মহামারীর পরে, আমরা আবার ঘুমিয়ে পড়তে পারি না

ডেভিড গ্রেয়বার




[মৃত্যুর কিছুদিন আগে লেখা একটি নিবন্ধে, ডেভিড গ্রেয়বার মত দেন যে মহামারী-উত্তর কালে, আমাদের আবার আগের মতো সমাজে ফিরে না যাওয়া বিচক্ষণপূর্ণ বা যুক্তিসঙ্গত মনে হয়—কারণ সেই সমাজ এমনভাবে সংঘটিত হয়েছিল যেখানে মুষ্টিমেয় কিছু ধনী লোকের প্রতিটি খোশখেয়ালকে পূরণ করতে গিয়ে আমাদের অধিকাংশকে হেয় ও অবজ্ঞা করা হয়েছিল। ২০২০ এর সেপ্টেম্বরে মাত্র একান্ন বছর বয়সে দুঃখজনক মৃত্যুর আগে অ্যানার্কিস্ট, নৃবিজ্ঞানী এবং সংগঠক ডেভিড গ্রেয়বার কোভিড-১৯ মহামারী পরবর্তী সময়ে জীবন ও রাজনীতির চিত্র কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে এই নিবন্ধটি লিখেছিলেন। চলতি মাসের ৪ তারিখে Jacobin ওয়েব পোর্টাল গ্রেয়বারের নিবন্ধটি David Graeber: After the Pandemic, We Can’t Go Back to Sleep শিরোনামে প্রকাশ করেছে। ডেভিড গ্রেয়বারেরই নিবন্ধটি যৌথভাবে তর্জমা করেছেন কাজী রবিউল আলম ও রাদিয়া আউয়াল তৃষা। অনুবাদকদ্বয় উভয়েই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে পড়ান।]


পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যে সংকটটি শেষ হয়ে যাবে এবং আমরা আবার আমাদের “অসাড় (nonessential)” কাজগুলোতে ফিরে যেতে সক্ষম হব। অনেকের কাছে এটি স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠার মতো হবে।


গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক শ্রেণী নিশ্চিতভাবে আমাদেরকে এই বিষয়ে এইভাবে ভাবতে প্ররোচিত করবে। যেমনটি ২০০৮ সালের আর্থিক বিপর্যয়ের পর ঘটেছিল। তখন একটা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল। (“অর্থ[finance]” আদতে কি? এটা কি শুধুই অন্য মানুষের দেনা নয়? “মুদ্রা” কি? এটাও কি শুধু দেনা নয়? দেনা কি? এটা কি শুধুই একটা প্রতিশ্রুতি নয়? মুদ্রা এবং দেনা যদি আমাদের একে অন্যের প্রতি করা প্রতিশ্রুতির সমাহার হয়, তাহলে আমরা কি সহজেই অন্য প্রতিশ্রুতিও তৈরী করতে পারিনা?) [প্রশ্নের] এই জানালাটা তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে যায় যারা চুপ করে থাকা, চিন্তা বন্ধ করে দেওয়া এবং কাজে ফিরে যাওয়া বা কমপক্ষে এই এগুলোর প্রতি উৎসাহিত হতে জোর দেয় তাদের মারফতে।


শেষবার, আমাদের বেশীরভাগই এর জন্য ধরাশায়ী হয়েছিলাম। কিন্তু এইবার এটি গুরুত্বপূর্ণ যে আমরা তা হইনি।


কারণ, বাস্তবিক আমরা এখন যে সংকটের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি সেটি একটা স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠার মতো। এটা জীবনের একটা প্রকৃত বাস্তবতার মুখোমুখী হওয়া, যেখানে আমরা কিছু ঠুনকো মানুষের সমারোহে একে অন্যের দেখভাল করছি। এখানে যাদের সিংহভাগ দায়িত্ব পালনের কারণে আমরা বেঁচে আছি তাদের উপরেই করের বোঝাটা বেশী, অথচ তারাই কম কম মজুরী পায় এবং প্রাত্যহিক জীবনে অপমানিত হয়। অন্যদিকে জনগণের বিরাট একটা অংশ যারা আদতে কিছুই করে না, কিন্তু উদ্ভট কল্পনার ঘোরের মধ্যে থাকে, ভাড়া আদায় করে, এবং সাধারণভাবে যারা দ্রব্যসামগ্রী তৈরী, স্থাপন, পরিচালনা বা পরিবহন করে বা অন্য জীবসত্তার প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করে তাদের পথের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায়। এটা আবশ্যকীয় যে আমরা এমন কোন বাস্তবতায় ফিরে যেতে চাইবো না যেখানে এই সমস্ত কিছু মিলে একটা ব্যাখ্যাতীত অর্থ তৈরী করে, যেমনটা স্বপ্নের মধ্যে আমরা প্রায়শই অর্থহীন অনেক কিছু করে থাকি।


সেটা কিভাবেঃ যার কাজের দ্বারা অন্যের উপকার হয়, সে স্বাভাবিকভাবে কম পাবে এটাই স্বাভাবিক এই ধরনের চিন্তা থেকে আমরা কেন বের হতে পারি না। অথবা, আর্থিক বাজার যেখানে এই পৃথিবীতে অধিকাংশের জীবনকে ধ্বংস করতে আমাদেরকে চালিত করা সত্ত্বেও সেটাকেই দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে ভালো পন্থা হিসেবে বিবেচনা করা থেকেও বের হতে পারি না।


বরং, এই চলমান জরুরত শেষ হয়ে গেলে, আমরা এখান থেকে কি শিখলাম তা স্মরণ করতে পারিঃ আর সেটা হচ্ছে “অর্থনীতি” বলতে আমরা যদি কিছু বুঝে থাকি তা হচ্ছে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যার যেটা প্রয়োজন তা একে অন্যকে সরবারহ করা। আর এই সরবারহটা যে কোন অর্থেই। অন্যদিকে “বাজার” বলতে আমরা যা বলি তা হচ্ছে মূলত ধনী ব্যক্তিদের সামগ্রিক চাহিদার হিসেব রাখার একটি ব্যবস্থা। আর যেখানে এই ধনী ব্যক্তিদের বেশীরভাগই অন্ততপক্ষে কিছুটা হলেও বিকারগ্রস্থ। এদের মধ্যে যারা আবার সবচেয়ে শক্তিশালী তারা ইতিমধ্যে তাদের পালানোর জন্য বাঙ্কারের পরিকল্পনা করে রেখেছেন। এক্ষেত্রে আমরা যদি এখনো তাদের চাটুকারি কথায় বিশ্বাস করার মতো বোকামি করি—যেটা আমরা সম্মিলিতভাবে করেও ছিলাম—তাহলে আগত বিপর্যয়কে মোকাবিলা করার মতো সাধারণ মৌলিক জ্ঞানও আমাদের আর বজায় থাকে না।


এই সময়ে এসে তাদেরকে কি আমরা উপেক্ষা করতে পারি?


বর্তমান সময়ে আমরা যে কাজগুলো করি তার বেশীরভাগই অলীক-কাজ। এগুলো কেবল এর নিজের স্বার্থের জন্য, অথবা ধনী ব্যক্তিদের নিজেদের সম্পর্কে ভালো থাকার বা গরীব ব্যক্তিদের নিজেদের সম্পর্কে খারাপ থাকার একধরনের অনুভূতি তৈরী করার জন্য বিদ্যমান। আমরা যদি নিছক থেমেও যাই, তবুও আমাদের নিজেদেরকে নিয়ে আরও যুক্তিসঙ্গত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়া সম্ভব হতে পারেঃ উদাহরণস্বরূপ, এমন একটা অর্থনীতি তৈরী করা, যা আমাদেরকে যারা সেবা দিচ্ছে তাদেরকে সেবা দিতে পরিচালিত করে।

____________

৪ঠা মার্চ, ২০২১


প্রকাশঃ ২৮শে ফাল্গুন, ১৪২৭:::১৩ই মার্চ, ২০২১