দর্শন প্রসঙ্গে

জিল দেল্যুজের সাক্ষাৎকার


[জেনেট কলোম্বেলের নেয়া দেল্যুজের এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল La Quinzaine litteraire জার্নালের ৬৮তম সংখ্যায়। তখন সবেমাত্র দেল্যুজের দুটি বই একই বছরে অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে বের হয়েছে। দেল্যুজের আরো কিছু সাক্ষাৎকার ও রচনা পরবর্তীতে অনূদিত হলে এসব অনুবাদগুলো আরো বেশি বোধগম্য হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। দেল্যুজের এই সাক্ষাৎকারটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন আবদুল্লাহ আল মামুন। আবদুল্লাহ আল মামুন পেশায় শিক্ষক, ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান।]



ইতিমধ্যে আপনার দুটো বই বেরিয়েছে— ফারাক ও পুনরাবৃত্তি (Difference and Repetition, ১৯৬৮) এবং স্পিনোজা ও অভিব্যক্তির সমস্যা (Spinoza and the problems of Expression, ১৯৬৮)। খুব শীঘ্রই আরেকটা বই আসতে যাচ্ছে, বোধের যুক্তি (Logic of Sense)। আমার প্রশ্ন হচ্ছে এই বইগুলোর বক্তা কে? বইগুলোতে কে বলে?


যখন আমরা লিখি, তখন আমরা অন্য আরেকজন হয়ে লিখি। এবং এটা এক ভিন্ন সত্তা, যা আমাদের মারফত কথা বলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ক্ল্যাসিক্যাল বা ধ্রুপদী যুগে ব্যক্তি নিজেই কথা বলত। ধ্রুপদী জগতটাতো পুরোই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের উপর ভর দিয়ে গড়ে উঠা। এই ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার সত্তা বা being এর ন্যায় বিস্তৃত (উদাহরণস্বরূপ আমরা আল্লাহর স্বতন্ত্র সার্বভৌম সত্তার কথা ভাবতে পারি)। আবার, রোমান্টিক যুগে কিন্তু কথা বলতো মানুষ। ব্যাপারটা কিন্তু ব্যক্তির চাইতে পুরোই ভিন্ন। মানুষকে সংজ্ঞায়িত করতে হচ্ছে রেপ্রিজেন্টেশেন এর সমান্তরালে। ভাষা এবং জীবনের নতুন মূল্যবোধ আবিষ্কৃত হয়েছিল সে সময়। ব্যক্তি বলুন মানুষ বলুন কেউই আজ স্বতঃস্ফূর্ত নয়। এবং শুধুমাত্র অজানা শক্তির কারণেই যে এই স্বতঃস্ফূর্ততা হারিয়ে গেছে তা নয়। দীর্ঘ সময় ধরে আমরা “মানুষ” এবং “ব্যক্তি” এই দুই বিকল্পের মাঝে ঝুলে ছিলাম। আমাদের বোঝানো হয়েছে এই দুইয়ের একটি বেছে না নিলে, তুমি নামহীন বিবর্ণ সাগরে হারিয়ে যাবে। যাইহোক, বর্তমানে আমরা pre-individual, impersonal singularity-র জগত আবিষ্কার করছি। ব্যক্তি, মানুষ, সমতার সমুদ্র ইত্যাদির পর্যায়ে নামিয়ে এনে pre-individual এবং impersonal singularity মাপা সম্ভব নয়। সিঙ্গুলারিটি বলে যা বোঝানো হচ্ছে তা ভ্রাম্যমাণ, ভাঙ্গতে পারে, চুরি করে পালাতে পারে, আগপিছ করে নিজেকে বদলে নিতে পারে, নৈরাজ্যের রাজপুত্রের ন্যায় যাযাবর ভূমি দখল করে রাখতে পারে। সীমানায় আবদ্ধ স্থির এবং গদিনশীন ব্যক্তির মাঝে ফারাক করা এবং খোলা জায়গায় Singularities-এর মাঝে বিভাজন রেখা টানার মাঝে বিস্তর ফারাক। কবি লরেন্স ফালেঙ্গারি (Ferlinghetti) ফোর্থ-পারসন সিঙ্গুলারের (একবচন-চতুর্থ পুরুষ) কথা বলেছেন। আমরাও সেই একবচন আর চতুর্থ পুরুষ মারফত কথা বলার চেষ্টা করছি।



যেসব দার্শনিকের কাজ আপনার আগ্রহ জাগায় তাদের আপনি কি তাহলে এভাবেই মুক্ত সিঙ্গুলারিটি হিসেবে (as singularities in an open space) দেখে থাকেন? একজন নাট্যপরিচালক যেভাবে লিখিত নাটককে মঞ্চে পরিচালনা করেন, আপনিও আপনার আগ্রহের দার্শনিকদের ক্ষেত্রে তা করেন— এযাবৎ পুরো ব্যাপারটা আমি এভাবেই সবসময় তুলনা করার চেষ্টা করেছি। অবশ্য আপনার ফারাক ও পুনরাবৃত্তি বইয়ের ক্ষেত্রে তুলনা আর তুলনার জায়গায় থাকেনি। ব্যাখ্যাকর্তা নয়, বরং সৃষ্টিকর্তার ভূমিকায় আপনি অবতীর্ণ হয়েছেন, এভাবে তুলনা কি করা যায়? নাকি দর্শনের ইতিহাসের ভূমিকাই ভিন্ন? আপনি যে দর্শনের ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন তা কি তবে কোলাজ— যে কোলাজ এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে? নাকি একে বলা চলে রচনার সাথে সংযুক্ত উদ্ধৃতি?



হ্যাঁ, দর্শনের ইতিহাস নিয়ে দার্শনিকেরা প্রায়শ ঝামেলায় থাকে; যা বেশ ভয়াবহ, চাইলেই এই ঝামেলা এড়িয়ে যাওয়া যায়না। মনে হয় এ ঝামেলা মোকাবিলা করার একটা পথ হতে পারে, আপনি যাকে বলছেন, বিকল্প হিসেবে এর মঞ্চায়ন করা। মঞ্চায়ন বলতে বোঝাতে চাচ্চি, লিখিত রচনাকে অন্যান্য (অন্তত খুব সাধারণ অর্থে) অলিখিত মূল্যবোধের আলোকে দেখা। দর্শনের ইতিহাসকে দর্শনের মঞ্চে পরিণত করা কিন্তু আসলেই সম্ভব। আপনি আরো উল্লেখ করেছেন, আমি ফারাকের ধারণা দিতে গিয়ে যতটা না মঞ্চ তার চাইতে বেশি কোলাজের মত আরেকটা পদ্ধতি অনুসরণ করেছি যে কোলাজ পদ্ধতি আমরা দেখে থাকি পপ আর্টে, যা আসলটার মত করে সিরিজ আকারে আনা হয় (পুনরাবৃত্তি এবং কিছুটা ভিন্নতা সহকারে)। অবশ্য আমি যে এ ব্যাপারে পুরোপুরি সফল তা আপনি মানতে নারাজ। আমার বিশ্বাস, বোধের যুক্তির ব্যাপারে আমার যে বই তাতে আমি এই ব্যাপারে আরো কিছুদূর এগিয়ে যাব।



আপনি যেসব দার্শনিকদের ব্যাপারে লেখেন তাদের প্রতি আপনার বন্ধুভাবাপন্ন আচরণ আমাকে বিস্মিত করে। মাঝে মাঝে ব্যাপারটা একটু বেশীই পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যায়। যেমন বার্গসোঁ’র চিন্তার রক্ষণশীল দিকটা আপনি ঢেকেই দেন কিন্তু অন্যদিকে হেগেলের ব্যাপারে আপনি একেবারে খড়গহস্ত। এটা কেন হয়?



আপনি যদি কোন কিছুর সমাদর করতে নাই পারেন, ভালোবাসতে নাই পারেন, তার ব্যাপারে লেখার কোন যুক্তিই নেই। নীটশে এবং স্পিনোজার কথাই ধরুন। এদের চিন্তাশক্তি এবং কোন কিছুকে গুঁড়িয়ে দেয়ার ক্ষমতা অসাধারণ। এ শক্তির উৎস হলো স্বীকৃতি এবং আনন্দ; আরো বলতে গেলে স্বীকৃতি এবং আনন্দের বন্দনা; কিংবা বলতে পারেন, জীবনকে যা বিকৃত করে বা আহত করে তার বিরুদ্ধে জরুরী ডাক। আমার কাছে এটাই দর্শন। যাইহোক, আপনি আমাকে দুজন দার্শনিকের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছিলেন আসলে, আমার কাছে যা গ্রহণযোগ্য তা হলো, মঞ্চায়ন বা কোলাজ যে পদ্ধতির ব্যাপারে আমরা কথা বলছিলাম তার মারফত রক্ষণশীল বলে পরিচিত যে দর্শন তার ভেতর থেকে সেসব singularities বের করে আনা যা আদপেই Singularities নয়। আসলে বার্গসোঁনিজমবা এর জীবের প্রতিচ্ছবির ক্ষেত্রে আমি তাই করেছি; একই জিনিস করেছি স্বাধীনতার প্রতিচ্ছবি বা মানসিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে, “হেগেলকে কেন এড়িয়ে যা?” এই প্রশ্নও আপনি তুলেছিলেন। আসলে কাউকে না কাউকে বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায়ও অভিনয় করতে হয়। হেগেলের মধ্যে দার্শনিকভাবে যেসব জিনিসের পুনর্জন্ম হয়েছে তা হলো জীবনকে ভারাক্রান্ত করে দেয়ার প্রচেষ্টা— যত ধরনের বোঝা আছে জীবনের উপর তা বিস্ময়করভাবে চাপিয়ে দেয়া, জীবনের সাথে রাষ্ট্র এবং ধর্মের খিচুড়ি বানানো, মৃত্যুকে জীবনের ভেতর প্রবেশ করানো। সত্যিই জীবনকে নেতিবাচকতার দিকে ঠেলে দেয়ার এ এক ভয়াবহ প্রচেষ্টা। আমি বলি, এ এক অতৃপ্ত এবং অসুখী বিবেকের চেষ্টা। স্বাভাবিকভাবেই এই নেতি এবং বিরোধের ডায়ালেক্টিক বা দ্বন্দ্বের মারফত, হেগেল ডানে বামে (তা ধর্মতত্ত্ব, আধ্যাত্মিকতাবাদ, কলাকৌশলতন্ত্র বা আমলাতন্ত্র যাই বলুন না কেন) বেঈমানীর ভাষা উসকে দিয়েছে।



এই যে নেতির প্রতি আপনার যে ঘৃণা তার বিপক্ষে দাড়িয়েই তো আপনি ভিন্নতা এবং বৈপরীত্যের কথা বলছেন। নিঃসন্দেহে হেগেলের দ্বান্দ্বিকতার যে (স্ব)বিরোধ তা আপনার মতামতকেই সঠিক প্রমাণ করে। কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে, মার্কসের ক্ষেত্রেও কি একইভাবে সিদ্ধান্ত টানা যাবে? আর আপনি কেন ব্যাপারটা ইশারা-ইঙ্গিত দিয়ে বুঝাচ্ছেন? ফ্রয়েডের ধর্ষকাম/মর্ষকাম, মৃত্যু চেতনা/মৃত্যু ইচ্ছা এসব বিরোধাত্মক-ভিন্নাত্মক সম্পর্ক যে আসলে ভ্রান্ত প্রতিসাম্য তা আপনি খোলাখুলি দেখিয়েছেন। তবে মার্কসের ক্ষেত্রে এমন কিছু নয় কেন?



ঠিকই ধরেছেন আপনি, কিন্তু মার্কসকে হেগেল থেকে আলাদা করা, মার্কসের আবার পুনর্মূল্যায়ন করা, মার্কসের কাজের ভিন্নাত্মক এবং ধনাত্মক প্রক্রিয়াগুলোর উন্মোচনসবই কি আলথুসার চমৎকারভাবে করেননি? যেকোন ক্ষেত্রেই, তা ভূল মতামত হোক বা ভুল বিরোধ হোক, আপনি বিস্ফোরক ব্যাপারস্যাপার পেয়ে যাবেন, শেষ পর্যন্ত যা হয়তো ভারসাম্যহীন অসম বৃত্তের ন্যায় কিছু একটা (উদাহরণ হিসেবে “ফেটিশ” শব্দটাই ধরুন না, যা একই সাথে অর্থনৈতিক এবং মনোঃবিশ্লেষণে ব্যবহার হয়)।



মার্কসের ব্যাপারে “যা বলা হয়নি” এমন কিছুর ব্যাপারে শেষ একটা প্রশ্ন করি। আমি পরিষ্কার দর্শন এবং ক্রীড়া বা খেলার মাঝে এক সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছি। এও বুঝতে পারছি যে এ এক প্রতিযোগিতামূলক সম্পর্ক। কিন্তু এর কি কোন রাজনৈতিক মাত্রা আছে কিংবা এটি কি বিপ্লবে কোন ভূমিকা রাখতে পারবে।



এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া কঠিন। প্রথমত, যদিও বন্ধুত্ব কিংবা ভালোবাসার যে সম্পর্ক তা নিজ ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক কিন্তু বৃহত্তর ক্ষেত্রে তা বিপ্লবের জন্যে অপেক্ষাও করে না তার পূর্বপরিকল্পনাও করে না। এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক শক্তি এদের মাঝে বিরাজ করে যা কাব্যিক জীবনের সাথে খাপে খাপ মিলে যায়ঃ যেমন ধরুন বিটনিকদের (beatniks) কথা। এদের কাজকর্ম যত না মার্কসবাদ তার চাইতে জেন বৌদ্ধবাদের সাথে বেশী মেলে; কেননা জেনবাদের মধ্যে আছে এক ধরনের কার্যকর এবং বিস্ফোরক শক্তি। সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে চিন্তা করলে, এই দশক কিংবা সেই দশকের দর্শনের কাজ হলো বিশেষ উদাহরণ মারফত নিজেকে প্রকাশ করা। যেমন ধরুন ধ্রুপদী বা ক্ল্যাসিক্যাল যুগের ব্যক্তি, রোমান্টিক যুগে লোক (person) এবং আধুনিক যুগের singularity হলো এই উদাহরণ। দর্শন কিন্তু এই উদাহরণসমূহের অস্তিত্ব প্রকাশ করে দেয় না, বরং এর মারফত এদের স্বরের প্রকাশ ঘটায়। কিন্তু কথা হলো এই ব্যক্তি, লোক বা singularity— এদের তো অস্তিত্ব আছে, ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এদের আবির্ভাব; এবং বিশেষ সামাজিক সম্পর্কের উপরও এরা নির্ভরশীল। ভালোই তো! বিপ্লব হলো এই কিংবা ঐ উদাহরণের উন্নতির জের ধরে ঐ সকল সম্পর্কের পরিবর্তন (এই ক্ষেত্রে ১৭৮৯ সালের “ধ্রুপদী” বিপ্লবের সময় বুর্জোয়া ব্যক্তির কথা আমলে নেয়া যায়)। নতুন সামাজিক সম্পর্কই হলো বিপ্লব কিংবা আমলাতন্ত্র বহির্ভূত বিপ্লবের সমস্যা। এই সম্পর্কে Singularity, সক্রিয় সংখ্যালঘু স্থান কিংবা সীমানা ব্যতিরেক যাযাবর ক্ষেত্রে কার্যকর হয়ে উঠে।


______________

মার্চ, ১৯৬৯



প্রকাশঃ ১৬ই মাঘ, ১৪২৮ ::: ৩০শে জানুয়ারি, ২০২২