অন্যতা ’র সাধনা রূপে রাজনৈতিক রুহানিয়াত

ল্যু ন্যুভেল অবজা’ভ্যাতা ’র সঙ্গে মিশেল ফুকোর সাক্ষাৎকার


[মিশেল ফুকোর ইরান বিপ্লব (১৯৭৯) বিষয়ক লেখালেখিতে ব্যবহৃত রাজনৈতিক রুহানিয়াত (Spiritualité Politique , ইংরেজিতে Political Spirituality) প্রত্যয়টির ভাব তিনি স্পষ্ট করেছেন ইতালীয় সংবাদপত্র ল্যু ন্যুভেল অবজা'ভ্যাতা(L'Obs)'কে দেয়া “Political Spirituality as the Will for Alterity” শিরোনামের এই সাক্ষাৎকারটিতে। ফুকোর নোটস্‌ ও অপ্রকাশিত লেখাজোখার প্রায় শ'খানেক বাক্স তাঁর পার্টনার ড্যানিয়েল ডেফার্ট ২০১৩ সনের দিকে বিক্রি করে দিলে এই সাক্ষাৎকারটি সেখানে মিলে। এই সাক্ষাৎকারটিতে তারিখ উল্লেখ রয়েছে, ৩রা জানুয়ারি ১৯৭৯। অর্থাৎ শাহের পতনের ঠিক ১৩ দিন পূর্বে এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়। ল্যু ন্যুভেল অবজা'ভ্যাতারের জন্য নেয়া হলেও এটি এতদিন যাবত অপ্রকাশিতই ছিল এবং ফুকো বেঁচে থাকা অবস্থায় কেন সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়নি সে ব্যাপারটি অজানাই রয়ে গেছে। ২০১৮ সনে এর নির্বাচিত অংশ ফরাসি ভাষায় ছাপা হয়। অতিসম্প্রতি এই সাক্ষাৎকারটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। ইংরেজি অনুবাদকের ছয় পাতার ভূমিকা সমেত সাক্ষাৎকারটি ছেপেছে ক্রিটিক্যাল ইনক্যোয়ারি জার্নাল, ৪৭ তম খণ্ডের ১ম সংখ্যায় (অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০২০)। ইংরেজিতে এটির অনুবাদ করেছেন স্যাবিনা ভ্যাকারিনো ব্রেম্‌নার (Sabina Vaccarino Bremner)। তিনি খঁনিংয়েন্‌ বিশ্ববিদ্যালয়ের(University of Groningen) দর্শনের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এবং বর্তমানে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। ফুকোর এই সাক্ষাৎকারটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মাহফুজ আবদুল্লাহ। মাহফুজ আবদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী এবং সিনেযোগ ম্যাগাজিনের সম্পাদক।]




মিশেল ফুকো, ন্যুভেল অবজা’ভ্যাতুতে যখন ইরান নিয়া রিপোর্ট দিতেছিলেন, তখন আপনি লিখছিলেন এই দেশ এখন এমন কিছু খুঁজতেছে, যেইটা আমরা পশ্চিমারা রেনেসাঁ এবং ক্রিশ্চিয়ানিটির ক্রাইসিস কাটানোর পরে হারায়ে ফেলছি। আপনি যেইটারে বলছিলেন, ‘রাজনৈতিক রুহানিয়াত’। এখন যেটা ঘটতেছে, মানুষ এ টার্ম শুইনা ভ্যাবাচ্যাকা খাইতেছে। মনে হয়, বিষয়টা আরেকটু ক্লিয়ার কইরা বলা দরকার আপনার।


ঐ লোকদের জবাব দিতে আমি পয়লা যেটা করতে চাই সেইটা হইল দায় ঘুরানো। আগে একটা গল্প বলি-

ইরানে থাকার সময়ে একটা ম্যাগাজিন একজন রিপোর্টার পাঠাইছিল, তো সে ইরান নিয়া লেখা হইলে যেমনে সবাই শেষ করে আরকি সেরকমই ধর্মীয় আন্দোলনগুলার দিকে ইঙ্গিত কইরা লিখছে— এগুলা তো পুরা ইরানের জনমানুষের মন মগজ খাইয়া দিছে। প্যারিসে পাঠানোর আগেই লেখাটা পড়ছিলাম আমি। এরপর দেখলাম, প্যারিসে ছাপানোর সময় সম্পাদকমণ্ডলী ‘ধর্মান্ধ’ শব্দটা ঢুকায়া দিছে।

এখন, যারা আমার মত ইরানে কি চলতেছে বুঝার চেষ্টা করতেছে তাদের কাজ কি নিজেদের সাচ্চা প্রমাণের জন্য এই ধর্মীয় অথবা রুহানি আন্দোলনগুলার অস্তিত্ব ঘোষণা কইরা বেড়ানো?

বরং, যারা এরকম গরল বুকে-মুখে নিয়া বেড়াচ্ছে, এইটা তাদের কাজ না যে ঠিক কি জন্য তারা গোঁ ধইরা আছেন তা খোলাসা কইরা বলা?


ঠিক। আমরা মুদ্রার দু’পিঠই দেখব। তবে আপনার কথা ধরলে, আপনি যখন ‘রাজনৈতিক রুহানিয়াত” টার্মটা ইস্তেমাল করেন,যার ভেতরে আমাদের ঐতিহ্য আর চিন্তার অনেক চিহ্ন ও দাগ লুপ্ত আছে— বিশেষত রুহানিয়াত শব্দটাই যদি ধরেন, তো এইটা কি একটু বিশদ কইতে পারবেন? এটা কি আদতে নিছক বর্ণনার জন্যই ব্যবহার করছিলেন?


আমি খোঁজার চেষ্টা করছি, এমন কোন শক্তি ইতিহাসে ছিল কিংবা আছে কিনা, যা এরকম ভয়ঙ্কর রেজিমরে মোকাবেলা করতে পারবে। এই রেজিম তো ধরেন অনেক শক্তিশালী, আর্মি আছে আবার বিপুল পুলিশ বাহিনী— অন্যদিকে সমগ্র জনগণ, জনগণের হাত খালি। তাদের হাতে তো আর অস্ত্র নাই। আমি ঠিক জানিনা কোথাও কি অস্ত্র লুকায়া রাখছে কিনা, তবে লুকাইলে ওরা ভালমতনই লুকাইবে, তবে অস্ত্র যে বেশি হবে না সেইটা শিউর, নইলে তো তারা গুলি-টুলি মারতো, যদিও প্রতিদিনই ডজন ডজন লোক মরতেছে।

তাইলে যারা নিজেদের একেবারে কোরবান করে দিতে চাইতেছে তাদের সেই শক্তি আসলে কি, যেখানে একটা তীব্র অবাধ্য ইচ্ছাশক্তি আছে— যেইটা দিনকে দিন নতুন প্রাণ পায়, কুরবানির কবুলিয়ত আছে?

এইটা তো স্পষ্ট, মার্ক্সবাদের মত একটা রাজনৈতিক আদর্শের মাঝে এর জবাব খুঁজমু না, কিবা পশ্চিমা অর্থে এক বিশেষ কিসিমের বিপ্লবী আদর্শেও না, বরং অন্য কোথাও।


ইরান সঙ্কট ব্যখ্যা করতে ইউরোপে মোটাদাগে যে চিন্তাকল্প খাড়া করা হইছে, তা হইল ইরানে তড়িঘড়ি আধুনিকায়ন ঘটছে। তাইলে এই বাস্তবতার মাথা কেটে আমাদের কেন একটা তুরীয় ব্যাখ্যা খুঁজতে হবে?


প্রথমত, এইটা কাটা ছেঁড়া না। আর, দ্বিতীয়ত এইগুলা তুরীয়ও না। বাস্তবতা আছে। তারা সোজাসাপ্টা বলতে পারতঃ “আমরা এই আধুনিকায়ন চাই না, এই রেজিম আমাদের উপরে উন্নয়ন, রাজনৈতিক কাঠামোর জঞ্জাল চাপিয়ে দিতে চাইতেছে, আমরা যেইটা মাইনা নিতে পারমু না, আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া আধুনিকায়নের জন্য এত মূল্য শোধ করতে পারমু না”। দেখেন, তারা কিন্তু এইগুলা বলতেছে না।

পয়লা কথা আধুনিকায়ন নিয়ে। আমার মনে হয়, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তুর্কিতে যা ঘটল, তাও প্রমাণ করে যে, ইরানে এখন যেইটা ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে তা আধুনিকায়ন না, বরঞ্চ পুরানাকরণ (antiquation, সেকেলে)। এ পুরানাকরণ আসলে কামালবাদ, বলতে গেলে মুসলিম, ইসলামি এবং অন্য সমাজগুলোর এক বিশেষ আদলের পুনঃসংগঠন, যে আদল আবার কমবেশ পশ্চিম থেকে ধার করা এবং কামাল আতাতুর্কের হাত ধরে ১৯২০ এর দশকে যার বিকাশ। পাহলভী বংশও এ আদল মেনে চলছে, ১৯৩৮ বা ১৯৪০ পর্যন্ত প্রকাশ্যে, এরপর থেকে নিরলে।

আর, এটা একটা বাস্তবতা যে জনগণের একটা বড় অংশে, মানে বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে আবাদানের কারখানা শ্রমিক, তেহরানের বাজারি থেকে আরম্ভ করে রাজধানী থেকে দূরবর্তী ইরানের পূর্বাঞ্চলের কৃষক— সবাই খোমেনি এবং মোটাদাগে সকল ধর্মীয় নেতার সাথে আত্মীয়তা বোধ করে। আসলে তাঁদের আত্মার সম্পর্ক ইসলামের লগে, যেটা জীবনের ভিন্ন এক সুরত, যেটাকে আধুনিকের তুলনায় প্রাচীন পন্থা বলা যায় না, বরং ধর্মে জড়ানো এক বিশেষ জীবনের সুরত বলা যায়।

আমার মনে হয় এ সত্যরে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, আর ইরান থেকে ফিরে আসা অনেক লোকের কেউই মনে হয় এটার বিপরীত কিছু বলবে না।

তাইলে এখন জানা লাগবে যে, তারা কি নিজেদের ধোঁকা দিচ্ছে। তারা কি আসলে ধর্মীয় মূল্যবোধ ধারণ করছে নাকি নিজেদের জবানে বেঁচে যাওয়া ধর্মীয় পরিভাষা দিয়েই বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটা বিশেষ অসহায়তা প্রকাশ করছে কেবল।


চলমান ঘটনাগুলো নিয়ে আপনার দেখাকে কি ইরান সম্বন্ধে সার্বিক চিন্তাকল্প রূপে ধরা যায়? আপনি কি মনে করেন, বিশেষ এক পরিস্থিতিতে ধর্মভাবের উদ্ভব- রাষ্ট্র এবং যারা আজকাল এটার ধারক-বাহক তাঁদের বিপরীতে ভিন্নমতের একটি প্রতিরোধের পরিসর তৈরি করবে?


ভাল প্রশ্ন। কারণ এর বরাতে একটা ফারাক স্পষ্ট করা সহজ হইল, যা আমার কাছে মোটামুটি স্পষ্টই ছিল, কিন্তু যা হয় সচরাচর— আমি পাঠকের জন্য ঠিকঠাক পরিস্কার করে বলিনি।

আমি যখন রুহানিয়াত নিয়া কথা বলি, আমি তখন ধর্ম নিয়া বলছিনা, মানে ধর্ম আর রুহানিয়াতের মাঝে ফারাক টানতে হবে। আমি বিষম খাইলাম, যখন দেখলাম রুহানিয়াত, রুহানিবাদ (spiritualism) আর ধর্ম— এ তিনটা জিনিস জগাখিচুড়ি টাইপ হয়ে গেছে, সবাই তালেগোল পাকায়া ফেলতেছেন।

রুহানিয়াত ধর্মে খুঁজে পাওয়া যাবে, সত্য। তবে, ধর্মের বাইরেও পাওয়া যাবে, ধরেন বৌদ্ধ ধর্মে— যেটার কোন ধর্মতত্ত্ব নাই, একেশ্বরবাদী অন্য ধর্মগুলোতেও আছে, আবার গ্রিক সভ্যতাতেও কিন্তু রুহানিয়াত আছে। মানে, রুহানি মানে ধর্মীয় এমন না ব্যাপারটা। যদিচ, অধিকাংশ ধর্মেরই এক ধরনের রুহানি মাত্রা আছে।

রুহানিয়াত কি?

আমার মনে হয়, এইটা হল এক বিশেষ চর্চা যার ভেতর দিয়ে ব্যক্তি স্থানচ্যুত হয়, নিজের রূপান্তর ঘটায়, ভেঙ্গে চুরে আগায় এতদূর যে নিজের ব্যক্তিসত্তা আর কর্তা অবস্থান খারিজ করে বসে। ঐ বিশেষ মাত্রা তক যে কর্তাসত্তা ছিল সে, আর সেখানে থাকে না— একটা রাজনৈতিক শক্তির সাপেক্ষে যে কর্তা সত্তা, এক বিশেষ জ্ঞানের তরিকা, একটা অভিজ্ঞতা আর একটা বিশ্বাসের সাপেক্ষে যে কর্তাসত্তা সে ছিল আগে সেখান থেকে তার চ্যুতি ঘটে।

আমার কাছে মনে হয়, একটা রাজনৈতিক বা ধর্মীয় শক্তি, একটা সংস্কার, বিশ্বাস, অভ্যাস ,সমাজ কাঠামো আরো বিবিধ জিনিস মিলিয়ে আপনার যে কর্তা অবস্থান নির্ধারণ করে দেয়, তা থেকে ভাসান দিয়ে উঠাটাই রুহানিয়াত। মানে ব্যক্তি যা, তা থেকে ভিন্ন হয়ে ওঠা, নিজের থেকে আলাদা হয়ে ওঠা।

সত্য যে, রুহানিয়াতের এত সব কিসিম আর চর্চার একধরনের আশ্রয় হল ধর্ম, আবার একই সাথে এক্ষেত্রে যত বাধা নিষেধ সেগুলোরও উৎস ধর্ম। ধর্ম ঠিক করে দেয় নিজের চেয়ে ভিন্ন ব্যক্তি কিভাবে হয়ে উঠতে হয়, কোন লক্ষ্যে ব্যক্তিকে এগুতে হবে, সে নতুন কোন হালতে পৌছাবে ইত্যাদি। বস্তুত, ধর্ম রুহানিয়াতের এক বিশেষ বিধিবদ্ধ রূপ নির্ধারণ করে।