দার্শনিকদের বিরোধিতায় ধর্ম-উত্তর নীতিবাগিশতায় পরিণত হয়েছে অ্যাক্টিভিজমের চর্চা

গ্রাহাম হারমান


[পশ্চিমা দর্শন চর্চায় সমকালীন স্পেকুলেটিভ রিয়েলিজম (Speculative Realism) মুভমেন্টের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র গ্রাহাম হারমান। অবজেক্ট-ওরিয়েন্টেড অন্টোলজি নামে পরিচিত তাঁর দর্শন এবং সেইসাথে কোয়েন্টিন মেয়াসুঁ, লেভি ব্রায়ান্ট ও অন্যান্য তরুণ দার্শনিকদের কাজ ইতিমধ্যেই দার্শনিক পরিমণ্ডলে একটা বাকবদলের দাবি তুলেছে। গ্রাহাম দীর্ঘদিন কায়রোর আমেরিকান ইউনিভার্সিটির দর্শন বিভাগে পড়িয়েছেন। বর্তমানে SCI-Arc'তে দর্শনের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। গত বছরের মে মাসে তিনি করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সাক্ষাৎকারটি একইসাথে ইংরেজি ও তুর্কি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। Lockdown and the Sense of Threat শিরোনামে এই সাক্ষাৎকারের ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। গ্রাহাম হারমানের এই সাক্ষাৎকারটি ইংরেজি থেকে তর্জমা করেছেন কাজী তাফসিন। তাফসিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।]


কোভিড-১৯ মহামারী শুরু হবার পরপরই এই পরিস্থিতি নিয়ে জিজেক, বাদিয়্যু ও আগামবেন বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন এবং সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত এই প্রসঙ্গে আপনার কোন লেখা হাতে পাইনি। এর কারণ কি এই প্রসঙ্গে আপনার কিছুই বলার নেই, নাকি আপনি এই ব্যাপারটা নিয়ে কোন ‘দার্শনিক নীরবতা’ পালন করছেন?


যেকোন জরুরী মুহুর্তকে ব্যাখ্যা করার চেয়ে বরং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করাই দর্শনশাস্ত্রের কাজ বলে আমি মনে করি। কোভিডের এই মুহুর্তে আমি বরং ভাইরাস বিশেষজ্ঞ, এপিডেমোলজিস্ট এবং রাজনীতিবিদদের কথাবার্তার দিকেই বেশি মনযোগ দিতে আগ্রহী। চলমান কোন ইস্যু নিয়ে যদি কোন দার্শনিক সাথে সাথেই ব্যাখ্যা করতে বেশি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন, তাহলে খুব সম্ভাবনা আছে তিনি তাঁর নিজের দার্শনিক দূর্বলতার দিকে নজর না দিয়ে বরং বর্তমান ইস্যুকে সমাধান করার কাজেই বেশি মনযোগী। দার্শনিকেরা যখন তাঁদের কাজ ঠিক মতন করে, বেশিরভাগ সময়েই তাঁরা কাজ করে একটা সমগ্র শতাব্দী কিংবা সহস্রাব্দকে মাথায় রেখেঃ যার জন্য আমরা দেখতে পাই, স্বয়ং প্লেটোও সিরাক্যুজের [স্বৈরাচার শাসকের] ব্যাপারে ভুলভাল মন্তব্য করেছিলেন। আর হাইডেগার [-এর নাজিবাদের সমর্থন] নিয়ে আর না-ই বললাম। একইভাবে জিজেক কিংবা বাদিয়্যু’র কোভিড-১৯ নিয়ে লেখাগুলো পড়তেও আমার কোন আপত্তি নাই, কিন্তু তার চেয়ে বরং আমি আরও বেশি আগ্রহী ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর এই মুহূর্তে কোভিড নিয়ে কি বলতে চাইছেন সে ব্যাপারে। দার্শনিকদের যেকোন মন্তব্য তখনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যখন তাঁরা যে-সময়ে বসে কথা বলছে তার কিছুকাল-আগের সময় নিয়ে কাজ করে। আমি দার্শনিকদের জনবুদ্ধিজীবী (public intellectuals) হয়ে ওঠার বিরোধিতা করি না, কিন্তু দর্শনশাস্ত্রকে মহামারী কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন বোঝার মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করতে আমি নারাজ। মোটাদাগে বর্তমান মানব সভ্যতা হিসেবে আমরা সবসময়ই হাই-কালচার আর জনপরিসর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলার বিষয়গুলোর সমালোচনা করি, কিন্তু আদতে দর্শনশাস্ত্র মূলত এই ধরনের লোকজনই চর্চা করে এসেছে।


তাহলে আমরা কি ইতোমধ্যেই একটা তথাকথিত ‘সভ্য দুনিয়ার’ ফাঁদে আটকা পড়েছি—যেখানে কিনা মহামারীর সার্বজনীনতা কিংবা বৈশ্বিকতা বোঝার ক্ষেত্রে আগে থেকেই আমাদের মাথায় ‘সার্বজনীনতা’ বা ‘বৈশ্বিকতার’ একটা পুর্বানূমান আমাদের ওপর আরোপ হয়ে আছে?


এইক্ষেত্রে এই বিষয়টাকে আমার একটা নিরীহ রাজনৈতিক ইস্যু বলেই মনে হয়। আমরা বরং এমন একটা পৃথিবীতে বাস করছি যেটা আকাশপথে চলাচলের মাধ্যমে বিশ্বায়িত হয়ে পড়েছে এবং যার জন্য এই ভাইরাস আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সমর্থ হয়েছে। ইউরোপে বলতে গেলে মহামারী নিয়ে সকল ব্যবস্থাপনা নিজ নিজ রাষ্ট্রের ওপরেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর এদিকে আমেরিকায় ট্রাম্প যেহেতু নিজস্ব অব্যবস্থাপনার উছিলা হিসেবে অদ্ভূতভাবে রাজ্যসরকারগুলিকে একে অপরের প্রতিযোগী হিসেবে দাড় করাতে চেয়েছিল, তাই দিন শেষে কোভিডের সকল দায়িত্ত্ব ছেড়ে দেয়া হয়েছিল অঙ্গরাজ্যে আর তাদের স্থানীয় সম্মিলিত জোটগুলির ওপর—যেটা করতে গিয়ে আবার ফেডারাল সরকার যোগানের অভাবে পড়ে গিয়েছিল। ফলে দেখা যাচ্ছে, এই ভাইরাসকে মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে অনেকেই বৈশ্বিকতা-বিরোধী আচরণ দেখাচ্ছে। এজন্য রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকা সামনের দিনলোতে চেষ্টা করবে যেন চীনের সাপ্লাই চেইনের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমে আসে। এই পন্থা অবলম্বন হওয়ার পিছে কিছু দায় বর্তাচ্ছে ট্রাম্পের ওপরে, যেগুলোর কিছু কিছু সামনের দিনগুলোতেও চলতে থাকবে।


আধুনিক দর্শনশাস্ত্রের অন্যতম একটা প্রবণতা হচ্ছে কৃত্রিম যেকোন কিছুকে অকৃত্রিম বিষয়াশয়গুলোর অধীনস্ত বলে মনে করা। আজকাল করোনাভাইরাসের এই সময়ে আবার দেখা যাচ্ছে এই ভাইরাসকে অনেকে জীবিত আর না-জীবিত’র বাইরে অন্য কোনকিছু হিসেবে দেখছেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি এমনকি জিজেকও এই ভাইরাসকে ‘জ্যান্তেমরা’ ধাঁচের কিছু একটা হিসেবে চিহ্নিত করছেন। সেই হিসেবে আধুনিক দর্শনশাস্ত্র যেহেতু এমন একটা কর্তাসত্তার কথা বলে যা কিনা জীবিত বা অকৃত্রিম, সে হিসেবে এই ভাইরাসের আগমন আমাদেরকে কৃত্রিম বিষয়গুলোর অকৃত্রিমের আধীনস্ততার যে দার্শনিক চিন্তার সীমারেখা সেটা থেকে বের হওয়ার একটা জায়গা তৈরি করে দিয়েছে। ‘জীবন’-এর ধারণা নিয়ে আমাদের বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে কৃত্রিম আর অকৃত্রিমের যে সীমারেখা সেটা নিয়ে তাই সবারই আবারও নতুন করে ভাবতে হয়—যতবারই নতুন কোন ‘অবজেক্ট’ আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। আপনিও কি সেরকমই মনে করেন যে, এই ভাইরাস এমন কিছু একটা যেটা কিনা কৃত্রিম আর অকৃত্রিমের বর্গের বাইরে নতুন কোন কিছু?


একটা বড় সময়ব্যাপী জীবনের ধারণা নিয়ে আমাদের পুনর্বার ভাবতে হয়েছে, যেহেতু এটা ১৬০০ শতক থেকেই দর্শনের অন্যতম দূর্বলতা ছিল। আধুনিক দর্শন মূলত এমন একটা শ্রেণীবিন্যাসের চর্চা করে যেখানে মূলত দুই জাতের জিনিস আছেঃ এক, মনুষ্য চিন্তা আর দুই, বাদবাকি সবকিছু। অবশ্যই এটা শুনতে যতটা নির্বোধ শোনায় আসলে ততটাও নির্বুদ্ধিতা নয়। যেহেতু ধরে নেয়া হয় যে, মনুষ্য চিন্তাই একমাত্র বিষয় যেটার মাধ্যমে কিনা কোন কিছু সম্পর্কে চিন্তা করাকে সম্ভবপর করে তোলা যায়, যা বাদবাকি অন্যকিছুর ক্ষেত্রে অসম্ভব। এটা আমাদের সেই পুরনো কার্তেসীয় ঐতিহ্যর কথাই মনে করিয়ে দেয় যেখানে দর্শন শুধুমাত্র কাজ করবে চিন্তা আর জগতের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে, আর বিজ্ঞান কাজ করবে বাদবাকি সবকিছু নিয়ে। আমার কাছে মনে হয় এই কার্তেসীয় ঐতিহ্যে একটা গলদ আছে; যেই গলদটাকে আমরা সামনের দিনের দর্শনশাস্ত্রে অতিক্রম করে আসব। আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড ছিলেন অন্যতম একজন দার্শনিক যিনি এই কার্তেসীয় ঐতিহ্যকে চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছিলেন, যেটা কিনা ব্রুনো লাতুরও করতে পেরেছেন অনেকাংশেই। এখন ফেরত আসি আপনার প্রশ্নে—আধুনিক দর্শন কিন্তু সবসময়ই অস্বস্তিতে ছিল যে প্রানী জগৎ নিয়ে সে কি করবে বা কি ভাববে। দেকার্ত মনে করেছিল প্রাণীরা হচ্ছে স্রেফ চিন্তাশূন্য জীব, কিন্তু কেউ-ই এই কথায় পুরোপুরি সন্তুষ্ট ছিল না। এর ফলে দেখা গেলো যে পরবর্তীতে আমরা একটা ত্রি-স্তরের কাঠামো বানালাম যেখানে কিনা একপার্শ্বে থাকবে প্রাণহীন বস্তু, অপরপার্শ্বে থাকবে [চিন্তাশীল] মানুষ আর মাঝামাঝি জায়গায় থাকবে প্রাণীজগত।


কিন্তু সবকিছুকে এই তিনটা স্তরে ভাগ করে ফেলার প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত খুব একটা সুবিধা করতে পারে নাই। যেমন ১৯২৯-৩০ এর লেকচারে হাইডেগার বলছিলেন যে প্রাণীজগতের দুনিয়ার অভাব আছে।এমনকি কোয়েন্টিন মেয়াসুঁও তাঁর লা’একজিস্টান্স ডিভাইন (L’Inexistence divine) বইতে এই ধরনের ফারাক চর্চা করার কারণ পরিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আরও অনেকেই আছেন যারা এই জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে চাইলেও পারেননি। মানুষ আর প্রানীজগতের এই সাদাসিধা ফারাক টানার অভ্যাস থেকে বের হয়ে এসে আমাদের বরং দরকার প্রানীজগতের ভিন্ন ভিন্ন আদলকে ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করা। এদিক থেকে ভাইরাসের বিষয়টা আগ্রহোদ্দীপক, কারণ এটা এমন কিছু যেটা জ্যান্ত আর মৃত’র (না-জ্যান্ত অর্থে) ধারণার মধ্যেকার সীমারেখায় বা সীমারেখার কাছাকাছি অবস্থান করছে। অনেকটা গাছের বীজের মত, আবার গাছের বীজের মত না এই অর্থে যে একটা বীজ যেমন প্রাণের শুরু ঘটায় ভাইরাস সেটা না করে বরং রূপকার্থে অনেকগুলো বীজের জন্ম দেয়। যদিও এই ভাইরাসের উৎপত্তি আর জৈবিকতার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ইতোমধ্যেই অনেক বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে, তবুও আমি মনে করি দর্শনশাস্ত্র এটা নিয়ে বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে অনেক কিছুর প্রস্তাব করতে পারে। এইভাবেই প্রাণীজগত নিয়ে দর্শনশাস্ত্র যখন ভিন্ন কোন প্রস্তাব দিতে সমর্থ হবে তখনই এক অর্থে ধরে নেয়া যাবে যে আধুনিক দর্শন থেকে আমাদের একরকম প্রস্থান ঘটে গেছে।

সমকালীন কন্টিনেন্টাল দর্শনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিকেরা; (বাম থেকে) ইয়েন হ্যামিল্টন গ্রান্ট, গ্রাহাম হারমান, কোয়েন্টিন মেয়াসুঁ এবং রে ব্রেসিয়ার


ধরা যাক যখন আমরা আপনার অবজেক্টের ধারণা দিয়েই কোভিড-১৯কে বুঝতে যাবো, তখন এটা খুবই স্বাভাবিক যে অবজেক্ট হিসেবে এই ভাইরাসের কিছু নিজস্ব গুণাবলী থাকবে। বিজ্ঞানীরা আমাদের জানায় যে, এই ভাইরাসের নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য আছে; এর মাধ্যমে তো তাহলে আমরা এই ভাইরাসের সত্তাগত অবস্থান(ontological status) নিয়েও কথা বলতে পারি। আমরা আরও জানি যে একটা নির্দিষ্ট ধরনের জীব এটাকে সজীব করে তোলে এবং তখন ভাইরাসটা একটা জীবের মতই সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাহলে আপনি মানুষ আর ভাইরাসের মধ্যে এই পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়টাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন—যেখানে কিনা অবজেক্ট হিসেবে মানুষ এমন কিছু একটা যেটা পূর্বের মতন আর গতানুগতিক ‘মানুষ’ নয়, নাকি আপনি এখানে এসব আলাপ বাদ দিয়ে আবারও এরিস্টটলের মতো করেই মানুষকে বুঝতে চাইবেন যেখানে মানুষের নিজস্ব সাবস্ট্যান্স আর অকস্মাৎ গুণাবলী থাকবে এবং এই অকস্মাৎ গুণাবলীসমুহ সত্তার নিজের সাবস্ট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে?


আমার চিন্তা-ভাবনা লিন মারগুলিস(Lynn Margulis)-এর দ্বারা খুবই প্রভাবিত। তিনি Serial Endosymbiosis Theory (SET) এর প্রবক্তা। তাঁর কাজ আমি আমার Immaterialism (২০১৬) বইয়ে ব্যবহার করেছি। মারগুলিস যেকোন কিছুর ধারাবাহিক পরিবর্তনের বিষয়টাকে লক্ষ্য করে বিবর্তনকে বুঝতে চাইতেন না, মানে অন্তত পপুলেশন জেনেটিক্স যেভাবে বিবর্তনকে বুঝতে চায়। বরং একটা নতুন প্রাণের উদ্ভব হয় তখনই যখন অন্য দুইটা ভিন্ন জাতের জীবিত সত্তা পরস্পরের সাথে সিম্বায়োসিসের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে পড়ে। মারগুলিস মনে করেন আমাদের কোষে এমন কিছু অর্গানেল আছে যেগুলো আমাদের ডিএনএ-তে কোডেড (coded) থাকে না এবং যার ফলে এই অর্গানেলগুলো আমাদের শরীরে এক ধাঁচের পরজীবীর মত করে বেঁচে থাকে যা কিনা আবার আমাদের কোষের দ্বারাই উৎপাদিত ও আমাদের শরীরের একটা অংশ হয়েই থেকে যায়। [একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে।] যেমন, ২০১৫ সালে আমি একবার স্টকহোমে যাই একটা লেকচার দিতে। স্টকহোমে আমার ঐ বারের ভ্রমণটা বেশ ভালোই কাটছিল। কিন্তু আসার পথে দেখা গেলো ভাইরাসজনিত কারণে আমার প্রচণ্ড ঠান্ডা লেগে যায়, যেই রকম তীব্র ঠান্ডা আমার সারা জীবনেও লাগে নাই। যদিও আমি এই ভাইরাসজনিত ঠান্ডা থেকে খুব স্বাভাবিক সময়ের মধ্যেই রেহাই পেয়েছিলাম, তবুও এই অসুস্থতা আমার মধ্যে কিছু ছোটখাটো স্থায়ী পরিবর্তন এনেছিল যেহেতু এটা হয়েছিল ভাইরাসজনিত কারণে। যদিও এর কারণে আমার শরীরে যে স্থায়ী পরিবর্তন এসেছে সেটা খুবই নগণ্য, তবুও শারিরীকভাবে এটা আমার মধ্যে এমন একটা পরিবর্তন এনেছে যার কারণে আমি আগের চেয়ে ভিন্ন কিছু হয়ে উঠেছি। ফলে আমি এখন সেই ভাইরাস এবং হারমানের সংযুক্তির মত কিছু একটাতে পরিবর্তিত হয়েছি, যেমনভাবে আমাকে হারমান আর মিশরের একটা সংযুক্তি হিসেবেও ধরে নিতে পারেন যেহেতু আমি মিশরে প্রায় ষোলো বছরের মতন শিক্ষকতা করে এসেছি [কর্মসূত্রে থেকে এসেছি]। মজার বিষয় হচ্ছে ভাইরাসের ব্যাপারে ভাবতে গেলে, এটা মানব শরীরের সবচেয়ে সবচেয়ে অভ্যন্তরীণ অংশে অর্থাৎ কোষে আক্রমণ করে! আপনার প্রশ্নের উত্তরে এরিস্টটলের সাবস্ট্যান্স আর অকস্ম্যাৎ গুণাবলী নিয়ে বলতে গেলে এটা বলতেই হয় যে, এই ভাইরাস এমন কিছু একটা করে যেটা আমাদের সাবস্ট্যান্সকে প্রভাবিত করে। হতে পারে এই প্রভাব কাউকে বেঁচে থাকতে দেয় কিংবা মৃত্যু ডেকে আনে।


বেশিরভাগ দার্শনিকই কিন্তু কোভিড-১৯ এর সত্তাগত অবস্থান নিয়ে চিন্তিত নন, যতটা তারা চিন্তিত এই ভাইরাস আমাদের সামনে কি কি নৈতিক-রাজনৈতিক বিষয়কে অসম্ভব করে তুলেছে সেটা নিয়ে। অন্যভাবে বলতে গেলে, কোভিডের এই মহামারীর সময়ে বসে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা আজাইরা দর্শন না কপচায়ে বরং এই সংকট মোকাবিলার ব্যাপারে বেশি জোর দিচ্ছেন—অন্তত যতক্ষণ না পর্যন্ত এই সংকট আমাদের সামনে থেকে বিদায় নিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত। এইভাবে আজকের দিনে বসে দার্শনিকেরা যে সত্তা নিয়ে চিন্তা না করে নৈতিকতা আর রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করায় বেশি জোর দিচ্ছে—এটার অর্থ কি দাঁড়ায় তাহলে?


ঠিকঠাক মতন চর্চা করতে পারলে দর্শন চর্চা কখনোই আসলে অর্থহীন হয়ে পড়ে না। আমি জানি যে মাঝে মাঝে কিছু বিষয় না চাইতেই আমাদের চোখের সামনে এসে হাজির হয়। কিন্তু যেমন ধরেন এই মুহূর্তে যদি আমার পরিবারের কোন আত্মীয় মৃত্যূশয্যায় পড়ে থাকে, তবুও আমি তখন দর্শন নিয়ে লিখতেই বেশি পছন্দ করবো। অথবা যদি এই মুহূর্তে ক্যালিফোর্নিয়ার লং বিচ এলাকায় (যেখানে আমি এখন বসবাস করছি) ১৯৩৩ সালের মতো আবারো কোন বড় ভূমিকম্প হয় তবুও আমি তখন দর্শন নিয়েই লিখতে পছন্দ করবো; কিংবা আমি যদি এখন প্যারিসে জার্মান অক্যুপেশনের সময় সেখানে থাকতাম তখনও ঐ একই কাজটা করার আকাঙ্খাই করতাম। কিছু সময় থাকে অবশ্য, যখন সময় দাবি করে সক্রিয় হয়ে ওঠাটাকে। কিন্তু করোনাভাইরাসের এই মুহূর্তে এই সক্রিয়তা দেখানোটা বরং অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রাসঙ্গিক যখন বরং কাজের কাজ হবে যদি আমরা বাসায় বসে থেকে নিজেদের নিরাপদ রাখি, বাকিদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখি এবং বাদবাকি প্রয়োজনীয় সবকিছু সংগ্রহে রাখার বিপদজনক রাস্তাগুলো এড়িয়ে চলি। বলতে গেলে লকডাউনের এই সময়টাতো আমার লেখালেখি এগিয়ে নেয়ার জন্য খুবই কাজের হয়েছে, যদিও বলে রাখা দরকার জনস্বার্থের বিষয়াশয় নিয়ে [আলাপে] আমার কোন আপত্তি নাই। তার মানে এও নয় যে আমাদের চিন্তা ভাবনায় আমরা এই মহাসংকটের কোনো ছাপই পড়তে দেবো না, বরং মেওয়া ফলানোর জন্য কিছুকাল সবুর করা লাগে। যেমন আমার মনে হয়, জনস্বাস্থ্য হচ্ছে এমন একটা বিষয় যেটা মুক্তিপরায়ণ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিরুদ্ধে বা বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে আর এদিকে আমেরিকার স্বাস্থ্যব্যবস্থা হচ্ছে নিঃসন্দেহে মুনাফামুখী একটা ব্যবস্থা। এটার পরিবর্তন হওয়া খুবই প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। কিন্তু যখন আমি জনস্বাস্থ্য নিয়ে এই মন্তব্যটা করছি তখন কিন্তু আমি একজন দার্শনিক হিসেবে নয় বরং একজন ভোটার কিংবা অ্যাক্টিভিস্ট রূপে কথাটা বলছি। একজন দার্শনিক একইসাথে একজন অ্যাক্টিভিস্ট হতেই পারেন, কিন্তু তার মানে এই-না যে দর্শনচর্চাকে অ্যাক্টিভিজমের সাথে মিলিয়ে ফেলতে হবে। আমরা এমন একটা সময়ের মধ্যে আছি যখন বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অ্যাক্টিভিস্টরা উচ্চমার্গের সামাজিক মর্যাদা উপভোগ করছে এবং এইটার বিপদটা হচ্ছে এই যে, দার্শনিকদের বিরোধিতা করতে গিয়ে অ্যাক্টিভিজমের এই চর্চাটা পরিণত হয়েছে একধরনের ধর্ম-উত্তর নীতিবাগিশতায়(post-religious moralism)—অনেকটা এরকম যে “জলবায়ু বিপর্যয়ে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাইতেছে আর এদিকে তোমরা ব্যস্ত আছো তোমাদের বিমূর্ত বা মারফতি মার্কা দর্শনচর্চায়।” এই ধাঁচের চিন্তাভাবনাগুলো আসে মূলত আশেপাশে চলতি থাকা আখেরিবিদ্যার পেট থেকে যারা মনে করে, বর্তমান সময়টা হইতেছে এমনই এক অনন্য মুহূর্ত যখন কিনা আমাদের থেকে ‘বাকি কাজ তুলে রাখো’ টাইপের প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করতে থাকে, এমন যেন বাদবাকি যেকোন কাজই হচ্ছে অসাড়। এই রকম কামের ফাঁদে আমাদের পড়া যাবে না আর এরকম হাস্যকরভাবে দর্শনকে অ্যাম্বুলেন্সের হাঁকডাকের মতন ব্যবহার না করাই কাজের হবে।


Speculative Turn বইতে আপনি এরকমটা বলেছেন যে ‘New Materialisms-New Realisms (নব্য বস্তুবাদ-নব্য বাস্তববাদ)’ শিরোনামে যতরকম দার্শনিক চিন্তা এই সময়ে উপস্থিত আছে সেগুলো—মোটাদাগে না হলেও—বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নৈতিকতা আর রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত আলোচনা থেকে বিরত থেকে গেছে। আপনি কি মনে করেন মহামারীর এই সময়টা আপনাকে রাজনীতি বা নৈতিকতা বিষয়ক আলোচনার এই গরহাজির থাকার দূর্বলতা নিয়ে পুনর্বার ভাববার সুযোগ করে দিয়েছে?


ওখানে আমি আসলে এটা বুঝাইনি [বলিনি]। আমরা যেটা বলতে চেয়েছি সেটা হচ্ছে মানুষ এমন কোন কিছু না-যে সে নিজেই একমাত্র বাস্তবের সকল ভাবনা বা অনুধ্যানের কেন্দ্রে অবস্থান করে। আলাপটা এই ছিল যে, নৈতিকতা আর রাজনীতি এমন কিছু না যেটাকে সত্তা বিষয়ক বোঝাপড়ার (ontology) ভরকেন্দ্র হতে হবে। এর মানে এই নয় যে দর্শনে এগুলোর কোন জায়গাই থাকবে না। রাজনীতি আর নৈতিকতা নিয়ে আমি অল্পবিস্তর যা লিখেছি, সবগুলোতেই আমি চেষ্টা করেছি মনুষ্যকেন্দ্রিকতা থেকে যথাসম্ভব সরে আসতে। কিন্তু বলতে গেলে এরকম কোন রাজনীতি বা নৈতিকতা বিষয়ক বোঝাপড়া কখনোই ছিলো না যেটা মানুষকে এই অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া থেকে বিরত থেকেছে। যাইহোক, আমি নিশ্চিত নই যে করোনাভাইরাসের জন্য আমাদের নৈতিকতার নতুন কোন নিয়মাবলীর প্রয়োজন রয়েছে কিনা। প্রতিবারের মত কিছু মানুষ এই লকডাউনে অন্যদের সাথে দায়িত্বশীল আচরণ করছে, আবার অন্যদিকে অনেকেই এই সময়ে স্বার্থপরের মত আচরণ করছে আর এমন সব কাজবাজ করে বেড়াচ্ছে যা বাকিদের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। কিন্তু এই কাহিনী তো নতুন কিছু না। আর রাজনীতির প্রশ্ন তো ভিন্ন ইস্যুঃ ধরুন, কোভিড-১৯ এর সংকট পরবর্তী সময় রাজনীতির চেহারায় বিরাট পরিবর্তন পাবে কিন্তু তার মানে তো আর এই নয় যে এই সংকটকালের যে রাজনৈতিক ব্যাখ্যাগুলো হাজির করা হচ্ছে যেগুলো এই মুহূর্তে যা যা ঘটছে সেগুলোকে তুলে ধরতে পারছে। অবশ্যই আমি মনে করি আমেরিকায় পাবলিক মেডিসিন থাকা প্রয়োজন, যেটার কথা আমি ভেবেছিলাম বেশ কয়েকবছর আগেই। তাই নতুন করে এটা আবারও বলার কিংবা এই বিষয়ে নতুন করে আবারও প্রবন্ধ লেখার কোন মানে দাঁড়ায় না। আমার কাছে মনে হয় দর্শনের যে কোন নতুন ধারণার আগমন ঘটে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর, যার সাথে কারো কাজ করার আনুপাতিক কোন সম্পর্ক নেই। আমি খেয়াল করেছি যে আমার নিজের ক্ষেত্রে প্রতি চার/পাঁচ বছর পর পর একটা নতুন দার্শনিক কন্সেপ্ট [ধারণা] আমার মাথায় আসে যেটার সাথে আমার কর্মনিষ্ঠার [পরিশ্রম/খাটুনির] সম্পর্ক খুবই অল্প। এর একটা কারণ হতে পারে এটা যে আমরা বরং দার্শনিক ভাবনার ভেতর দিয়েই বেড়ে উঠি, সেগুলো নিয়ে কেবল চিন্তা করার চেয়ে। দর্শনে যতরকম নতুন ধ্যানধারণা রয়েছে সেগুলা বামপন্থী ঘরানা থেকেই বেশি আসে, কিন্তু বামপন্থীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দার্শনিকভাবে উনিশ শতকের চর্চা করা ভাববাদ (idealism) দ্বারাই বেশি প্রভাবিত—যেটা চর্চা করা নিয়ে আমার বিশেষ আপত্তি আছে।


আমরা যা জানি যে একটা নির্দিষ্ট সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী নিজেদেরকে কোয়ারেন্টিনে রাখার সামর্থ্য রাখে। কিন্তু এই জনগোষ্ঠীর বাইরে থাকা বিপুল সংখ্যক মানুষকে তাদের জীবনজীবিকা চালিয়ে নেয়ার স্বার্থে অবশ্যই কাজ করতে হয়। তাহলে এই বৈষম্যের পৃথিবীতে কোয়ারেন্টাইন আমাদের জন্য কি অর্থ বয়ে আনে? তাহলে সে অনুযায়ী এই কোয়ারেন্টিনের দিনগুলোতে কিভাবে আমরা ঘরে বসে দার্শনিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে পারি? নাকি আমরা যা করি সেটাই চালিয়ে যাব?


শ্রেণী কাঠামোর এই ঝামেলাটা বেশ গুরুতর। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের শ্রেণী অবস্থা কি এই ক্ষেত্রে? কিছু অধ্যাপক আছেন যারা পারিবারিকভাবেই বিত্তশালী, যদিও তারা সংখ্যায় বেশ অল্প। আমাদের বেতন একেবারে মন্দ না, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের তেমন কোন পুঁজি [সঞ্চয়] নেই কারণ আমারিকাতে শিক্ষার্থী-ঋণ পরিশোধ করতে করতেই আমাদের অনেকগুলো বছর নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু করোনাভাইরাসের সময়টাতে এই আমরা একটা সুবিধাভোগী গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছি যাদেরকে কাজ চালিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে কোন ঝুঁকির মধ্যে পড়তেই হচ্ছে না। আমি বাসায় বসে বসে জুমে ক্লাস নিয়ে খুবই আরামে আছি। আর এই মুহূর্তে আপনাকে আমার রুমে বসে বসেই এই উত্তরগুলো পাঠাচ্ছি, যেটা অবশ্যই পণ্য সরবরাহ করা বা সুপারশপে ক্যাশিয়ারের কাজ করার চেয়ে কম কষ্টদায়ক।


বর্তমান সংকট আমাকে যে কারণে আরও রাগান্বিত করে তোলে সেটা হচ্ছে এই করোনার মধ্যে রাজ্যসরকারের প্রধানেরা লোকজনকে তাদের কর্মক্ষেত্রে ফেরত যেতে আদেশ করছে যাতে তারা বেকার ভাতা দাবি না করতে পারে। এই বিষয়টাই শ্রমিক শ্রেণীকে এমন একটা জায়গায় ঠেলে দিয়েছে যেটা তাদেরকে (এবং তাদের পরিবারের সদস্যদেরও) জানের ঝুঁকি নিয়ে পেটের চিন্তায় নামতে বাধ্য করছে। যার জন্য এই মুহূর্তে স্বাচ্ছন্দ্যে বসে এই সাক্ষাৎকার দিতে আমার কোন নৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে পড়তে হচ্ছে না। আমাদের মধ্যে সবাই-ই কোন না কোন ব্যাপারে বাকিদের চেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান, যেটা নিয়ে আপরাধবোধে ভোগার আমি কোন কারণ দেখি না। আর ভাইরাস আক্রান্ত করার মত যথেষ্ট বয়স যেহেতু আমার হয়েছে, এই মুহূর্তে ঘরে থাকাটাই আমার জন্য শ্রেয়।


আগামবেন তাঁর করোনা বিষয়ক প্রথম লেখাটায় দাবী করছেন যে, জরুরী অবস্থাকে জায়েজ করার জন্য রাষ্ট্রগুলো (বিশেষত ইতালি) করোনাভাইরাসের মহামারীকে উদ্ভাবন করছে যার সাথে অন্যান্য ফ্লুগুলোর বিশেষ কোন ফারাক নাই। আগামবেন যে তাঁর প্রথম লেখাটির প্রতিক্রিয়ার পরবর্তী দ্বিতীয় লেখাটি লিখেছেন তাতেও তিনি তাঁর আগের মেজাজটাই ধরে রেখেছেন, আপনি কি মনে করেন এই বিষয়টা তিনি তাঁর তাত্ত্বিক অবস্থানটাকে ধরে রাখার জন্যই আভিজ্ঞতালব্ধ কিছু ফ্যাক্টকে বিকৃত করেছেন?


আগামবেন তাঁদের মধ্যেই একজন যিনি কিনা এই বর্তমান সংকটের প্রতিক্রিয়ায় তাঁর পূর্ববর্তী অবস্থানটাই ধরে রেখেছেন(doubling down)। এটা যেকোন একটা অকস্মাৎ ঘটনাকে সত্যিকার অর্থে মোকাবেলা করার কোন রাস্তা হতে পারে না। হ্যাঁ, আমরা জানি যে আগামবেন জরুরী অবস্থা নিয়ে যে তর্ক তুলেছেন সেটা বেশ শক্তিশালী। কিন্তু দেখুন, তাঁর নিজের এই অবস্থান আজকে কিভাবে ট্রাম্পের সমর্থকদের সাথে খাপ খেয়ে যায়—যারা মনে করে করোনার পুরো ব্যাপারটাই দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজানোর জন্য সাজানো একটা রটনা(hoax) এবং এর ফলস্বরূপ তারা এখন ট্রাম্পকে পুনরায় নির্বাচনে দাড়া করানোর পায়তারা করে বেড়াচ্ছে। পুরোপুরি সন্তোষজনক না হলেও, ভাইরাস নিয়ে বাদিয়্যুর প্রবন্ধটা বরং বেশি বাস্তবিক ও দায়িত্বশীল। যদিও ব্যক্তিগতভাবে এবং লেখক হিসেবে জিজেককে আমি বেশ পছন্দ করি, তবে ‘জনবুদ্ধিজীবী’ হিসেবে তিনি যে লেখালেখিগুলো করেন সেগুলো পড়া আমি বন্ধ করে দিয়েছি যেহেতু সেগুলো বড্ড অনুমেয় হয়ে পড়েছে। তিনি যেমনটা বলেন যে, “ডানপন্থীরা নয়, বরং মূল সমস্যাটা লিবারালরাই”। এটা একটা আদর্শ গোছের গতানুগতিক লেনিনীয় আলাপ এবং যেটা সমসাময়িক প্রচারমাধ্যমগুলোতে একটা সস্তা শক [বা হতবম্ব করে] দেয়ার কাজই নিশ্চিত করে। এমনকি এই সময়েও জিজেক অনেক নতুন নতুন কনসেপ্ট হাজির করছেন, কিন্তু সাংবাদিকতাধর্মী লেখাগুলোতে সচরাচর সেগুলোর দেখা মেলে না। আমরা এখন এমন দুষ্প্রাপ্য সময়গুলোর মধ্যেই একটা পর্যায় পার করছি যখন আগামবেনের কথা শোনার চেয়ে আমি বরং ইতালীয় সরকারী বিজ্ঞপ্তির ব্যাপারেই বেশি আগ্রহ দেখাবো। আমি এই মুহূর্তে তাদের কথা শুনতেই বেশি আগ্রহী যারা বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত অবস্থায় আছে এবং মূখ্যত এরা হচ্ছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়, ডাক্তার, নার্স, ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও এপিডেমোলজিস্ট। কিছু মুহূর্ত আছে যখন আমাদের দরকার চুপ থাকা ও কি বলছে সেটা শোনা; এবং এই মুহূর্তগুলো যখন আসে তখন তাকে চিনতে পারাটাও জরুরি।


এই সংকট নিয়ে আমেরিকার সরকার ও জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন দেখছেন? প্রসঙ্গত, তুরস্ক নিয়ে আপনার কোন পর্যবেক্ষণ আছে কিনা। আর অন্য কোন বিষয় যদি আমার কথায় বাদ পড়ে যায় সেটাও যুক্ত করলে আমরা উপকৃত হতাম।


ট্রাম্পের ছ্যাচড়ামি নিয়ে যার-ই নূন্যতম জানাশোনা আছে সে নিশ্চয়ই জানে যে আমেরিকার বর্তমান অবস্থা কতটা শোচনীয়। আমার নিজদেশের ভবিষ্যত নিয়ে আমি কখনো এতটা ভীতসন্ত্রস্ত হইনি, যদিও আমি এখনো নভেম্বরের নির্বাচনে তাঁর [ট্রাম্পের] হেরে যাওয়ার প্রত্যাশাই করছি। আমেরিকা বাদে অন্যান্য যেকোন দেশের মধ্যে তুরস্কের ব্যাপারেই আমি সবচাইতে বেশি মনোযোগ দেই, কেননা আমার স্ত্রী একজন তুর্কি এবং আমি তাঁর পুরো পরিবারের সাথেই বেশ ঘনিষ্ট। আমার যেটা মনে হয়, ভাইরাস মোকাবেলায় আমেরিকার চেয়ে তুরস্ক অনেক কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে। মনে হচ্ছে আপনাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বেশ ভালোই এবং যেটা শুনতে পেয়েছি যে যথেষ্ট পরিমাণ মাস্কের সরবরাহ রয়েছে আর সরকারও সেগুলো বণ্টনের কাজ করছে। আমেরিকার তুলনায় তুরস্কের সমাজিক ও পারিবারিক বন্ধন বেশ জোরালো, যেখানে আমেরিকায় একজন মানুষের অন্যজনের উপর নির্ভরশীল হওয়াটাকে অনৈতিক ভাবা হয়। মাঝে মাঝে এই বিষয়টা সাংস্কৃতিকভাবেই কাজের হয়ে উঠে; কিন্তু এখন এটা আসলে তেমন কোন কাজেই দিচ্ছে না।

____________

৬ই মে, ২০২০



অনুবাদকের টীকা

[১] হাইডেগার মনে করতেন প্রাণীর যে আচরণ সেটা সত্তার জন্য উন্মুক্ত নয়, কারণ প্রাণীরা তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশে বাঁধা পড়ে আছে। এই বিষয়টা তিনি ১৯২৯-৩০ সালে দেয়া লেকচারে একটা উদাহরণের মাধ্যমে স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন যে, কোন মৌমাছি যে-মৌচাকে থাকে সেটা যদি তার আগোচরে সরিয়ে নেয়া হয় তখন ওখানে থাকা মৌমাছিগুলো দিশাহারা হয়ে পড়ে। তখন তারা বোঝেনা তারা কি করবে। হয়তো মৌচাক থেকে বের হয়ে সে দেখে যে সূর্য অন্যদিকে উঠে বসে আছে, সে রাস্তা হারায়ে ফেলে। এমনকি কোন গবেষক যদি ছলচাতুরি-কায়দা করে তার পাকস্থলিটা কেটে দেয়, তবুও সে মোমাছি কিছু না বুঝেই মধু আহরণ করতেই থাকে তার মৃত্যূ না হওয়া পর্যন্ত। এই উদাহরণের মাধ্যমে হাইডেগার স্পষ্ট করতে চাইছিলেন যে প্রাণীদের জীবন তার পারিপার্শ্বের দ্বারা বন্দীদশায় আটকানো থাকে, যেখানে মানুষ এর ব্যতিক্রম। একমাত্র মানুষই তার সত্তাকে ঠাওর করতে পারে; সে জগতকে সামনে আনতে পারে, তার একটা চেহারা দিতে পারে আর জগতকে নির্মাণ করতে পারে। ডাজাইন (Dasein) হচ্ছে জগত-নির্মাতা (world-forming) কেননা এটা একটা জগতকে হাজির করতে পারে, যেটাতে প্রাণীরা অপারঙ্গম। সত্তার এই প্রকারের টেম্পোরালিটি প্রাণীজীবনের ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।


[২] কোয়ান্টিন মেয়াসুঁর Correlationism-এর ধারণায় মনে করা হয় যে, আমরা দর্শনশাস্ত্রে সবসময় সত্তা আর চিন্তাকে পরস্পরের সাথে নির্ভরশীল হিসেবেই দেখেছি, যেটা আমাদের একমাত্র যাতায়াতের রাস্তা। কখনোই আমরা এই দুটোর যেকোন একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটাকে ভাবতে পারিনি।

প্রকাশঃ ২৩শে ফাল্গুন, ১৪২৭:::৮ই মার্চ, ২০২১