ইন্টেনশনালিটিঃ হুসার্লের ফেনোমেনোলজির একটা মৌলিক ধারণা
জঁ-পল সার্ত্র
[আমাদের চিন্তাজগতে মানবতাবাদী জঁ-পল সার্ত্রেই পূজিত ও নিন্দিত, তাঁর মার্ক্সবাদে গতায়ত নিয়েও অল্পকিছু কথা হয়। কিন্তু তরুণ সার্ত্রে (যাকে অনেকেই অ্যান্টি-হিম্যানিস্ট বা মানবতাবাদ-বিরোধী হিসেবে পড়েন) অপাংক্তেয় ও অজানা থেকে গেছে। তাছাড়া তাঁকে পড়বার বেলায়ও পদ্ধতিগত গলদ রয়ে গেছে। সার্ত্রের রচনা বাংলাদেশেও কিছু কিছু অনূদিত হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মৃণালকান্তি ভদ্র বলতে গেলে একাই সার্ত্রের প্রায় সমস্ত রচনার বাংলা অনুবাদ করেছেন। ভদ্রের A Critical Survey of Phenomenology and Existentialism শীর্ষক ডক্টরাল থিসিসও অস্তিবাদ নিয়ে, যার মুখবন্ধ লিখে দিয়েছেন সার্ত্রের কমরেড সিমোন দ্যা বেভোয়ার। অন্য অস্তিবাদী দার্শনিক আলবেয়ার কাম্যু'র রচনারও বঙ্গানুবাদ করেছেন তিনি। সার্ত্রের প্রথম উপন্যাস "বিবমিষা" (লা নোজে, ১৯৩৮) প্রকাশের মাত্র ২০ বছর পরেই অর্থাৎ ১৯৫৮ সনে ফরাসি থেকে ভদ্রের অনুবাদে বাংলা ভাষায় বের হয়। কিন্তু শুরুর দিককার ছোট-ছোট অথচ সার্ত্রের দার্শনিক প্রকল্পকে অনুধাবনে অত্যন্ত দরকারী রচনাগুলো সম্পর্কে তিনি বেখবর। আত্মজীবনী সমেত সার্ত্রের প্রায় সমস্ত রচনাই অনুবাদ করলেও সম্ভবত তাঁর রাডারের বাইরে থেকে যায় মাত্র তিরিশ পাতার The transcendence of the Ego (১৯৩৭) ও দুই পাতার Intentionality: A fundamental idea of Husserl's Phenomenology (১৯৩৯)। অথচ এই দুটি লেখা ভালো করে পড়া থাকলে সহজেই ধরা যাবে সার্ত্রে কি করতে যাচ্ছেন। ব্যাপারটা দুঃখজনক হলে সত্য যে, কন্টিনেন্টাল ফিলোসফি ও সার্ত্রের দার্শনিক ভাবনা নিয়ে একটা সুসংহত বোঝাপড়া ভদ্রের থেকে আমরা পাইনা। মার্টিন হাইডেগারকে নিয়ে তাঁর লেখা আমাদের ধন্ধে ফেলে দেয় তাঁর বোঝাপড়া নিয়ে। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দর্শন বিভাগ অ্যানালাইটিক বা বিশ্লেষণী দর্শন কেন্দ্রিক হওয়ায়, কন্টিনেন্টাল ফিলোসফির প্রাতিষ্ঠানিক ও পদ্ধতিমাফিক চর্চার সুযোগ কম। ফলে কন্টিনেন্টাল ফিলোসফির বোঝাপড়া করতে গিয়ে আমাদের বেশ ভুগতে হচ্ছে। ১৯৩৯ সনে প্রকাশিত সার্ত্রের দুই পাতার প্রবন্ধটি তাঁর দার্শনিক প্রকল্প বুঝতে বেশ সহায়ক। হুসার্লের দার্শনিক প্রকল্প সম্পর্কে বোঝাপড়া না থাকলে এটির অর্থ ও তাৎপর্য বোধগম্য হওয়া কঠিন, নিখাদ সাহিত্য মনে হতে পারে। সার্ত্রের এই ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ দুই পাতার প্রবন্ধটির (ইংরেজি থেকে) বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করছে বোধিচিত্ত।]
“সে তাকে তার চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলেছিল”। এই অভিব্যক্তি সহ অন্যান্য অনেক চিহ্ন (sign) বাস্তববাদ ও ভাববাদ উভয়ের মধ্যেই উপস্থিত অধ্যাসের (Illusion, বিভ্রম) দিকে ইঙ্গিত করে, অর্থাৎ জানা মানে হচ্ছে খাওয়া। শতবর্ষের বিদ্যায়তনিক চর্চা শেষেও ফরাসী দর্শন এইখানেই রয়ে গেছে। আমরা সবাই ব্রুনশ্ভিক, লেনান্দ, এবং মেয়ার্সনের লেখাপত্র পড়েছি।২ আমরা সক্কলে বিশ্বাস করেছি যে মাকড়সা-মন বিষয়াদিকে (things) তার জালে আবদ্ধ করে রেখেছে, সাদা থুতু দিয়ে তাদের ঢেকে রেখেছে এবং ধীরে ধীরে তাদের গিলে খেয়ে নামিয়ে নিয়ে এসেছে নিজের সারবস্তুতে। একটা টেবিল, একটা পাথর, একটা ঘর আসলে কী? উত্তরঃ “চেতনার উপাদানের” একটা নির্দিষ্ট সম্মিলন; এমনতর উপাদানের একটা শ্রেণী। আহা, হজ্মি দর্শন (digestive philosophy)! অথচ এর থেকে অন্য কিছুকেই বেশি অবধারিত মনে হয়নিঃ টেবিলটাই কি আমার সংবেদনের মূল উপাদান নয়? আমার চেতনার বর্তমান দশাই কি আমার সংবেদন নয়? নিউট্রিশন, একীভূতকরণ! লেনান্দ বলছেন, ভাবনার সাথে বস্তুর একত্রীকরণ, ধারণার দ্বারা ধারণার আর মনের দ্বারা মনের একীভূতকরণ। এই নিষ্ঠাবান গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ অর্থাৎ একত্রীকরণ, একীভূতকরণ আর অভিন্নকরণের মাধ্যমে দুনিয়ার শরীরী কঙ্কালগুলিকে পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে। আমাদের মধ্যে নাদান যারা তাঁরা নিস্ফলভাবে এমন কিছু খুঁজেছেন যাকে ধরা যায় ছোঁয়া যায়, যা কেবলই চেতনাগত নয়। বরং এমন নরম বাষ্পকণা যার সাথে তাদের মোলাকাত হবে সবজায়গায়। এটা অন্য কিছু নয়, খোদ তারাই।
এম্পিরিকো-ক্রিটিসিজম, নব্য-কান্টবাদের হজ্মি দর্শনের বিরুদ্ধে এবং সকল সর্বমনোবৈজ্ঞানিকতাবাদের (psychologism) বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে [এডমুন্ড] হুসার্ল নিরন্তরভাবে বলে গেছেন যে সকল কিছুকে চেতনায় পর্যবসিত করা সম্ভব না। আপনি এই গাছটাকে দেখেন, নিশ্চিত হওয়ার জন্যে। কিন্তু আপনি এই গাছটা যেখানে আছে সেখানেই এটাকে দেখেন অর্থাৎ রাস্তার ধারে, ধূলার মধ্যে, একা এবং রোদে নড়তে থাকা অবস্থায়, ভূমধ্যসাগরের তীর হতে আট মাইল দূরে। এটা কোনভাবেই আপনার চেতনায় ঢুকে পড়তে পারবে না, কারণ আপনার চেতনার আর এই গাছের প্রকৃতি একরকমের নয়। আপনার [হেনরি] বার্গসোঁর কথা মনে পড়তে পারে। মনে পড়ে যেতে পারে ম্যাটার অ্যান্ড মেমোরি গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ের কথা।৩ কিন্তু হুসার্ল বাস্তববাদী কেউ ননঃ শুকিয়ে যাওয়া পৃথিবীর ‘পরে এই গাছ এমন কোন পরম নয় যা পরবর্তীতে আমার সাথে যোগাযোগে লিপ্ত হবে। চেতনা আর জগৎ একই সাথে প্রদত্তঃ সারগতভাবেই চেতনার বাহিরে, তথাপি জগৎ সারগতভাবে চেতনার সাথে সাপেক্ষিক। হুসার্ল চেতনাকে দেখেন অপর্যবসেয় একটা ফ্যাক্ট হিসেবে যাকে কোন ভৌত সুরতের মারফত বর্ণনা করা যাবেনা। পাওয়া যেতে পারে হয়ত কেবল একটা বিষ্ফোরণের তড়িৎ এবং দুর্বোধ্য প্রতিচ্ছবি রূপে। জানার মানে হচ্ছে “কোন কিছুর দিকে বিষ্ফোরিত হওয়া”, স্যাতস্যাতে গ্যাস্ট্রিক-অন্তঃরঙ্গতা থেকে নিজেকে ছিড়ে-ফুড়ে বের করে নিয়ে আসা, নিজের বাইরে গিয়ে উজান বাওয়া, বাহিরে গাছের নিকট গমন করা অথচ তাকেও মাড়িয়ে যাওয়া। কারণ এই গাছ আমার থেকে পালিয়ে যায় এবং আমাকে বাঁধা দেয়, এবং এই গাছ যতখানি নিজে আমার মধ্যে বিলীন হয় তার থেকে বেশি আমি আর কোনভাবেই গাছের মধ্যে বিলীন হতে পারিনা। আমি তার করায়ত্তের বাইরে, সে আমার করায়ত্তের বাইরে।
আপনি কি এই বর্ণনার মধ্যে নিজের পরিস্থিতি এবং [আপনার ওপরে যে] ছাপ [পড়েছে তা] খুঁজে পান? নিশ্চিতভাবেই, আপনি জানতেন যে ঐ গাছ আপনি নন। আপনি জানতেন যে আপনার অন্ধকার পাকস্থলীতে আপনি এটাকে ঢুকাতে পারবেন না। জানতেন যে, চাতুরীর আশ্রয় না নিলে জ্ঞানকে কখনোই অধিকৃত বস্তুর সহিত তুলনা করা চলে না। আচমকা চেতনার বিশুদ্ধিকরণ ঘটে যায়। চেতনা ঝড়ো হাওয়ার মতই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। নিজের থেকে নিজের পলায়ন বাদে, নিজকে ছাড়িয়ে যেতে থাকা বাদে অতিরিক্ত আর কিছুই এর মধ্যে নেই। এটা অসম্ভব হতে পারে, তবুও আপনি যদি চেতনার “গভীরে বা ভেতরে” প্রবেশ করতে পারতেন, আপনি ঘূর্ণিপাকের মধ্যে পড়তেন এবং আপনাকে ছুড়ে বাইরে ফেলে দেয়া হত। আপনাকে ফেলে দেয়া হত ধুলার মাঝে গাছের কাছে। কারণ, চেতনার কোন “ভেতর” নাই। ঠিক এই নিজেকে অতিক্রম করে থাকা, এই পরম উড়াল, এই বস্তুতে পরিণত হইতে না চাওয়াই চেতনাকে চেতনা করে।
এক মুহুর্তের জন্য এক সূতায় গাঁথা ধারাবাহিক বিষ্ফোরণের কথা ভাবুন যা আমাদের নিজেদের ছিড়ে-ফুড়ে বাইরে বের করে দেয়। এমন বিষ্ফোরণ যা এমনকি আমাদের নিজেদের গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ পর্যন্ত দেয়না। বরং আমাদের ঠেলে ফেলে দেয় বাইরে দুনিয়ার শুষ্ক ধুলার মাঝে, বস্তুর মাঝে, পৃথিবীতে। খোদ নিজের প্রকৃতির দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে একটা নির্বিকার, প্রতিকূল এবং অশান্ত দুনিয়ায় নিজেকে কল্পনা করুন। তবেই আপনি হুসার্লের সেই বিখ্যাত আবিষ্কার, সেই উক্তির গভীর দ্যোতনা উপলব্ধি করতে পারবেনঃ “সকল চেতনাই হচ্ছে কোন কিছুর সম্বন্ধে চেতনা”। ইম্যানেন্সের (Immanence) সেই জীর্ণ দর্শন (যেখানে সকল কিছু ঘটে আপসের মাধ্যমে, ঘটে প্রোটোপ্লাজমিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে, নিস্তেজ কোষীয় রষায়নের মাধ্যমে) থেকে আমাদের আর নিজেদের মুক্ত করতে হবেনা। ট্রান্সেন্ডেন্স (Transcendence) বা লোকোত্তরের দর্শন আমাদের ছুড়ে ফেলে মহাসড়কে, বিপদের মুখে, চোখ ঝলসানো আলোর নিচে।
consciousness is always a consciousness of something