গ্রাহাম হারমান ও অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড অন্টোলজিঃ (উত্তর)আধুনিকতা থেকে প্রস্থান




[ বিভিন্ন পক্ষ ও অবস্থান থেকে আধুনিকতাকে চিহ্নায়ন ও পর্যালোচনা করার পাশাপাশি নানান কৌশলে এর থেকে অনেকেই বের হয়ে আসতে চেয়েছেন; উত্তর-আধুনিকদের মধ্যেও এই চেষ্টা লক্ষনীয়। পরবর্তীতে উত্তর-আধুনিক ভাবুকদের প্রত্যুত্তরকে এক ছাতার নিচে নিয়ে এসে অনেকটা আধুনিক বনাম উত্তর-আধুনিক দ্বিত্ব তৈরী করা হয়েছে। এই দ্বিকোটিক জগতের বাইরে এসে অবস্থান নেন ফরাসী দার্শনিক ব্রুনো লাতুর, যিনি নিজেকে ন-আধুনিক বলে দাবী করেন। গ্রাহাম হারমান’দের অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড অন্টোলজি অনেকটা এই অবস্থান থেকে অনুপ্রাণিত এবং একধরনের দার্শনিক ধারবাহিকতা। স্মরণ রাখতে হবে যে এই ধারাবাহিকতা কেবল বিস্তৃতি বা নিছক অনুসরণ নয়। It is a continuation with rupture. পশ্চিমা দর্শনে দীর্ঘদিনের চর্চিত ‘সাবজেক্ট ওরিয়েন্টেড অন্টোলজি’ থেকে হারমানদের এই যে বের হওয়ার প্রচেষ্টা, তা আমরা পাই তাদের অবজেক্ট ওরিয়েন্টেড অন্টোলজির আলাপে। পশ্চিমের কন্টিনেন্টাল দর্শনে এই সময়ে চলমান এই দার্শনিক বিতর্ক সম্পর্কে বাংলা ভাষাভাষী বিদ্যায়তনে পরিচিতি নাই বললেই চলে। এই লেখায় লাতুরের সূত্র ধরে গ্রাহাম হারমানের প্রস্তাবনার মূলে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে। কাজী তাফসিন এই লেখায় আমাদেরকে এই নতুন চিন্তার সাথে পরিচিত করানোর কোশেশ করেছেন।]




Object Oriented Ontology(OOO)-র যাত্রা দর্শনের জগতে প্রায় নতুনই বলা চলে। যদিও এরকম নতুন কিছুর আসার সম্ভাবনা এবং আলাপ অনেক দিন ধরেই চলছিলো। আর এদিকে Object Oriented Ontology নিয়ে আমার নিজের আগ্রহও একেবারেই শিশু অবস্থায় আছে। কিন্তু আমার এই আগ্রহ বোধ করারও যথেষ্ট কারণ আছে। নৃবিজ্ঞান নিয়ে একদিক দিয়ে পড়াশোনা শুরু করা এবং বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে জানাশুনার আগ্রহ ছিলো বিধায় আমি কোনো এককালে খুঁজতে শুরু করেছিলাম বিজ্ঞান বিষয়ক জায়গাগুলোতে নৃবিজ্ঞানের কোনো কন্ট্রিবিউশান/কাজ আছে কিনা। এই নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতেই আমি ব্রুনো লাতুরের Laboratory Life (১৯৭৯) নামের এথনোগ্রাফিটা খুঁজে পাই।


Laboratory Life নামের এই এথনোগ্রাফিটা ছিলো ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করা একটা ল্যাবরেটরিকে নিয়ে, যেখানে লাতুর আর উলগার যৌথভাবে বেশ কিছুদিন যাবত নৃবিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছেন। ওই বইয়েই ব্রুনো লাতুর প্রথমবারের মত বিজ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিকতা নামের এই এথনোগ্রাফিটা ছিলো ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা করা একটা ল্যাবরেটরিকে নিয়ে, যেখানে লাতুর আর উলগার যৌথভাবে বেশ কিছুদিন যাবত নৃবিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছেন। ওই বইয়েই ব্রুনো লাতুর প্রথমবারের মত বিজ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিকতা নিয়ে নানারকম প্রশ্ন তোলা শুরু করেন এবং দেখাতে চেষ্টা করেন বৈজ্ঞানিক গবেষণা যে আসলে ‘অরাজনৈতিক’ কোনো কিছু না। ওই সময়ে, মানে ১৯৭৯ সালে, লাতুর যখন ল্যাবরেটরি লাইফ নামের এই এথনোগ্রাফিটা প্রকাশ করেছিলেন তখন বিজ্ঞানবোদ্ধারা এটা পড়ে নানানরকম আলোচনা সমালোচনা ও গালাগালি শুরু করে দেন। পরবর্তীতে লাতুর এই কাজগুলো শুধু এথনোগ্রাফিক কাজে সীমাবদ্ধ না রেখে দার্শনিক জায়গা থেকেও তাঁর অবস্থান প্রকাশ করা শুরু করলেন। বিজ্ঞান ও রাজনীতির এরকম পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে গিয়েই লাতুর তখন নিজেদের চক্রের অন্যান্য বন্ধুবান্ধব মিলে Actor-network Theory(ANT) নামে একটা সমাজতাত্ত্বিক ও দার্শনিক অনুসন্ধানের বা পদ্ধতির সূচনা করলেন।


Actor Network Theory মূলত Flat Ontology-ওয়ালা একটা তত্ত্ব যেখানে কিনা সব জিনিসই(entity) একেকটা অ্যাক্টর, যতক্ষণ পর্যন্ত ওই জিনিসটা কোনো না কোনোভাবে ক্রিয়াশীল থাকে এবং ঐ জিনিসটা(entity) অন্য জিনিসের(entity’র) সাথে সম্পর্কিত থাকে কোনো না কোনোভাবে। মানে হিলারি ক্লিনটন, রিপন ভিডিও, পারমাণবিক বোমা, ব্যাটম্যান, প্লাস্টিকের বোতল, স্মার্ট ফোন, পাশের বাড়ির তালগাছ, ক্রিকেট বল, ডিএনএ স্যাম্পল সবকিছুই সমান গুরুত্বপূর্ণ এই অ্যাক্টর নেটওয়ার্ক থিওরির জন্য। এখানে উল্লেখ করা প্রত্যেকটা এন্টিটিই হচ্ছে লাতুরের জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত একেকটা ‘Actor যতক্ষন পর্যন্ত সেগুলো অন্যকিছুর ওপর কোনো না কোনোভাবে প্রভাব রাখতে থাকবে।(দেখুন গ্রাহাম, ২০১৪)


প্রশ্ন হলো, সবকিছুকে এমন এক কাতারে এনে ‘Actor’ হিসেবে দেখানোর প্রয়োজনটা কি? এই প্রয়োজনটা লাতুরের মাথায় হাজির হয়েছিল Laboratory Life (১৯৭৯) বইটা লেখার পর থেকেই। সেখানে ‘সায়েন্স’ নিয়ে যখন একরকম বিতর্ক যখন শুরু হলো তখন এই বিতর্ক করতে করতে লাতুরের আলোচনা মডার্নিটির সমালোচনার মুখোমুখি এসে ঠ্যাকে। মডার্নিটি নিয়ে যখন লাতুর সমালোচনা শুরু করেছিলেন তখন উনি মডার্নিটির একটা বড় ঝামেলা দেখতে পেয়েছিলেন। ঝামেলাটা শুরু হয় যখন থেকে মডার্নিটি ন্যাচার এবং কালচারকে আলাদা করা শুরু করে। তিনি দেখাচ্ছিলেন যখন থেকেই মানুষ ন্যাচার এবং কালচারকে আলাদা করা শুরু করল, তখন থেকেই মানুষ আসলে একটা মেটাফিজিকাল সীমাবদ্ধতায় পড়ে গেল। মডার্নরা এভাবে সবকিছুর মধ্যে বিভক্তি এনে কিছু বিষয়কে অধিক গুরুত্ব এবং কোনো কোনো বিষয়কে কম গুরুত্ব দিয়ে একটা জঞ্জাল তৈরি করলো। এটা করলো তারা মেটাফিজিকালি দুইটা পোল/মেরু তৈরি করার মাধ্যমে। এই মেরু দুইটার মধ্যে মডার্নিটি একপাশে রাখলো ন্যাচারকে এবং অপর পাশে তারা রাখলো সমাজকে/কালেক্টিভকে/কালচারকে। এরপর তাদের বানানো এই মেরু দুইটা অনুযায়ী, তারা তাদের জ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখাকে ভাগ করে দিল, চিন্তার ফ্যাকাল্টিগুলোকেও ভাগ করল। মানে, যারা ন্যাচার পোল নিয়ে কাজ করবে মডার্নিটি তাদের নাম দিলো সায়েন্টিস্ট এবং যারা সায়েন্স বাদে অন্য ফ্যাকাল্টিগুলো নিয়ে কাজ করবে মডার্নিটি তাদেরকে রাখলো সোসাইটি/কালচার পোলের আশেপাশে। এভাবে জ্ঞান ও চিন্তার ভাগবাটোয়ারা করার মাধ্যমে মডার্নিটি একধরনের যোগাযোগ-বিচ্ছিন্নতা তৈরি করলো নিজেদের মধ্যেই। এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা যখন তৈরি হলো, তার কিছুকাল পর থেকেই দেখা গেলো ন্যাচার পোল নিয়ে যারা কাজ করা শুরু করল তারা কালচার পোলের বিশেষজ্ঞদের কথা কানে নেয় না এবং একই ভাবে কালচার পোল নিয়ে যারা কাজ করে তারা ন্যাচার পোলের বিশেষজ্ঞদের কথা কানে নেয় না।