ঔপনিবেশিকতা এবং আধুনিকতা/যুক্তিবাদিতা

আনিবাল কিহানো



[লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুর সমাজতাত্ত্বিক ও চিন্তক আনিবাল কিহানো(Anibal Quijano)। বিউপনিবেশায়ন ও ক্রিটিক্যাল তত্ত্বচিন্তার দুনিয়ায় তাঁর কাজের বিস্তৃত প্রভাব রয়েছে। লাতিন আমেরিকার আরেক প্রখ্যাত আর্জেন্টাইন চিন্তক ওয়াল্টার মিনোলো(Walter Mignolo), যিনি "লাতিন আমেরিকার সাবঅল্টার্ন স্কুল"-এর অন্যতম তাত্ত্বিক, তাঁর কাজের সূত্রে আমরা আনিবাল কিহানোর সাথে পরিচিত হই। মিনোলো'র The Darker Side Of Western Modernity(২০১১) গ্রন্থের একেবারে শুরুর দিকেই আনিবাল কিহানো'র এক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের খোঁজ দিচ্ছেন। মিনোলো যখন বোগোটা'য় গিয়েছিলেন, তখন তিনি সদ্য প্রকাশিত Los Conquistados: 1942 y La Poblacion Indígena de Las Américas (edited by Heraclio Bonilla,১৯৯২) বইটা খুঁজে পান। এই বইয়ের শেষ অধ্যায়ে তাঁর চোখ আটকে যায়। এটা ছিল আনিবাল কিহানো'র লেখা, যার কথা তিনি আগেও শুনেছিলেন কিন্তু তাঁর বা তাঁর লেখাজোখার সাথে পরিচয় ছিলনা। এই প্রবন্ধটি পরবর্তীতে Cultural Studies জার্নালেও প্রকাশিত হয়, শিরোনাম ছিল Coloniality and Modernity/Rationality। পরবর্তীতে মিনোলো, কিহানোর প্রবন্ধের ঔপনিবেশিকতা(Coloniality) ধারণায় মনোযোগী হন এবং তাঁর পরের দুটি গ্রন্থের কেন্দ্রীয় কনসেপ্ট বা প্রত্যয় হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কালাচারাল স্টাডিজ জার্নালে প্রকাশিত সোনিয়া থেরবন কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে আনিবাল কিহানো'র এই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী তানহা তাহসিন]




আজকের দুনিয়ায় লাতিন আমেরিকা নামে পরিচিত অঞ্চলে যেসব সমাজ-ও-সংস্কৃতি বিরাজ করে, সেসব পরিমণ্ডলে কর্তৃত্ব স্থাপনের মধ্যদিয়ে এক নতুন বিশ্ব-কাঠামোর পরিগঠন শুরু হয়েছিল, যেটি কি-না পাঁচশত বছর পরে এসে শেষমেষ পুরো পৃথিবী পরিব্যাপ্ত এক বৈশ্বিক ক্ষমতা রূপে হাজির হয়েছে। এই প্রক্রিয়া গুটিকয়েক ইউরোপীয় সংখ্যালঘু—এবং সবচেয়ে বড় কথা, এর শাসক শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে এবং তাদের আয়েশের খাতিরে পুরো বিশ্বের সম্পদরাজির সহিংস পুঞ্জিভবনের(accumulation) দিকে ইঙ্গিত দেয়। যদিও অধীনস্তদের বিদ্রোহের মুখে কখনো-সখনো তা ভদ্র বেশ ধরেছে, তবুও এই প্রক্রিয়া এখন অব্দি জারি আছে। কিন্তু বর্তমানে চলমান সংকটকালে নতুন এক উদ্দীপনায় এই ধরনের পুঞ্জিভবনকে অবলম্বন করা হচ্ছে—এমনকি এমন এক পন্থায় বৈশ্বিক পর্যায়ে ঘটছে যা হয়তো আরও সহিংস এবং বেশ বৃহদাকারের। এখনও যার মূল সুবিধাভোগী ‘পশ্চিমা’ ইউরোপীয় শাসকগণ এবং তাদের ইউরো-উত্তর আমেরিকান পূর্বসুরীরা। সেই দলে আরও আছে বিশ্বের অ-ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো যারা কি-না কখনোই ইউরোপীয় উপনিবেশ হয়নি—প্রধানত জাপান—এবং যুক্ত আছে মূলত তাদের শাসক শ্রেণিগুলো। লাতিন আমেরিকা এবং আফ্রিকার নিপীড়িত ও শাসিত মানুষেরাই এসব যাগযজ্ঞের প্রধান বলি।



ইউরোপীয়রা সব মহাদেশেই দখলকৃত অঞ্চলের উপর একধরনের প্রত্যক্ষ, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল। কিন্তু এই কর্তৃত্বকে স্থূলদৃষ্টিতে শুধুমাত্র ইউরোপকেন্দ্রিক উপনিবেশবাদ হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়। সবরকমের প্রাতিষ্ঠানিক এবং আলোচিত-সমালোচিত দিকগুলো বাদ দিয়ে দিয়ে আলাপ করলে, ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ব তার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরাজিত হয়েছে। এই পরাজয়ের প্রথম ঘটনা ছিল আমেরিকা এবং পরবর্তীতে—দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে—এশিয়া এবং আফ্রিকা। ফলস্বরূপ, পশ্চিমা ইউরোপীয় সমাজগুলো কর্তৃক অন্যান্য সমাজগুলোর উপর রাজনৈতিক খবরদারির চিরাচরিত পদ্ধতির অর্থে এই ইউরোপকেন্দ্রিক উপনিবেশবাদকে অতীতের বিষয় বলে মনে হয়। বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়ার থেকে, বরং —উপনিবেশবাদের উত্তরসূরী— পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে অসমভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগতকারী দেশের আধিপত্যশীল গোষ্ঠীদের (‘সামাজিক শ্রেণিগুলো’ এবং/অথবা ‘জাতিসত্তাগুলো’) মধ্যে সামাজিক স্বার্থের এক মেলবন্ধন।



তাছাড়া, ঐ বিশেষ ঔপনিবেশিক ক্ষমতাকাঠামো বিশেষ সামাজিক বৈষম্য উৎপাদন করেছে। এগুলোকে পরবর্তীতে কাল, প্রতিনিধি এবং জনসাধারণের সম্পৃক্ততার নিরিখে ‘গোষ্ঠীগত’, ‘জাতিগত’, ‘নৃতাত্ত্বিক’ কিংবা ‘জাতীয়’ ইত্যাদি রঙচঙে ট্যাগ দিয়ে নথিবদ্ধ করা হয়েছিল। এমনকি ইউরোপকেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বের ফসল এসব আন্তঃবিষয়ী (intersubjective) নির্মাণকে কোনো ঐতিহাসিক গুরুত্ব না দিয়ে, বরং ‘নিরপেক্ষ’, ‘বৈজ্ঞানিক’ বর্গতে ফেলা হতো। স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবেই এটা ক্ষমতার ইতিহাসের দিকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে না। এই ক্ষমতা কাঠামো হচ্ছে সেই পাটাতন, যার উপর ভর করে শ্রেণি অথবা অঞ্চলগুলোর অন্যান্য সামাজিক সম্পর্কগুলো পরিচালিত হতো এবং এখনও হয়।



প্রকৃত অর্থে, আমেরিকার দখলের পর থেকে বৈশ্বিক নিরিখে শোষণ ও সামাজিক কর্তৃত্বের প্রধান প্রধান তরিকার দিকে তাকালে, সেইসাথে বর্তমান বিশ্ব-ক্ষমতার কাঠামো এবং পৃথিবীর জনগণের মধ্যে সম্পদরাজি ও শ্রমের বন্টনের দিকে একটু গভীর মনোযোগ দিলে এটি স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, শোষণ, কর্তৃত্ব ও বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ট বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকেরা একেবারে কাটায়-কাটায় সেসব ‘জাত’, ‘নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী’ অথবা ‘নেশনে’র অন্তর্ভুক্ত যেখানে উপনিবেশিত জনসংখ্যাকে ঐ বিশ্ব-ক্ষমতার নির্মাণ প্রক্রিয়ার বিভক্ত করা হয়েছিল।



একইভাবে, রাজনৈতিক উপনিবেশবাদ সরে গেলেও ইউরোপীয় (একে ‘পশ্চিমা’ও বলা যায়) সংস্কৃতির সাথে অন্যান্য সংস্কৃতির সম্পর্কে এখনও উপনিবেশিক আধিপত্যের বিষয়টি বিরাজ করে। এটি কেবল বাহ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের কাছে অন্যান্য সংস্কৃতির অধীস্থনতার বিষয় নয়; তীব্রতা ও গভীরতার ভিন্নতা সত্ত্বেও অন্যান্যের সংস্কৃতির উপনিবেশায়নকেও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। বাহ্যিক সম্পর্কের দিক থেকে দেখলে, এটা কেবল ইউরোপীয় সংস্কৃতির আরশের নিচে ‘অপর’দের সংস্কৃতির অধীনতার বিষয় নয়; আমাদের আলাপ-আলোচনায় অন্যান্য সংস্কৃতির উপনিবেশের ব্যাপারটাও জায়গা দিতে হবে। আর সেটা মাত্রা এবং গভীরতার নিরিখে পার্থক্য স্থাপনের মাধ্যমেই করতে হবে। এই সম্পর্ক প্রথমেই অধীনস্তদের কল্পনা-জগতে উপনিবেশায়নের ভিত-স্থাপন করে। এক অর্থে, সেই কল্পনা-জগতের জমিনে বীজ বোনে, যা কি-না আবার সেই জগতের-ই একটা অংশ।



গোড়াতে উপনিবেশবাদ একটি পদ্ধতিগত নিপীড়নের ফসল ছিল। কেবল সেইসব কিছু নির্দিষ্ট বিশ্বাস, চিন্তা, চিত্রকল্প, প্রতীক বা জ্ঞানকাণ্ড ছাড়া যেগুলো কিনা বৈশ্বিক উপনিবেশিক আধিপত্যের জন্য দরকারি ছিল না। অন্যদিকে একইসাথে উপনিবেশকরা উপনিবেশিতদের কাছ থেকে তাদের জ্ঞানকাণ্ড, বিশেষত খনিবিদ্যা, কৃষিবিদ্যা, প্রকৌশলবিদ্যাসহ তাদের পণ্য ও কাজ সব কেড়ে নিয়েছিল। সর্বোপরি এই নিপীড়ন ছিল জ্ঞান, জ্ঞান উৎপাদন, দৃষ্টিভঙ্গির উৎপাদনের ধরণ, চিত্রকল্প ও চিত্রকল্পের ব্যবস্থা, প্রতীক, অর্থের প্রণালীর (modes of signification) উপর; ছিল প্রাতিষ্ঠানিক ও objectivised (চিন্তার বিষয়ে পর্যবসিত) অভিব্যক্তির উপাদান, ছাঁচ এবং হাতিয়ারের উপর—হোক সেটা বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা ভিজ্যুয়াল। এরপরই আরোপ করা হয় শাসকদের অভিব্যক্তির নিজস্ব ধরন এবং অতিপ্রাকৃত সম্পর্কিত তাদের বিশ্বাস ও চিত্রকল্প। এই বিশ্বাস ও চিত্রকল্পগুলো কেবল অধীনস্থদের সাংস্কৃতিক উৎপাদনকেই ব্যাহত করে না। বরঞ্চ যখন তাৎক্ষণিক নিপীড়ন স্থায়ী ও পদ্ধতিগত রূপ নেয়, তখন এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণের খুবই কার্যকরী হাতিয়ার।



উপনিবেশক প্রভুরা জ্ঞান ও অর্থ উৎপাদনের নিজস্ব আদর্শ বা রীতিগুলোর বিভ্রান্তিকর প্রক্রিয়াও চাপিয়ে দিয়েছিল৷ প্রথমত, উপনিবেশিকরা জ্ঞান উৎপাদনের এই আদর্শ বা রীতিগুলোকে অধীনস্থদের হাতের নাগালের বাইরে রেখেছিলো। পরবর্তীতে, তাদের জ্ঞানশিক্ষা দেওয়া হয়েছিলো আংশিক ও নির্দিষ্ট পথে, যাতে করে অধীনস্থদের মধ্য থেকে কিছু লোককে তারা নিজেদের ক্ষমতাচর্চার প্রতিষ্ঠানের জন্য বেছে নিতে পারে। তারপর ইউরোপীয় সংস্কৃতিকে প্রলুধ্বকর বা লোভনীয় করে তোলা হয়েছিল: এটি ক্ষমতায় প্রবেশের রাস্তা তৈরি করে দিতো। সর্বোপরি, দমনপীড়নের বাইরেও, সমস্ত ক্ষমতার প্রধান হাতিয়ার হলো এই প্রলোভন। সাংস্কৃতিক ইউরোপীয়করণ একটি আকাঙ্ক্ষায় রূপান্তরিত হয়েছিল। এটি অংশগ্রহণের একটি মাধ্যম ছিল এবং পরবর্তীতে এটি ইউরোপীয়দের মতো সমান বস্তুগত সুবিধা আদায় এবং ক্ষমতায় পৌঁছানোর একটি মাধ্যম হয়ে উঠে: যেমন, ‘উন্নয়ন’-এর নামে প্রকৃতিকে জয় করা। ইউরোপীয় সংস্কৃতি হয়ে উঠে সর্বজনীন সাংস্কৃতিক আদর্শ। অ-ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে এই কল্পজগৎ আজ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সর্বোপরি এই সম্পর্কগুলোর বাইরে এটি নিজেকে পুনরুৎপাদন করতে পারে৷



সময় আর অবস্থাভেদে সাংস্কৃতিক ঔপনিবেশিকতার আকার ও প্রভাব ভিন্ন হয়ে থাকে। লাতিন আমেরিকায় সাংস্কৃতিক দমনপীড়ন এবং কল্পজগতের উপনিবেশায়ন ঘটেছিল নেটিভ বা স্থানীয়দের নির্মূলীকরণের মাধ্যমে। বিশেষত খরচাযোগ্য শ্রমশক্তি হিসেবে, দখলের সহিংসতা এবং ইউরোপীয়দের নিয়ে আসা রোগ-বালাই ব্যবহার করে এই স্থানীয় অধিবাসীদের নির্মূল করা হয়েছিল। [এরূপ উদাহরণ জোসেফ কনরাডের হার্ট অফ ডার্কনেস-এ পাওয়া যায়—অনুবাদক] অ্যাজটেক-মায়া-ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে এবং তাওয়ান্তিসুয়ানা (বা ইনকা) অঞ্চলগুলোতে, প্রায় ৬ কোটি ৫০ লক্ষ অধিবাসীকে পঞ্চাশ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে নির্মূল করা হয়েছিল। এই নির্মূলের মাত্রা এত বিশাল ছিল যে এতে কেবল জনসংখ্যা বিপর্যয় জড়িত ছিল না, সেইসাথে সমাজ ও সংস্কৃতির বিনাশও জড়িত ছিল। সাংস্কৃতিক দমন এবং ব্যাপক গণহত্যা একিসাথে আমেরিকার পূর্ববর্তী উচ্চ সংস্কৃতিগুলোকে মৌখিকতার ভিত্তিতে নিন্দা করে অশিক্ষিত, কৃষক উপসংস্কৃতিতে পরিণত/অবনমিত করেছিল। অর্থাৎ, আনুষ্ঠানিক, বিষয়ীকৃত (objectivised), বুদ্ধিবৃত্তিক এবং মূর্তিগ্রাহী(plastic) বা দৃশ্যগত অভিব্যক্তির (expression, প্রকাশ) নিজস্ব আদর্শ বা রীতি বা ধরন থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। অতঃপর, যারা বেঁচে যাবেন তাদের শাসকশ্রেণির আরোপিত সাংস্কৃতিক আদর্শ ব্যতীত কোন বুদ্ধিবৃত্তিক, বা মূর্তিগ্রাহী বা দৃশ্যগত(visual) অভিব্যক্তির, আনুষ্ঠানিক এবং বস্তুনিষ্ঠ অভিব্যক্তির অন্য উপায় থাকবে না; এমনকি কিছু ক্ষেত্রে অভিব্যক্তির অন্যান্য জরুরত মেটানোর জন্য এদেরকে পরাভূত করতে হলেও। নিঃসন্দেহে লাতিন আমেরিকা ইউরোপের সাংস্কৃতিক উপনিবেশায়নের সবচেয়ে চরমতম ঘটনা।



এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে উচ্চতর সংস্কৃতিগুলোকে এরূপ তীব্রতা এবং গভীরতার সাথে ধ্বংস করা যায়নি। তৎসত্ত্বেও এগুলোকে কেবল ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গিতেই নীচু অবস্থানেই রাখা হয়নি, বরঞ্চ নিজস্ব বাহকদের(bearers) দৃষ্টিতেও এগুলোকে নিচে রাখা হয়েছিল। ইউরোপীয় বা পশ্চিমা সংস্কৃতি তার অগ্রবর্তী সমাজগুলোর রাজনৈতিক, সামরিক এবং প্রযুক্তিগত শক্তির মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক চিত্র উপস্থাপন করেছিল এবং প্রধান জ্ঞানভিত্তিক উপাদানগুলোকে (বিশেষত বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শৈল্পিকতার ক্ষেত্রে) সমস্ত সাংস্কৃতিক বিকাশের এবং দৃষ্টিভঙ্গির আদর্শ হিসেবে আরোপ করেছিল। এই সম্পর্ক সেই সকল সমাজ এবং সংস্কৃতির পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি অত্যাবশ্যকীয় ভূমিকা পালন করেছিল, যাদের সমস্ত কিছু বা কিছু অংশকে ইউরোপীয়করণের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল।



আফ্রিকাতে সংস্কৃতির বিনাশের মাত্রা অবশ্যই এশিয়া থেকে অনেক বেশি তীব্র ছিল, তবে আমেরিকার থেকে কম ছিল। ইউরোপীয়রা প্রকাশ বা অভিব্যক্তির ধরনগুলোর, বিশেষত objectification এবং visual formalization-এর সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটাতে সফল হয়নি। ইউরোপীয়রা আসলে যা করেছিল তা হচ্ছে ইউরোপীয় আদর্শে পরিচালিত বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায় আফ্রিকার অধিবাসীদের বৈধতা এবং স্বীকৃতি প্রদান থেকে বঞ্চিত করেছিল। তাদেরকে ’উদ্ভট’ (exotic) বর্গে সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল। এটাকে ইউরোপীয় রীতিনীতির সমতুল্য তাদের নিজস্ব শৈল্পিক অভিব্যক্তির পন্থা হিসেবে তুলে ধরা হয় না। এটাই আসলে উপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি।



ঔপনিবেশিকতা এখনও বিশ্বে কর্তৃত্বের সবচেয়ে সাধারণ রূপ, একসময় যা প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। স্পষ্টতই, এটি মানুষে মানুষে শোষণ ও কর্তৃত্বের পদ্ধতিগুলো বা শর্তগুলোকে নিঃশেষ করে দেয়নি। কিন্তু গত ৫০০ বছর ধরে এর মূল কাঠামোটি বাতিল হয়ে যায়নি। পূর্ববর্তী সময়ের উপনিবেশিক সম্পর্ক সম্ভবত একই ধরণের পরিণতি নিয়ে আসেনি এবং সর্বোপরি তারা কোনো বৈশ্বিক ক্ষমতার ভিত্তি ছিল না।

ছবিঃ আনিবাল কিহানো


‘জাতি(race)’ এবং ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতা


ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতা একত্রে আমেরিকা ও ইউরোপকে এবং ঔপনিবেশক ও উপনিবেশিতের সামাজিক শ্রেনীবিন্যাসের মূল উপাদান হিসেবে ‘জাতি(race)’ নামক সামাজিক বর্গকে ধারণ করে নিয়েছিল। উর্ধ্বতনদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং অধীনস্থদের হীনমন্যতার পুরনো ধারণাগুলো ইউরোপীয় উপনিবেশের অধীনে জৈবিকভাবে ও কাঠামোগতভাবে মহৎ-হীনমন্যতার একটি সম্পর্কের আদলে পরিবর্তিত হয়েছিল। এটি উপনিবেশবাদের অন্যান্য কোনো পূর্বতন অভিজ্ঞতার মতো নয়।



পরবর্তী শতকে নতুন বিশ্বক্ষমতার ইউরোকেন্দ্রিকীকরণের (Eurocentrification) প্রক্রিয়া পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর নতুন সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসের উপর এধরণের ‘জাতিগত(racial)’ মানদণ্ড আরোপ করেছিল। তাই প্রথমদিকে বিশ্বজুড়ে নতুন সামাজিক পরিচয় তৈরি হয়েছিল: ‘সাদা’, ‘ভারতীয়’, ‘কালো’, ‘হলদে’, ‘জলপাই’; মানুষের শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করা হয় ‘বর্ণগত’ প্রকৃতির বাহ্যিক প্রকাশে। তারপর সেই ভিত্তিতে নতুন ভূ-সাংস্কৃতিক পরিচয় তৈরী হয়েছিল: ইউরোপীয়, আমেরিকান, এশীয়, আফ্রিকান এবং আরও পরে ওশেনিয়া। দুনিয়াব্যাপী ইউরোপীয় উপনিবেশিক আধিপত্য চলাকালে সমগ্র বৈশ্বিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কাজের বণ্টন অর্থাৎ বেতনভোগী, স্বাধীন কৃষক, স্বাধীন বণিক এবং দাস ও ভূমিদাসদের মধ্যকার বণ্টনব্যবস্থা, আদতে সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের একই ‘বর্ণবাদী’ পদ্ধতি অনুসরণ করে সংগঠিত হয়েছিল। এর সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রগুলোর জাতীয়করণের প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত সমস্ত বিষয়াদি এবং সারা বিশ্বজুড়ে জাতিরাষ্ট্র, নাগরিকত্ব, গণতন্ত্র ইত্যাদি গঠন জড়িত। বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কাজের এজাতীয় বন্টন(distribution) ধীরে ধীরে ইউরোপীয় উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের সাথে সাথে (বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে এবং পুঁজিবাদের পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার সাথে সাথে) পরিবর্তন হতে শুরু করে। তবে এমনতর কাজের বন্টন একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি, যেহেতু ইউরোকেন্দ্রিক উপনিবেশবাদের তুলনায় ক্ষমতার ইউরোকেন্দ্রিক ঔপনিবেশিকতা দীর্ঘস্থায়ী প্রমাণিত হয়েছে৷ এটি ছাড়া লাতিন আমেরিকা এবং বিশ্বের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোতে পুঁজিবাদের ইতিহাস ব্যাখ্যা করা দুরূহ।



অতএব, ইউরোকেন্দ্রিক বিশ্বক্ষমতার অধীনে বিশ্বের জনসংখ্যার ‘জাতিগত’ সামাজিক শ্রেণিবদ্ধকরণের ওপর ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতা নির্ভর করে। তবে ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতা কেবল ‘বর্ণবাদী’ সামাজিক সম্পর্কের সমস্যায় নিঃশেষিত হয়না। এটি ইউরোকেন্দ্রিক পুঁজিবাদী ঔপনিবেশিক/আধুনিক বিশ্বক্ষমতার মূল ঘটনাগুলোকে বিস্তৃত ও নিয়ন্ত্রিত করে ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতার ভিত্তি হয়ে উঠে।


ইউরোকেন্দ্রিকতা, সাংস্কৃতিক ঔপনিবেশিকতা এবং আধুনিকতা/যুক্তিবাদীতা


ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক আধিপত্য যেসময় দৃঢ়তর হচ্ছিলো, সেসময়েই ইউরোপীয় আধুনিকতা/যুক্তিবাদীতা হিসেবে পরিচিত সাংস্কৃতিক জটিলতা গঠিত হচ্ছিলো। ইউরোকেন্দ্রিক পুঁজিবাদী ঔপনিবেশিক ক্ষমতা কর্তৃক তৈরিকৃত আন্তঃবিষয়ী (intersubjective) মহাবিশ্বটিকে ইউরোপীয়রাই বর্ধিত এবং প্রাতিষ্ঠানিক করে তুলেছিল। একচেটিয়া ইউরোপীয় পণ্য হিসেবে এবং জ্ঞান, মানবতা ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সার্বজনীন প্যারাডাইম(paradigm) হিসাবে একে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ঔপনিবেশিকতা এবং যুক্তিবাদীতা/আধুনিকতার সম্প্রসারণের মধ্যকার এমন মিশেল মোটেও আকস্মিক ঘটনা নয়, যেমনটা যেই পদ্ধতিতে যৌক্তিক জ্ঞানের ইউরোপীয় মডেলের সম্প্রসারণ করা হয়েছিল বলে দেখানো হয়। প্রকৃতপক্ষে এই প্যারাডাইম তৈরীতে ক্ষমতার ঔপনিবেশিকতার অনিবার্য তাৎপর্য রয়েছে, যা নগর ও পুঁজিবাদী সামাজিক সম্পর্কের উত্থানের সাথে জড়িত। এটি উপনিবেশবাদ এবং ঔপনিবেশিকতার বাইরে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাবে না। অন্তত লাতিন আমেরিকা সম্পর্কে যতক্ষণ বলা হয়। আধুনিকতা/যুক্তিবাদীতার ইউরোপীয় আদর্শ তৈরীতে ঔপনিবেশিকতার চূড়ান্ত প্রভাব, সাংস্কৃতিক জটিলতার প্রকৃত সংকটে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এই সঙ্কটের প্রাথমিক কয়েকটি প্রশ্নের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে সমস্যাটির দিকে আলোকপাত করা যাবে।



জ্ঞান উৎপাদনের প্রশ্নে


শুরুতেই ইউরোপীয় মডেলের যুক্তিবাদী জ্ঞানের বিদ্যমান সংকটে, পরবর্তীটির মৌলিক পূর্বানুমান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে: যেমন, চিন্তার কর্তা-চিন্তার বিষয়ের সম্পর্কের (subject-object relation) ফলাফল হিসেবে জ্ঞান। অন্তর্নিহিত জ্ঞানের বৈধতা সংক্রান্ত সমস্যাগুলো ছাড়াও, এই পূর্বানুমান আরও কিছু সমস্যা উত্থাপন করে এবং তা সংক্ষিপ্ত আলাপের দাবি রাখে।



প্রথমত, এই পূর্বানুমানে ‘বিষয়ী/চিন্তার কর্তা(subject)’ একটি বিচ্ছিন্ন স্বতন্ত্র ক্যাটেগরি বা বর্গকে নির্দেশ করে। কারণ এটি নিজে নিজেকে গঠন করে নিজেরই-মধ্যে এবং নিজেরই-জন্য, এটার ডিসকোর্স এবং এটার ভাবনার ক্ষমতার মধ্যে। কার্তেসীয় ‘cogito, ergo sum’ (আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমার অস্তিত্ব আছে)-এর অর্থ হুবহু তা-ই। দ্বিতীয়ত, ‘চিন্তার বিষয়(object)’ বর্গটি এমন একটি সত্তা নির্দেশ করে যা কেবল ‘চিন্তার কর্তা’ থেকে আলাদাই নয়, বরঞ্চ প্রকৃতিগতভাবে এটি বহিরাগতও। তৃতীয়ত, ‘চিন্তার বিষয়’ নিজের সাথেও অভিন্ন কারণ এটি এমনসব ‘গুণাবলী’ দ্বারা গঠিত, যা একে চিহ্নিত করে এবং সংজ্ঞায়িত করে। অর্থাৎ তারা এটিকে নির্দিষ্ট করে দেয় এবং পাশপাশি অন্যান্য ‘বিষয়’-এর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এর অবস্থানও নির্ণয় করে দেয়।



এই মডেলে যে সমস্যা আছে তা হলঃ প্রথমত, ‘চিন্তার কর্তা’র স্বতন্ত্র এবং স্বাতন্ত্রিক চরিত্র intersubjectivity ও সামাজিক সামগ্রিকতাকে জ্ঞানের জমিন হিসেবে অস্বীকার করে প্রতিটি অর্ধ-সত্যের মতন করে সমস্যাটিকে বিভ্রান্ত করে ফেলে। দ্বিতীয়ত, ‘বিষয়’-এর ধারণাটি বর্তমান বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলাফলের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই অনুযায়ী ‘গুণাবলী(properties)’ হল প্রদত্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রের ধরন(Modes) এবং কাল(Times)। অতএব, সম্পর্কের ক্ষেত্রের বাইরে সত্তাগতভাবে(ontologically) অপরিবর্তনীয় মৌলিকত্ব হিসাবে অভিন্নতার(identity) ধারণার খুব বেশি জায়গা নেই। তৃতীয়ত, ‘চিন্তার কর্তা’ এবং ‘চিন্তার বিষয়’-এর সম্পর্কের বাহ্যিকতা (যা কিনা প্রকৃতির ভিন্নতার উপর প্রতিষ্ঠিত) তা কেবল পার্থক্যগুলোর খেয়ালী অতিরঞ্জনই নয়। কেননা বর্তমান গবেষণা বরঞ্চ দেখায় যে, মহাবিশ্বে একটি গভীর যোগাযোগ কাঠামো রয়েছে। আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে এই যে, এই জ্ঞানজাগতিক পরিপ্রেক্ষিতে এটি একটি নতুন র‍্যডিক্যাল দ্বৈতবাদের দিকে ইঙ্গিত দেয়: মহান যুক্তি (reason) এবং প্রকৃতি। ‘বিষয়ী বা চিন্তার কর্তা’ হচ্ছে ‘যুক্তি’র বাহক; অন্যদিকে ‘বিষয়’ কেবল এর বাইরেই নয়, বরঞ্চ প্রকৃতিগতভাবে ভিন্ন। প্রকৃতপক্ষে, এটিই ‘প্রকৃতি’।



যে কেউ অবশ্য ‘বিষয়ী বা চিন্তার কর্তা’র ধারণার মধ্যে বিচ্ছিন্ন স্বতন্ত্র হিসাবে ইউরোপের সামাজিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তির(individual) মুক্তির প্রক্রিয়ার একটি ঘটনা ও উপাদান শনাক্ত করতে পারেন। পরবর্তীটি ব্যক্তিকে তার পুরো জীবনকালে একটি একক স্থান এবং সামাজিক ভূমিকার জন্য নিন্দা জানিয়েছিল, যেন নিপীড়ন ও মতাদর্শ এবং অনুরূপ ধারণাগুলো কর্তৃক জারি থাকা দৃঢ়ভাবে স্থির স্তরায়িত সকল সমাজে এটি ঘটে। এটি আধুনিক-পূর্ব ইউরোপীয় সংস্কৃতি/সমাজগুলোর ঘটনা ছিল। এই মুক্তি পুঁজি এবং নগরজীবনের সামাজিক সম্পর্কের উত্থানের সাথে যুক্ত একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম ছিল। কিন্তু, অন্যদিকে সেই প্রস্তাবটি এই জমানার সাম্প্রতিক জ্ঞান জগতে অগ্রহণযোগ্য। এই পৃথকীকৃত স্বতন্ত্র কর্তাসত্তা(subjectivity) বাস্তব, তবে এটি কোন সত্তা(being) নয়। সুতরাং এটি কেবলমাত্র নিজের বিপরীতে বা নিজের সাথে উপস্থিত থাকে না। এটি intersubjectivity বা সামাজিক সম্পর্কের আন্তঃবিষয়ী মাত্রার পৃথকীকৃত অংশ হিসেবে উপস্থিত থাকে, তবে আলাদা হিসেবে নয়। প্রত্যেক স্বতন্ত্র ডিসকোর্স অথবা ভাবনা আন্তঃ-সাবজেক্টিভিটির কাঠামোতে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে প্রথমটি দ্বিতীয়টির অন্তর্ভুক্ত এবং তার সাথে সম্পর্কিত। এই দৃষ্টিকোণ থেকে জ্ঞান হচ্ছে কোন কিছুর উদ্দেশ্যে একটি আন্তঃবিষয়ী(intersubjective) সম্পর্ক; একটি বিচ্ছিন্ন কর্তাসত্তা(subjectivity) এবং সেই কিছুটার মধ্যকার সম্পর্ক নয়।



সম্ভবত এটি আকস্মিক ঘটনা নয় যে, জ্ঞানকে তখন সম্পত্তির মতো করে বিবেচনা করা হতো—একজন ব্যক্তির সাথে অন্য কিছুর সম্পর্ক হিসেবে বিবেচনা করা হত। এই একই মানসিক প্রক্রিয়া আধুনিক সমাজ উত্থানের মুহূর্তে উভয় ধারণাতেই নিহিত ছিল—তা সত্ত্বেও, জ্ঞানের মতো সম্পত্তিও হলো কোন কিছুর উদ্দেশ্যে মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক; কোন ব্যক্তি ও কোন কিছুর মধ্যকার সম্পর্ক নয়। এই ঘটনাগুলোর মধ্যে এই পার্থক্য রয়েছেঃ সম্পত্তির সম্পর্ক কোন বস্তুর মধ্যে যেমন বিদ্যমান, ঠিক তেমনি একটি আন্তঃবিষয়ী পদ্ধতিতেও বিদ্যমান; কিন্তু অন্যদিকে জ্ঞান কেবলই একটি আন্তঃবিষয়ীintersubjective) সম্পর্ক হিসেবে বিদ্যমান থাকে।



সুতরাং, এটা মনে হয় যে, যেকেউ-ই সেই সময়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ/দ্বৈতবাদ এবং ইউরোপীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের মধ্যে সংযোগ প্রদর্শন করতে পারে, যখন মূল ইউরোপীয় যৌক্তিকতার প্যারাডাইমটি ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। তবে এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ/দ্বৈতবাদে আরও একটি উপাদান আছে, যার ব্যাখ্যা ইউরোপের অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে শেষ হয়না: ‘অপর(other)’ সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত; কিংবা উপস্থিত থাকতে পারে কেবলমাত্র একটি objectivized(চিন্তার বিষয়ে রূপান্তরিত করা) রূপে।



‘অপর’-এর র‍্যাডিক্যাল অনুপস্থিতি কেবল সাধারণভাবে সামাজিক অস্তিত্বের একটি অতিক্ষুদ্র (atomistic) চিত্রকেই স্বীকার করে না, এটি সামাজিক সামগ্রিকতার ধারণাটিকে অস্বীকার করে। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক অনুশীলনটি এমন দেখাতে হয়েছিল, যে প্যারাডাইমটি ইউরোপীয় প্রেক্ষাপটের বাইরে যেকোন ‘চিন্তার কর্তা’র সাথে জড়িত সবকিছুকে বাতিল করেছিল, সামগ্রিকতা হিসেবে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাকে(order) গায়েব করে দেয়ার জন্য; একই সাথে একই সময়ে বাকি বিশ্বের সাথে উপনিবেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইউরোপের ধারণা নিজেকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। ‘পশ্চিম’ বা ‘ইউরোপ’-এর ধারণার উত্থান, অপর সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কের এবং অপর সংস্কৃতির সাথে পার্থক্যের সম্পর্কের পরিচয়ের স্বীকৃতি। তবে এই পার্থক্যগুলো সম্পূর্ণরূপে ‘ইউরোপীয়’ বা ‘পশ্চিমা’ ধারণার কাছে স্বীকৃত হয়েছিল প্রাথমিকভাবে হায়ারার্কির অর্থে অসমতা হিসেবে। এই জাতীয় অসমতাগুলো প্রাকৃতিক হিসেবে দেখানো হয়েছিল। কেবল ইউরোপীয় সংস্কৃতিটিই যৌক্তিক, এটি ‘চিন্তার কর্তা(subject)’ ধারণ করে; বাকি সংস্কৃতিগুলো ‘যৌক্তিক’ নয়, সেগুলো ‘চিন্তার কর্তা’ হতে বা ধারণ করতে পারে না। ফলস্বরূপ, অপর সংস্কৃতিগুলো যেহেতু যেহেতু অসম সেহেতু ভিন্ন, প্রকৃতপক্ষে বৈশিষ্ট্যগতভাবে নিচুশ্রেনীর। এরা কেবল জ্ঞানের অথবা/এবং কর্তৃত্ব চর্চার ‘বিষয়’ হতে পারে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, ইউরোপীয় সংস্কৃতি এবং অপর সংস্কৃতির মধ্যকার সম্পর্ক ‘চিন্তার কর্তা’ এবং ‘চিন্তার বিষয়’-এর মধ্যকার সম্পর্ক হিসেবে স্থাপন করা হয়েছিল এবং বজায় রাখা হয়েছিল। সুতরাং, এটি সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে যোগাযোগের সকল সম্পর্ক, জ্ঞানের আন্তঃবিনিময় এবং জ্ঞান উৎপাদনের প্রক্রিয়া অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল। কেননা মডেলটি নির্ধারণ করে দিয়েছিল যে ‘বিষয়’ এবং ‘বিষয়ী বা চিন্তার কর্তা’র মধ্যে কেবল বাহ্যিক সম্পর্ক থাকতে পারে। ইউরোপ এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যে কেবল ঔপনিবেশিকতার সম্পর্কের ফসল হিসেবে এই জাতীয় মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি পাঁচশো বছর ধরে চর্চা হিসেবে টিকে আছে। অন্যকথায়, যুক্তিবাদী/যৌক্তিক জ্ঞানের ইউরোপীয় প্যারাডাইম কেবল এই প্রসঙ্গেই ব্যাখ্যা করা হয়নি। বরং বিশ্বজুড়ে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক কর্তৃত্বের সাথে জড়িত একটি ক্ষমতা কাঠামোর অংশ হিসেবেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই প্যারাডাইম ক্ষমতা কাঠামোর ঔপনিবেশিকতার নির্দেশক।


যেমনটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে, বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এথনোলজি(ethnology) এবং নৃবিজ্ঞানের মতো কিছু নির্দিষ্ট শাখার গঠন এবং বিকাশ সর্বদা ‘পশ্চিমা’ সংস্কৃতি এবং অপর সংস্কৃতির মধ্যে এই জাতীয় ‘বিষয়-বিষয়ী বা চিন্তার বিষয়-চিন্তার কর্তা’র সম্পর্ক প্রদর্শন করে। সংজ্ঞামতে, অন্যান্য সংস্কৃতিগুলো হল অধ্যয়নের/পাঠের ‘বিষয়’। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি এবং সমাজ সম্পর্কে এই জাতীয় অধ্যয়নগুলো ব্যাঙ্গাত্মক প্যারোডি ব্যতীত বস্তুত অস্তিত্বহীন। [“ন্যাসিরেমার (Nacirema) একটি আচার—‘আমেরিকান’দের একটি এনাগ্রাম(anagram, কোনো শব্দ বা শব্দগুচ্ছের অক্ষরগুলিকে এদিক-ওদিক করে গঠিত শব্দ বা শব্দগুচ্ছ) এর একটি আদর্শ উদাহরণ]



জ্ঞানে সামগ্রিকতার প্রশ্ন


কার্তেসীয় মডেলে এর অনুপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও, ইউরোপীয় বিতর্কে বিশেষত সামাজিক বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত সামগ্রিকতার ধারণার বুদ্ধিগত প্রয়োজনীয়তা উপস্থিত ছিল; প্রথমদিকে আইবেরিয়ান দেশগুলোতে (ভিক্টোরিয়া, সুয়ারেজ) এবং গির্জা ও সম্রাট দ্বারা আশ্রিত ক্ষমতা সংরক্ষণ এবং কিছুটা পরে (আঠারো শতকে) ফ্রান্সে, এবং এরপর সামাজিক সমালোচনা ও বিকল্প সামাজিক প্রস্তাবের মূল উপাদান হিসেবে এর উপস্থিতি ছিল। সর্বোপরি, সেইন্ট-সিমন(Saint-Simon) থেকে সামাজিক সামগ্রিকতার ধারণাটি বৈপ্লবিক সামাজিক পরিবর্তনের প্রস্তাবগুলোর সাথে সংঘবদ্ধ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল, সামাজিক অস্তিত্বের আণবিক(atomistic) দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করেছিল, তারপর কর্তৃত্বের জায়গা দখল করেছিল অভিজ্ঞতাবাদীদের মধ্যে এবং বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলার অনুগতদের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীতে, সামগ্রিকতা পরিণত হয়েছিল একটি দৃষ্টিকোণে এবং বৈজ্ঞানিক তদন্তে স্বীকৃত একটি ক্যাটেগরি (বিশেষত সমাজসম্পর্কিত) হিসেবে।



ইউরোপীয় পশ্চিমা যুক্তিবাদ/আধুনিকতা কেবল গীর্জার সাথে এবং ধর্মের সাথে বিতর্কিত সংলাপেই গঠিত হয়নি; বরঞ্চ একদিকে পুঁজিবাদী ও শহুরে সম্পর্কে এবং জাতি-রাষ্ট্রে, এবং অন্যদিকে বিশ্বের বাকি অংশের উপনিবেশায়নে ক্ষমতার পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায়ও গঠিত হয়। সম্ভবত এমন পরিস্থিতিতে সামাজিক সামগ্রিকতার ধারণাটি যা organicist[পৃথক অঙ্গ নয়, সমগ্র কাঠামো হিসেবে কাজ করা] চিত্র অনুযায়ী বিকশিত হয়েছিল, যার ফলে বাস্তবতার একটি রিডাকশনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি গৃহীত হয়েছিল।



প্রকৃতপক্ষে, সামাজিক সামগ্রিকতার অর্থাৎ সমাজের ধারণাটি প্রবর্তন এবং প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সে দৃষ্টিভঙ্গিটি অবশ্যই দরকারি ছিল। তবে, দুটি অন্যান্য ধারণার সাথে এটি একই ধারণা তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিলঃ এক, প্রতিটি অংশের মধ্যকার কার্যকরী সম্পর্কের কাঠামো হিসেবে সমাজ একটিমাত্র যুক্তির ক্রিয়াতে যুক্ত, অতএব একটি বদ্ধ সামগ্রিকতা। এটি পরবর্তীতে কাঠামোগত-কার্যকারিতাবাদে সামগ্রিকতার একটি পদ্ধতিগত ধারণা নিয়ে আসে। অন্য ধারণাটি ছিল সমাজ একটি জৈব কাঠামো, যেখানে জীব বিশেষত মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গগুলোর মত হায়ারার্কি অনুযায়ী সমাজের বিভিন্ন অঙ্গ একে অপরের সাথে জড়িত। যেখানে একটি প্রধান অংশ (মস্তিষ্ক) আছে যা বাকি অংশগুলোকে চালিত করে – যদিও তা অস্তিত্বের খাতিরে কোন অংশকে বাদ দিতে পারে না এবং বাকি অংশের (বিশেষত পা) প্রধান অংশের সাথে সম্পর্কিত না হলে অস্তিত্ব থাকে না।



রোমান প্রজাতন্ত্রের শুরুর দিকে ইতিহাসের প্রথম ধর্মঘটকারীদের নিরস্ত্র করতে চালু হওয়া মেনেনিয়াস আগ্রিপ্পা’র কিংবদন্তী বক্তব্যটি (মালিকরা হচ্ছেন মস্কিষ্ক, এবং শ্রমিকরা হচ্ছেন বাহু যা শরীরের বাকি অংশের সাথে একত্রিত হয়ে সমাজ গঠন করে) প্রসারিত হয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি বা অভিযানের সাথে সাথে এবং উদ্যোক্তা ও শ্রমিকের মধ্যকার সম্পর্কগুলোর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। মস্তিষ্ক ছাড়া বাহুগুলো অকেজো এবং বাহু ছাড়া মস্তিষ্ক টিকে থাকতে পারেনা। শরীরের বাকী অংশকে জীবিত এবং সুস্থ রাখতে উভয়ই প্রয়োজনীয়, যা ছাড়া মস্তিষ্ক এবং বাহু কোনটারই অস্তিত্ব থাকতে পারে না। [ভ্লাদিমির] লেনিন কর্তৃক গৃহীত [কার্ল] কাউটস্কির প্রস্তাবটি ছিল এই চিত্রেরই আরেকটি রূপ, যেখানে প্রলেতারিয়েতেরা তাদের শ্রেণিচেতনাকে বিশদভাবে জানাতে অক্ষম এবং বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী ও/অথবা পেটি বুর্জোয়ারা এটি প্রলেতারিয়েতদের শেখাবে। এটি মোটেও আকস্মিক নয় যে, লেনিন রাশিয়ান পপ্যুলিস্ট বা লোকরঞ্জনবাদীদের সাথে বিতর্কে (‘Who are the Friends of the People’) স্পষ্টভাবে যুক্তি দিয়েছিলেন যে সমাজ একটি অরগ্যানিক সামগ্রিকতা(organic totality)। লাতিন আমেরিকাতে চিত্রটি বারবার ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন সম্প্রতি হামে পা সামোরা(Jaime Paz Zamora) এক সাক্ষাৎকারে বলিভিয়ার বুদ্ধিজীবী ও শ্রমিকদের মধ্যে, রাজনৈতিক দল ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মধ্যেকার সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলেন: দলগুলো মাথা, ইউনিয়নগুলো হচ্ছে পা। এই ধারণাটি রাজনৈতিক দলগুলোর চর্চা এবং তাদের জনপ্রিয় ‘ভিত্তি’কে দ্রুতই পরিব্যাপ্ত করে ফেলে।



সমাজের ও সামাজিক সামগ্রিকতার এই organicist ধারণাটি ‘বিষয়-বিষয়ী সম্পর্ক’ হিসেবে জ্ঞানের সাধারণ মডেলের সাথে বেমানান নয়। এগুলো বাস্তবতার আণবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি বিকল্প বটে, কিন্তু তারা একই মডেলেই নিজেদের জিইয়ে রাখে। তবে, উনিশ শতকে এবং বিশ শতকের একটি বড় অংশে সামজিক সমালোচনা এবং সামাজিক পরিবর্তনের প্রস্তাবগুলো এই organicist দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা উত্থাপিত হতে পারে, কারণ দ্বিতীয়টি অর্থাৎ সামাজিক পরিবর্তনের প্রস্তাবগুলো সমাজের আর্টিকুলেটর হিসেবে ক্ষমতার অস্তিত্ব স্পষ্ট করেছিল। এটি এভাবে সমাজে ক্ষমতার প্রশ্ন প্রতিষ্ঠা করতে এবং তর্কবিতর্ক করতে অবদান রাখে।



অন্যদিকে, উপনিবেশবাদ কর্তৃক রূপায়িত ব্যবস্থা(order) সমজাতিক না হওয়া সত্ত্বেও এই organicist ধারণাগুলো একটি ঐতিহাসিকভাবে সমজাতীয় সামগ্রিকতার পূর্বানুমানকে ইঙ্গিত করে। অতএব, উপনিবেশিত অঞ্চলটি মূলত সামগ্রিকতার অন্তর্ভুক্ত ছিল না৷ জানা কথা যে, এনলাটেনমেন্টের ইউরোপেরর ‘মানবতা’ এবং ‘সমাজ’ বর্গগুলো অ-পশ্চিমা জনগণ পর্যন্ত প্রসারিত হয়নি, অথবা এই স্বীকৃতির কোনো ব্যবহারিক প্রভাব ছিল না। যাইহোক, বাস্তবের অর্গানিক চিত্র অনুসারে, প্রধান অংশ অর্থাৎ জীবদেহের মস্তিষ্ক ছিল ইউরোপ এবং বিশ্বের প্রতিটি উপনিবেশিত অংশে ছিল ইউরোপীয়ানরা। উপনিবেশিতরা হচ্ছে ‘হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন’–জনপ্রিয় মতটি এই ছবির সাথে সরাসরি জড়িত।



এভাবে, পরিশেষে, সামগ্রিকতার ধারণা সমাজকে তার বিভিন্ন অংশগুলোর মধ্যকার কার্যকরী সম্পর্কের সাথে ক্রমাধিকার ব্যবস্থার ভিত্তিতে রূপায়িত একটি বদ্ধ কাঠামো হিসাবে চিত্রিত করে; যা কিনা ঐতিহাসিক সামগ্রিকতার (historical totality) একটি একক ঐতিহাসিক যুক্তি মেনে নেয়; এবং পাশাপাশি মেনে নেয় সেই একক সামগ্রিক যুক্তির প্রতিটি অংশের অধীনতাকে গঠন করা যৌক্তিকতাকে। এটি সমাজকে একটি ম্যাক্রো-ঐতিহাসিক বিষয় হিসেবে গ্রহণের দিকে ধাবিত করে যা একটি ঐতিহাসিক যৌক্তিকতায় পরিপূর্ণ; এটি পরিপূর্ণ একটি আইনানুগত্যে যা কিনা সমগ্র ও তার প্রতিটি অংশের আচরণ পূর্বানুমানের অনুমতি প্রদান করে; পাশপাশি সময় অনুযায়ী এর বিকাশের দিক ও চূড়ান্তটাও পূর্বানুমান করে। সামগ্রিকতার এই প্রধান অংশটি, কোনভাবে সেই ঐতিহাসিক যুক্তিটি, ঔপনিবেশিক বিশ্ব অর্থাৎ ইউরোপের প্রসঙ্গে হাজির হয়। তখন এটা অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয় যে, ইতিহাসকে গ্রহণ করা হয়েছিল আদিম থেকে সভ্য পর্যন্ত বিবর্তনীয় ধারাবাহিকতা হিসেবে—প্রাচীন থেকে আধুনিক পর্যন্ত, বর্বর থেকে যৌক্তিক পর্যন্ত, পুঁজিবাদপূর্ব অবস্থা থেকে পুঁজিবাদ পর্যন্ত ইত্যাদি এবং ইউরোপ নিজেকে অন্য সকল সমাজ ও সংস্কৃতির ভবিষ্যতের দর্পণ হিসেবে ভেবেছিল; সমগ্র প্রজাতির ইতিহাসের উন্নত রূপ হিসেবে ভেবেছিল। তবে যেটা বিস্মিত না করে পারে না সেটা হচ্ছে যে, ইউরোপ ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির ব্যবহারিক সামগ্রিকতার উপরে সেই ‘মরীচিকা’ আরোপ করতে সফল হয়েছিল এবং এবং সবচাইতে বড়ো কথা, এই বিভ্রমটা এখনও অনেকের কাছে আকর্ষণীয় বলে মনে হয়।

ছবিঃ আনিবাল কিহানো



জ্ঞানতাত্ত্বিক পুনর্গঠন প্রক্রিয়া: বিউপনিবেশায়ন


কেবল অভিজ্ঞতাবাদীরাই নন, বরং নিজেদের উত্তরাধুনিক বলে চিহ্নিত করা বুদ্ধিজীবী সমাজও বর্তমানে ইউরোপে সামগ্রিকতার ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন এবং অস্বীকার করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, সামগ্রিকতার ধারণাটি ইউরোপের ঔপনিবেশিকতা/আধুনিকতার একটি ফসল। আর এটা স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে, যেমনটি আমরা পূর্বেই দেখেছি, সামগ্রিকতার ইউরোপীয় ধারণাগুলো তত্ত্বীয় রিডাকশনিজম এবং ম্যাক্রো-ঐতিহাসিক বিষয়ের অধিবিদ্যার দিকে ধাবিত করে। তদুপরি, সমাজের সম্পূর্ণ যৌক্তিকীকরণের(Rationalization) উদ্দেশ্যের পিছনে অনভিপ্রেত রাজনৈতিক চর্চার সাথে এই ধারণাগুলো সংযুক্ত হয়েছে।



কিন্তু ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতা/আধুনিকতায় বিস্তৃত সামগ্রিকতার ধারণা ও ভাব থেকে কেউ নিজেকে রেহাই দিতে চাইলে সামগ্রিকতার সম্পূর্ণ ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করার প্রয়োজন নেই। একেবারে ভিন্ন কিছু করতে হবে: ইউরোপীয় যুক্তিবাদিতা/আধুনিকতার ফাঁদ থেকে জ্ঞান, ভাবনা, এবং চিন্তার আদান-প্রদানকে মুক্ত করতে হবে।



‘পশ্চিম’-এর বাইরে, বস্তুত সকল জ্ঞাত সংস্কৃতিতে, সৃষ্টিগত দর্শনে, কল্পজগতে(image), সকল পদ্ধতিগত জ্ঞানের উৎপাদন সামগ্রিকতার একটি দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সংযুক্ত। তবে সেই সংস্কৃতিগুলোতে জ্ঞানের সামগ্রিকতার দৃষ্টিভঙ্গিতে সকল বাস্তবতার ভিন্নতার(heterogeneity) স্বীকৃতি অন্তর্ভুক্ত থাকে; অর্থাৎ সকল বাস্তবতার উপাদানগুলোর বিচিত্র চরিত্র, সর্বোপরি সামাজিকতার স্বীকৃতি অন্তর্ভুক্ত থাকে। সামাজিক সমগ্রতার ধারণাটি কেবল অস্বীকারই করে না বরং সকল সমাজের ঐতিহাসিক বৈচিত্র্য এবং ভিন্নতার উপর নির্ভরও করে। অন্যকথায় এটা কেবল অস্বীকার করে না, এটা বিচিত্র ও ভিন্ন ‘অপর’-এর ধারণার দাবিও করে। এই পার্থক্য ‘অপর’-এর অসম প্রকৃতি, হায়ারার্কির অসমতা, কিংবা অপরের সামজিক অধীনতার দিকে অপরিহার্য ইশারা প্রদান করে না। যার ফলে সম্পর্কের চূড়ান্ত বাহ্যিকতার দিকেও ইঙ্গিত প্রদান করে না। পার্থক্যগুলো অপরিহার্য শাসন বা আধিপত্যের ভিত্তি নয়। একই সময়ে এবং এই কারণেই, ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক ভিন্নতা এদের কোন একটির চতুর্দিকে বিচিত্র ঐতিহাসিক ‘যুক্তি’র রূপায়ন ও সহ-উপস্থিতিকে বোঝায়, যা অধিপতি হলেও কোনভাবেই একক নয়। এইভাবে, রিডাকশনিজমের পাশাপাশি একটি ঐতিহাসিক ম্যাক্রো-বিষয়ের অধিবিদ্যার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এই ঐতিহাসিক ম্যাক্রো বিষয় নিজ যৌক্তিকতা এবং ঐতিহাসিক উদ্দেশ্যতে সক্ষম, যার মধ্যে ব্যক্তি এবং নির্দিষ্ট গোষ্ঠী­­—যেমন শ্রেণি—বাহক বা প্রচারক হতে পারে না।



যুক্তিবাদিতা/আধুনিকতার ইউরোপীয় মডেলের পর্যালোচনা করা অপরিহার্য, এমনকি জরুরিও বটে। কিন্তু সন্দেহ হয় এইসব সমালোচনা কি এর সকল বর্গের, জ্ঞানজগতের সামগ্রিকতার ধারণা ও পরিপ্রেক্ষিতকে কেবল খারিজ করেই গঠিত হবে! প্রথমত, যুক্তিবাদিতা/আধুনিকতা এবং ঔপনিবেশিকতার মধ্যকার সংযোগসমূহ থেকে নিজেকে মুক্ত করা জরুরী এবং অবশ্যই সেসকল ক্ষমতা থেকে মুক্ত করা জরুরি যেগুলো স্বাধীন মানুষের স্বাধীন সিদ্ধান্তে গঠিত হয়নি। এটি প্রথমত ক্ষমতা সর্বোপরি ঔপনিবেশিক ক্ষমতার জন্য হাতিয়ার, যা জ্ঞানের বিকৃত প্যারাডাইম উৎপাদন করে এবং আধুনিকতার মুক্ত প্রতিশ্রুতিগুলোকে বিনষ্ট করে। সুতরাং বিকল্প আমাদের কাছে পরিষ্কার: বিশ্বক্ষমতার ঔপনিবেশিকতার বিনাশ। নতুন আন্তঃসাংস্কৃতিক যোগাযোগের জন্য, অভিজ্ঞতা ও অভিপ্রায়ের বিনিময়ের জন্য, আরেক যৌক্তিকতার বুনিয়াদ হিসেবে যেটা ন্যায়সঙ্গতভাবে সর্বজনীনতা জাহির করতে পারে তার জন্য, বিউপনিবেশিকতা হিসেবে, জ্ঞানতাত্ত্বিক বিউপনিবেশায়ন প্রয়োজন। পরিশেষে, নির্দিষ্ট কোন এক গোষ্ঠীর মহাজাগতিক অভীষ্টকে সার্বজনীন বা সার্বিক যৌক্তিকতা হিসাবে গ্রহণ করার দাবির চাইতে কম যুক্তিযুক্ত আর কিছু হতে পারে না, এমনকি সেই গোষ্ঠী যদি পশ্চিমা ইউরোপও হয়ে থাকে। কারণ এটি আসলে একটি প্রাদেশিকতাবাদকে (provincialism) সার্বিক বা সার্বজনীনতাবাদ(universalism) হিসাবে আরোপ করতে চায়।



ঔপনিবেশিকতার দাসত্ব থেকে আন্তঃসাংস্কৃতিক সম্পর্কগুলোর মুক্তি সব মানুষের স্বতন্ত্রভাবে বা সম্মিলিতভাবে বাছাই করার স্বাধীনতা বোঝায়: বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে নির্বাচন করার স্বাধীনতা এবং সর্বোপরি, উৎপাদন, সমালোচনা, পরিবর্তন এবং সংস্কৃতি-ও-সমাজ বদলের স্বাধীনতা। এই মুক্তি হল অসমতা, বৈষম্য, শোষণ এবং আধিপত্য দ্বারা গঠিত সকল ক্ষমতার সামাজিক মুক্তির প্রক্রিয়ার অংশ।

______________



ইংরেজি অনুবাদকের টীকা

১। রেস-এর ধারণার উৎপত্তি নিয়ে এখানে বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ অবশ্য নেই। দেখুন, কিহানো(১৯৯২)।

২। লাতিন আমেরিকার জন্য, দেখুন কিহানো(১৯৯৩)।


দোহাই


i. [কিহানো, ১৯৯২]
Quijano, Aníbal (1992) “Raza, Etnia y Nacin: en Mariátegui: cuestiones abiertas” in José Carlos MariáteguiyEuropa, ed. Roland Forgues, La OtracaradelDescubrimiento, Liina, Amauta, Peru.

ii. [কিহানো, ১৯৯৩] Quijano, Aníbal (1993), "América Latina en la economía mundial", in Problemas dcl Deserrollo Revista del Instituto de Investigaciones de la Facultad de Econornja, UNAM, vol. XXIV, no. 95, Mexico.


প্রকাশঃ ১৬ই পৌষ, ১৪২৭:::৩১শে ডিসেম্বর, ২০২০

***এই অনুবাদটি আরও পরিমার্জনার ভিতর দিয়ে যাবে। সে অর্থে একে খসড়াও বলতে পারেন। অনুবাদ সম্পর্কে আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের ফেসবুক পাতায় জানাতে পারেন।