গিওর্গ লুকাচের (এবং আন্তোনিও গ্রামসির) লিগ্যাসি নিয়ে আপনার নিজস্ব আত্তিকরণ, কীভাবে প্রকৃতির ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি ব্যবহারে বাধা তৈরি করেছে তা আপনি মার্কসের ইকোলজি বইয়ে উল্লেখ করেছেন। আপনি দেখিয়েছেন, এই সাধারণ দুর্বলতার কারণে পশ্চিমা মার্কসবাদ বিজ্ঞানের দর্শন ও প্রকৃতির ক্ষেত্র থেকে কিছুটা পরিত্যাক্ত হয়ে চিন্তার যান্ত্রিক ও দৃষ্টবাদী ধরনের এলাকায় যায়। তবে দি রিটার্ন অব নেচার (২০২০) বইটি শুরু হয়েছে লুকাচ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন দিয়ে। সেগুলো প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা থেকে পশ্চিমা মার্কসবাদের বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে কেন্দ্রীয় প্রশ্ন। কী কী শর্তাবলী এইরকম গুরুত্বপূর্ণ অনেক ফলাফল পেতে বিলম্ব ঘটিয়েছে? বিশেষ করে বাস্তুতন্ত্রবিদ্যার সাথে মার্কসবাদ নিয়ে যেসব আন্দাজ ছিলো, সেসবের প্রধান প্রভাব কী ছিলো?
আমি হয়তো এর কিছুটা ব্যাখ্যা করতে পারি আমার নিজস্ব বৌদ্ধিক বিকাশের ভেতর দিয়ে। আমি যখন স্নাতকের ছাত্র ছিলাম, তখন ইমানুয়েল কান্ট, হেগেল, আর্থার শোপেনহাওয়ার, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন এবং ম্যাক্স ওয়েবারের কাজ মোটামুটি ব্যপকভাবেই অধ্যয়ন করেছিলাম। সেইসাথে অধ্যয়ন করেছিলাম হারবার্ট মার্কুস, মেসজারোস, আর্নস্ট কাজিরার, এইচ. স্টুয়ার্ট হিউস এবং আর্নল্ড হাউসারের মতো চিন্তকদের কাজ। ফলে, আমি যখন স্নাতকোত্তরে [পড়তে] গেলাম, কান্টবাদ/নব্য-কান্টবাদ এবং হেগেলবাদ/মার্কসবাদের মাঝে সীমা সম্পর্কে আমার বেশ ভালো একটা সাধারণ ধারণা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও, বিচারমূলক তত্ত্বের কোর্সে অংশ নিয়ে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। সেখানে একদম প্রথম যে প্রত্যয় শেখানো হয়েছিলো তা হলো, প্রকৃতিতে দ্বান্দ্বিকতা প্রয়োগ করা হয়নি। প্রাথমিকভাবে এর ভিত্তি ছিলো লুকাচের হিস্টোরি অ্যান্ড ক্লাস কনশাসনেস’(১৯২৩, ইংরেজিতে অনূদিত ১৯৭১) বইয়ের একটা পাদটীকা। সেখানে তিনি প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা প্রসঙ্গে এঙ্গেলসের সমালোচনা করেছিলেন। বাহাস করা হয়েছিল, প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা প্রত্যাখ্যান করেও কেবল ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার হুবহু, বিষয়ী-বিষয় (subject-object, অর্থাৎ চিবতার কর্তা-চিন্তার বিষয়) অনুসারে দ্বান্দ্বিকতা সংজ্ঞায়িত করা যায়।
যেহেতু লুকাচ নিজেই পরে খোলাসা করেছিলেন, তিনি অবশ্যই কখনো সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা অথবা “নিখাদ বিষয়গত দ্বান্দ্বিকতা”র প্রত্যয় পরিত্যাগ করেননি। যেটি তিনি হিস্টোরি অ্যান্ড ক্লাস কনশাসনেস’ (১৯২৩) বইয়ের কোথাও কোথাও উল্লেখ করেছেন। বস্তুত, লুকাচ মার্কসকে অনুসরণ করে ‘হিস্টোরি অ্যান্ড ক্লাস কনশাসনেস’ বইয়ে, ১৯৬৭ সালের বিখ্যাত সূচনায়, বিপাক-ক্রিয়া হিসেবে শ্রমের ভেতর দিয়ে সমাজ ও প্রকৃতির মাঝে দ্বান্দ্বিক মধ্যস্থতার ওপর জোর দিয়েছিলেন। আর এই অর্থে তা ছিলো প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা ধারণার ওপর জোর দেয়া। এই একই বাহাস করা হয়েছিল তাঁর কনভারসেশন উইথ লুকাচ (১৯৬৮) বইয়ে। বইটি আমি পড়েছিলাম ১৯৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে।
পশ্চিমা মার্কসবাদী দার্শনিক ধারণায় দ্বান্দ্বিকতা প্রয়োগযোগ্য ছিলো কেবল মানব-ঐতিহাসিক ক্ষেত্রে। প্রকৃতিতে (অথবা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে) নয়। বিষয়টি প্রদত্ত হয় যান্ত্রিকতাবাদ অথবা দৃষ্টবাদে। সম্পূর্ণরূপে নেয়া ছাড়াই আমি এই প্রেক্ষিত কিছুটা ব্যবহারিক স্তরে আত্তীকরণ করেছিলাম। সেটা ছিলো অস্পষ্টতা আর অনিশ্চয়তা নীতির প্রেক্ষিত থেকে ঐতিহাসিক দ্বান্দ্বিকতা দেখার জন্য যাতে আমরা ইতিহাস বুঝতে পারি। মার্কসবাদী ইতিহাসবিদ ই. পি. থম্পসন একে বিকশিত করে বলেন, কারণ ইতিহাস আমরাই তৈরি করেছি। যদিও গভীরতর স্তরে আমি চিহ্নিত করেছি যে তা পুরোপুরি সন্তোষজনক নয়। যেহেতু মানুষ একাই ইতিহাস তৈরি করে না। সে ইতিহাস তৈরি করে প্রকৃতির সার্বিক বিপাক-ক্রিয়ার সাথে যুগপৎ সংঘটনে— মানব সমাজ যার এক প্রকাশমান অংশ। ১৯৮০ এর দশকে আমার আগ্রহ ছিলো প্রধানত ইতিহাস ও রাজনৈতিক অর্থনীতির দিকে। সেখানে এই ধরনের ইস্যুগুলো হাজির হতো কখনো-সখনো। যেহেতু, যতটা সম্ভব এখানে মনোযোগে ছিলো মানুষের ঐতিহাসিক ক্ষেত্র, কাজেই প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার প্রশ্ন ব্রাকেটবন্দী করা বেশ সহজ ছিলো।
১৯৮০ এবং ৯০ এর দশকে আমি যখন আরও সরাসরি বাস্তুতন্ত্রের প্রশ্নে আসি, তখন এই সমস্যা আর এড়ানো গেলো না। প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতাকে নির্বিরোধীভাবে একপাশে সরিয়ে রাখা যেতে পারে শুধু ভাবতান্ত্রিক (idealist) অথবা যান্ত্রিক বস্তুবাদের জমিনে। তবুও,মার্কসের ইকোলজি লেখার সময়, মার্কসের সাথে সম্পর্কে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা নিয়ে বিস্তারিত এবং যে কোন মূর্ত বিবেচনার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেছি। বিষয়গুলো ছিলো জটিল। আর সেগুলো তখন শনাক্ত করতেও প্রস্তুত ছিলাম না। যদিও পরিষ্কারভাবেই মার্কসের সামাজিক বিপাক-ক্রিয়ার ধারণা তাঁকে ওই দিকেই নিয়ে গেছে। আর তাই,‘মার্কসের ইকোলজি ভাবনা’র ‘উত্তরভাষ’ অংশে, আমি “বস্তুর মুক্ত গতি” নিয়ে আলাপের পন্থা হিসেবে সহজভাবে মার্কসের “দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি” নির্দেশ করেছি। এই পদ্ধতি কীভাবে এপিকিউরাস সহ অন্যান্য বস্তুবাদীদের ঐতিহ্যের অংশ ছিলো এবং হেগেল অধ্যয়নের মধ্যস্থতায় তিনি কীভাবে তাদের কাছ থেকে এই ধারণা গ্রহণ করেছিলেন তাও আমি দেখিয়েছি। জ্ঞানতাত্ত্বিক অ্যাপ্রোচ হিসেবে আমি ইঙ্গিত দিয়েছি, কান্টে মানব চৈতন্যের জন্য ধর্মতত্ত্ব যে ভূমিকা পালন করে, তা অনুসন্ধানমূলকভাবে এর সমান হতে পারে। কিন্তু মার্কস, এঙ্গেলস (এবং লুকাচের) সাথে সম্পর্কের নিরিখে এবং তাদের মাঝে প্রকাশিত হিসেবে, আমার কাজে “তথাকথিত নৈব্যক্তিক বা বিষয়গত দ্বান্দ্বিকতা”র বিস্তৃত সত্তাতাত্ত্বিক প্রশ্নের বেশিরভাগই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
বের্টেল ওলম্যান এবং টনি স্মিথ ২০০৮ সালে একটি বই সম্পাদনা করেন। সেখানে আমি একটা অধ্যায় লিখেছিলাম। এই অধ্যায়টি লেখার আগে আমি বিস্তারিতভাবে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতাকে চিহ্নিত করিনি। (পরে অধ্যায়টি দি ইকোলজিক্যাল রিফ্ট গ্রন্থে যুক্ত হয়) আমি তখনো “লুকাচ সমস্যা”য় আটকে ছিলাম। যদিও পরিণত লুকাচের কারণেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম,বিপাক -ক্রিয়া নিয়ে মার্কসের বাহাস, সমগ্র জ্ঞানতাত্ত্বিক এবং সত্তাতাত্ত্বিক উভয়সংকটের বাইরেই একটি প্রশস্ত পথ প্রদান করেছিলো। (অন্যদিকে আমি বাহাস করেছি, আরেকটা পথ পাওয়া গেছে। মার্কস যাকে বলতেন “সংবেদনশীল নিশ্চয়তার দ্বান্দ্বিকতা”। এটি এপিকিউরাস, ফ্রান্সিস বেকন ও লুডভিগ ফয়েরবাখের বস্তুবাদ তুলে ধরেছিলো। এবং মার্কসের প্রথম দিকের কাজে এই ধারণা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল)। যদিও, আমি হয়তো এক কদম সামনে এগিয়েছি, তবু আমার অ্যাপ্রোচ ছিলো বিভিন্ন দিক থেকেই অপর্যাপ্ত। যেহেতু আমি বিষয়গুলো বুঝতে চেয়েছিলাম, বস্তুতান্ত্রিক দ্বান্দ্বিকতার দার্শনিক সীমাবদ্ধতা ছিলো কঠিন দিকগুলোর একাংশ (এবং একই সময়ে তা ছিলো আরও বড় আকারের বৈজ্ঞানিক সুযোগ)। যেটি কখনোই হেগেলের ভাবতান্ত্রিক দর্শনের মতো চক্রাকার, বদ্ধ ব্যবস্থার হতে পারে না। কিংবা তা অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক ও জানালাহীন মোনাডের সর্বাত্মক একচেটিয়া কোন ব্যবস্থা নয়। পদার্থ জগতের ক্ষেত্রে যেমন ছিলো, ঠিক একইভাবে মার্কসের কাছে দ্বান্দ্বিকতা ছিলো উন্মুক্ত। আবদ্ধ নয়।
‘দি রিটার্ন অব নেচার’ বইয়ে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার প্রশ্ন ছিলো কেন্দ্রীয়। পরিণত লুকাচের অধ্যয়ন ছিলো একটা উপাদান। বিশেষ করে দি ইয়াং হেগেল (১৯৪৮) এবং অন্টোলজি অব সোশ্যাল বিইং (১৯৭৩)। এখানে একটা বড় ফ্যাক্টর ছিলো হেগেলের ভাবনার নির্ধারক নিয়ে লুকাচের বাহাস। এটি আমাকে একটা পন্থা বুঝতে সাহায্য করেছে, যার মাঝে একটা বিবেচনাযোগ্য পরিসরে এঙ্গেলসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ উৎসাহিত হয়েছিল। সেটা হয়েছিলো হেগেলের লজিক-এ সারসত্তার মতবাদ দ্বারা। আরেকটি ব্যাপার আমাকে প্রভাবিত করেছিলো। মার্কসের ইকোলজি’র কাছে ফিরে গেলে,সেটি ছিলো রয় ভাস্করের বৈচারিক বাস্তববাদ। বিশেষ করে তাঁর ‘ডায়ালেক্টিকঃ দি পালস অব ফ্রিডম’ (১৯৯৩)। তবে দি রিটার্ন অব নেচার’(২০২০) প্রকল্পের একদম হৃদপিন্ডে ছিলো এঙ্গেলসের প্রকৃতির দ্বান্দিকতা ( (Dialectics of Nature, ১৯২৫)-এর অনুপুঙ্খ বিচার। (একই সাথে এই বিচারের আওতায় ছিলো লেনিনের রচনাবলী)। এগুলোর গভীরতা ছিলো অকথিত। প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা সমস্যা নিয়ে এঙ্গেলস যেসব চিন্তকদের প্রভাবিত করেছিলেন, তার একটা তালিকা প্রস্তুত করতে এটা আমাকে সমর্থ করে। এঁদের মাঝে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য হলেনঃ নিডহ্যাম, ক্রিস্টোফার কডওয়েল এবং লিন্ডসে। এছাড়া শিল্পে (Art) উইলিয়াম মরিস এবং বিজ্ঞানে জে. ডি. বার্নাল, হ্যালডেন, হগবেন এবং লেভি বস্তুতান্ত্রিক ও দ্বান্দ্বিক বাস্তুতন্ত্রবিদ্যার ক্ষেত্রে শক্তিশালী অন্তর্দৃষ্টির একটি ধরন প্রদান করেন।
বিচ্ছিন্ন করা শ্রমের বিভাগ কীভাবে পুঁজির বিশেষায়িত কাজকারবারে প্রয়োজন অনুযায়ী জ্ঞানের শৃঙ্খলাগত বিভাগ বৃদ্ধি করে, লুকাচ তা উল্লেখ করেছেন। প্রায়োগিক বা অনুশীলনের দর্শন (philosophy of praxis) হিসেবে মার্কসবাদ অন্যান্য বিষয়ের মাঝে সমগ্রতাবাদী প্রকল্প হিসেবে প্রস্তাবিত হয়। তা হয় বিজ্ঞান ও শিল্পের মাঝে, প্রকৃতি ও সমাজের মাঝে পুঁজিবাদ যে অনেক ও বিভিন্নরকম ফাটল বড় করেছে বা আরোপ করেছে তার পুনর্গঠনের লক্ষ্যে। আপনার নতুন বইয়ের একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হলো বাস্তুতন্ত্রে সমান্তরাল অ্যাপ্রোচের অস্তিত্ব এবং শিল্প ও বিজ্ঞানে সমাজতন্ত্র। এই সংযোগগুলো কীভাবে বস্তুবাদী ইকো-সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় অবদান রাখে? বাস্তুতন্ত্র ও বাস্তু-সামাজিক সম্পর্কের আন্তক্রিয়া নিয়ে আমরা যেসব সংকটের মুখোমুখি হই তার পুনর্চিন্তায় এগুলো কীভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারে?
‘দি রিটার্ন অফ নেচার’ বইটি লেখার সময় ‘নিউজ ফ্রম নোহোয়ার’ এর একটা বিবৃতি সবসময় আমার মনে ছিলো। মরিস সেখানে বলেছেন, বিজ্ঞান ও শিল্পের দুটি অলঙ্ঘনীয় রূপ আছে। বাস্তুতন্ত্র নিয়ে মনোযোগী সব মার্কসবাদী চিন্তকই বিভিন্ন পন্থায় এই সীমাগুলো পার হয়ে গেছেন। কাজেই, সমান্তরালভাবে বিকশিত যে কোন পরম্পরাগত-ঐতিহাসিক খতিয়ানগুলো পরখ করতে হয়েছিল। স্পষ্টতই, বিজ্ঞান ও প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার সাথে এর সম্পর্ক হিসেবে বাস্তুতন্ত্রের বিশ্লেষণগত উন্নতি প্রধানত বিবর্ধিত হয়েছে বৈজ্ঞানিক ধারার ভেতর দিয়ে। কিন্তু একে সমাজতান্ত্রিক নন্দনভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন করা ছিল খুব কঠিন।
কাজেই, ল্যাংকেস্টারের বন্ধুত্ব ছিলো মরিস এবং প্রাক-রাফায়েলপন্থীদের সঙ্গে। হগবেন তাঁর সমাজতান্ত্রিক প্রেরণা প্রধানত নিয়েছিলেন মরিসের কাছ থেকে। মরিসের কাজে আমরা যে বিশ্লেষণ খুঁজে পাব তা একটি ধারণার মাঝে প্রোথিত। ধারণাটি হলো, সকল বিচ্ছিন্নতাহীন কাজ শিল্প (Art) ধারণ করে। মরিস এই ধারণা নিয়েছিলেন জন রাস্কিন থেকে। তবে এই ধারণায় তিনি গভীরতা দিয়েছেন মার্কস হয়ে। মরিস অবশ্য সকল শিল্পের সামাজিক চরিত্রের প্রত্যয় পুনরুৎপাদন করেছিলেন মার্কস থেকে স্বাধীনভাবে। বাস্তুতান্ত্রিক পর্যালোচনায় কডওয়েল দুর্দান্তভাবে উভয়ত নন্দনতাত্ত্বিক এবং বৈজ্ঞানিক ধারা আত্মস্থ করেছিলেন। তাঁর নন্দনতাত্ত্বিক ভাবনা অঙ্কিত হয়েছে ‘মিমেসিস’-এর ধারণা থেকে যার ভিত্তি ছিলো এরিস্টটলে। এবং ক্যামব্রিজ রিচুয়ালিস্টদের র্যাডিকেল ব্রিটিশ ধ্রুপদী ঐতিহ্যে। এই ঐতিহ্য তুলে ধরেছিলেন জেন হ্যারিসন। কডওয়েল পরে বস্তুতান্ত্রিক দ্বান্দ্বিকতার সাথে একে মিলিয়েছেন। কডওয়েলের শক্তিশালী অ্যাপ্রোচ চালিত হয়েছে কবিতা ও নাটকের উৎস নিয়ে জর্জ থমসনের অসামান্য বিশ্লেষণে।
বাম ঘরানায় এই সমগ্র নন্দনতাত্ত্বিক -বাস্তুতান্ত্রিক বিকাশ চূড়া ছুয়েছে অস্ট্রেলিয় মার্কসবাদী জ্যাক লিন্ডসের কাজে। লিন্ডসে তাঁর ব্যপক মাত্রার ধ্রুপদী, সাহিত্যিক, দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক অধ্যয়নে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতার প্রত্যয় সামনে এনেছেন। তা এনেছেন উভয়ত নন্দনতত্ত্ব এবং বিজ্ঞান থেকে একত্রে। এটা মোটেই কোন দুর্ঘটনা নয় যে – লুকাচ, মেসজারোস ও থমসনের মতো চিন্তকরা লিন্ডসের কাজকে উচ্চতর মর্যাদায় দেখেছেন। তবে লিন্ডসের কাজ যথেষ্টরূপে মূল্যায়িত হয়নি। তার কারণ সম্ভবত লিন্ডসের ১৭০ খন্ড রচনা সঙ্কলনের গুরুভার। প্রাচীন ধ্রুপদী রচনা থেকে নিয়ে সাহিত্য, কবিতা, ইতিহাস এবং বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে তাঁর কাজের বিস্তৃতি সহজভাবে বললে অতি ভয়াবহ।
আপনার নতুন বইয়ে প্রধান চরিত্র এঙ্গেলস। বহুদিন ধরেই নির্দিষ্ট মার্কসবাদের মাঝে, মার্কসের চিন্তাকে স্থুল করার জন্য এঙ্গেলসকে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু পুঁজিবাদের বাস্তুতান্ত্রিক এবং সামাজিক পর্যালোচনার জন্য আপনি এঙ্গেলসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জটিলতা ও প্রাসঙ্গিকতার কথা বলেছেন। ক্রমাগতভাবে চিনে নেয়া হলেও আপনি দেখবেন, মার্কস ও এঙ্গেলসের কাজের বন্ধন সম্পর্কে এঙ্গেলস এখনো অবজ্ঞার শিকার। এটা কীভাবে ঘটছে? মার্কসীয় বাস্তুতান্ত্রিক চিন্তার দৃষ্টিকোণ থেকে এই অবস্থানগুলো আমরা কীভাবে মোকাবিলা করতে পারি?
আমার মনে আছে,ডেভিড ম্যাকলিলেনের বক্তব্য শুনেছিলাম ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে। সেটা মার্কসের জীবন নিয়ে তাঁর লেখার খুব বেশি পরে নয়। এঙ্গেলসের বিরুদ্ধে তাঁর দুর্দান্ত দীর্ঘ বক্তৃতায় আমি সম্পূর্ণরুপে হতচকিত হয়ে গেছিলাম। এঙ্গেলসের বিরুদ্ধে বলাটাই ছিলো তাঁর বক্তৃতার মূল বিষয়। এঙ্গেলসের বিরুদ্ধে আক্রমণে এই বক্তৃতাটা ছিলো আমার প্রথম বাস্তব অভিজ্ঞতা। শীতল যুদ্ধ চলাকালে এই বক্তৃতা অনেকভাবেই পশ্চিমা মার্কসবাদী ঐতিহ্যকে সংজ্ঞায়িত করে। আর তা অব্যাহত থাকে শীতল যুদ্ধের পরেও। আলভিন গৌল্ডনার একে বলতেন “দুই মার্কসবাদ”। তবে “দুই মার্কসবাদের” চাইতে চিন্তক হিসেবে এঙ্গেলস সম্পর্কে এর সবকিছু ছিলো আরও নিচের দিকের। একটা বিবেচনাযোগ্য মাত্রায়, পশ্চিমা মার্কসবাদ ও একাডেমির জগত মার্কসকে তাদের নিজেদের বলে দাবী করলো। একজন নাগরিক চিন্তাবিদ হিসেবে দাবী করলো। কিন্তু এদের বেশিরভাগই আন্দাজে এঙ্গেলসকে অতি “অমার্জিত” হিসেবে বর্জন করলো। এঙ্গেলসের ভূমিকাকে দেখা হলো বিনষ্টকারী হিসেবে। যেন তিনি এমন এক “মার্কসবাদ” সৃষ্টি করেছেন যার সাথে মার্কসের কোন সম্পর্ক নেই। আর এভাবেই তিনি নাকি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ছাড়িয়ে স্ট্যালিন অবধি, অর্থনীতিবাদ, নির্ধারণবাদ, বিজ্ঞানবাদ, স্থুল দার্শনিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিতের জন্য দায়ী।
কাজেই, আমাদের হয়তো এতে বিস্মিত হওয়া উচিৎ নয় যে, এঙ্গেলসের প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা নিয়ে শত শত বা হাজার হাজার নিবন্ধ লেখা হয়েছে। আর সেখান থেকে আমাদের শেখার আছে খুব সামান্যই। কারণ, তারা এঙ্গেলসের দৃষ্টিভঙ্গি বিচার করেছে হয় পুরানো প্রাতিষ্ঠানিক মার্কসবাদ বা একটা মতবাদিক পন্থায়, নয়তো পশ্চিমা মার্কসবাদী ঐতিহ্যে এন্টি-ড্যুরিং (১৮৭৭) অথবা কখনো কখনো প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা’ থেকে কয়েকটা লাইনের উদ্ধৃতি হিসেবে, যাতে করে মার্কসবাদে এঙ্গেলসের স্থুলকরণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। টেরেল কার্ভারের মতো অন্যান্য লেখকরা, যারা এঙ্গেলসের ওপর ব্যপকভাবে লিখেছেন, তারা এঙ্গেলসের কাজ বোঝার জন্য নিজেদের নিয়োজিত করেননি। তারা বরং মার্কসের কাজ থেকে এঙ্গেলসের কাজকে পদ্ধতিগতভাবে সংকটাপন্ন করেছেন।
আমার মনে আছে, আমি যখন কার্ল পাডোভারের ‘কার্ল মার্কসের চিঠিপত্র’ দেখছিলাম, আমি ভাবছিলাম, এই বইটা মার্কসের নিজের কথা দিয়ে ভরা হলেও, এত শূন্যগর্ভ লাগছে কেন। আমি এর কারণ বুঝলাম। এই বইয়ের প্রায় সবগুলো চিঠি ছিলো এঙ্গেলসের প্রতি, আর সেই বই থেকে এঙ্গেলসকেই বাদ দেয়া হয়েছিলো! কাজেই, এটা ছিলো একপাক্ষিক আলাপ। যেন শুধু মার্কসই সেখানে আমলযোগ্য ব্যাপার এবং মার্কস নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। মার্কস-এঙ্গেলস যোগাযোগ অবশ্যই দ্বিপাক্ষিক আলাপ আলোচনা। এই দুজন বিরাট চিন্তকের মাঝে নিরবচ্ছিন্ন সংলাপ হিসেবে তা ছিলো দুর্দান্ত। মার্কস-এঙ্গেলস দুজনে মিলেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মার্কসীয় বাস্তুতন্ত্র প্রসঙ্গে এঙ্গেলস অপরিহার্য। কেননা, এক্ষেত্রে মার্কসের বিশ্লেষণ যেমন দুর্দান্ত ছিলো, এঙ্গেলসের শ্রেণি-ভিত্তিক [রোগবিস্তারবিদ্যা বা] মহামারীবিদ্যার বিপুল অবদানও আমরা এড়ানোর চেষ্টা করতে পারি না (মহামারীবিদ্যা ছিলো তাঁর কন্ডিশন অফ দি ওয়ার্কিং ক্লাস ইন ইংল্যান্ড (১৮৪৫)-এর প্রধান বিষয়)। আবির্ভাব ও প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা, প্রকৃতিকে জয় করার পর্যালোচনা কিংবা মানুষের বিবর্তনগত বিকাশ বোঝার ক্ষেত্রেও আমরা তাঁকে এড়াতে পারি না। ‘এন্টি-ড্যুরিং’ বইয়ে এঙ্গেলস যেভাবে ডারউইন আত্মস্থ করেছেন, তা ছিলো বিবর্তনবাদী বাস্তুতন্ত্র বিকাশে মৌলিক। প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা বইয়ে বিকশিত আবির্ভাবতান্ত্রিক বস্তুবাদ (emergentist materialism) ছিলো বিচারমূলক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বিষয়।