মহামারী কি আমাদের গণতন্ত্র শেখাবে?

এক্সেল হোনেথ-এর সাক্ষাৎকার



[জার্মান দার্শনিক এক্সেল হোনেথ (Axel Honneth) ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয় ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। ২০০১ থেকে ২০১৮ সাল অব্দি পরিচালক ছিলেন "Institute for Social Research"-এর, যা কিনা "ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল" নামেই সমধিক পরিচিত। The Critique of Power: Reflective Stages in a Critical Social Theory গ্রন্থটি তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এই গ্রন্থে তিনি ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল ও মিশেল ফুকোর কাজের মধ্যকার সম্বন্ধ বিচার করেছেন। এছাড়াও "রিজন" ও "ক্রিটিক" প্রসঙ্গে ইয়ুর্গেন হেবারমাস ও ফুকো এবং তাঁদের উত্তরসূরীদের বিতর্কের সংকলন (Critique and Power: Recasting the Foucault/Habermas Debate) গ্রন্থের অন্যতম কন্ট্রিবিউটর তিনি। করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে অতিসম্প্রতি তিনি এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। Will the pandemic teach us democracy?-An interview with Axel Honneth শিরোনামে হোনেথের সাক্ষাৎকারটি গত ৪ঠা নভেম্বরে EUROZINE ওয়েবপোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে। এই সাক্ষাৎকারে এক্সেল হোনেথ দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, মহামারী নিয়ন্ত্রণে সরকারগুলো তাদের সমস্যাগুলো প্রকাশের বিষয়ে যত বেশি স্পষ্ট হবে, তত বেশি এর গণতান্ত্রিক সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কিন্তু মানুষ যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে সরকারের পদক্ষেপগুলো অযৌক্তিক, তবে সেটির ফলাফল গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও বেশী অবিশ্বাস তৈরী করবে। জার্মান দার্শনিক এক্সেল হোনেথের এই সাক্ষাৎকারটি যৌথভাবে অনুবাদ করেছেন কাজী রবিউল আলম এবং রাদিয়া আউয়াল তৃষা। অনুবাদকদ্বয় উভয়েই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে পড়ান।]



করোনাভাইরাসের সংকট দেখিয়েছে যে এটাকে নিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা জড়িত, যাকে বিজ্ঞানও পুরোপুরি বিচার-বিবেচনা করতে পারেনি। একটি ব্যাধি এবং তার সামাজিক প্রভাব নিয়ে একজনের পক্ষে সবকিছু জানা সম্ভব নয় সেটা স্বীকার করা কি কোন অক্ষমতার প্রকাশ? অথবা এগুলোকে গণতান্ত্রিক সমাজের একটি গুণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, কারণ সেগুলো অনিশ্চয়তাগুলোকে ইতিবাচক উপায়ে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়?


গত কয়েকমাস ধরে দেশগুলো যেভাবে করোনাভাইরাস সংকটকে মোকাবিলা করেছে, সেটি তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক মানের একটি সূচক হয়ে উঠেছে। একটি সরকার যত বেশী অকপটে, সর্বসমক্ষে এবং আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে এই সংকট নিয়ন্ত্রণে তাদের সমস্যাগুলোর কথা প্রকাশ করে, তত বেশি এর গণতান্ত্রিক সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তবে, এই [সম্ভাবনার] বিকাশ কর্তৃত্ববাদী ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে কেবল মেরুকরণকেই প্রকাশ করেনা, বরং এটি একটি ক্রমান্বয়িক মাপকাঠি। স্বাধীন স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সরকারের সমর্থনে যত বেশি তাঁদের বিচার-বিবেচনা, উদ্বিগ্নতা এবং প্রস্তাবনাসমূহ জনসম্মুখে তুলে ধরতে পারে, তত বেশি গণতান্ত্রিকভাবে মজবুত ও উন্নত রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছে বলে মনে হয়। এই ক্ষেত্রে, ট্রাম্প প্রশাসন চীনা প্রশাসনের চেয়ে ভালো ভূমিকা পালন করেছে। অনেক অনেক ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও, এটা কমপক্ষে কিছু স্বাধীন বিশেষজ্ঞকে জনসম্মুখে তাঁদের মতামত তুলে ধরতে সুযোগ দেয়। আটলান্টিকের অন্যদিকে, বেশীরভাগ ইউরোপীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের তাঁদের ভিন্ন মতামত প্রকাশ ও তুলে ধরার সুযোগকে উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনকে ছাড়িয়ে যায়।



এর মধ্যে কোন ব্যবস্থাটা সংকট নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে বেশী কার্যকর সেই টেকনিক্যাল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। আমাদের জানার উপর ভিত্তি করে বলা যায়, দুইটা প্রান্তই খুব ভালো করেছে। একদিকে, চরম কর্তৃত্ববাদী চীনা সরকার রয়েছে, যার ভাইরাস বিস্তার রোধে ব্যবস্থা নেওয়ার কেন্দ্রীয় ক্ষমতা রয়েছে। অন্যদিকে, সীমিত পরিচালনা-ক্ষমতার কিন্তু একটি মুক্ত, জনবিতর্কসম্পন্ন তুলনামূলক গণতান্ত্রিক ইউরোপীয় সরকার রয়েছে। যে দেশগুলি সবচেয়ে খারাপভাবে কাজ করেছে তারা হলেন [ডোনাল্ড] ট্রাম্প এবং [জাইর] বলসোনারো’র মতো ডানপন্থী জনতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতিদের নেতৃত্বে পরিচালিত কর্তৃত্ববাদী গণতন্ত্র, উভয়েই প্রথমে এই সঙ্কটকে অস্বীকার করে এবং পরে কোনও বিশেষজ্ঞের উপর নির্ভর না করেই দুর্বল কল্পনাশক্তি-নির্ভর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। দীর্ঘমেয়াদে, আমি আশা করি যে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকারগুলি সঙ্কট পরিচালনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল করবে। যা সম্ভবত স্বাধীন স্বাস্থ্যগবেষকের সাথে সংলাপের মাধ্যমে গৃহীত ব্যবস্থা এবং টিকা ও চিকিৎসা—তাদের সংশ্লিষ্ট জনগনের মধ্যে সমানভাবে বিতরণের আগ্রহের ফলস্বরূপ ঘটবে।



করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় সরকারী পদক্ষেপের প্রতি জনগণের আস্থা দেশে-দেশে বিভিন্ন রকম হয়। বর্তমানে ফ্রান্সের চেয়ে জার্মানিতে আস্থার মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি। যদিও বার্লিনে গৃহীত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভও হচ্ছে, কারণ অনেকে মনে করছেন গৃহীত ব্যবস্থাগুলো ‘স্বাধীনতা-বিরোধী’। এই সংকট কিভাবে আমাদের আইনের শাসন ও জনস্বাস্থ্যের মধ্যকার সম্পর্ককে পুনর্ভাবনায় উৎসাহিত করতে পারে? গৃহীত ব্যবস্থা এবং স্বাধীনতার উপর বিধিনিষেধ চিকিৎসাবিষয়ক উদ্যোগে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ফলাফল, নাকি সেটি আমাদের সমাজে ব্যক্তি জীবনের মূল্যবোধ নিয়ে নতুন ধরনের বিবেচনাকে প্রতিফলিত করে?



এই সংকট গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাগুলোকে তাদের নৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মূল্যবোধগুলোকে প্রকাশ্যে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে। আর রাজনৈতিক মূল্যবোধগুলো লিখিত বা অলিখিত সংবিধানের উপর দাঁড়িয়ে আছে। সর্বাপেক্ষা কার্যকর সরকারও ব্যাপকভাবে একটি সুসজ্জিত, সরাকারী তহবিল দ্বারা পরিচালিত এবং স্বচ্ছ স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল—সেটির অনুধাবনই এই ধরনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফলাফল হিসেবে দেখা দেয় বা দেখা দিতে পারে। এটার(স্বাস্থব্যবস্থার) এই ধরনের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ কারও সামাজিক অবস্থান, যৌনতা বা সাংস্কৃতিক পরিচয় বিবেচনায় না নিয়ে নির্বিশেষে সবাইকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা। আমার অনুমান ও আশা এই-যে আমরা একটি ঐতিহাসিক বিকাশের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাব। আর এটি হবে ফুকোডিয়ান ‘জৈব-ক্ষমতা’-এর দৃষ্টান্তের সমর্থকরা যা পূর্বাভাস করেছিলেন তার বিপরীত একটি বিষয়। এখানে শুধু শারীরিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য জনগণকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার করার উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়ন করা হবে না। বরং এর পরিবর্তে সকল নাগরিকের মহামারীর ঝুঁকি মোকাবেলা ও দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিশেষজ্ঞদের স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় জ্ঞানের রাজনীতিকরণ ঘটবে। যখন একটি জরুরী কার্যকর স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রয়োজন ঠিক সেই সময় ফুকোডিয়ান বুদ্ধিজীবীদের বিজয়োল্লাসের আক্ষেপের চেয়ে অশ্লীল আর কিছু হতে পারে না। আর এই বুদ্ধিজীবিরা যুক্তি দেন যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান জৈব-ক্ষমতা আমাদের শারীরিক জীবনকে অধিকার করবার মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতাকে ক্রমাগতভাবে সীমাবদ্ধ করে চলেছে। বিপরীত দিকটিই বরং সত্য বলে মেনে নেয়। আমরা, জ্ঞাত সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকরা ভাইরাসের শারীরিক বিপদ থেকে রক্ষা পেতে একে অপরকে সহযোগীতামূলক সাহায্য করবার উদ্দেশ্যে কিছুটা স্বাধীনতার খর্বকে স্বেচ্ছায় মেনে নয়; কিন্তু কোনভাবেই আমাদের নাগরিক স্বাধীনতার বিপর্যয়কর সীমাবদ্ধতাকে কোনভাবেই মেনে নেই না।



গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে আপনার লেখায়, আপনি স্বাধীনতার ধারণাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন, যেটাকে আপনি কেবল আনুষ্ঠানিক বা আইনীভাবে সংজ্ঞায়িত করেন নি। আপনার কাছে, এর অর্থ এই যে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা আইনী বোঝাপড়ার বাইরের একটি বিষয়; এটা সামাজিক জীবনের সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য (পারিবারিক এবং পেশাদার উভয় জীবনের ক্ষেত্রেই।) কিন্তু এটা স্বাধীনতার একটি ‘আনুভূমিক’ বোঝাপড়া কি-না, যা জনগনের কার্যকর অংশগ্রহণ এবং একটি জনপরিসর গঠনের উপর নির্ভর করে, (এবং) যা বর্তমানে একটি উলম্ব বা খাড়াখাড়ি ক্ষমতার চর্চার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন?



রাজনৈতিক শক্তির আনুভূমিক চর্চার সুযোগ, আপনি যেমনটি যথাযথভাবে উল্লেখ করেছেন, বিশ্বের অন্যান্য অংশ বাদ দিলেও, ইউরোপেও তা গত কয়েক দশকে ভালোভাবে হয়নি। এখানে কারও বিভ্রান্তি থাকা উচিৎ নয়। গত চল্লিশ বছরে যা উন্নতি হয়েছে তা হ’ল পরিবারের মধ্যে সাম্যতা ও অংশগ্রহণের সম্ভাবনা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মধ্যে বন্ধুত্বের গণতান্ত্রিক সম্ভাবনা। একই সময়ে, নব্য-উদারনৈতিক সংস্কারের ফলে কর্মক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনাগুলো মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে।



গণতান্ত্রিক জনপরিসরের পরিস্থিতি সমানভাবে খারাপ। রাজনৈতিক দলগুলো বেশ কয়েকটি কারণে বেশ খারাপ অবস্থায় রয়েছেঃ বয়স্কদের দলের সদস্য হওয়া ও নির্বাচনে জয়ী হওয়ার বিষয়ে অটলতা; অর্থনৈতিক বেসরকারীকরণের কারণে সরকারী গণমাধ্যমের সঠিক তথ্য জানাতে ব্যর্থতা; কাজের ধরনের কারণে একটি ব্যাপক সংখ্যক জনগণের অংশগ্রহণের কার্যকর ক্ষমতা না থাকা। গণতান্ত্রিক জনসমাজের উপর মহামারীর প্রভাব অত্যন্ত অস্পষ্ট। একদিকে, সংকটের বিরুদ্ধে দ্রুত এবং একাগ্র ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনে ক্ষমতার উল্লম্ব(vertical) অনুশীলন শক্তিশালী হয়েছে। অন্যদিকে, সরকারগুলো জনগণের সমর্থন ও অংশগ্রহণের উপর অনেক বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে—ফলে নার্স, আবর্জনা সংগ্রহকারী ও পরিবহন শ্রমিকদের মতো কিছু নির্দিষ্ট কর্মী এবং পেশা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যাদের সক্রিয় সহযোগীতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল (এই ধরনের শ্রমের অপ্রত্যাশিত পুনর্মূল্যায়নের ফলাফল কি হবে তা এত দ্রুত বোঝা যাবে না)। এই সংকটকালে, সামাজিক সুসংহতকরণের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে, অত্যন্ত সেই দেশগুলোতে যেখানে নাগরিকরা অনুধাবন করতে পেরেছে যে তাঁরা একে উপরের উপর আসলে কতটা নির্ভরশীল। আপনারা যেমনটি দেখতে পাচ্ছেন, এ বিষয়ে আমার কোন সুস্পষ্ট উত্তর জানা নেই। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া যার মধ্যে আমরা এই মুহূর্তে বেঁচে আছি। এর অনেক কিছুই পরিবর্তন হতে পারে।


ফ্রান্সে ঔষধ সরবরাহের ক্ষেত্রে সমস্যাগুলি সার্বভৌমত্বের ধারণাটিকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে। ডানপন্থীদের কাছে এটি জাতীয় সার্বভৌমত্বের বিষয় আর বামপন্থীদের কাছে লোকপ্রিয় সার্বভৌমত্বের বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে বিশ্বায়নের সময় রাজনীতি যে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় শক্তিহীন এই বোধের প্রতিক্রিয়া বলে মনে করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, সার্বভৌমত্ব এবং এর বিপরীতে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক প্রকল্প হিসাবে সমর্থন দেওয়া ইউরোপ একত্রীকরণ এবং ফেডারেলিজমের (বিতর্কের) ইস্যুটি একটি কেন্দ্রীয় জায়গা করে নিয়েছে। এমন কোন সার্বভৌমত্বের ধারণা কি আছে যা রাষ্ট্র নির্ধারিত আইনি সীমার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?



এটা খুব কঠিন একটি প্রশ্ন। মহামারীর শুরুতে মনে হচ্ছিল যে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে নাগরিকদের জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীভূত কর্তৃত্ব ও ক্ষমতাসম্পন্ন অতিপ্রবল জাতিরাষ্ট্রগুলোই কেবল একমাত্র সফল কর্তৃপক্ষ হবে। যাইহোক, প্রারম্ভিক গৃহীত ব্যবস্থাগুলোর পরবর্তীতে এই ধরনের ‘সার্বভৌম’ প্রতিক্রিয়ার পরিণতি দৃশ্যমান হয়ে উঠছিল। কিছু ইউরোপিয় দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থা এত খারাপ অবস্থায় ছিল যে তারা খুব দ্রুত হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল এবং তাদের প্রতিবেশী দেশ থেকে সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছিল। সীমান্ত বন্ধ করবার সিদ্ধান্তের বিষয়েও আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের প্রয়োজন হয়। পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়ন জুড়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে দুর্বল সদস্য দেশগুলোকে সাহায্য করবার ক্ষেত্রে ইউরোপীয় দেশগুলোর উপর অর্থনৈতিক চাপের বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। এটা কোন নৈতিক অর্ন্তদৃষ্টি কিংবা বিদ্যমান সৌহার্দ্যের অনুভূতি থেকে উদ্ভূত হয়নি। এটা ছিল কেবলই একটি গতানুগতিক হিসেব-নিকেষের ফলাফল: তারা যদি সবাই ত্রাণ তহবিলে তাদের জিডিপির সমানুপাতিক পরিমাণ হারে চাঁদা দেয় তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সকল সদস্য রাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে দীর্ঘমেয়াদে অধিক সঙ্গতিসম্পন্ন হবে। এমনকি ইউরোপের জাতীয় সার্বভৌমত্বের কট্টর সমর্থকরাও এখন বুঝতে পেরেছে স্বল্প মেয়াদে হলেও ক্ষমতার পর্যায়ক্রমিক স্তরায়ন জরুরী। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি ফেডারেল রাষ্ট্রও হয়তো মেনে নিতে পারে যে আঞ্চলিক এবং পৌর পর্যায়ে কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া এখন আরও বেশি যথাযথ এবং বিচক্ষণতার।



ইউরোপীয় ইউনিয়নের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের বিকেন্দ্রীকরনের অর্থ হলো এই যে প্রতিটি সদস্যকে একইসঙ্গে বিভিন্ন “বৈধ সম্প্রদায়”-এর অথবা, আপনাদের ভাষায় বলতে গেলে বিভিন্ন “বৈধ রাষ্ট্রের” সদস্য হওয়া শিখতে হবে—যাদের প্রত্যেকের নিজস্ব সাংবিধানিক নিয়ম এবং আইন রয়েছে । এটি একেবারে অকল্পনীয় কোন বিষয় নয়। আমরা কি একই সঙ্গে বিভিন্ন বৈধ কতৃপক্ষের কাছে আমাদের সমর্পণ করার বিষয়টি খুব দ্রুত আয়ত্ব করছিনা? যেমন, একটা বৈধ রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার সাথে সাথে আমরা কি একটি আংশিক স্বায়ত্বশাসিত শহরেরও বৈধ সদস্য নই? কেন আমরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন আরও একটি আংশিক সার্বভৌম বহুজাতিক সংস্থার সদস্য হয়ে এই জটিল আইনী আত্ম-উপলব্ধিকে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হবো না? আমার মতে, রাজনৈতিক যুক্তিতর্ক কেবলমাত্র জাতীয় সার্বভৌমত্ব (যা জাতি অথবা জনগণ যেকোন কিছুর ভিত্তিতে গঠিত হতে পারে) এবং একে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা একটা অতিপ্রাকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন সংস্থার মধ্যে কেবল একটিকেই বিকল্প হিসেবে সম্মতি দেয়। এটা খুবই সরল এবং আমরা বর্তমানে যে ধরনের পৃথিবীতে বসবাস করছি সেটির রাজনৈতিক জটিলতার সঙ্গে মেলে না ।


আপনি প্রায়শই আন্তঃব্যক্তিক(interpersonal) স্বাধীনতার বর্তমান অগ্রগতি (যেমন, ব্যক্তিগত পরিসরে) এবং জনপরিসরের ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার সুনিশ্চিত হ্রাসের মধ্যকার ব্যবধানের উপর গুরুত্বারোপ করেন। এই ব্যবধান নিরসনে আপনি “রাজনৈতিক স্বাধীনতা”-এর ধারণা প্রস্তাব করেন যা গনতান্ত্রিক আদর্শকে অভিজ্ঞতায় গাঁথবার উদ্যোগ। বর্তমানে সময়ে আমরা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে ব্যক্তিজীবন এবং জনপরিসর উভয়ই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, সেটা কি এই ধরনের মনোভাবকে উৎসাহিত করতে সক্ষম?



নাগরিক হিসাবে চলমান মহামারী থেকে আমরা কি শিখেছি তা বিচার করার সময় এখনো আসেনি। আমি অনেকটা নিশ্চিত যে আমাদের মধ্যে অনেকেই গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত নিয়মগুলো মেনে চলার জন্য সঙ্গী নাগরিকদের বিশ্বাস করতে পারার গুরুত্ব কতখানি তা ইতিমধ্যে শিখে ফেলেছে। সাবওয়েতে মাস্ক পরতে রাজি নয় এমন লোককে সম্মিলিতভাবে তিরস্কার করছে এমন একদল লোকের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাওয়া কতই না আশ্বাসদায়ক। এই প্রেক্ষিতে, প্রাত্যহিক জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে তেমন ধরনের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিতে জনগণকে সক্ষম করে তোলার ক্ষেত্রে এই মহামারীর একটি ফলপ্রসূ এবং হিতকর প্রভাব রয়েছে। আর এটি সম্ভব হয় একটি গণতান্ত্রিক ‘আমরা’ পুনঃপ্রতিষ্ঠা অথবা এই ধরনের সিদ্ধান্ত আপনার নিজের শারীরিক সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা স্পষ্ট করবার মাধ্যমে।



আর এটি যদি সত্যি হয়, তাহলে অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা পুনঃসৃষ্টি করবার সম্ভাবনা মহামারীর আছে। কিন্তু, তারপরেও, এখনো এটিকে বিচার করবার সঠিক সময় আসেনি। একইরকমভাবে এর বিপরীতটাও ঘটতে পারে, যদি বেশিরভাগ মানুষ এই সিদ্ধান্তে পৌছে যে মহামারী নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য জাতীয় সরকার বা ইইউ যে সমস্ত পদক্ষেপ করেছে তার সমস্তই অযৌক্তিক, যা এমনকি আদতে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত-গ্রহণে আরও বেশি মাত্রার অবিশ্বাস তৈরী করতে পারে। অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান দূর্বলতা এবং নিঃশব্দ অন্তর্ধানকে ভারসম্যপূর্ণ করবার জন্য বিভিন্ন বিকল্প রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দুইটি উপায় হলো পাবলিক বিদ্যালয়গুলোতে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক শিক্ষা ফিরিয়ে নিয়ে আসা এবং কর্মক্ষেত্রগুলো গণতান্ত্রিক করবার চেষ্টা করা। সামাজিক স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নিয়ে এখনকার যে সংগ্রাম, যাইহোক, সেখানে আমরা একটি ভালো ধরনের গণশিক্ষা এবং একটি নায্য, অধিকতর ইনক্লুসিভ শ্রমবিভাজন তৈরী করতে ডুর্খেইম এবং জন ডিউই-এর লড়াইয়ের বাইরে খুব বেশিদূর এগোতে পারিনি।

____________

৪ঠা নভেম্বর, ২০২০


প্রকাশঃ ৯শে পৌষ, ১৪২৭:::৩রা জানুয়ারি, ২০২১