ফ্রেডরিখ নীটশের “ভবচক্রের দর্শন”

কার্ল লুভিথ


সাধারণত লুকানোর জন্য সবচাইতে ভালো জায়গা হচ্ছে প্রকাশ্য দিবালোক। হাইডেগার একদা এটাকে বলেছিলেন, “সুনিশ্চিতের (পৃথকভাবে) চিহ্নিতকরণহীনতা”। আমরা এই উস্কানিমূলক ইশারা দিচ্ছি এই কারণে যে বহু দশক ধরে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারিনি যে, ঠিক কি কারণে লুভিথের অতিগুরুত্বপূর্ণ নীটশে পাঠ অর্থাৎ নীটশের একইয়ের নিরন্তর ফিরে আসার দর্শন (Nietzsche's Philosophy of the Eternal Recurrence of the Same) ইংরেজিতে অনূদিত হয়নি। অথচ, এই দশকগুলির মধ্যেই অন্তর্ভেদী নীটশে পাঠ থেকে শুরু করে হাস্যকর পাঠ পর্যন্ত কার্যত সকল লেখা ইংরেজিতে অনূদিত ও আলোচিত হয়েছে। লুভিথের (Nietzsche's Philosophy of the Eternal Recurrence of the Same) ইংরেজিতে অনূদিত হয়নি। অথচ, এই দশকগুলির মধ্যেই অন্তর্ভেদী নীটশে পাঠ থেকে শুরু করে হাস্যকর পাঠ পর্যন্ত কার্যত সকল লেখা ইংরেজিতে অনূদিত ও আলোচিত হয়েছে। লুভিথের নীটশে অপাঙক্তেয় রয়ে গেছে। এর কারণ আমাদের কাছে এখন সুনিশ্চিত। এটি আলাদা করে টের পাওয়া যায়না। এইটা গোটাটাই রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে। লুভিথ ছিলেন ইহূদী এবং তিনি নাৎসি জার্মানি থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসিত ছিলেন। জার্মানিতে যখন জাতীয় সমাজতন্ত্রের আধিপত্য শুরু হচ্ছে তার গোঁড়ার দিক থেকে এটার ব্যাপারে তাঁর সুস্পষ্ট বোঝাপড়া ছিল। তিনি ছিলেন হাইডেগারের খুব কাছের ছাত্র যিনি কিনা হাইডেগারের অপ্রকাশিত নীটশে পাঠ ও অন্যান্য লেখালেখির মধ্যে নাৎসিবাদের সাথে এক নিবিড় যোগ আঁচ করতে পেরেছিলেন। ইংরেজি ভাষাভাষি বিদ্যার দুনিয়ায় তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ঠাওর করতে অর্ধশত বছর লেগে গেছে।


জে. হার্ভে লোম্যাক্স এই ভল্যিউমের ভূমিকায় যেমনটা তুলে ধরছেন যে Die Runde প্রেসের স্বত্ত্বাধিকারী, ১৯৩৫ সালে হিটলারের জার্মানির রাজধানীতে লুভিথের নীটশের একইয়ের নিরন্তর ফিরে আসার দর্শন ছাপাতে গিয়ে যথেষ্ট সাহস দেখিয়েছেন। ১৯৩৫ আসতে আসতে Kantstudien-সহ নানান প্রকাশনা ও জার্নাল লুভিথের লেখা ছাপাতে অস্বীকৃতি জানাতে শুরু করে। কার্যত, নীটশের একইয়ের নিরন্তর ফিরে আসার দর্শন বইয়ের ১৯৩৫ সালের সংস্করণে পরিশিষ্টের পুরোটা ছাপানো সম্ভব হয়নি, কারণ এতে ১২ টি বুক রিভিয়্যু ছিলো। এই বারোটা রিভিয়্যু রচয়িতাকে তীব্র আক্রমণ করে লেখা। এর মধ্যে আলফ্রেড বাম্লার নামের এক তৃতীয় শ্রেণীর নাৎসি পার্টির ঠিকাদারের রিভিয়্যুও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই তৃতীয় সারির বুদ্ধিজীবির ১৯৩১ সালের প্রকাশনা নীটশেঃ দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ বইটি পার্টির প্রপাগান্ডা যন্ত্র হয়ে ওঠে। একই সাথে বাম্লারকে নাৎসিদের নীটশের “আনুষ্ঠানিক” ভাষ্যকার বানিয়ে তোলে। লুভিথের ক্ল্যাসিক রচনাটি যখন লেখা হচ্ছে তখনকার জার্মানির অবস্থা আরো ভালোভাবে বুঝতে হলে আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে লুভিথ যখন পান্ডুলিপি Die Runde এর স্বত্ত্বাধিকারীর কাছে জমা দেন, তখন নীটশের বোন এলিজাবেথ ফর্স্টার-নীটশে জীবিত ছিলেন। খুব কম সংখ্যক জার্মানই ছিলেন যারা এলিজাবেথের হিটলার ও নাৎসি পার্টি প্রীতির বিরোধিতা করেছে। এবং নীটশের লেখালেখিকে নাৎসি ভাবাদর্শের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য আর কেউই তাঁর মত এত নিরলসভাবে কাজ করেনি।


কেন প্রাথমিকভাবে জার্মানিতে লুভিথের বই ততটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, তার একটা ব্যখ্যা মোটামুটি এভাবে করা যায়। কিন্তু এর কোনোটাই, কেন ইংরেজি ভাষাভাষি জগতে লুভিথের নীটশে সংক্রান্ত বইকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সেটার ব্যাখ্যা দেয়না। অথচ নাৎসি জার্মানিতে কার্যত যিনি নিগৃহীত হয়েছেন তাঁর লেখা আমাদেরকে আরো বেশি আকৃষ্ট করার কথা ছিল না?


এই অসামঞ্জস্যতার নানান সম্ভাব্য ও তর্কসাপেক্ষ ব্যাখ্যা রয়েছে। যেটা এমনিতে আন্দাজ করা যায় তা হচ্ছে, লুভিথের বই ইতোমধ্যে অনূদিত নীটশে অধ্যয়নের জাত সমতূল্য না। উদাহরণস্বরূপ, কার্ল ইয়েস্পার্সের নীটশে ও ক্রিশ্চিয়ানিটি (১৯৩৮, অনূদিত ১৯৬১), নীটশে (১৯৩৬, অনূদিত ১৯৬৫), জর্জ জিমেলের শোপেনহাওয়ার ও নীটশে (১৯০৭, অনূদিত ১৯৮৬) অথবা হ্যান্স ফাইহিঙ্গারের “যেন”র দর্শন (১৯১১, The philosophy of ‘As If’, অনূদিত ১৯২৪)। এগুলি অনেক অনুবাদের মধ্যে গুটি কয়েকটি মাত্র। এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সমাধান করার ক্ষেত্রে পূর্বতঃসিদ্ধ কোন রাস্তা নেই।প্রত্যেক রচয়িতার নীটশের ওপরে রচিত টীকা-টিপ্পনীর সাথে লুভিথের এই ভল্যিউমের তুলনা প্রত্যেক পাঠিকাকে অবশ্যই করতে হবে ও তার পরে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।


আমার অনুমান ভীষণভাবে আলাদা প্রকৃতির। তাঁর ইহূদী পরম্পরা জার্মানিতে নীটশের একইয়ের নিরন্তর ফিরে আসার দর্শনের মত নিবিড় পাঠের ক্ষেত্রে তাঁর পরাজিত অবস্থার পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল। হাইডেগারের সাথে তার সুবিদিত মতভিন্নতা, বিশেষ করে নীটশে পাঠের ক্ষেত্রে তাঁদের ফারাক, যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর পরাজিত অবস্থানের ক্ষেত্রে একই রকম ভূমিকা রেখেছে। ইংরেজি ভাষাভাষী দর্শনের অধ্যাপক, যাদেরকে (ভুলভাবে) “কন্টিনেন্টাল দার্শনিক” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তাঁদের মধ্যে ১৯৬০ সাল থেকে আজ অব্দি হাইডেগারের তুমুল প্রভাব বিরাজমন রয়েছে। এটা বলাবাহুল্য হবেনা যে Society for Phenomenology and Existential Philosophy’র সদস্যদের কাছে হাইডেগার আমাদের সময়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক হিসেবে বহুল বিবেচিত। আমরা যারা হাইডেগারের নাৎসি সংশ্লিষ্টতাঁর পুরনো বিতর্কের সমকালীন পুনঃজাগরনের সাক্ষী হচ্ছি তাঁদের পক্ষে আমেরিকান হাইডেগারিয়ানদের ইর্ষাপরায়ণতা ও হাইডেগার ভক্তির বিষয়ে অত্যুক্তি করা কঠিন। এই পরিস্থিতির মধ্যে, লুভিথের নীটশে পাঠ খুবই সীমিত আগ্রহের উদ্রেক করেছে। এবং প্রায়শই এটা ছিল অমর্মস্পর্শী।


আমরা তাহলে নীটশের একইয়ের নিরন্তর ফিরে আসার দর্শন কেন পড়বো? ১৯৩০ সালের আগ পর্যন্ত জার্মানি ও এর বাইরের দুনিয়ায় নীটশেকে মূলত সাহিত্যিক হিসেবেই পড়া হত। স্টেফান জর্জ ও তাঁর কবি মহল নীটশেকে নবীর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাকিরা তাকে সংস্কৃতির সমালোচক হিসেবে পড়েছেন। তাঁর প্রাথমিক, দীর্ঘস্থায়ী ও সবচাইতে বহুল প্রচলিত প্রয়োগ ছিল সাহিত্যিয়ঃ ফ্রান্সে আন্দ্রে গিডে; জার্মানিতে গটফ্রিড বেন, রবার্ট মুজিল ও হারমান হেস; রাশিয়ান সিম্বলিস্ট ভ্যায়াশ্লাভ ইভানভ, আন্দ্রেই বেলিই, ও ভালেরি ব্রুয়োসভ; ইংল্যান্ডে উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস ও জর্জ বার্নার্ড শ (১৯০৩ সালে লন্ডনের মঞ্চে যার মানব ও অতিমানবের প্রথম মঞ্চায়ন ঘটে); এবং সুইডেনে অগাস্ট স্ট্রাইন্ডবার্গ। এর বাইরেও জর্জ ব্র্যান্ডেস ও গ্যাব্রিয়েল ডি’আনুঞ্জিও থেকে শুরু করে গুস্তাভ ম্যাহলার, ফ্রেড্রিক ডিলিউস ও রিচার্ড স্ট্রসের মিউজিকাল ট্রিবিউট পর্যন্ত নিশ্চয়ই নীটশের অন্যান্য প্রয়োগও ঘটেছিল।


নীটশেকে বিশেষ করে দার্শনিক হিসেবে বিবেচনা করা হলেও, হয় তাকে জর্জ জিমেল, লুডভিগ ক্লেজেস এবং হেনরি বার্গসোঁর সাথে গুলিয়ে ফেলেছে অথবা অন্যত্র তাঁর সমসাময়িকরা তাকে পুরোদস্তুর খারিজ করে দিয়েছেন- উদাহরণস্বরূপ, যেমনটা করেছেন উইলহেল্ম ডিলথে। হাইডেগারের ১৯৩৬-৪০ সালের মধ্যে দেয়া বক্তৃতা (যা পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়) বাদ দিলে কেবল ইয়েস্পার্স ও লুভিথই সফলভাবে নীটশেকে প্রথমত এবং মূলত দার্শনিক হিসেবে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছিলেন।


থিসিস ও ডকট্রিনের কোন জমাট বাঁধা শরীর নয়, বরং ইয়েস্পার্স নীটশের লেখালেখিকে দার্শনিক তৎপরতা হিসেবেই দেখেছেন। ইয়েস্পার্স তুলে ধরছেন যে, এই লেখালেখি এমন এক অস্তিবাদী প্রদর্শন যা সকল অনুমিত নিশ্চয়তাকে এক নিরন্তর প্রতিবিম্বের ঘূর্ণিপাকে ঠেলে নিয়ে আসা যায়। এ এমন এক ঘূর্ণিপাক যা থেকে কোন অনড় থিসিস, শিক্ষণ অথবা ডকট্রিন প্রশ্নবানে বিদ্ধ না হয়ে টিকতে পারেনা। হাইডেগার ঠিক এর উল্টোটা বলেছেন। তাঁর মতে, নীটশে ছিলেন পশ্চিমের শেষ অধিবিদ্যক। তিনি ছিলেন এক উলটানো প্লেটোনিস্ট(reverse Platonist) যার লেখালেখিতে প্লেটোনিজমের শেষ পরিণতিগুলি নিঃশেষিত হয়। এই পরিণতিগুলি হচ্ছে, মূলত সত্তাকে ভুলে থাকা ও প্লেটো হয়ে “সত্যের” (সত্তার নিজের মধ্যে যে আত্মপ্রকাশ তা থেকে ঘটনাপ্রবাহের দশাসমূহের সাথে বিশ্বাসের যে সম্বন্ধ পর্যন্ত) যে রূপান্তর তার পরিণতি। হাইডেগারের দর্শনের অধি-ইতিহাসে, নিটশের “Will to power” সত্তার (যার অস্তিত্ব “একইয়ের নিরন্তর ফিরে আসায়” রূপ নেয়) সারবত্ত্বায় পরিণত হয়। এরও আগেরকার কান্টীয় শব্দকোষে “Will to power” কে নউমেনাল বাস্তবতা (Noumenal reality), বস্তুর স্বরূপ (thing in itself) হিসেবে বিবেচনা করা যেত; “নিরন্তর ফিরে আসা”কে বিবেচনা করা যেত নিছক Appearances বা প্রতিভাস (প্রপঞ্চ) হিসেবে।


ইয়েস্পার্স ও হাইডেগারের সাথে যে জায়গায় কার্ল লুভিথের নীটশের একইয়ের নিরন্তর ফিরে আসার দর্শন এক কাতারে দাঁড়িয়ে থাকে তা হচ্ছে যে তারা প্রত্যেকে নীটশেকে সাহিত্যিয় পরিমন্ডল নয়, বরং দার্শনিক পরিমন্ডলে রেখে পড়তে চান। যাইহোক, তাঁদের মধ্যেকার মিল এইখানেই শেষ হয়। বইয়ের আস্তিনে অর্থাৎ শিরোনামেই লুভিথের এই অসাধারণ বইয়ের মূল বক্তব্য হাজির রয়েছেঃ নীটশে একজন দার্শনিক এবং তিনি “একইয়ের নিরন্তর ফিরে আসার দার্শনিক”। উপরন্তু, লুভিথ নীটশের দর্শনের ঘরানাকে বইয়ের শিরোনামে ও প্রথম অধ্যায়ের উপশিরোনামে (নীটশের দর্শনঃ এফোরিজমের একটি পদ্ধতি) বসিয়েছে। নীটশের “সিস্টেম ইন এফোরজিমসের” ভাবনাকে সুসংগঠিত করার ক্ষেত্রে নিরন্তর ফিরে আসার ডকট্রিনকে কেন্দ্রে বসানোর মাধ্যমে লুভিথ স্পষ্টত ও দারুণভাবে, “Will to power” ও নিরন্তর ফিরে আসার ডকট্রিন এই দুটিকে সহগামী হিসেবে গড়ে তুলবার হাইডেগারের যে প্রচেষ্টা তা থেকে সড়ে যান। একই সাথে নীটশের এফোরিজমের মধ্যে একটা সুসংহত দার্শনিক অবস্থান থাকার সম্ভাবনাকে এড়িয়ে যাওয়ার ইয়েস্পার্সের যে প্রবণতা তা থেকেও লুভিথ নিজেকে আলাদা করেন।


পাঠিকা যেমনটা দেখতে পাবেন, নীটশের নিরন্তর ফিরে আসার ডকট্রিনের নিজের মধ্যে সুপ্তাবস্থায় যে কূটাভাস(paradox) আছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন, সেটার প্রচুর ব্যখ্যা নিয়ে লুভিথ হাজির হন। লুভিথ বলছেন, একদিকে, নিরন্তর ফিরে আসা একটি বিশ্বতত্ত্বীয় মতবাদ যা হেরাক্লিটাস থেকে শুরু হয়ে ইতিহাসে অজস্রবার এসেছে। যাইহোক এটা তারই ইংগিত দেয় যে, জগতের একটা সীমিত সংখ্যার দশাসমূহ তাদের সকল প্রকারের নির্মাণে সময়ের মধ্যে প্রস্ফুটিত হতে বাধ্য— যেটা আবার অসীম, সসীম নয়। অতএব, যেহেতু জগতের সম্ভাব্য দশাসমূহ সসীম এবং সময় অসীম, সেহেতু জগতের যেকোন দশাকে পুনর্বার ফিরে আসতেই হবে। অধিকন্তুঃ এই দশাসমূহকে ফিরে আসতে হবে নিরন্তরঃ একইয়ের নিরন্তর ফিরে আসা(Eternal recurrence of the Same)। যাই হোক, একই সাথে, নীটশের এফোরিজম নির্দেশনামূলক আহ্বানও করে। অর্থাৎ, এমন এক জীবন যাপনের আহ্বান যে তুমি তোমার জীবনের নিরন্তর ফিরে আসাকে আনন্দের সাথে আকাঙ্ক্ষা করবে। এই ফিরে আসা হবে কোন পরিবর্তন অথবা পরিবর্ধন ছাড়াই। এই ফিরে আসা হবে বারংবার।


প্রতি মুহুর্তে বেঁচে থাকার যে নৈতিক নির্দেশনা (এমনভাবে যাতে করে তুমি এই বেঁচে থাকার নিরন্তর ফিরে আসাকে আকাঙ্ক্ষা করতে পার) তার সাথে এই বিশ্বতত্ত্বীয় সংস্করণকে, যেটাকে লুভিথ মাঝেমধ্যে “একটি ভৌত অধিবিদ্যা” হিসেবে চিহ্নিত করেন, খালিচোখে বেখাপ্পা লাগতে পারে। বিশ্বতত্ত্বীয় বিষয়টাকে ধরে নিলে, যেই ঘটনাপ্রবাহের দশা আকাঙ্ক্ষা করা হোক বা না হোক তা যদি ঘটবেই, তবে তাকে আকাঙ্ক্ষা করা সম্ভব কিভাবে? একইয়ের নিরন্তর ফিরে আসার ডকট্রিনের মধ্যে একধরণের নিয়তিবাদ কি নিহিত আছে-না যা যেকোন ধরণের নির্দেশনাকে অক্ষম প্রতিয়মান করে? এমনকি প্রতিমুহুর্তের নিরন্তর ফিরে আসাকে আনন্দের সাথে আকাঙ্ক্ষা করে বেঁচে থাকা, এটাকে প্রত্যাখ্যান করা বা এড়িয়ে যাওয়া, এ সবই পূর্বনির্ধারিত মনে হবে। যা ঘটবেই তাকে কেউ আকাঙ্ক্ষা কিভাবে করবে?


লুভিথ বলছেন, এই কূটাভাস নীটশের কেন্দ্রীয় ও একসূতায় গাঁথার যে নিরন্তর ফিরে আসার ডকট্রিন তাকে “তুলনার অযোগ্য খন্ডে খন্ডে” ভেঙ্গে ফেলে। লুভিথের মতে, “ভৌত অধিবিদ্যা”কে “নিরিশ্বরবাদী রিলিজিয়নের” সাথে এক রশিতে বাঁধার নীটশের যে প্রচেষ্টা, এটি তার অবশ্যম্ভাব্য পরিণতি। নীটশেতে এই দোটানা যা লুভিথ শনাক্ত করেন তা নীটশের নিজেরই একটি নোটে পাওয়া যায়। এটি তিনি পরবর্তীতে প্রকাশ করতে চাননিঃ “এমনভাবে বাঁচতে হবে যাতে তুমি আবার বাঁচতে চাইবেই— যাইহোক তুমি আবার বাঁচবেই!” শেষের সংযুক্তি (“you will [live] anyway!”) আমাদের যে কাজ দেয়া হয়েছে তাকে গুরুত্বহীন করে তোলে। কারণ কাজটাকে গ্রহণ করা বা প্রত্যাখ্যান করার বেছে নেয়ার সিদ্ধান্তসহ, শেষের সংযুক্তি আমাদেরকে সকল পরিণতির সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করে।


আমার সাথে লুভিথের প্রথম পরিচয় ঘটে যখন আমি স্নাতক পড়ছি। লুভিথের ইতিহাসে মানে বা অর্থ (Meaning in History) গ্রন্থটি পড়ার মধ্যদিয়ে এই পরিচয় ঘটে। ১৯৬০ এর দশকে হাইডেগার ও নীটশের ওপরে আমার পিএইচডি থিসিস লেখার আগ পর্যন্ত আমি লুভিথের নীটশের একইয়ের নিরন্তর ফিরে আসার দর্শন গ্রন্থের সাথে পরিচিত ছিলাম না। এই বইয়ের মূল অনুসিদ্ধান্তগুলি প্রত্যাখ্যান করলেও আমি অনেক আগ্রহ ও উদ্দীপনার সাথে আমি বইটি পড়ি। অতএব আমার ওপরে এই বইয়ের অনেক প্রভাব আছে এটা ভাবলে খুব ভুল ভাবা হবে।


অথবা, আমার এমনটা মনে হয়েছিল।


অতি সম্প্রতি, তিন দশক পরে, আমি এখন টের পাচ্ছি যে নীটশের ওপরে লেখা আমার বই অথবা আর্টিকেলে আমি অচেতন ভাবে আসলে লুভিথের বইয়ের সাথে কথোপকথন চালিয়েছি। উদাহরণস্বরূপ, নীটশের ওপরে আমার প্রথম বই যেটি নিরন্তর ফিরে আসার ডকট্রিনকে “অস্তিবাদী নির্দেশনা” হিসেবে পাঠ করে, সেই বইটি মূলত লুভিথের বিছিয়ে দেয়া জমিনেই ক্রিয়াশীল হয়। আর নয়তো কেন আমি সব বাদ দিয়ে নিরন্তর ফিরে আসার ডকট্রিনকে নীটশের লেখালেখির একসূত্রে গাঁথার জাল হিসেবে বিবেচনা করব (শাস্ত্রগত দোহাইগুলি বাদ দিয়ে অবশ্যই) ? নিরন্তর ফিরে আসার ডকট্রিনকে বিশ্বতত্ত্বীয় হাইপোথিসিস হিসেবে পড়াটা যে ভুল, সেটা উন্মোচন করার আমার পূর্বেকার যে চেষ্টা তাতে এই ব্যপারটা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।


.........


এখন টের পাই, নানান উপায়ে আমি আজও লুভিথের সাথে কথা চালিয়ে যাচ্ছি।


______________

বার্ন্ড ম্যাগনাস

বিগ বেয়ার লেক, ক্যালিফোর্নিয়া

৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৬




হদিস— Nietzsche's Philosophy of the Eternal Recurrence of the Same গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদে সংযুক্ত বার্ন্ড ম্যাগনাস লিখিত মুখবন্ধ।


প্রথম প্রকাশঃ ৪ঠা জানুয়ারি, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ৪ঠা জানুয়ারি, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/1632546020261471/