জাতি-রাষ্ট্রের বিউপনিবেশায়ন

আধুনিকতার উপনিবেশিক দিগন্তে জায়নবাদ


ওয়াল্টার ডি. মিনোলো



[ওয়াল্টার ডি. মিনোলো (Walter D. Mignolo) প্রখ্যাত আর্জেন্টাইন তাত্ত্বিক ও দার্শনিক। মিনোলো ডিউক ইউনিভার্সিটিতে পড়ান। "লাতিন আমেরিকার সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ" নামে পরিচিত তৎপরতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক। সেমিওটিক্স, সাহিত্যতত্ত্ব এবং আধুনিক ও ঔপনিবেশিক দুনিয়ার নানান দিক (বৈশ্বিক উপনিবেশিকতা, জ্ঞানের ভূ-রাজনীতি প্রভৃতি) নিয়ে কাজের জন্য মশহুর। মিনোলো'র Decolonizing the Nation-State: Zionism in the Colonial Horizon of Modernity শীর্ষক প্রবন্ধটি ২০১৪ সনে প্রকাশিত Deconstructing Zionism: A Critique of Political Metaphysics নামক গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। মিনোলোর এই প্রবন্ধটি বাংলায় তর্জমা করেছেন গবেষক ও রাষ্ট্রচিন্তা জার্নালের সহ-সম্পাদক সহুল আহমদ।]



আলোচ্য বিষয়


জায়নবাদ সম্পর্কিত যে কোন আলাপচারিতা একটি মেরুকরণের দিকে ধাবিত হয়, কারণ জায়নবাদ ও ইহুদি ধর্ম দুটোকে অদলবদল করে গ্রহণ করা হয়। জায়নবাদ সম্পর্কিত পর্যালোচনামূলক আলাপচারিতাকে সাধারণত ইহুদি-বিরোধিতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আমি এখানে মার্ক এলিসের সূত্র অনুসরণ করছি: ‘ইহুদি ধর্ম এবং ইসরায়েল সমান নয়’।


আমি নিজে ইহুদি নই, আমি একজন ইতালীয় অভিবাসীর সন্তান, ক্যাথলিক শিক্ষায় শিক্ষিত। দীর্ঘমেয়াদে যা বিরাজ করছিল তা হচ্ছে আমার অভিবাসীজনিত পরিস্থিতি। আমি যখন পড়াশোনা করতে ফ্রান্সে এবং কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্রে যাই, তখনও সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। এই অভিজ্ঞতা আমাকে এই বিষয়ে সচেতন করে তোলে যে, সেক্যুলারবাদ ও আধুনিকতা গল্পের অর্ধেক মাত্র। বাকি অর্ধেককে, অর্থাৎ উপনিবেশিকতাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। এটা ঘটেছিল উপনিবেশিকতার মারফতে; এবং ফ্রান্সে শিক্ষার্থী থাকাকালে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিউপনিবেশায়নের জন্য সংগ্রামের মাধ্যমে আমি দেখতে পাই (বা শিখতে পারি) যে, উনিশ শতকের ইউরোপে জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভব কারো জন্য (বুর্জোয়াদের জন্য) সমাধান ও কারো জন্য সমস্যা হিসাবে হাজির হয়েছিল। ইউরোপে জাতি-রাষ্ট্রের রূপ ও মতাদর্শ একটি জাতীয় নাগরিক এবং অ-জাতীয়দের (অ-নাগরিকও) মধ্যকার এক স্পষ্ট বিভাজনের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু উপনিবেশগুলোতে এর ফলাফল হয়েছিল ভয়াবহ: উপনিবেশিকতার মাধ্যমে দখলকৃত দেশগুলোর মতোই সবখানে জাতি-রাষ্ট্রকে অবধারিতরূপে গ্রহণ করা হয়েছিল, যেমন চীন, জাপান, রাশিয়া, তুরষ্ক, ইরান ও অন্যান্য স্থানে।


অতএব, আমার যুক্তি হচ্ছে যে, যখন ইসরায়েল রাষ্ট্র ইহুদি জনগণের জন্য একটি সমাধান পেশ করছিল, এটা একইসাথে ফিলিস্তিনিদের জন্য একটা সমস্যা হয়ে উঠে। কারণ জায়নবাদী প্রকল্প একই সময় একটি স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনও ছিল, যে আন্দোলন আধুনিক ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রের মডেলের কাঁধে সওয়ার হয়েছিল, যা ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের খপ্পরেই পড়েছিল। এই কারণে ফিলিস্তিন/ইসরায়েলের সংঘাত সমাধানের জন্য শান্তিচুক্তির চাইতে বেশি কিছু দরকার— এর জন্য আধুনিক ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্রের গড়নকে বিউপনিবেশিকরণ করা দরকার।


১৬৮৮ সালের মহিমান্বিত বিপ্লব (Glorious revolution), ১৭৭৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের বিপ্লব এবং ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর জাতি-রাষ্ট্রের আবির্ভাব ও দৃঢ়ীকরণ, বিকশিত ইউরোপীয় বুর্জোয়াদের জন্য একটি সমাধান হিসাবে হাজির হয়েছিল। অভিলাষ ছিল গির্জা ও রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হাত থেকে স্বাধীন হওয়া। যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাংলো-ক্রিয়োলসের (Anglo-Creoles) জন্য একটি সমাধান ছিল ব্রিটিশ রাজতন্ত্র থেকে বিচ্ছেদ ঘটানো। তদুপরি একশো বছর (১৬৮৮-১৭৮৯) যাবত যে প্রক্রিয়া পৃথিবীকে বদলে দিয়েছিল তা কারোর (আধুনিকতা) জন্য ভালো সমাধান ছিল, এবং অন্যান্যদের (উপনিবেশিকতা) জন্য অপমানজনক ছিল। ১৬৮৮ সালের মহিমান্বিত বিপ্লব ও ফরাসি বিপ্লব উদীয়মান ইউরোপীয় বুর্জোয়াদের (এথনো-শ্রেণি, ethno-class) রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে আরো সুদৃঢ় করে তোলে। যুক্তরাষ্ট্রের বিপ্লব আরেকটি নতুন উদীয়মান শ্রেণির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণকে দৃঢ় করে, সেই শ্রেণিটা হচ্ছে উপনিবেশোত্তর অভিজাত বা এলিট। উত্তর-উপনিবেশিক অভিজাত যখন নিজেকে স্বাধীনতার নামে জাহির করছিল, তখন একই সময়ে কয়েক লক্ষ আদিবাসী আমেরিকানকে স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ও অধিকারচ্যুত (dispossess) করছিল। তার মানে, উত্তর-উপনিবেশিক রাষ্ট্র বিপ্লবীদের হাতেই উপনিবেশিকতাকে পুনরুৎপাদিত করেছিল


ইউরোপে গল্পটা ভিন্ন ছিল। সেখানে উৎখাত করার মতন কোন একটি ভিন্ন ‘জাতে’র (race) নিম্নতর সামাজিক স্তর ছিল না। এর পরিবর্তে উপনিবেশগুলোতেই জাতিগত উৎখাতের ঘটনা ঘটেছিল: প্রকৃতপক্ষে, ষোড়শ শতক থেকে উপনিবেশগুলো থেকে আহরিত সুযোগ-সুবিধা-সম্পদ দিয়ে ইউরোপ নিজেকে শক্তিশালী করে তুলেছিল। ইউরোপের আধুনিকতা ও প্রগতির অর্থ হচ্ছে বাকি দুনিয়ার (উপনিবেশে) স্থবিরতা ও দুর্দশা। মুক্তি বা পরিত্রাণের বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তিতে, আধুনিকতা ও প্রগতি দুটো মৌল ধারণা হিসাবে হাজির হয়েছিল। স্থবিরতা ও দুর্দশা (যা আগে ছিল এবং এখনো বহাল তবিয়তে আছে) সম্পর্কে মুক্তি বা পরিত্রাণের বাগাড়ম্বরপূর্ণ উক্তিগুলো নীরব রয়েছে। আধুনিকতার বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তার তলে উপনিবেশিকতার যুক্তিকে লুকিয়ে রাখা হয়। বিপ্লবগুলো প্রগতিশীল পরিবর্তনের নিশান হয়ে উঠে। তাদের অন্ধকার দিককে (উপনিবেশিকতা) এর উজ্জ্বল দিকের (আধুনিকতা) সুবিধার্থে বিসর্জন দেয়া হয়েছিল।

ওয়াল্টার ডি. মিনোলো



ইসরায়েল রাষ্ট্র অবশ্য ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বা যুক্তরাষ্ট্রের মতন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র নয়। তদুপরি জমি দখল করে প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রের ভিত্তিকে বৈধতাপ্রদানকারী ডিসকোর্সগুলো, বাইবেলকে উদ্ধৃত করে পূর্বতন সাম্রাজ্যবাদী ডিসকোর্সগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছিল। আইরিশ ধর্মতাত্ত্বিক মিশেল প্রিয়োর দৃঢ়ভাবে যুক্তি দেখান যে, নির্বাচিত জনগণ ও তাদের অধিকারের ওপর বর্ণিত একই ধরনের বাইবেলীয় যুক্তি স্পেনীয়দের আমেরিকা দখলে, আমেরিকার জাতি-রাষ্ট্র গঠনে, দক্ষিণ আফ্রিকায় ইউরোপীয়দের উপনিবেশায়নে এবং ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় দেয়া হয়েছিল। আবার ইসরায়েল রাষ্ট্র ভারত (ভারতীয় রিপাবলিক, ১৯৪৭), মিশর (১৯৫৩) বা আলজেরিয়ার (১৯৬২) মতন জাতি-রাষ্ট্র নয়। ভারত, মিশর বা আলজেরিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, যেখানে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে। ফলে আমি জায়নবাদী রাষ্ট্রের চাইতে জায়নবাদী রাষ্ট্রের দিকে নজর দিতে প্রস্তাব করি।

ইহুদি ধর্ম ও ইসরায়েল সমান নয়


জায়নবাদ-বিরোধী যুক্তি দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। এখানে সর্বাধিক র‍্যাডিক্যাল কণ্ঠস্বরগুলোর মধ্যে একজন হচ্ছেন ইহুদি মার্কিন নাগরিক মার্ক এলিস। (এই সংকলনেও তাঁর একটি অধ্যায় রয়েছে)। ‘যে-ইহুদি ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়িয়েছেন’ তাঁকে ইহুদি-বিদ্বেষী (অ্যান্টি-সেমাইট) মনে হতে পারে। জাতি-রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে এই অভিযোগ সাধারণ ও যৌক্তিক। বুশ-চেনি জমানায়, রাষ্ট্রের সমালোচনাকে নেশন বা জাতি’র সমালোচনা হিসাবেই গ্রহণ করা হয়েছে এবং শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু অবশ্যই সেটা জায়নবাদ-বিরোধী হিসাবে নয়, বরঞ্চ দেশপ্রেম-বিরোধী হিসাবে। বিষয়বস্তু আলাদা হলেও যুক্তিটা কিন্তু একই। যতক্ষণ পর্যন্ত ‘প্যাট্রিয়া (Patria)’কে [মানে স্বদেশ, হোমল্যান্ড ইত্যাদি] আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের সাথে মিলিয়ে চিহ্নিত করা হচ্ছে, যেখানে কিনা একটি রাষ্ট্র একটি জাতির অনুরূপ, ততক্ষণ পর্যন্ত নিজ রাষ্ট্রের সমালোচনাকারী নাগরিক অ্যান্টি-ন্যাশনালিস্ট বা জাতীয়তা-বিরোধী হিসাবেই অভিযুক্ত হবেন। এই নাগরিকরা নিজ জাতির বিরুদ্ধে চলে যান, মানে নিজস্ব রাষ্ট্রীয় পরিচয় গঠনের প্রক্রিয়াতে যুক্ত সমরূপ [হোমোজেনাস, সমসত্ত্ব] সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চলে যান। এই ধরনের রাষ্ট্র-সমালোচনা আসলে অ-আমেরিকানসুলভ, কারণ এটা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল নীতির বিরুদ্ধে ছিল। এই জটিল দৃশ্যে, এলিস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক। তদুপরি তিনি তাঁর ইহুদি পরিচয়কেও ধারণ করেন, এথনিক ও ধর্মীয়ভাবে। তাঁর জায়নবাদের সমালোচনা ইসরায়েলের ইহুদি ও অভিবাসী [ডায়াস্পোরা] ইহুদিদেরকে যেমন বিবেচনা করে, তেমনি ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির ভূমিকাকেও আলাপে তোলে।


এলিসের যুক্তির মূল খুঁটি হচ্ছে যে, ‘ইহুদি ধর্ম ও ইসরায়েল সমান নয় (Judaism does not equal Israel)’। বইতে তাঁর মুখবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদে এলিস স্বচ্ছতার সাথে তাঁর যুক্তিকাঠামোকে তুলে ধরেন :


ইহুদি জীবনের অভাবনীয় প্রভাবশালী ও মৌলিক নির্দেশক হচ্ছে প্রফেটিক বা ভবিষ্যদ্বাণী। এই ভবিষ্যদ্বাণী ছাড়া ইহুদি জীবনকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এটাই সর্বদা ইহুদিবাদকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। এই বইতে আমি ইহুদিবাদের ভবিষ্যদ্বাণীমূলক চিহ্নটিকে আধুনিক ইসরায়েলের সাথে যুক্ত এর দুর্নীতিগ্রস্থ— এবং সম্ভাব্য সর্বনাশা— পরিচয়ের বিরুদ্ধে ধারণ করেছি। আমি দুনিয়ার ইহুদি জীবনের জন্য একটি প্রফেটিক ও সঞ্জীবনী উপায় পেশ করেছি।


যদিও এই অনুচ্ছেদে ‘আধুনিক ইসরায়েল’ শব্দবন্ধ আলাদাভাবে করা হয়নি, কিন্তু নিঃসন্দেহে এটাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার ফজিলত আছে। কেননা, ১৯৪৮ সালের ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম এশিয়া ও আফ্রিকার বিউপনিবেশয়ানের আন্দোলনের সাথে সামসাময়িক। এর মানে হচ্ছে যে, যখন এশিয়া ও আফ্রিকায় বিউপনিবেশায়ন আন্দোলনের সূত্রপাত হচ্ছে, তখন ইসরায়েল রাষ্ট্রের উদ্ভব ভারত বা আলজেরিয়ার মতো বিউপনিবেশিত রাষ্ট্রের মত হয় নি। বরঞ্চ একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে এর উদ্ভব হয়েছে। ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা এবং বিউপনিবেশায়ন আন্দোলনের পরিণতি যতক্ষণ পর্যন্ত বিবেচ্য, ততক্ষণ এই রাষ্ট্র-কাঠামোর সঙ্কটগুলো সমান, এমনকি যদিও এর ফলাফল ও পরিণাম বেশ আলাদা। এই বিষয়ে আমি পরে ফিরে আসবো।


‘ইহুদি ধর্ম ও ইসরায়েল সমান নয়’ এই বিষয় নিয়ে আরো কিছুক্ষণ আলোচনা করতে চাই। এলিসের বইয়ের শুরুতেই বিশপ ডেসমন্ড টুটুর লেখা একটি মুখবন্ধ রয়েছে, যা শুরু হয়েছে এভাবে: ‘আমার হিব্রু পূর্বসূরীগণ ও তাঁদের বাইবেলের জন্য ঈশ্বরের কাছে অশেষ শুকরিয়া’। এই মুখবন্ধে তিনি আরো লিখেন:


একটি ন্যায়পরায়ণ ও যত্নশীল দুনিয়ার জন্য ইহুদীরা অপরিহার্য। তাঁদের ধর্মীয় কিতাব ও ধর্মীয় আহ্বানে (প্রফেটিক ভোকেশন) বিশ্বাসী ইহুদীদের আমাদের প্রয়োজন; এগুলো দুনিয়ার নৈতিকতার জন্য জরুরি, মজলুমকে মুক্ত করার জন্য এবং ন্যায়পরায়ণ দুনিয়ার জন্য।


বিশপ টুটু বহু-ধর্মীয় ও বহু-জাতিক দুনিয়া গড়ে তোলার আমাদের প্রচেষ্টায় ইহুদি ধর্ম ও এর অবদানকে স্বীকার করেন। (আমাদের বলতে বোঝানো হচ্ছে ‘আমরা সবাই’ যারা কাজ করছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং একটি ন্যায়পরায়ণ দুনিয়া প্রতিষ্ঠার জন্য যা কিনা সকল অনায্যের ভিত্তিকে সরিয়ে দিবে।) এরপর বিশপ টুটু এলিসের কেন্দ্রীয় যুক্তিতে যান:


ইসরায়লে রাষ্ট্রের সাথে ইহুদি ধর্মের সমতুল্যতা ধর্মীয় কেতাবের শক্তি ও সত্যতাকে অপ্রাসঙ্গকিতার হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে, যে কেতাব যুগ যুগ ধরে ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস স্থাপনে প্রেরণা যুগিয়েছে এবং ভিত্তি দিয়েছে। ফিলিস্তিনের জনগণের সাথে ইসরায়েলের ব্যবহার আমাকে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যের নীতি-কালীন কেপটাউনের কথা মনে করিয়ে দেয়: কালোদেরকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া, দূরের শহরের ঘেটোতে নিয়ে যাওয়া, অবৈধ দেয়াল = জনগণের আদিজমি দখল করা, পরিবারকে বিচ্ছেদ করে ফেলা, সম্পদকে বিভক্ত করে ফেলা এবং সামরিক চৌকির দুঃস্বপ্ন। (vii-viii)


এই মুখবন্ধের বাইরেও বিশপ টুটুর ইসরায়েলকে কোণাঠাসা করার প্রচেষ্টার সাথে সবাই পরিচিত। কয়েক বছর আগে তিনি টিচার্স ইন্স্যুরেন্স অ্যান্ড এনুইটি এ্যাসোসিয়েশনের (Teachers Insurance and Annuity Association) যুক্তরাষ্ট্রের পেনশন তহবিলকে ইসরায়েলী কোম্পানির সাথে তাদের অংশীদারিত্ব ছিন্ন করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ইসরায়েলে অস্ত্র অবরোধ প্রলম্বিত করার জন্য টুটু প্রচারণা চালিয়েছিলেন। কেপটাউনে তিনি সময়ে-সময়ে ‘ইসরায়েল বিরোধী রাসেল ট্রাইব্যুনাল’-এর সমাবেশ আয়োজন করা শুরু করেছিলেন। তিনি ইসরায়লের বেন-গুরিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ বিশ্বাবিদ্যালয়ের সম্পর্ক বন্ধ করতেও অবদান রেখেছিলেন। এসবের জন্য তাঁকে ইহুদী-বিদ্বেষী বলে আক্রমণ করা হয়েছে। বিশপ ডেসমন্ড টুটু খোলামেলাভাবে এবং স্পষ্টভাবেই জায়নবাদ-বিরোধী। এর মানে এটা বোঝায় না যে, তিনি ইহুদি-বিদ্বেষী।

এই তর্ক-বিতর্কে ‘আপনি আমাদের পক্ষে অথবা বিপক্ষে’ এই জায়গা থেকে রেহাই পাওয়া প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়, যেন আপনি যদি জায়নবাদ-বিরোধী হয়ে থাকেন তাহলে আপনাআপনি ইহুদি-বিদ্বেষীও। ফিলিস্তিন/ইসরায়েল সঙ্কটের সমাধানের অন্যতম প্রধান মৌলিক শর্ত হচ্ছে ধর্ম, জাতি ও রাষ্ট্রের এই জেলখানাকে অতিক্রম করা। অন্যটা হচ্ছে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে আধুনিকতা/উপনিবেশিকতা’র বৈশ্বিক কাঠামোতে বুঝতে পারা। এই জেলখানা থেকে রেহাই পাওয়ার মুশকিলগুলো যেন আমাদেরকে ইহুদি ধর্ম থেকে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে ধারণাগতভাবে বিচ্ছিন্ন করতে বিরত না রাখে।


যে-ধার্মিক ইহুদিরা ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে জায়নবাদের সমালোচনা করতেন, তাঁরা বিশেষত ১৯৬৭ সালের ‘ষাট-দিনের যুদ্ধে’র পর এখন স্পষ্ট ও দৃঢ় সমর্থন প্রদান করেন।১০ জট পাকানো ঝামেলাগুলো এই বাস্তবতা থেকে উৎসারিত। সম্ভবত এর একটা কারণ হতে পারে ‘রাষ্ট্রে’র চাইতে ‘জায়নবাদে’র (ধর্মীয় কিংবা সেক্যুলার) দিকে মনোযোগ ধাবিত করা। এটাও উল্লেখ করা দরকার, ১৯৪৮ সালে যেখানে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের বদৌলতে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, সেখানে ‘ষাট-দিনের যুদ্ধ’ ইসরায়েল রাষ্ট্রকে তার ভৌগলিক ও জাতিগত প্রকল্পকে দৃঢ় করার প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছিল। ফিলিস্তিনিদের অবস্থান থেকে এই দুটো মুহূর্তই ছিল ক্ষতিকারক: ১৯৪৮ সালে ইসরাইলী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তাঁদেরকে উচ্ছেদ করেছিল; ১৯৬৭ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র পূর্বতন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মত প্রচণ্ড উপনিবেশিক কায়দা-কানুন প্রয়োগ করেছিল। তবু ইসরায়েলকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসাবে দেখা হয়না, যদিওবা সাম্রাজ্যবাদী/উপনিবেশিক কায়দাকানুন ও যুক্তি কার্যত ১৯৬৭ থেকেই ক্রিয়াশীল।


পরবর্তী অংশে আমি আধুনিকতার উপনিবেশিক দিগন্তের মধ্যে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে দেখবো, এবং এর ফলস্বরূপ যে-রাষ্ট্রের ওপর জায়নবাদ ভর করে আছে সেই রাষ্ট্রের বিউপনিবেশীকরণের সম্ভাবনার দিকে মনোযোগ দেব। রাষ্ট্রকে বিউপনিবেশীকরণ করার মানে হলো, প্রথমত রাষ্ট্রের ধরনে/গড়নে অন্তর্নিহিত উপনিবেশিকতা’র যুক্তিকে উন্মোচন করা, পাশাপাশি মুক্তি ও গণতন্ত্রের বাগাড়ম্বরপূর্ণ আলাপচারিতার আবরণকে উন্মোচন করা। রাষ্ট্রকে বিউপনিবেশীকরণ করারটা নিশ্চিতভাবেই একটি ধারণাগত ও দার্শনিক বিষয়। আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র প্রায় তিন শত বছরের পশ্চিমা রাজনৈতিক তত্ত্ব দ্বারা সমর্থিত। রাষ্ট্রকে বিউপনিবেশীকরণ করার মানে হচ্ছে পশ্চিমা রাজনৈতিক তত্ত্বের ধারণাগত যুক্তি ও [তার] আঞ্চলিক ইতিহাসের প্রভাবকে হ্রাস করা।১১


পশ্চিমা বর্ণ সংক্রান্ত রূপরেখা, জাতি-রাষ্ট্র, এবং আধুনিকতার ধারণা


ইসরায়েল রাষ্ট্র বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারবাদ ও বিশ্বায়নের ঐতিহাসিক চৌরাস্তায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আধুনিক ও সেক্যুলার ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্র (মানে, আলোকায়ন-উত্তর) চার্চ ও রাজতন্ত্র১২ দ্বারা পরিচালিত বিশ্বাসী (খ্রিষ্টান ও ইহুদী) সম্প্রদায়ের ধর্মতাত্ত্বিক গঠনকে স্থানচ্যুত করেছিল এবং সেক্যুলার রাষ্ট্র দ্বারা পরিচালিত জন্মগত সম্প্রদায় (natio) দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছিল। যে ‘সেক্যুলার ইহুদিরা’ জায়নবাদী প্রকল্পকে প্রচার করেছিলেন মধ্য-ইউরোপে তাঁদের উত্থান এই সন্ধিক্ষণেই ঘটেছিল। জায়নবাদের রাজনৈতিক ও বর্তমান প্রধান শাখাটির উত্থান অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা, দক্ষিণ আফ্রিকা বা এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে অকল্পনীয় ছিল।১৩ ইউরোপের জাতি-রাষ্ট্রের দ্যুতি উদীয়মান এথনো-শ্রেণি, মানে বুর্জোয়াদেরকে রাজতন্ত্র ও খ্রিষ্টান গির্জার যৌথ জোটকে উচ্ছেদ করে এক জাতিকে এক রাষ্ট্রে এঁটে দেয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল।


ইউরোপে এক জাতিকে এক রাষ্ট্রের সাথে সংযুক্ত করা সম্ভব হয়েছে প্রধানত সাদা, ইউরোপীয় ও খ্রিষ্টান জনগণের সাপেক্ষিক সমরূপতার কারণে। ইউরোপ ও উপনিবেশিত অঞ্চলে, দুইজায়গাতে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে আরো পরে। কেননা ইউরোপের বাইরে দুনিয়াতে খুব একটা বেশি অঞ্চল নাই যেখানে একটা জাতি দিয়ে একটা রাষ্ট্র হতে পারে। এমনকি ইউরোপেও আগে এটা সম্ভব হলেও এখন আর তেমন নয়। অভিবাসন পশ্চিমা ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রকে একটি সম্ভাব্য বহু-জাতিক রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, অথবা এমন কোন শাসনব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে যা আমরা এখনো কল্পনা করতে পারছি না। প্রতিটি আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র যে সমাধান-অযোগ্য সঙ্কটগুলোর সম্মুখীন হয় ইসরায়েল রাষ্ট্র শুরু থেকেই সেগুলোর সম্মুখীন হচ্ছে : নিজের নাগরিকদের ভালো-মন্দের দেখভাল করা এবং জাতি-রাষ্ট্রের সাপেক্ষে বাদ-বাকি সবাইকে সন্দেহজনক বা ঊন-মানুষ এবং খরচযোগ্য হিসাবে বিবেচনা করা। এখান থেকে এবং অবশ্যই পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্যই জাতি-রাষ্ট্রের আইনগত বৈধ সহিংসতাকে অতিক্রম করা অত্যাবশ্যকীয়।


ইউরোপে নাজিবাদের অধীনে এক জাতি ও এক রাষ্ট্রের সমরূপতাকে কেন্দ্র করে মতাদর্শ তীব্র আকার ধারণ করেছিল, এতে প্রায় ১.৬ কোটি লোক প্রাণ হারিয়েছিলেন, এর মধ্যে জার্মানি ও অ-জার্মানি মিলিয়ে প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি ছিলেন। জার্মান রাষ্ট্রের জেনোসাইড এবং হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমাহামলা (যা কিনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতি ঘটিয়েছিল) মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের শর্ত তৈরি করে দিয়েছিল : পশ্চিমা সভ্যতার নিরাপত্তার সমান্তরালে জাতির নিরাপত্তাও চলেছিল। অর্থাৎ, মানবাধিকারের ডিসকোর্স একটি দো-ধারী তলোয়ার: কিছু সুনির্দিষ্ট মূল্যবোধ রক্ষাকারী ব্যক্তির সম্মান ও সুরক্ষা জারির জন্য এগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে, এবং সেই একই মূল্যবোধের অজুহাতে এগুলোকে লঙ্ঘন করা যেতে পারে।১৪


এভাবেই যখন জার্মান পরিচালিত জেনোসাইড বা গণহত্যা১৫ এক জাতিকে এক রাষ্ট্রের খোপে আটকে ফেলার মতাদর্শ ও রূপের অভ্যন্তরীণ সীমার পরিণতি ছিল, তখন হিরোশিমা ও নাগাসাকি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে (যা তাদেরকে ‘হলদে বিপদে’র১৬ প্রতিনিধি বানিয়েছিল) একই মতাদর্শের পরিণাম ছিল। “এক জাতি, এক রাষ্ট্র” মডেলটি পশ্চিমা সভ্যতার খুঁটি হয়ে উঠেছিল। হিটলার ও জাপানের হিরোহিথো’র পরাজয় আধুনিক ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রের রাজনৈতিক রূপটিকে ইউরোপে ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও দৃঢ় করেছিল। ১৯৪১ সালে পার্ল হারবারে জাপানি বোমা-হামলার পর থেকে পশ্চিমা সভ্যতার প্রতি জাপানি ‘হলদে বিপদ’কে পশ্চিমা ইউরোপীয় রাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্র রুখে দিয়েছিল। তদপুরি, ইউরোপের ইতিহাসে যেখানে জাতি-রাষ্ট্রের রূপ ‘স্বাভাবিকভাবেই’ আবির্ভূত হয়েছিল, সেখানে অ-ইউরোপীয় দুনিয়ায় এটা ছিল জোরপূর্বক আরোপ বা জোরপূর্বক অভিযোজন। উনিশ শতকের দক্ষিণ আমেরিকাতে (ফরাসি যুক্ততার কারণে ‘লাতিন’ আমেরিকা হিসাবে রাষ্ট্রগুলো গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েছিল) এবং বিশ শতকে এশিয়া ও আফ্রিকাতে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র জোরদার হয়ে উঠেছিল আদতে এই কারণেই যে, আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রকে একমাত্র সমাধান হিসাবে জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। যে ইতিহাস ও সংবেদনশীলতার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, তার কাছে এই ধরনের শাসনব্যবস্থা/সরকারব্যবস্থা অপরিচিত বা বেমানান ছিল। কিন্তু এই ধরনের মুশকিলজনক অভিজ্ঞতা এবং/বা ইউরোপের বাইরে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের ব্যর্থতার বিপরীতে ইসরায়েল সফল ছিল।


কেন ইসরায়েল রাষ্ট্র সফল হলো যেখানে আফ্রিকা ও এশিয়ার জাতিরাষ্ট্রগুলোকে নানামুখী জঞ্জাট সহ্য করতে হচ্ছে, যার সর্বশেষ পরিণতি আমরা সাম্প্রতি উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি? এমনকি ‘লাতিন’ আমেরিকাতে উনিশ শতকে যে রিপাবলিকগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেগুলো এখনো জাতি-রাষ্ট্রের গঠন নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে। লাতিন আমেরিকায় নির্ভরতা তত্ত্ব এটার একটা উত্তর দিয়েছিল: নতুন উদ্ভূত রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নির্ভরতা। আফ্রিকা ও এশিয়াতেও এই তত্ত্ব গৃহীত হয়েছিল। মূল যুক্তিটা ছিল অর্থনৈতিক নির্ভরতা, যদিও সেটা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক নির্ভরতার বাস্তবতাকেই নির্দেশ করেছিল। আজতক কেবল বলিভিয়া ইভো মোরালেসের নির্বাচনের পর জাতি-রাষ্ট্রের আধুনিক ধরন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল: বিদ্যমান গড়নের পুনর্গঠন অথবা বিউপনিবেশায়ন বর্তমান বিতর্কের একেবারে কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল। তা সত্ত্বেও ইসরায়েল রাষ্ট্রের উদ্ভব ভারত, আলজেরিয়া বা মিশরের মতন স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম (যেখানে কিনা সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসন ও সামরিক ব্যবস্থাকে উৎখাত করেছিল) থেকে ঘটেনি। উল্টো ইসরায়েল রাষ্ট্র সেই সাম্রাজ্যবাদি শক্তিগুলোর সমর্থনই পেয়ে আসছিল যেগুলোকে অন্যান্যরা উৎখাত করার জন্য লড়াই করছিলেন। তদুপরি, এটা উল্লেখ করা দরকার যে, ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে ফিলিস্তিনের জায়নবাদী ও আরবরা ব্রিটিশদের মোকাবিলা করছিলেন; ব্রিটিশরা ১৯১৭-১৯৪৮ এর মধ্যে, অটোমান সুলতানের পতনের পরপর, এই অঞ্চলকে দখল করে নেয় (এই বিষয়ে আমি পরে আবার ফিরে আসবো)।


ইসরায়েল রাষ্ট্রের ভিত্তি বিউপনিবেশায়নের ফলে সৃষ্ট নতুন রাষ্ট্রগুলোর চাইতে কেবল আলাদাই ছিল না, বরঞ্চ ষোড়শ শতক থেকে কাস্তিলে, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রে চালু হওয়া দখলদারিত্ব জায়েজিকরণের যুক্তিগুলোও হাজির করছিল।১৭ মিলটা লক্ষ্যনীয়। নয়া দুনিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতে (জমি বা সম্পদ থেকে) অধিকারচ্যুত করা হয়েছিল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের (স্পেন, ইংল্যান্ড, হল্যান্ড) সমর্থনে ও তাদের মাধ্যমে সেটা প্রণীত হয়েছিল। জায়নবাদের ক্ষেত্রে অধিকারচ্যুত করা হয়েছিল রাষ্ট্রবিহীন জনগণের (যেমন ডায়াস্পোরা থেকে যারা আসছেন) নিজস্ব রাষ্ট্র নির্মাণের প্রক্রিয়ার সমর্থনে এবং তাদের মাধ্যমে সেটা প্রণীত হয়েছিল। তদুপরি, ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ও ধারাবাহিকতা সম্ভব হয়েছে প্রধানত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের সমর্থনে— প্রক্রিয়ার শুরুতে ব্রিটেনের সমর্থন এবং ১৯৬৭ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন।


একটা লক্ষ্যণীয় প্যারাডক্স হচ্ছে যে, বিউপনিবেশায়ন প্রক্রিয়ার থেকে উদ্ভূত রাষ্ট্রগুলো হয় ব্যর্থ হয়েছে (মিসর, তিউনিশিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া), অথবা নিজের রাস্তা খুঁজে পেতে বেশ ঝঞ্জাট পোহাতে হয়েছে (নাইজেরিয়া, ভারত), অথবা একটি দোসরা বিউপনিবেশায়নের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে (ম্যান্ডেলা’র দক্ষিণ আফ্রিকা), অথচ ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং দৃঢ় হয়েছে। এই প্রক্রিয়াতে ফিলিস্তিনিরা উত্তরাধুনিক উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীতে (ইউরোপীয় বসতি ও দখল করার পূর্বে যেমন আমেরিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে বসবাসরত আদিবাসীরা ছিল) পরিণত হয়েছে, ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইসরায়েল রাষ্ট্রের আইনের দ্বারা ফিলিস্তিনিরা অধিকারচ্যুত (dispossession) হচ্ছেন। প্রথম ধরনের উপনিবেশিক অধিকারচ্যুতকরণের পাশাপাশি ইসরায়েল রাষ্ট্র দ্বিতীয় মাত্রার অধিকারচ্যুতকরণ শুরু করেছে।


ইউরোপীয় সেক্যুলারবাদ ও রাজনৈতিক জায়নবাদের আবির্ভাব


পনের শতকের শেষের দিকে ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে যে ধরনের সম্পর্কই থাকুক না কেন সেটা পনের শতকের শেষের দিকে এবং ষোল শতকে ঘুরে যায়। এই সিমান্টিক রূপান্তরের (semantic mutation) ফলে চার শতাব্দী পরে জায়নবাদের আবির্ভাব ঘটে। কীভাবে?


আইবেরিয় উপত্যকা থেকে ইহুদিদের বিতাড়নের সাথে মিসর থেকে ইহুদিদের হিজরতের (exodus) যেমন মিল আছে, তেমনি অমিলও আছে।১৮ এমনকি যদিও অ-ইহুদি বিবরণে আমরা হিজরতকে স্বেচ্ছায় প্রস্থান না বলে বিতাড়ন বা বহিষ্কার হিসাবে ব্যাখ্যা করি, তবু পার্থক্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই গল্পের বর্তমান অবস্থার সাথে প্রাসঙ্গিক : মিসর ত্যাগ করার কালে মুসা’র নেতৃত্বে ইহুদিরা খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল না। তাদের প্রস্থান স্বেচ্ছায় বা জোরজবরদস্তিমূলক, (মিসর থেকে) হিজরত বা (আইবেরিয় উপত্যকা থেকে) জোরপূর্বক বিতাড়ন যাই হোক না কেন, দুটো ক্ষেত্রেই (যাদেরকে রেখে আসা হয়েছিল এবং যারা বহিষ্কার করেছিল উভয় দ্বারা) ইহুদিদেরকে অবাঞ্চিত হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। কিন্তু হিজরতের ক্ষেত্রে, ইহুদিরা এক ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাসের কারণে প্রধানত অবাঞ্চিত ছিল, এবং এই বিশ্বাস মিসরীদের বহু-ঈশ্বরবাদী জগতের চাইতে ইহুদি সম্প্রদায়গুলোর মধ্যেই সে মনোভাবের জন্ম দিয়েছিল। হিজরতের কালে আরবরা তখনো মিসরে ছিল না, (আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৪৪১) এবং খ্রিষ্টান ধর্মের জন্মও তখন হয়নি। অন্যদিকে ইহুদিরা যখন আইবেরিয় উপত্যকা থেকে বহিষ্কৃত বা বিতাড়িত হয়েছিল, তখন তাদের সাথে খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের মিথস্ক্রিয়া চলছিল। কিন্তু সে সময়ে খ্রিষ্টানরা ক্ষমতাবান ছিল এবং খ্রিষ্টান ভূমি থেকে ইহুদি ও মুসলমানদেরকে বিতাড়িত করতে সক্ষম ছিল। ইউরোপীয় রেনেসাঁর কালে আধুনিক পশ্চিমা ক্রিশ্চিয়ানিটি এভাবেই জাতি-রাষ্ট্র গঠনের নীলনকশা তৈয়ার করে ফেলে: ‘রক্তের শুদ্ধতা’ নীতির ওপর সমজাতীয় বিশ্বাসীদের সম্প্রদায় গড়ে তোলা হবে। পরবর্তীতে, জাতি-রাষ্ট্রের রূপ বিশ্বাসীদের সম্প্রদায়কে জন্মগত ও (ত্বকের রঙ দ্বারা নির্ণিত) রক্তের শুদ্ধতা ভিত্তিক সম্প্রদায় দিয়ে প্রতিস্থাপিত করে।

আমরা জানি যে, ১৪৯২ সাল এক সারি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী। যেমন, আইবেরিয় উপত্যকা থেকে মুর ও ইহুদিদের বিতাড়ন। মুর’রা দক্ষিণের দিকে চলে যায়, ইহুদিরা উত্তরের দিকে। কলম্বাস পশ্চিমের দিকে যাত্রা শুরু করে ইউরোপীয়দের কাছে অপরিচিত এক অঞ্চলে পদার্পণ করেন, এবং সেটাকে ‘ইন্ডিয়া’স (Indias)’ নামকরণ করেন। পরবর্তীতে আমেরিগো ভেস্পুচ্চি’র সম্মানার্থে এক ইউরোপীয় মানচিত্রবিদ এ অঞ্চলের নাম দেন ‘আমেরিকা’। কিছুদিন পর, বন্দি আফ্রিকানদের জোরপূর্বক অভিবাসন নয়া দুনিয়া/আমেরিকার ডেমোগ্রাফির গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং আধুনিক/উপনিবেশিক জাতিগত (racial) বিন্যাসের পূর্বশর্ত তৈরি করে। ইহুদিরা একটি বৃহৎ ছবির অংশ হয়ে উঠে। খ্রিষ্টানরা এমন এক অবস্থানে ছিল যেখান থেকে তারা পরবর্তী কয়েক শতকের জন্য শ্রেণিবিন্যাস এবং সেই শ্রেণিবিন্যাসকে বৈধ করতে পারত : ইহুদি, মুসলমান, ‘ইন্ডিয়ান’, এবং ‘কালো’রা মিলে তৈরি করেছিল প্রাথমিক জাতিগত চতুর্ভুজ, যা সংযোজন-অভিযোজনের মাধ্যমে আজতক টিকে আছে।১৯


পশ্চিমা খ্রিষ্টানরাজ্য (Western Christendom) থেকে মুসলমানদেরও বিতাড়িত করা হয়েছিল, কিন্তু সে সময়ে মুসলমানদের পিছনে ছিল ইসলামি খেলাফত থেকে শুরু করে শক্তিমান অটোমান সালতানাত পর্যন্ত আটশো বছরের ইতিহাস। অ্যাজটেক, মায়া ও ইনকা সভ্যতাগুলোকে ধ্বংস করে তাদের জনগণকে ‘ইন্ডিয়ান্‌স’-এ পর্যবসিত করা হয়েছিল। দাস বানানো আফ্রিকানদেরকে আফ্রিকা-রাজ্য থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছিল এবং ‘কালো’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। একদিকে মুসলমানরা হয়ে উঠে বহিরাগত সাম্রাজ্যবাদী শত্রু (যেমন, আফ্রিকার উত্তরে ও ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্বে অটোমানদের উপস্থিতি), অন্যদিকে ‘ইন্ডিয়ান্‌স’ ও ‘কালো’রা হয়ে যায় বহিরাগত উপনিবেশিক প্রজা। এবং পশ্চিমা খ্রিষ্টান অঞ্চলে (শীঘ্রই সেটা ইউরোপ হয়ে উঠবে) যে ইহুদিরা রয়ে গিয়েছিলেন তারা হয়ে উঠেন অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিক প্রজা। উনিশ শতকের ইউরোপে জায়নের পুনরুত্থান আসলে ইউরোপীয় রাজতন্ত্রের ভাঙ্গন, গির্জার প্রান্তিকীকরণ ও ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রাক্কালে রাষ্ট্রহীন জনগণ ও অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিক প্রজা হিসাবে ইহুদি জীবনের একটি পরিণতি।


সাম্রাজ্যবাদী আধুনিকতার উপনিবেশিক দিগন্তে ইসরায়েল রাষ্ট্র


অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে বৈশ্বিক ব্যবস্থার রূপান্তরে আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক প্রকৃতি সম্পর্কে ইসরায়েল রাষ্ট্র এবং তাতে পশ্চিমা ইউরোপীয়দের সমর্থন কিছু প্রশ্ন হাজির করে। আমার যুক্তিতর্কের জন্য দুটো বিষয় প্রাসঙ্গিক : ১) যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানিতে জাতি-রাষ্ট্রের গড়ন (form)-এর হেজেমনির অধীনে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের বৃহৎ পটভূমি; ২) ‘জাতি (Nation)’-এর ধারণা যার ওপর আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রীয় হাতিয়ারগুলো প্রতিষ্ঠিত।


এই বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদেরকে ষোড়শ ও উনিশ শতকের ঘটনাগুলোর দিকে পুনরায় ফিরে তাকানো দরকার। আমি ইতোমধ্যে আইবেরিয় উপত্যকা থেকে খ্রিস্টান কর্তৃক ইহুদি ও মুসলমানদের বিতাড়ন সম্পর্কে উল্লেখ করেছি। আমরা সবাই জানি, ষোড়শ শতকে মুসলমানরা কেবল স্পেন ও উত্তর আফ্রিকাতেই ছিল না। ইসলামি খেলাফত (অর্থাৎ, একজন একক খলীফার অধীনে উম্মাহ বা বিশ্বাসী সম্প্রদায়দের নিয়ে যে রাষ্ট্র) অধিকৃত অঞ্চলেও তারা বসবাস করতেন। সে খেলাফত বিস্তৃত ছিল স্পেন থেকে শুরু করে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল হয়ে একেবারে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত, পুরো পারস্য শাহানাত২০ জুড়ে; একেবারে আজ যাকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বলি পুরোটা জুড়েই ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় উপনিবেশ ছিল দক্ষিণ এশিয়া। দিল্লী ভিত্তিক মুঘল সালতানাতকে ভেঙ্গে ব্রিটিশদের আগ্রাসন শুরু হয়েছিল; সেটা একেবারে কাবুল থেকে মাদ্রাজ হয়ে কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল; অর্থাৎ প্রায় পুরো ভারত এবং আজকের আফগানিস্তান জুড়ে। ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় হোক, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম বৃহৎ উপনিবেশ ছিল একটি সালতানাত।


ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মারফতে প্রথম আগ্রাসন বাণিজ্যিক হলেও, সালতানাতকে উচ্ছেদ করে এবং আধুনিক/উপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্থাপন করে “ভারতে”র ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও (১৮৫৮) হাসিল করা হয়। দ্বিতীয় ধাক্কা ছিল, পারস্য অঞ্চলে তেল আবিষ্কৃত হওয়ার পর পারস্য/ইরানি সালতানাতে ব্রিটিশদের আগ্রাসন। ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইরান আক্রমণ করে। রেজা শাহ্‌কে জোর করে সিংহাসন থেকে নামানো হয়, এবং সেখানে তাঁর ছেলে রেজা শাহ্‌ পাহলভিকে বসানো হয়। শাহ্‌ পাহলভি ছিলেন ব্রিটিশ-অনুরক্ত। তিনি ১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তৃতীয়ত, অটোমান সালতানাত ১৯২২ সালে ব্রিটিশদের হাতে পতন হয়। অটোমান সুলতানাতের ধ্বংসাবশেষ থেকে মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে একটি রিপাবলিকের (জাতি-রাষ্ট্র) জন্ম হয়। এবং অটোমান অধিকৃত অঞ্চলে আরেকটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয় : ইরাক। বিশ শতকের গোড়াতেই সে অঞ্চলে তেল পাওয়া যায়।


১৯১৭ সালে ব্রিটিশরা জেরুজালেমে প্রবেশ এবং দখলে নেয়ার আগ পর্যন্ত এটি অটোমান শাসনাধীন ছিল। মুসলিম, ইহুদি এবং ব্রিটিশদের মধ্যে ক্রমাগত সংঘর্ষের কারণে এই শহর টালমাটাল ও বিক্ষুদ্ধ অবস্থায় ছিল। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে দুই অঞ্চলে ভাগ করার অনুমোদন দেয়। একটা আরব, আরেকটা ইহুদি: ইসরায়েল এবং জর্ডান। লম্বা ইতিহাসকে সংক্ষেপে বললে দাঁড়ায়, অটোমান সালতানাতের পতন ও ১৯৪১ সালে রেজা শাহে্‌র অপসারণের মাধ্যমে ব্রিটেন একেবারে মুঘল সালতানাত থেকে শুরু করে পারস্য হয়ে অটোমান পর্যন্ত এক বিশাল অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা কেবল ইহুদিদের প্রতিশ্রুত ভুমিতে ফিরে আসাই নয়, বরঞ্চ একটি মূখ্য অঞ্চল সুরক্ষা করা— অর্থাৎ ইউরোপের পূবের বাফার জোন নিশ্চিত করা। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাম্প্রতিক ‘ইসরায়েলের সাথে অলঙ্ঘনীয় জোট’ সংক্রান্ত ঘোষণা ইহুদি অধ্যুষিত দেশের মধ্যকার সম্পর্ক এবং ইহুদি-খ্রিষ্টান ঐতিহ্যের একতার চাইতেও অধিক ছিল। এটি একটি ভূ-রাজনৈতিক জোটকেও ইঙ্গিত করে যার গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও সামরিক পরিণাম রয়েছে : সীমানার একদিকে ইরান ও সিরিয়া; পূর্বে রাশিয়া ও চীন।


জাতি-রাষ্ট্রের গড়নের বিস্তারের মধ্যে “এক রাষ্ট্র, এক জাতি”র ধারণা নিহিত রয়েছে। অটোমান সালতানাতের পতন আতাতুর্কের নেতৃত্বে আধুনিক তুরষ্ক রিপাবলিকের জন্ম দিয়েছিল। এই রূপান্তরের একটি লজ্জাজনক অধ্যায় হচ্ছে জাতীয় প্রতিরক্ষা ও একতা’র নামে আর্মেনিয়দের বিরুদ্ধে জেনোসাইড বা গণহত্যা চালানো। “এক রাষ্ট্র, এক জাতি”র মধ্যে ‘অ-জাতীয়’দের কোন স্থান নেই। এক জাতির সাথে এক রাষ্ট্র— এই পূর্বানুমান পরোক্ষভাবে ভারত/পাকিস্তানের ভাগের মধ্যেও ছিল। এই একই অন্তর্নিহিত অনুমান অটোমান সুলতানের ধ্বংসাবশেষ থেকে ইরাক সৃষ্টিকারী ম্যান্ডেটকেও প্ররোচিত করেছিল, যদিওবা স্থানীয় ইতিহাসগুলো ছিল আলাদা। মুঘল সালতানাতের ওপর ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণ আফিম উৎপাদনের শর্তগুলো তৈরি করেছিল এবং একই সময় চীনের সাথে আফিম যুদ্ধের শর্ত তৈরি করেছিল। সাফাভি ও অটোমান সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়াতে তেল আবিষ্কৃত হয়েছিল। ইরাক জাতি-রাষ্ট্র হওয়ার পর তারা কুর্দিদের বিরুদ্ধে একই কাজ করেছিল এবং ইরাকের নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের সম্ভাব্য বিক্ষোভকে দমন করার জন্য ১৯৮০ সালে ইরানে আক্রমণ করে। সবকিছু করা হয়েছিল জাতীয় ঐক্যের নামে: এক জাতি, এক রাষ্ট্র। জাতীয় ঐক্যের নামে একের পর এক গণহত্যা ও যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আধুনিক/উপনিবেশিক বিশ্বব্যবস্থার জাতি-রাষ্ট্রের এই নিয়মের বাইরে ইসরায়েল রাষ্ট্রও যেতে পারেনি।


সেক্যুলার-ধর্মীয় ইসরায়েল রাষ্ট্র


উনিশ শতকে ইউরোপে জন্ম নেয়া রাজনৈতিক জায়নবাদ বৈশ্বিক ইতিহাসের কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটি হচ্ছে আধুনিক/উপনিবেশিক দুনিয়ার এক যৌক্তিক পরিণতি। এটি ছিল ইউরোপীয় ইতিহাসের উন্মোচন, যা ‘আধুনিকতা’ হিসাবে স্ব-রচিত; যা প্রয়োজন মোতাবেক জাতি-রাষ্ট্রের গড়ন উদ্ভাবন করেছিল। সেই সন্ধিক্ষণে ইহুদিরা ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসাবে বিবেচিত না হয়ে, বরঞ্চ জাতিগত বা এথনিক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল।


হিসাবমতে, বর্তমান দুনিয়ার ইহুদি জনগণের সংখ্যা প্রায় ১.৪-১.৫ কোটি। এর মধ্যে ০.৫৭ কোটি ইসরায়েলে বসবাস করেন, ০.৫২ কোটি যুক্তরাষ্ট্রে। প্রায় দশ লক্ষের কাছাকাছি ইহুদি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বসবাস করেন (ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, ব্রিটেন, জার্মানি ও হাঙ্গেরি), এবং দক্ষিণ আমেরিকাতে প্রায় তিন লক্ষ। আরো প্রায় পাঁচ লক্ষ ইহুদি বসবাস করেন দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউক্রেন ও রাশিয়াতে।


কিন্তু অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের একজন হাঙ্গেরীয় থিওডর হার্জল (১৮৬০-১৯০৪), তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবদ্দশাতেই ইসরায়েল রাষ্ট্রের সন্ধানে জায়নবাদের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন। হার্জল দ্বিগুণভাবে প্রান্তিক ছিলেন এবং তিনি সেটা অনুভবও করেছিলেন : তিনি ইহুদি ছিলেন এবং একটি প্রান্তিক ও ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যের বাসিন্দা ছিলেন। অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যকে তখন পশ্চিমা ইউরোপীয় বাহিনী ও সাম্রাজ্যবাদী জাতি-রাষ্ট্রকে মোকাবিলা করতে হচ্ছিল। তিনি প্রথম জায়নবাদের ধারণা নিয়ে আসেন নি, কিন্তু তিনিই ছিলেন এই প্রকল্পের মূল কারিগর। তিনি এমন এক সময়ে ইউরোপে বসবাস করছিলেন যখন পশ্চিমা ইউরোপের প্রধান দেশগুলোতে জাতি-রাষ্ট্র দৃঢ় হচ্ছিল। জাতি-রাষ্ট্র একটি সেক্যুলার প্রতিষ্ঠান ছিল; এবং ফলে হার্জলের জায়নবাদও তাই।


মহিমান্বিত বিপ্লব (Glorious revolution) ও ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের পাশাপাশি মহাদেশীয় ইউরোপের ফরাসি বিপ্লবের সাথে যুক্ত উদীয়মান এথনো-শ্রেণি, অর্থাৎ বুর্জোয়াদের জন্য জাতি-রাষ্ট্র ছিল আদর্শ প্রতিষ্ঠান। এটা ছিল আধুনিকতা ও প্রগতির নিশানা, শাসনব্যবস্থার ইউরোপীয় সেক্যুলার রূপ। এটা ওয়েস্টাফেলিয়া চুক্তির পরিণতিও ছিল, যে চুক্তি মরণঘাতী ত্রিশ বছরের যুদ্ধের (১৬৬০-১৭১৫) অবসান ঘটিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে বুর্জোয়ারা (এথনো-শ্রেণি, ethno-class) আধুনিক জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেনি, বরঞ্চ করেছিল সেটেলাররা, বসতিস্থাপনকারী উপনিবেশকরা। এবং সেটা খ্রিস্টানদের মধ্যকার ধর্মীয় বিবাদ মেটানোর জন্য নয়, বরঞ্চ ব্রিটিশদের শাসন অবসানের জন্য। ইউরোপীয় বুর্জোয়ারা যেখানে রাজতন্ত্র ও গির্জাকে সরিয়ে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাগণ আদিবাসী আমেরিকানদের স্থানচ্যুত ও উচ্ছেদ করেছিলেন। নয়া দুনিয়ার স্পেনীয় উপনিবেশায়ন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বোয়ার (Boer) ও ব্রিটিশ উপনিবেশায়নের ক্ষেত্রে ‘ম্যানিফেস্ট ডেস্টিনি’ বা ‘অনিবার্য নিয়তি’ দাবি তুলে জমি দখল করা হয়েছিল; অর্থাৎ ঈশ্বরের নির্দেশে তার নির্বাচিত লোকেরা জমির দখল নিবেন। উনিশ শতকের শুরুর দিকে ইউরোপে যেখানে শ্রেণি বর্ণকে (রেস) সরিয়ে দিয়েছিল, সেখানে আমেরিকা শুরু থেকেই বর্ণগত (racial) শ্রেণিকরণ ও হায়ারার্কি বা ক্রমাধিকার দ্বারা চিহ্নিত হয়েছিল: আদিবাসী আমেরিকান (দক্ষিণের “Pueblos Originarios”, কানাডার ফার্স্ট নেশন) এবং দাস [বানানো হয়েছে যাদের সেইসব] আফ্রিকান। এটা ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর স্পেনে মুর এবং ইহুদিদের সমতুল্য ছিল (ইউরোপ তখনো পশ্চিমা খ্রিষ্টানরাজ্য নামে পরিচিত ছিল)। ‘ম্যানিফেস্ট ডেস্টিনি (অনিবার্য নিয়তি)’ স্পষ্ট একটি বর্ণবাদী মতবাদ ছিল, যা আদিবাসী আমেরিকানদের জমি দখল করাকে জায়েজ করেছিল। সাম্রাজ্যবাদী/উপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত প্রথম জাতি-রাষ্ট্রগুলোর সাথে সাম্রাজ্যবাদী/উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত ইসরায়েল রাষ্ট্রের মিল লক্ষণীয়। উনিশ শতকের শেষের দিকে হাওয়াই ও ফিলিপাইনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রগতি, আধুনিকতা, মুক্তি ও অনিবার্য নিয়তির ওপর জোর দিয়ে একধরনের বুলি আওড়ানো হয়েছিল।২১


ইউরোপের সেক্যুলারবাদ গির্জা থেকে রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিসমাপ্তি টেনে দিয়েছিল। তদুপরি, গির্জা বা রাজতন্ত্র কোনটাই উধাও হয়ে যায়নি। পর্দার পিছনে তারা তাদের প্রভাবের পরিসর ঠিকই বজায় রেখেছিল। ইউরোপের সকল তথা-কথিত উন্নত ও শিল্পায়িত দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা তাই দেখতে পাই। তবুও, জাতি-রাষ্ট্রকে, যেমনটা এই যৌগিক নাম ইঙ্গিত করছে, জন্মগত সম্প্রদায়ের (নেশন, nation) উপর ভিত্তি করে আইনগত, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক সংগঠন হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছিল, কোন বংশগত পারিবারিক উত্তরাধিকার বা রোমান পোপের শাসনাধীন অগণতান্ত্রিক নির্বাচনের ভিত্তিতে নয়। জাতীয় ভাষা, জাতীয় সাহিত্য ও জাতীয় সংস্কৃতি (মধ্যযুগে লাতিন-উদ্ভূত ভাষাগুলোয় ‘সংস্কৃতি’ ধারণাটি যা ছিল এখন তার ভিন্নার্থ যোগ হয়েছে) দ্বারাও জাতীয় প্রজা একত্রিত হয়েছিল। জাতীয় প্রজারা তখন আধুনিক অর্থে ‘নাগরিক’ হয়ে উঠে, মানুষ ও নাগরিকের অধিকার সম্বলিত ঘোষণায় (Declaration of the Rights of Man and of Citizen) তা বর্ণিত হয়েছিল।


থিওডর হার্জলের রূপকল্পে ও কর্মে জায়নবাদ মূলত একটি সেক্যুলার প্রকল্পই ছিল। এর অর্থ হচ্ছে যে, রাষ্ট্রের জায়নবাদী রূপকল্প অনুমান করে নিয়েছিল যে, ইহুদিরা ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়, বরঞ্চ এথনিক সম্প্রদায়। এ কারণে সেক্যুলার জায়নবাদী প্রকল্পকে ইহুদি ধর্মীয় নেতাদের মোকাবিলা করতে হয়েছিল, যারা এটার বিরোধীতা করেছিলেন। মিশেল ব্রেনার ২০০৩ সালে একে আপাতবিরোধী [বা প্যারাডক্সিক্যাল] আন্তর্জাতিকতাবাদী জাতীয়তাবাদ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।২২ এই যুক্তি অনুসারে আরেকটি প্যারাডক্স বা কূটাভাষ হচ্ছে যে, শুরুতে যে আন্দোলন ছিল সেক্যুলার এবং ফলে ধর্মীয় সিলসিলার চাইতে এথনো-ইহুদি জাতীয়তাকে গুরুত্ব দিয়েছে, সে আন্দোলন ধার্মিক ইহুদিদের সমালোচনার মুখে পড়েছিল, যারা জায়নবাদকে ইহুদি-ধর্মের জন্য অবমাননাকর হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। পশ্চিমা ইউরোপ ও আমেরিকা ব্যতীত, দুনিয়ার আর কোথাও রাষ্ট্র বিষয়ে এমন ধরনের সেক্যুলার-ধর্মের (secular-sacred) বিভাজন অর্জিত হয়নি।


জায়নবাদের ইতিহাস— একদম শুরু থেকে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত এর গতিপথের বর্ণনা— ইহুদি ও অ-ইহুদিরা একইভাবে বলেছেন। আমি দুজন বিতর্কিত ধর্মতাত্ত্বিকদের ব্যাখ্যা থেকে শুরু করবো, যাদের কথা ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি: একজন ইহুদি, আরেকজন খ্রিস্টান। প্রথমজন মার্ক এলিস এবং দ্বিতীয়জন মিশেল প্রিয়োর। এলিস বহু কারণেই পরিচিত, এর মধ্য একটা হচ্ছে, যা আমি ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি— ইহুদি ধর্ম ও ইসরায়েল সমান নয়। প্রিয়োর পরিচিত উপনিবেশবাদের ইতিহাসের মধ্যে ফিলিস্তিনের প্রশ্নটিকে আকার দেয়ার জন্য। এই দুই ধর্মতাত্ত্বিকের যুক্তির সাথে সঙ্গতি রেখে আমার মতামত আধুনিক ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রের উপনিবেশিকতার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়াবে, যেখান থেকে জায়নবাদের উদ্ভব হয়েছিল। অন্যভাবে বললে, জায়নবাদের উদ্ভব কেন ইউরোপের একটি ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যেই (অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয়) হলো এবং কেন অন্যান্য ইহুদি-ডায়োস্পোরাতে হলো না তার যৌক্তিক-ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে, সেটা কেবল দৈবাৎ ঘটনা নয়।


বৈশ্বিক রৈখিক ভাবনা, উপনিবেশিকতা এবং অধিকারচ্যুতকরণ


আমি যে যুক্তি দেখাচ্ছি সেটা হচ্ছে, ফিলিস্তিন/ইসরায়েল প্রশ্ন কোন স্থানীয় ইস্যু বা সমস্যা নয়। এটা বৈশ্বিক ব্যবস্থার মধ্যে প্রোথিত। আমি যে বৈশ্বিক ব্যবস্থার কথা বলছি তাকে কার্ল স্মিট বর্ণনা করেছিলেন বৈশ্বিক রৈখিক ভাবনা (Global linear thinking) দ্বারা পরিচালিত ‘পৃথিবীর দ্বিতীয় বিধান হিসাবে। এটা ইউরোপীয় রূপকল্প এবং গল্পের অর্ধেক। বাকি অর্ধেক, অর্থাৎ বৈশ্বিক রৈখিক ভাবনার পরাজিত প্রান্তের রূপকল্প; এই অর্ধেক হচ্ছে ‘ক্ষমতার উপনিবেশিক বিন্যাসের’ প্রতিষ্ঠার মুহূর্ত এবং পশ্চিমা সভ্যতার জন্ম।২৩ আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা পরিচলিত দ্বিতীয় বিধান’ হচ্ছে উপনিবেশিক বিন্যাসের একটি দিক। দুই আখ্যানের (দ্বিতীয় বিধান ও ক্ষমতার উপনিবেশিক বিন্যাস) কেন্দ্রে রয়েছে অধিকারচ্যুতকরণ। বৈশ্বিক রৈখিক ভাবনা আন্তর্জাতিক আইনের সমতুল্য: গ্লোব বা গোলকের পুর্ননির্মাণ দ্বিতীয় বিধানকে বাস্তবায়ন করেছিল, এবং আন্তর্জাতিক আইন দ্বিতীয় বিধানের সূচনা থেকেই অধিকারচ্যুতকরণকে আইনি বৈধতা দিয়েছিল, অর্থাৎ ষোড়শ শতক থেকে শুরু করে ১৮৮৪ সালের বার্লিন চুক্তির পর আফ্রিকা ভাগের আগ পর্যন্ত। ইসরায়েল রাষ্ট্রের ভিত্তি সাম্রাজ্য বিস্তারের অন্যতম কৌশল থেকে উপকৃত হয়েছিল।ক্ষমতার উপনিবেশিক বিন্যাস-এর শব্দভান্ডারে, আন্তর্জাতিক আইন কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনাকে বৈধতা দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক আইনের সাথে যুক্ত আইনত বৈধ অধিকারচ্যুতকরণ ছিল রাষ্ট্রের বিষয়, তা সে রাষ্ট্র রাজতান্ত্রিক বা সেক্যুলার যাই হোক না কেন। এই সমারোহের মধ্যেই ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল : প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরে যাওয়া প্রগতি সভ্যতার নামে অধিকারচ্যুতকরণ বৈধ করার দীর্ঘমেয়াদী পথচলা দ্বারা সমর্থিত ছিল।২৪

কিন্তু আইনের উর্ধ্বেও অধিকারচ্যুতকরণের (dispossession) মারাত্মক তাৎপর্য রয়েছে এবং ধর্মীয় কেতাবাদির মাধ্যমে এটাকে কোনভাবেই জায়েজ করা যায় না : অধিকারচ্যুতকরণ অবৈধ ও অধর্মীয়। মনে হয় এমন কোন আইন বা ধর্মীয় [পবিত্র] সত্য নেই যা একজনের যা-আছে তা থেকে তাকে বঞ্চিত করার অধিকার অন্য কোন ব্যক্তিকে দেয়। জাতি-রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, মানুষের মাঝে সার্বভৌমত্বের-যে-সম্পর্ক তার সাথে সমঝোতা করে : কোন ব্যক্তিরই অন্যকে দাস বানানোর, শোষণ করার এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার নেই। জাতি-রাষ্ট্রের এই ধরন মানবকল্যাণ ও এই গ্রহের মঙ্গলের উর্ধ্বে, বিভিন্ন জাতীয়তার মঙ্গল ও সুরক্ষাকে স্থান দিয়ে বিশ্বশান্তির সমঝোতা করে যাচ্ছে। পশ্চিমা সভ্যতায় রাষ্ট্রের আইন ও ধর্মীয় কেতাবের সত্যের মধ্যকার নিরবচ্ছিন্নতা ও পরিপূরকতা জমি, অঞ্চল ও মানবসন্তানের ক্রমবিন্যাসে ও জাতিভেদে অবদান রেখেছে। মিশেল প্রিয়োর যা দেখিয়েছেন তা হচ্ছে : অধিকারচ্যুতকরণের বাইবেলীয় জায়েজিকরণ, আন্তর্জাতিক আইনের আইনি নীতি হয়ে উঠেছিল।২৫


অধিকারচ্যুতকরণ হচ্ছে সর্বোপরি বি-মানবিকীকরণ ও মানসিকভাবে অবমাননাকর। তদুপরি, বি-মানবিকীকরণ আধুনিক/উপনিবেশিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কে অপ্রাসঙ্গিক : প্রথমেই আসে রাষ্ট্রের স্বার্থ, দ্বিতীয়ত আসে রাষ্ট্রের নাগরিকদের সুবিধা যারা অধিকারচ্যুতকরণ আরোপ করছেন, এবং তৃতীয়ত আসেন অ-জাতীয়রা যারা অধিকারচ্যুত হবেন। এখানে আমরা আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান সীমাবদ্ধতা পাই : অ-জাতিদের (নন-নেশনাল, non-nation) চাইতে জাতিদের (নেশনাল, national) অগ্রাধিকার রয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, অ-জাতিরা তুলনামূলক ঊন-মানুষ। দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রের সাথে এথনিক্যালি চিহ্নিত জাতিরা রাষ্ট্রের মনো-এথনিক [একক-এথনিক] জাতীয়তার মধ্যে অন্তর্গত নয় এমন জাতিদের (মানে বৈধ নাগরিক) চাইতে বেশি অগ্রাধিকার পাবেন। হলোকাস্টই তেমন এক উদাহরণ : এথনিক জার্মানরা জার্মান ইহুদিদের চাইতে অগ্রাধিকার পাবেন; জার্মান ইহুদিরা জাতি-রাষ্ট্রের সমরূপতাকে বিপদে ফেলে দিচ্ছিল। এবং তৃতীয়ত ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েল রাষ্ট্রে বহিরাগত, এবং যারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের বাসিন্দা তারাও ইসরায়েল রাষ্ট্র যে এথনিসিটিকে চিহ্নিত করে তাতে অন্তর্গত নয়।


জায়নবাদ-বিরোধী নাকি জাতি-রাষ্ট্র-বিরোধী?


আমার যুক্তি হচ্ছে কেবল ইসরায়েল রাষ্ট্র থেকে ইহুদি-ধর্মকে বিযুক্ত করা জরুরি নয়, বরঞ্চ ইসরায়েল রাষ্ট্র থেকে জায়নবাদকে বিযুক্ত করাও জরুরি। যদি ইহুদি ধর্ম ও ইসরায়েল রাষ্ট্র সমান না হয়ে থাকে, তাহলে ইহুদি ধর্ম থেকে ইহুদি-জায়নবাদকে বিযুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। জায়নবাদের সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে সমস্যা সেটা আসলে ইহুদি ধর্মের সাথে সমস্যা নয়, বরঞ্চ আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের রূপের সাথে সমস্যা। এই কাঠামোর ভেতর এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ও আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণের আন্তর্জাতিক সংঘাত ও লড়াইয়ের নেটওয়ার্কের মধ্যে ফিলিস্তিনি/ইসরায়েল সংঘর্ষের কোন সমাধান নেই।


আমি ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি যে, ইহুদি-জায়নবাদ উনিশ শতকে হাজির হয়েছিল। ইহুদি জায়নবাদ ছিল একদিকে ইহুদি প্রবাসীদের দীর্ঘ ইতিহাসের এবং অন্যদিকে ইউরোপে ইহুদিদের রূপান্তর ও পরবর্তীতে নিপীড়নের আবশ্যক প্রতিক্রিয়া। ইউরোপীয় আলোকায়ন ও সেক্যুলারকরণ ইহুদিদের অবস্থান (স্ট্যাটাস) পরিবর্তন করে দিয়েছিল। ধার্মিক ইহুদিরা জাতিগত সম্প্রদায় গঠনে অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলেন যা সেক্যুলার ইহুদিদের (হিলোনি, অ-ধার্মিক ইহুদি) উত্থানে জ্বালানি দিয়েছিল। অতএব, যদি জায়নবাদ একটি ইহুদি জাতীয় আন্দোলন হয়ে থাকে যা কিনা ইহুদিদের তাদের ঐতিহাসিক জন্মভূমিতে (জায়ন— ইসরায়েল ও জেরুজালেমের ভূমি) ফিরে যাওয়ার অধিকার দাবি করে, তাহলে সেটা অধিকারচ্যুত যে কোন সম্প্রদায়ের আকাঙ্ক্ষা ও অধিকারের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। এই ক্ষেত্রে উনিশ-শতকের ইউরোপে জায়নবাদের গঠন আসলে এই গ্রহের আদিবাসী জনগণের অবস্থার সমতূল্য এক অবস্থার প্রতিক্রিয়া ছিল। ১৫০০ সাল থেকে আদিবাসী জনগণ তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ ও অধিকারচ্যুত হচ্ছিলেন : ষোড়শ শতকে আমেরিকাতে, উনিশ শতকে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে, ১৮৮৪ সালে বার্লিন কনফারেন্সের পর সমগ্র আফ্রিকার জনগণ ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র কর্তৃক অধিকারচ্যুত হয়েছিলেন। জায়নবাদী রাষ্ট্রের প্যারাডক্সটা হচ্ছে এই যে, ঐতিহাসিক জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার মানে হচ্ছে সে ভূমির জনগণকে অধিকারচ্যুত করা, যে সম্প্রদায় কাউকে অধিকারচ্যুত করে সেই ভূমি দখল করেনি।


এই চৌরাস্তাতেই হার্জলের প্রকল্প দুটো কৌশল কাজে লাগায় : ইহুদি জনগণের মুক্তি এবং অধিকারচ্যুতকরণের ডিসকোর্সের আত্মসাৎকরণ। হার্জলের মনে ইসরায়েল রাষ্ট্র কোথায় তৈরি হবে? তিন নম্বর অধ্যায়ে (“জমি ক্রয়”) হার্জল অন্য দেশে জমি ক্রয়ের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন :


আর্জেন্টিনা বিশ্বের অন্যতম উর্বর দেশ, বিরাট অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত, অল্প জনসংখ্যা এবং কোমল আবহাওয়া। আর্জেন্টাইন রিপাবলিক তার ভূখণ্ডের একটি অংশ আমাদের কাছে দিয়ে যথেষ্ট মুনাফা অর্জন করতে পারবে। বর্তমান ইহুদি অনুপ্রবেশ নিশ্চয় কিছুটা অসন্তোষ তৈরি করেছে এবং আমাদের নতুন আন্দোলনের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আর্জেন্টিনাকে আলোকিত করা জরুরি।


তদুপরি তিনি যখন ফিলিস্তিনকে বিবেচনায় নেন তখন পরিস্থিতি বদলে যায়। এক্ষেত্রে তাঁর পরামর্শ (সেটা তিনি পঞ্চম অধ্যায়ে আলোচনা করেন) হচ্ছে ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনে যারা বসবাস করছেন তাঁদের জমি দখল (এবং অধিকারচ্যুতকরণ):


ফিলিস্তিন আমাদের চিরস্মরণীয় ঐতিহাসিক বাসস্থান। ফিলিস্তিন নামটি আমাদের মানুষদের এক বিষ্ময়কর শক্তি দ্বারা আকৃষ্ট করে। যদি মহামান্য সুলতান আমাদেরকে ফিলিস্তিন দিতেন, তাহলে আমরা এর বিনিময়ে তুরষ্কের পুরো অর্থনীতিকে সংহত করার দায়িত্ব নিতে পারতাম। আমাদের উচিৎ হবে সেখানে এশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপের একটি কেল্লা তৈরি করা, যেন বর্বরতার বিরুদ্ধে সভ্যতার একটি ফাঁড়ি। একটি নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে আমাদের উচিৎ হবে সমগ্র ইউরোপের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখা, যা আমাদের অস্তিত্বের নিশ্চয়তা দিবে।


ফিলিস্তিনি যা দিতে পারবে আর্জেন্টিনা তা পারবে না, এবং সেটা কেবল এই কারণে নয় যে ফিলিস্তিন তাঁদের ‘চিরস্মরণীয় ঐতিহাসিক বাসস্থান’। অটোমান সুলতান ফিলিস্তিনকে ইহুদিদের হাতে দিয়ে দিবেন, এটা কল্পনা করে ইসরায়েল রাষ্ট্র ‘এশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপের একটি কেল্লা’ তৈরি করবে, যা ‘বর্বরতার বিরুদ্ধে সভ্যতার একটি ফাঁড়ি’ হবে। এখানে একই সময়ে দুটো কৌশল কাজে লাগানো হয়, ইহুদিদেরকে আর ‘বর্বর’ হিসাবে দেখা যাবে না, বরঞ্চ বর্বরতার বিরুদ্ধে ইউরোপের যে লড়াই তাতে সে একীভূত হয়ে যাবে


আধুনিক ইউরোপীয় জাতি-রাষ্ট্রের গড়ন, ‘জাতি’ ও ‘জাতীয়তাবাদ’ ধারণার হাতে হাত ধরাধরি করেই চলছিল। এটি জাতীয়দের (নেশনাল্‌স) জন্য একটি সমাধান প্রস্তাব করলেও ‘অ-জাতীয়’দের জন্য মুশকিল তৈরি করেছিল। জন্মগত সম্প্রদায়ের ধারণা ও প্রতিচ্ছবি (জাতীয়তাবাদ) তৈরির মাধ্যমে, এটি ঠিক এর বিপরীতটাও তৈরি করে দিয়েছিল, অর্থাৎ জেনোফোবিয়া বা বিদেশাতঙ্ক বা বিদেশিদের সম্বন্ধে অহেতুক ভয় ও ঘৃণা। এই প্রক্রিয়াতে ‘মানবতা’র বৃহৎ ছবিটা হারিয়ে গিয়েছিল, এবং এখনো যাচ্ছে। জাতীয়তাবাদ ও জাতি-রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকে বিশ্বের ইতিহাসে এর পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ। আমি ইতোমধ্যে তুরষ্ক প্রতিষ্ঠাকালীন আর্মেনিয় গণহত্যার কথা বলেছি; হিটলারের অধীনে ইহুদি ও অ-জার্মানদের গণহত্যা; বেলজিয়াম ছেড়ে যাওয়ার পর রুয়ান্ডার ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ, একইসময়ে বেলজিয়াম দেশে জাতীয়তাবাদী অনুভূতি রেখে যায় যা পরবর্তীতে তুতসী ও হুতুদের মধ্যে ভয়াবহ মরণঘাতি সংঘর্ষের জন্ম দিয়েছিল। জেনোসাইডের বাইরেও, জাতীয়তাবাদী অনুভূতি রাষ্ট্রের সাথে যুক্ত হয়ে বহিরাগত শক্তির হাত থেকে জাতি-রাষ্ট্রের পবিত্রতা রক্ষার জন্য অধিকারচ্যুতকরণ, যুদ্ধ ও সহিংসতার জন্ম দিয়েছে। জাতি-রাষ্ট্রের দেহের সঙ্গে যুক্ত যে-উপনিবেশিক-যুক্তি অষ্টাদশ শতাব্দীর পর থেকে আধুনিক/উপনিবেশিক বিশ্বের গড়ন ঠিক করে দিয়েছিল এবং এখনো দিচ্ছে, যে-ব্যবস্থা পশ্চিমা সভ্যতার বৈশ্বিক ডিজাইনকে সংহত করেছিল, সেই যুক্তি থেকে ইসরায়েল রাষ্ট্রও বের হতে পারে নি।


ইসরায়েল রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে ইহুদি জায়নবাদ ইহুদিদের দ্বারা এবং ইহুদিদের জন্য একটি মুক্তির আন্দোলন ছিল; তা সে ধার্মিক ইহুদি হোক বা সেক্যুলার এথনিক ইহুদি হোক। সে সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি জায়নবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জায়নবাদি ইহুদিদের কতটা স্পষ্ট ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, এবং জায়নবাদী প্রকল্পকে সমর্থনে পশ্চিমা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর কতটা লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, সে বিষয়গুলো বিশেষ মনযোগ দাবি করে। এখানে আমি ধরে নিচ্ছি যে জায়নবাদ একটি মুক্তি/স্বাধীনতার প্রকল্প ছিল, যা পশ্চিমা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর (প্রধানত ইংল্যান্ড) থেকে সহায়তা ও সমর্থন চেয়েছিল। বাহুল্যের ঝুঁকি নিয়েই বলছি, তদুপরি ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টির পর জায়নবাদ একটি রাষ্ট্রীয় মতাদর্শে পরিণত হয়, সাথে ছিল ইসরায়েলি জাতীয় নাগরিকদের স্বার্থ রক্ষার্থে আইনি ও সামরিক হাতিয়ার। অ-জাতীয়দের মানবিকতার বোধটুকু হারিয়ে গিয়েছিল, এবং এই বিষয়টাই মার্ক এলিস উল্লেখ করছিলেন। যার ফলে ইসরায়েল রাষ্ট্র কেবল না-ইহুদিই (un-jewish) ছিল না, বরঞ্চ সেকারণে না-মানুষও (un-human) ছিল। উল্লেখযোগ্যভাবে এটা ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এড হমিনেম (ad hominem) অভিযোগ নয়; বরঞ্চ এটা আধুনিক, ইউরোপীয় ও সাম্রাজ্যবাদী জাতি-রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই অভিযোগ।


উদাহরণস্বরূপ এটা কুখ্যাত যে, ইরাক আগ্রাসনের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর বক্তৃতায় মানবজীবনের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ তুলে ধরেন (এবং সেটা কেবল মৃতদের কথাই নয়, বরঞ্চ সৈনিক ও তার পরিবারের ব্যক্তিগত মানসিক পরিণাম, যে শারীরিক ক্ষত সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে, ইত্যাদি সব তুলে ধরেন)। কিন্তু তিনি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবনের কথাই উল্লেখ করেছিলেন। লক্ষাধিক ইরাকির প্রাণহানি, দেশটির অবকাঠামোর ধ্বংস সাধন এবং ইরাকি রাষ্ট্রের সামাজিক কাঠামোর ভাঙ্গন— এসবই নীরবে তিনি পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন।


যেসকল সেক্যুলার ইহুদিরা ইউরোপে ইহুদিদের জন্মভূমি ও প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন, কেবল তাদের কর্মকাণ্ডের দরুন ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়নি। এই ধারণার উদ্ভব সতের শতকেও হতো না, যখন জাতিরাষ্ট্রের ধরণ ও ধারণা হাজির হয়নি। অথবা উনিশ শতকের অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা বা দক্ষিণ আফ্রিকাতেও হতো না, সেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ইহুদিদের বসবাস থাকা সত্ত্বেও সেখানে জাতি-রাষ্ট্র ধরনের শাসনব্যবস্থা অপরিচিত ও দূরবর্তী রূপ ছিল। ইসরায়েল রাষ্ট্র অস্তিত্ববান হয়েছিল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের দরুণও (তারা এখানে দুটো কার্ড খেলেছিল) : একদিকে খোদ ইউরোপ যে সঙ্কট তৈরি করেছে (হিটলারের অধীনে ইহুদি জেনোসাইড) সে সঙ্কটের সমাধান করা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ময়দানে নজর রাখা এবং মধ্যপ্রাচ্যে ব্রিটিশরা যে জঞ্জাট তৈরি করেছে তার সমাধা খোঁজা। ইহুদিদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটা সময়ে এই প্রক্রিয়াতে দুটো ভিন্ন ভিন্ন সম্ভাবনা ছিল : তাদের নিজস্ব জমির ব্যবস্থা করা (একটি সেক্যুলার সমাধান) এবং প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফিরে যাওয়া (একটি ধর্মীয় সমাধান)। প্রথম ক্ষেত্রে অন্যান্য যে কোন স্থানে একটা রাষ্ট্রের জন্ম হতে পারতো; যেমন আর্জেন্টিনা এমন একটা স্থান ছিল। অন্যদিকে ফেরা মানে জায়নেই একটি নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি। অটোমান সুলতানের পরাজয় ও জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ (১৯২২-৪৮) নেয়ার পর ইংল্যান্ড যে বিশেষ পরিস্থিতিতে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল, সেটাও এসবের একটা কারণ।


শেষ মন্তব্য

এই অ্যাখ্যানের দৃষ্টিতে, স্বল্প মেয়াদে ফিলিস্তিন/ইসরায়েলের সংঘাত সমাধানের সম্ভাবনা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। বৈশ্বিক ব্যবস্থার মধ্যকার সংঘর্ষ আরো তীব্র হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাম্প্রতিক ইসরায়েল সফরের অনেকগুলো ওভারলেপিং এজেন্ডা রয়েছে এবং একটি স্পষ্ট বার্তাও রয়েছে। এজেন্ডার একটা বিষয় হচ্ছে, সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের দিকে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া এবং বলা যে, ‘দুই-রাষ্ট্র সমাধান সম্ভব’ ; সমাধানে দেরী করার জন্য প্রস্তাবিত এই ফর্মুলা ফিলিস্তিনিদের বোকা বানাতে পারেনি। এর মধ্যে ইরানে নজর আরো বেশি ছিল, এবং মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ জারি রাখার জন্য ইসরায়ল রাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। তৃতীয়ত, ইরানের পাশাপাশি নজর ছিল সিরিয়ার দিকে; পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বার্থের জায়গা থেকে এই অঞ্চলগুলোর দিকে নজর দেয়া হচ্ছে, যেমন করে ইরাককে অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিকভাবে দমন বা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছিল। এই সমীকরণের ‘অজানা’রা হচ্ছে উত্তরের দিকে রাশিয়া এবং সিরিয়া ও ইরানের পূর্বে চীন। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের স্থানীয় উত্তেজনাকে পেরিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র বৈশ্বিক শক্তি ও সংঘাতের এই চৌরাস্তায় দারুণভাবে অবস্থান নিয়েছে।


জায়নবাদ-বিরোধী হওয়া মানে ইহুদি-বিরোধী হওয়া নয়। বরঞ্চ এর মানে হচ্ছে জাতি-রাষ্ট্র বিরোধী হওয়া। অথবা আরো ভালো করে বলা যায়, জাতি-রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থার সর্বজনীন রূপ এই ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। তাহলে সম্ভাবনাগুলো কী কী? আমি তিনটা সম্ভাব্য পথ দেখি। তার মানে কিন্তু কোন নীলনকশার কথা আমি বলছি না, বরঞ্চ বর্তমানে হচ্ছে এমন কিছু ট্রাজেক্টরির বা পথের কথা বলছি যার ফলাফল ও সম্ভাব্য ভবিষৎ অজানা। জাতিরাষ্ট্রের যে রূপ পরিচিত তা নিঃশেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।


প্রথমত, বহু-জাতিক রাষ্ট্রের সাংবিধানিক রূপ ইতোমধ্যেই হাজির রয়েছে। বলিভিয়া ও ইকুয়েডরের সংবিধান ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে যে, এরা বহু-জাতিক রাষ্ট্র। এর অর্থটা কী? সরলভাবে বললে এর অর্থ হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকাতে ইউরোপীয় বংশধররা কেবল একটাই জাতি যারা বহু জাতির (Aymaras, Quechuas, Chiquitanos, আফ্রো-বংশদ্ভূত বহু জাতি) সাথে সহাবস্থান করছে। তদুপরি তারা নিজেদেরকে এই জাতি-রাষ্ট্রের সাথে চিহ্নিত করছে, যা খোদ তারাই অন্যান্য জাতিগুলোকে দমন করার প্রক্রিয়াতে তৈরি করেছিল। ইকুয়েডরে ৩৩টি আদিবাসী জাতি রয়েছে, সাথে রয়েছে আফ্রো-বংশোদ্ভূত জাতিসমূহ। নিশ্চিতভাবেই রাষ্ট্রের সাথে এক জাতিকে (ইউরোপীয় বংশদ্ভূতরা) যুক্ত করার কোন কারণ এখানে নেই। বলিভিয়া ও ইকুয়েডরকে বহু-জাতির রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলার উদ্যোগটা যেমন ক্রিওল (Creoles) ও মিস্তিযোদের (Mestizos) থেকে আসেনি, তেমনি ইউরোপীয় বংশদ্ভূতদের কাছ থেকেও আসেনি। এটা এসেছিল আদিবাসী উদ্যোগগুলো থেকে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই একটি বহু-জাতিক রাষ্ট্র, যদিও সেটা সংবিধানমতে (এখনও) স্বীকৃত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান পুনর্লিখন ও একটি বহু-জাতিক রাষ্ট্র ঘোষণার সম্ভাব্য দাবি থেকে রেহাই পেতে ‘সংখ্যালঘু’ এবং ‘বহুসংস্কৃতিবাদ’ (multiculturalism) ধারণাসমূহকে বাফার জোন হিসাবে প্রাতিষ্ঠানিক ডিসকোর্সে তৈরি করা হয়েছে।


দ্বিতীয়ত, বর্তমানে চীনে একটি জাতীয় রাষ্ট্রের পরিবর্তে একটি সভ্যতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তর্ক-বিতর্ক চলছে। এই বিতর্ক সরকার কর্তৃক প্ররোচিত না হয়ে বরঞ্চ স্ব-ঘোষিত ‘নাগরিক বুদ্ধিজীবী’দের উদ্যোগ থেকে আসছে। এর অর্থটা কী? এর অর্থ হচ্ছে, চীনা নাগরিক বুদ্ধিজীবীরা অনুধাবন করছেন যে, জাতি-রাষ্ট্রের গড়নটা, আসলে সান ইয়াৎসেনের নেতৃত্বের চীনা বিপ্লব ও বর্তমানে জারি থাকা চীনা মার্ক্সবাদী-রাষ্ট্রীয় সংবিধানের মধ্যকার একটি মরীচিকা ছিল। সভ্যতামূলক রাষ্ট্রের ধারণা কনফুসিয়ান সংবিধানবাদের (Confucian constititutionalism) তর্কের সাথে যুক্ত। পশ্চিমা অভিজ্ঞতা থেকে সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থার জরুরতকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে জাতি-রাষ্ট্রের রূপটি বোধহয় খারিজ হয়ে যাচ্ছে। কনফুসিয়ান সংবিধানবাদ ও সভ্যতামূলক রাষ্ট্রের অর্থ হচ্ছে এমন শাসন-কাঠামোর সন্ধান করা যা চীনের ইতিহাসের সাথে খাপ খায়, পশ্চিমা সভ্যতার ইতিহাসের সাথে নয়। একইভাবে ইসলামি রাষ্ট্রগুলো তাদের সালতানাত ধ্বংস ও জাতি-রাষ্ট্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার পর এখন সভ্যতামূলক রাষ্ট্র হিসাবে নিজেদের পুনর্গঠন করা শুরু করেছে। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে তুরষ্কে এমন ধরনের কিছু একটার উত্থান ঘটছে : অটোমান সালতানাত, মানে একটি সভ্যতামূলক রাষ্ট্রের স্মৃতি আতাতুর্কের আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের স্মৃতিগুলোকে নাকচ করে দিচ্ছে।


তৃতীয়ত, রাষ্ট্রের পরিসরের বাইরে আরেক ধরনের কার্যক্রম চালু আছে, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থার সন্ধান করা যা রাষ্ট্রের স্বার্থের স্থলে জনগণের প্রয়োজনকে পূরণ করবে। এই পরিসরে রাষ্ট্রের বিউপনিবেশীকরণ মানে হচ্ছে শাসনব্যবস্থার মুক্তকরণ। তদুপরি, যে অ্যাক্টর এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ এই প্রকল্পগুলো চালাচ্ছে তারা যেমন বিদ্যমান রাষ্ট্রগুলো নয়, তেমনি কর্পোরেশন ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানও নয়। এই অ্যাক্টরেরা তাদের ভাগ্যকে তাদের হাতেই নিয়ে নিচ্ছেন, কেননা রাষ্ট্র বা পুঁজি কেউই তাদের দেখভাল করছে না; ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতরে রাষ্ট্রের সংখ্যা বৃদ্ধিজনিত জটিল পরিস্থিতিতে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। এই জায়গাতে জাতিরাষ্ট্রের সঙ্কটের কেন্দ্র এবং এর ভাঙ্গনের সম্ভাবনার যে লড়াই ফিলিস্তিনিরা তার একদম মধ্যিখানে পড়েছেন।


জাতি-রাষ্ট্র শাসনব্যবস্থা ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের মডেল হিসাবে থাকবে কিনা, তা বলা কঠিন। মূল কথা হচ্ছে যে, যেহেতু ইসরায়েল রাষ্ট্র সেক্যুলার ইউরোপীয় ও আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের রূপকে পূর্বেই মেনে নিয়েছে, সেহেতু যে কাঠামো এই সংঘাতের জন্ম দিয়েছে সেই কাঠামোর মধ্যে ফিলিস্তিন/ইসরায়েল সংঘাতের কোন সমাধান পাওয়া দুষ্কর। একইসাথে দুনিয়া নাগরিক সমাজের রাজনীতিকীকরণ (মর্যাদার দাবিতে ক্রমবর্ধমান ম্যানিফেস্টেশন) এবং একটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক সমাজের উত্থানের সাক্ষী হচ্ছে। যে জাতি-রাষ্ট্র আধুনিক/উপনিবেশিক বৈশ্বিক ব্যবস্থাতে জায়নবাদ উত্থানের শর্তগুলোর জন্ম দিয়েছিল, সেই জাতি-রাষ্ট্রের বিকল্প প্রস্তাব করতে পারে এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থার মধ্যে ফিলিস্তিন/ইসরায়েল সংঘাতের সমাধান চিন্তা করতে হবে।

____________

পাদটীকা

১) আমি সান্তিয়াগো স্লাবোদস্কির কাছে কৃতজ্ঞ, কেবল প্রবন্ধটি পড়া এবং বিভিন্ন মতামত জানানোর জন্যই নয়, বরঞ্চ তাঁর মতামতগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনায় যুক্ত হওয়ার জন্যও বটে। দশ বছরের অধিক সময় ধরে জায়নবাদ, ইহুদি-ধর্ম, ইহুদি-বিদ্বেষ, বিউপনিবেশায়নের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে আলাপচারিতার জন্যও কৃতজ্ঞ। থিওডর হার্জলের ওপর তাঁর প্রকাশিতব্য Decolonial Judaism (Basingstoke: Palgrave, ২০১৪) গ্রন্থের একটি পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্যও ধন্যবাদ।

২) পরিষ্কার করার জন্য: ‘জাতি-রাষ্ট্রের বিউপনিবেশীকরণ’ বলতে আমি বুঝাচ্ছি রাষ্ট্রের তত্ত্বের বিউপনিবেশীকরণ, কেননা তত্ত্ব বিনা কোন রাষ্ট্র নেই, যেমন করে আধুনিক ইউরোপীয় চিন্তায় জাতি-রাষ্ট্রের রূপকল্প ছাড়া কোন তত্ত্বও নেই।


৩) আমি ‘আধুনিকতা’কে ‘পশ্চিমা’ হিসাবে বিবেচনা করছি, কারণ ‘আধুনিকতা’ কোন একটি সত্তা (entity) বা একটি ঐতিহাসিক কাল নয়। বরঞ্চ এটি হচ্ছে ইউরোপের নিজস্ব অর্জন এবং অধিকারচ্যুতকরণ, শাসন ও দখলের জায়েজিকরণ বিষয়ক ইউরোপ কর্তৃক স্ব-রচিত আখ্যান।


৪) থিওডর হার্জল যখন ১৮৯৬ সালে তাঁর কর্মসূচিমূলক টেক্সট, ‘The Jewish State’ লিখেন তখন আধুনিকতার রেটরিককে পুরোপুরি গ্রহণ করেছিলেন। (http://www.jewishvirtuallibrary.org/jsource/Zionism/herzl2.html) [date accessed August 28, 2013]. সে সময় তিনি একটি নিম্নবর্গের অবস্থান থেকে আধুনিকতার রেটরিককে গ্রহণ করেছিলেন : তাঁর ধারণার বাস্তবায়ন বা প্রয়োগের পরিণতি দেখার জন্য তখনো কোন রাষ্ট্র ছিল না। পুনর্বিবেচনার জন্য একটি কেইস: একটি নিম্নবর্গীয় অবস্থান থেকে মুক্তির প্রকল্পগুলো কেবল প্রকল্পই। আমরা এমন বহু ঘটনা মনে করতে পারি, যেমন রুশ বিপ্লব ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আবির্ভাবের পূর্বে ভ্লাদিমির লেনিনের লেখাপত্র। লেনিন উদারপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আধুনিকতার রেটরিককে পুরোপুরি সমর্থন করেছিলেন।


৫) [মিশেল প্রিয়োর] Michael Prior, The Bible and Colonialism. A Moral Critique (London: Bloomsbury, 1997).


৬) [মার্ক এলিস] Marc Ellis, Judaism Does Not Equal Israel (New York: Te News Press, 2009).


৭) Ellis, Judaism, p. ix.


৮) Giulio Meotti, “Tutu’s War on Israel, Jews.” Y-Net Magazine, August 11, 2011 (http://www.ynetnews.com/articles/0,7340,L-4107913,00.html) [date accessed August 28,2013].


৯) Alan M. Dershowitz, “Bishop Tutu Is No Saint When It Comes to Jews.” Gatestone Institute. International Policy Council, December 20, 2010 (http://www.gatestoneinstitute.org/1742/bishop-tutu-is-no-saint-when-it-comes-to-jews) [dateaccessed August 28, 2013]; Robert Fine, “Blame Games Won’t Lead Us to Peace. ”October 2010 (http://engageonline.wordpress.com/2010/10/08/robert-fne-respondsto-desmondtutus-call-for-a-boycott-of-israel-in-the-south-african-mail-guardian/)[date accessed August 28, 2013].


১০) The Virtual Jewish Library-তে পুরো প্রতিবেদনটি দেখুন: (http://www.jewishvirtuallibrary.org/jsource/History/67_War.html) [date accessed August 28, 2013].


১১) এই দিকে একটি দারুণ প্রচেষ্টা হচ্ছে এই বইটা: Roxanne L. Euben, Enemies in the Mirror. Islamic Fundamentalism and the Limits of Modern Rationalism (Princeton, NJ: Princeton University Press, 1999).


১২) আমি এশিয়ায় (কনফুসিয়ানিজম, বৌদ্ধধর্ম), আফ্রিকা এবং তাওয়ান্টিন্সুয়ু ও আনাহুয়াক (ইনকাস, মায়া এবং অ্যাজটেক)-এর মহান সভ্যতার মধ্যের বিশ্বাসী সম্প্রদায়গুলো নিয়ে বিস্তারিত বলতে পারছি না।


১৩) ১৯০০ সালের দিকে যখন রাজনৈতিক জায়নবাদের উত্থান হচ্ছিল তখন ইউরোপের সবচেয়ে বেশি ইহুদিদের ঘনত্ব ছিল রাশিয়াতে (ত্রিশ লক্ষের অধিক), এবং দ্বিতীয় ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যে (১০ লক্ষের অধিক)। যুক্তরাষ্ট্রে তখন ইহুদি জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ লক্ষ। ১৯৪২ সাল নাগাদ ইহুদিদের প্রধান দলটি (ঘনত্বের দিক দিয়ে) ছিল সেন্ট্রাল ইউরোপে। (http://www.jewishvirtuallibrary.org/jsource/History/totaljews.html) [date accessed August 28, 2013]. তখন যদি সাংস্কৃতিক জায়নবাদের উৎপত্তিস্থল রাশিয়া ও পোল্যান্ড হতো, তাহলে রাজনৈতিক জায়নবাদের উত্থান হতো মধ্য ইউরোপে, যেখানে পশ্চিমের হাওয়া সবচেয়ে জোরালোভাবে প্রবাহিত হচ্ছিল : ১৯১৮ সালেই অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্য ভেঙ্গে গিয়েছিল।


১৪) Franz Hinkelammert, “The Hidden Logic of Modernity: Locke and the Inversion of Human Rights.” WKO, 2004

(http://globalstudies.trinity.duke.edu/wpcontent/themes/cgsh/materials/WKO/v1d1_HinkelammertF.pdf) [date accessed August 28, 2013].


১৫) নাজি জেনোসাইডের ওপর : [জিগমুন্ট বম্যান] Zygmunt Bauman, Modernity and the Holocaust (Ithaca: Cornell University Press, 1991).


১৬) Gregory Blue, “Gobineau on China. Race Teory, the ‘Yellow Peril’ and the Critique of Modernity.” Journal of World History, 10/1, 1999, pp. 93–111.


১৭) বিস্তারিত বিবরণের জন্য দেখুন : [মিশেল প্রিয়োর] Michael Prior, Zionism and the State of Israel. A Moral Inquiry (London: Routledge, 1999).


১৮) একটি সাম্প্রতিক বিস্তারিত ও গভীর বিবরণের জন্য দেখুন: David Nirenberg, Anti-Judaism. The Western Tradition (Chicago, IL: The University of Chicago Press,2013), pp. 13–47, 217–68.


১৯) ষোড়শ শতকের বর্ণ/জাতগত গঠনের বিবরণ পাওয়া যাবে : Rereading the Black Legend: The Discourse of Religious and Racial Difference in the Renaissance Empire, Margaret Greer, Walter Mignolo, and Maureen Quilligan (eds) (Chicago, IL: The University of Chicago Press, 2008).

২০) শাহ্‌ [The Shah] সম্রাট ছিলেন না, যেমন করে একজন সম্রাট [Emperor] শাহ্‌ ছিলেন না। ফলস্বরূপ, পারস্য একটা সাম্রাজ্য [Empire] ছিল না, বরঞ্চ একটি শাহানাত [Shahanate] ছিল, একইভাবে রোম শাহানাত ছিল না, বরঞ্চ সাম্রাজ্য ছিল। কালিক ও স্থানিক এই পার্থক্যগুলোকে যদি আমরা বুঝতে না পারি, তাহলে [উদাহরস্বরূপ] সাম্রাজ্যের মতো কাল্পনিক এন্টিটিকে ইমাজিন করার ঝুঁকি রয়ে যাবে।


২১) Conrad Cherry, God’s New Israel: Religious Interpretations of American Destiny (Chapel Hill: The University of North Carolina Press, 1998).


২২) [মিশেল ব্রেনার] Michael Brenner, Zionism: A Brief History, trans. Shelley L. Frisch (Princeton, NJ: Marku and Wienner Publisher, 2003). তদুপরি, বিউপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘আন্তর্জাতিক জাতীয়তাবাদ’ কোন আপাত-বিরোধাত্মক বা প্যারাডক্স নয়, বরঞ্চ এশিয়া ও আফ্রিকার (The Bandung Conference, 1955) ও জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর (যুগোশ্লোভিয়া, ১৯৬১) বিউপনিবেশিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক পরিণতি। তবু এই প্রকল্পগুলোর ডিরেকশনালিটি সহগামী হয় : বিউপনিবেশিক সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণের অবসান ঘটিয়ে নিজস্ব রাষ্ট্রের গঠনের দিকে; যেখানে জায়নবাদ উল্টো পথে যাত্রা করেছিল, ইচ্ছা ছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সহায়তায় একটি অঞ্চল পাওয়া এবং একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলা।


২৩) [কার্ল স্মিট] Carl Schmitt, The Nomos of the Earth in the International Law of the Jus Publicum Europaeum [1950], trans. G. L. Ulmen (New York: Telos Press, 2006). [অনুবাদ দেখুন, এখানে ] পশ্চিমা সভ্যতার ভিত্তি হিসাবে ‘ক্ষমতার উপনিবেশিক বিন্যাসের জন্য দেখুন : [ওয়াল্টার মিনোলো] Walter D. Mignolo, The Darker Side of Western Modernity: Global Futures, Decolonial Options (Durham, NC: Duke University Press, 2011).


২৪) (কু)খ্যাত ‘Requerimiento’ ভূমিসন্তান/নেটিভদের স্পেনীয় শাসন ও খ্রিস্টধর্মের কাছে নিজেদেরকে আত্মসমর্পণের দাবি জানিয়েছিল। (http://www.milestonedocuments.com/documents/view/rzquerimiento) [date accessed August 28, 2013] অধিকারচ্যুতকরণ এটার সাথে খাপ খেয়েছিল। দুই দশক পরে, মানবেতিহাসে প্রথমবারের মতো অধিকারচ্যুতকরণকে বৈধতা দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক আইন করা হয়। Fernandez de Santa Maria, The Discovery of America and the School of Salamanca (Cambridge: Cambridge University Press, 1977).


২৫) Anthony Angie, Imperialism, Sovereignty and the Making of International Law (Cambridge: Cambridge University Press, 2007); Sba N’ Zatioula Grovogui, Sovereigns, Quasi-Sovereigns, and Africans (Minneapolis: University of Minnesota Press, 2005).



প্রকাশঃ ই ভাদ্র, ১৪২৮:::২শে আগস্ট, ২০২১