নিয়ন্ত্রিত সমাজের পুনর্পাঠ

জিল দেল্যুজ



[প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক জিল দেল্যুজের ১৯৯০ সালের Post-scriptum sur les sociétés de contrôle প্রবন্ধটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে এমআইটি প্রেসের অক্টোবর নামের জার্নালের ৫৯তম ভল্যুমে অর্থাৎ ১৯৯২ সনের শীত সংখায় প্রকাশিত হয়। মিশেল ফুকোর শৃঙ্খলিত সমাজের ধারণার উপর দাঁড়িয়ে সমাজের গড়ন ও নিয়ন্ত্রণে চলমান শিফট বা পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা দেল্যুজের এই গুরুত্বপূর্ণ Postscript on the Societies of Control লেখাটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছেন আবদুল্লাহ আল মামুন। দেল্যুজের কাজ নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত পড়াশোনা ও অনুবাদের কাজে যুক্ত আছেন তিনি তিনি পেশায় শিক্ষক, ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান।]



১ ঐতিহাসিক

ফুকো আঠারো এবং উনিশ শতকের সমাজব্যবস্থায় তাঁর শৃঙ্খলিত সমাজব্যবস্থা (disciplinary societies) চিহ্নিত করেছেন। অবশ্য তিনি বিংশ শতাব্দীতে এর চূড়ান্ত রূপটি দেখাতে ভোলেননি। এই ধরনের সমাজগুলোতে প্রতিষ্ঠানগুলো বৃহৎ পরিসরে বন্দীশালার ভূমিকা পালন করে। প্রতিটা প্রতিষ্ঠানেরই আছে নিজস্ব রীতিনীতি, আর ব্যক্তি মাত্রই এইসব প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতির বাইরে যেতে পারে না। এক প্রতিষ্ঠান হতে আরেক প্রতিষ্ঠানে গমন মানেই এক ঝাঁক রীতিনীতি ছেড়ে আরেক ঝাঁক রীতিনীতির মাঝে প্রবেশ। ভাবুন আপনার পরিবারের কথা [যখন আপনি পরিবারের মাঝে থাকেন তখন আপনি পারিবারিক/সাংসারিক কিছু নিয়ম মেনেই চলাফেরা করছেন], এরপর ভাবুন স্কুলের কথা [স্কুলে প্রবেশের সাথে সাথে আপনি আর কিন্তু পরিবারের রীতিনীতি নয়, বরং স্কুলের রীতিনীতি অনুযায়ী চলাফেরার চেষ্টা করছেন] এরপর যদি আপনি সৈন্যদের ব্যারাকে যান, আপনি কিন্তু আর স্কুলের নিয়মনীতির অধীনে নেই। এইভাবে ভাবুন কলকারখানার কথা, হাসপাতালের কথা, [সোজা কথা যখনই আপনি প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করেছেন, আপনি এক ঝাঁক নিয়মকানুন মাথা পেতে নিচ্ছেন] এবং সবচাইতে ধাক্কা মারার মত উদাহরণ হিসেবে অবশ্য আমরা দেখি জেলখানাকে, তার বদ্ধ পরিবেশকে, তার অলঙ্ঘনীয় শৃঙ্খলাকে। এই শৃঙ্খলিত সমাজব্যবস্থার চিত্র রোসেলিনি পরিচালিত “ইউরোপা ৫১” ছবির নায়িকার একটি উক্তিতেই পরিষ্কার হয়ে যায়। কিছু শ্রমিককে দেখে তিনি আশ্চর্য্য হয়ে বলে উঠেন, “মনে হচ্ছিল যেন কিছু আসামী দেখছি।“


ফুকো কিন্তু এই বন্দিদশার চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন, কারখানার অবস্থার কথা তিনি উদাহরণ দিয়েছেন যেখানে শ্রমিকদের সংঘবদ্ধ করা হয়। জায়গা অনুযায়ী সাজানো হয়, সময় অনুযায়ী শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। কিন্তু কেন করা হয়? সময় এবং স্থানের পরিসরে একটা নির্দিষ্ট উৎপাদন শক্তি এক এক করে আরও লাভজনক কিছুর আশায়। ফুকো এর কাঠামোর পরিবর্তনও কিন্তু লক্ষ্য করেছেন। এই কাঠামো মূলত এসেছে সার্বভৌমত্বের সমাজগুলো (societies of sovereignty) হতে যার মূল লক্ষ্য এবং কার্যক্রম ছিল ভিন্নঃ যেমন উৎপাদনের আয়োজন করার পরিবর্তে কর আরোপ করা; জীবনযাপন শৃঙ্খলিত করার পরিবর্তে মৃত্যুর পরোয়ানা নির্ভর আদেশ জারি করা। পরিবর্তন অবশ্য একদিনে আসেনি—সময়ের প্রেক্ষিতেই এসেছে, সময় নিয়েই এসেছে। এই পরিবর্তন আনার ব্যাপারে নেপোলিয়ান বেশ সিদ্ধহস্ত ছিলেন। এক সমাজ ব্যবস্থা হতে আরেক সমাজব্যবস্থায় তিনি আমূল পরিবর্তন এনে দিয়েছেন, কিন্তু সময়ের পথ-পরিক্রমায় এই নিয়মশৃঙ্খলাসমূহ নতুন শক্তির কব্জায় এসে পড়লো। এই নিয়ম শৃঙ্খলাগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হলো এবং ব্যাপারটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পালে হাওয়া পেল। শেষকথা হলো এই যে, আমারা আর শৃঙ্খলিত সমাজের অধীনে রইলাম না, ব্যাপারটার সমাপ্তি ঘটেছে।


যেকোন বদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে সার্বিকভাবে যে আমরা ঝামেলায় আছি বোঝাই যাচ্ছে। [বদ্ধ পরিস্থিতি মানে জেলখানা, বিদ্যালয়, পরিবার] শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে বলি বা কার্যক্ষেত্রের দিক থেকে চিন্তা করলে পরিবার ছোট অবস্থানে আছে। স্কুল, কলকারখানা, হাসপাতাল, সেনানিবাস, জেলখানা—সব জায়গার কর্তাব্যক্তির মুখে এক সুর, “পরিবর্তন দরকার”, মেয়াদ যত দীর্ঘই হোক না কেন এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সমাপ্তি ঘোষনার সময় এসে গেছে। সবাই এখন তা জানে। ব্যাপারটা হচ্ছে নতুন পরিবর্তন দোরগোড়ায় এসে কড়া না নাড়া পর্যন্ত কিছু নিয়মনীতি পালন করা আর মানুষকে চাকরীতে বহাল রাখা, একেই বলা হচ্ছে “নিয়ন্ত্রিত সমাজব্যবস্থা (societies of control)”। বারোই (William S. Burroughs) প্রথম “নিয়ন্ত্রণ”-এর পরিবর্তে শব্দটা প্রস্তাব করেছেন। ফুকো তো একেই ভবিষ্যৎ বলেছেন। পল ভিরিলো (Paul Virilio) অবশ্য এই অতিমূল্যায়িত মুক্ত-ভাসমান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই মুক্ত-ভাসমান নিয়ন্ত্রণই জায়গা করে নিচ্ছে পুরনো সময় এবং স্থানের বেড়াজালে আটকে যাওয়া শৃঙ্খলব্যবস্থার, এর জন্যে অবশ্য অন্যরকম ঔষধ উৎপাদন সংক্রান্ত গবেষণার প্রয়োজন নেই; নেই প্রয়োজন পারমাণবিক প্রকৌশল কিংবা জিন পরিবর্তনের ধুয়া তোলা, যদিও নতুন ব্যবস্থাপনায় প্রবেশের জন্যে এসবও সমালোচনার দাবি রাখে। এর মাঝে কোনটা সবচাইতে কঠোর শাসনব্যবস্থা এই প্রশ্ন তোলা অবান্তর, কেননা প্রতিটা শাসনব্যবস্থার মাঝেই বিদ্যমান পরস্পর ক্রিয়াশীল গলা চেপে ধরা এবং মুক্ত করে দেয়ার ব্যাপারস্যাপার। হাসপাতালের বদ্ধ পরিবেশের কারণে অনেকে কাছাকাছি ক্লিনিক, ডে-কেয়ার, হসপিস বা সেবা সদনের চিন্তা করতে পারে কিন্তু এরাও নামান্তরে বদ্ধ জায়গায় নিয়ন্ত্রণেরই ব্যবস্থাপনা। পরিশেষে বলতে হবে, ভয় পাওয়ারও কিছু নেই, আবার আশান্বিত হওয়ারও কিছু নেই, শুধু নতুন অস্ত্র কিংবা উপায়েরই অপেক্ষা।