ক্ষমতা/জ্ঞান ছাড়িয়ে

ক্ষমতা, অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার একটি অন্বেষণ

ডেভিড গ্রেয়বার




[প্রতি বছর "লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস"-এর নৃবিজ্ঞান বিভাগ একজন নৃবিজ্ঞানীকে আমন্ত্রণ জানান "ম্যালিনোস্কি বক্তৃতা" প্রদানের জন্য। নৃবিদ্যায় যাদের কাজকে তাৎপর্যপূর্ণ বিবেচনা করা হয় তাদেরকেই মূলত এই বক্তৃতা প্রদানের জন্য ডাকা হয়। ২০০৬ সালের ২৫শে মে, ডেভিড গ্রেয়বার(David Graeber) সম্মানজনক ম্যালিনোস্কি বক্তৃতা দেন। গ্রেয়বার প্রদত্ত এই বক্তৃতার শিরোনাম ছিল Beyond Power/Knowledge: an exploration of the relation of power, ignorance and stupidity (ক্ষমতা/জ্ঞান ছাড়িয়েঃ ক্ষমতা, অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতার একটি অন্বেষণ)। গ্রেয়বারের এই ম্যালিনোস্কি বক্তৃতা যৌথভাবে অনুবাদ করেছেন কাজী রবিউল আলম এবং রাদিয়া আউয়াল তৃষা। অনুবাদকদ্বয় উভয়েই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে পড়ান।]




আমলাতন্ত্র সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত গল্প দিয়ে শুরু করি।



আমার মা গত বছর জুড়ে বেশ কয়েকটি স্ট্রোক করেছিলেন। শীঘ্রই এটি স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে তিনি কারও সহায়তা ছাড়া বাড়িতে একা বসবাস করতে অক্ষম; যেহেতু বাড়িতে দেখাশুনা করা তাঁর বীমার অন্তর্ভুক্ত ছিল না, সে কারণে অনেক সমাজকর্মী আমাদের পরামর্শ দিল তাঁকে হাসপাতালে ভর্তির জন্য। একজনের কাছে কেবল ছয় হাজার ডলার থাকলেই সে হাসপাতাল সেবা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। আমরা তাঁর সঞ্চয় স্থানান্তরের ব্যবস্থা করলাম। আমার ধারণা মতে, এটি ছিল একটি প্রযুক্তিগত কেলেঙ্কারী। যদিও সরকার হাজার হাজার কর্মী নিয়োগ দিয়েছেন যাদের প্রধান কাজ হচ্ছে এটি কিভাবে করা যায় তা জনগণকে বলা, তা সত্ত্বেও এটি ছিল একটি অদ্ভুত ধরনের কেলেঙ্কারী। কিন্তু এর অল্প কিছুদিনের মধ্যে, তিনি আরেকটি গুরুতর স্ট্রোকের শিকার হন এবং তাঁকে দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসনের জন্য একটি নার্সিং হোমে ভর্তি হতে হয়। তিনি যখন সেখান থেকে ছাড়া পান তখন তাঁর বাড়িতে পরিষেবার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেখানে একটি সমস্যা দেখা দেয়ঃ তাঁর সামাজিক সুরক্ষার চেক সরাসরি তাঁর একাউন্টে জমা হয়ে গিয়েছিল। সে অনেক কষ্টে কেবল তাঁর নাম সই করতে সক্ষম হচ্ছিলেন। ফলে যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি তাঁর একাউন্টের অ্যাটর্নি ক্ষমতা পাচ্ছিলাম না ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর মাসিক বিল পরিশোধ করতে পারছিলাম না। আর যতক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব হচ্ছে না ততক্ষণ পর্যন্ত মাসিক বিল দ্রুত বাড়তে থাকবে এবং তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করবে। যদিও আমি ইতিমধ্যে হাসপাতাল সংক্রান্ত অনেক নথি পূরণ করেছিলাম তাঁর বিল পরিশোধের যোগ্যতা অর্জনের জন্য।



আমি তাঁর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে যাই, প্রয়োজনীয় ফর্মগুলো নেই। সেগুলো নার্সিং হোমে নিয়ে আসি। নথিগুলো নোটারি করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট নার্স আমাকে জানান যে তাদের নিজস্ব একজন নোটারি আছেন। কিন্তু তাঁর জন্য আগে থেকে সাক্ষাৎকারের সময় নির্ধারণ করতে হবে। সে ফোনটি তুলে আমাকে একটি নীরস কন্ঠস্বরের ব্যক্তিকে ধরিয়ে দিলেন, যিনি শেষ পর্যন্ত নোটারির সঙ্গে আমাকে সংযোগ করিয়ে দিলেন। নোটারি আমাকে জানালো যে প্রথমে আমাকে সামাজিক সেবার প্রধানের কাছে থেকে অনুমোদন নিতে হবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ফোনটি কেটে দিল। আমি তাঁর নাম ও রুম নম্বর নিলাম এবং যথাযথভাবে লিফট দিয়ে নীচে নেমে এসে তাঁর অফিসে উপস্থিত হলাম। এসে দেখলাম, তিনি আর কেউ নন ফোনের সেই নিরস কন্ঠস্বরের ব্যক্তি। সামাজিক সেবার প্রধান ফোনটি উঠালেন এবং বললেন “মার্জরি, আপনি এই নির্বোধ লোকটিকে পাগল করে তুলেছেন এবং সাথে সাথে আমাকেও”, এবং পরের সপ্তাহের প্রথম দিকে আমার জন্য একটি সাক্ষাৎকারের তারিখ নির্ধারণ করলেন।



“ঠিক আছে, আমি করেছি, কিন্তু নোটারি আমাকে যা করতে বলেছে আমি ঠিক তা’ই করেছি”।

“তবে এখানে স্পষ্টতই স্বাক্ষর লেখা আছে”।

“ও, হ্যাঁ, এটা দিয়ে কাজ চলবে তো নাকি? আমার ধারণা সে আমাকে ভুল বলেছে। আবার। ঠিক আছে…সব তথ্য এখানে আছে, তাই না? শুধু একটির জায়গায় অন্যটি দেওয়া হয়েছে। এটা কি আসলেই কোন সমস্যা? এটা একধরণের চাপ এবং আমার পক্ষে নোটারির সাথে আবার একটা সাক্ষাৎকারের সময় পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা সম্ভব নয়”।

“ঠিক আছে, কিন্তু আমরা স্বাক্ষর প্রদানকারীর স্বশরীরে উপস্থিত ব্যতীত এই ধরনের ফরম গ্রহণই করি না”।

“আমার মা স্ট্রোক করেছেন। তিনি শয্যাশায়ী। প্রথমত, এই কারণেই আমার অ্যাটর্নি ক্ষমতা দরকার”।



সে বলল, এ বিষয়ে ম্যানেজারের সাথে কথা বলে তারপরে জানাবে। দশ মিনিট পরে ফিরে এসে সে জানালো যে, ব্যাংকের বর্তমান অবস্থায় তাদের পক্ষে এই ফরমটি গ্রহণ করা সম্ভব নয় এবং এমনকি সেটি যদি সঠিকভাবে পূরণ হয় তারপরেও। এ ক্ষেত্রে আমার মায়ের ডাক্তারের কাছে থেকে একটি চিঠি লাগবে যেখানে উনি উল্লেখ করবেন যে আমার মা এই ধরনের নথিতে স্বাক্ষর করতে মানসিকভাবে সক্ষম। আমি তাঁকে বললাম যে এর আগে কেউ আমাকে এ ধরনের চিঠির বিষয়টি উল্লেখ করেনি।


ম্যানেজার যে ব্যক্তিটি শুনছিলেন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন “কি?” “আপনাকে কে এই ফরমগুলো দিয়েছিল এবং এই চিঠির বিষয়টা আপনাকে বলেনি?”


যেহেতু আপাত অপরাধী প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকের সুন্দর কর্মচারীদের মধ্যে একজন ছিলেন, তাই আমি প্রসঙ্গটি পরিবর্তন করলাম, এবং উল্লেখ করলাম যে ব্যাংকবহিতে স্পষ্টতই লেখা আছে, “ডেভিড গ্রেয়বারের বিশ্বস্থতায়”। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে জবাব দিলেন যে এটি কেবল তিনি মারা গেলে কেবল সে ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।


যেমনটি ঘটেছিল, পুরো সমস্যাটি শীঘ্রই একাডেমিক হয়ে উঠল: আমার মা সত্যিই কয়েক সপ্তাহ পরে মারা গেলেন।


এই সময়ে, এই অভিজ্ঞতা আমার মধ্যে একধরনের অত্যন্ত উদ্বেগ তৈরী করে। সাধারণভাবে আমি এই ধরনের বিষয় থেকে সম্পর্কবিহীন একটি জীবন অতিবাহিত করার অভিজ্ঞতা থেকে পরবর্তীতে আমি আমার বন্ধুদের প্রায়শই জিজ্ঞাসা করতে থাকি যেঃ বেশীরভাগ মানুষের দৈনন্দিন জীবন কি এরকমই? বন্ধুদের বেশিরভাগই সন্দেহ করেছিল যে সেটি এরকমই ছিল। নিশ্চিতভাবে, নোটারি অস্বাভাবিকভাবে অযোগ্য ছিলেন। এরই মধ্যে, নিউইয়র্ক-এর মোটরযান বিভাগের একজন অজানা কর্মকর্তার একটি ভুলের কারণে আমাকে ইতিমধ্যে একমাস সময় ব্যয় করতে হয়েছে। কর্মকর্তাটি ভুল করে আমার প্রদত্ত নাম দেয়ঃ


“Daid, যেখানে ভেরিজোন কর্মকর্তার কথা উল্লেখ না করাই ভালো, যিনি আমার পদবী উচ্চারণ করেছিলেন “Grueber”।


যে কোন ঐতিহাসিক কারণেই – সরকারী এবং বেসরকারী আমলাতন্ত্র এমনভাবে পরিচালিত হয় যেন নিশ্চিতভাবেই এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশরাই তাদের দায়িত্ব প্রত্যাশা অনুযায়ী পালন করতে সক্ষম হয় না। আর যারা এই ব্যবস্থাটা চালায় তাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এটি ব্যবস্থার সমস্যা নয়, বরং যে ব্যক্তিগুলো এর সাথে যুক্ত তাদের অদক্ষতার ফলাফল। এর এটি আবিষ্কার করার পর এই ধরনের ইউটোপীয় চর্চার মৌলিক বৈশিষ্ট কি হতে পারে সম্পর্কে আমার মনে একটা ধারণা হয়।


এই ফরমগুলো পূরণ করতে গিয়ে যেভাবে যে বোকামি আমি করেছি তা ছিল একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে আমার কাছে সম্ভবত সবচেয়ে অস্বস্তিকর বিষয়। কিভাবে আমার চোখে পড়েনা যে, যে জায়গায় “স্বাক্ষর” লেখা আছে সে জায়গায় আমি আমার নাম মুদ্রিত করেছি? আর এমনটি ঘটেছিল পুরো বিষয়টি নিয়ে আমার যথেষ্ট মানসিক ও আবেগীয় শক্তি ব্যয় করা সত্ত্বেও। আমার উপর আমলাতান্ত্রিক শক্তির যে প্রভাব পড়েছিল তাকে বোঝার নিরন্তর প্রয়াসেই এই শক্তির বেশীরভাগ ব্যয় হয়েছিল বলে আমার মনে হয়। কিন্তু এখানে যা দরকার ছিল তা হলো মূলত দুই একটা ল্যাটিন শব্দের সঠিক ব্যখ্যা এবং একটি যান্ত্রিক কাজের সঠিক সম্পাদন। অদক্ষতার জন্য আমি নোটারির মুখ ঘষছিলাম এমনটা যাতে মনে হয় কিংবা কি কারণ আমাকে ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে ছিল সে ভাবনায় সময় ব্যয় করার জন্য আমি খেয়ালই করতে পারিনি যে তাঁরা আমাকে বোকার মতো কিছু করতে বলেছিল। এটা নিশ্চিতভাবে ভুল জায়গায় ভুল কৌশল ছিল, কারণ আমি যাদের সঙ্গে কথা বলছিলাম তাদের কারও পক্ষেই নিয়মগুলোকে পরিবর্তনের ক্ষমতা ছিলনা। উপরন্ত, আমার বার বার মনে হচ্ছিলো আমি যদি তাদের সাথে মুখোমুখিও হতাম এবং একটি প্রকৃত কাঠামোগত অযৌক্তিতা সম্পর্কে অভিযোগও করতাম তবে সেটার একমাত্র সম্ভাব্য ফলাফল হতো কিছু নিন্মপদস্থ কর্মভার-প্রাপ্ত ব্যক্তিকে সমস্যার মধ্যে ফেলে দেওয়া।



একজন নৃবিজ্ঞানী হিসেবে আমার কাছে সবচেয়ে কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় ছিল এথনোগ্রাফিক লেখালেখিগুলোতে এই বিষয়গুলোর যৎসামান্য উপস্থিতি। সর্বোপরি, নৃবিজ্ঞানীরা জন্ম, বিবাহ, মৃত্যু এবং সমরূপ আচার-অনুষ্ঠানকে নিয়ে কাজ করার মধ্য দিয়ে একটা বিশেষত্ব তৈরী করেছেন। আমরা বিশেষভাবে আচার-অনুষ্ঠানের সেই ভঙ্গী নিয়ে আগ্রহী যা সামাজিকভাবে কার্যকরঃ যেখানে নিছক কিছু বলা বা করাও একটি সামাজিক সত্য হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এই মুহুর্তে বেশীরভাগ সমাজে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান নয়, বরং কাগজপত্র সামাজিকভাবে কার্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়। উদাহরণস্বরুপ আমার মায়ের কথা বলা যায়, যিনি কোন অনুষ্ঠান ছাড়াই সমাধিস্থ হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। আমার কাছে মায়ের অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার প্রধান স্মৃতি বলতে যা মনে পড়ে তা হচ্ছে একজন দ্বিধাহীন স্বভাবসুলভ কেরানী কর্তৃক প্রদত্ত ১৪ পৃষ্ঠার একটি নথি যা তাকে পূরণ করতে হবে মায়ের মৃত্যুর সার্টিফিকেট পাবার জন্য। এখানে কার্বন পেপারে বলপয়েন্টে লিখতে হয়েছিল যেন তিনটি কপি করা যায়। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম “দিনের কত ঘন্টা সময় আপনাকে এই ধরনের ফরম পূরণ করবার জন্য ব্যয় করতে হয়?” সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তাঁর ব্যান্ডেজ করা একটি হাত (ইনসিপিয়েন্ট কার্পাল টানেল সিনড্রোম-এর কারণে) উঠিয়ে সে বললো “আমার কাজ’ই এটা”। এই ফরমগুলো ছাড়া আমার মা আইনগতভাবে–সামাজিকভাবে–মৃত নন।


কেন তাহলে আমেরিকান বা ব্রিটিশ আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে লিখিত বইয়ে ফরম বা কাগজপত্র নিয়ে দীর্ঘ অধ্যায় নেই? এর সুস্পষ্ট উত্তর হতে পারে কাগজপত্র হচ্ছে বিরক্তিকর। এটার বলার মতো তেমন কোন আকর্ষণীয় দিক নেই।


নৃবিজ্ঞানীরা সাধারণত উপাত্তের ঘনত্বের দিকে আকৃষ্ট হন। আমাদের হাতে যে ইন্টারপ্রেটেটিভ কৌশল আছে সেটা অর্থ(meaning) বা মর্মার্থের জটিল বিন্যাসগুলোকে উম্মোচন করবার জন্য সবচেয়ে উপযুক্তঃ আচার-অনুষ্ঠানের জটিল প্রতীক, সামাজিক নাটক, কাব্যিক রূপ, আত্মীয়তার নেটওয়ার্ক… এর সবগুলোর মধ্যে যে মিল রয়েছে তা হলো প্রত্যেকটিই সীমাহীনভাবে সমৃদ্ধ এবং উম্মুক্ত; কেউ যদি কেবল একটি চ্বাঁলা (Ncwala) আচার-অনুষ্ঠান, বালিনিস মোরগ লড়াই, যাদুবিদ্যার অভিযোগ অথবা পারিবারিক কাহিনীর প্রতেকটি অর্থ, উদ্দেশ্য, অনুষঙ্গ সম্পর্কে জানতে চায় তবে সেটিও সম্ভাব্য অনন্তকাল ধরে চলতে পারেঃ উপরন্ত কেউ যদি বৃহত্তর সামাজিক বা প্রতিকী ক্ষেত্রের সাথে এর সম্পর্ককে অনুসন্ধান করতে চায় তবে সেটিও তাঁর জন্য উন্মুক্ত থাকে। এর বিপরীতে ফরমগুলো সর্বাধিক সহজ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণরূপে ডিজাইন করা। সেখানে ব্যাখ্যা করবার মতো তেমন কিছু নেই। সাহিত্যের সাথে আমলাতন্ত্রের সম্পর্কের মধ্যেও একই সমস্যা রয়েছে। সর্বোপরি এটি একধরনের নিরানন্দ কাফকায়েস্ককৌতুকের মতো বিষয় হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু এখানেও এটি তাৎপর্যপূর্ণ যে [ফ্রানৎস] কাফকা একমাত্র লেখক যিনি আমলাতন্ত্রের বাইরে গিয়েও দুর্দান্ত সাহিত্য তৈরী করেছেনঃ আর একবার আপনি এটি সম্পন্ন করবার পরে সেখানে অন্য কারও যোগ করবার মতো তেমন কিছু অবশিষ্ট থাকে না।


এখনও, সামাজিক তত্ত্ব শূন্যতাকে ঘৃণা সহকারে পরিহার করে। আমলাতন্ত্র নিয়ে সাহিত্য এই বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। আমলাতন্ত্র নিয়ে যতটুকু এথনোগ্রাফিক লেখালেখি আছে–সেটির প্যারাডাইম হচ্ছে হার্জফিল্ডের “উদাসীনতার সামাজিক উৎপাদন” (হার্জফিল্ড ,১৯৯২)–যেখানে “আমলাতন্ত্র হচ্ছে একটা নির্বুদ্ধিতা” এই দৃষ্টিভঙ্গি একটি সরল লোক মডেল হিসেবে উপস্থাপিত হয়। আর এর মাধ্যমে আমলাতন্ত্রের যে কোন পরিশীলিত, সাংস্কৃতিক বোঝাপড়াটা ব্যাখ্যা করা শুরু করা যায়। এই ধরনের কাজগুলো স্বাভাবিকভাবেই অস্বীকার করে না-যে আমলাতান্ত্রিক কোড ও বিধিবিধানগুলো নিয়মিতিভাবে এমনভাবে আচরণ করতে বাধ্য করে যেটা অন্য যে কোন পরিস্থিতিতে একটি বোকামির কাজ বলে বিবেচিত হবে। আর এটি মানুষ তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পারে। কিন্তু সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সত্যকে খুব কমই পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অন্তত একজন একটি “হ্যাঁ, কিন্তু” প্রত্যাশা করে–যেখানে “কিন্তু” এমনকিছু উপস্থাপন করে যা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।


আমরা যখন আরও গূঢ় তত্ত্বের দিকে এগিয়ে যাই, তখন এই “হ্যাঁ, কিন্তু”ও সাধারণত অদৃশ্য হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকার সামাজিক তত্ত্বে, ’পঞ্চাশ এবং ’ষাটের দশকে ম্যাক্স ওয়েবার এবং তার পর থেকে মিশেল ফুকোর আধিপত্যের ভূমিকাকে বিবেচনা করা যায়। নিঃসন্দেহে মার্ক্স বিরোধী হিসেবে তাঁদের খুব সহজে জনপ্রিয়তা পাওয়ার কারণ ছিল। তাঁদের তত্ত্বগুলো যুক্তি দেয় যে (সাধারণত অদ্ভুত সরলীকৃতভাবে) যুক্তি দেয় যে ক্ষমতা কেবল বা প্রাথমিকভাবে উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের বিষয় নয় বরং যে কোন সামাজিক জীবনের এক বিস্তীর্ণ, বহুমুখী এবং অনিবার্য বৈশিষ্ট্য। আমি আরও মনে করি এটা কোন কাকতালীয় ঘটনা নয় যে মানব ইতিহাসে এই দুইজন ব্যক্তি একমাত্র বুদ্ধিমান ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন যারা সত্যই বিশ্বাস করে আমলাতন্ত্র কাজ করে। ওয়েবার সংগঠনের আমলাতান্ত্রিক রূপগুলোকে যৌক্তিকতারই প্রতিমূর্তি হিসেবে দেখেছিলেন। আর এটাকে দেখেছিলেন যে কোন বিকল্পের চেয়ে সর্বোৎকৃষ্টরূপে, যা মানবতাকে চেতনা ও প্রতিভামুক্ত একটি আনন্দহীন “লোহার খাঁচায়” আটকানোর হুমকিস্বরূপ। ফুকো ছিলেন অনেক বেশি বিধ্বংসী, কিন্তু সেটি আমলাতন্ত্রিক শক্তিকে আরও বেশি কার্যকর করে তোলে।


শরীর, বিষয়, এমনকি সত্য, সবকিছু প্রশাসনিক ডিসকোর্সের উৎপাদন হয়ে ওঠে; শাসনতান্ত্রিকতা এবং জৈব-ক্ষমতার মতো ধারণার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র মানব অস্তিত্বের শর্তগুলোকে এমন প্রগাঢ়ভাবে গঠন করে যা সম্ভবত ওয়েবারের কল্পনারও বাইরে ছিল।


এই উপসংহার এড়ানো কঠিন যে, এদের উভয়ের জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে সেই সময়ের আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা একটা ভূমিকা পালন করে। কারণ, ঐ সময়ে সেগুলো ক্রমশ এমন প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠছিল যা বিশ্বব্যাপী একটি সাম্রাজ্যীয় প্রশাসনিক উপকরণের জন্য কার্যনির্বাহী উৎপাদন করবার জন্য নিবেদিত ছিল। ফুকোর বর্তমান কর্তৃত্বের কারণও একই। আর এর পথচিহ্ন দেখা যায় মূলত ওয়েবার-এর টেলকোট পার্সন(Talcott Parsons) সংস্করণের ’ষাটের দশকের বৈপ্লবিক’ প্রত্যাখ্যানের মধ্যে; যাইহোক এর চূড়ান্ত ফলাফল ছিল একধরনের শ্রম বিভাজন। আর এই বিভাজনে “যৌক্তিক পছন্দ তত্ত্বের” নামে আমলাদের আরও যথার্থ প্রশিক্ষণের জন্য ওয়েবারের আশাবাদী দিকটি আরও সরল রূপে পুনঃআবিস্কৃত হয়েছিল। অন্যদিকে হতাশাবাদী দিকটি ফুকোডিয়ানদের কাছে ন্যস্ত করা হয়েছিল। ফুকোর উত্থান সুনির্দিষ্টভাবে জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রচেষ্টার সেই পরিসরে গড়ে ঘটে যেখানে উভয়েই পক্ষান্তরে প্রাক্তন উগ্রবাদিদের জন্য স্বর্গ হয়ে ওঠে। কিন্তু সেগুলো কোন ধরনের রাজনৈতিক ক্ষমতা, এমনকি ক্রমান্বয়ে কোন ধরনের প্রকৃত সামাজিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আর এটিই ফুকোকে “জ্ঞান/ক্ষমতা”-এর যোগসূত্রকে গুরুত্ব দিতে আগ্রহী করে তোলে। আর এই যোগসূত্রে জ্ঞানের রূপ আর সামাজিক শক্তির রূপ একই। বস্তুত এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক শক্তির রূপ একটি বিশেষ আহ্বান মাত্র।



কোন সন্দেহ নেই এই ধরনের যুক্তিগুলো কিছুটা ব্যঙ্গাত্মক ও অনায্য। কিন্তু আমি মনে করি একটি গভীর সত্য রয়েছে। এটি কেবল এই নয় যে আমরা ঘনত্বের ক্ষেত্রগুলোর দিকে আগ্রহী, যেখানে ব্যাখ্যার দক্ষতা সর্বোত্তমভাবে প্রয়োগ হয়। যা কৌতূহলোদ্দীপক ও গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়ে তা চিহ্নিত করবার আমাদের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা রয়েছে। ঘনত্বের পরিসরগুলোকে ক্ষমতারও পরিসর হিসেবে ধরে নেয়, কিন্তু আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা আমাদের দেখায় যে এটি এই পরিসরের মধ্যে প্রায়শই বিবেচিত হয় না।


এই প্রবন্ধটি আমলাতন্ত্র অথবা নৃবিজ্ঞান এবং নৃবিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত জ্ঞানকান্ডে আমলাতন্ত্র উপেক্ষিত হওয়ার কারণ নিয়ে নয়। এই প্রবন্ধটি মূলত সহিংসতা নিয়ে।



আমি যে যুক্তিটি দিতে চাই তা হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলো একধরনের স্বেচ্ছাকৃত অন্ধত্ব তৈরী করে। এই পরিস্থিতি তৈরী হয় মূলত সহিংসতার দ্বারা। এখানে সহিংসতা বলতে কাঠামোগত সহিংসতা বোঝানো হচ্ছে। আর, কাঠামোগত সহিংসতা বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি একটি ব্যাপ্তিশীল বৈষম্যের ধরন যা শারীরিক ক্ষতির হুমকির দ্বারা সমর্থনপুষ্ট। স্থূলভাবে বলতে গেলে আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজাতভাবে এতটা বোকা নয় অথবা, তাঁরা এমন কিছু আচরণ সৃষ্টি করে যেগুলো নিজেদেরকেই বোকা হিসেবে চিহ্নিত করে। বরং, সেগুলো সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবার এমন একটি অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া যা ইতিমধ্যে বোকা হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে, কারণ সেগুলো কাঠামোগত সহিংসতার উপর প্রতিষ্ঠিত। আমি মনে করি এই দৃষ্টিভঙ্গি এমন কিছু সম্ভাব্য অন্তর্দৃষ্টি দেয় যা একই সঙ্গে কৌতূহলোদ্দীপক ও গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, সামাজিক তত্ত্বগুলোর সরলীকৃত ধরন ও আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ধরনের মধ্যে বিদ্যমান প্রকৃত সম্পর্ক বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টি।



II


আমরা চূড়ান্ত বিমূর্ত ও রূপক অর্থ ব্যতীত নার্সিং হোম, ব্যাংক বা এমনকি HMO (Health Maintain Organization)-গুলোকে সহিংস প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাবতে অভ্যস্থ নই। কিন্তু আমি এখানে যে সহিংসতার কথা বলছি সেগুলো মহৎ নয়। এগুলো বেশ মূর্ত। এই সব প্রতিষ্ঠানগুলো একটি সম্পত্তির অধিকার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে পরিচালিত সম্পদ বন্টনের সঙ্গে যুক্ত। আর এই ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত শক্তি প্রয়োগের হুমকির উপর নির্ভরশীল সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও নিশ্চিত হয়। ‘শক্তি’ প্রকারন্তরে সহিংসতা নির্দেশ করবার একটি শ্রুতিমধুর পথ।


এই সবগুলোই যথেষ্ট সুস্পষ্ট। এখানে এথনোগ্রাফিক আগ্রহের বিষয়টা হচ্ছে মূলত শিল্প গণতন্ত্রের নাগরিকরা আসলেই এই সত্যটি সম্পর্কে কীভাবে ভাবেন বা কতটা সহজাতভাবে আমরা এর গুরুত্বকে বিবেচনায় নেই না। উদাহরণস্বরূপ, এটিই সম্ভব করে তোলে, একজন স্নাতক শিক্ষার্থীর পক্ষে গ্রন্থাগারে গিয়ে আধুনিক জীবনে জবরদস্তির হ্রাসের গুরুত্ব সম্পর্কে, তত্ত্ব সম্পর্কে বইয়ের স্তুপে ডুবে থেকে দিন পার করতে। কিন্তু, সে কখনই ভাবে না যে যদি সে এই গ্রন্থাগারে তাঁর সীলমোহরকৃত বৈধ পরিচয়পত্র না দেখিয়ে প্রবেশ করবার তাঁর অধিকারের উপর জোর দিত তাহলে সশস্ত্র নিরাপত্তাকর্মী তাঁকে সেখান থেকে বের করে দিতে উদ্যত হতো। আমরা যত বেশি আমাদের প্রতিদিনের অস্তিত্বের দিকগুলো আমলাতান্ত্রিক বিধিবিধানের আওতায় পড়তে দেই, আমরা তত বেশি এর সবকিছু যে শেষ পর্যন্ত সহিংসতার হুমকির উপর নির্ভরশীল সে সত্যটাকে অস্বীকার করবার ঘটনার (এবং বাস্তবে যারা এই ব্যবস্থা পরিচালনা করছে সুস্পষ্টভাবে তাদের সাথে) সাথে গোপন আঁতাত গড়ে তুলি।


নৃবিজ্ঞানীরা যে গ্রামীণ সমাজগুলোর সাথে সর্বাধিক পরিচিত, যেখানে আধুনিক প্রশাসনিক কৌশলগুলোকে সুস্পষ্টভাবে ভীনগ্রহের আরোপ হিসেবে দেখা হয়, সেখানে এই সম্পর্কগুলো আরও ভালোভাবে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, গ্রামীণ মাদাকাস্কারের যে অংশে আমি আমার মাঠকর্ম সম্পন্ন করেছি, সেখানে সরকারগুলো যে ভীতি তৈরীর মাধমে পরিচালিত হয় সেটা পরিস্কারভাবে দেখা যায়। একই সময়ে দেখা যায় যে, প্রাত্যহিক জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ হস্তক্ষেপের অনুপস্থিতিতে (যেমন বিল্ডিং কোড, মুক্ত ধারক আইন, যানবাহনের বাধ্যতামূলক বীমা ইস্যু করা ইত্যাদি), সরকারী আমলাতান্ত্রের মূল কাজটি ছিল কেবল করযোগ্য সম্পত্তির নিবন্ধকরণ। এর কৌতূহলোদ্দীপক ফলাফল ছিল এই যে, আমি যে সমাজ নিয়ে গবেষণা করছিলাম যে সম্পর্কে ম্যালাগাছি আর্কাইভ থেকে ঊনিশ শতক ও বিশ শতক সম্পর্কিত যে তথ্য পেয়েছিলাম তা ছিল কেবলমাত্র তাদের পরিবারের আকার, জমির পরিমাণ এবং গবাদিপশু (এবং পূর্ববর্তী সময়ে ক্রীতদাস) সম্পর্কিত। আমি যে সময়টুকু ঐখানে ছিলাম তখন কেবল এই তথ্যগুলোই পাওয়া গিয়েছিল। এটার সাধারণ কারণ হলো বেশীরভাগ লোকজনের এই ধারণা জন্মেছিল যে রাজধানী থেকে আসা বহিরাগতরা এই বিষয়গুলোই জানতে চাইবে এবং তাঁরাও কেবলমাত্র এই বিষয়গুলোই জানাতে প্রবৃত্ত ছিল।


সর্বোপরি, ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার একটি ফলাফল বলা যেতে পারে একটি আজ্ঞার সম্পর্ক তৈরী হওয়া। এটি মূলত একটি চলমান সম্পর্ক যেখানে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তি নিজের ইচ্ছার বাইরে অন্যকে কোন কিছু প্রদান করেন, যেটিই দাসপ্রথা হিসেবে চিহ্নিত হয় এবং এই দাসপ্রথাই রাষ্ট্রের একটি অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত হয়। আমি যে সমাজে গবেষণা করি, সেখানকার মানুষেরা যখন ঊনিশ শতকের দাসত্বের অধিকারী পরিবারগুলো নিয়ে কথা বলে তখন এই সম্পর্কের বিষয়টা সামনে চলে আসে। এই পরিবারগুলোর সন্তানেরাই ঔপনিবেশিক সময়ের প্রশাসনের অন্তঃসার হয়ে ওঠে। আর এটি সম্ভব হয়েছিল শিক্ষার প্রতি তাদের গভীর অনুরক্তি এবং প্রশাসনিক কাজে তাদের দক্ষতার জন্য। অন্য প্রেক্ষিতে, আজ্ঞার সম্পর্ক (বিশেষত আমলাতান্ত্রিক প্রেক্ষিতে) ভাষাগতভাবে সংকেতাবদ্ধ ছিলঃ এগুলো দৃঢ়ভাবে ফরাসি ভাষার দ্বারা চিহ্নিত করা হতো; অন্যদিকে, মালাগাছি ভাষাকে বিতর্ক, ব্যাখ্যা এবং ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভাষা হিসেবে উপযুক্ত মনে করা হতো। অপ্রধান কর্মকর্তারা, যখন কোন স্বেচ্ছাচারী আদেশ চাপিয়ে দিতে চান, তখন প্রায়শই তা ফরাসি ভাষায় করে থাকেন। আমি এরকম একটি সুনির্দিষ্ট ঘটনার কথা মনে করতে পারি, যেখানে আমার সঙ্গে একজন কর্মকর্তার ম্যালাগাসি ভাষায় অনেক কথোপকথন হয় এবং যার কোন ধারণাই ছিল না যে আমি ফরাসি ভাষা বুঝি। একদিন সবাই যখন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল সেই সময় আমাকে আসতে দেখে সে উত্তেজিত হয়ে যায়। সে ফরাসী ভাষায় বললো “অফিস বন্ধ হয়ে গেছে, আপনার যদি কোন কাজ থাকে তাহলে আগামীকাল সকাল ৮.০০ টায় আসতে হবে”। আমি তখন ফরাসি ভাষা বুঝিনা এমন ভান করে ম্যালাগাছি ভাষায় আমার বিভ্রান্তি এবং দাবী প্রকাশ করতে থাকলাম। সে তখন আঞ্চলিক ভাষায় তাঁর কথাটি পুনরাবৃত্তি করতে নিতান্তই অক্ষমতা প্রকাশ করলেন এবং বার বার ফরাসি ভাষাতেই তা পুনরাবৃত্তি করতে থাকলেন। অন্যরা পরে আমার সন্দেহের বিষয়টা নিশ্চিত করেনঃ তিনি যদি ম্যালাগাছি ভাষায় আমার সঙ্গে কথা বলতেন, তাহলে অফিসটি কেন এরকম অস্বাভাবিক সময়ে বন্ধ হয়ে গেল সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে হতো। ম্যালাগাছিতে ফরাসি প্রকৃতপক্ষে “আদেশের ভাষা” হিসেবে পরিচিত; এটা সেই প্রেক্ষিতকে নির্দেশ করে যেখানে ব্যাখ্যা, বিবেচনা, চূড়ান্তভাবে, সম্মতির কোন প্রয়োজন হতো না। কারণ, সেগুলো আদতে সহিংসতার হুমকিকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।


ম্যাদাগাস্কারে, আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা কতকটা শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে মানুষের মনে গেঁথে গিয়েছিল। তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেখায় যে আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রয়োগকৃত শক্তির মাত্রা এবং এর থেকে দৃশ্যত উদ্ভুত অযৌক্তিকতার মাত্রার মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কীথ ব্রেকেনরিজ, ঔপনিবেশিক দক্ষিণ আফ্রিকার “জ্ঞানহীন ক্ষমতার” শাসনামলের চিত্র কিছুটা দীর্ঘ পরিসরে তুলে ধরেছেন(২০০৩) যেখানে, আফ্রিকান কর্তাসত্তাকে(subject) বোঝার প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে বলপ্রয়োগ এবং প্রশাসনিক কাগজপত্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, একটি নতুন ছাড়পত্র ব্যবস্থা চালুর মধ্য দিয়েই মূলত ১৯৫০-এর দশকের দিকে এখানে প্রকৃত বর্ণবৈষম্যের সূচনা হয়েছিল। আগে আফ্রিকান শ্রমিকরা তাদের শ্রমচুক্তির বিস্তৃত প্রমাণাদি বহন করতে বাধ্য ছিল। নতুন ব্যবস্থায় একটিমাত্র পরিচয় পুস্তিকার মাধ্যমে আগের জটিল নিয়মকে প্রতিস্থাপন করে সেটিকে আরও সহজ করেছিল। এই পরিচয় পুস্তিকাতে শুধুমাত্র তাদের “নাম, ঠিকানা, আঙুলের ছাপ, কর স্থিতি এবং শহর ও নগরে বসবাস ও কাজ করবার অফিসিয়াল অনুমোদন” (২০০৫: ৮৪) ব্যতীত আর কিছু উল্লেখ ছিলনা। সরকারী কর্মকর্তারা প্রশাসনিক কাজকে সহজ করবার জন্য, পুলিশরা আফ্রিকানদের সাথে কথা বলবার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এই ব্যবস্থাকে তারিফ করে; আর সেজন্যই এটি পরবর্তীতে সর্বজনীনভাবে “দমপাস”, বা “বোকা ছাড়পত্র” বলে চিহ্নিত হয়। ইংরেজী ভাষাতেও আমরা যে ভাবে কথা বলি তার মধ্যেও জবরদস্তি এবং অযৌক্তিকতার মধ্যে যোগসূত্রের চিহ্ন রয়েছেঃ উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, আমলাতান্ত্রিক বোকামিকে নির্দেশ করে এমন চলিত পদাবলি যেমন এসএনএফইউ (SNAFU), ক্যাচ-২২ (Catch-22) এবং এরকম আরও অনেক শব্দগুলো সামরিক ‘গালি’ (Slang) থেকে এসেছে। আরও সাধারণভাবে বললে, ডেভিড আপটার (১৯৬৫, ১৯৭১) যেমনটা দেখিয়েছেন, রাজনৈতিক বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে বলপ্রয়োগ এবং তথ্যের মধ্যে একটি “নেতিবাচক অনুবন্ধন” লক্ষ্য করেছেনঃ যেমন, যখন একটি তুলনামূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অনেক বেশি তথ্যের মধ্যে ভাসমান থাকে, সেটি তখন তত বেশি কর্তৃত্ববাদী ও দমনকারী শাসনব্যবস্থায় পরিণত হয়। মানুষের এখানে এটা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলার থাকে না। আর এই কারণেই এই সরকারগুলি গুপ্তচর, গোয়েন্দা সংস্থা এবং গোপন পুলিশের উপর অনেক বেশী নির্ভর করতে বাধ্য হয়।

III


সহিংসতা স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত নেওয়াকে অনুমোদন দেয়। এর মাধ্যমে বিতর্ক, ব্যাখ্যা এবং পুনঃসমঝোতা যা অধিকতর সাম্যবাদী সমাজের সামাজিক সম্পর্কের বৈশিষ্ট্য তাকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। আর এটিই ভুক্তভোগীদের সহিংসতার উপর প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতিগুলোকে নিবুর্দ্ধিতা অথবা অযৌক্তিক হিসাবে দেখার অনুমোদন দেয়। এটা বলা যেতেই পারে যে, যার শক্তি ভীতির উপর ভরসা করে তারা বেশি ব্যাখ্যা দিতে চায় না এবং সাধারণভাবে বলতে গেলে তারা তা করেও না।


সহিংসতার এই দিকগুলো নৃবৈজ্ঞানিক কাজে খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি। বরং কিভাবে সহিংসতা বোধগম্য ও অর্থপূর্ণ হয় নৃবৈজ্ঞানিক কাজগুলো সেদিকে গুরুত্ব দিয়েছে। আমার মনে হয় এটি এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে আমরা বিশেষত ব্যাখ্যামূলক গভীরতা ও সামাজিক তাৎপর্যের মধ্যে বিভ্রান্তির শিকার হওয়ার প্রবণতা বোধ করিঃ অর্থাৎ আমাদের কাছে সহিংসতার সবচেয়ে জনপ্রিয় দিকটাকেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। আবার সাধারণভাবে এটিও বলা যায় না যে সহিংসতার ক্রিয়াকলাপগুলো যোগাযোগমূলক নয়। স্পষ্টতই সেগুলো যোগাযোগমূলক। কিন্তু এটা মানুষের অন্য যে কোন ক্রিয়াকলাপের ক্ষেত্রেও একইভাবে সত্য। কিন্তু সহিংসতার গুরুত্বপূর্ণ যে দিকটি আমাকে নাড়া দিয়েছে তা হলো এটিই একমাত্র মানব কর্ম যা যোগাযোগমূলক না হয়েও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রভাব রাখার সম্ভাবনা টিকিয়ে রাখে। আরও সুস্পষ্ট করে বললেঃ সহিংসতা মানব কর্মের একমাত্র ধরন যা একজন ব্যক্তি সম্পর্কে কোন কিছু না জেনেও তাঁর উপর একটি অনুমিত প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা রাখে। অন্য যেকোন উপায়ে কোন ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে ব্যক্তি নিজের সম্পর্কে কি ভাবছে, অপর ব্যক্তি সম্পর্কে কি ভাবছে, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ব্যক্তির চাওয়া, ব্যক্তির ঘৃণা, প্রবণতা এবং অন্যান্য নানাবিধ বিষয় সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা প্রয়োজন হয়। সজোরে কারও মাথায় আঘাত কর, তখন এগুলোর সবকিছু অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে।


এটা সত্যি যে, কোন ব্যক্তিকে হত্যা বা পঙ্গু করে খুব সীমাবদ্ধ কিছু ফলাফল যাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলো ভীষণ বাস্তব এবং আরও সুক্ষভাবে বলতে গেলে দারুণভাবে অনুমেয়। মর্মার্থ বা বোধগম্যতার অংশীদারিত্ব ব্যতীত অন্য যে কোন বিকল্প কর্মকান্ডের কোন ধরনের অনুমিত প্রভাব থাকে না। যদিও, সহিংসতার হুমকি দ্বার অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রেও একটি অংশীদারিত্বমূলক বোধগম্যতার প্রয়োজন হয়, তবে সেটা একেবারেই ন্যুনতম। এটা মনে রাখা জরুরী যে অধিকাংশ মানবিক সম্পর্কই বিশেষত চলমান সম্পর্কগুলো (তা সে দীর্ঘদিনের বন্ধুই হোক বা দীর্ঘদিনের শত্রুই হোক না কেন) অত্যন্ত জটিল প্রকৃতির এবং অভিজ্ঞতা ও মর্মার্থ দ্বারা গভীরভাবে সন্নিবেশিত। সেগুলোকে ধরে রাখতে হলে ধারাবাহিক এবং সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা এবং অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অন্তহীন অনুমান প্রয়োজন হয়।


অন্যকে শারীরিক ক্ষতির হুমকি প্রদান এই সমস্ত কিছুকে ছেটে ফেলার সম্ভবনাকে অনুমোদন দেয়। এই হুমকি অনেক বেশি পরিকল্পিত সম্পর্ক তৈরিকে সম্ভবপর করে (যেমন: যদি এই রেখা পার হও, আমি তোমাকে গুলি করব)। ঠিক এই কারণেই সহিংসতা সবসময়ই বোকাদের একটি পছন্দের অস্ত্রঃ আবার অনেকে এটাকে মানব অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি হিসেবে বলতে পারে। কারণ, সহিংসতা এমন এক ধরনের নিবুর্দ্ধিতা যার কোন বৃদ্ধিবৃত্তিক প্রত্যুত্তর দেওয়া সবচেয়ে কঠিন।


আমি এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী নিয়ে আসার প্রয়োজন মনে করছি। ধরুন, এখানে যদি দুটি পক্ষ সহিংসতার প্রতিযোগীতায় লিপ্ত হয়। মনে করুন, দুইজন জেনারেল সেনাবাহিনীর দুটি পক্ষকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাহলে, সেক্ষেত্রে উভয়েরই একে অন্যের চিন্তাকে পড়বার উপযুক্ত কারণ রয়েছে। কিন্ত, কোন পক্ষের অন্যকে শারীরিকভাবে আঘাত করার সামর্থের অপ্রতিরোধ্য সক্ষমতা থাকে তাহলে তাদের আর এটা করার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু এর সুগভীর প্রভাব রয়েছে। কারণ এর অর্থ দাড়ায় যে সহিংসতার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যমূলক প্রভাব— ব্যাখ্যা করার শ্রমকে কমাতে পারার সক্ষমতা—তখনই সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে ওঠে যখন সহিংসতা সবচেয়ে কম দৃশ্যমান থাকে, মুলত যেখানে দৃষ্টিগ্রাহ্য শারীরিক সহিংসতার ঘটার সম্ভবনা সবথেকে কম থাকে। এই পরিস্থিতিগুলোকেই আমি কাঠমোগত সহিংসতা (structural violence) বলেছি এই অনুমান থেকে যে, বল প্রয়োগের হুমকির দ্বারা সমর্থিত পদ্ধতিগত বৈষম্যই এখানে সহিংসতার ধরন হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। এই কারণে কাঠামোগত সহিংসতার পরিস্থিতি অবিচ্ছিন্নভাবে কাল্পনিক পরিচয়ের একটি চূড়ান্ত ভারসাম্যহীন কাঠামো তৈরি করে।


এই প্রভাবগুলো সর্বাধিক দৃশ্যমান হয় তখনই যখন বৈষম্যের কাঠামো গভীরভাবে অন্তঃস্থকরণের ধরন গ্রহণ করে। উদাহরনস্বরুপ বলা যায়, ১৯৫০ সালে আমেরিকার প্রেক্ষাপটে নিত্যদিনের প্রধান কৌতুক ছিল নারীদেরকে বোঝার অসম্ভাব্যতা সম্পর্কিত রসিকতাগুলো। এই রসিকতাগুলো (যা অবশ্যই পুরুষের দ্বারাই উপস্থাপিত হত) নারীর যুক্তিকে সবসময় অস্বাভাবিক এবং অবোধগম্য হিসাবে উপস্থাপন করত। কারোরই এই অনুভূতি ছিল না যে, নারীদেরও পুরুষকে বুঝতে সমস্যা হতে পারে। কারণগুলো ছিল খুবই স্পষ্ট, পুরুষকে বুঝা ছাড়া নারীর অন্য কোন উপায় ছিল না। এটা ছিল পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের একটি সুনির্দিষ্ট চিত্রের পূর্ণ বিকশিত অবস্থা যেখানে নারীর নিজের আয় এবং সম্পদে অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকার কারণে তাদের পুরুষ মনের গতি প্রকৃতিকে বুঝতে অধিকাংশ সময় এবং শ্রম ব্যায় করা ব্যতীত আর কোন বিকল্প ছিলনা বললেই চলে।


যেমনটা দীর্ঘ সময় ধরে নারীবাদীরা বলে আসছেন, এই ধরনের পিতৃতান্ত্রিক পরিবারগুলো নিশ্চিতভাবেই কাঠামোবদ্ধ সহিংসতার একটি ধরন; এই পরিবারগুলোর নীতি-নৈতিকতাগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবিরাম শারীরিক ক্ষতির হুমকির দ্বারাই অনুমোদিত হতো। নারী জাতির রহস্যময়তা সম্পর্কে এই ধরনের বাগাড়ম্বর তাদের একটি চিরস্থায়ী বৈশিষ্ট্য হিসেবেই মনে করা হয়। দীর্ঘ সময় ধরে নারী ঔপন্যাসিকগণ, যাদের মধ্যে প্রথমেই ভার্জিনিয়া উলফের নামই প্রথমে মনে আসছে, এই ধরনের ব্যবস্থার বিপরীত দিকটিও তুলে ধরেছেন: আত্মবিস্মৃত এবং আত্মগর্বী পুরুষের অহংকে পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং সমন্বয় করতেই নারীর ক্রমাগত প্রচেষ্টা নিঃশেষ হয়। আর এটি করতে একটি কাল্পনিক পরিচয় নির্মাণের ক্রমাগত শ্রম বা যাকে আমি ব্যাখ্যামূলক শ্রম (interpretive labor) বলে উল্লেখ করেছি তার প্রয়োজন হয়। এটা প্রতিটি স্তরেই বজায় থাকে। একজন পুরুষের চোখে বিষয়গুলো দেখতে কেমন লাগবে একজন নারী সবসময় সেই অনুযায়ী নিজেকে কল্পনা করবে বলে আশা করা হয়। পুরুষের কাছে থেকে এর বিপরীতটা ঘটবে বলে কখনো আশা করা হয় না। আচরণের এই ধরনটি এত গভীরভাবে অন্তঃস্থকরণ হয় যে, এর চেয়ে ভিন্ন কিছু করার পরামর্শে অনেক পুরুষ এমনভাবে প্রতিক্রিয়া দেখান যেন এই ভিন্ন কিছু করাটাই একটা সহিংস কাজ। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকায় উচ্চ বিদ্যালয়গুলোতে সৃজনশীল লেখা শেখানো শিক্ষকদের একটি জনপ্রিয় অনুশীলনের কথা বলা যেতে পারে। এই অনুশীলনে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদেরকে একদিনের জন্য একজন বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছেন তা কল্পনা করতে বলেন এবং এই একদিনের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল তা বর্ণনা করতে বলেন। এর ফলাফল দৃশ্যতই অদ্ভুতভাবে অভিন্ন হয়। মেয়েরা সকলেই দীর্ঘ এবং বিস্তারিত রচনা লেখেন যা থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে তাঁরা বিষয়টি সম্পর্কে দীর্ঘ সময় ভেবেছে। ছেলেদের অর্ধেক সাধারণত রচনাটি লিখতেই অস্বীকার করে। যারা লেখে তাদের লেখা থেকে এটি স্পষ্ট হয় যে একজন কিশোরী মেয়ে কেমন হয় সে সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই এবং এই বিষয়ে ভাবতেও তাদের তীব্র বিরক্তি রয়েছে। এখানে দুটি জটিল বিষয় সংযুক্ত অবস্থায় রয়েছে যেগুলোকে যা আলাদাভাবে আলোচনা করা উচিৎ। প্রথমটি হলো জ্ঞানের একটি রূপ হিসাবে কল্পিত একাত্মতার প্রক্রিয়া। বিষয়টি এরকম যে কতৃর্ত্বের সম্পর্কগুলির ক্ষেত্রে, সামাজিক সম্পর্কগুলো বাস্তবে কিভাবে কাজ করে তা বুঝার দায়িত্ব কার্যকরভাবে অধঃস্তনদের উপরই ন্যাস্ত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, রেস্টুরেন্টের রান্না ঘরে কাজ করবার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন যে কেউ জানে যে, যদি খুব খারাপ কোন কিছু ঘটে এবং সেটা ঠিক করতে কোন রাগী বস হাজির হন তবে তিনি কখনোই বিস্তারিত অনুসন্ধান করেন না কিংবা ঘটনার বিষয়ে নিজ নিজ কৈফিয়ত দেওয়ার জন্য ভীড় করে থাকা অন্য কর্মচারীদের প্রতিও তেমন মনোযোগ দেন না। তিনি সবাইকে চুপ করতে বলেন এবং ইচ্ছামত একটা গল্প চাপিয়ে দেন যেখানে সাধারণত একটি তাৎক্ষণিক রায় থাকেঃ যেমন, “তুমি নতুন লোক, তুমিই ঝামেলাটা বাধিয়েছ - আবার যদি কখনো এই ঘটনা ঘটে তাহলে কিন্তু তোমাকে বরখাস্ত করা হবে”। আর যাদের চাকরী দেবার এবং বরখাস্ত করার ক্ষমতা থাকে না তাদের উপরই প্রকৃত ঘটনা খুঁজে বের করার দায়িত্ব পরে এটা নিশ্চিত করার জন্য যে ভবিষ্যতে যেন এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। আমাদের চলমান সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সাধারণত একই ঘটনা ঘটেঃ সবাই জানে যে বাসার গৃহকমীরা নিয়োগকর্তার পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত জানলেও তার বিপরীতটা কখনো ঘটে না বললে চলে। দ্বিতীয় উপাদানটি হলো সহানুভূতিশীল একাত্মকরণ। মজার ব্যাপার হলো, অ্যাডাম স্মিথ তাঁর Theory of Moral Sentiment (XXX) গ্রন্থে প্রথম এই প্রপঞ্চ সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণের কথা বলেন যাকে আমরা এখন “সহানুভূতির অবসাদ” হিসাবে আখ্যায়িত করি। তাঁর প্রস্তাবনায়, মানবজাতি তার সঙ্গীদের সাথে স্বাভাবিকভাবে কেবলমাত্র কাল্পনিক একাত্মকরণেই আগ্রহী নয়, বরং এর ফলাফলস্বরূপ স্বতঃস্ফূর্তভাবে একে অপরের আনন্দ এবং দুঃখকেও অনুভব করে। যাইহোক, দরিদ্রদের দুর্দশা এতটাই অটল যে তাদের প্রতি যেকোনভাবে সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদেরও হয় তাদের দুর্দশার প্রতি সম্পূর্ণ মোহাচ্ছন্ন হওয়া বা তাদের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলার পথের যে কোন একটিকে নীরবে বেছে বেছে নিতে হয়। এর ফলাফল হচ্ছে যারা সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের নিচের দিকে থাকে তাদের বেশীরভাগ সময়ই ব্যয় হয় উপরের দিকের লোকদের দৃষ্টিভঙ্গিটা কী সেটা বুঝতে এবং সেটার প্রতি সাবধান থাকতে। এর বিপরীটা কখনো ঘটে না বললেই চলে।


প্রভু ও ভৃত্য, পুরুষ ও নারী, নিয়োগকর্তা ও কর্মচারী, ধনী এবং দরিদ্র যাদেরকে নিয়েই কাজ করা হোক না কেন কাঠামোবদ্ধ অসমতা - যাকে আমি কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা বলছি – অবশ্যম্ভাবীভাবে চিন্তার ক্ষেত্রেও একটা অসম কাঠামো তৈরী করে। আমি যেহেতু, চিন্তার সঙ্গে সঙ্গে সহানুভূতিও তৈরী হয়–স্মিথের এই পর্যবেক্ষণকে সঠিক মনে করিঃ [কিন্তু আমার মতে,] এর ফলাফল হচ্ছে যে এখানে কাঠামোবদ্ধ সহিংসতার সুবিধাভোগীরা যতটা এর ভুক্তভোগীদের নিয়ে যতটা ভাবেন তাঁর চেয়ে অনেক বেশী ভুক্তভোগীরা এর সুবিধাভোগীদের নিয়ে ভাবেন। যেহেতু আমি মনে করি স্মিথ এই পর্যবেক্ষণে সঠিক ছিল যে, কল্পনা তার সাথে সহানুভূতি নিয়ে আসে। এর ফলাফল হলো কাঠামোবদ্ধ সহিংসতার সুবিধাভোগীদের নিপীড়িতদের পরোয়া করার পরিবর্তে নিপীড়িতদেরই অনেক বেশি পরোয়া করার প্রবণতা রয়েছে। সহিংসতাকে বাদ দিলে, এই ধরনের ভাবনাই এই ধরনের সম্পর্ক টিকিয়া রাখার সবচেয়ে ক্ষমতাশীল শক্তি।


IV


আমার মতে এই সবকিছুর কতিপয় তাত্ত্বিক তাৎপর্য রয়েছে।


বর্তমানে, সমসাময়িক শিল্পোন্নত গণতান্ত্রিক সমাজগুলোতে সহিংসতার বৈধ প্রয়োগের ক্ষমতা তাদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে যাদেরকে শ্রুতিমধুরভাবে “আইন প্রয়োগকারী” বলা হয় – বিশেষত পুলিশ কর্মকর্তাদের হাতে। সমাজবিজ্ঞানীরা যেমনটা বারংবার দেখিয়েছেন, [পুলিশ] এদের বাস্তব ভূমিকা ফৌজদারী আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে অতটা দেখা যায় না যতটা প্রশাসনিক সমস্যার সমাধানের সহায়তায় শারীরিক শক্তির বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে দেখা যায়। পুলিশেরা মুলত অস্ত্রধারী আমলা। একই সময়ে, গত ৫০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে তারা তাৎপর্যপূর্ণভাবে কাল্পনিক একাত্মতার প্রায় আচ্ছন্নকারী বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সমসাময়িক শিল্পোন্নত গণতন্ত্রে একজন নাগরিকের জন্য এটা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয় যে তিনি এমন সব বই পড়ে, সিনেমা দেখে বা টিভি অনুষ্ঠান দেখে দিনের অনেকটা সময় ব্যয় করছেন যা তাদেরকে পুলিশের চোখে বিশ্বকে দেখার এবং তাদের কীর্তিকলাপে বিকৃতভাবে অংশগ্রহণের আহবান জানায়। আর কিছু না হলেও, এটি ওয়েবারের লৌহ পিঞ্জর (iron cage) নিয়ে অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যত বাণীকে কুঞ্চিত করেঃ যেমনটি দেখা যাচ্ছে, নামহীন আমলারা তাদের মহিমান্বিত নায়কের রূপটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে অবিরতভাবে পুরাকল্পীয় গোয়েন্দা, গুপ্তচর, পুলিশের মতো নানা ধরনের চেহারা নিচ্ছে। আর এই প্রত্যেকটি চেহারার আদলে তথ্য বিন্যাসের আমলাতান্ত্রিক কাঠামো তার কাজটি সঠিকভাবে পরিচালনা করবার জন্য প্রকৃত শারীরিক সহিংসতার মুখাপেক্ষী হয় এবং আবেদন জানায়।


আমার কাছে আরও বেশি লক্ষণীয় মনে হয়েছে এ সম্পর্কিত তত্ত্বগুলোর প্রায়োগিক অবস্থান।


আরও বেশি মারাত্মক মনে হয় তত্ত্বের নিজের অবস্থানের জন্যই এর প্রয়োগ।


প্রণালীসঙ্গত (schematization) করাই হচ্ছে আমলাতান্ত্রিক জ্ঞানের কাজ। কার্যত, আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বলতেই বোঝায় বাস্তব সামাজিক অস্ত্বিত্বের সূক্ষ্মতাগুলোকে উপেক্ষা এবং সমস্তকিছুকে পূর্ব-অনুমিত যান্ত্রিক এবং পরিসংখ্যানগত সূত্রে নিবন্ধ করা বোঝায়। হোক না সেটা কাঠামো, নিয়ম, পরিসংখ্যান বা প্রশ্নপত্র, এটা সর্বদা সরলীকরণের বিষয়।



সাধারণভাবে এটা ওই বস থেকে তেমন আলাদা না যে রান্নাঘরে প্রবেশ করে সেখানে কি ভুল হয়েছে সে সম্পর্কে নিজের খামখেয়ালিপূর্ণ সহজ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যঃ উভয় ক্ষেত্রেই এটি জটিল এবং দুবোর্ধ্য পরিস্থিতিতে সরল এবং পূর্ব—নির্ধারিত ছক আরোপ করে। এর ফলাফল প্রায়শই আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের সাথে মোকাবিলা করতে বাধ্য লোকদের এমন ধারণা দেয় যে তাঁরা এমন কিছু লোকের মোকাবিলা করছেন যারা তাদের স্বেচ্ছাপ্রসূত ইচ্ছায় এমনভাবে টেবিলের উপর গ্লাস রাখেন যেন সামনে থেকে এর মাত্র ২% দেখা যায়। সন্দেহাতীতভাবে, সামাজিক তত্ত্বের ক্ষেত্রেও অনুরূপ কিছু ঘটে। এমনকি, একটি ভালো এথনোগ্রাফিক বর্ণনাও একটি নুয়্যার দাঙ্গা বা একটি বালিদের মোরগ লড়াইয়ে যা ঘটছে তার মাত্র ২% কে ধারণ করতে পারে। মানব পরিস্থিতির জটিল বিন্যাসের মধ্য থেকে একটি তাত্ত্বিক কাজ একটি বা দুটি সূত্রকে তুলে নিয়ে আসে, একটি ক্ষুদ্র অংশের উপর শুধু মনোনিবেশ করে এবং এটিকেই ভিত্তি করে সাধরণীকরণ করেঃ উদাহরণস্বরূপ, সেটা হতে পারে সামাজিক দ্বন্দ্বের প্রকৃতি বা কর্মশৈলীর প্রকৃতি নিয়ে। এই ধরনের তাত্ত্বিক হ্রাসকরণের মধ্যে কোন ভুল আছে তা আমি বলতে চাচ্ছি না। (যৌক্তিকভাবে আমিও এখন এটাই করছি)।


প্রকৃতপক্ষে, আমি মনে করি যদি কেউ পৃথিবী সম্পর্কে নাটকীয়ভাবে নতুন কোন ধারণা দিতে চায় তাহলে এই পদ্ধতির প্রয়োজন আছে।


কাঠামোগত বিশ্লেষণের কথা বিবেচনা করুন, যেটা প্রায় অর্ধশতাব্দি আগেই (১৯৫৯) ১ম ম্যালিনোস্কি স্মরণ বক্তৃতার মাধ্যমে এডমন্ড লিচ ব্যাপকভাবে সমর্থন করেছিলেন। বর্তমান সময়ে কাঠামোগত বিশ্লেষণ একটি বিগতযৌবনা হিসেবে বিবেচিত হয়; [ক্লদ] লেভি স্ট্রসের তাত্ত্বিক সংকলনগুলো অনেকটা পরিহাস্য। এটা আমার কাছে দুভার্গ্যজনক মনে হয়। একটি ভালো তত্ত্বের মতো কাঠামোগত বিশ্লেষণের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হলো এটি এমন একটি প্রায় অব্যর্থ কৌশল প্রদান করে যার মাধ্যমেঃ জটিল বিষয়বস্তুকে এমনভাবে সরলীকরণ ও প্রণালীসঙ্গত করা যায় যেন এর মাধ্যমে অভাবনীয় কিছু বলা যায়। ঘটনাচক্রে আমি প্রকৃতপক্ষে এই ভাবেই ওয়েবার সম্পর্কে উপরোক্ত সিদ্ধান্তে পৌছেছি:

আমি লেভি-স্ট্রসের মতো কাউকেই বীরত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখতে চাই। উনি পুরোদস্তুর বৌদ্ধিক সাহসী একজন মানুষ যিনি তাঁর মডেলটি নিয়ে যতদূর পর্যন্ত যাওয়া যায় ততদূর পর্যন্ত গিয়েছেন। এমনকি এর ফলাফলটা অনেক সময় নিশ্চিতভাবে অর্থহীন হলেও – অথবা, আপনি এও বলতে পারেন, এর মাধ্যমে বাস্তবতার কতটা অনিষ্ট সাধন হলো সেটা তাঁর কাছে কোন বিবেচ্য ছিল না।


আমার যুক্তিতে, তাত্ত্বিক পরিসরের মধ্যে থাকলে সরলীকরণও জ্ঞানের একটা ধরন হতে পারেও। সহিংসতা যখন আর রূপক অর্থে থাকেনা সমস্যা তখনই তৈরী হয়। এখন কাল্পনিক থেকে বাস্তবের একজন পুলিশে ফিরে আসা যাক।


যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ কোন তত্ত্বের ডোমেইনের মধ্যে থাকবে ততক্ষণ আমার যুক্তি হলো যে সরলীকরণ মেধার একটা ফর্ম। যখন সহিংসতা আর রুপকভাবে থাকে না তখনই সমস্যার সৃষ্টি হয়। এখন কাল্পনিক পুলিশ থেকে বাস্তবে আসা যাক। লস—অ্যাঞ্জেলস পুলিশ বিভাগের প্রাক্তন কর্মকর্তা থেকে সমাজবিজ্ঞানী হওয়া (কুপার, ১৯৯১) লক্ষ্য করলেন যে পুলিশ যে সমস্ত ব্যক্তিকে প্রহার করে তার একটা বড় অংশই কোন ধরনের অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত নয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি লক্ষ্য করলেন যে “পুলিশ চোরদের মারে না”। তাঁর ব্যাখ্যা মতে কারণটা খুব সাধারণঃ পুলিশের কাছ থেকে সহিংস প্রতিক্রিয়া পাওয়ার একটা সবচেয়ে নিশ্চিত কারণ হচ্ছে তাদের “পরিস্থিতিকে সংজ্ঞায়িত করার” ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা। আমি যা বলেছি তা যদি সত্য হয় তাহলে আমরা ঠিক এই প্রতিক্রিয়াই পাব। পুলিশের লাঠি হচ্ছে ঠিক সে জায়গা যেখানে রাষ্ট্রের সাধারণ প্রশাসনিক পরিকল্পনা প্রয়োগের আমলাতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা এবং এর বল প্রয়োগের একচেটিয়া অধিকার একত্রিত হয়। যারা বিকল্প পরিকল্পনা বা ব্যাখ্যার উপর জোর দেন তাদের উপর আমলাতান্ত্রিক সহিংসতার খড়গ সবচেয়ে আগে এবং সবচেয়ে বেশি কেন পড়ে সেই বিষয়টিও তখন বোধগম্য হয়। একই সময়ে, পরিণত বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত পিগেট-এর বিখ্যাত সংজ্ঞাও বিষয়টিকে বুঝতে সাহায্য করে। তাঁর সংজ্ঞা অনুযায়ী বহুবিধ দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে (বা সম্ভাব্য দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে) সমন্বয় করার সক্ষমতাই হচ্ছে পরিণত বুদ্ধিমত্তা। আর এই আলোকে দেখলে একজন বুঝতে পারে কিভাবে আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতা যে মুহুর্তে সহিংসতায় রূপ নেয় ঠিক তখনই এটা আক্ষরিকভাবে একটি শিশুসুলভ নির্বুদ্ধিতায় পরিণত হয়।


আরও বেশি সময় থাকলে আমি দেখাতে পারতাম কেন আমি মনে করি এই দৃষ্টিভঙ্গি পুরাতন সমস্যাগুলো বিবেচনায় নতুন কিছু পথ নির্দেশ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মার্ক্সবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ যদি দেখে তাহলে লক্ষ্য করবে যে আমার “ব্যাখ্যামূলক শ্রমের(interpretative labor)” ধারণা দেখায় যে সামাজিক উৎপাদন (ব্যক্তি এবং সামাজিক সম্পর্কের উৎপাদন) ও পণ্য উৎপাদনের পরিসরের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। এখানে “ব্যাখ্যামূলক শ্রম” সামাজিক জীবনের চলমানতাকে সাবলীল রাখে। আর সামাজিক উৎপাদনের পরিসরে সৃষ্টিশীল শ্রমের অবস্থান থাকে নীচের দিকে এবং পণ্য উৎপাদনের পরিসরে শ্রমের সৃষ্টশীল দিকগুলোর অবস্থান থাকে উপরের দিকে।


যদিও উভয় ক্ষেত্রেই অসমতার কাঠামো চিন্তার ভারসাম্যহীন কাঠামো তৈরি করে। আমি আরও প্রস্তাব করব যে যাকে আমরা “বিচ্ছিন্নতা” বলে থাকি তা আসলে এই ধরনের ভারসাম্যহীন কাঠামোগুলোর মধ্যেকার ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা। যে কোন ধরনের মুক্তিকামী রাজনীতিতে এর তাৎপর্য রয়েছে। যদিও এই মুহুর্তে আমি নৃবিজ্ঞানে এর কিছু তাৎপর্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।


এর মধ্যে একটি হলো আমরা যেসব ব্যাখ্যামূলক কৌশল ব্যবহার করি তার অনেকগুলোই ঐতিহাসিকভাবে ক্ষমতার হাতিয়ার-এর চেয়ে অনেক বেশি দুর্বলের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হতো। রেনেতো রোজালদো (১৯৮৬) এর একটা সুবিদিত যুক্তি দিয়েছেন। ইভান-প্রিচার্ড যখন মুওত ডিট-এর নুয়্যার ক্যাম্পে কেউ তাঁর সাথে কথা বলবেনা এই ভেবে বিরক্ত হয়ে অবশেষে তাঁর “তাবুর দরজা” থেকে বাইরের দিকে নজর দিচ্ছিলেন, তখন পুরো বিষয়টিকে তিনি (রোজাল্ডো) ফুকোর প্যানোপটিকনের(panopticon, নজরদারি) সাথে তুলনা করেছেন। যুক্তিটা এরকম যে অসম পরিস্থিতিতে সংগৃহীত যে কোন জ্ঞান একটি শৃঙ্খলাবদ্ধতার ভূমিকা পালন করে। আমার কাছে এটি অর্থহীন। প্যানোপটিকন ছিল একটা কারাগার। এখানে বন্দীরা নজরদারিতে থাকতো এবং এই শাসনকে তারা আত্তস্থকরণ করেছিল কারণ তারা যদি পালানোর চেষ্টা করতো অথবা প্রতিবাদ করত তাহলে তদেরকে হত্যাও করা হতে পারতো। বল প্রয়োগের ব্যবস্থার অনুপস্থিতে, এই ধরনের পর্যবেক্ষক প্রতিবেশীর খোশগল্পের সমতুল্য হয়ে পড়ে। এমনকি, সেটা কোন ধরনের জনসম্মতি থেকেও বঞ্চিত হয়।


আমি মতে, এই ধরনের তুলনার অন্তর্নিহিত পূর্বানুমান এই যে, এই ধরনের বিস্তৃত জ্ঞান যে কোন সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পের একটি সহজাত অংশ। এমনকি, ঐতিহাসিক রেকর্ডের একটি সংক্ষিপ্ততম অনুসন্ধানও এটা স্পষ্ট করে দেয় যে জাতিতাত্ত্বিক উপাত্ত নথিভূক্ত করবার ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যগুলোর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। এর পরিবর্তে আইন এবং প্রশাসনের প্রশ্নে বরং তারা অনেক বেশি আগ্রহী ছিল। অন্য সমাজের বিবাহ প্রথা কিংবা মৃতদেহ সৎকারের আচার সম্মন্ধে জানতে একজনকে প্রায় অশ্যম্ভাবীভাবে হেরোডোটাস, ইবনে বতুতা কিংবা ঝা কিয়াং-এর মত পর্যটকদের বর্ণনার উপর নির্ভর করতে হয়। অর্থাৎ ঐ ভ্রমণকারী যে রাষ্ট্রের অধিবাসী তার বাইরে যে কোন স্থান সম্পর্কে তাঁর বর্ণনার উপর নির্ভর করতে হয়।


ঐতিহাসিক গবেষণা হতে জানা যায় মুওত ডিটের অধিবাসীরা বস্তুত গ্বেক (Gwek) নামক এক ধর্মপ্রচারকের সাবেক অনুসারী ছিলেন যিনি এক বছর আগে আরএএফ-এর বোমা হামলা এবং জোরপূর্বক উচ্ছেদের শিকার (জনসন ১৯৭৯, ১৯৮২, ১৯৯৪) হন। পুরো বিষয়টি স্পষ্টভাবে সাধারণ আমলাতান্ত্রিক নিবুর্দ্ধিতার কারণেই সংঘটিত হয়েছিল (নুয়্যার সমাজের ক্ষমতার প্রকৃতি সম্পর্কে প্রাথমিক ভুল বোঝা এবং সেখান থেকে যুগ যুগ ধরে জড়িয়ে থাকা নুয়্যার ও ডিংকা জনগণকে আলাদা করবার প্রচেষ্টা)। ইভান্স-প্রিচার্ড যখন সেখানে ছিলেন তখনও পর্যন্ত তারা বৃটিশ কর্তৃপক্ষের শাস্তিমূলক হানা বা উপদ্রবের শিকার হচ্ছিলেন। ইভান্স প্রিচার্ডকে মূলত একজন গুপ্তচর হিসেবে সেখানে যাওয়ার জন্য বলা হয়। তিনি প্রাথমিকভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরবর্তীতে শেষ পর্যন্ত সম্মত হন। পরবর্তীতে তাঁর যাওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন,


“তাদের জন্য দুঃখ অনুভব করেছিলাম”। কর্তৃপক্ষ প্রকৃতপক্ষে যে নির্দিষ্ট তথ্যগুলো চাচ্ছিলেন তিনি দৃশ্যত সাবধানতার সাথে সেগুলো সংগ্রহ করা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু, একই সময়ে, তিনি নুয়্যার সমাজের প্রতি কর্তৃপক্ষের কিছু নির্বোধের মতো করা অত্যাচার নিরুৎসাহিত করবার উদ্দেশ্যে নুয়্যার সমাজের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে তাঁর আরও বেশি সাধারণ অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলেন। যেটি তাঁর ভাষায়, কর্তৃপক্ষকে “মানবিক” করতে করছিলেন (জনসন ১৯৮২ঃ২৪৫)। ফলে, একজন এথনোগ্রাফার হিসেবে উনি শেষ পর্যন্ত যা করলেন সেটিকে ঐতিহ্যবাহী মহিলাদের কাজের সাথে তুলনা করা যায়ঃ কিছু কৌশলী হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ব্যবস্থাকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করা। যার অর্থ আদতে দাঁড়ায় অচেতন এবং আত্ম-অহংকারী পুরুষকে তাদের নিজেদের অন্ধত্বের ফলাফলের দায় থেকে মুক্তি দেওয়া।


কারও হাত পরিস্কার রাখলে কি ভালো হতো? এটা আমার কাছে ব্যক্তিগত বিবেকের প্রশ্ন হিসেবে নাড়া দেয়। কিন্তু আমার সন্দেহ বৃহত্তর নৈতিক বিপদগুলো সম্পূর্ণ অন্য স্তরে রয়েছে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে যে আমাদের তাত্ত্বিক কাজগুলো কি শেষ পর্যন্ত চিন্তার অসম কাঠামোর প্রভাবকে ভেঙ্গে ফেলা কিংবা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে অথবা যা খুব সহজেই ঘটতে পারে যেখানে আমাদের সর্বোত্তম ধারণাগুলোও আমলাতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত সহিংসতার দ্বারা সমর্থিত হয় – আমরা শেষ পর্যন্ত তাদেরকেই শক্তিশালী করি।


এই প্রকল্পে উপদেশ, পরামর্শ এবং উৎসাহ দেওয়ার জন্য আমি ডেভিড আপ্টার, কেথ ব্রেকেনরিজ, ক্রিস্টিনা ফেভারভ্যারি, অ্যান্ডরেজ গ্রুব্যাসিস, ম্যাথিউ হল, লরেন লেভি, ক্রিশ্চিয়ান মুন, স্টুয়ার্ট রকফেলার, মেরিনা সিটরিন, স্টিভ কিউপিড থিওডোর এবং হিল্টন হোয়াইটকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিতে চাই। এই রচনাটি আমার মাকে উৎসর্গকৃত, তাঁর নৈতিক রাজনৈতিক অঙ্গীকার, অপছন্দ এবং সাধারণ বোধের সম্মানে।

____________

২৫শে মে, ২০০৬



অনুবাদকের টীকা

[১] কাফকায়েস্ক- চেক লেখক ফ্রানৎস কাফকার নামানুসারে এই টার্মটির উদ্ভব হয়েছে। কাফকা তাঁর গল্পগুলোতে যেই বিভ্রান্তিকর ও পরাবাস্তব পরিস্থিতির মাঝে ফেলে অর্থহীনতা, অসহায়ত্ব ও বিচ্ছিন্নতাবোধের মধ্য দিয়ে তাঁর চরিত্রগুলোকে আবিষ্কার করতে চেয়েছেন, সেই পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করতেই কাফকায়েস্ক শব্দটির ব্যবহার করা হয়। একে প্রায়শই বিংশ শতাব্দীর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকাঠামো ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সম্মুখীন আধুনিক মানস-এর উপলব্ধির সাথে তুলনা করা হয়। কাফকার সাহিত্যের বিশেষ ধরনটি বুঝাতেও এই টার্মটির ব্যবহার হয়ে থাকে।



দোহাই


[আপ্টার] Apter, David

1965 The Politics of Modernization. Chicago: University of Chicago Press.

1971 Choice and the Politics of Allocation: a developmental theory. New Haven: Yale University Press.

[ব্রেকেনরিজ] Breckenridge, Keith

2003 “Power Without Knowledge: Three Colonialisms in South Africa.” http://www.history.und.ac.za/Sempapers/Breckenridge2003.pdf.

2005 “Verwoerd’s Bureau of Proof: Total Information in the Making of Apartheid.” History Workshop Journal 59: 83-108

[কুপার] Cooper, Marc

1991 "Dum Da Dum-Dum". Village Voice April 16, 1991, pp.28-33.

[গ্রেয়বার] Graeber, David

2006 On the Nature of Politics: Magic and the Legacy of Slavery in Madagascar. Bloomington: Indiana University Press.

[হার্জফিল্ড] Herzfeld, Michael

1994 The Social Production of Indifference: Exploring the Symbolic Roots of Western Bureaucracy. Chicago: University of Chicago Press.

[জনসন] Johnson, Douglas H.

1979 “Colonial Policy and Prophecy: the ‘Nuer Settlement’ 1929-20” in Journal of the Anthropological Society of Oxford, X/1.

1982 “Evans-Pritchard, the Nuer, and the Sudan Political Service.” African Affairs, Vol. 81, No. 323. (Apr., 1982), pp. 231-246

1994 Nuer Prophets. Oxford: Clarendon Press.

[লিচ] Leach, Edmund

1959 “Rethinking Anthropology.” Man:

[রোজালদো] Rosaldo, Renato

1986 “From the Door of His Tent: the Fieldworker and the Inquisitor.” In Writing Culture: The Poetics and Politics of Ethnography (James Clifford and George Marcus, eds.), Berkeley: University of California Press, pp. 77-97.

[স্মিথ] Smith, Adam

XXX Theory of Moral Sentiments


পুনশ্চঃ বক্তৃতাটিকে পরবর্তীতে পরিমার্জনা করে প্রবন্ধে রূপ দেন গ্রেয়বার। "Dead zones of the imagination: On violence, bureaucracy and interpretive labor" শিরোনামে এর পরিমার্জিত রূপটি প্রকাশিত হয় Journal of Ethnographic Theory এর ভলিয়্যুম ২, সংখ্যা ২ (২০১২)-তে।


প্রকাশঃ ৬ই মাঘ, ১৪২৭:::২০শে জানুয়ারি, ২০২১