অন্যতা ’র সাধনা রূপে রাজনৈতিক রুহানিয়াত

ল্যু ন্যুভেল অবজা’ভ্যাতা ’র সঙ্গে মিশেল ফুকোর সাক্ষাৎকার


[মিশেল ফুকোর ইরান বিপ্লব (১৯৭৯) বিষয়ক লেখালেখিতে ব্যবহৃত রাজনৈতিক রুহানিয়াত (Spiritualité Politique , ইংরেজিতে Political Spirituality) প্রত্যয়টির ভাব তিনি স্পষ্ট করেছেন ইতালীয় সংবাদপত্র ল্যু ন্যুভেল অবজা'ভ্যাতা(L'Obs)'কে দেয়া “Political Spirituality as the Will for Alterity” শিরোনামের এই সাক্ষাৎকারটিতে। ফুকোর নোটস্‌ ও অপ্রকাশিত লেখাজোখার প্রায় শ'খানেক বাক্স তাঁর পার্টনার ড্যানিয়েল ডেফার্ট ২০১৩ সনের দিকে বিক্রি করে দিলে এই সাক্ষাৎকারটি সেখানে মিলে। এই সাক্ষাৎকারটিতে তারিখ উল্লেখ রয়েছে, ৩রা জানুয়ারি ১৯৭৯। অর্থাৎ শাহের পতনের ঠিক ১৩ দিন পূর্বে এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়। ল্যু ন্যুভেল অবজা'ভ্যাতারের জন্য নেয়া হলেও এটি এতদিন যাবত অপ্রকাশিতই ছিল এবং ফুকো বেঁচে থাকা অবস্থায় কেন সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়নি সে ব্যাপারটি অজানাই রয়ে গেছে। ২০১৮ সনে এর নির্বাচিত অংশ ফরাসি ভাষায় ছাপা হয়। অতিসম্প্রতি এই সাক্ষাৎকারটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। ইংরেজি অনুবাদকের ছয় পাতার ভূমিকা সমেত সাক্ষাৎকারটি ছেপেছে ক্রিটিক্যাল ইনক্যোয়ারি জার্নাল, ৪৭ তম খণ্ডের ১ম সংখ্যায় (অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০২০)। ইংরেজিতে এটির অনুবাদ করেছেন স্যাবিনা ভ্যাকারিনো ব্রেম্‌নার (Sabina Vaccarino Bremner)। তিনি খঁনিংয়েন্‌ বিশ্ববিদ্যালয়ের(University of Groningen) দর্শনের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এবং বর্তমানে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। ফুকোর এই সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মাহফুজ আবদুল্লাহ। মাহফুজ আবদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী এবং সিনেযোগ ম্যাগাজিনের সম্পাদক।]




মিশেল ফুকো, ন্যুভেল অবজা’ভ্যাতুতে যখন ইরান নিয়া রিপোর্ট দিতেছিলেন, তখন আপনি লিখছিলেন এই দেশ এখন এমন কিছু খুঁজতেছে, যেইটা আমরা পশ্চিমারা রেনেসাঁ এবং ক্রিশ্চিয়ানিটির ক্রাইসিস কাটানোর পরে হারায়ে ফেলছি। আপনি যেইটারে বলছিলেন, ‘রাজনৈতিক রুহানিয়াত’। এখন যেটা ঘটতেছে, মানুষ এ টার্ম শুইনা ভ্যাবাচ্যাকা খাইতেছে। মনে হয়, বিষয়টা আরেকটু ক্লিয়ার কইরা বলা দরকার আপনার।


ঐ লোকদের জবাব দিতে আমি পয়লা যেটা করতে চাই সেইটা হইল দায় ঘুরানো। আগে একটা গল্প বলি-

ইরানে থাকার সময়ে একটা ম্যাগাজিন একজন রিপোর্টার পাঠাইছিল, তো সে ইরান নিয়া লেখা হইলে যেমনে সবাই শেষ করে আরকি সেরকমই ধর্মীয় আন্দোলনগুলার দিকে ইঙ্গিত কইরা লিখছে— এগুলা তো পুরা ইরানের জনমানুষের মন মগজ খাইয়া দিছে। প্যারিসে পাঠানোর আগেই লেখাটা পড়ছিলাম আমি। এরপর দেখলাম, প্যারিসে ছাপানোর সময় সম্পাদকমণ্ডলী ‘ধর্মান্ধ’ শব্দটা ঢুকায়া দিছে।

এখন, যারা আমার মত ইরানে কি চলতেছে বুঝার চেষ্টা করতেছে তাদের কাজ কি নিজেদের সাচ্চা প্রমাণের জন্য এই ধর্মীয় অথবা রুহানি আন্দোলনগুলার অস্তিত্ব ঘোষণা কইরা বেড়ানো?

বরং, যারা এরকম গরল বুকে-মুখে নিয়া বেড়াচ্ছে, এইটা তাদের কাজ না যে ঠিক কি জন্য তারা গোঁ ধইরা আছেন তা খোলাসা কইরা বলা?


ঠিক। আমরা মুদ্রার দু’পিঠই দেখব। তবে আপনার কথা ধরলে, আপনি যখন ‘রাজনৈতিক রুহানিয়াত” টার্মটা ইস্তেমাল করেন,যার ভেতরে আমাদের ঐতিহ্য আর চিন্তার অনেক চিহ্ন ও দাগ লুপ্ত আছে— বিশেষত রুহানিয়াত শব্দটাই যদি ধরেন, তো এইটা কি একটু বিশদ কইতে পারবেন? এটা কি আদতে নিছক বর্ণনার জন্যই ব্যবহার করছিলেন?


আমি খোঁজার চেষ্টা করছি, এমন কোন শক্তি ইতিহাসে ছিল কিংবা আছে কিনা, যা এরকম ভয়ঙ্কর রেজিমরে মোকাবেলা করতে পারবে। এই রেজিম তো ধরেন অনেক শক্তিশালী, আর্মি আছে আবার বিপুল পুলিশ বাহিনী— অন্যদিকে সমগ্র জনগণ, জনগণের হাত খালি। তাদের হাতে তো আর অস্ত্র নাই। আমি ঠিক জানিনা কোথাও কি অস্ত্র লুকায়া রাখছে কিনা, তবে লুকাইলে ওরা ভালমতনই লুকাইবে, তবে অস্ত্র যে বেশি হবে না সেইটা শিউর, নইলে তো তারা গুলি-টুলি মারতো, যদিও প্রতিদিনই ডজন ডজন লোক মরতেছে।

তাইলে যারা নিজেদের একেবারে কোরবান করে দিতে চাইতেছে তাদের সেই শক্তি আসলে কি, যেখানে একটা তীব্র অবাধ্য ইচ্ছাশক্তি আছে— যেইটা দিনকে দিন নতুন প্রাণ পায়, কুরবানির কবুলিয়ত আছে?

এইটা তো স্পষ্ট, মার্ক্সবাদের মত একটা রাজনৈতিক আদর্শের মাঝে এর জবাব খুঁজমু না, কিবা পশ্চিমা অর্থে এক বিশেষ কিসিমের বিপ্লবী আদর্শেও না, বরং অন্য কোথাও।


ইরান সঙ্কট ব্যখ্যা করতে ইউরোপে মোটাদাগে যে চিন্তাকল্প খাড়া করা হইছে, তা হইল ইরানে তড়িঘড়ি আধুনিকায়ন ঘটছে। তাইলে এই বাস্তবতার মাথা কেটে আমাদের কেন একটা তুরীয় ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে?


প্রথমত, এইটা কাটা ছেঁড়া না। আর, দ্বিতীয়ত এইগুলা তুরীয়ও না। বাস্তবতা আছে। তারা সোজাসাপ্টা বলতে পারতঃ “আমরা এই আধুনিকায়ন চাই না, এই রেজিম আমাদের উপরে উন্নয়ন, রাজনৈতিক কাঠামোর জঞ্জাল চাপিয়ে দিতে চাইতেছে, আমরা যেইটা মাইনা নিতে পারমু না, আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া আধুনিকায়নের জন্য এত মূল্য শোধ করতে পারমু না”। দেখেন, তারা কিন্তু এইগুলা বলতেছে না।

পয়লা কথা আধুনিকায়ন নিয়ে। আমার মনে হয়, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তুর্কিতে যা ঘটল, তাও প্রমাণ করে যে, ইরানে এখন যেইটা ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে তা আধুনিকায়ন না, বরঞ্চ পুরানাকরণ (antiquation, সেকেলে)। এ পুরানাকরণ আসলে কামালবাদ, বলতে গেলে মুসলিম, ইসলামি এবং অন্য সমাজগুলোর এক বিশেষ আদলের পুনঃসংগঠন, যে আদল আবার কমবেশ পশ্চিম থেকে ধার করা এবং কামাল আতাতুর্কের হাত ধরে ১৯২০ এর দশকে যার বিকাশ। পাহলভী বংশও এ আদল মেনে চলছে, ১৯৩৮ বা ১৯৪০ পর্যন্ত প্রকাশ্যে, এরপর থেকে নিরলে।

আর, এটা একটা বাস্তবতা যে জনগণের একটা বড় অংশে, মানে বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে আবাদানের কারখানা শ্রমিক, তেহরানের বাজারি থেকে আরম্ভ করে রাজধানী থেকে দূরবর্তী ইরানের পূর্বাঞ্চলের কৃষক— সবাই খোমেনি এবং মোটাদাগে সকল ধর্মীয় নেতার সাথে আত্মীয়তা বোধ করে। আসলে তাঁদের আত্মার সম্পর্ক ইসলামের লগে, যেটা জীবনের ভিন্ন এক সুরত, যেটাকে আধুনিকের তুলনায় প্রাচীন পন্থা বলা যায় না, বরং ধর্মে জড়ানো এক বিশেষ জীবনের সুরত বলা যায়।

আমার মনে হয় এ সত্যরে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, আর ইরান থেকে ফিরে আসা অনেক লোকের কেউই মনে হয় এটার বিপরীত কিছু বলবে না।

তাইলে এখন জানা লাগবে যে, তারা কি নিজেদের ধোঁকা দিচ্ছে। তারা কি আসলে ধর্মীয় মূল্যবোধ ধারণ করছে নাকি নিজেদের জবানে বেঁচে যাওয়া ধর্মীয় পরিভাষা দিয়েই বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটা বিশেষ অসহায়তা প্রকাশ করছে কেবল।


চলমান ঘটনাগুলো নিয়ে আপনার দেখাকে কি ইরান সম্বন্ধে সার্বিক চিন্তাকল্প রূপে ধরা যায়? আপনি কি মনে করেন, বিশেষ এক পরিস্থিতিতে ধর্মভাবের উদ্ভব- রাষ্ট্র এবং যারা আজকাল এটার ধারক-বাহক তাঁদের বিপরীতে ভিন্নমতের একটি প্রতিরোধের পরিসর তৈরি করবে?


ভাল প্রশ্ন। কারণ এর বরাতে একটা ফারাক স্পষ্ট করা সহজ হইল, যা আমার কাছে মোটামুটি স্পষ্টই ছিল, কিন্তু যা হয় সচরাচর— আমি পাঠকের জন্য ঠিকঠাক পরিস্কার করে বলিনি।

আমি যখন রুহানিয়াত নিয়া কথা বলি, আমি তখন ধর্ম নিয়া বলছিনা, মানে ধর্ম আর রুহানিয়াতের মাঝে ফারাক টানতে হবে। আমি বিষম খাইলাম, যখন দেখলাম রুহানিয়াত, রুহানিবাদ (spiritualism) আর ধর্ম— এ তিনটা জিনিস জগাখিচুড়ি টাইপ হয়ে গেছে, সবাই তালেগোল পাকায়া ফেলতেছেন।

রুহানিয়াত ধর্মে খুঁজে পাওয়া যাবে, সত্য। তবে, ধর্মের বাইরেও পাওয়া যাবে, ধরেন বৌদ্ধ ধর্মে— যেটার কোন ধর্মতত্ত্ব নাই, একেশ্বরবাদী অন্য ধর্মগুলোতেও আছে, আবার গ্রিক সভ্যতাতেও কিন্তু রুহানিয়াত আছে। মানে, রুহানি মানে ধর্মীয় এমন না ব্যাপারটা। যদিচ, অধিকাংশ ধর্মেরই এক ধরনের রুহানি মাত্রা আছে।

রুহানিয়াত কি?

আমার মনে হয়, এইটা হল এক বিশেষ চর্চা যার ভেতর দিয়ে ব্যক্তি স্থানচ্যুত হয়, নিজের রূপান্তর ঘটায়, ভেঙ্গে চুরে আগায় এতদূর যে নিজের ব্যক্তিসত্তা আর কর্তা অবস্থান খারিজ করে বসে। ঐ বিশেষ মাত্রা তক যে কর্তাসত্তা ছিল সে, আর সেখানে থাকে না— একটা রাজনৈতিক শক্তির সাপেক্ষে যে কর্তা সত্তা, এক বিশেষ জ্ঞানের তরিকা, একটা অভিজ্ঞতা আর একটা বিশ্বাসের সাপেক্ষে যে কর্তাসত্তা সে ছিল আগে সেখান থেকে তার চ্যুতি ঘটে।

আমার কাছে মনে হয়, একটা রাজনৈতিক বা ধর্মীয় শক্তি, একটা সংস্কার, বিশ্বাস, অভ্যাস ,সমাজ কাঠামো আরো বিবিধ জিনিস মিলিয়ে আপনার যে কর্তা অবস্থান নির্ধারণ করে দেয়, তা থেকে ভাসান দিয়ে উঠাটাই রুহানিয়াত। মানে ব্যক্তি যা, তা থেকে ভিন্ন হয়ে ওঠা, নিজের থেকে আলাদা হয়ে ওঠা।

সত্য যে, রুহানিয়াতের এত সব কিসিম আর চর্চার একধরনের আশ্রয় হল ধর্ম, আবার একই সাথে এক্ষেত্রে যত বাধা নিষেধ সেগুলোরও উৎস ধর্ম। ধর্ম ঠিক করে দেয় নিজের চেয়ে ভিন্ন ব্যক্তি কিভাবে হয়ে উঠতে হয়, কোন লক্ষ্যে ব্যক্তিকে এগুতে হবে, সে নতুন কোন হালতে পৌছাবে ইত্যাদি। বস্তুত, ধর্ম রুহানিয়াতের এক বিশেষ বিধিবদ্ধ রূপ নির্ধারণ করে।

মানে আপনি জোর দিচ্ছেন, ইরানি শিয়া মতবাদ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এরকম প্রতিরোধ অনুমোদন করলেও এর নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।


দুনিয়াতে যত বড় বড় রাজনৈতিক, সামজিক আর সাংস্কৃতিক রদ-বদল ঘটেছে, কোনটাই রুহানিয়াতের ভেতর দিয়ে বিকশিত হওয়া ছাড়া ঘটতে পারত না।

মধ্যযুগের শেষদিকে কি ঘটল দেখেন। মধ্যযুগ আর ১৬শ শতকের মধ্যখানে ইউরোপ উত্তাল হয়ে উঠল এমন কিছু আন্দোলনে, যেগুলো ১৮শ শতকের শেষভাগ আর ১৯শ শতকের মধ্যখানের বৈপ্লবিক কালপর্বে যা ঘটেছিল সেগুলোর চেয়ে অধিক না হলেও অন্তত সমান গুরুত্বের হকদার।

বিশ্বাস, জীবনধারা, সামাজিক সম্পর্ক, রাজনৈতিক আনুগত্যের সুরত, সমাজের ভেতরকার তবকা (hierarchies) , অর্থনৈতিক কারবার— সব কিছু আসলেই বদলে গেছিল। এখন এটা তো সত্য, ঐতিহাসিকেরা দেখিয়ে গেছেন ১৫শ আর ১৬শ শতকের আন্দোলন ধর্মের ভেতর দিয়ে ঘটে নাই, বরং একধরনের রুহানিয়াতের ভেতর দিয়া ঘটছে, যা খোদ ধর্মের তবকাগিরিই (hierarchical structures) ভেঙ্গে দিসিল। এটা আছিলো ধর্মের বিরুদ্ধে ধর্ম!

পনের শতকী ফ্লেন্ডার্সদের সন্ন্যাস আন্দোলন, জার্মানিতে বিকশিত হওয়া সব কিসিমের ধর্ম সম্প্রদায়— লুথারের সমসময়ে কিবা সেটার অব্যবহিত পরে, (যেমন, এনাব্যাপ্টিস্ট আন্দোলন), ১৭ শতকের ইংলন্ডে ধর্মীয় গোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধি যা ইংরেজ রাজযন্ত্রকে বিকল করে ইউরোপের ইতিহাসের প্রথম বিপ্লব সম্পন্ন করতে পেরেছিল। এসবই পোক্ত প্রমাণ যে, সকল রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক উত্থান-পতনের শেকড়ে রুহানিয়াত আছে আর ধর্ম এরকম আন্দোলনে চূড়ান্ত ভূমিকা রাখে, যে ভূমিকা যত না ধর্মীয় তার চাইতে বেশি রুহানি।

একথাই বলতে চাইছিলাম।


আপনি অবশ্যই জালিম শক্তির বিরুদ্ধে জনগণকে যে শক্তি খাড়া করিয়ে দেয় তা নিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটা বিস্তর সময় ব্যবহৃত তাত্ত্বিক কাঠামোর ঐতিহ্যগত নিদান সম্বন্ধে জানেন।

ধর্মকে মোদ্দাকথায় এখানে একধরনের বুদ্বুদ কি উপরিকাঠামো রূপে স্থান দেয়া হয়; এটাকে ব্যাখ্যার জায়গা থেকে কখনো একটা মৌলিক আর অপর্যবসেয় (irreducible, হ্রাস করা যায় না এমন) ঘটনা আকারে দেখা হয় না।


কলেজে আমাকে ক্রুসেড নিয়ে পড়তে হয়েছে এবং এ বিষয়ে একটা প্রবন্ধও লিখতে হয়েছিল। যদি আমি বয়ান করতাম যে, ক্রুসেডাররা নেভার্স (Nevers) ছাড়ছিল, কারণ তারা খ্রিস্টের মাজার হেফাজত করতে জেরুজালেম রওনা হয়েছিল, তাইলে বাজে গ্রেড পাইতাম। কিন্তু যদি বলতাম, ঐ ক্রুসেডার ছিল তার পরিবারের ছোট ছেলে, এমন জনমিতিক বিস্ফোরণ ঘটছিল যে তার দশা খারাপ, কিছু করে খাওয়ার অবস্থা নাই, অন্য কথায়, আমি যদি বয়ান করতাম— সেখানে সে বাজার আর সুযোগ বাড়ানোর জন্য গিয়েছিল; কারণ পশ্চিমে তখন রমরমা উৎপাদন, তখন আমার বয়ান ঠিকই সই হত।


আপনার প্রফেসরেরই আসলে বাজে গ্রেড পাওয়ার কথা!


আমি মনে করি, ইতিহাসবিদেরা একটা বদ অভ্যাস রপ্ত করছে। খুব নির্দিষ্ট এবং নির্ধারক উপাদানগুলোর ক্ষেত্রেই কার্যকারণ শক্তি আরোপ, মানে এমন কোন বিশ্লেষণই কবুল করা হয় না; যেটাতে কোন ধ্রুপদী রাজনৈতিক অর্থনীতি কিংবা মার্ক্সবাদ থেকে ধার করা নীলনকশা মাফিক সম্পর্কগুলোর তবকাগিরি করা হয়নাই। তবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। আপনি যে ফ্যাক্টরগুলোর কথা বলতেসেন, সেগুলো নাই— এটা বলছি না। বরং, মামলাটা হল— একটা লোক একাকিত্ব, দারিদ্র্য, সমাজচ্যুতি, কিবা সামাজিক সত্তা থেকে বিচ্ছিন্নতার মোকাবেলা কেমনে করবে। মামলাটা এটাই, কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে। উদ্ভুত প্রতিক্রিয়ার বিশেষ প্রকৃতির জন্য আবার উদ্দীপকের প্রকৃতি দায়ী থাকবে না।

এ উদ্দীপক— ধরেন দারিদ্র্য, পরিবারের ছোট ছেলে হওয়া, সামন্ত কাঠামো, আর বাকি যা যা আছে— এগুলো বেশ কিছু ব্যক্তিকে মধ্যযুগের সমাজে অনাহুত অব্যবহার্য বা খুব ঘুরুঞ্চি করে তুলেছিল, কিন্তু এগুলা ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারবে না কেন তারা ক্রুসেড চালাইছিল, কিভাবে মাথায় ঢুকল কেবল তাদের জন্যই না সমূহ খ্রিস্টানের জন্য খ্রিস্টের মাজার মুসলিমদের হাত থেকে মুক্ত করাটা বহুত ফযিলতের।


কারণের প্রকৃতি কখনই প্রতিক্রিয়ার প্রকৃতি নির্ধারণ করে দেয় না।


আমি যেটা বলব, ইরানি জনগণ তাদের উপর ছাপিয়ে দেয়া অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ভুগতেছিল, পুলিশি শাসনের অধীনে তারা ভুগতেছিল। একদিকে দেশের ক্ষমতাধর আর অন্যদিকে আমেরিকা তাদের চোখের সামনে প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করতেছিল— তারা ভুগতেছিল; এ ঘটনাগুলা সত্য। এটা নিশ্চিত যে, ঈমানই এখন এমন একটা জিনিস যা এ রুহানিয়াতের ইচ্ছাকে মানে নিজ থেকে ভিন্ন হওয়ার ইচ্ছাকে একটা বাস্তব নির্দিষ্ট রূপ দিতে পারে, যেটাকে শেষমেশ রাজনৈতিক আন্দোলনে গুছিয়ে জুড়ে নেয়া যাবে।


ইরানে যা দেখলেন, তা অন্য সমসাময়িক ঘটনাদির ক্ষেত্রে খাটবে?


হ্যাঁ। আর, রুহানিয়াত ছাড়া বিপ্লবের ঘটনা ঘটলে তা ব্যতিক্রম।


ব্যতিক্রমের উদাহরণ?


ধরেন, ফরাসি বিপ্লব। আমি বলব- এটা এমন একটা বিপ্লব, এমন এক অভ্যুত্থান যেখানে জনগণ নিজেরা যা তার চাইতে ভিন্নতর হতে চাইছে; যেখানে তারা সর্বার্থেই কর্তা হওয়া বাদ দিয়েছে, তবে এইখানে যত যা ন্যায্যতা দেয়া হয়েছে, যেভাবে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, কোনক্ষেত্রেই ঐতিহ্যগত রুহানি বরাত টানতে হয় নাই।


সেই অর্থে এটা একটা ছেদ আকারে জারি ছিল।


এটা ছিল সমাজের পুনঃসংগঠন; যেখানে আইনপ্রণেতা চাইলে আসলেই একটা নিখুঁত স্বচ্ছ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এই বিপ্লবেই কেবল ভাবা হয়েছিল, সংসদীয় প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা সমস্যা সমাধান করতে পারে মানে বুদ্ধিদীপ্ত আর যুগোপযোগী দর্শন সত্যি সত্যি জনগণকে পূর্বেকার অধীন অবস্থান থেকে ছাড়িয়ে সর্বজনীন যুক্তি ও অন্যবিধের কর্তা বানিয়ে দিতে পারে।


ইংরেজ বা মার্কিন বিপ্লবের বিপরীত, এমন?


১৬শ শতকের সঙ্কটগুলো ছিল রুহানি।

১৯শ শতকের রাশিয়ার কথা ভেবে দেখুন। ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পথ করে দিছে যা কিছু, সবই মূলত রুহানি আন্দোলন ছিল; ঐ ঘটনা ঘটছে যে তুমুল উদ্দীপনার জোরে, যেটার পরে বলশেভিকেরা হাল ধরল, এটা এক অর্থে রুহানি ছিল; মানে একটা শৌক বা তাড়না ছিল; অবস্থা বদলে যাবে এজন্য না, বরং এইটা জেনে নেয়ার জন্য যে, নিজেরা না বদলালে কিছুই বদলাবে না। এ দুটা আগাগোড়া সংযুক্ত, আর ‘অপর হয়ে উঠা’ই হল বিপ্লবী ইচ্ছার মর্মকথা।


আমি এখন শুনতে চাইব…


অনুমতি দিলে আরো কিছু যোগ করতাম। জঁ-পল র‍্যাবাউত সেইন্ট-এতিয়েন বলেছিলেন, “মানুষকে বদলাতে হবে, দুনিয়াকে বদলাতে হবে, চিন্তাকে বদলাতে হবে, কথাকে বদলাতে হবে, সবকিছু বদলাতে হবে… সবকিছু ভেঙ্গে আবার গড়তে হবে।“

ঐ বাক্যের প্রথম অংশই বাস্তবিকই রুহানিয়াত; সবকিছু বদলে দেয়া, সর্বোপরি নিজেকে বদলে দেয়া, অন্য হয়ে উঠা, তবে সে অন্য দেখতে কেমন হবে তা আগেভাগে না জেনে, মানে ব্যক্তির নিজেকে পরিবর্তনের একটা র‍্যাডিকাল ইচ্ছা। আর, সেইন্ট-এতিয়েন যখন বলছেন— সব ভেঙ্গে আবার গড়তে হবে। তিনি এমন এক দার্শনিক চেতনের কথা বলছিলেন যা সকল প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, যা সেগুলোকে একটা যুক্তিবাদী ব্যবস্থার ভিত্তিতে আবার পুনর্গঠিত করবে।

ঐ বাক্যের প্রথম অংশ রুহানিয়াত, আর দ্বিতীয় অংশ দার্শনিক বিপ্লব নিয়ে। এক্ষেত্রে পরেরটাকে প্রথমটার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে।

ফরাসি বিপ্লবই প্রথম এবং একমাত্র বিপ্লব ছিল, যা এর নিজস্ব রুহানিয়াত চিনে নিতে পেরেছিল।


ইরানি পরিস্থিতি বিচারে, এ অন্যতা (Alterity) সাধনা আর একটা কর্তা না হয়ে উঠা মূলত ধর্মীয় চর্চাদি আর নস্টালজিয়া-সমগ্রের প্রতি পুনরাঙ্গীকারের ভেতর দিয়ে এগুছে, যেগুলো সেখানের লোকদের কাছে সহজলভ্য আর আগে থেকেই তাদের হৃদয়ে গাঁথা।

আপনি এ পুরান চর্চায় ফেরাকে কিভাবে দেখবেন? ধরেন, আয়াতুল্লাহ খোমেনি সিনেমা হল ধ্বংসের উসকানি দিচ্ছেন, পশ্চিমাকরণ নাকচ করা হচ্ছে, মানে একটা ঐতিহ্যগত ধর্মতন্ত্রের দিকে ফিরতি চলা— এ ঘটনাগুলোকে সম্ভাব্য অন্যতা আকারে কিভাবে ভাবা যায়? আমি ভালমতন বলতে পারছি না। এ যে আবার সভ্যতার সবচেয়ে পুরাতন খাদে পা হড়কে পড়া, এটাকেও কি সম্ভাবনা আকারে দেখতে হবে? তবে, আপনি এটার জবাব দিয়েছেন।


এ রুহানি আন্দোলন যা হাতে আছে তাই এস্তেমাল করে; মামলাটা এটা না যে উপায়টা ধর্মীয় কিনা তা জানা, বরং অন্যতা সাধনার সাথে এ উপায়ের সম্বন্ধ জানার মামলা।


উল্লেখিত প্রতিবেদকের প্রবন্ধ আর আপনার প্রতিবেদন নিয়ে প্রতিক্রিয়া ঐ শব্দের সাথে বিরোধের জানান দিচ্ছে; এইটা কিভাবে ব্যখ্যা করবেন? আপনার ক্ষেত্রে যে বিরাগ— মিশেল ফুকো রুহানিয়াত নিয়ে বলছেন, আর সবাই খড়গহস্ত হল, আপনাকে ঘিরে ধরল। কিভাবে এটা ব্যখ্যা করবেন?


আমি খুব কড়া করে বিশ্বাস করতে চাইতাম, এটা অজ্ঞতা; কিন্তু সেটা নিছক অজ্ঞতা ছিল না। কেন ছিল না, সে ব্যাখ্যা দিতে আমাকে ব্যক্তিগত কিছু কথা বলতে হবে।

দিনশেষে, তারা তাজ্জব হবে ভেবে আমি নিজেই তাজ্জব হইছিলাম, কারণ আমি ব্লাশোঁ ও বাতাইয়ে পুরো মগ্ন ছিলাম; এরাই আসলে আমার শিক্ষক। আমি বলতে পারি, যৌবনে যা কিছু অধিপতি ছিল আমার তার সাথে ছেদ বিন্দু ছিল- বাতাইয়ের উপর লেখা সার্ত্রের প্রবন্ধ পাঠ। আমার কাছে মনে হইছিল, বাতাই নিয়ে সার্ত্রের অবুঝে এমন কিছু ছিল যা মেরামতের অযোগ্য ছেদের ভিত গড়ে দিছিলো আর শেষতক এমন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল— যা আসলেই আমাদের যুগের জন্য জরুরী ছিল। আসলে, দর্শন, রাজনীতি আর সর্বোপরি আমাদের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ- তা হল, যেটাকে বাতাই “অভিজ্ঞতা” বলেছিলেন; মানে এমনকিছু যা নিজস্ব প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় কর্তাসত্তার নিশ্চিতি না। বরং, ঐ ছেদ আর ঝুঁকি মিলে এটা গড়ে উঠে, যেগুলোর ভেতর দিয়ে কর্তাসত্তা বস্তু, অপর, সত্য আর মৃত্যুর সাপেক্ষে নিজের বদল, রূপান্তর ও রদ কবুল করে নেয়। এটাই অভিজ্ঞতা। নিজস্ব হওয়ার ঝুঁকি আর না নেয়া।

আমি কেবল এ অভিজ্ঞতাই বয়ান করেছি, পাগলামির ইতিহাস তো ঐ অভিজ্ঞতাই, যার ভেতর দিয়ে পশ্চিম একই সাথে নিজের অবস্থানের ঝুঁকি নিয়ে নিজেকে গঠন করেছে; অন্যকথায় পাগলামির বিপরীতে কর্তাসত্তা হিসাবে যুক্তির অবস্থান, যা জ্ঞানের বিষয় হিসাবে শেষতক রূপান্তরিত হইছে।১০

তো, আমি ঐ কাজটাই করেছি কেবল, আর শেষমেষ- পশ্চিমা বিজ্ঞান অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কি; যেখানে শুদ্ধ, স্থির যুক্তির বিষয় গড়ে উঠছে, যেটা এমন একটা বয়ান নির্মাণে সিদ্ধহস্ত, যেটাকে আগাগোড়া প্রমাণ করা যাবে, কিবা এমন এক দুনিয়া যেটাকে আগাগোড়া পরীক্ষা করা যাবে। এটাই অভিজ্ঞতা।

রুহানিয়াতের ইতিহাসে সত্য কেবলই এক(টা) পর্ব।


এখন, আপনি আমাকে একটা বিষয়ে ভাবতে সহায়তা করেন; যেটা আপনার চিন্তার কাছাকাছি, আপনার চিন্তার কিছুটা বিস্তারও বটে। ধরেন, আমরা যখন সোভিয়েত ভিন্নমতধারীদের ব্যাপারে শুনতে শুরু করলাম; রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ভিন্নমতাবলম্বীদের কার্যক্রমের রুহানি দিক নিয়ে বুদ্ধিজীবীরা সন্দেহ দেখাচ্ছিলেন। সলঝেনিতসিনের ক্ষেত্রে এটা ঘটেছিল; যাকে মূলত নিন্দা করা হয়েছিল ক্রুশ্চেভ আর ব্রেজনেভের বানানো রাষ্ট্রের বিরোধিতায় ‘আমি ঐতিহ্যগত ক্রিশ্চিয়ানিটির কাছে আর্জি জানাচ্ছি’ এই বক্তব্য ধরে। এ লোকগুলো যখন পশ্চিমে পৌঁছাল; তাদের লড়াইয়ের প্রশংসা করা হল, কিন্তু একই সময়ে বাম বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই তাদের কার্যকলাপের রুহানি দিক নিয়ে বিব্রত হচ্ছিলেন।


রুহানি না ধর্মীয়?


দোনোটাই; আপনি সেগুলোকে যে অর্থে ধরেছেন সে অর্থেই।


তারা অবশ্যই ধর্মীয় ও রুহানিকে মিলিয়েছে। এটা সত্যই বটে যে, ১৯১৭ থেকে যেসব অভিজ্ঞতা তারা পেয়েছে তাতে একজন রুশ— বিদ্রোহী কর্তাসত্তার উদ্বোধনে জন্য রুহানির যে নীতি তাকে মার্ক্সবাদ বা সমাজতন্ত্র কিবা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে জায়গা করে দিতে পারে না।


ঠিক তাই।


কেন আজকাল ধর্মের শরণ নিতে হচ্ছে; এটার উত্তরের কাজ মার্ক্সবাদ, সমাজবাদ কিবা দ্বান্ধিক বস্তুবাদের উপর বর্তায়।


অবশ্যই


জবাব দিবে তারাই, অন্য কেউ না।


ঐ দৃষ্টিকোণ থেকে আমি শুদ্ধ সমাজতাত্ত্বিক প্রশ্নটি মাথায় রেখেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, এ বিষয়ে স্বর বদলাবে।

সলঝেনিতসিনের কার্যকলাপের রুহানি অথবা ধর্মীয় দিক বিবেচনায় সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করা হইছিল- সেক্ষেত্রে আপনার ভেদবিচারও যথার্থ; কিন্তু আমি ভাবছি, উল্টোদিকে, আজকাল ইরানে যা ঘটছে তা ঐ লোকগুলোকেই –যারা কিছু ভুল বুঝাবুঝি থেকে আপনার প্রতিবেদন পছন্দ করেছিল; ধরুন আয়াতুল্লাহ খোমেনি আর পশ্চাদমুখী চর্চার মাঝেই সকল সদগুণ খুঁজে পাচ্ছে। এ রুহানি দিকটার ক্ষেত্রে মহৎ সব গুণ বর্তানো হচ্ছে, যা ইরানিদের উত্তেজিত করছে, তাদের উঠে দাড়ানোর সাহস দিচ্ছে, কিন্তু এতসবের পিছনে যে ভিত নজরে আসছে তা ধর্মীয়, যেটা সন্দেহজনক।


আমার সমসাময়িকেরা কি ভাবছে তার কারণ খোঁজার দায়িত্ব আমার না; তারা কি জন্য আমার মত ভাবে না, তা নিয়ে না ভেবে আমি কি ভাবতে চাই তা নিয়েই আমি যথেষ্ট প্যারায় থাকি।

অবশ্যই কিছুটা অতিমূল্যায়ন এমন ঘটিয়েছে যে, কোন ইসলামি রাষ্ট্র হলেই আমাদের এর পক্ষে থাকতে হবে। এই একই রুহানি ধারা ইহুদিদের মাঝে খুঁজে পেলে, আমরা যাদের কথা বললাম তাদের মাঝেই অবিশ্বাস দেখা যাবে।

ধরেন বৌদ্ধ ধর্ম ও অন্যসব বিশ্বাস নিয়ে খুব কমই বলেছি। আমি আবারো বলব- কর্তাসত্তার উদ্বোধনের জায়গা থেকে রুহানিয়াত ব্যাখ্যা করা বেশ কিছু বিষয়ের সাথে যুক্ত, যা সমকালীন দুনিয়ার ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঙ্গী জড়িত। অবশ্যই, একটা বিপ্লব প্রকল্প, যেটা বিজ্ঞানের ভাষায় বোধগম্য, যা একটা যৌক্তিকভাবে সংগঠিত রাষ্ট্র গঠনের দিকেও চালিত করবে, একই সময়ে ব্যক্তির সুখ ও নিশ্চিত করবে- সেটার বড়সড় ব্যর্থতার ফলে রুহানিয়াতের এ সাধনা এখন নাঙ্গা দশায় পুনঃহাজির হচ্ছে, আর এ আন্দোলন এখন কেবল ধর্মীয় লেবাস পরেই হাজির হতে পারছে।


এরকম লেবাসে বড়সড় ঝুঁকি কি নাই, যখন আমাদের কোন উপদেশ কিবা বক্তব্য দেয়ার সুযোগ নেই?

ঘটনা হল, সমগ্র জনগণ জালিম রাষ্ট্রীয় সর্বাত্মকবাদের (totalitarianism) বিরুদ্ধে লড়ছে, শরণ নিচ্ছে ধর্মের আর শেষমেশ ফিরতে চাইছে একটা ধর্মীয় রাষ্ট্রে, যে কারণেই হোক- এটা কি সঙ্গে করে সম্ভাব্য কল্পনীয় সব ভীতিকর বাস্তবতা নিয়ে হাজির হচ্ছে না? সংক্ষেপে বললে, চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যকার বিচ্ছেদের মামলা আবার তোলা, যদিও ইরানের পরিস্থিতিতে এ পরিভাষাগুলো খাটে না; এটা কি বড়সড় ঝুঁকি না?


আমার মনে হয় আমাদের একইসাথে সুনির্দিষ্ট আর সতর্ক হতে হবে।


ঘটনা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, বিষয়টা খুব সহজ। শাহের একনায়কতন্ত্র আছে, পুলিশ আছে, টর্চার আছে, জেলখানা অসহনীয় অথচ পূর্ণ; কিন্তু তার বিরুদ্ধে শিয়া ধর্মমতের হাত ধরে অনেকগুলি আকাঙ্ক্ষার উদ্ভব, সংগঠিত হওয়া ঘটতেছে। এই হল ঝুঁকি। এই আকাঙ্ক্ষাগুলোর বাহকেরা সেগুলো বাস্তবে রূপ দিতে অক্ষম হলে একধরনের মৌলবাদ যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, সেটা সত্যিই ভীতিকর, আর অনেক বেশি দমনমূলক। অনেকে যে তখন মায়াকান্না করবেন, সেটা আমি এখানে বসেই দেখতে পারছি।


আমি যে প্রবন্ধ লিখেছিলাম সেখানে যদি ফিরি, আমার স্পষ্ট মনে আছে এই ইস্যুতে আমি ইরানিদের বক্তব্য উদ্ধার করেছি, তাতে খুব মুশকিলের আর বিপজ্জনক দিকগুলো ফুটে উঠেছে, সেখানে পশ্চিমা প্রভাবিত সরকার কাঠামোর বিপদ আর ধর্মীয় আন্দোলনের অন্তর্নিহিত বিপদের একধরনের জগাখিচুড়ি পাকিয়ে গেছে।

ধরেন, আমরা যখন জিজ্ঞাসা করি- ‘আপনাদের ইসলামি সরকারে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা কি হবে? একদিক থেকে উত্তরটা ক্লাসিক, গতানুগতিক, সেটা কত ভয়ঙ্কর আমরা জানি; অষ্টাদশ শতকের জবাব। তারা বলে- ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ আইন বানিয়ে নির্ধারণ করবে সংখ্যালঘুদের কি মর্যাদা দেয়া হবে’। আর, এটার গন্তব্য কোথায় তা আমাদের জানা আছে। অন্যদিকে, এই লোকেরাই আমাদের বলেছে বিশেষ কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী যেমন বাহাই ধর্মাবলম্বীরা এমন ধর্মমত গ্রহণ করেছে, যা পুরোটাই ভুল এবং এতই কলুষিত যে তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়া হবে না। দেখতেই পারছেন দিনশেষে কিভাবে পশ্চিমা যুক্তিবাদী চিন্তা- যার চিহ্ন হল এরকম জ্যাকোবিন গণতন্ত্র, ধর্মীয় মৌলবাদের বিপদকেই বাস্তব করে তোলে। আর এ বিপদগুলো একে অপরের সঙ্গী, ইরানি আন্দোলনকে যেগুলো বাধাগ্রস্ত করছে, যেরকমটা সর্বোপরি অন্য সকল আন্দোলনকেই করছে।

ইরানিদের অধিকাংশই এ সব বিষয়ে পাক্কা সচেতন, বিশেষত যাদের সাথে আমি একটা ভাল সময় ধরে কথা বলতে পেরেছি। তারা এগুলা ভাল করেই বুঝে, তারা এখন যেটা করতে চাইতেছে তা হল ইসলাম থেকে যদি কিছু বের করে আনা যায়, যেটা এখন একাধারে তাদের ঐতিহ্য, জাতীয় চৈতন্যের রূপ, যুদ্ধের প্রেরণা, অভ্যুত্থানের মূলসূত্র, যেটা অনুসারে তারা এসকল বিপদ এড়াতে পারবে।

আমার মনে হয়না একাধারে এটা বলে যেতে হবে- ‘তোমরা তো ইসলামের গাড্ডায় পড়তেছ আবার, যেটা মৌলবাদের বিপদ সাথে করে নিয়ে আসবে, যে ধর্মটা একেশ্বরবাদী ধর্ম হিসাবে খুবই অসহিষ্ণু’। আর যা যা আছে আর কি। আমি মনে করি না, এইসব বিষয়ের ভিত্তিতে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে তাদের বাতিল করে দেয়া, তাদের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধতার অভিযোগ তোলা কোন কাজে দিবে। তারা ধর্মান্ধ না, তবে সত্য হল যখন থেকেই এ আন্দোলন ধর্মরাষ্ট্র আকারে সংগঠিত হচ্ছে, কিবা রাষ্ট্রধর্ম আকারে, তখনই ধর্মান্ধতার ঝুঁকি বাড়ে।

সমকালে যা খুঁজে বের করতে হবে— আমি ইরানিদের কথা বলসি এবং অন্যদের কথাও বলছি— এ রুহানিয়াতের সাধনা, যা মহাবিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার ধ্বংসাবশেষের নিচ থেকে নাঙ্গা সুরতে হাজির হচ্ছে, যা এখানে ইসলামের রূপে হাজির, আবার অন্যত্র ক্রিশ্চিয়ানিটি রূপে- এগুলো নিয়ে কি করব।


পোলিশ পোপের নির্বাচন?


হয়ত, কিবা ধরেন পরিবেশবাদে কিবা অন্যত্র।

এর হাজার সুরত আছে। কখনো অস্বাভাবিক, কখনো প্যারাময়, কখনো মর্মছোঁয়া, কখনো বোকা, কখনো সূক্ষ্ম, কিন্তু সমকালে দুনিয়ার সর্বত্র তুমুলভাবে খুঁটি গাড়া বাস্তবতা। অস্বীকারের উপায় নাই।


আর কাল্ট বা সেক্ট?


সেটা নিয়ে কি কাজ? একটা ভাবাদর্শের নামে সেটাকে না দুষে, যেটা আসলে রুহানিয়াতের জন্য এ সমগ্র প্রচেষ্টাকে বিফল করেছে, এটার ভেতর দিয়ে কিভাবে কাজ করা যায় তা ভাবা দরকার। এই অর্থে, রুহানিয়াতে নিবেশের যে ধারণা বাতাই বিশ বছর আগেই ইশারা করে গেছেন, আমার কাছে সেটাকে সামগ্রিকভাবে প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। আর আমি সেজন্যই লড়ছি।


এখন বলেন, আমরা এ চিন্তা নিয়ে কি করব? কিভাবে এটাকে মোকাবেলা করব? আমাদের আছে কি, যা দিয়ে এটারে ধরতে পারব, বুঝতে পারব, গ্রহণ করতে পারব?


দুইশ বছর লাগসে ক্রিশ্চিয়ানিটির ভেতরে রুহানিয়াতের বিকাশে, যেটা ক্রিশ্চিয়ান থাকা সত্ত্বেও চার্চের বিরুদ্ধে খাড়া হয়ে গেসিল, যেটা পশ্চিমের অনেককিছুই বদলে দিতে পারত। এখন আমরা যে ধ্বংসাবশেষের উপর দাঁড়িয়ে আছি; দশ-পনের বছরের আগে সেটা কি রূপ নিবে তা বলা মুশকিল। ব্রেথ্রেন অব দ্যা কমন লাইফ, অ্যানাব্যাপ্টিস্ট, ট্যাবোরাইটদের জমানা আর যারা আছে, সবই আবার শুরু হবে। কিন্তু ধর্মীয় মোড়কে না, যদিও এটার একটা ধর্মীয় রূপ সবসময়ই থাকবে, এটা বিপুল নিরীক্ষাযজ্ঞের ভেতর দিয়ে যাবে অন্তত আগামী এক শতক। আমাদের এটাই করতে হবে।


মানে, অপেক্ষা করতে হবে।


না, অপেক্ষা না; কিছু করতে হবে, চর্চা করতে হবে। উঠে দাঁড়ানো চর্চা করতে হবে, মানে, কর্তাসত্তার অবস্থানে একটা লোক নিজেকে খুঁজে পাচ্ছে, সেটাকে খারিজ করার চর্চা জারি রাখতে হবে। নিজস্ব পরিচয় খারিজ করতে হবে, নিজের ধারাবাহিকতা খন্ডাতে হবে, নিজে যা তা বাতিল করে দিতে হবে। চলতি দুনিয়াকে বাতিল করার এটাই প্রথম শর্ত।


এটাই কি আশা করতে হবে ঘটনাদি থেকে, সামষ্টিক আত্মহত্যার মত যেগুলা একে অপরের প্রতি বিরূপ আর বিরুদ্ধ প্রকৃতির?


আপনি তো আমার জন্য বহুত ফাঁদ পেতে রাখসেন, দেখতেছি।


আমরা চাই বা না চাই; আপনি যা বয়ান করলেন, সেটা আমি ইতোমধ্যে যা বলছিলাম তার স্বপক্ষের মনে হচ্ছে। এই প্রকৃতি ঠিক কেমন আমি জানি না; তবে এটা বিশেষ কিছু অবশ্যই। একধরনের মিল কি খুঁজে পান না, অন্য হয়ে উঠার ইচ্ছায়, উঠে দাড়ানোর ইচ্ছায়? এই মিলের জায়গাটা কি আসলে?


এটা খুব সরল কথা হবে, এ চিন্তায় যা হারিয়ে গেছে, ১৮শ শতকের আশেপাশে ফরাসি বিপ্লবের ক্ষণিক পূর্বে যার উদ্ভব, সেটা হলঃ ইতিহাসের একটা কর্তাসত্তা আছে।

ইতিহাসের এই কর্তাসত্তা ছিল যুক্তি, মানবতা, মানুষ আর সমাজ। আমরা এখন জানি ইতিহাসের কোন কর্তাসত্তা নাই। ইতিহাস কোন কর্তাসত্তা বয়ে বেড়ায় না; আর কর্তাসত্তাও সাথে করে ইতিহাস নিয়ে আসে না। আমার মনে হয় এখন এটা স্পষ্ট হইছে। কর্তাসত্তার এরকম পুনরুত্থান, যেটা ইতিহাসের কর্তাসত্তার অধীন থাকতে চায় না, এটাই আমাদের সময়ের বৈশিষ্ট্যসূচক ঘটনা।



ভালো। এখানেই শেষ করা ভালো। ধন্যবাদ আপনাকে।

____________


ইংরেজি অনুবাদকের টীকা

[১] রাজনৈতিক রুহানিয়াত প্রত্যয়ের অবতারণা প্রসঙ্গে দেখুন, “À quoirêvent les Iraniens?” Dits et écrits, ed. François Ewald, Daniel Defert, and Jacques Lagrange, 2 vols. (Paris, 2001), 2: 694.

ইরান নিয়ে ফুকোর রিপোর্টগুলোর জন্য এই গ্রন্থের পরিশিষ্ট দেখুন, Janet Afary and Kevin B. Anderson, Foucault and the Iranian Revolution: Gender and the Seductions of Islamism (Chicago, 2005)

[২] বাজারি বলা হয় ইরানের বণিক শ্রেণীকে, বাজারে যারা কাজ করেন।

[৩] দেখুন, “1 March 1978,” Security, Territory, Population: Lectures at the Collège de France 1977–1978, trans. Graham Burchell, ed. Michel Senellart (New York, 2007), pp. 191–226.

[৪] ফুকো এখানে ভুল বলেছেন। যে সঙ্কটের কথা তিনি উল্লেখ করেছে তা ঘটে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে, ষোড়শ শতকে নয়।

[৫] উদ্ধৃত হয়েছে, Edmund Burke, Reflections on the Revolution in France, ed. L. G. Mitchell [New York, 2009], p. 168

[৬] এখানে, ফুকো উপরে যা বলেছিলেন তার বিপরীত কথাটিই বলছেন, স্ববিরোধ করছেন। উপরে তিনি বলেছিলেনঃ ফরাসি... এমন একটা বিপ্লব,… কোনক্ষেত্রেই ঐতিহ্যগত রুহানি বরাত টানতে হয় নাই।

[৭] ফরাসিতে, সাক্ষাৎকার-গ্রহীতা উল্লেখ করেছেন “désoccidentalisation” (de-Westernification। কিন্তু পরিপ্রেক্ষিত দেখে মনে হচ্ছে তিনি Occidentalization বা Westernification বুঝাতে চেয়েছেন। সে অনুসারেই বদল আনা হয়েছে।

[৮] দেখুন, Jean-Paul Sartre, “A New Mystic: On Bataille’s Inner Experience,” trans. Chris Turner, in We Have Only This Life to Live: The Selected Essays of Jean-Paul Sartre, 1939–1975, ed. Ronald Aronson and Adrian van den Hoven (New York, 2013), pp. 47–82

[৯] জর্জ বাতাই নিয়ে ফুকোর শুরুর দিককার বোঝাপড়া জানতে, দেখুন Foucault, “A Preface to Transgression,” in Language, Counter-Memory, Practice: Selected Essays and Interviews, trans. Donald F. Bouchard and Sherry Simon, ed. Bouchard (Ithaca, N.Y., 1980), pp. 29–52

[ফুকোর এই লেখাটি নিয়ে বোধিচিত্তে "জর্জ বাতাই ও সীমার সীমাহীনতা" শিরোনামে আলাপ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী রবিউল আলম।]

[১০] দেখুন, Foucault, History of Madness, trans. Jonathan Murphy and Jean Khalfa, ed. Khalfa (New York, 2009)



ইতোমধ্যে বাংলায় ফুকোর ইরান বিপ্লব (১৯৭৯) নিয়ে ভাবনা ও 'রাজনৈতিক রুহানিয়াত' ধারণা নিয়ে বেশকিছু পর্যলোচনামূলক লেখালেখি রয়েছে। আগ্রহীদের জন্যে সেগুলোর কয়েকটির হদিস সংযুক্ত করে দেয়া হলো।

প্রকাশঃ ২১শে বৈশাখ, ১৪২৮:::৪ঠা মে, ২০২১