নীটশে ও খোদার অন্তর্ধান

জঁ ভাহ্‌


[১৯৩০ এর দশকে ফরাসী চিন্তা দুনিয়া ফ্যাসীবাদীদের হাত থেকে নীটশেকে উদ্ধার করতে চেয়েছে। এই তৎপরতার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন জর্জ বাতাই। বাতাই সম্পাদিত আসেফালের পাতায় পাতায় নীটশে-উদ্ধার প্রকল্পের হদিস পাওয়া যায়। অস্তিবাদী দার্শনিক কার্ল ইয়েস্পার্স(Karl Jaspers)-এর Nietzsche বইয়ে হাজির ‘নীটশের’ ক্রিটিক করে ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত আসেফালের দ্বিতীয় সংখ্যায় জঁ ভাহ্‌ল(Jean Wahl) “বইয়ে হাজির ‘নীটশের’ ক্রিটিক করে ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত আসেফালের দ্বিতীয় সংখ্যায় জঁ ভাহ্‌ল “Nietzsche and the Death of God: A Note on Jaspers's : A Note on Jaspers's Nietzsche” শিরোনামে একটা লেখা লেখেন।


ইয়েস্পার্স যেখানে দাবী করছেন নীটশের কাজ মূলত লৌকিকতার ইচ্ছাকে (will to immanence) ঘিরে, সেখানে জঁ ভাহল প্রশ্ন করছেন এই লৌকিকতার ইচ্ছা লোকোত্তর হওয়ার ইচ্ছার (will to transcendence) ওপরে দাঁড়িয়ে থাকে কিনা।


পরবর্তীকালের ফরাসী চিন্তা জগতে নীটশে, কিয়ের্কেগার্দ ও হেগেল পাঠের নানান রূপের ঠিকুজি নির্ণয়ে জঁ ভাহ্‌ল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একজন দার্শনিক। ভাহ্‌ল অবশ্য বেশি পরিচিত হেগেলের দর্শনে অসুখী চৈতন্যের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করার জন্য। লি গেক্লে কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে “পরবর্তীকালের ফরাসী চিন্তা জগতে নীটশে, কিয়ের্কেগার্দ ও হেগেল পাঠের নানান রূপের ঠিকুজি নির্ণয়ে জঁ ভাহ্‌ল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একজন দার্শনিক। ভাহ্‌ল অবশ্য বেশি পরিচিত হেগেলের দর্শনে অসুখী চৈতন্যের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করার জন্য। লি গেক্লে কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে “Nietzsche and the Death of God: A Note on Jaspers's : A Note on Jaspers's Nietzsche” লেখাটি এখানে অনুবাদ করা হয়েছে।]




I - লৌকিকতা ও লৌকিক হবার বাসনা (IMMANENCE AND WILL TO IMMANENCE)


অন্যান্যরা যেখানে পরমকে হাজির রেখে দর্শন চর্চা করছেন, নীটশে করেছেন তার ঠিক উল্টোটা।

বলতে গেলে, নীটশে দর্শন চর্চা করছেন পরমের অনুপস্থিতির উপস্থিতিতে। এতে কোন সন্দেহ নেই যে এটা আরো ভয়াবহ। কিয়ের্কেগার্দ দাঁড়িয়ে আছেন “খোদার সম্মুখে” আর নীটশে দাঁড়িয়ে আছেন খোদার গলিত লাশের সামনে। আরো এগুলে, কিয়ের্কেগার্দ ভাবছেন যে খোদা আমার মরণ চায় আর নীটশে ভাবছেন মানুষকে নিরন্তর খোদার মরণ কামনা করতে হবে। এই মরণ নিছক কোন ফ্যাক্ট নয়, বরং একটা ইচ্ছার সক্রিয় কর্ম (action of a will)। মানুষ সত্যিকারের অর্থেই মহান, সত্য ও সৃষ্টিশীল, এই জন্য খোদাকে মরতেই হবে, তাকে মারতেই হবে, তাকে নাই হতেই হবে। মানুষকে খোদাবঞ্চিত করে আমি মানুষকে দিবো এক বিশাল উপহার। এটা হচ্ছে একই সাথে পুরোপুরি নিঃসঙ্গতা এবং মহান হয়ে ওঠার ও সৃষ্টিশীল হওয়ার অপার সম্ভাবনা।


মরণের মুখোমুখি দাঁড়ানোর ভয় উধাও হয়ে যায়। নীটশে বলছেন “এটা দেখে আমি আনন্দ পাই যে মৃত্যুচিন্তা নাই হওয়ার আগপর্যন্ত মানুষ আসলে চিন্তা করতে পারেনা”। আমরা যত আমাদের উর্ধ্বে উঠি[the cernitude and of value], এটাই আমাদের একমাত্র নিশ্চিত ব্যাপার এবং এটা এইভাবেই ভালো। একই সাথে এটা ভালো যে, “আমাদের জীবন যত বেশি পরিপূর্ণ ও মূল্যবান আমরা মুহুর্তের সুখানুভূতির জন্য সে জীবন দিয়ে দিতে তত বেশি প্রস্তুত থাকবো”। মরণের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ ভয়ডরহীন ভাবে কুর্নিশ করবেঃ প্রত্যেকে, তার নিজের মরণকে। নীটশে প্রায়ঃশই মরণকে ভুড়িভোজের(feast) ধারণার সাথে যুক্ত করেন। মৃত্যুর জন্য এক ভুড়িভোজের আয়োজন করো। মৃত্যুকে এক ভুড়িভোজে রূপান্তরিত করো। জীবনের প্রতারণার প্রতিশোধ নেয়ার এটাই হবে সর্বোত্তম উপায়।


II - লৌকিক হবার বাসনা ও লোকোত্তর হবার বাসনা (WILL TO IMMANENCE AND WILL TO TRANSCENDENCE)


ইয়েস্পার্স আমাদের বলছেন যে জগৎকে বিশুদ্ধ লৌকিক রূপে নিশ্চিত করাই হচ্ছে নীটশের দর্শনের সারবস্তু। এইখানে এই জগৎই হচ্ছে ‘আছে’, অর্থাৎ অস্তিত্বশীল। কিন্তু কিয়ের্কেগার্দের বিশ্বাস যেমনটা সন্দেহগ্রস্থ বিশ্বাস, নীটশের নেতির ক্ষেত্রেও তাই-ই। খোদার অনুপস্থিতি ভুলও না, সত্যও না। কিয়ের্কেগার্দে খোদার চিন্তা যেমন আসক্তি ও ইচ্ছা (passion and will), ঠিক তেমনি নীটশের ক্ষেত্রে খোদার অনুপস্থিতিও আসক্তি ও ইচ্ছা। আমরা যেমনটা দেখেছি, নীটশে খোদার মরণের বাস্তবতা যাপন করছে সেটা আকাঙ্ক্ষা করার মধ্য দিয়ে, কিন্তু একই সাথে এটা আকাঙ্ক্ষা না করার মধ্য দিয়েও। উনি খোদাকে চান আবার একই সাথে খোদার মৃত্যুও চান। এবং খোদা না থাকার চিন্তা খোদায়ী সৃষ্টিশীল প্রবৃত্তিকে নিজে নিজেই উপড়ে ফেলেনা। এটাই “existenzielle Gottlosigkeit” যা নিয়ে ইয়েস্পার্স আলাপ করছেন।


III - লোকোত্তর হওয়া (TRANSCENDENCE)


যে লোকোত্তর হওয়াকে নীটশে খারিজ করছেন তার দ্বারা তিনি আন্দোলিত হচ্ছেন, বিদ্ধ্ব হচ্ছেন। ইয়েস্পার্স প্রশ্ন করছেন, লোকোত্তরের প্রভাবে আচ্ছন্ন সত্তর বিনাশ ও কোরবানির যে রূপ, নিজেকে ছেড়ে যাওয়ার গুরু-গাম্ভীর্যতা যেটা নীটশে অর্জন করছেন তা একই রকম কিনা।


“তার সাথে সাথে একটা সার্বিক নঞর্থকতা রয়েছে। রয়েছে সত্তর সকল দিকের মুখোমুখি এক সীমাহীন অতুষ্টি। এটা পজিটিভিজম, ন্যাচারালিজম ও ম্যাটেরিয়ালিজমের ঠিক উল্টো। এবং অতুষ্টি ও নঞর্থকতার এই ধাক্কা এমন আসক্তি ও কোরবানি দানের বাসনা নিয়ে ঘটে, মনে হয় যেন প্রফেটদের মহান ধর্ম ও বিশ্বাসের মতই একই গভীরতা থেকে তা উৎসরিত।” নীটশের অনৈতিকতা হচ্ছে ভুল নীতির নেতি (negation)। ঠিক যেমনটা ইয়েস্পার্স আমাদের বলছেন, নীটশের খোদার নেতি মূলত সত্তর সাথে একটা খাঁটি যোগাযোগ, ‘হ্যাঁ’ এর নিশ্চিতকরণ ও সারবত্তার আকাঙ্ক্ষা (will to substance)। না যদি র‍্যাডিকাল হয়, সে নিজ শক্তি ও আসক্তির জোরে হ্যাঁ তে রূপ নিতে পারে। নাস্তিবাদকে (nihilism) সদর্থক দর্শনে রূপান্তরিত করতে পারে। এটা সবলের নাস্তিবাদ, কোনভাবেই আর দুর্বলের নাস্তিবাদ নয়। এই নাস্তিবাদে যা নিজেকে অতিক্রম করে যায়, যা নিজেকে খারিজ করে, তার মধ্যে সত্ত নিজেকে প্রকাশিত করে। যে যন্ত্রণা সে নিজের ভেতরে অনুভব করে,তার ভেতরে এক ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন খোদার যে ব্যথা, তার মাধ্যমে নীটশে সত্ত ও সময়ের গভীরতম প্রান্তে পৌঁছে যায়। নিরন্তর ফিরে আসার (eternal recurrence) চাকা আর অতিমানবের সবচাইতে দূরবর্তী দিগন্তে (সসীম ও অসীম) তার চোখ আটকে যায়। সে তার মধ্যে ইক্সিয়ন আর প্রমিথিউসের মিলন ঘটায়।


যদি দরকার আর ইচ্ছা মিলে যায়, মিলে যায় অতীত ও ভবিষ্যৎ; যদি সর্বোচ্চ নিয়তিবাদ আসে; যদি আসে নীটশের নিজের ভাষণের উপর ভর করে এটাকে সর্বোচ্চ তৎপরতার সাথে দৈবাৎ ও সৃষ্টির সাথে একিভূত করে । অবিরাম অতুষ্টির অসম্পূর্ণ ও অ্যাবসার্ড জগত যদি অবিনাশিতার মোহর ও বরপ্রাপ্ত হয়ে অনন্ত তুষ্টিতে পরিপূর্ণ জগতে রূপ নেয়, তবে তা কি এই কারণে নয় যে বিপরীতের অভিন্নতা আসলে সত্তর তূরীয় অভিব্যক্তি? এই কারণে কি নয় যে এটা কোন বর্গ দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়? এবং আমরা কি জানিনা যে সকল চক্র ও বিরোধাভাস (circles and antinomies) আসলে পরোক্ষভাবে ছুয়ে দেখার মাধ্যম মাত্র? আমরা কি জানিনা যে এই চক্র ও বিরোধাভাস থাকে ছায়ায় যা সকল বিধান, সকল কথা ও সকল আদলের উর্ধ্বে?

______________


হদিস- http://blogs.law.columbia.edu/nietzsche1313/files/2016/09/Nietzsche-and-the-Death-of-God_final.pdf


প্রথম প্রকাশঃ ২৭শে অক্টোবর, ২০১৯

সর্বশেষ সংশোধনঃ ২৭শে অক্টোবর, ২০১৯

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/351942432551087/