জাতি-রাষ্ট্রের বিউপনিবেশায়ন

আধুনিকতার উপনিবেশিক দিগন্তে জায়নবাদ


ওয়াল্টার ডি. মিনোলো



[ওয়াল্টার ডি. মিনোলো (Walter D. Mignolo) প্রখ্যাত আর্জেন্টাইন তাত্ত্বিক ও দার্শনিক। মিনোলো ডিউক ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। "লাতিন আমেরিকার সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ" নামে পরিচিত তৎপরতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক। সেমিওটিক্স, সাহিত্যতত্ত্ব এবং আধুনিক ও ঔপনিবেশিক দুনিয়ার নানান দিক (বৈশ্বিক উপনিবেশিকতা, জ্ঞানের ভূ-রাজনীতি প্রভৃতি) নিয়ে কাজের জন্য মশহুর। মিনোলো'র Decolonizing the Nation-State: Zionism in the Colonial Horizon of Modernity শীর্ষক প্রবন্ধটি ২০১৪ সনে প্রকাশিত Deconstructing Zionism: A Critique of Political Metaphysics নামক গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। মিনোলোর এই প্রবন্ধটি বাংলায় তর্জমা করেছেন গবেষক ও রাষ্ট্রচিন্তা জার্নালের সহ-সম্পাদক সহুল আহমদ।]



আলোচ্য বিষয়


জায়নবাদ সম্পর্কিত যে কোন আলাপচারিতা একটি মেরুকরণের দিকে ধাবিত হয়, কারণ জায়নবাদ ও ইহুদি ধর্ম দুটোকে অদলবদল করে গ্রহণ করা হয়। জায়নবাদ সম্পর্কিত পর্যালোচনামূলক আলাপচারিতাকে সাধারণত ইহুদি-বিরোধিতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আমি এখানে মার্ক এলিসের সূত্র অনুসরণ করছি: ‘ইহুদি ধর্ম এবং ইসরায়েল সমান নয়’।


আমি নিজে ইহুদি নই, আমি একজন ইতালীয় অভিবাসীর সন্তান, ক্যাথলিক শিক্ষায় শিক্ষিত। দীর্ঘমেয়াদে যা বিরাজ করছিল তা হচ্ছে আমার অভিবাসীজনিত পরিস্থিতি। আমি যখন পড়াশোনা করতে ফ্রান্সে এবং কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্রে যাই, তখনও সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। এই অভিজ্ঞতা আমাকে এই বিষয়ে সচেতন করে তোলে যে, সেক্যুলারবাদ ও আধুনিকতা গল্পের অর্ধেক মাত্র। বাকি অর্ধেককে, অর্থাৎ উপনিবেশিকতাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। এটা ঘটেছিল উপনিবেশিকতার মারফতে; এবং ফ্রান্সে শিক্ষার্থী থাকাকালে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিউপনিবেশায়নের জন্য সংগ্রামের মাধ্যমে আমি দেখতে পাই (বা শিখতে পারি) যে, উনিশ শতকের ইউরোপে জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভব কারো জন্য (বুর্জোয়াদের জন্য) সমাধান ও কারো জন্য সমস্যা হিসাবে হাজির হয়েছিল। ইউরোপে জাতি-রাষ্ট্রের রূপ ও মতাদর্শ একটি জাতীয় নাগরিক এবং অ-জাতীয়দের (অ-নাগরিকও) মধ্যকার এক স্পষ্ট বিভাজনের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু উপনিবেশগুলোতে এর ফলাফল হয়েছিল ভয়াবহ: উপনিবেশিকতার মাধ্যমে দখলকৃত দেশগুলোর মতোই সবখানে জাতি-রাষ্ট্রকে অবধারিতরূপে গ্রহণ করা হয়েছিল, যেমন চীন, জাপান, রাশিয়া, তুরষ্ক, ইরান ও অন্যান্য স্থানে।


অতএব, আমার যুক্তি হচ্ছে যে, যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র ইহুদি জনগণের জন্য একটি সমাধান পেশ করছিল, এটা একইসাথে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটা সমস্যা হয়ে উঠে। কারণ জায়নবাদী প্রকল্প একই সময় একটি স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনও ছিল, যে আন্দোলন আধুনিক ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রের মডেলের কাঁধে সওয়ার হয়েছিল, যা ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের খপ্পরেই পড়েছিল। এই কারণে ফিলিস্তিন/ইসরায়েলের সংঘাত সমাধানের জন্য শান্তিচুক্তির চাইতে বেশি কিছু দরকার— এর জন্য আধুনিক ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্রের গড়নকে বিউপনিবেশিকরণ করা দরকার।


১৬৮৮ সালের মহিমান্বিত বিপ্লব (Glorious revolution), ১৭৭৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের বিপ্লব এবং ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর জাতি-রাষ্ট্রের আবির্ভাব ও দৃঢ়ীকরণ, বিকশিত ইউরোপীয় বুর্জোয়াদের জন্য একটি সমাধান হিসাবে হাজির হয়েছিল। অভিলাষ ছিল গির্জা ও রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হাত থেকে স্বাধীন হওয়া। যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাংলো-ক্রিয়োলসের (Anglo-Creoles) জন্য একটি সমাধান ছিল ব্রিটিশ রাজতন্ত্র থেকে বিচ্ছেদ ঘটানো। তদুপরি একশো বছর (১৬৮৮-১৭৮৯) যাবত যে প্রক্রিয়া পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিল তা কারোর (আধুনিকতা) জন্য ভালো সমাধান ছিল, এবং অন্যান্যদের (উপনিবেশিকতা) জন্য অপমানজনক ছিল। ১৬৮৮ সালের মহিমান্বিত বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লব উদীয়মান ইউরোপীয় বুর্জোয়াদের (এথনো-শ্রেণি, ethno-class) রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে আরো সুদৃঢ় করে তোলে। যুক্তরাষ্ট্রের বিপ্লব আরেকটি নতুন উদীয়মান শ্রেণির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে দৃঢ় করে, সেই শ্রেণিটা হচ্ছে উপনিবেশোত্তর অভিজাত বা এলিট। উত্তর-উপনিবেশিক অভিজাত যখন নিজেকে স্বাধীনতার নামে জাহির করছিল, তখন একই সময়ে কয়েক লক্ষ আদিবাসী আমেরিকানকে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ও অধিকারচ্যুত (dispossess) করছিল। তার মানে, উত্তর-উপনিবেশিক রাষ্ট্র বিপ্লবীদের হাতেই উপনিবেশিকতাকে পুনরুৎপাদিত করেছিল


ইউরোপে গল্পটা ভিন্ন ছিল। সেখানে উৎখাত করার মতন কোন একটি ভিন্ন ‘জাতে’র (race) নিম্নতর সামাজিক স্তর ছিল না। এর পরিবর্তে উপনিবেশগুলোতেই জাতিগত উৎখাতের ঘটনা ঘটেছিল: প্রকৃতপক্ষে, ষোড়শ শতক থেকে উপনিবেশগুলো থেকে আহরিত সুযোগ-সুবিধা-সম্পদ দিয়ে ইউরোপ নিজেকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। ইউরোপের আধুনিকতা ও প্রগতির অর্থ হচ্ছে বাকি দুনিয়ার (উপনিবেশে) স্থবিরতা ও দুর্দশা। মুক্তি বা পরিত্রাণের বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তিতে, আধুনিকতা ও প্রগতি দুটো মৌল ধারণা হিসাবে হাজির হয়েছিল। স্থবিরতা ও দুর্দশা (যা আগে ছিল এবং এখনো বহাল তবিয়তে আছে) সম্পর্কে মুক্তি বা পরিত্রাণের বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তিগুলো নীরব রয়েছে। আধুনিকতার বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তার তলে উপনিবেশিকতার যুক্তিকে লুকিয়ে রাখা হয়। বিপ্লবগুলো প্রগতিশীল পরিবর্তনের নিশান হয়ে উঠে। তাদের অন্ধকার দিককে (উপনিবেশিকতা) এর উজ্জ্বল দিকের (আধুনিকতা) সুবিধার্থে বিসর্জন দেয়া হয়েছিল।