স্যার আলেক্সান্ডার কানিংহাম (১৮১৪-১৮৯৩): ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের প্রথম পর্যায়

আবু ইমাম


[ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক আবু ইমামের 'Sir Alexander Cunningham (1814-1893): The First Phase of Indian Archaeology' শীর্ষক প্রবন্ধটি ১৯৬৩ সনে দ্যা জার্নাল অব দ্যা রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব গ্রেট ব্রিটেন অ্যাণ্ড আয়ারল্যান্ড-এর অক্টোবর (৩য়-৪র্থ) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। আবু ইমাম, প্রত্নতত্ত্বকে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে স্বতন্ত্র ডিসিপ্লিন বা বিভাগ হিসেবে চালু করতে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বরেন্দ্র মিউজিয়ামের কিউরেটর এবং ইতিহাস সমিতির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। শিক্ষকতা করছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে। আবু ইমামের এই প্রবন্ধটি তর্জমা করেছেন কাব্য কৃত্তিকা। কাব্য কৃত্তিকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী।]



গত একশ’ বছর বা এরকমই সময় ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে প্রত্নতত্ত্বের বিকশিত হওয়ার একটি সংযুক্ত গল্পে নিবেদনের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু প্রশংসাযোগ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভারতে এটির বিকশিত হবার ক্ষেত্রে কাছাকাছি বা তুলনাযোগ্য কোন বিবরণ পাওয়া যায় না। ডেনমার্ক, এজিয়ন (Aegean), মিশর এবং ক্র্যানবোর্ন চেস-এ প্রত্নতত্ত্ব বিকশিত হয়েছিল এমনভাবে যেন অনেকগুলো পরীক্ষাগারে এই নতুন শাস্ত্রের কর্মপদ্ধতি ও কৌশল নিখুঁতভাবে তৈরি হচ্ছিল। স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, কেন এই পদ্ধতিগুলো ভারতে উৎপাদিত হলো না যেখানে কিনা আক্ষরিক অর্থেই শত শত প্রত্নস্থান প্রত্নতাত্ত্বিকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক দৃশ্যপটে কি পরিস্থিতি প্রভাববিস্তার করেছিল যে বিকশিত চিন্তা বা ধারণা (concept) এবং কৌশলের পরিচয় করানোর ক্ষেত্রে এরকম দৃশ্যমান দেরী হলো? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে আমাদের অবশ্যই সেই পর্যায়কে পরীক্ষা করতে হবে যখন ভারতের প্রত্নতত্ত্ব কানিংহাম ও বারজেস (Burgess)-এর নিয়ন্ত্রণে ছিল কিংবা তাঁদের মত অধিপতি ছিল।


১৮৩৩ সালে, মাত্র উনিশ বছর বয়সে সেনা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কোম্পানির কাজে আলেক্সান্ডার কানিংহাম ভারতে এসেছিলেন। তাঁর চাকরি জীবন পরিষ্কারভাবে দুইটি ভিন্ন অংশে বিভক্তঃ প্রথম, ১৮৬০ সাল পর্যন্ত তাঁর সেনাবাহিনীর জীবন এবং দ্বিতীয়— যেটার কারণে তিনি বর্তমানে অধিক পরিচিত— ১৮৮৫ সাল পর্যন্ত ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সার্ভের [জরিপ] (Indian Archaeological Survey) পরিচালক থাকার পর্যায় (একটি ছোট্ট বিরতি সহ [যখন প্রথম সার্ভে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়] ১৮৬৬-১৮৭০ পর্যন্ত)।


কিভাবে এই সেনা প্রকৌশলী এই উপমহাদেশের প্রত্নতত্ত্বে জড়িয়ে পড়লো? উত্তরের জন্য আমাদের ঐ সময়ের বৃটিশ কলকাতার বুদ্ধিবৃত্তিক পরিস্থিতির দিকে তাকাতে হবে। ঐ সময়ে কোম্পানির অফিসারদের মধ্যে একজন জেমস প্রিন্সেপ, যে অসাধারণ মেধা, অবাধ সক্ষমতা এবং অসীম উদ্দীপনা নিয়ে সক্রিয় ছিল এবং কলকাতা টাকশালের দায়িত্বে ছিল। এটা এমন হয়েছিল যে কোম্পানির কারেন্সি [মুদ্রা] ব্যবস্থা বদলের ক্ষেত্রে পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ করার প্রয়োজন হয়েছিল। এই ঘটনা, ভারতের অতীতের-মুদ্রা-ব্যবস্থা নিয়ে তাঁকে আগ্রহী করে তোলে। উপরন্তু তিনি এইচ. এইচ. উইলসনের (সংস্কৃত বিদ্যার একজন অভিজ্ঞ ও সম্ভ্রান্ত জ্ঞানী এবং টাকশালের প্রাক্তন প্রধান) অধীনে শিক্ষানবিশ হয়ে যান ।


পাশাপাশি ঐ সময়ে ভাগ্যের আরেকটি স্পর্শে, ভেনচুয়া (Ventura, রণজিৎ সিংয়ের ফরাসি জেনারেল) মিশরীয় পিরামিড-ডাকাতদের সাফল্যের কাহিনী দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়ে পাঞ্জাব ও পর্বতের সীমানাঘেষাঁ ভূমিতে খনন করতে মনস্থির করেন। এই অঞ্চলটির অভ্যন্তরে অজানা উৎসের সংখ্যাতীত টাওয়ারগুলো (Towers) রহস্যজনকভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। এগুলো স্থানীয় জনগণের ভাষায় “topes” হিসেবে পরিচিত। শুধুমাত্র এগুলোকে ঘিরে রাখা ভূমিরূপকে বাদ দিলে, স্থানীয় অধিবাসীরা বহুকাল ধরেই এই “topes”-গুলোতে মনোযোগ দেয়া বাদ দিয়ে দিয়েছিল এবং পরোক্ষ নিরুদ্বিগ্নতা অর্থাৎ অগ্রাহ্য করা শিখে গিয়েছিল। কিন্তু বিদেশীদের অত্যাশ্চর্য হওয়া ও উদ্দীপ্ত হওয়া দেখে তারা উদ্বেলিত হয়ে যায়। ভেনচুরা, রণজিৎ সিংয়ের সাথে সুসম্পর্ককে ব্যবহার করে খননের আদেশ লাভ করে।


তাঁর এই প্রাপ্তি আলোড়ন তৈরি করে এবং অন্যরা এই উদাহরণ অনুসরণ করে। আগ্রহ আরও ব্যাপ্তি লাভ করে যখন প্রচুর সংখ্যক ব্যাকট্রিয়ান, রোমান এবং ইন্দো-স্কিদিক মুদ্রা প্রাপ্তি শুরু হয়। অ্যান্টিকুয়েরিয়ান চিন্তায় বুঁদ হয়ে থাকা সকলেই এই নতুন বিকাশে ডুবে যায় এবং এটি প্রিন্সেপ (Prinsep)-এর হাতে সূচনা হওয়া জার্নাল অব দ্যা এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের (Journal of the Asiatic Society of Bengal) সকল বুদ্ধিবৃত্তিক সক্রিয়তার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে যায়।


এভাবেই, প্রিন্সেপ ভারতীয় ইতিহাসের অজানা অঞ্চলকে জানার এই নতুন কারবারের ক্রীড়নকে পরিণত হন। প্রিন্সেপের মুদ্রা ও শিলালিপি পাঠানোর আহবানে ভারতের চারদিক থেকে অভূতপূর্ব সাড়া আসে এবং খুব দ্রুতই তিনি মুদ্রার স্রোতে ডুবে যান— বিশেষত ম্যাসন, হনিগবার্গার, জেরার্ড, কেরামত আলি এবং মোহন লালের পাঠানো পাঞ্জাব এবং আফগানিস্থান থেকে প্রাপ্ত মুদ্রা দিয়ে। ভেনচুরার সংগ্রহ কলকাতায় পাঠানো হয় এবং তিনি নিজেও সেখানে চলে যান। আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে— ক্যাপ্টেন কট্‌ল (Captain Cautley)-এর আকস্মিকভাবে আবিষ্কৃত বেহাতের (Behat) কাছাকাছি একটি প্রচীন শহরের অবশেষ (যা যমুনা খাল খননের সময়) পাওয়া যায়। কানিংহাম এই স্বতঃস্ফূর্ত কর্মকাণ্ডের মাঝামাঝি সময়ে এখানে এসে পৌঁছান। এটা কোন আশ্চর্য বিষয় নয় যে, তিনি মূহুর্তেই এই ঘূর্ণনের মধ্যে ধরা পড়েন এবং খুব কম সময়ের মধ্যেই প্রিন্সেপের সবচেয়ে কাছের সহযোগী হয়ে যান। তাঁর চোখের সামনে ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপির পাঠীদ্ধার করা হয়। পিয়াদাসী (piyadasi)’র শিলালিপি পঠিত হয়। টার্নার (Turnour) আবিষ্কার করেন যে, এই পিয়াদাসী আর কেউ নয় বরং বুদ্ধিস্ট ঐতিহ্যের উদযাপিত অশোক।


ভেনচুরার দেখাদেখি, কানিংহাম নিজেই সারনাথের বৃহৎ ধামেক (Dhamek) স্তূপ উন্মুক্ত করেন। এতে অনেক খরচ এবং বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। ১৮৪২ সালে তিনি সানকিস্‌সা’র (Sankissa) প্রত্নস্থান আবিষ্কার করেন। ১৮৩৯, ১৮৪৬ এবং ১৮৪৭ সালের কাশ্মির ও লাদাখের জরিপের সময় তিনি তাঁর প্রাত্যহিক দায়িত্বের বাইরে গিয়ে...অ্যান্টিকুইরিয়ান খোঁজে লিপ্ত হন।


একই সময়ে, ১৯শ শতকের ত্রিশের দশকের দিকে একই ঐতিহাসিক সময়ে বৌদ্ধবাদ (Buddhism) আবিষ্কৃত হয় হগসন, টার্নার, সোমা (Csoma), রেমুসাট, বুর্নফ এবং ল্যাসেল-এর যৌথ গবেষণার মাধ্যমে। এটা ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব ও হিস্ট্রিওগ্রাফি বা ইতিহাস-রচনার ভবিষ্যৎ ধারার ভয়াবহ ফলাফল এবং একইসাথে ভারতীয় ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্রে কানিংহামের সম্পূর্ণ মনোভাবের উপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।


পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি বৌদ্ধবাদ এবং ভারতে এর প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস নিয়ে গভীরভাবে জানতে শুরু করেন। এই সময় থেকে ভারতের প্রত্নতত্ত্বে বৌদ্ধবাদের আধিপত্য বিস্তার করা শুরু হয়, যা পরবর্তী শতাব্দীতে এর পরিচয় নির্ধারণ করে দেয়। সারনাথে তাঁর কার্যক্রম, হিউয়েন সাঙয়ের ভাষ্যের পক্ষে তাঁর প্রবন্ধ এবং চূড়ান্তভাবে ১৮৪২ সালের সানকিস্‌সার জরিপ, ১৮৫১ সালের সাঁচী খনন তাঁর বৌদ্ধবাদ-কেন্দ্রিক প্রত্নতত্ত্বের দিকে ধাবিত হবার ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে গণ্য করা হয়। কানিংহামকে তাঁর পূর্বসিদ্ধ চিন্তার কারণে ভুলভাবে সমালোচনা করা হয় যা সম্ভবত ঐ সময়ের পারিপাশ্বিক পরিস্থিতিতে অবশ্যম্ভাবী ছিল। কার্যত, ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের গবেষণার ক্ষেত্রে বৌদ্ধবাদ-ই তাঁকে চমকপ্রদভাবে সবচেয়ে উত্তম [প্রেরণা বা] কারণটি দিয়েছিল।

যখন সানকিস্‌সার প্রত্নস্থান আবিষ্কার করেন, তিনি সেই খবরটি লন্ডনে থাকা কর্ণেল স্কাইসকে প্রদান করেন এই বার্তা সহ যে, একটি ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ করা “রাজনৈতিকভাবে ভারতীয় সরকার এবং ধর্মীয়ভাবে বৃটিশ জনগণের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ হবে।“ প্রথমত, এটা দেখাবে যে ভারত সাধারণত অগণিত রাজ্যে (cheifships) বিভক্ত ছিল যা প্রতিটি সাফল্যমণ্ডিত আক্রমণের ক্ষেত্রে অপরিবর্তনশীলভাবে ভূমিকা রেখেছে। যখনই এটি একক রাজার অধীনে ছিল তখনই সবসময় এটি বিদেশী শক্তিকে দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করেছে। অন্যদিকে, এটা দেখাবে যে ব্রাহ্মণ্যবাদ অপরিবর্তনশীল ও অপরিবর্তনীয় ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘকাল ধরে টিকে ছিল যা তুলনামূলকভাবে আধুনিক উৎস থেকে আগত এবং ক্রমাগত সংযুক্তি ও বিযুক্তি গ্রহণ করেছে। এটি প্রমাণ করে যে, খ্রিস্টধর্মের গোড়াপত্তন ভারতে অবশ্যই সাফল্যমণ্ডিত হবে।


বৌদ্ধবাদ এবং এর প্রত্নতত্ত্ব এখানে গবেষণা করা হয়েছে মূলত খ্রিস্টধর্মকে প্রচার করার উদ্দেশ্য। সর্বোপরি ব্রাহ্মণ্যবাদ—এতো বেশি অপরিবর্তনশীল ছিলনা। যাইহোক, বৌদ্ধবাদের একটি নিয়মতান্ত্রিক গবেষণার লক্ষ্যে, সরকারী খরচে একটি সার্ভে প্রয়োজন ছিল।


স্কাইসকে চিঠি লেখার সময়ে তাঁর মাথায় একটা সার্ভে তৈরি করার চিন্তা খেলা করছিল। সানকিস্‌সা’র আবিষ্কার তাঁকে বিস্ময়ের মধ্যে ফেলে দিল। স্কাইসকে ঐ একই চিঠিতে তিনি লিখেনঃ “বর্ষাকালেও হেঁটে হেঁটে দায়িত্ব পালন করে এবং নূন্যতম বিরতি না নিয়ে এই অল্প কিছু বিষয় (points) যা আমার পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে, তা আপনাকে এটা দেখাবে যে যদি কেউ সময় নিয়ে এই কাজটা করার সুযোগ পেত, সকল স্থান (যা আগ্রহোদ্দীপক বিষয়বস্তুর ইঙ্গিত করে) হেঁটে হেঁটে দেখার সুযোগ পেত তাহলে কি হতে পারত... এগুলো উন্মুক্ত করা এবং ভারতের সকল বুদ্ধিস্টিক্যাল অবশেষ শনাক্ত করার কাজ বৃহত্তর আগ্রহের এবং গুরুত্বপূর্ণ। কি পরিমাণ আনন্দ এবং উৎসাহ নিয়েই কেউ ফা হিয়েনের মথুরার যাত্রাপথ, তাঁর প্রথম ভারতীয় স্টেশন, সিলনের দিকে তাঁর যাত্রা করার রাস্তা শনাক্ত করবে।“ ১৮৪৮ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের নিজ আবাসে এই বিষয়গুলো আরেকটি পত্রের মাধ্যমে প্রবেশ করে। ভারতের ইতিহাসকে চিত্রায়িত করার জন্য বেদ এবং পুরাণ ছাপানো যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বৌদ্ধবাদের টিকে থাকা অবশেষও—তাদের স্থাপত্য, ভাষ্কর্য, মুদ্রা এবং লিপিসমূহের প্রকাশনা— ততটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটা সরকারের সেইরকম একটি দায়িত্ব ছিল, যা করার জন্য তারা এই দেশের প্রতি দায়বদ্ধ ছিল। উপরন্তু, স্থাপত্য ও ভাষ্কর্যের অবশেষসমূহ প্রতিনিয়ত ক্ষয়িষ্ণু হচ্ছিল এবং লিপিসমূহ ভাঙা ও বিকৃত হয়ে পড়ছিল। “ভারতে বৌদ্ধবাদ অনেক শতক ধরে বিকশিত হয়েছিল এই সত্যটি কেবল মনুমেন্ট বা স্মৃতিস্তম্ভ থেকেও মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়। মাহমুদ গজনবীর অধীনে মুসলমানদের আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত মনুমেন্ট, মুদ্রা এবং লিপিসমূহ সবই বুদ্ধীয় উত্থানকে নির্দেশ করে।... মনুর প্রতিষ্ঠানসমূহ, রামায়ণ, মহাভারত এবং চমৎকার পুরাণগুলো বৌদ্ধবাদ বিষয়ে একেবারেই নিশ্চুপ ছিল যেন এই ধর্মটি ভারতে কখনোই বিকাশ লাভ করেনি...।” তিনি আরও নির্দেশ করেন কিভাবে “ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের একজন অনুসন্ধানকারীর চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এবং ফা হিয়েনের পদাঙ্ক অনুসরণ করা উচিৎ।“


এটাই ছিল সেই চিন্তার ভূল যেটাকে তিনি পরবর্তীতে দেখতে পাবেন, পরিণত অবস্থায় দেখতে পাবেন। [ফ্রান্সিস] বুকাননের (যাকে এক অর্থে প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপকারীও বলা যায়) জরিপ, সাম্প্রতিক সময়ে সুবিস্তৃতভাবে পরিচিত হয়েছে মার্টিন-এর করা ডাইজেস্ট-এর মধ্য দিয়ে। ম্যাকেঞ্জি এবং টডের দাপ্তরিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে দীর্ঘ সময় ধরে এন্টিক্যুইটি সংগ্রহ দীর্ঘদিন যাবত পরিচিত ছিল। এটা সেই সময় যখন স্কটিশ নীল-চাষী ফার্গুসন (১৮৩৫-৪২) মাত্রই তাঁর প্রত্নতাত্ত্বিক ভ্রমণ সম্পন্ন করেন—ভারতে পরিচালিত প্রথম ভ্রমণ যা শুধুমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিল এবং তাঁদের এই উপলব্ধিসমূহ কানিংহাম বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। উনিশ শতকের শুরুর দিকে করা ত্রিকোণমিতিক ও ট্রপোগ্রাফিক জরিপগুলোও উদ্দীপ্ত হবার একটি উৎস ছিল। সোমা করোসি’র তিব্বতের অভিযান এবং হনিগবার্গার, কোর্ট, ভেনচুরা এবং ম্যাসনের ত্রিশের দশকের শুরুর দিকের উদাহরণসমূহ স্মৃতিতে তখনো সতেজ ছিল এবং বৌদ্ধবাদের প্রত্নতাত্ত্বিক যারা হতে চায় তাঁদেরকে উদ্দীপ্ত করেছিল। আমরা পূর্বেও যেটা দেখেছি, কানিংহামের নিজেরই শ্রমসাধ্য ভৌগোলিক জরিপ করার অভিজ্ঞতা ছিল যার সাথে সে মাঠ-প্রত্নতত্ত্বকে একত্রিত করেছিলেন। কিন্তু কানিংহামের ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ গতিপথ ঠিক করে দেয় দশকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা—ফা হিয়েনের ভারত ভ্রমণ বিবরণীর অনুবাদ।


ইন্দোলজির দুনিয়ায় এটির প্রকাশনার ফলাফল বর্তমান সময়ে অনুধাবন করা মুশকিল, যখন ভারতীয় ইতিহাসের মূল সাবস্ট্যান্স (substance) হয়ে পড়েছে কমনপ্লেস। প্রথমবারের মত, অনুবাদটির প্রকাশনার মাধ্যমে ভারতীয় ইতিহাস এমন এক ধরনের বাস্তবতার দিকে গেলো যা এই সময়ের পূর্ব পর্যন্ত অপূর্ণ ছিল। একইসাথে প্রথমবারের মতো ফা হিয়েনের ভাষান্তর—যতটাই খুঁত-সম্পন্ন এটা হোক না কেন—ভারতের হারিয়ে যাওয়া শহরগুলোর চিহ্নগুলো শনাক্ত করার বা খুঁজে বের করার কিছু তাগিদের যোগান দিয়েছিল, যদি শুধুমাত্র কারো পর্যাপ্ত অবসর থাকে ভাষান্তরটি হাতে নিয়ে এর খোঁজে বের হবার। এটা ভারতের জন্য সেই ধরনের দিকনির্দেশনা দিয়েছিল যেমনটা pansanians ধ্রুপদী পৃথিবীর ক্ষেত্রে দিয়েছিল এবং কানিংহাম ও অন্যান্যেরা খুব দ্রুতই এটি অনুধাবন করে। ফা হিয়েনের অনুবাদকরা তাঁদের টেক্সটে ভৌগোলিক নোটসমূহ যুক্ত করেছিল, যদিও স্বীকার করা যায় যে এটি খুব বেশি কার্যকরীভাবে নয়। কিন্তু JRAS-এ উইলসনের একটি আলোচনার পরেই এটি প্রমাণিত হয়।এই গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধে উইলসন প্রায় সমস্ত প্রত্নস্থানকে নিখুঁতভাবে নিরূপণ করেছিল। ১৮৫৭ এবং ১৮৫৮ সালে স্ট্যানিসলাস জুলিয়ানের করা হিউয়ান সাঙের অনুবাদটি ফা হিয়েনের অনুবাদের ধারায়ই হয়েছিল যেটি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং একইভাবে সুদূরবিস্তারী প্রভাব রেখেছিল এবং উপরন্তু এটি ভারতের ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বের আরও সুপিরিয়র (বৃহৎ) নির্দেশনা হিসেবে কাজ করেছে। এই অনুবাদের মূল্য আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ভি. সেইন্ট মার্টিনের উচ্চমানের ভৌগোলিক আলোচনার সংযুক্তির মাধ্যমে।


এই বইটি সঠিক সময়েই আসে। একটি সার্ভে প্রতিষ্ঠিত করার এর চেয়ে ভালো আর কি সময় হতে পারত? ভারতীয় ইতিহাসের সামগ্রিক রূপ (outline) পূর্বের থেকে আরও স্পষ্টতর হচ্ছিলো— কানিংহামের ভিলসা টোপ (Bhilsa Topes)-এ এটির নকশা/খসড়া তৈরি করার নিজস্ব চেষ্টায় সফল হওয়াই এর বড় প্রমাণ, ল্যাসেন-এর আরও বড় পরিসরের কাজের কথা না বললেও। বৌদ্ধবাদ সম্পর্কিত বেশি নির্ভরশীল উপাদানগুলো তখন স্কলারদের আয়ত্তের মধ্যে ছিল। ভারতের শিল্পকলার (art) ইতিহাসের কিছু বিষয় ঐ একই সময়ে জানা যায়। খরোষ্ঠী এবং ব্রাহ্মী উভয়ই পঠিত হয়। রাজনৈতিকভাবে ভারত বৃটিশ শাসনের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণের অধীনে একত্রিত ছিল। প্রান্তীয় অঞ্চল যেখানে এতদিনে প্রবেশাধিকার সহজ ছিল না তা সহজগম্য হয়েছিল তখন। বিদ্রোহের সময়কার হলোকাস্টের পরে The Pax Britannica আরও প্রতিপত্তির সাথে সাম্রাজ্য বিজয় করেছিল। কানিংহাম তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের পরে নিজেই অবসরের দিকে যাচ্ছিলেন। তিনি তখন তাঁর পুরো সময়ের মাস্টার হয়ে যেতে পারতেন যা তিনি তাঁর পছন্দের গবেষণার খোঁজে নিয়োগ করতে সক্ষম হতেন। ভাইসরয় নিজেও পরিচিত ছিলেন এই ধরনের বিষয়ে (আলোকিত?) আগ্রহের জন্য। তিনি মাত্রই (১৮৫৬) জিওলজিক্যাল সার্ভে [ভূতাত্ত্বিক জরিপ]-কে সঠিক স্থানে স্থাপন করেছিলেন।


১৮৬১ সালের নভেম্বরে কানিংহাম লর্ড ক্যানিংয়ের উদ্দেশ্যে একটি মেমোরান্ডাম লেখেন যেখানে তিনি ভারতের এন্টিক্যুইটির প্রতি সরকারের অনুভূতিহীনতার অভিযোগ করেন। এটা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না যে, সরকার তখন পর্যন্ত বৃটিশরাজের বিস্তার ও সুসংহতকরণের দিকে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু প্রাচীন ভারতের যত প্রকার স্থাপত্য বিদ্যমান বৃটিশ রাজ এর মর্যাদা রক্ষায় সমপরিমান গুরুত্ব দিয়ে এদের নিয়মতান্ত্রিক নিরীক্ষণ করার সময় চলে এসেছিল। এই কাজ সমাপ্ত হলে ভারতের উপরের দিককার অংশের যত প্রত্নতাত্ত্বিক অবশিষ্টাংশ পাওয়া যায় তার একটি বিস্তারিত এবং নিখুঁত ছবি পাওয়া যেত। বিদ্রোহ পরবর্তী সেই অবস্থায় সরকার মুহূর্তেই এই চিন্তাটি গ্রহণ করে এবং লর্ড ক্যানিং খুব দ্রুতই কানিংহামকে সার্ভের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার আদেশ জারি করেন, “ভারতের এই অঞ্চলে অন্য যেকোন কর্মকর্তার চেয়ে বেশি এই দেশের এন্টিক্যুইটিকে তাঁর গবেষণার বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন” সেই মানুষ হিসেবে।


জরিপসমূহ তাঁর সময়ে খুব বেদনাময় বিপর্যয়মূলক কর্ম ছিল। বেশিরভাগ ভ্রমণ ঘোড়ার পিঠে চড়ে করতে হতো। তবে তিনি হাতি, মোষের গাড়ি এবং উটও ব্যবহার করেছিলেন। এমনকি কখনো কখনো তিনি পায়ে হেঁটেও ভ্রমণ করেছিলেন এবং যত সময় অতিবাহিত হতে থাকে তিনি ট্রেনে বেশি বেশি ভ্রমণ করতে থাকেন। ইতিহাসবিদদের পরিশ্রম সহ্য করার নিছক সামর্থ্যের চেয়েও বেশি কিছু দরকার ছিল— কৌশল ও দক্ষতার আহবানও তারা দেয়। সেই সব কম আলোকিত সময়ে, লোকজন সবসময়ই প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে ওৎ পেতে থাকা নিয়ে সন্দেহগ্রস্থ থাকতো— গুপ্তধন পুনরুদ্ধার করা ছাড়া তার আর সম্ভাব্য কি-ই বা উদ্দেশ্য থাকতে পারে? শিলালিপিগুলো শুধু এ ধরনের গুপ্তধনের সূত্র দিচ্ছে! বিদ্রোহ পরবর্তী সেই দিনগুলোতে কানিংহামের নির্দিষ্টভাবে ধর্মীয় সংবেদনশীলতার বিষয়েও সতর্ক থাকতে হয়েছিল। প্রায়শই একজন অসহযোগী পুরোহিত, কোন শিলালিপির কপি বা ভাষ্কর্যের ড্রয়িং সংগ্রহ করার তাঁর সমস্ত উদ্যোগ ধুলিস্মাৎ করে দিত। উপরন্তু, অতৃপ্ত ভূত এবং ভয়ঙ্কর আত্মার আতঙ্ক তাঁর নিয়োগ দেওয়া শ্রমিকদের মস্তিষ্কে ভয়াবহভাবে চেপে বসেছিল—দে বতারা নিজেরা যে আক্রমণ করতে পারে সেই আতঙ্কের কথা না বললেই নয়। কার্যতই, প্রায়শই ভূতের উপদ্রবের কারণে তাঁর খনন বন্ধ বা বাঞ্চাল হয়েছিল। সেখানে আরও বাস্তবিক বিপদের আশঙ্কা ছিল, যেমন- বাঘ, ডাকাত এবং অসুখ।


যাইহোক, তাঁর অনুসন্ধানমূলক ভ্রমণগুলো প্রত্নস্থান থেকে প্রত্নস্থানে দ্রুত দেখে যাওয়া ব্যতীত কিছু ছিল না। এক সিজনে তাঁকে ত্রিশটির মতো প্রত্নস্থানও হয়তো দেখতে হয়েছে। এই স্বল্প সময়ের ভ্রমণে তিনি প্রত্নস্থানগুলোর প্রতি কদাচিৎ সদাচার করতে পারতেন। সাধারণত তিনি একটা প্রত্নস্থানে ৩-৬ দিনের মতোন অবস্থান করতেন, তবে ক্ষেত্রবিশেষ বড় কাজের জন্য তিনি হয়তো ২ সপ্তাহ অবস্থান করতেন। তাঁর জন্য খনন শেষ পর্যন্ত এক ধরনের পরীক্ষণ-নিরীক্ষণ হিসেবেই রয়ে যায়, যা কখনোই নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে এমন কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক কার্যক্রম ছিল না। তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল হিউয়েন সাঙের দেখা শহরগুলো এবং সেই শহরের দালানগুলো শনাক্ত করা। তাঁর মতে, ধ্বংসাবশেষ দেখে প্রাচীন শহরগুলোর শনাক্তকরণের দক্ষতা একজন প্রত্নতাত্ত্বিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়া। কদাচিৎ তাঁর অনুসন্ধানগুলো নিছক বস্তু খোঁজার অভিযানে পরিণত হতো। তিনি প্রত্নস্থান পরিদর্শন করতেন, চারপাশের জঙ্গল সাফ করতেন এবং বিশাল শ্রমিকদলকে মুদ্রা, শিলালিপি এবং ভাষ্কর্য খোঁজার জন্য নিয়োগ দিতেন। প্রায়ই “এমনকি একটি একক অক্ষর”-এর জন্য পুরস্কার ঘোষণা করতেন। তারপর তিনি হয়তো নিজেই গ্রামাঞ্চলে, বাগানে, ঝোঁপে এবং মানুষজনের বাসস্থান নিজের হাতে পরিষ্কার করতেন। এভাবেই তিনি বহু সংখ্যক শিলালিপি ও ভাষ্কর্য সংগ্রহ করেছেন, বিশেষত ভারহুত, কৌসাম্বী এবং মথুরা থেকে।


যাহোক,তাঁর প্রত্নতত্ত্ব সীমিত সুযোগের মধ্যেও হয়তো চর্চায় ছিল, তত্ত্বত তাঁর অন্তত অনেক বেশি বিশদ idea (চিন্তা?) ছিল— একটি আইডিয়া যা কার্যতই বর্তমানের যেকোন চিন্তার মতই সুসংহত। তিনি এটি তাঁর Memorandam of Instruction-এ ব্যক্ত করেন, যেটা তিনি ১৮৭১ সালে তাঁর সহকারীদের কাছে তুলে ধরেন এবং তাঁর প্রতিবেদনের তৃতীয় ভলিয়্যুমে প্রকাশ করেন।


তিনি এই ঘোষণা দিয়ে শুরু করেন যে, “প্রত্নতত্ত্ব ভাঙা ভাষ্কর্য, পুরনো দালান এবং ধ্বংসাবশেষের ঢিবির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরং পৃথিবীর ইতিহাসে যা কিছু রয়েছে সবই ধারণ করে।“ যদিও স্থাপত্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বস্তু “সকল প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের গবেষণা বৃদ্ধি করা উচিৎ যা তাদের পূর্ববর্তী সময়ের আচরণ ও প্রথাসমূহের ইলাস্ট্রেট (illustrate) করতে সাহায্য করবে”। স্থাপত্যে নির্দিষ্টভাবে সেই বৈশিষ্ট্যগুলো গবেষণা করা প্রয়োজন “যেগুলো ভারতের স্থাপত্যকলার ক্রমশ বিকাশ বা উন্নতির ধারাকে দেখাবে... সকল সুন্দর অলংকরণ বা অদ্ভূত নির্মাণশৈলীর উদাহরণসমূহ-ও নোট করতে হবে...”। প্রাগৈতিহাসের প্রয়োজনীয়তার কথা ভুলে যাওয়া হয়নিঃ “পাথরের সেল্টের (celts) সাথে জড়িত রয়েছে বৃহৎ মাটির ঢিবিসমূহ, পাথরের চক্রগুলো এবং পাথরের বাড়িগুলো (dolmens) যা ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে পাওয়া যায়। সবগুলোর অবস্থান এবং আকৃতি নথিবদ্ধ করা প্রয়োজন ভবিষ্যৎ গবেষণা এবং খননের জন্য। ছোট স্থাপনাগুলো হয়তো একবারেই উন্মুক্ত করা যেতে পারে যেহেতু কিছুদিনের বেশি এই কাজ আটকে থাকবে না; কিন্তু সকল বড় ঢিবিসমূহ অবশ্যই রেখে দিতে হবে সময় নিয়ে অনুসন্ধান করবার জন্য। মনোলিথ বা মেনহিয়া (menhirs, পশ্চিম ইউরোপের [মধ্য ব্রোঞ্জ যুগের] মানুষের-বানানো খাড়া পাথর) কদাচিৎ পাওয়া যাবে... কিন্তু মুদ্রা, লিপি, স্থাপত্য এবং ভাষ্কর্য এগুলোই প্রত্নতত্ত্ববিদের মনোযোগের যোগ্য একমাত্র বস্তু নয়। তিনি মনে করেন, “এটাও আশা করা যায় যে অনেক গ্রামীণ কিন্তু আগ্রহোদ্দীপক কৃষিজ সরঞ্জাম যা এখনো যমুনার দক্ষিণ দিকের সন্নিহিত জেলাগুলোয় দেখা যায় তার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ। তাদের নামগুলো নোট নেয়া উচিৎ এবং প্রত্যেকটির প্রায়োগিক দিক খসড়া স্কেচ বা নকশার মাধ্যমে দেখানো উচিৎ যেখানে প্রত্যেকটি অংশ কি ধরনের উপাদান দিয়ে নির্মিত তা দেখা যায়। চিনি এবং তেলের বিভিন্ন ধরনের মিলগুলোও নোট করতে হবে। ... স্থানীয় মালবাহী গাড়ির ধরন বা নির্মাণের কোন ধরনের ভিন্নতা থাকলে সেটাও সুবিধাজনকভাবে নথিবদ্ধ করতে হবে।... এগুলোর কিছু হয়তো পুরাতন স্থাপনাগুলোর খোদাইকৃত ভাষ্কর্যের দৃশ্যসমূহের দিকে আলোকপাত করবে, অন্যগুলো প্রাচীন লেখকদের সম্পর্কে চিত্রায়ন করতে সাহায্য করবে; অনেক অঞ্চলের জিনিসপত্রের সম্পর্কে জ্ঞান সংরক্ষণ করতে এই সবগুলোই গুরুত্বপূর্ণ হবে, যা বর্তমানে হারিয়ে যাচ্ছে এবং দ্রুতই অব্যবহৃত ও বিস্মৃত হয়ে যাবে।


এভাবেই তাঁর প্রত্নতত্ত্বের সংজ্ঞা প্রায় সম্পূর্ণটাই নৃবিজ্ঞান এবং সমাজতত্ত্বের গুণাগুণ-সম্পন্ন হয়ে ওঠে। তাঁর প্রাগৈতিহাসিক বস্তুসমূহ নিয়ে যে সচেতনতা তাও আগ্রহোদ্দীপক। অনেকেই সন্দেহ করেন যে তাঁর ১৮৬৬ এবং ১৮৭০ সালের মধ্যকার ইউরোপে অবস্থান প্রত্নতত্ত্বের চিন্তা তৈরী হবার পাটাতন হিসেবে কাজ করে। নির্দিষ্টভাবে যখন আমরা মনে করতে পারি যে এটাই সেই সময় ছিল যখন লায়েল, লুব্ধক এবং টাইলরের বইগুলোর মাধ্যমে প্রাগৈতিহাস বিস্তৃতভাবে পরিচিতি পাচ্ছিল। একইসাথে ঐ সময়ে নৃবিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্বের ফিল্ডেও দ্রুততার সাথে গুরুত্ববহ গবেষণাগুলো চলছিল এবং এটার প্রভাব এড়িয়ে যাওয়া কঠিন ছিল— যদিও মর্গানের বিখ্যাত কাজটি তখনো বাইরে আসেনি।


কিন্তু যাইহোক, তিনি তাঁর এই আদর্শ ইশতেহারের ধারা মেনে জীবন কতটুকু চালিয়েছেন তা অন্য ব্যাপার। অনুশীলনের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে তাঁর পদ্ধতিসমূহ ঐতিহাসিক প্রত্নতত্ত্বের পরিসরে বিকশিত হতে ব্যর্থ হয়, এমনকি প্রাগৈতিহাসও কোন গুরুত্বপূর্ণ মনোযোগ পায়নি শুধুমাত্র পাথরের বস্তুসমূহের সংগ্রহ করা ছাড়া—এই ব্যাপারটা একটু উদ্ভট যে তাঁর জীবনের কর্ম সক্রিয় বেশিরভাগ বছরগুলোয় ইউরোপে এবং নিকট প্রাচ্যে নির্দিষ্টভাবে Aegean অংশে পুরনো ধরনের অ্যান্টিকুয়্যেরিয়ানিজম ধীরে ধীরে প্রত্নতত্ত্বের মূল রূপ নিচ্ছে নিউটন, কনজ্‌, ফিওরেল্লি, ডোর্পফেল্ড এবং শেলিম্যান-এর মতোন মানুষদের দ্বারা। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এই শতাব্দীর শেষ দিকে দুইজন মহৎ ইংরেজ প্রত্নতাত্ত্বিক পিট রিভার্স এবং পেত্রিয়ের দ্বারা।


ভারতে আমরা এর সীমানার বাইরে যত পদ্ধতি ও কৌশলের বিকাশ হচ্ছে তা সম্পর্কে একটি অবিশ্বাস্য রকমের অসচেতনতা শনাক্ত করতে পারি। কার্যতই কানিংহামের লেখায় কেউ একজন কাদাচিৎ তাঁর সমসাময়িক অন্য প্রত্নতাত্ত্বিকদের (যারা তাঁর সাথে কাজ করেছে তাদের কোন ধরনের) উল্লেখ পাবে, লায়ার্ডের একটি আকস্মিক রেফারেন্স ছাড়া। ১৮৭০ সালে দ্বিতীয় সার্ভের প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে, ১৮৬১ সালের মতোন একই উপায়ে তিনি তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো আবার তুলে নেন। বছরের পর বছর একই রকমের (pattern) অনুসন্ধান, খনন এবং প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে যে মনে হয় যেন এই সময়ের মধ্যে প্রত্নতত্ত্বের বিজ্ঞানে নতুন কিছুই ঘটেনি। তিনি ভারতে তাঁর সাথে ঢিবি খননের বৃটিশ ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে আসেন এবং আসলে কখনোই এর বাইরে বের হতে পারেন নি। কার্যত তিনি প্রায়শই “borrow (ঢিবি)” শব্দটি ব্যবহার করেছে একটি স্তূপ (stupa)-কে বর্ণনা করার সময়ে এবং অন্তত একবার প্রাচীনতম স্তূপকে সাধারণ মাটির ঢিবি হিসেবে উল্লেখ করেছে “যেরকম ঢিবি এখনো ইংল্যান্ডে অস্তিত্বশীল”।

কানিংহাম নিশ্চিতভাবেই আধুনিক প্রত্নতত্ত্বের কিছু মূল গুরুত্বপূর্ণ ধারণাসমূহ ভারতে বিকশিত করতে পারতেন, যেহেতু তাঁর বিশাল এবং প্রতিশ্রুতিমূল গবেষণাক্ষেত্র ছিল, যেমন- তক্ষশীলা, বৈশালী, শ্রাবস্তী, কৌসাম্বি ইত্যাদি। পঞ্চাশ বছরে তিনি অসংখ্য tells পরীক্ষা করেছে উত্তর ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে এবং এর প্রায় সবগুলোই ছিল প্রাচীন শহরের অবশিষ্টাংশ। যদিও তিনি কখনোই তাঁদের খননে প্রকাশিত অদ্ভূত সমস্যাগুলো কখনোই ঠিকভাবে বোঝেননি, এমনকি লেভেলের প্রশ্নের গুরুত্বও তিনি কখনো অনুধাবন করেননি; যেমন ধরা যাক, ৫০ ফিট উঁচু tell হাজার বছর বা তারও বেশি সময়ের সঞ্চয়নকে (accumulation) রিপ্রেজেন্ট করছে। এই ভাবনার পিছনে অবশ্যম্ভাবীভাবে বাঁধা প্রদান করেছে যেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর (ঘটনা) তা হলো ভারতের ইতিহাসের এপিগ্রাফিক ও লিখিত নথিসমূহের অস্তিত্ব— তাঁর আগ্রহের সময়ের যেকোন কেইসে তথাকথিত “বুদ্ধিস্ট পর্যায়”।


এজন্যই এটা আবিষ্কার করা অসাধারণ আগ্রহোদ্দীপক যে যখনই এরকম একটি অবস্থার মুখোমুখি হলো যেখানে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিসমূহ কোন কাজে আসছিল না তখনই এটাকে সামাল দিতে গিয়ে তিনি স্ট্যাটিগ্রাফির (স্তরায়ন) মূলনীতিগুলো প্রায় আবিষ্কার করে ফেলেছিল।


মুলতানে তিনি ৫০ ফিট উচ্চতার একটি সঞ্চয়নের মুখোমুখি হন যেখানে তাঁর নিজস্ব পথে তাঁকে নির্দেশনা দেবার পছন্দের চিহ্নগুলো— স্থাপনার অবশেষ, ভাষ্কর্যের টুকরো বা মুদ্রা এবং লিপি— অনুপস্থিত ছিল। মরিয়া হয়ে তিনি খনন করেন যেটাকে তিনি একটি “প্রত্নতাত্ত্বিক কূয়া (archaeological well)” নাম দেন। একটা বিশাল সেকশন (section) কাটা হয়েছিল, যা ৪০ ফিট গভীরতা পর্যন্ত পৌঁছেছিল, যেখানে তিনি ভার্জিন মাটি (virgin soil) পর্যন্ত পৌছাতে পারেন। ফলাফল একটি ট্যাবুলার ফরমে দেয়া হয়।১০ এই ছকটি এমন একটি নীতির ভিত্তিতে অঙ্কিত হয়েছিল বর্তমানের প্রত্নতত্ত্বে যার কোন স্থান নেই। যেহেতু তিনি “প্রত্নতাত্ত্বিক কূয়া”য় লেভেলে এর সমস্যা ও এদের কাল নিরূপণের সমস্যার মুখোমুখি হলেন, তিনি চেষ্টা করেছিলেন একটি সময়-পরীক্ষা করার ছক বানাতে যার ভিত্তি হবে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সঞ্চয়নের পুরুত্বের হার কীরূপ তার উপর, যাতে সেকশনের যেকোন নির্দিষ্ট গভীরতায় একটি স্বয়ংক্রিয় কালানুক্রম পাওয়া যায়। এই পদ্ধতি যা দ্বিধাহীনভাবেই একটি মহৎ উদ্যোগ ছিল তা ইতিমধ্যেই অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিকদের দ্বারা ব্যবহৃত এবং বাতিলকৃত হয়েছে এটার অবশ্যম্ভাবী কিছু সংকটের কারণে। যাইহোক, মোটামুটি অযৌক্তিকভাবে কিছু ফিগারের ভুলভাবে পরিবর্তন করে তিনি এই নির্দিষ্ট ঘটনায় (মুলতান খনন) প্রতি ১ ১/২ ফিট সঞ্চয়নকে এর এক একটি শতকের বলে চিহ্নিত করেন। তিনি যদি তাঁর প্রাপ্তবস্তুর strata (স্তর)-এর দিকে মনোযোগ দিতেন— যা মূলত তিনি শনাক্ত করে ফেলেছিলেন—মৃত-সংখ্যার অযৌক্তিকতা থেকে সঞ্চয়নের পুরুত্ব হয়তো আরও পষ্ট হতো এবং স্তরায়নবিদ্যার আসল নীতিগুলো হয়তো তাঁর বোঝাপড়ার রাস্তায় চাপ প্রয়োগ করতো। আপাত দৃশ্যমান অসঙ্গতি যেমন, লাল ছাই (red ash)-এর গাদ্দার যে স্তর একটি অগ্নিকান্ডকে প্রকাশ করে এবং যদিও ১৫-১৭ ফুট পর্যন্ত বিস্তৃত—এই সুঞ্চয়ন তার আদেশাবলী অনুযায়ী ২০০ বছরের একটি কালপর্বকে নির্দেশ করার কথা—তাঁর কাছে এটি অদ্ভূত/অযৌক্তিক হিসেবে নাড়া দেয়নি। ২ ফুটের একটি ছাইয়ের স্তর (layer) যা তিনি ৩০ থেকে ৩২তম ফুটের উপরে বিস্তৃত হিসেবে দেখান তার ক্ষেত্রেও আবারও এটি সত্য।


আরেকবার, তাঁর ক্যারিয়ারের শেষের দিকে, এক ধরনের স্তরায়নবিদ্যায় নীতি তাঁর আওতার মধ্যে প্রায় চলে আসে। এটা ঘটে যখন তিনি বোধগয়ায় পুনরানয়নের কাজ চলছিল। মন্দিরের মেঝে সম্পূর্ণরূপে খোড়া হয়েছিল এবং এটা কিছু মেঝের নাটকীয় উন্মোচনের দিকে ধাবিত হয়েছিল যা একটার নিচে আরেকটা এভাবে অবস্থিত ছিল এবং বিভিন্ন কালপর্বের পুননির্মাণের সাক্ষ্য প্রকাশ করছিল। কাল নির্ণয় করা সম্ভব এমন বস্তুর সাথে মেঝেসমূহের তুলনা করে বিভিন্ন কালপর্বের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর বোধগয়া-র প্রতিবেদনে১১ ভিন্ন ভিন্ন মেঝের কথা বলেছেন— অশোকীয় এবং অন্যান্য— এবং সেখানে এমনকি কিছু প্রাথমিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন মন্দিরের বাইরের মাটির স্তরের সাথে ভিতরের মেঝের সংযোগ নির্ণয় করার এবং আরও একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন ভিন্ন ভিন্ন ইপোক-এ প্রত্নস্থানের অ্যাপিয়ারেন্স (appearance) পুনঃনির্মাণ করার। এটা কার্যতই সামনের দিকে এগোনোর একটি দীর্ঘ পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু এটা অনেক দেরীতে এসেছিল— ফলে তাঁর প্রত্নতত্ত্বের ধারায় কার্যকর কোনো ছাপ ফেলতে পারতো না— তিনি তখন দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রাক্কালে।


বর্তমানে কেউ শুধুমাত্র এটাই ভাবতে পারে যে এত খোঁজাখুঁজির পর ঠিক কখন আসলে ভারতের হারিয়ে যাওয়া শহরগুলো খুঁজে পাওয়া গেলো, এটা কখনোই তাঁর ক্ষেত্রে ঘটেনি যে সে এগুলোকে শহর হিসেবে উন্মোচিত করবে—একটা আইডিয়া যা ক্রমেই তাঁকে “পূর্নাঙ্গ খনন”-এর ধারণার দিকে ধাবিত করবে। নিশ্চিতভাবেই রিসোর্সের প্রশ্নটি সম্পূর্ণভাবে এটাকে ব্যাখ্যা করতে পারেনা। এই বিস্ময়টি আরো বড় হয়ে যায় যখন আমরা Grote-কে লেখা তাঁর চিঠিতে তাঁকে এটা ব্যক্ত করতে দেখি (যা JASB-তে প্রকাশিত হয়েছিল)— এবং নিশ্চিতভাবেই যা এখন একটি ব্যতিক্রমী আগ্রহের নথি—যে সে মূলত তক্ষশীলার সোজা রাস্তাগুলো দেখেছিল এবং শনাক্ত করেছিল।১২ এটা একটা ফ্যাক্ট যা কেউই শুধুমাত্র তাঁর প্রতিবেদনগুলো পড়ে আন্দাজ করবে না। আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিকেরা কি এরকম উত্তেজনাপূর্ণ ক্লু বা সূত্র পাবার পরে নিজের টেকসই খননের প্রলোভন আটকে রাখতে পারবে?


এটা জানা আগ্রহীদ্দীপক হবে যে, তাঁর অনুশীলনকৃত প্রত্নতত্ত্বের ধরন নিয়ে তাঁর সমসাময়িকদের কীরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল। তাঁদের মধ্যে গুটিকয়েকের অভিমত পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। কিছু খাপছাড়া ইঙ্গিত পাওয়া যায় যা সংকেত দেয় যে ঘরের এবং বাইরের উভয়দিকে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা অস্থির হয়ে পড়েছিল তাঁর বছরের পর বছর একই অপেশাদারি ভঙ্গিমায় প্রকাশ করা ভ্রমণ প্রতিবেদন নিয়ে যা সঠিক সেকশন, অনুলিপি এবং আলোকচিত্র ছাড়াই প্রকাশ করা হতো। ১৮৭০ সালে সার্ভের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বারজেম আশা করেছিলেন যে, একটা “নতুন বৈজ্ঞানিক যাত্রা এখন ভারতে অনুশীলনক্ষম হবে যেমনটা তখন ধ্রুপদী প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে ঘটেছিল।“১৩ কিন্তু তিনি দ্রুতই মোহগ্রস্ততা কাটিয়ে ওঠেন। কানিংহামের প্রতিবেদন বিষয়ে তিনি শেষ করেন এভাবেঃ “এগুলো মূলত কিছু অসম্পর্কিত ভ্রমণের প্রতিবেদন... এবং বৈজ্ঞানিক বা গ্রহণযোগ্য নয়”।১৪ এর অনেক আগেই ফার্গুসন ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের অবস্থান নিয়ে তাঁর অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। বুহ্‌লার (Bühler) অধৈর্য্য নিয়ে আশা করছিলেন যে তক্ষশীলা, পাটলিপুত্র এবং মথুরার মতোন রাজধানীগুলোতে “পূর্ণাঙ্গ খনন”-এর কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। তিনি ভেবেছিলেন বর্তমানে আসলেই বৈজ্ঞানিক খনন বলতে যেটা বোঝায় যা স্থাপনা বা প্রত্নস্থানের নিচে কি রয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে অনুসন্ধান করবে সেরকম উদ্যোগ খুব কম স্থানেই গ্রহণ করা হয়েছে... এবং সকল স্থাপনাসমূহ যা খননকৃত... মূলত বুদ্ধিস্ট, যা বর্তমানের গবেষণা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতরভাবে দেখিয়েছে যে কোনভাবেই এগুলো সর্বপ্রাচীন নয় এমনকি প্রাচীন ভারতের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় গোষ্ঠী (sect) নয়।১৫


যাইহোক, সমসাময়িক ইউরোপীয় প্রত্নতত্ত্বের পদ্ধতিসমূহ সম্পর্কে কানিংহামের নিজের থেকে ভালো কোন স্পষ্ট ধারণা তাঁর সমালোচকদের ছিলনা। “বৈজ্ঞানিক প্রত্নতত্ত্ব”-এর তাঁদের যে অর্থ তা কার্যতই খুবই অস্পষ্ট ছিল এবং নিশ্চিতভাবেই স্তরায়নবিদ্যার ধারণা-এর কোনো অংশেই ছিলনা। ১৮৯৯ সালে ওয়াডেল তাঁর পাটলিপুত্র খননে super imposed স্তরসমূহ লক্ষ্য করেন এবং তাঁর প্রতিবেদনে রহস্যজনক উপায়ে এগুলোর কথা বলেনঃ “যেহেতু প্রাচীন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ অবশেষগুলো খুব গভীরভাবে পরবর্তী শতকগুলোর ধুলা ও ময়লার ভিতরে প্রোথিত রয়েছে, তাদের চিহ্নসমূহ পুনরুদ্ধার করবার জন্য খনন পদ্ধতি অবলম্বন করা প্রয়োজনীয়। এই অপারেশন-যে আগ্রহোদ্দীপক বিষয়টি প্রকাশিত করে তা হলো এখানে একটি কালানুক্রমিক স্তর (stratification) পাওয়া গেছে যেরকমটা ইউরোপের পুরনো peat-mosses খুড়লে দেখা যায়। যেখানে প্রতিটি জেনারেশন তার নিজস্ব ছাপ বা প্রমাণ রেখে দিয়েছে। এগুলো বিশেষত মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশসমূহ এবং ইটের ক্ষেত্রে প্রতীয়মান...।“১৬


তাহলে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে কানিংহামের অবস্থান কোন জায়গায়? যেরকম ম্যারিয়েত্তে (Mariette) মিশরের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের “পিতা এবং প্রতিষ্ঠাতা” ছিল, সেরকমই কানিংহাম ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সার্ভের। শেলিম্যান যেমন পজানিয়াসকে অনুসরণ করেছিল সেরকম কানিংহামও হিউয়েন সাঙ এবং ফা-হিয়েনকে অনুসরণ করেছিলেন। রাওলিনসন এবং নরিসের মতো তিনি লিপির একজন বিশাল পাঠোদ্ধারকারী ছিলেন। ফ্রান্সের রচেত্তের মতোন তিনিও একজন বিশাল মানের মুদ্রা বিশেষজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তুলনার শেষ এখানেই। কারণ তাঁর এই চতুর্মুখী কার্যক্রমের কোনোটিই নিয়মতান্ত্রিক গবেষণায় রূপ নেয় নি। লিপিবিদ্যার একজন ফ্লিটের জন্য, মুদ্রাবিদ্যার একজন র‍্যাপসন-এর জন্য এবং খননের একজন মার্শালের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে।


যখন এসকল কিছু বলা হচ্ছে তখনও এই বিষয়টা সত্যই রয়ে যায় যে, তিনি ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের জন্য যা করেছেন তাঁর গুণমান পর্যাপ্ত চিত্তাকর্ষক এবং পরিমাণ হিসাব করলে এর কোনো তুলনাই হয়না। সম্ভবত তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল সমগ্র উত্তর ভারতের অসংখ্য প্রত্নস্থানের (বিশেষত এযাবৎকালে যে সকল অঞ্চলকে অ্যান্টিক্যুয়েরিয়ান সম্ভাবনাময় নয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো সেগুলোর) তালিকা তৈরি করা। এসকল কিছুর মধ্যে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে কারোর মাথায় আসতে পারে তা হলো ভারতের বিন্ধ্যাঞ্চলের বন্য-দুর্গম অঞ্চল (Vindhyan India) ও মালওয়া এবং রাজস্থানের দ্বারা পরিবেষ্টিত অঞ্চল। এমনকি ভারতের শিলালিপির সংকলনে চোখ বুলিয়ে গেলেও আমরা তাঁর কাছে আমাদের ঋণ স্বীকার করতে বাধ্য হই, যেহেতু এগুলো আমাদের দেখায় যে কি বিপুল সংখ্যক শিলালিপি তিনি আবিষ্কার ও সংরক্ষণ করেছেন। এই শিলালিপিগুলোর দিক থেকে দেখলে, যখন এগুলো পাঠোদ্ধার হল—যার অনেকগুলোই কানিংহামের নিজের করা—এগুলো ভারতীয় ইতিহাসের অনেক অন্ধকারাচ্ছন্ন দিককে আলোকোজ্জ্বল করতে সাহায্য করল। একই ঘটনা মুদ্রার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তিনি সর্বকালের সেরা অন্যতম একজন সংগ্রাহক ছিলেন এবং অনেক নতুন ধরনের ও বৈচিত্র্যের বস্তু তাঁর দ্বারাই প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল। তিনি আমাদের সর্বপ্রথম একটি কালানুক্রমিক কাঠামো প্রদান করেন ভারতীয় প্রাচীন মুদ্রাসমূহের সম্পূর্ণ সিরিজের, যা তিনি JASB এবং Numismatic chronicle নামক জার্নালে উল্লেখ করেন। তিনি সম্ভবত ভারতে সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা কর্মকর্তা ছিলেন। উত্তর ভারতের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তের অগণিত যাত্রাকালে তিনি এই দেশ এবং এর জনগণকে গভীরভাবে জানতে পেরেছেন। অধ্যাপক কডরিংটন যথার্থই বলেছিলেন যে, “তিনি (কানিংহাম) ভারতকে জেনেছেন হাঁটতে হাঁটতে”।১৭ এই জ্ঞান তাঁকে এক অদ্ভূত অন্তর্দৃষ্টি দেয় ভারতের ইতিহাস এবং সমাজ সম্পর্কে, যা অন্যদের কমতি ছিল।


মনে করা হয় কানিংহামের খ্যাতি তাঁর প্রাচীন ভারতের প্রত্নস্থানসমূহের শনাক্তকরণ এবং প্রাচীন ভারতের ভূগোল ব্যাখ্যা করার মধ্যেও অন্তর্হিত রয়েছে, যেখানটাতে জোন্‌স এবং উইলফোর্ডের সকল অকপটতাকে হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল যা তাঁরা তালিকাভুক্ত করতে পারতো। যাহোক, এটা স্মরণে রাখতে হবে যে এই ভূগোল [ভৌগোলিক অবস্থা] ব্যাখ্যা করার যে প্রচেষ্টা এবং যৌক্তিক সাফল্য তা ১৮৭০ সালে তাঁর “জিওগ্রাফি (Geography)” লেখার অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। আমরা এর মধ্যেই ল্যাসেন, উইলসন এবং ভি. সেইন্ট মার্টিনের মহৎ প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করেছি। এসকল প্রচেষ্টার পরেই কার্যত ওখানে খুবই কমই কাজ করার ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাদ দিলে। তখন যেটা প্রয়োজন ছিল তা হল কারো একজনের দায়িত্ব নিয়ে সমস্ত জায়গায় শ্রমসাধ্য ভ্রমণ করে পরিদর্শন করা, প্রমাণ-এর জন্য যাতে তাদের ধারণাগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় এবং কানিংহাম সংক্ষেপে এই দরকারী কাজটাই করেছিল। যাইহোক, কানিংহাম ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন শহরগুলোর শনাক্তকরণের প্রস্তাবনা দিয়েছিল— মানসম্পন্ন প্রকাশনাগুলোতে যা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই করা হয়েছিল— এটা ঐতিহাসিকভাবে ভুল। কানিংহামের এই কৃতিত্ব অবশ্যই উলসন, সেইন্ট মার্টিন এবং এমনকি কিট্টো (kittoe)’র সাথে ভাগাভাগি করে নিতে হবে। JASB-এর একটি এযাবতকাল পর্যন্ত অলক্ষিত একটি প্রবন্ধ দেখায় যে, আদতে কিট্টো অনেক আগেই নালন্দার সাথে বড়গাঁওয়ের সনাক্তকরণের প্রস্তাব দিয়েছিল।১৮


একইসাথে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বে স্বীকার্য হিসেবে একটি কানিংহাম পর্যায় মেনে নেওয়াটাও ভুল। ভারতীয় ঐতিহাসিক গবেষণায় উত্তর ভারতের অদ্ভূত অধিক আধিপত্যশালী অবস্থা, যা কানিংহামকে সম্ভবত একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ গুরুত্ব প্রদান করেছে। তিনি কখনোই লিপিবিদ্যা, মুদ্রাতত্ত্ব, স্থাপত্য এবং দক্ষিণের ভাষ্কর্যসমূহের ব্যাপক বিস্তৃত কাজের (পরিসর) স্থানের সাথে নিজেকে সংশ্লিষ্ট করেননি, যেখানে বিশাল মাপের ফলপ্রসূ কাজ ফ্লিট, হাল্টজ, কিয়েলহর্ন, রেয়া, রাইস এবং সিওয়েল-এর দ্বারা সাধিত হয়েছে। তাঁর সমসাময়িকদের মধ্যে আরও একজন যার দ্বারা দক্ষিণের বিশেষত পশ্চিম ভারতের বিশদ কাজ হয়েছিল, তাঁরই (কানিংহাম) ফেলো ডামফিশায়ারের লোক— ড. বার্জেস, যেই গ্ণিতের শিক্ষক প্রত্নতাত্ত্বিকে রূপান্তরিত হল— তাঁর দ্বারা। ১৮৭৩ সাল থেকে তাঁকে পশ্চিম ভারতের সার্ভের দায়িত্বে রাখা হয়েছিল এবং তাঁর কাছেই ১৮৮১ সালে দক্ষিণের দায়িত্ব যোগ করা হয় এবং আরও কিছু বছর পরে, কানিংহামের অবসর লাভের পরে। তিনি ডিরেক্টর জেনারেল পদে আসীন হন। বার্জেস ১৮৮৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর ২০ বছরের দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি যত সম্ভব royal quarto monograph তৈরি করেন পশ্চিমে ও দক্ষিণের অ্যান্টিক্যুইটিস-এর উপরে।


যদিও বার্জেস খননকারী (excavator) ছিলেন না— তিনি অনেক কম খননকাজ করেছিলেন—এবং ভারতীয় ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে তাঁর বোঝাপড়া ও অন্তর্দৃষ্টি কানিংহামের মত এত প্রগাঢ় ছিল না, তাঁর স্থাপত্য ও লিপিবিদ্যার পদ্ধতিসমূহ সম্ভবত কানিংহামের চেয়ে উন্নত ছিল। কানিংহামের যদি মেধা থাকে, বার্জেসের ছিল পদ্ধতি। তাঁর প্রতিবেদনসমূহ অধিকতর ভালোভাবে তৈরি এবং অনেক বেশী নিয়মতান্ত্রিক ছিল কানিংহামের গুলোর থেকে। বিশেষত নিউ ইম্পেরিয়াল সিরিজ যা বার্জেসের দ্বারা শুরু হয়েছিল তার ভলিউমগুলো এ ধরনের প্রতিবেদনের আদর্শ। তিনি ভারতের প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক ছিলেন যিনি ওই সময়ে বিকশিত হওয়া আলোকচিত্র শিল্পের বিশদ ব্যবহার করেছিলেন। তিনি বিশেষায়িত জ্ঞানের এবং জ্ঞানজ সহযোগিতার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন এবং তাঁর লিপিবিদ্যা ও মুদ্রাতত্ত্বের জন্য বিশেষজ্ঞদের উপরে নির্ভর করেছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ও কল্পনা পর্যাপ্ত ছিল যে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পেরেছিলেন ২টি জার্নালের কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে, যেগুলো ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব এবং ইতিহাসের বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেঃ Indian Antiquity এবং Epigraphia Indica—জার্নালদ্বয় যা একদল মেধাবী মানুষদের স্বয়ংক্রিয় করেছিল, বিশেষত লিপিবিদ্যার ক্ষেত্রে, তাদের সঠিক ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে— বুহ্‌লার, ফ্লিট, হান্টজ এবং কিয়েলহর্ন এর মত মানুষ যারা তাদের গবেষণার মাধ্যমে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসের সম্পূর্ণ আঙ্গিক বদলে দিয়েছিল।


ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বে কানিংহামের আসল স্থান অনেক আগে সঠিকভাবে ভোগেল (Vogel) নির্ণয় করে গিয়েছিলেন। চাম্বা (Chamba)কে নিয়ে বলার সময় তিনি লেখেন, “এখানে, অন্যখানের মতোই, ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বের মহৎ পথপ্রদর্শক শুধুমাত্র গবেষণাক্ষেত্রকে আলাদা করে, অন্যদের কাছে দিয়ে গিয়েছিল এর পরবর্তী অনুসন্ধানের লক্ষ্যে”।১৯ (বাঁকা হরফ লেখকের) সে কার্যতই একজন পথপ্রদর্শক ছিলেন এবং পরবর্তীদের স্বীকৃতিই তাঁর সর্বোচ্চ পাওনা।

____________


***এই অনুবাদটি আরও পরিমার্জনার ভিতর দিয়ে যাবে। সে অর্থে একে খসড়া অনুবাদও বলা চলে।

দোহাই

[১] "Verification of ftie Itinerary of Hwan Thsang through Ariana and India, with reference to Major Anderson's hypothesis of its modern compilation', JASB., 1848, Pt. I, 476-488 and Pt. II, 13-60.

[২] ‘An Account of the Discovery of the Ruins of the Buddhist city of Samkassa’, JRAS., 1843, 241 ff.

[৩] 'Opening of the Topes or Buddhist Monuments of Central India, JRAS., 1852, 108 ff.

[৪] Op. cit., JRAS., 1843, 246-7.

[৫] 'Proposed Archaeological Investigation', JASB., 1848, 535-6

[৬] Foé Koué Ki ou Relation des Royaumes Bouddhiques, par Abel Rémusat, Klaproth et Landresse. Paris, 1836.

[৭] 'Account of the Foé Koué Ki, or Travels of Fa Hian in India, translated from the Chinese by Rémusat', JRAS., 1839, 108-140.

[৮] Memoires sur les Contre'es Occidentales. Paris, tome I, 1857; tome II, 1858.

[৯] For this and the related matters the most handy reference is Volume I of Cunningham's reports.

[১০] Cunningham, Report V, pp. 126-129

[১১] Mahdbodhi. London, 1892.

[১২] JASB, 1864, pp. 332 and 333.

[১৩] 'Sketch of Archaeological Research in India during Half a Century’, JBBRAS., 1905, p. 140.

[১৪] Ibid., p. 141.

[১৫] "Some Notes on Past and Future Archaeological Explorations in India', JRAS., 1895, p. 655.

[১৬] Report on the Excavations at Pataliputra (Patna). Calcutta, 1903, p. 27.

[১৭] The Place of Archaeology in Indian Studies, London, 1949, p. 8

[১৮] 'Extract of a letter from Capt. Kittoe', JASB., 1848, p. 539

[১৯] Antiquities of Chamba State. New Imperial Series, Vol. XXXVI, Part I, Calcutta 1911, p. i


প্রকাশঃ ২১শে আষাঢ়, ১৪২৮:::৫ই জুলাই, ২০২১