নয়া-উদারবাদ একটি রাজনৈতিক প্রকল্প

ডেভিড হার্ভে


[নয়া-উদারবাদ আসলে কি বস্তু এবং এতে কি আসেযায় অর্থাৎ এই কনসেপ্টের তাৎপর্য কিরূপ সেই সম্বন্ধে ডেভিড হার্ভের Neoliberalism Is a Political Project শীর্ষক একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে জ্যাকোবিন ম্যাগাজিনের ওয়েবসাইটে। ডেভিড হার্ভে মার্ক্সীয় অর্থনীতিক-ভূগোলবিদ(economic geographer) এবং Graduate Center of the City University of New York (CUNY)-এর ভূগোল ও নৃবিদ্যার অধ্যাপক।ডেভিড হার্ভের এ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ডেনমার্কের অরহুস বিশ্ববিদ্যালয়ে তত্ত্বের ইতিহাস ও দর্শন বিভাগের পিএইচডি গবেষক বিয়র্ক স্কারলন্ড রিসাজার। ডেভিড হার্ভের এই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন গৌরাঙ্গ হালদার। তিনি একাধারে লেখক ও অনুবাদক।]




গৌরচন্দ্রিকা

ডেভিড হার্ভে ১১ বছর আগে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। নাম ‘A Brief History of Neoliberalism’ বা ‘নয়া-উদারবাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’। এটি এখন নয়া-উদারবাদ নিয়ে সবচেয়ে বেশি পড়া বইগুলোর একটি। যে বছরগুলি থেকে অর্থনৈতিক ও মুদ্রাব্যবস্থার নতুন সংকট দেখা দিলো, সেই বছরগুলি থেকে একই সঙ্গে দেখা গেলো প্রতিরোধের নতুন ঢেউ। সমকালীন সমাজের পর্যালোচনায় এই সংকট প্রায়ই “নয়া-উদারবাদ” হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।


কর্নেল ওয়েস্ট “নয়া-উদারবাদী শক্তির আক্রমণ” হিসেবে কালো মানুষের অধিকার আন্দোলনের( Black Lives Matter) কথা বলেন। প্রয়াত হুগো শাভেজ নয়া-উদারবাদকে বলেছিলেন “জাহান্নামের রাস্তা”। আর এখন শ্রমিক নেতারা বৃহত্তর পরিবেশে কর্মক্ষেত্রের সংগ্রাম বর্ণনায় ক্রমশ এই পরিভাষাটি ব্যবহার করছেন। প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলোও এই পরিভাষাটি ব্যবহার করছে। তবে কেবল বাহাস করার জন্য যে, নয়া-উদারবাদের আসলে কোনো অস্তিত্ব নেই


তাহলে আমরা যখন নয়া-উদারবাদ সম্পর্কে কথা বলি, আমরা ঠিক কী নিয়ে কথা বলি? এটি কি সমাজতন্ত্রীদের জন্য কোন দরকারি লক্ষ্য? বিশ শতকের শেষদিকে এর জন্মলগ্ন থেকে কীভাবে এটি পরিবর্তিত হয়েছে? নয়া-উদারবাদের রাজনৈতিক প্রকৃতি আসলে কী এবং কীভাবে এটি প্রতিরোধ আন্দোলনের ধরন বদলে দিয়েছে এবং পুঁজিবাদের সমাপ্তি ঘটাতে বামদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা কেন গুরুত্বপূর্ণ– এই প্রসঙ্গে ডেভিড হার্ভের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিয়র্ক স্কারলন্ড রিসাজার




নয়া-উদারবাদ একটি রাজনৈতিক প্রকল্প


আজকের দিনে নয়া-উদারবাদ একটি বহুল প্রচলিত শব্দ। তবে, লোকে যখন শব্দটি ব্যবহার করে কিছু নির্দেশ করতে চায়, তা প্রায়ই অস্পষ্ট থাকে। এই পরিভাষাটির পদ্ধতিগত ব্যবহারে একে হয়তো একটি তত্ত্ব হিসেবে নির্দেশ করা যায়; ধারণাসমূহের একটি সেট, রাজনৈতিক কৌশল কিংবা একটি ঐতিহাসিক কালপর্ব হিসেবে নির্দেশ করা যায়। নয়া-উদারবাদকে আপনি কীভাবে বোঝেন? ব্যাখ্যা দিয়ে শুরু করবেন কি?


নয়া-উদারবাদকে আমি সবসময়ই একটি রাজনৈতিক প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করেছি। আর এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে কর্পোরেট পুঁজিপতি শ্রেণির হাতে। কারণ, তারা ১৯৬০ থেকে ৭০ দশকে প্রবেশের শেষদিকে, উভয়ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রচণ্ড হুমকি অনুভব করেছিল। তারা মরিয়া হয়ে একটি রাজনৈতিক প্রকল্প চালু করতে চেয়েছে যাতে শ্রমিকের শক্তির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যায়।


বহুদিক থেকেই এই প্রকল্প ছিল প্রতিবিপ্লবী প্রকল্প। এই প্রকল্প সে সময়ে চীন, মোজাম্বিক ও অ্যাঙ্গোলার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যে বিপ্লবী আন্দোলন ছিল তাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেয়। একই সঙ্গে ইতালি ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলোতে কমিউনিস্ট প্রভাবের ঢেউ এবং কিছুটা কম মাত্রায় স্পেনে এই প্রভাবের পুনরুত্থান হুমকিকেও দমন করা হয়।


এমন কি আমেরিকাতেও ট্রেড ইউনিয়নগুলো একটি গণতান্ত্রিক কংগ্রেস গড়ে তুলেছিল। এই কংগ্রেসের প্রবণতা ছিল বেশ র‍্যাডিকাল। ১৯৭০ দশকের গোড়ার দিকে অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনগুলোর পাশাপাশি তারা বেশকিছু সংস্কার ও সংস্কারপন্থী উদ্যেগের চাপ সৃষ্টি করে। এগুলো ছিল কর্পোরেট বিরোধী। পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা, পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সংস্থা, ভোক্তা অধিকার রক্ষা ও শ্রমিকদের ক্ষমতায়নকে কেন্দ্র করে আরও বেশকিছু ব্যাপার আসে যা তাদের আগের চাইতেও বেশি শক্তিশালী করেছিল।


কাজেই, এর প্রভাব হিসেবে ঐরকম একটা পরিস্থিতি বিশ্বজুড়ে পুঁজিপতি কর্পোরেট শ্রেণির ক্ষমতার প্রতি হুমকি হয়ে উঠছিল। সুতরাং অবিলম্বে প্রশ্ন উঠলো, “করনীয় কী?” শাসক শ্রেণি সর্ববিদ্যা-বিশারদ ছিল না। কিন্তু তারা বুঝতে পেরেছিল যে, কয়েকটা ফ্রন্টে তাদের লড়তে হবে। ভাবাদর্শিক ফ্রন্ট, রাজনৈতিক ফ্রন্ট এবং সর্বোপরি, সম্ভাব্য সকল উপায়ে শ্রমিকের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তাদের সংগ্রাম করতে হয়েছিল। এই সবকিছুর ভেতর থেকে একটি রাজনৈতিক প্রকল্প আবির্ভূত হয় যাকে আমি বলি নয়া-উদারবাদ।


ভাবাদর্শিক ও রাজনৈতিক ফ্রন্ট এবং শ্রমিকদের ওপর আক্রমণ বিষয়ে কিছু বলবেন কি?


ভাবাদর্শিক ফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল লুইস পাওয়েল নামে এক লোকের পরামর্শ অনুসরণ করে। তিনি একটি পরিপত্র লিখে বলেন যে, ব্যাপারগুলো বহুদূরে চলে গেছে। পুঁজির এখন একটি যৌথ প্রকল্প দরকার। এই পরিপত্রটি চেম্বার অফ কমার্স ও ব্যবসায়ীদের গোলটেবিলকে গতিশীল করতে সাহায্য করে।


একই সঙ্গে এই ধারণাগুলো ভাবাদর্শিক ফ্রন্টের জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তৎকালীন পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সংগঠিত করা ছিল অসম্ভব। কারণ ছাত্র আন্দোলন ছিল খুব শক্তিশালী এবং ফ্যাকাল্টি ছিল অতি-উদারমনা। কাজেই তারা ম্যানহাটন ইন্সটিটিউট, হেরিটেজ ফাউন্ডেশন এবং ওলিন ফাউন্ডেশনের মতো থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক গঠনের উদ্যেগ নেয়। এই থিঙ্ক-ট্যাঙ্কগুলো ফ্রেডরিখ হায়েক ও মিল্টন ফ্রিডম্যানের ধারণা এবং ‘সাপ্লাই-সাইড ইকোনমিকস’ একই সঙ্গে এই ধারণাগুলো ভাবাদর্শিক ফ্রন্টের জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তৎকালীন পর্যবেক্ষণের সিদ্ধান্ত অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সংগঠিত করা ছিল অসম্ভব। কারণ ছাত্র আন্দোলন ছিল খুব শক্তিশালী এবং ফ্যাকাল্টি ছিল অতি-উদারমনা। কাজেই তারা ম্যানহাটন ইন্সটিটিউট, হেরিটেজ ফাউন্ডেশন এবং ওলিন ফাউন্ডেশনের মতো থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক গঠনের উদ্যেগ নেয়। এই থিঙ্ক-ট্যাঙ্কগুলো ফ্রেডরিখ হায়েক ও মিল্টন ফ্রিডম্যানের ধারণা এবং ‘সাপ্লাই-সাইড ইকোনমিকস’ [i] ধারণা নিয়ে আসে।


এই থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক গঠনের ধারণা ছিল গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করার জন্য। এবং এদের কিছু সে কাজ করেছেও। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ‘ন্যাশনাল ব্যুরো অফ ইকোনমিক রিসার্চ’ ছিল একটি ব্যক্তি-অর্থায়িত প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানটি দুর্দান্ত রকমের ভালো এবং অনুপুঙ্খ গবেষণা করেছিল। পরে এই গবেষণাপত্র স্বাধীনভাবে প্রকাশ করা হয় এবং সংবাদমাধ্যমগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তার করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ধীরে ধীরে এর প্রভাব বলয় তৈরি হয়। যেখানে ধারণাসমূহ অনুপ্রবিষ্ট করানো হয়।


এই প্রক্রিয়া একটি দীর্ঘ সময় নিয়েছে। আমার মনে হয়, আমরা এখন এমন একটি অবস্থায় পৌঁছেছি যে, হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের মতো প্রতিষ্ঠানেরও ঐ ধরণের কিছুর আর দরকার নেই। নয়া-উদারবাদী প্রকল্প বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বেশ ভালোভাবেই কব্জায় নিয়েছে।


শ্রমিক প্রসঙ্গে চ্যালেঞ্জ ছিল বৈশ্বিক শ্রমিকের সাথে অভ্যন্তরীণ শ্রমিকের প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করা। এটা একদিকে অভিবাসনের পথ খুলে দিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬০ এর দশকে জার্মানরা তুর্কি শ্রমিক, ফরাসীরা মাগরেবীয় (Maghrebian, উত্তর-আফ্রিকান) শ্রমিক ও ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক শ্রমিক আমদানি করেছিল। কিন্তু এটি ব্যপক অসন্তোষ ও বিক্ষোভের জন্ম দেয়।


এর পরিবর্তে তারা আরেকটি পথ নেয়—শ্রমিক বাহিনী যেখানে সস্তা সেখানে তারা পুঁজি নিয়ে যায়। তবে বিশ্বায়ন সচল করার জন্য শুল্ক কমাতে হয়েছিল এবং ফিন্যান্স পুঁজিকে শক্তিশালী করতে হয়েছিল। কারণ ফিন্যান্স পুঁজিই পুঁজির সবচেয়ে গতিশীল রূপ। কাজেই, ফিন্যান্স পুঁজি ও কাঁচা টাকার মতো ব্যাপারগুলো শ্রমিক নিয়ন্ত্রণে চরম হয়ে উঠলো।


একই সঙ্গে এই ভাবাদর্শিক প্রকল্প-সৃষ্ট বেকারত্বে, বেসরকারিকরণ ও নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হয়। ফলে, অভ্যন্তরীণ ও আন্তঃদেশীয় বেকারত্ব নিজ দেশের বাইরে চাকরি খুঁজতে বাধ্য হয়। আর তৃতীয় উপাদান হল প্রযুক্তিগত পরিবর্তন–রোবটের ব্যবহার ও স্বয়ংক্রিয়( automation) করার ভেতর দিয়ে বি-শিল্পায়ন। শ্রমিকদের চিড়েচ্যাপ্টা করে দিতে এই ছিল কৌশল।


এটি ছিল একটি ভাবাদর্শিক আক্রমণ এবং একই সঙ্গে একটি অর্থনৈতিক আক্রমণ। আমার কাছে এটাই ছিল নয়া-উদারবাদ–ছিল একটি রাজনৈতিক প্রকল্প। আমি মনে করি বুর্জোয়া বা কর্পোরেট পুঁজিপতি শ্রেণি একে ধাপে ধাপে গতিপ্রবাহের মাঝে প্রবেশ করিয়েছে।


তবে, আমি মনে করি না যে তারা হায়েক বা অন্যকিছু পাঠের ভেতর দিয়ে এটি করেছে। আমার মনে হয় তারা তাদের স্বজ্ঞা থেকেই এটি বলেছে, “শ্রমিক দমন করতে হবে, কিন্তু কীভাবে করবো?” এবং তারা দেখলো যে এই দমনকে বৈধতা দেয়ার জন্য তত্ত্ব প্রস্তুত, যা তাদের সাহায্য করতে পারে।


২০০৫ সালে A Brief History of Neoliberalism প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এই ধারণা নিয়ে বহু কালি খরচ করা হয়েছে। এখানে মনে হয় দুটো প্রধান শিবির রয়েছে। এক শিবিরের পণ্ডিতরা নয়া-উদারবাদের বৌদ্ধিক ইতিহাসে আগ্রহী, অন্য শিবিরের ভাবনা “আসলেই বহাল নয়া-উদারবাদ” নিয়ে। আপনি নিজেকে কোথায় উপযুক্ত মনে করেন?


সমাজবিজ্ঞানে ‘এক ঢিলে পাখি মারা তত্ত্ব’ খোঁজার প্রবণতা আছে। আমি একে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করি। এখানে লোকদের একটি ঘরানা আছে যারা বলে নয়া-উদারবাদ একটি ভাবাদর্শ। কাজেই তারা এর ভাবতান্ত্রিক ইতিহাস লেখে। এর একটি বর্ণনা পাওয়া যায় ফুকো’র শাসন-কৌশলগত(Governmentality, শাসনতান্ত্রিকতা) বাহাসে। যেটি আঠেরো শতকের মাঝেই নয়া-উদারবাদীকরণ প্রবণতা দেখতে পায়। কিন্তু আপনি যদি নয়া-উদারবাদকে একটি ধারণা অথবা শাসন-কৌশল চর্চার একটি সীমাবদ্ধ সেট হিসেবে দেখেন, তাহলে আপনি অনেক অগ্রদূত খুঁজে পাবেন।


এখানে একটি জিনিস বাদ পড়ে যায়। অর্থাৎ ১৯৭০ ও ১৯৮০’র দশকের গোড়ার দিকে পুঁজিপতি শ্রেণি যে পন্থায় একে সংগঠিত করেছিল। আমার মনে হয় এটা বলা ঠিক হবে যে, সে সময় –ইংরেজিভাষী দুনিয়ায়– কর্পোরেট পুঁজিপতি শ্রেণি বেশ ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিল।


তারা বহু বিষয়ে একমত হয়। যেমন ধরুন, এমন একটি রাজনৈতিক শক্তি যা আসলেই তাদের প্রতিনিধিত্ব করবে। কাজেই এখানে আপনি রিপাবলিকান পার্টির নিয়ন্ত্রণ ও কিছু পরিমাণে ডেমোক্রেটিকদের হীনবল করার ব্যাপারটা পেয়ে যান।


১৯৭০ দশকে সুপ্রিম কোর্ট বেশকিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই সিদ্ধান্তের ফলে কর্পোরেট পুঁজিপতিরা আগের চাইতে আরও সহজে নির্বাচনব্যবস্থাটা কিনে নেয়ার সুযোগ পায়।


উদাহরণ দেয়া যাক। আপনি জানেন যে, নির্বাচনী তহবিল সংস্কারের অবদানকে বিবেচনা করা হয় ‘বাকস্বাধীনতা’য় প্রচারণার অবদানের মতো। আমেরিকায় কর্পোরেট পুঁজিপতিদের নির্বাচন কেনার একটা দীর্ঘ রীতি আছে। কিন্তু এখন এটা একদম আইনসঙ্গত ব্যাপার। টেবিলের নিচের দুর্নীতি করার দরকার নেই।


সব মিলিয়ে আমি মনে করি, এই পর্বটা সংজ্ঞায়িত ভাবাদর্শ ও রাজনীতির অনেক ফ্রন্টের একটি বিস্তৃত গতিশীলতা দিয়ে। আপনি এই বিস্তৃত গতিশীলতাকে কেবল একটি পথেই ব্যাখ্যা করতে পারেন। সেটি হল কর্পোরেট পুঁজিপতি শ্রেণির উচ্চ মাত্রার সংহতি বুঝতে পারা। পুঁজি তার আর্থিক সম্পদ ও প্রভাব পুনরুদ্ধারের বেপরোয়া চেষ্টায় তার শক্তিকে পুনর্গঠিত করেছে। ১৯৬০ দশকের শেষ থেকে ১৯৭০ দশকে এই শক্তি মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল।


২০০৭ সাল থেকে অনেকগুলো সংকট আমরা দেখেছি। এই সংকটগুলো বুঝতে নয়া-উদারবাদের ধারণা ও ইতিহাস কীভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারে?


১৯৪৫ ও ১৯৭৩-এর মাঝের সময়টাতে সংকট ছিল মাত্র কয়েকটি; তখন মারাত্মক কয়েকটি মুহূর্ত ছিল কিন্তু বড় কোনো সংকট ছিল না। নয়া-উদারবাদী রাজনীতি মোড় নেয় ১৯৭০ দশকের মাঝামাঝি সংকটের সময়ে। তার পর থেকে পুরো ব্যবস্থাতন্ত্রে একটার পর একটা সংকট হাজির হয়েছে। আর অবশ্যই সংকট ভবিষ্যৎ সংকটের শর্ত তৈরি করে।


১৯৮২ থেকে ৮৫ সালের মাঝে ইকুয়েডর, ব্রাজিল ও মেক্সিকোতে ঋণ সংকট দেখা দেয়। মূলত পোল্যান্ড সহ সকল উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই এই সংকট ছিল। ১৯৮৭ থেকে ৮৮ সালে আমেরিকায় সঞ্চয় ও ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যপক সংকট ছিল। সুইডেনে ১৯৯০ সালে বিরাট সংকট দেখা দেয়। ফলে সকল ব্যাংকগুলোকে জাতীয়করণ করতে হয়। এরপর অবশ্যই আসবে ১৯৯৭-৯৮ সালে ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংকটের কথা। এই সংকট তারপরে ধায় রাশিয়ার দিকে। তারপর ব্রাজিলে। ২০০১-০২ সালে আঘাত করে আর্জেন্টিনায়। ২০০১ সালে আমেরিকার সমস্যার কথা বিবেচনায় নিন। পুঁজি বাজারের টাকা নিয়ে গৃহায়ন খাতে ঢালতে হয়েছিল। ২০০৭-৮ সালে হাউজিং ব্যবসা ধ্বসে যায়। কাজেই, এখানেও আপনি সংকট দেখতে পাচ্ছেন।


বিশ্বের মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখবেন, এই সংকটের প্রবণতা হলো দুনিয়াময় ঘুরে বেড়ানো। নয়া-উদারবাদ সম্পর্কে ভাবনা এই প্রবণতাগুলো বুঝতে সাহায্য করে।


নয়া-উদারীকরণের অন্যতম বড় পদক্ষেপ ছিল ২০১২ সালে। বিশ্বব্যাংক ও আই.এম.এফ (IMF) থেকে কেইনসীয় অর্থনীতিবিদদের বের করে দেয়া হয়। কেইনসীয় দৃষ্টিভঙ্গী পোষণকারী সকল অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা বাদের খাতায় চলে যান। এদের জায়গায় আসেন নয়া ধ্রুপদী ‘সাপ্লাই-সাইড’ তাত্ত্বিকরা। তারা এসেই প্রথমে একটি কাজ করে। তারা পরামর্শ দেয় যে, যখনই কোথাও সংকট দেখা দেবে, আই.এম.এফের উচিৎ ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট’ ’ [ii] বা মুক্তবাজারের কাঠামো সংস্কার নীতি অনুসরণ করা।


আমার পরিষ্কার মনে আছে, মেক্সিকোয় ১৯৮২ সালে একটি ঋণ সংকট ঘটে। আই.এম.এফ বললো যে, “আমরা তোমাদের বাঁচাবো”। আসলে তারা বাঁচিয়েছিল নিউইয়র্কের লগ্নি ব্যাংকগুলোকে। সেইসাথে ব্যয়সংকোচের রাজনীতি প্রয়োগ করলো।


আই.এম.এফের ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট’ রাজনীতির ফল কী হলো? ১৯৮২ সালের পরে, চার বছরের মাঝে মেক্সিকোর জনগণের জীবনমান অন্তত ২৫ শতাংশ নেমে গেল। এরপর মেক্সিকোতে প্রায় চার বার ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট’ করা হয়। অন্য অনেক দেশেও এটা একাধিকবার ঘটেছে। এটা হয়ে উঠেছে চর্চার একটি মানদণ্ড।


গ্রীসে তারা এখন কী করছে? ১৯৮২ সালে মেক্সিকোতে যা করেছে তারই হুবহু নকল মাত্র। তবে আরেকটু তীক্ষ্ণভাবে। ২০০৭-০৮ সালে এই একই জিনিস ঘটেছে আমেরিকায়। ব্যাংকগুলোকে তারা দেউলিয়া ঘোষণা করে; আর ব্যয়সংকোচনের রাজনীতির ভেতর দিয়ে জনগণকে বাধ্য করা হয় তার দায় মেটাতে।


সাম্প্রতিক সংকটগুলোকে শাসক শ্রেণির লোকেরা যে পন্থায় সামাল দিয়েছে, সেখানে এমন কিছু আছে কি যা আপনার নয়া-উদারবাদী তত্ত্ব নিয়ে পুনরায় আপনাকে ভাবতে বাধ্য করছে?


বেশ, আমি মনে করি না যে পুঁজিপতি শ্রেণির সংহতি আগে যেমন ছিল তা আজও তেমন আছে। ১৯৭০ দশকে বৈশ্বিকভাবে আমেরিকার যে অবস্থান ছিল ভূ-রাজনৈতিকভাবে সে আজ আর সেই অবস্থানে নেই। আমার মনে হয়, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাতন্ত্রে আমরা বৈশ্বিক ক্ষমতা কাঠামোর আঞ্চলিকায়ন দেখতে পাচ্ছি। এটা আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের মতো। যেমন, ইউরোপে জার্মানি, ল্যাটিন আমেরিকায় ব্রাজিল ও পূর্ব এশিয়ায় চীন।


স্পষ্টতই, আমেরিকার এখনো একটি বৈশ্বিক অবস্থান আছে। কিন্তু সময় বদলে গেছে। ওবামা জি-টুয়েন্টির সম্মেলনে গিয়ে বলতে পারে “আমাদের এটা করা উচিৎ” অ্যাঙ্গেলা মেরকেল বলতে পারে “না, আমরা তা করবো না”। ১৯৭০ এর দশকে এমনটা ঘটতে পারতো না।


কাজেই, ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও বেশি আঞ্চলিক হয়ে উঠছে। এতে আরও বেশি স্বাধিকার রয়েছে। আমার মনে হয়, এটি অংশত শীতল যুদ্ধ সমাপ্তির ফল। জার্মানির মতো দেশ সুরক্ষার জন্য আর আমেরিকার ওপর নির্ভর করে না।


তাছাড়া যাদের বলা হয় “নতুন পুঁজিপতি শ্রেণি” সেই বিল গেটস, আমাজনসিলিকন ভ্যালি’র রাজনীতি রয়েছে, যা প্রচলিত তেল ও শক্তির (Energy) রাজনীতির চাইতে ভিন্ন। এর ফল হিসেবে তারা তাদের নিজস্ব রাস্তায় যাওয়ার প্রবণতা দেখায়। সুতরাং এখানে এনার্জি ও ফাইন্যান্স এবং এনার্জি ও সিলিকিন ভ্যালির লোকদের মাঝে অনেকগুলো বিভাগগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে সাংঘাতিক বিভাজন বিদ্যমান।


আরেকটি জিনিস আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। ১৯৭০ দশকের নয়া-উদারবাদী চাপ বিনা প্রতিরোধে আগাতে পারে নাই। ইউরোপ এবং অন্যান্য জায়গায় লেবারদের থেকে, কমিউনিস্ট পার্টিগুলো থেকে ব্যাপক প্রতিরোধ ছিল। তবে আমি বলবো, ১৯৮০ দশকের শেষদিকে এই যুদ্ধে তারা হেরে যায়। কাজেই যে মাত্রায় প্রতিরোধ ছিল তা অদৃশ্য হয়ে যায়। লেবারদের একসময় যে শক্তি ছিল তা আর নেই। নয়া-উদারবাদ সচল রাখার জন্য শাসক শ্রেণির মাঝে সংহতিও আর প্রয়োজনীয় নয়। একদম তলা থেকে শুরু করার জন্য একত্রিত হয়ে সংগ্রামের কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ কোনদিক থেকেই আর কোনো হুমকি নেই। শাসক শ্রেণি চরমরকম ভালো করছে, সুতরাং কোনকিছু পাল্টানোরও প্রয়োজন নেই।


তবে পুঁজিপতি শ্রেণি যখন দারুণভাবে খেলছে, পুঁজিবাদ খেলছে বরং বাজেভাবে। মুনাফার হার পুনরুদ্ধার করা গেলেও পুনঃলগ্নির হার ভয়ানকভাবে নিচের দিকে নেমে গেছে। প্রচুর টাকা আর উৎপাদন সঞ্চালনে ফিরতে পারছে না। এর পরিবর্তে টাকা এখন সম্পদ কেনা আর ভূমি দখলের দিকে যাচ্ছে।


প্রতিরোধ সম্পর্কে কিছু আলাপ করা যাক। আপনার কাজে আপনি একটি আপাত কূটাভাস নির্দেশ করেছেন। আপনি বলছেন, অন্তত উত্তর গোলার্ধে স্বতন্ত্রের মুক্তির জন্য “নতুন সামাজিক আন্দোলনের” অনুকূলে, নয়া-উদারবাদী আক্রমণ ঘটেছিল শ্রেণি সংগ্রাম পতনের সমান্তরালে। আপনি কীভাবে ভেবেছেন যে, নয়া-উদারবাদের কারণে প্রতিরোধের নির্দিষ্ট ধরণ উত্থিত হয়েছে, বিষয়টি একটু খুলে বলবেন কি?


বিষয়টি নিয়ে ভাববার একটি প্রত্যয় আছে। একটি আয়নার কাছে তার প্রতিচ্ছবির মতো, উৎপাদনের প্রতিটি আধিপত্যশীল ধর যদি এর নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বিন্যাসের সাথে বিরোধীতার একটি ধর সৃষ্টি করে তাহলে কী হবে?


উৎপাদন প্রক্রিয়ার ফোর্ড জমানার সংগঠনে এই আয়নার প্রতিচ্ছবি ছিল একটি বৃহৎ কেন্দ্রায়িত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিকভাবে কেন্দ্রবাদী রাজনৈতিক দল। উৎপাদন প্রক্রিয়ার পুনঃসংগঠন এবং নয়া-উদারবাদী জমানায় নমনীয় সঞ্চয়নের দিকে মোড় নেয়া একটি বাম উৎপন্ন করেছে যা অনেক ভাবেই এর আয়না–-নেটওয়ার্কিং, বিকেন্দ্রীকরণ ও ক্রমোচ্চ-কাঠামোহীনতা। আমার মনে হয় এটা বেশ আগ্রহের ব্যাপার।


এই আয়নার প্রতিচ্ছবি কিছু মাত্রায় নিশ্চিত করে যে, তা কিছুটা ধ্বংসের চেষ্টা করে। তবে আমি মনে করি, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শেষপর্যন্ত আসলে ফোর্ডবাদকে নীচ থেকে রক্ষা করেছে। আমার মনে হয়, বেশিরভাগ বাম এখন অত্যন্ত স্বাধীন ও অরাজবাদী হয়ে আসলে নয়া-উদারবাদের শেষখেলার(endgame) মঞ্চায়ন করছে। বামের অনেক লোকেরই এটা শুনতে ভাল লাগার কথা না।


কিন্তু অবশ্যই এখানে প্রশ্ন ওঠে, সংগঠিত হওয়ার কোনো উপায় আছে কি যা কোন আয়নার প্রতিচ্ছবি নয়? আমরা কি ঐ আয়না চূর্ণ করে দিতে পারি এবং অন্যকিছু খুঁজে নিতে পারি যা নয়া-উদারবাদের হাতের খেলার পুতুল হবে না?


নয়া-উদারবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন পন্থায় ঘটতে পারে। আমার কাজে আমি জোর দিয়েছি, যে বিন্দুতে মূল্য বাস্তবায়িত হয় একই সঙ্গে সেই বিন্দুটিও একটি চাপের জায়গা। মূল্য উৎপাদিত হয় শ্রম প্রক্রিয়ায়, শ্রেণিসংগ্রামে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষিত। কিন্তু মূল্য বাস্তবায়িত হয় বাজারে বিক্রির ভেতর দিয়ে। এখানে এবিষয়ে অনেক রাজনীতি আছে। পুঁজির সঞ্চয়নে প্রবল প্রতিরোধ কেবল উৎপাদন বিন্দুতেই ঘটে না, মূল্যের বাস্তবায়ন ও ভোগের ভেতর দিয়েও ঘটে।


স্বয়ংক্রিয় কারখানা বিবেচনায় নেয়া যাক। বড় কারখানায় আগে ২৫ হাজারের মতো লোক নিয়োগ দেয়া হতো। এখন নিয়োগ দেয়া হয় ৫ হাজার। কারণ টেকনোলজি শ্রমিক সংখ্যার প্রয়োজন কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে প্রতিনিয়ত আরও বেশি শ্রমিক উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে উৎপাটিত হয়ে যাচ্ছেন, আরও বেশি মানুষ নগর জীবনে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। পুঁজিতান্ত্রিক গতিশীলতার মাঝে অসন্তোষের প্রধান কেন্দ্র ক্রমশ মূল্যের বাস্তবায়ন সংগ্রামের দিকে ধাবিত হচ্ছে। শহুরে জীবনের রোজকার সংগ্রামের রাজনীতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে।


শ্রমিকরা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং শ্রমিকদের মাঝে বহু ইস্যু রয়েছে যা সিদ্ধান্তনির্ধারক। আমরা যদি চীনের শেনজেনে যাই দেখবো, শ্রম প্রক্রিয়ার ওপরে সংগ্রাম প্রভাশালী। এবং আমেরিকায়, উদাহরণস্বরুপ, আমাদের শ্রমিকরা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং শ্রমিকদের মাঝে বহু ইস্যু রয়েছে যা সিদ্ধান্তনির্ধারক। আমরা যদি চীনের শেনজেনে যাই দেখবো, শ্রম প্রক্রিয়ার ওপরে সংগ্রাম প্রভাবশালী এবং আমেরিকায়, উদাহরণস্বরুপ, আমাদের ভেরিজোন ধর্মঘট সমর্থন করা উচিৎ।


তবে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে রোজকার জীবনের মান নিয়ে সংগ্রাম এখন প্রভাবশালী। গত ১০ বা ১৫ বছরের বড় সংগ্রামগুলোর দিকে নজর দিন। যেমন ধরুন, ইস্তাম্বুলের গাজী পার্ক নিয়ে সংগ্রাম শ্রমিকদের সংগ্রাম ছিল না। সেই সংগ্রাম ছিল রোজকার জীবনের রাজনীতি ও সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্রহীনতার অসন্তোষজাত। ২০১৩ সালে ব্রাজিলের শহরগুলোয় গণ-অভ্যুত্থান ছিল দৈনন্দিন জীবনের রাজনীতির অসন্তোষ –বড় বড় স্টেডিয়াম বানানোর টাকা আছে অথচ পরিবহণ, সম্ভাবনা, স্কুল নির্মাণ, সাশ্রয়ী আবাসন এবং হাসপাতাল বানাবার জন্য টাকা নেই। লন্ডন, প্যারিস ও স্টকহোমে আমরা যে গণ-অভ্যুত্থান দেখি তা শ্রম প্রক্রিয়া নিয়ে নয় –রোজকার জীবনের রাজনীতি নিয়ে।


উৎপাদন নিয়ে যে রাজনীতি বিদ্যমান তা এই রাজনীতি থেকে ভিন্ন। উৎপাদনের বিন্দুতে যে রাজনীতি তা পুঁজি বনাম শ্রমের। নাগরিক জীবনের মান নিয়ে যে সংগ্রাম তা তাদের শ্রেণি গঠনের ভিত্তি থেকে কম স্পষ্ট। স্পষ্ট শ্রেণি-রাজনীতি সাধারণত উৎপাদনের একটি বোঝাপড়ার মাঝ থেকে আসে। যেহেতু তা আরও বাস্তবিক হয়ে ওঠে, তাই তাত্ত্বিকভাবে তা ঝাপসা হয়ে যায়। এটি একটি শ্রেণি প্রশ্ন কিন্তু তা ধ্রুপদী অর্থে শ্রেণি প্রশ্ন নয়।


আপনি কি মনে করেন, আমরা নয়া-উদারবাদ সম্পর্কে অনেক বেশি কথা বলি, আর পুঁজিবাদ সম্পর্কে কথা বলি খুব কম? শব্দ দুটির কোনটির ব্যবহার কখন সঠিক, এবং এদের একত্রে জড়িত করার ঝুঁকি আছে কি?


অনেক উদারবাদী বলে থাকেন, আয়ের অসমতার প্রেক্ষিতে নয়া-উদারবাদ বহুদূর চলে গেছে, মানে ব্যক্তিমালিকানা নাগালের বাইরে চলে গেছে, এখানে অনেক অভিন্ন কল্যাণের ব্যাপার আমলে নেয়ার আছে, যেমন ধরুন পরিবেশ।


পুঁজিবাদ সম্পর্কে বলার উপায়ে বৈচিত্র্য রয়েছে। যেমন ধরুন ভাগাভাগির অর্থনীতি(sharing economy), যেটি উচ্চ পুঞ্জিভবন ও উচ্চ শোষণমূলক হওয়ার দিকে যায়। এখানে আছে নৈতিক পুঁজিবাদের প্রত্যয় যেটি সহজভাবে চুরি করার পরিবর্তে সৎ হবার কথা বলে। কাজেই কিছু লোকের মনে পুঁজিবাদের অন্যান্য রূপগুলোর মাঝে নয়া-উদারবাদী পদ্ধতির একধরণের সংস্কার চিন্তার সম্ভাব্যতা আছে।


আমি মনে করি বহাল পুঁজিবাদের চাইতে আরেকটু ভাল পুঁজিবাদ তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু সেই ভালো খুব বেশি নয়। মৌলিক সমস্যাগুলো এই মুহূর্তে আসলেই অত্যন্ত গভীর। তাই একটি অত্যন্ত শক্তিশালী পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনদিকে যাওয়ার আমাদের কোনো উপায় নেই। কাজেই আমি ‘নয়া-উদারবাদী’ পরিভাষার পরিবর্তে ‘পুঁজিবাদ বিরোধী’ শব্দ ব্যবহার করতে চাই।


লোকদের এমনভাবে নয়া-উদারবাদবিরোধী কথাবার্তা বলতে শুনি, যেন তা পুঁজিবাদ নয়। অথচ নয়া-উদারবাদ নিজেই পুঁজিবাদের একটি রূপ। আমি একে সমস্যা ও বিপদ বলে মনে করি।


বেশিরভাগ নয়া-উদারবাদ বিরোধীতা বাস্তুসংস্থানের, রাজনীতির এবং অর্থনীতির সীমাহীন বৃহৎ-সমস্যা মোকাবিলায় ব্যর্থ। কাজেই, আমি নয়া-উদারবাদ বিরোধীতার চাইতে বরং পুঁজিবাদ বিরোধীতা সম্পর্কে কথা বলতে থাকবো।


___________

২৩শে জুলাই, ২০১৬



অনুবাদকের টীকা


[i] সাপ্লাই-সাইড ইকোনোমিকস : সামষ্টিক অর্থনীতির একটি তত্ত্ব। এই তত্ত্ব যুক্তি দেয়, কর কমিয়ে এবং নিয়ন্ত্রণ তুলে নিয়ে সবচেয়ে কার্যকরভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সৃষ্টি করতে পারে। এই তত্ত্ব ‘ডিমান্ড-সাইড’ অর্থনৈতিক তত্ত্বের সরাসরি উল্টো।


[ii] স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট : সরকারী ব্যয় কমানো এবং বাজার উন্মুক্ত করাসহ আরও অনেকগুলো নীতি নিয়ে অর্থনৈতিক সংস্কারের একটি সেট। মূলত অর্থনৈতিক সংকটে আক্রান্ত কোনো দেশের ঋণ নিশ্চিতকরণে আইএমএফ অথবা বিশ্বব্যাংকের দেয়া শর্তাবলী। এর মাঝে রয়েছে পাওনা মেটানোর ক্ষেত্রে ভারসাম্যের ঘাটতি কমাতে টাকার অবমূল্যায়ন। গণ-পরিষেবায় কর্মী ছাঁটাই, ভর্তুকি তুলে নেয়া এবং অন্যান্য খাতে ব্যয় কমিয়ে বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনা। রাষ্ট্র-মালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজগুলো ব্যক্তি-মালিকানায় ছেড়ে দেয়া এবং রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত শিল্প কারখানায় বিনিয়ন্ত্রণ। লগ্নি আকর্ষণে বিদেশি ব্যবসায় বিধিমালা সহজ করা। কর ফাঁকগুলো বন্ধ করে অভ্যন্তরীণ কর সংগ্রহ বাড়ানো ইত্যাদি।




বিয়র্ক স্কারলন্ড রিসাজার ডেনমার্কের অরহুস বিশ্ববিদ্যালয়ে তত্ত্বের ইতিহাস ও দর্শন বিভাগের পিএইচডি ফেলো। গবেষণায় তাঁর আগ্রহের বিষয়–

  • সামাজিক আন্দোলন ও অ্যাক্টিভজমঃ বিচারমূলক সামাজিক আন্দোলন তত্ত্ব, বামপন্থী আন্দোলন, ব্যয়সংকোচন-বিরোধীতা, আবাসন ও উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলন।

  • রাজনৈতিক অর্থনীতিঃ মার্কসবাদ, শ্রেণির পুনর্গঠন, শ্রেণি সংগ্রাম, অর্থায়ন, সাংস্কৃতিক এবং রোজকার রাজনৈতিক অর্থনীতি, আয়ের অনিশ্চয়তা।

  • মানব ভূগোলঃ নগর তত্ত্ব ও অধ্যয়ন, শহরে অধিকার, আবাসন, ভদ্রসম্মত বসবাসের প্রক্রিয়া, পরিসর সৃষ্টি।



প্রথম প্রকাশঃ ১২ই জুন, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ২রা জানুয়ারি, ২০২১

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/810874846411839/