভাবনা নয়। ব্যক্তি কর্তৃক যে পথগুলি বেছে নেয়া হয়নি সেই সকল বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যেই এরা নিহিত রয়েছে। এই রকম করে, ব্যক্তি ভবিষ্যতের সাথে যেইভাবে যুক্ত ঠিক সেইভাবে অতীতের সাথে সম্পর্কিত। অতীত ও ভবিষ্যতের সাথে এই দ্বৈত সম্পর্কই বর্তমানকে নির্মাণ করে। আমরা দেখতে পাই কিভাবে সময় অস্তিত্বকে এবং অস্তিত্ব সময়কে নির্ধারণ করে। এবং মানুষ কখনোই তার পাশের মানুষের থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা হতে পারেনা। খোদ আমাদের জ্ঞানে অপর মানুষের হাজির থাকার আভাস পাওয়া যায়।


কিন্তু আমরা সবসময়ই এই সত্যিকারের অস্তিত্বকে ঠাওর করিনা। আমরা আমাদের অলসতা ও সামাজিক রীতিনীতির দ্বারা আরোপিত একটা ভাসা-ভাসা জীবন যাপন করি। মানুষ প্রাথমিকভাবে ভাসা-ভাসা পর্যায়ে থাকে। আরো গভীরে যেতে হলে কিছু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিয়ের্কেগার্দ ইতোমধ্যে সম্ভাবনার প্রলোভনের প্রকাশ হিসেবে উদ্বিগ্নতার (anxiety) গুরুত্বের ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। এই বেদনার অভিজ্ঞতাকে আর বেশি অধিবিদ্যক ও সত্তসম্বন্ধীয় ঠাট দেয়। বেদনার এই অভিজ্ঞতায় যে নাস্তি অনুভূত হয় তা সম্ভাবনার নাস্তির অংশবিশেষ নয়। বরং না-থাকার (Not Being) পুরোদস্তুর নাস্তি। হাইডেগারের মতে, না-থাকা হচ্ছে অ্যাক্টিভ বা সক্রিয়। কিন্তু তিনি এই তৎপরতাকে সেই সকল টার্ম ছাড়া প্রকাশ করতে পারেনা যারা কিনা আবার নিজেরাই নঞর্থক। ঠিক এই কারণেই উনি বলছেন যে নাস্তি (nothingness) অথবা না-থাকা; “নাস্তি নিজে নিজেই” কারণ উনি আসলে এটা বলতে পারেন না যে এটা আছে (it is) (এই অনুচ্ছেদটি যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদী ও অন্যান্যদের মধ্যে বেশ কেলেঙ্কারির কারণ হয়েছিল)। তো, হাইডেগার এমন একটা কিছু বলছেন যা অনেকটা এরকম দাঁড়ায় যে, নিজে নিজেকে এবং অন্য সকল কিছুকে নাস্তিকরণ (nothinging)। এটা হচ্ছে সত্তর নঞর্থক পটভূমি।


হাইডেগারের মুরিদেরা, বিশেষ করে লেভিনাস ও সার্ত্রে, সত্তর এই পটভূমির প্রকাশ হিসেবে গা-গোলানোভাব বা বিবমিষার (nausea) ওপরে জোর দিয়েছেন। কিন্তু, অস্তিত্বশীলকে এই উদ্বিগ্নতা ও বিবমিষার নিষ্ক্রিয় শিকার হিসেবে থাকতেই হবে এমনটি নয়। সে একে বিজয়ও করতে পারে। সে নিজের নিয়তি নিজের ঘাঁড়েই নিয়ে নিতে পারে। এটাকে হাইডেগার বলছেন সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত। (কিয়ের্কেগার্দ এটাকে বলেছেন পুনরাবৃত্তি। লক্ষ করে দেখুন, হাইডেগারের চিন্তার পেছনে আমরা প্রায়শই কিয়ের্কেগার্দের চিন্তাকে পাচ্ছি)।