মহামারীকালের ভারত: করোনাভাইরাস এবং ইতিহাসের উপযোগ

ডেভিড আর্নল্ড



[নিম্নবর্গ অধ্যয়ন বা সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ গ্রুপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ডেভিড আর্নল্ডের Pandemic India: Coronavirus and the Uses of History লেখাটি The journal of Asian Studies এর ৭৯ তম খন্ডের ৩য় সংখ্যায় (আগস্ট, ২০২০) প্রকাশিত হয়েছে। আর্নল্ডের এই লেখাটি অনুবাদ করেছেন সাদিয়া শান্তা। সাদিয়া শান্তা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। এই অনুবাদটির সম্পাদনার কাজটি করে দেয়ায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বখতিয়ার আহমেদের প্রতি বোধিচিত্ত বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।]



ভারতের কোভিড-১৯ এর ঘটনাপ্রবাহের ব্যাখ্যা-বিবরণগুলোতে মোটাদাগে দুই ধরনের বয়ান দেখা যায়। একটাকে বলা যায় "ঐতিহাসিক", অন্যটি "বিদ্রোহী"। আগে ঐতিহাসিক বয়ানটা নিয়ে আলাপ করা যাক। দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় অতীতের শিক্ষা এবং ধারাবাহিকতার ছাপ খুব প্রগাঢ়। মহামারী বিজ্ঞানীদের কাছে কোভিড-১৯ একটি "অভিনব" করোনাভাইরাস, কিন্তু ঐতিহাসিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো এই রোগের আচরণ এবং তার বিপরীতে যে আর্থ-সামাজিক প্রতিক্রিয়াগুলো দেখা গেছে, তাতে নিশ্চিত কোন "অভিনবত্ব" নেই।


২০২০ সালের শুরুর দিকের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষকদের বারবার গত দুইশো বছরে উপমহাদেশে শুরু হওয়া বা বাইরে থেকে আসা মহামারীর এক দীর্ঘ সারির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। ১৮১৭ সালের কলেরা, ১৮৯৬ সালের বুবোনিক প্লেগ, ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মিলিয়ে দেখে অনেকেই খুব সরলকৃত একটি উপসংহার টানছেন যে ‘ইতিহাস নিজের পুনরাবৃত্তি’ ঘটাচ্ছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির ধারণাকে সমর্থন জানাতেই যেন মহামারীবিদরা দীর্ঘদিন ধরেই অনুমান করছিলেন যে ১৯১৮-১৯১৯ এর স্প্যানিশ ফ্লু'র এক শতাব্দী পরে আরেকটা মহামারী—খুব সম্ভবত ইনফ্লুয়েঞ্জা—প্রায় অনিবার্যভাবে আসতে যাচ্ছে। (স্প্যানিশ ফ্লু'তে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর সম্ভবত এক-তৃতীয়াংশ কী এক-চতুর্থাংশ, প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মিলিয়ন মানুষ, মারা গিয়েছিল শুধু ভারতেই।) এক বিলিয়নেরও বেশি জনসংখ্যা, ঘনসবতি, ব্যাপক দারিদ্র ও অপুষ্টি, লক্ষ লক্ষ অভিবাসী কর্মী এবং জরাজীর্ণ জনস্বাস্থ্য অবকাঠামো নিয়ে ভারত এই মহামারীর ছোবলে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হবে সেটা প্রায় নিশ্চিত ছিল। ১৯১৮ সালের ছকে হিসেব করলে তো কয়েক মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে।


সাধারণত 'প্যান্ডেমিক' এবং 'এপিডেমিক'-এর ধারণা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ধরে নিই এপিডেমিকের বৈশ্বিক বিস্তারই প্যান্ডেমিক৷ কিন্তু কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের ফলে সামাজিক গতিশীলতা এবং রাজনৈতিক পুনর্বিবেচনাতে (political reverberation) প্যান্ডেমিক এবং এপিডেমিকের ভিন্ন ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠে। এপিডেমিকের ফলে রাষ্ট্রের সরকার এবং স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলি (health services) জনগণের সুরক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে; অন্যদিকে প্যান্ডেমিক একটি বৈশ্বিক ব্যাপার। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে ভারত প্যান্ডেমিকের প্রচলিত ধারণা পাল্টে দেয়। কলেরা, ডেঙ্গু, পক্স, প্লেগ একের পর এক রোগের ঢেউ আসতে থাকে, যা স্থলপথে ইউরোপের দিকে কিংবা ভারত সাগরের উপকূলবর্তী পরিসীমার দিকে অগ্রসর হয়। বিশ্বায়ন, যা কিনা ভারতের মূলনীতির কেন্দ্র, তা আধুনিক প্যান্ডেমিকের ধারণাকে নতুন আকৃতি দান করে। জাহাজ পথে চলাচল, রেলপথ, বিস্তারমান আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং অভিবাসী শ্রমিকদের যাতায়াতের ফলে মহামারী বিস্তারের গতি ও সংক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে সংবাদপত্র, টেলিগ্রাফ ইত্যাদির মাধ্যমে মহামারীর বৈশ্বিক ভীতি ও সতর্কবার্তা ছড়িয়ে পড়ছিল। ১৮১৭-১৮২৩ এর কলেরা মহামারী পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়তে বছরখানেক সময় নেয়, কিন্তু ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে এসে প্লেগ ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয় মাত্র কয়েক মাস এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা সময় নেয় কয়েক সপ্তাহ!


প্রতিটি মহামারীর ক্ষেত্রেই ভারত ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা রাখে। ঊনবিংশ শতাব্দীর কলেরা মহামারীর সময় ভারত ছিল এর উৎপত্তিস্থল, আবাসস্থল এবং বৈশ্বিক সংক্রমণের উৎসস্থল (যা ব্রিটিশ শাসনের সমালোচকরা ক্লান্তিহীনভাবে বলে যাচ্ছেন)। বুবোনিক প্লেগের সময়, ভারত ছিল চীন থেকে পশ্চিমাভিমুখগামী বের হয়ে আসা রোগের গ্রহীতা। তবে আশঙ্কা ছিল, পাছে ভারতের বন্দরগুলি অতিক্রম করে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দিকে তা অগ্রসর হয়। পরিশেষে দেখা যায়, প্লেগে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বব্যাপী মারা যাওয়ার নব্বই শতাংশই (৯০%) ভারতবাসী। ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রেও ভারত ছিল রোগের গ্রহীতা (recipient)। তবে এবার মহামারীর বিস্তার ঘটলো পশ্চিম থেকে পূর্বাভিমুখে, ইউরোপের যুদ্ধাঞ্চল ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে। প্লেগের সময় যখন কয়েক বছর ধরে কেবল আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছিল, ইনফ্লুয়েঞ্জা সেখানে কয়েক মাসেই মৃতের সংখ্যা বাড়িয়ে তুললো। এই মহামারীতে ভারতে মৃত্যুর সংখ্যা বারো মিলিয়নে গিয়ে ঠেকলেও ভারত তখনো বিশ্ববাসীর মনোযোগ পায়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কবলে পড়ে ভারতের মহামারী পরিস্থিতি দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায়। বিশ্ববাসীর মনোযোগের কেন্দ্র তখন যুদ্ধের করুণ দশা এবং মহামারীতে পশ্চিমা ক্ষয়ক্ষতিতে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। কলেরা এবং প্লেগের সময় ভারতকে কেন্দ্র করে মূল গল্প তৈরী হলেও ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রে ভারত ছিল কেবল একটা পার্শ্ব-দৃশ্য।


উনবিংশ শতাব্দীর কলেরার পর থেকে মহামারী এলেই পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মাঝে সংক্রমণ বিস্তারের দায়ভার নিয়ে একে-অপরকে দোষারোপের একটা বৈশ্বিক ‘ব্লেইম-গেইম’ শুরু হয়। সাথে ‘প্যান্ডেমিক লীগে’ জার্মানীর তুলনায় ব্রিটেন কেমন করলো কিংবা পাকিস্তানের তুলনায় ভারত কেমন করলো টাইপের আলাপ। কলেরা যেহেতু ভারত থেকে ছড়িয়েছিল, অন্য উপনিবেশিক সাম্রাজ্য আর জাতিগুলো তখন ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের দুষেছিল ভারত তথা উৎসস্থলেই কলেরা আটকে রাখতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য, যার মর্মার্থে ছিল ভারতের হিন্দুদের স্নান-উৎসবগুলো আর মুসলমানদের হজ্ব যাত্রার দিকে তোলা অভিযোগের আঙুল, কলেরার পশ্চিমাভিমুখী বিস্তার ও ইউরোপের পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার জন্য এসবকে দায়ী করে। মহামারীর অপবাদমূলক ভৌগোলিক নামগুলো, যেমন- "এশিয়ান কলেরা", "হংকং ফ্লু" এখন আর তেমন প্রচলিত নয়। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারীর ভাবনা জন-মনে এখনো একই রকম প্রভাব ফেলে।


১৮৬৬ সালে আন্তর্জাতিক স্যানিটারি কনফারেন্সে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আদিরূপ) ব্রিটিশ ভারতের স্বাস্থ্য-সুরক্ষার ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংশোধন করার ও মহামারী রোগ প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করা হয়। এই চেষ্টার উদ্দেশ্য ছিল "প্রাচ্য থেকে আসা অচেনা রোগের সংক্রমণ" থেকে ইউরোপকে রক্ষা করা। ফলে মুক্ত বাণিজ্য ও দেশ বিদেশে অবাধ যাতায়াতে বাধা সৃষ্টির কারণে ব্রিটিশদের আপত্তি থাকলেও পরিদর্শনমূলক ব্যবস্থা ও সঙ্গ-নিরোধ (কোয়ারেন্টিন) এর মত কিছু ব্যবস্থা টিকে যায়। কিন্তু এসব পদক্ষেপের মূলে ভারতকে মহামারী উত্তরণে সহায়তার চেয়ে যে প্যানডেমিক-এশিয়া থেকে ইউরোপ আর উত্তর আমেরিকাকে আলাদা রাখার উদ্দেশ্য সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়। লক্ষণীয় যে, ১৮৯৬ সালে বোম্বেতে (মুম্বাই) বুবোনিক প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে ১৮৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি এবং মার্চে ভেনিস কনফারেন্সে স্বাস্থ্য-সুরক্ষার জন্য পরিচ্ছন্নতা অভিযানের দাবি তোলা হয় এবং চটজলদি ব্রিটিশরা পদক্ষেপ না নিলে ভারতের সাথে সমুদ্র বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা জারির হুমকি দেয়া হয়। ফলে ১৮৯৭ সালে "এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট(Epidemic Diseases Act)" নামে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়, যা ১২৩ বছর পরে পুনরুজ্জীবিত করে প্রায় একই রকম সঙ্কট মোকাবেলা করার জন্য বর্তমান ভারত সরকার নতুন করে প্রয়োগ করছে।


সাম্প্রতিক মহামারী পরিস্থিতিকে ১৮৯৬ ও ১৮৯৭ সালের ভারতের মহামারী পরিস্থিতির সাথে খুব সহজেই তুলনা করা যায়। ভারতে তখন (এখনকার মতোই) এক বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছিল। মহামারীর ভয়ে এবং মহামারী ঠেকাতে ব্রিটিশ কর্তৃক ব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে বিপুল সংখ্যক দরিদ্র ও শ্রমিক শ্রেণী পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। বাড়ি থেকে ভাড়াটিয়াদের তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। সন্দেহভাজন সংক্রমিতদের বাড়ি কিংবা রাস্তা থেকে তুলে এনে হাসপাতালে ভর্তি করানো হচ্ছিল। কখনো বা সন্দেহভাজনদের বাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। রেলপথের যাত্রীদের যেখানে সেখানে পাশবিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছিল। রাষ্ট্রের জনগণও এমন পরিস্থিতিতে দাঙ্গা বাধিয়ে তোলে। তারা ডাক্তার ও এম্বুলেন্সের উপর আক্রমণ করতে থাকে। রাস্তার ধারে ধারে প্রতিদিন লাশের পাহাড় জমতে থাকলে লাশের সৎকার ব্যবস্থায়ও নিষ্ঠুরতা দেখা যায়। (দেখুন ফিগার-১ ও ফিগার-২) তবে তখনকার মধ্যবিত্ত শ্রেণী "নিজেদেরকে সরিয়ে রাখা(self-isolating)"র মাধ্যমে রোগের সংক্রমণ থেকে নিজেদের বিরত রাখতে পারতো। এটা অংশত সম্ভব হয়েছিল ১৮৯০ এর দশকে “বর্ণভিত্তিক হাসপাতাল(caste hospitals)” প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তারা জাত-পাত, ধর্ম, শ্রেণীর দোহাই দিয়ে নিজেদের আলাদা রাখতে পারতো। মধ্যবিত্তদের জন্য তখন এই জাত-পাতের ভেদাভেদ এক ধরনের বিশেষ সুবিধা হয়ে উঠেছিল। দরিদ্র বস্তিবাসী এবং অভিবাসীদের জন্য "সেল্ফ-আইসোলেটিং" ছিল (এবং এখনও তা-ই) এক অবাস্তব কল্পনা মাত্র। তারা রোগ আর রুজি হারানো দুইয়েরই শিকার হয়েছিল।