উদোর পিন্ডি উদোর ঘাড়ে, বুধোর পিন্ডি বুধোর

রাশীদ মাহমুদ



[ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাশীদ মাহমুদ আমাদের ছেড়ে গেছেন। তাঁর বেশকিছু লেখা ফেসবুকে প্রকাশিত হলে বোধিচিত্তের ফেসবুক পেইজে শেয়ার করা হয়েছিল। সেই লেখাগুলো ধারাবাহিকভাবে সাইটে তুলে রাখা হবে। গত বছরের ২৮শে মার্চে তাঁর ফেসবুক ওয়ালে এই লেখাটি পোস্ট করেন।]



করোনা মহামারর এই দিনগুলোতে আমরা নিজেদেরকে নিজেরা খুব কষে গালাগাল দিচ্ছি। আমরা জাতি হিসেবে অসভ্য, বেকুব, মূর্খ, স্বার্থপর ইত্যাদি কত কি। এ নিয়ে আমার তর্ক থাকলেও তা এখন নয়। যে প্রশ্ন করবার জন্য এই লেখা শুরু করলাম তা হচ্ছে, আমরা যদি জাতি হিসেবে অসভ্য, বেকুব, মূর্খ হয়েই থাকি তবে আমাদেরকে পথ দেখাবার দায়িত্ব ছিল কাদের?



প্লেটোর মতে, এই দায়িত্ব হচ্ছে অভিভাবক শাসকদের। কারণ, আমরা তো আমজনতা, যারা প্রবৃত্তি তাড়িত। অভিভাবক শাসকদের থাকবে জ্ঞান/প্রজ্ঞা যা প্রয়োগ করে তাঁরা আমাদের ন্যায়-অন্যায় মেনে চলতে শেখাবেন। প্লেটো জানাচ্ছেন যে তাঁর গুরু সক্রেটিসের মতে এই অভিভাবকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তিও থাকবে না, কারণ এতে করে তারা দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়তে পারেন। অবশ্য প্লেটো অতিমাত্রায় কল্পনাশ্রায়ীত ছিলেন। প্লেটোর ছাত্র এরিস্টটল গুরুর সাথে অনেক বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলেও নেতৃত্বের গুণাবলী চিহ্নিত করার ব্যপারে তাঁদের মাঝে বেশ মতৈক্য দেখা যায়।



এরিস্টটল তাঁর এথিকস গ্রন্থে একটি প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রশ্নটি হচ্ছে: "ভালো মানুষ আর ভালো নাগরিক কি অভিন্ন"? (Is the good man identical with the good citizen?)। তাঁর মতে, না। কারণ শাসন ব্যবস্থার ধরনের সাথে সাথে নাগরিকের গুণাবলী, মূল্যবোধ, আচরণ ইত্যাদির মানদণ্ড পরিবর্তিত হয়। কিন্তু, এটি একজন ভালো মানুষের ক্ষেত্রে ঘটে না। কারণ, ভালো মানুষ হচ্ছে প্রজ্ঞাবান (the man of Phronesis) যাঁর মূল্যবোধের মানদণ্ড সব ক্ষেত্রেই অনড় থাকে। ফলে, ভালো নাগরিক মানেই ভালো মানুষ না হলেও, ভালো মানুষ মাত্রই ভালো নাগরিক। আর তাই, একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্রের নেতৃত্বে থাকবেন তারাই যারা একই সাথে ভালো মানুষ ও ভালো নাগরিক। তাঁর মতে,

"প্রজ্ঞা একমাত্র শাসকেরই থাকবে। অন্যান্য গুণ (যেমন: মিতাচার, ন্যায় ও সাহস) শাসক ও জনগণ দুয়েরই থাকতে পারে। জনগণের ভালোত্বকে প্রজ্ঞা নয়, সুমতি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে"।


Prudence (phronesis) is the only form of goodness which is peculiar to the ruler. The other forms of virtue [i.e. temperance, justice and courage] must, it would seem, belong equally to rulers and subjects. The form of goodness peculiar to subjects cannot be prudence and may be defined as right opinion.



বেদেও শাসককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে পরামর্শের জন্য ঋষির দ্বারস্থ হতে, কারণ ঋষি হচ্ছেন প্রজ্ঞাবান। চাক্যও কিন্তু ঋষি-রাজাকেই (প্রজ্ঞাবান রাজা) সেরা রাজা বলেছেন। অর্থাৎ আমরা আমজনতা হচ্ছি বেঁকাত্যারা, বেকুব, মূর্খ যাদেরকে সঠিক পথে রাখবেন প্রজ্ঞাবান শাসক। কিভাবে রাখবেন সে নিয়ে ম্যালা পন্ডিত ম্যালা রাস্তা দেখিয়েছেন। ম্যাকিয়াভেলী দেখিয়েছেন প্রিন্সের ক্রুঢ় পথ, চাণক্য দেখিয়েছেন টক-ঝাল-মিষ্টি মেশানো পথ, রুশো দিযেছেন নিষ্পেষহীন পথ। যেভাবেই রাখুন না কেন, মূল দায়িত্ব কিন্তু শাসকের; আধুনিক রাষ্ট্রে আমরা যাদেরকে সরকার নামে অভিহিত করি।



তাই বলে আমি বলছি না আমাদের অর্থাৎ আমজনতার কোনো দায়িত্ব নাই। অবশ্যই রয়েছে। প্রজ্ঞাবান শাসকের দেখানো পথ অনুসরণ করা। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যদি নির্বাচিত শাসককে প্রজ্ঞাবান মনে না হয়, তবে আমাদের কাজ হচ্ছে সুমতি খাটিয়ে নতুন কোন প্রজ্ঞাবানের হাতে শাসনভার তুলে দেয়া।



এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমার মতো আমজনতাকে শেখানোর জন্য শাসকের প্রজ্ঞার কোনো লেশমাত্র কি দেখতে পাচ্ছেন? আমি কোন নির্দিষ্ট সময়ের নির্দিষ্ট শাসক/সরকারের কথা বলছিনা। যতদূর সম্ভব হয় পেছন দিকে তাকিয়ে দেখুন তো। আল্লার মাল আল্লায় নিয়ে গেসে, উই আর লুকিং ফর শত্রুস, চার হাজার কোটি টাকা কিছুই না, করোনা মারাত্মক রোগ নয় এটা সর্দি-কাশির মতো- নেতৃত্বের প্রজ্ঞাহীনতার উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। গত কয়েকদিন ধরে আমার ফেসবুক বন্ধুদের অনেকেই যখন করোনার কালে ঢাকা থেকে মানুষের হুড়মুড় করে ঢাকার বাইরে যাওয়া নিয়ে আফসোস করে পোস্ট দিচ্ছিলেন, তখন আমি অনেকের পোস্টেই মন্তব্যের ঘরে লিখেছি যে - "একটি খুশিতে, ঠ্যালায়, ঘোরতে প্রযোজনা"। সত্যিই তো। আমাকে তো নেতৃত্ব খুশিতে, ঠ্যালায়, ঘোরতে, অর্থাৎ যা ইচ্ছা তাই করতে শিখিয়েছে। কারণ, আমি নেতৃত্বকেও তাই করতে দেখে অভ্যস্ত। আমরাই তো বলি, সন্তানদের সুন্দর বেড়ে ওঠার জন্য পরিবারের অর্থাৎ অভিভাবকদের শিক্ষা কত গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে, রাষ্ট্রের সন্তানদের জন্য রাষ্ট্রের অভিভাবকদের শিক্ষা আরও গুরুত্বপূর্ণ নয় কি?



কিন্তু, এই অভিভাবকেরা কি কখনও দেশ গঠন আর জাতি গঠনের পার্থক্য অনুধাবন করেছে? তারা সবসময় ব্যস্ত দেশ গঠন নিয়ে। অর্থাৎ, রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ, ইমারত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি ভৌত অবকাঠামো নিয়ে। কিন্তু, এসব ব্যবহারের জন্য যে জাতি গঠন করতে হয় সেই চেষ্টা কি করেছেন বা করেন? এমন কি দেশ গঠনেও কি তারা কোনো প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন? শুধু চুরি আর চুরি। এতই চুরি করেন যে ক্ষমতা থেকে ১০/২০ বছর দূরে থাকলেও এদের ট্যাঁকে ন্যূনতম টান পড়ে না। হিসেব খুব কঠিন নয় বন্ধুরা। আমাকে উনারা কিভাবে হেলমেট পরাবেন, যেখানে উনাদের দলীয় সভায় যোগদানের জন্য শত-শত মোটরবাইকে (অধিকাংশ মোটরবাইকে তিনজন!!!) নেতা-কর্মীরা হেলমেট ছাড়া চলাফেরা করে? আমাকে উনারা কিভাবে বিভিন্ন কারণে অপরের গাড়ি ভাঙতে নিষেধ করবেন, যেখানে উনাদের কর্মীদের ভ্যন্তরী কমিটি পছন্দ না হওয়ার গোস্‌সা রাস্তার গাড়ি-ঘোড়ার উপর ঝাঁড়েন? এই তালিকা অনেক লম্বা করা যাবে। অর্থাৎ, আমাদেরকে জবাবদিহিতায় আনা উনাদের পক্ষে সম্ভব নয় এই কারণে নয় যে আমরা অসভ্য, মূর্খ, স্বার্থপর। বরং, এই কারণে যে উনারা নিজেরাই জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী নন। পন্ডিত চাণক্য বলেনঃ

"জনগণকে তাদের কাজের জন্য কৈফিয়ত দিতে বাধ্য করা একজন ভালো নেতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আর, একজন ভালো নেতা তাঁর নিজের কাজ-কর্মের জন্যও কৈফিয়ত দিতে বাধ্য থাকেন"।



প্রিয় বন্ধুরা, আপনাদের কাছে একটাই অনুরোধ। একে অপরের দিকে আঙ্গুল তুলে পরিবর্তন আনতে চাইছেন, ভালো। সেই চেষ্টা অব্যাহত থাকুক। কিন্তু একটা আঙ্গুল তুলে রাখুন নেতৃত্বের দিকে। অতীত-বর্তমান সবার দিকে। মনে রাখবেন, এরিস্টটলের মতানুযায়ী আমরা প্রজ্ঞাবান না হলেও আমাদের কিন্তু সাহসী হবার অধিকারটুকু আছে।

___________

২৮শে মার্চ, ২০২০


মূল পোস্টের লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/raasheed.mahmood/posts/10158126459712760

প্রকাশঃ ২২শে চৈত্র, ১৪২৭:::৫ই এপ্রিল, ২০২১