ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের রয়্যাল লাইব্রেরীর বাগানে অবস্থিত সোরেন কিয়ের্কেগার্দের ভাষ্কর্য


অস্তিবাদঃ একটি মুখবন্ধ

জঁ ভাহ্‌



[১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে নিউ রিপাবলিক পত্রিকায় দার্শনিক জঁ ভাহ্‌(Jean Wahl)-এর “Existentialism: A Preface” শিরোনামের লেখাটি প্রকাশিত হয়। বিংশ শতকের ফরাসী চিন্তাপ্রবাহে যে নানান দিক এসে মিলিত হয়েছে তার একটা হদিস করবার জন্য এই লেখাটি বেশ কাজের হবে ভেবে অনুবাদ করে দেয়া হয়েছে। একই সাথে ফ্রান্সের চিন্তাচর্চায় কিয়ের্কেগার্দের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি ও অস্তিবাদের সিলসিলার খোঁজ করতেও এই লেখাটি সহায়তা করবে বলে আমরা আশাবাদী। তথাকথিত উত্তর-আধুনিক চিন্তকেরা সহ বাকি যারা বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ফ্রান্সে দর্শন চর্চা করেছেন তাঁদের চিন্তার নানাবিধ সূত্রগুলি যে আসমানী নয়, হঠাৎ করে একদিন মারফতি জ্ঞান হিসেবে নাজেল হয়নাই তাও কিছুটা আন্দাজ করা যাবে। মূল লেখার হদিস লেখার শেষে সংযুক্ত করে দেয়া হয়েছে।]



প্যারিসে, গ্রিনউইচ গ্রামে এবং এমনকি ম্যানহাটনের কেন্দ্রেও অস্তিত্ব এবং অস্তিবাদ নিয়ে বেশ আলাপ চলছে। প্যারিসের ক্যাফে দ্যু ফ্লো (Cafe de Flore)-তে অস্তিবাদীরা জড়ো হন। Librairie Gallimard প্রকাশনী কর্তৃক অস্তিত্বের ওপরে ধারাবাহিকভাবে কিছু বই প্রকাশিত হচ্ছে। প্যারিসে অ্যাকশন (Action) পত্রিকায় একজন কমিউনিস্ট অস্তিবাদী দর্শনের বিরুদ্ধে লিখছেন। লন্ডনে হরিযন (Horizon) পত্রিকা ফ্রান্সের অস্তিবাদী নাটকের ওপরে প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে। ইতোমধ্যেই অডেনের লেখা একটা প্রবন্ধ অস্তিত্বের একটি দিক ও উৎস হিসেবে কিয়ের্কেগার্দকে আমেরিকার জনপরিসরে পরিচিত করে তুলেছে।


একদা কিয়ের্কেগার্দ নামে এক লোক হেগেলের ধারণাগুলি নিয়ে গভীরভাবে অসন্তুষ্টি বোধ করছিলেন। হেগেল দেখিয়েছিলেন যে সত্য হচ্ছে সমগ্র। সেটা শিল্পে, সমাজে বা ইতিহাসে হোক। বিশেষের সমগ্রের বাইরেও একটা পরম সমগ্র আছে যা সকল কিছুকে ধারণ করে। কিন্তু কিয়ের্কেগার্দ বলছেনঃ “আমি কোন সমগ্রের অংশ না, আমি একিভূত হইনি, হইনি অন্তর্ভুক্ত। যেই সমগ্র তুমি কল্পনা করো তাতে রাখতে গিয়ে তুমি আমায় নেতি/নাই করো। আমি কে? সত্তদের সাপেক্ষে অনুভূতির এক তীব্রতা হচ্ছি আমি। বিশেষ করে সেই স্বর্গীয় সত্তার সাপেক্ষে, যে আমার বাসনাকে, আমার জ্ঞানকে উস্‌কে দেয়। ইশ্বর অর্থাৎ পরম অপরের সাথে আমি একরকম আত্মবিনাশী সম্পর্কে জড়াতে চাই।” কিয়ের্কেগার্দের আরেকটি ধারণা হচ্ছে যে, হেগেলের যুক্তিবাদী প্রকল্প সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দেয়। এবং আমাদের কর্মকে এমন এক জগতে বুঝে ওঠা সম্ভব যেখানে সম্ভাবনা হাজির থাকে। ইন্ডিভিজ্যুয়ালিটিকে সমাজ, যুক্তি, নীতিবোধ থেকে পৃথক করে এবং সম্ভাবনাকে বাস্তবতা থেকে আলাদা হিসেবে দাঁড় করান কিয়ের্কেগার্দ।


তো আর একবার “To be or not to be”ই প্রশ্ন হয়ে পড়ে। আমরা এটা বলে যেতে পারি যে অনেক মহান ব্যক্তিই অস্তিবাদী ছিলেন। অথবা কিয়ের্কেগার্দের সুরে আমরা বলতে পারি নিজেদের অজান্তেই অস্তিমান (existent men) ছিলেন যারা। আমরা এটার ইশারা দিয়েছি যে হ্যামলেট অস্তিমান (existent) ছিলেন। প্যাস্কেলও তাই। প্রায় অপরিচিত ফরাসী দার্শনিক লিকুইয়েরও অস্তিমান ছিলেন। এমনকি কার্লাইলও (কিন্তু চলুন আমরা কার্লাইলকে অলক্ষ্য স্থানে রাখি। আজকাল লোকে কার্লাইলকে খুব একটা পছন্দ করেনা। আমি করি)। মেলভিলও এই দলে পড়বেন। কিয়ের্কেগার্দ বলছেন, এমনকি সক্রেটিসও অস্তিমান মানুষ ছিলেন। আমরা এই তালিকায় সক্রেটিসের জানি দুশমন নীটশেকেও যুক্ত করতে পারি। এখন আমরা থামবো। এই জন্য যে আমরা দেখাতে পারবো প্লেটো, দেকার্ত, কান্টের মত মহান দার্শনিকদের দর্শনের ভিত্তিমূল হাতড়ালে খুঁজে পাওয়া যাবে অস্তিবাদী প্রত্যাদেশ।


এরপরে আসে দ্বিতীয় অঙ্কঃ কিয়ের্কেগার্দের জন্য, অস্তিত্ব ও ইশ্বর (তূরীয় ও পরম অপর) একই সাথে গাঁথা। কিয়ের্কেগার্দে আমরা যে প্রবণতাগুলি দেখতে পাই তার আর বেশি তত্ত্বায়িত ও সাধারণীকৃত প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় জার্মান দার্শনিক কার্ল ইয়েস্পার্স (Karl Jaspers)-এর দর্শনে। ঈশ্বর বা যশু খ্রিস্টের সাথে সম্পর্কের প্রশ্নে আর থেমে নেই। বরং এমন এক দুর্বোধ্য অলক্ষ্যের সাথে সম্পর্কের প্রশ্ন যাকে আমরা অনুভব করতে পারি, কিন্তু কোনদিনই ধরতে পারি না। পাই কেবল আংশিক ও ফেরারি মুহুর্তে যাতে করে শেষমেষ আমরা একরকম বিপর্যয়ের মুখে পড়ি ।


আরেকজন জার্মান দার্শনিক হাইডেগার ইশ্বরকে বাতিল করেন এবং এ নিয়ে তিনি বেশ দুঃখিত। কিন্তু দুঃখিত হওয়াটাই একটা অস্তিবাদী অনুভূতি। আমরা একা হয়ে গেছি, পরিত্যাক্ত হয়েছি। ইশ্বর যিনি কিনা নিজেই অস্তিত্বশীল নন তিনি আমাদের পরিত্যাগ করেনি। কিন্তু পরিত্যাক্ত ও নিক্ষিপ্ত হয়েছি in se (এটা নিয়ে যেকেউ প্রশ্ন তুলতে পারে)। যাই হোক আমরা একধরনের লোকোত্তর বা তূরীয় গমন অর্জন করি, যা অস্তিত্বশীল নয় এমন কোন ইশ্বরের দিকে আমাদের নিয়ে যায়না। বরং নিয়ে যায় জগতের দিকে, ভবিষ্যতের দিকে। আমরা জগতের বাইরের সত্ত হিসেবে নিজেদের জল্পনা-কল্পনা করতে পারিনা। আমরা যদি ছাড়িয়ে যাই, তবে জগতের মাঝেই অতিক্রম করে বা ছাড়িয়ে (transcend) যাই।


আমরা জগতের মধ্যেই তো আছি। এটা সাধারণ জ্ঞানের বিষয় মনে হয়। কিন্তু কার্যত খুব কম সংখ্যক দার্শনিকই এটার ওপরে জোর দিয়েছিলেন। দেকার্ত শুরু করছেন জগতের বাস্তবিকতাকে খারিজ করার মধ্যে দিয়ে। কান্ট জগতের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। হাইডেগারের মতে আমাদের সারসত্তকে জগত থেকে পৃথক করা যাবেনা। আমরা জগতের কাছে উন্মুক্ত। লাইব্‌নিজ বলেছিলেন যে মোনাডের (monads) কোন জানালা নেই। কিন্তু হাইডেগারের মতে ব্যক্তির কোন জানালা নেই, কারণ তারা মূলত বাহির।


হাইডেগারের জন্য, মানুষ মূলত সে সত্ত যে নিজের অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। এই অর্থে, সে এমন এক সত্ত যে দর্শন-করে (philosophize) নিজের সত্তর কারণেই। এইযে অস্তিত্বকে প্রশ্নের দিকে ঠেলে দেয়া (যেটা একই সাথে হাইডেগার যেটাকে বলছেন অস্তিত্বের বোধগম্যতা), এটা সত্তর নিজেকেই বিপদ ও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়ার নামান্তর।


এইযে ব্যক্তিসত্তর ঝুঁকির মুখে থাকার ধারণা, এটা আমাদেরকে হাইডেগারের দর্শনে যে দ্বিতীয় ছাড়িয়ে যাওয়ার ইশারা তার দিকে নিয়ে যায়। অর্থাৎ ভবিষ্যতের দিকে অতিক্রম করে যাওয়া। কিয়ের্কেগার্দে সম্ভাবনা প্রসঙ্গে যা আমরা দেখতে পাই এখানে আমরা আবারো তার ওপরে জোর খুঁজে পাই। মানুষ এমন এক সত্ত যে নিজেকে সবসময়ই নিজের সম্ভাবনাগুলির দিকে পরিচালিত করে। সে সবসময়ই নিজের থেকে এগিয়ে থাকে। তো, আমরা বলতে পারি এদিক থেকে বিবেচনা করলে অস্তিত্বের কাল আসলে ভবিষ্যত থেকে শুরু হয়। অস্তিত্ব হচ্ছে তা-ই যাকে অস্তিত্বশীল হতেই হবে। এই অর্থে আমরা এটাও বলতে পারি যে, জগতের সমগ্রতার আভাস সকল সত্যিকারের দার্শনিক প্রশ্নের মধ্যেই আছে। এই প্রশ্নগুলির মধ্যে ব্যক্তির নিয়তি সংকটাপন্ন। কিন্তু এই সম্ভাবনাগুলি কোন বিমূর্ত সম্ভাবনা নয়। ব্যক্তি কর্তৃক যে পথগুলি বেছে নেয়া হয়নি সেই সকল বিশেষ পরিস্থিতির মধ্যেই এরা নিহিত রয়েছে। এই রকম করে, ব্যক্তি ভবিষ্যতের সাথে যেইভাবে যুক্ত ঠিক সেইভাবে অতীতের সাথে সম্পর্কিত। অতীত ও ভবিষ্যতের সাথে এই দ্বৈত সম্পর্কই বর্তমানকে নির্মাণ করে। আমরা দেখতে পাই কিভাবে সময় অস্তিত্বকে এবং অস্তিত্ব সময়কে নির্ধারণ করে। এবং মানুষ কখনোই তার পাশের মানুষের থেকে সম্পূর্ণরূপে আলাদা হতে পারেনা। খোদ আমাদের জ্ঞানে অপর মানুষের হাজির থাকার আভাস পাওয়া যায়।


কিন্তু আমরা সবসময়ই এই সত্যিকারের অস্তিত্বকে ঠাওর করিনা। আমরা আমাদের অলসতা ও সামাজিক রীতিনীতির দ্বারা আরোপিত একটা ভাসা-ভাসা জীবন যাপন করি। মানুষ প্রাথমিকভাবে ভাসা-ভাসা পর্যায়ে থাকে। আরো গভীরে যেতে হলে কিছু অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিয়ের্কেগার্দ ইতোমধ্যে সম্ভাবনার প্রলোভনের প্রকাশ হিসেবে উদ্বিগ্নতার (anxiety) গুরুত্বের ওপর বিশেষভাবে জোর দিয়েছেন। এই বেদনার অভিজ্ঞতাকে আর বেশি অধিবিদ্যক ও সত্তসম্বন্ধীয় ঠাট দেয়। বেদনার এই অভিজ্ঞতায় যে নাস্তি অনুভূত হয় তা সম্ভাবনার নাস্তির অংশবিশেষ নয়। বরং না-থাকার (Not Being) পুরোদস্তুর নাস্তি। হাইডেগারের মতে, না-থাকা হচ্ছে অ্যাক্টিভ বা সক্রিয়। কিন্তু তিনি এই তৎপরতাকে সেই সকল টার্ম ছাড়া প্রকাশ করতে পারেনা যারা কিনা আবার নিজেরাই নঞর্থক। ঠিক এই কারণেই উনি বলছেন যে নাস্তি (nothingness) অথবা না-থাকা; “নাস্তি নিজে নিজেই” কারণ উনি আসলে এটা বলতে পারেন না যে এটা আছে (it is) (এই অনুচ্ছেদটি যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদী ও অন্যান্যদের মধ্যে বেশ কেলেঙ্কারির কারণ হয়েছিল)। তো, হাইডেগার এমন একটা কিছু বলছেন যা অনেকটা এরকম দাঁড়ায় যে, নিজে নিজেকে এবং অন্য সকল কিছুকে নাস্তিকরণ (nothinging)। এটা হচ্ছে সত্তর নঞর্থক পটভূমি।


হাইডেগারের মুরিদেরা, বিশেষ করে লেভিনাস ও সার্ত্রে, সত্তর এই পটভূমির প্রকাশ হিসেবে গা-গোলানোভাব বা বিবমিষার (nausea) ওপরে জোর দিয়েছেন। কিন্তু, অস্তিত্বশীলকে এই উদ্বিগ্নতা ও বিবমিষার নিষ্ক্রিয় শিকার হিসেবে থাকতেই হবে এমনটি নয়। সে একে বিজয়ও করতে পারে। সে নিজের নিয়তি নিজের ঘাঁড়েই নিয়ে নিতে পারে। এটাকে হাইডেগার বলছেন সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত। (কিয়ের্কেগার্দ এটাকে বলেছেন পুনরাবৃত্তি। লক্ষ করে দেখুন, হাইডেগারের চিন্তার পেছনে আমরা প্রায়শই কিয়ের্কেগার্দের চিন্তাকে পাচ্ছি)।

জঁ ভাহ্‌ল (১৮৮৮-১৯৭৪)


কিয়ের্কেগার্দ পরবর্তী তথাকথিত অস্তিত্বের দর্শনগুলিতে, অস্তিত্বের যে অর্থ রয়ে গেছে তা কিয়ের্কেগার্দ’ই দিয়ে যাচ্ছেন। হাইডেগারকে প্রায়ই অস্তিত্বের দার্শনিক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু হাইডেগার নিজেকে অস্তিত্বের দার্শনিক হিসেবে মানতে রাজি নন। তিনি বরং তার সাবেক বন্ধু ইয়েস্পার্সের জন্য এই উপাধিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করেন। উনি নিজেই বলছেন যে নার আগ্রহ মূলত সত্তয় এবং সত্তর ক্ষেত্রে অস্তিত্ব একটা বিশেষ আদল (structure) মাত্র। আর দুইটা আদল রয়েছে। এর মধ্যে একটা হচ্ছে সে বস্তুর সেই আদল যা আমরা চোখে দেখতে পাই। অন্যটি হচ্ছে বস্তুর সেই আদল যা আমাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অস্তিত্ব হচ্ছে দর্শক ও ব্যবহারকারীর আদল। কেবল মানুষই অস্তিত্বশীল। (আমি জানিনা জীব-জানোয়ারকে সে কোন জায়গায় রাখছে)। কার্যত অস্তিত্বের দার্শনিক হিসেবে নিজেকে না দেখার হাইডেগারের যে-বাসনা তার বিরোধিতা না করেও এই ব্যাপারটা সত্য হিসেবে রয়ে যায় যে তার মহান কাজের প্রথমাংশে তিনি বিশেষ করে অস্তিত্বের আদলের সংজ্ঞায়ন করেছেন। আমরা যেমনটা দেখেছি যে, তাঁর জন্য অস্তিত্ব যত্নপীরিত (care-ridden), নিজের সম্বন্ধে একাগ্র (intent on itself), সবসময়ই প্রকল্প নির্মাণ করছে এবং তা এই জগতেই করছে।


হাইডেগারে অন্ততপক্ষে দুইটা গুরুত্বপূর্ণ ধারনা আছেঃ অস্তিত্বের ধারণা যা তিনি কিয়ের্কেগার্দের কাছ থেকে নিচ্ছেন এবং জগত-স্থিত-সত্তর (being-in-the-world) ধারণা যা তিনি নিচ্ছেন হুসার্লের কাছ থেকে। বিখ্যাত দার্শনিক হুসার্ল ছিলেন হাইডেগারের শিক্ষক। নাৎসিবাদের প্রথমদিকে কেবলমাত্র ইহুদী হওয়ার কারণে হাইডেগার হুসার্লকে ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে দেননি। এই দুই ধারণার মিশেলে হাইডেগারের দর্শনের রংয়ের বিশিষ্টতা দাঁড়ায়। অস্তিত্ব যত্নে ঠাসা, কারণ তা জগতের মধ্যেই। এবং জগত-স্থিত-সত্ত পরিত্যাক্ত অবস্থায় রূপ নেয়। কারণ, হাইডেগার বিশেষ করে অস্তিত্বের বিচ্ছিন্নতার ওপরে জোর দেন। এই কারণেও যে তিনি জগতের দিকে এমন একটা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাকান যা আগে ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে পরিগণিত হত বলেই বলা যেতে পারে।


এই দুই ধারণার পরিণতি হচ্ছে এই যে আমাদের সকল কান্ডজ্ঞান-দর্শনের ধারণাকে ধ্বংস করতে হবে আমি বিশেষ করে সারসত্ত ও সাবস্টেন্সের কথা বোঝাচ্ছি। আমার সারসত্ত, অস্তিত্ব থেকে পৃথক নয়। প্লেটো ভুল ছিলেন (এবং হাইডেগার প্লেটোকে দারুণভাবে বুঝতেন)। দর্শন আর সারসত্ত-দর্শন রইবেনা। এটা হবে অস্তিত্ব-দর্শন।


আমরা একটা “পূর্বতন ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির” কথা বলেছি। এটা আমাদের হাইডেগারের দর্শনের একটা ব্যর্থতাঁর দিকে নিয়ে যেতে পারে। এটা জগতের এমন এক দৃষ্টিভঙ্গির আভাস দেয় যে জগত নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে। হাইডেগার যদি পুরোদস্তুর ধর্মতাত্ত্বিক পূর্বানুমান থেকে বের হয়ে যেতেন তবে হাইডেগার আর হাইডেগার হয়ে উঠতেন না। এবং যৌক্তিকভাবে বিবেচনা করলে তাঁর এটা থেকে মুক্ত হতেই হবে। তো, আমরা যদি হাইডেগারের দর্শনকে যৌক্তিক পথে ঠেলে নিয়ে যাই, তাঁর কাজের কিছু সারগত অনুভূতি যা তাঁর কাজের চরিত্র ঠিক করে দেয় তাদের ছেড়ে যেতে হবে। এই বিবেচনায়, নীটশে নিঃসন্দেহ আর জোরালো (bold) চিন্তক ছিলেন। কিয়ের্কেগার্দ ও নীটশের মাঝামাঝি পথে, নীটশের জগতে হাইডেগার আছেন কিয়ের্কেগার্দের অনুভব নিয়ে, আর কিয়ের্কেগার্দের জগতে তিনি আছেন নীটশের অনুভব নিয়ে।


আমরা অস্তিবাদের বর্তমান বৈশিষ্ট্যগুলি দেখেছি। মনে হয় যেন এটি পৃথকতা, পরিত্যক্ততা, ও গভীর দুঃখবোধের সাথে যুক্ত। এটা কি তার উল্টোটা হতে পারেনা? কার্যত, ইয়েস্পার্স এবং গ্যাব্রিয়েল মার্সেলের মত কিছু ফরাসী অস্তিবাদীরা গোষ্ঠীর (community) পরে বেশি জোর দিয়েছেন। অবসাদ, বিবমিষা অথবা উদ্বিগ্নতার মত অনুভূতিগুলি কি আসলেই এত বিশেষভাবে জগতকে উন্মোচিত করে? এবং কেন এদের এতখানি পাত্তা দেয়া হচ্ছে? আমরা এটা নিয়েও বিস্মিত হতে পারি যে হাইডেগার মৃত্যুকে এত গুরুত্ব কেন দিচ্ছেন। এটা নিয়েও বিস্মিত হতে পারি যে কেন আশাবাদ ও আমাদের সারগত নশ্বরতার চিন্তা আমলে নিতে হবেনা। উপরন্তু, মনে হচ্ছে কিছু প্রবণতাকে যথেষ্ট বিশ্লেষণ করা হয়নি। যেমনটা ঘটেছে সম্ভাবনার ক্ষেত্রে যা কিনা ইয়েস্পার্স, কিয়ের্কেগার্দ এবং হাইডেগারে সমান গুরুত্ব পেয়েছে। (কিন্তু সার্ত্রে এই বিষয় নিয়ে খুব ই সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন)।


ত্তার ভাবগতির ক্ষেত্রে, হাইডেগার অন্টিক ও অন্টলজিকালের মাঝে যে বিরুদ্ধতা দেখাচ্ছেন, নিজের দর্শনকে অন্যদের থেকে আলাদা করবার জন্য, এটা কি একটা কৃত্তিম তরিকা কিনা সেই প্রশ্নও আমরা করতে পারি। অন্ততপক্ষে যেটা তাঁর কিছু শিষ্যর কাজের মধ্যে দেখা যায়। এই কারণে যে হাইডেগারের শিষ্যরা খুবই ধূর্ততার সাথে কিছু চাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে। এবং অস্তিবাদের একধরনের স্কলাস্টিক দিক রয়েছে।


হাইডেগার যে নৈতিক সিদ্ধান্ত টানছেন তা হচ্ছে এই দর্শনের আরেকটা দুর্বল জায়গা। এই দৃঢ় সিদ্ধান্তকে মাঝেমধ্যে একটা রীতিবিরুদ্ধ দর্শনের গতানুগতিক সমাপ্তি মনে হয়। এই মতবাদের ভিন্ন ভিন্ন উপাদানের মধ্যে এক প্রকারের প্রভেদ করার প্রয়োজনীয়তা আছে। এবং যদি অধিবিদ্যক ধারণাগুলিকে যুক্তিযুক্ত মনে হয়, তবে সেক্ষেত্রে নৈতিক সিদ্ধান্তের যুক্তিযুক্ততা নিয়ে সন্দেহ এসে পড়বে। সন্দেহটা আর বেড়ে যায় যখন এই অস্তিবাদী দার্শনিকের তৎপরতা (এমনকি খোদ অস্তিত্বশীল থাকা) সবসময়েই আমাদের সেটা দেয়না যাকে আমরা বাস্তবিক দৃঢ় সিদ্ধান্ত বলতে পারি। অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও তিনি নাৎসিদের কবলে পড়েছেন এবং বেশ অনুচিতভাবেই একটা জনগোষ্ঠির কাছে নিজের বদল ঘটিয়েছেন। ইন্ডিভিজ্যুয়াল প্রসঙ্গে যেটাকে তিনি হেগেলের ভুল হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন তাকে আর কম যুক্তির সহিত নবায়ন করেছেন। তাঁর অধিবিদ্যক সিদ্ধান্তকে দায়ী করার জন্য এটা যথেষ্ট নয়। তবে নৈতিক পথপ্রদর্শক হিসেবে তাঁর গুরুত্ব ও বিবেচনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যেতে পারে।


অস্তিবাদের আগের কিছু মহান অস্তিমান মানুষের কথা আমরা আগেই বলেছি। এখানে একটা ঝামেলার প্রশ্ন আছে। এমন কি কোন বিপদ নেই যে অস্তিবাদ যেই অস্তিত্বের চিন্তাকে সংরক্ষণ করতে চায়, অস্তিবাদের জ্ঞান খোদ তাকেই খুন করেনা? এইখানে আমরা অস্তিবাদী’র দোটানা দেখতে পাই।


পন্ডিত ভ্যালেরি বলছেন, মাঝে মধ্যে আমি চিন্তা করি, মাঝে মধ্যে আমি থাকি। এবং উনি চিন্তা করাকেই বেছে নেন। অন্যান্যরা থাকতেই পছন্দ করেন। কিন্তু মাঝে মধ্যে খুব সুক্ষ্মভাবে ভ্যালেরি থাকেন (Valéry is)। এবং হাইডেগারও অত্যন্ত সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্মভাবে চিন্তা করেন।


এরপর আসে তৃতীয় অঙ্ক। কিছু তরুণ ফরাসি দার্শনিকেরা (এবং এদের মধ্যে সর্বোত্তমেরা) এই ধারণাগুলির মধ্যে নতুন ও অপ্রথাগত কিছু খুঁজে পান। এমন কিছু খুঁজে পান যা তাঁদের নিজেদের উদ্বিগ্নতার উত্তর দেয়। ফ্রান্সে ইতোপূর্বেই এমন কিছু হাজির ছিল যাকে অস্তিবাদের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কিন্তু মহাযুদ্ধের শেষ বছরগুলিতে হাইডেগারের প্রভাব সবচাইতে তীব্রভাবে অনুভূত হয়। আমাদের এটা স্বীকার করা জরূরী যে হাইডেগারের দর্শনে একরকম মাতলামি আছে। যে মাতলামি দিতে পারে সবচাইতে পুরনো জার্মান-দর্শন-ওয়াইন (German philosophical wines of the best vintage give)। হাইডেগারের যে ফরাসি অনুবাদ হয়েছে তার যে অনাস্থা সেটার বিরোধিতা না করেও এটা বলা যায় যে, ফ্রান্সে হাইডেগারের মতবাদে একটা সত্যি সত্যি আগ্রহ ছিল, যা দার্শনিক ও সাহিত্যিক ঘরানায় অবিরত জারী ছিল। সার্ত্রে ও আলবেয়ার ক্যামু যারা তাঁদের এবসার্ডে বিশ্বাসকে কাজের সাথে যুক্ত করেছেন তাঁদের নিয়ে এখন কথা বলাটা হয়তো বেশি আগেভাগে হয়ে যাবে। অথবা, বাতাই যে নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা তাড়িত এবং যে নীটশেকে নিজের গুরু দাবী করছেন; যিনি এমন কিছু দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন যেটাকে তিনি বলছেন চূঁড়ার নৈতিকতা (ethics of summits), তাকে নিয়ে কথা বলাটাও একইভাবে চটজলদি হয়ে যাবে।


চলেন আমরা কোনটা অস্তিবাদ আর কোনটা অস্তিবাদ না তা ঠিক করার জন্য কিছু নিয়ম বেঁধে দেই। আপনি যদি বলেন— মানুষ তার নিজের জগতে আছে, এমন এক জগত যা মৃত্যু এবং উদ্বিগ্নতার অভিজ্ঞতা দ্বারা সীমিত। যে মানুষ নিজেকে বোঝে সারগতভাবে সতর্ক একজন হিসেবে, যে কিনা কালের দিগন্তে নশ্বরতার কাছে ন্যুব্জ। সেই কাল যার তিন সমাধি আছে (অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ)। তাহলে আপনি আসলে হাইডেগারয় অস্তিবাদের কথা বলছেন।


আপনি যদি বলেন— মানুষ আসলে তার নিজের জন্যই (man is for himself), এবং যেই অসংখ্য বস্তুর স্বরূপের সম্মুখে সে হাজির থাকে, এই অমিল সেই অসংখ্য বস্তুর স্বরূপের সামনে তাঁর মধ্যে একধরনের তীব্র বিরক্তির জন্ম দেয়। আপনি যদি বলেন, নিজে নিজের জন্য যে বস্তু, যা সে নিজে, আবার যা সে নিজে না, তার সম্মুখে সে একধরনের ভীতি বোধ করে। তবে আপনি হেগেলবাদ মিশ্রিত হাইডেগারবাদের সার্ত্রীয় ব্র্যান্ডের কথা বলছেন।


আপনি যদি বলেন— আমি একটা চিন্তাশীল বস্তু, যেরকমটা দেকার্ত বলেছেন; অথবা, বাস্তব সত্ত আসলে ধারণাই, যেরকমটা বলছেন প্লেটো; অথবা, আমি প্রতিভাসগুলিকে সঙ্গ দেয়, যেরকমটা বলেছেন কান্ট। তবে আপনি আসলে অস্তিবাদীই না।


এখন আমাদের এই ফ্যাক্টের দিকে মনযোগ দিতে হবে যে হাইডেগারের দর্শন গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা পাঠের প্রয়োজন আছে। কিন্তু আমাদের এইদিকেও মনযোগ দিতে হবে যে যেই ভিন্ন ভিন্ন বিষম উপাদানগুলি এই দর্শনকে গড়ে তোলে সেগুলিকে খুবই সতর্কতার সাথে নিরীক্ষণ করতে হবে।


মনের উচুমাপের প্রশ্নগুলি নিয়ে উৎফুল্ল হওয়া সবসময়েই একটা ভালো বিষয়। অস্তিবাদ আমাদের আর একবার সেটাই শখায় যা সকল মহান দর্শন শিখিয়েছে। এই শিক্ষাটা হচ্ছে এই যে, বাস্তবতার এমনতর চেহারা আছে যাকে পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে নামিয়ে আনা যায়না। স্বাভাবিকভাবেই, যারা উল্টোমত পোষণ করেন তারা অস্তিবাদকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করতে চাইবেন। এটা করতে চাইবেন অর্থনৈতিক অথবা ঐতিহাসিক যুক্তির মাধ্যমে। কিন্তু অস্তিবাদের মূলকথা নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা তাঁদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের যথার্থতা নয়, বরং এর সারকথা হচ্ছে তাদের সবকিছুকে বিশ্লেষণ করার সবৈব সক্ষমতাকে খারিজ করে।


আমরা হাইডেগারে এসে একটা সমগ্র তৎপরতা সম্পর্কে সজাগ হই যা শুরু হয়েছিল একদিকে কিয়ের্কেগার্দের অস্তিত্বের ওপরে জোর দেয়ার মধ্যে দিয়ে। অন্যদিকে জগত-স্থিত-সত্তর ওপরে হুসার্লেই পরোক্ষ জোরারোপের মধ্য দিয়ে। যেক্ষেত্রে মাঝে মধ্যে বার্গসোঁ এবং হোয়াইটহেডের উপস্থিতিও টের পাওয়া যায়। হোয়াইহেড তাঁর নিজস্বতা বজায় রেখে জগত-স্থিত-সত্তর ওপরে জোর দেন। আমরা এক নতুন দর্শনের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছি।

____________


হদিসঃ https://newrepublic.com/article/76994/existentialism-preface

স্কলাস্টিকবাদ— নিজস্ব বিশ্বাসে সমর্থনের তাগিদে দার্শনিকদের দ্বারস্থ হওয়া। যেমনটা ইউরোপের মধ্যযুগে সন্ত একুইনাস, সন্ত আনসেল্‌ম, ডানস্‌ স্কোটাস, উইলিয়াম অব অকাম প্রভৃতির কাজে প্লেটো-এরিস্টটলের ব্যবহারের মধ্যে পাই।


পুনশ্চঃ হাইডেগারের দর্শনের কিছু জার্গন বাংলায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। আমরা খোঁজ করছি। পেলে, পরিমার্জন করা হবে।


প্রথম প্রকাশঃ ২৮শে নভেম্বর, ২০১৯

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/1301835686824087/