সংক্রমণ

জর্জিও আগামবেন


[করোনা মহামারি ও এর সাপেক্ষে জরুরী অবস্থার প্রসঙ্গে ইতালীয় দার্শনিক জর্জিও আগামবেনের “Lo stato d’eccezione provocato da un’emergenza immotivata” শিরোনামের লেখাটা il manifesto’তে প্রকাশিত হলে দার্শনিকদের মধ্যে তীব্র বিতর্কের সূচনা হয়। বিতর্কের সাপেক্ষে পরবর্তীতে Contagio(Contagion) শিরোনামের আগামবেনের লেখাটি প্রকাশিত হয়। সময়ের বিচারে মহামারী প্রসঙ্গে এটি আগামবেনের দ্বিতীয় লেখা, কিন্তু ইংরেজি অনুবাদ দেরিতে হওয়ায় এই লেখাটির বাংলা অনুবাদও আসতে বেশ দেরী হয়। মার্চ মাসে ফেসবুক নোট আকারে প্রকাশিত হয় এই লেখার অনুবাদ। ফেসবুক নোটের লিঙ্কটি এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা বিধায় দেয়া গেল না। আগামবেনের এই লেখাটি অনুবাদ করেছিলেন কাব্য কৃত্তিকা। কাব্য কৃত্তিকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী]



সংক্রমণকারী! ধরো! ধরো ওকে! সংক্রমণকারীকে পাকড়াও করো!

- আলেসান্দ্রো মানজোনি

I promessi sposi [বাগদত্ত]


তথাকথিত করোনাভাইরাস মহামারীর উপলক্ষে, আতঙ্কের সবচেয়ে অমানবিক ফলাফল হচ্ছে খোদ ছোঁয়াচে রোগের ধারণা—যা তারা ইতালিতে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে, যার ভিত্তিতে সরকার ব্যতিক্রমী জরুরি পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করেছে। ছোঁয়াচে রোগের ধারণাটি চিকিৎসাবিদ্যার অতীব গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয় না। এই ধারণার প্রথম অচেতন আবির্ভাবের পরিপ্রেক্ষিত ছিল ১৫০০ থেকে ১৬০০ শতকে ঘটে যাওয়া ইতালির কয়েকটা শহরের বিধ্বংসী মহামারীর ঘটনা। এই ঘটনা সংক্রমণকারীদের রূপ চিত্রায়িত করে, যাকে মানজোনি তাঁর উপন্যাস ও নিবন্ধে অমরত্ব প্রদান করেন। ১৫৭৬ সনের প্লেগের সময়ে প্রকাশিত এক মিলান অধিবাসীর “ঘোষণা”-য় এদেরকে এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং এদের নামে নাগরিকদের রিপোর্ট করার জন্য বলা হচ্ছে।



“গভর্নরের কাছ থেকে শোনা যায় যে, কতিপয় ব্যক্তি—দানখয়রাতের কৃত্রিম জোশে চালিত হয়ে, সেইসাথে যারা মিলানের অধিবাসীদের সন্ত্রস্ত করার লক্ষ্যে এবং তাঁদেরকে হাঙ্গামায় উৎসাহিত করতে—বাড়ির দরজায় দরজায়, সদর খিড়কীতে, জেলার ও নগররাষ্ট্রের [ততকালের ইতালীতে, বিশেষত মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে কিছু ছোট ও স্বাধীন নগররাষ্ট্র ছিল] বিভিন্ন জায়গায় কিছু পিঁপড়া ছেড়ে দেয় (যা তাঁদের ভাষ্যে সংক্রামক এবং ছোঁয়াচে)। এই ঘটনা ঘটে ব্যক্তিক ও জনপরিসরে প্লেগ নিয়ে আসার অছিলায়, যা বহুবিধ সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যার মধ্যে রয়েছে জনগণের মধ্যে তৈরি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ বদল, এই বদল মূলত তাদের মধ্যে বেশি যাদেরকে সহজেই পটানো যায়। এমন একটি ডিক্রি জারি করা হয় যে, যেকোন অবস্থার বা পদমর্যাদার যেকোন ব্যক্তি পাঁচশটি স্কুটি পুরস্কার পাবেন যিনি এই ঘোষণার চল্লিশ দিনের ভেতরে এই ধৃষ্টতায় সাহায্যকারী, সুবিধাপ্রদানকারী বা অবগত এমন ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ করবে...”


কোনো ধরনের ভিন্নতা ছাড়াই বলা যায়, বর্তমানে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে (ইতালির সরকার কর্তৃক গৃহীত হয়েছে, যা আমরা আশা করতে চাই—কিন্তু আদতে একটা ভ্রম ছাড়া আর কিছুই না—সেগুলো বাস্তবায়নে সংসদে গৃহীত কোন নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নয়, এবং এগুলোকে আইনে পরিণত হয়েছে) তা মূলত প্রতিটি ব্যক্তিকে একজন সম্ভাব্য সংক্রমণকারী'তে রূপান্তরিত করে ঠিক সেভাবেই, যেভাবে সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে আদতে আইনত প্রত্যেক নাগরিকই একজন সম্ভাব্য সন্ত্রাসী। এই তুলনা এতটাই স্পষ্ট যে, সম্ভাব্য সংক্রমণকারী যদি প্রদত্ত ব্যাবস্থাপত্র মেনে না চলে, তাহলে তাকে জেলে যাবার শাস্তি ভোগ করতে হবে। (লক্ষণ প্রকাশিত না এমন)সুস্থ কিংবা অসতর্ক রোগজীবাণু বহনকারীকে(যারা অনেক ব্যক্তিকে সংক্রমিত করেছে; এবং ঠিক যেভাবে কেউ সংক্রমণকারীর থেকে নিজেকে রক্ষা করে তেমনি করে নিজের কাছে থেকে অন্যদের বাঁচাতে অসমর্থ হয়েছে) ভয়াবহ শয়তানরূপে উপস্থাপন করা হচ্ছে।


স্বাধীনতার সীমিতকরণের চেয়েও এসকল পদক্ষেপের ফলে সৃষ্ট যে ব্যাপারটা আমার কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক মনে হয় তা হল, মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি। অপর মানুষটি, সে যেই হোক না কেন, যদি ভালোবাসার কেউও হয়, তার কাছে যাওয়া যাবেনা বা তাকে স্পর্শ করা যাবেনা—এমনকি আমাদের এবং তার মধ্যে দূরত্ব রাখতে হবে। কিছু লোকের মতে এই দূরত্ব ১ মিটার হওয়া উচিৎ, কিন্তু সাম্প্রতিকতম তথ্য (কিছু তথাকথিত বিশেষজ্ঞের মতে) অনুযায়ী এই দূরত্ব হতে হবে ৪.৫ মিটার (এই ৫০ সে.মি. কিন্তু বেশ আগ্রহোদ্দীপক!)। আমাদের প্রতিবেশীরা নাই হয়ে গেছে। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের নৈতিক ধারাবাহিকতাহীনতার ফলে এটা সম্ভব যে, এই পদক্ষেপসমূহ উদ্ভূত হয়েছে তাঁদের মগজে যারা এদেরকে গ্রহণ করেছে এবং ঐ একই ভয়ের তাড়নায় উদ্ভূত হয়েছে যা নেতারা উসকে দেয়। এই ভাবনা না ভাবা বরং কঠিন যে, যেই অবস্থা তাঁরা তৈরি করল তা মূলত আমাদের নেতারা প্রায়শই অর্জন করার চেষ্টায় থাকেঃ অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুল বন্ধ করা ও সকল পাঠ অনলাইনে স্থানান্তর করা হয়েছে যাতে করে আমরা একে অপরের সাথে সাক্ষাৎ বন্ধ করি, রাজনীতি বা সংস্কৃতি নিয়ে কথা না বলি তা নিশ্চিত করার জন্য; আমাদের ডিজিটাল বার্তা আদান প্রদানের দিকে ঠেলে দেওয়া যাতে করে, যেখানেই সম্ভব সেখানেই যন্ত্র প্রতিস্থাপন করবে মানুষের মাঝের যোগাযোগকে- প্রতিটি ছোঁয়াকে।


___________

১১ই মার্চ, ২০২০



দোহাই

১। আলেসান্দ্রো মানজোনি'র উপন্যাস I Promessi Sposi বা The Betrothed বা বাগদত্ত।

২। Storia della Colonna Infame বা History of the infamous column


প্রথম প্রকাশঃ মে, ২০২০