মানুষ হওয়া বলতে আমরা কি বুঝব?

এতিয়েঁন বালিবার


["মানুষ হওয়া মানে কি? (Being Human?)" এবারের ৩২তম ফোরাম ফিলো' ২০২০ (Forum Philo Le Monde Le Mans - 2020) এর আলোচ্য বিষয়। ফরাসি মার্কসীয় দার্শনিক এবং আলথুসারের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উত্তর-সাধকদের মধ্যে অত্যতম দার্শনিক এতিয়েঁন বালিবার (Etienne Balibar) প্রজাতির ধারণার মারফতে এটিকে বুঝতে চেয়েছেন। প্রজাতি হিসেবে মানুষের স্বতন্ত্রতা বা অনন্যতা এবং জীববিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র ও নৃবিজ্ঞানের ক্রসরোড বা তেমাথা’য় চলমান মহামারীটি যেভাবে আমাদের অস্তিত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয় বালিবার সে বিষয়ক ভাবনাচিন্তায় আগ্রহী। ভার্সো (Verso) ব্লগে ডেভিড ফেয়ার্নবাখ কৃত ইংরেজি অনুবাদে বালিবারের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে গত মাসের পনের তারিখে। ফেয়ার্নবাখ কৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে এটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন ইয়াসির আরাফাত বর্ণ। বর্ণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।]


ফিলো ফোরামের (Forum Philo) এ বছরের প্রশ্নটি খুবই সাদামাটা : ‘মানুষ হওয়া মানে কি?’ অন্যভাবে বললে, এটি হচ্ছে আমাদের নিজেদের জন্যে প্রত্যেকে এবং একসঙ্গে (পরস্পরের জন্যে, পরস্পরের সাথে) ‘আমরা [আসলে] কী’ সে সম্পর্কিত। এই গতানুগতিক ক্লিশে সূত্রগুলোর বাইরেও, সকলেই জানেন যে এখানে একটি সমস্যা আছেঃ এই ‘আমরা’ টা কে? আমরা যখন ‘আমরা’ বলি তখন আদতে কী বোঝাতে চাই? এবং কিসের বা কার নামে কথা বলছি আমরা? যাদেরকে আমরা সহ-মানব বলে অনুভব বা বোধ করি তাদেরকে একত্রিত করার দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে একজন যখন নিজেকে দাঁড় করায় তখন মানবতা, মানবজাতি, জনসংখ্যা এবং প্রজাতি’র মত ধারণাগুলো ভাবনায় আসে।


এই সমস্ত ধারণাগুলোর মধ্যে, আমি প্রজাতি’র ধারণার দিকে মনোনিবেশ করছি যা এই সময়ে আমার কাছে স্বচ্ছভাবে সংজ্ঞায়িত মৌলিক প্রশ্ন বলে মনে হয়। আমি এর অর্থ, ব্যবহার, কুলজি বা সিলসিলা’র প্রতি মনোযোগ দিতে চাই। কারণ এটি স্পষ্টভাবেই বলা যায় যে, কোন দার্শনিক চাইলে সমস্ত রকমের উপলব্ধ জ্ঞান ব্যবহার করে কোন সমস্যা অনুসন্ধানের চেষ্টা করতে পারেন। এটিও প্রাসঙ্গিক, আমরা যে (এই উদ্বেগজনক কোভিড-১৯ মহামারী’র) নানাবিধ অসুবিধা ও সমাপ্তির ভাবলক্ষণ বা পূর্বাভাসহীনতার মধ্য দিয়ে পার করছি তা জীববিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র ও নৃবিজ্ঞানের ক্রসরোড বা তেমাথা’য় একধরনের কৌশলগত ক্রিয়াশীলতা প্রদান করেছে। জীবিত প্রজাতি হিসেবে কোন জিনিস মানবতাকে অনন্য বা স্বতন্ত্র করে তুলেছে (বা তোলে নি) এবং ‘প্রজাতি’ বলতেই বা আমরা কী বুঝি’র মতো পাশ্চাত্যের অধিবিদ্যা ও প্রাকৃতিক ইতিহাসের চর্চার সমান বয়সী পুরোনো প্রশ্নগুলিকেও এটি একইসাথে তুলে এনেছে। কোন ধরনের ঐক্য, বৈচিত্র্যতার কোন প্রান্তিকতা, বিবর্তন বা রূপান্তরের কোন প্রত্যাশাকে এটি চিহ্নিত করেছে?


যতটা দ্রুত সম্ভব অগ্রসর হয়ে, মোট তিনটে হাইপোথিসিস [প্রস্তাব] আমি দাঁড় করাব। এর প্রথমটি ঐক্যের প্রশ্নের সাথে যুক্ত। ‘প্রকৃত সময়’-এ আমাদের চোখের সামনেই, আমরা স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে মেনে চলি অথবা এমনকি কোন ‘সারসত্তা’র (‘বিশেষায়িত মানুষ’ কী বস্তু) কথাও বলে না যাতে আমরা অংশগ্রহণ করি (আমাদের মধ্যে ব্যাপ্ত ‘জিন-পুল’-এর আকারেও) কেবলই এমন এক ধরন বা প্রকরণকে মানব প্রজাতি আর নির্দেশ করছে না। এটি নজিরবিহীন তীব্রতা ও সর্বজনীনতার এক রকম বস্তুগত আন্তঃনির্ভরতার দিকে ইঙ্গিত করে। উনিশ শতকে অগাস্ট কোঁৎ যাহাকে ‘মহান সত্তা’ বলে ডেকেছেন তা ভবিষ্যতে বা আমাদের মধ্যেই বাস্তবায়িত হয়েছিল বলে মনে হয়। ভাইরাসটি সকল সীমানা ডিঙ্গিয়ে এবং সমস্ত সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করে, আমাদের প্রত্যেককে একই সাথে ঝুঁকিপূর্ণ এবং সম্ভাব্য একটি আশ্রয় হিসেবে প্রস্তুত করছে। জনস্বাস্থ্য সমস্যাকে পুরো প্রজাতির বেলাতেই সাধারণ সমস্যা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে সংক্রমণ, প্রচারণা এবং রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জনের (টিকাদান ও অন্যান্য) মত ধারণাগুলো একে অপরকে অনুসরণ করে, যাকে ‘জৈবরাজনীতি’ বলে ডাকার ক্ষেত্রে আমরা মিশেল ফুকোকে অনুসরণ করতে পারি।


তবে আরও কথা আছে। কোভিড-১৯ হচ্ছে একটি পশু-পক্ষীবাহিত রোগ, এটি এমন ধরনের রোগ যা প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। বলা হয় যে এটি ‘প্রজাতিগত বাঁধা অতিক্রম করে গিয়েছে’— এটি এমন এক অভিব্যক্তি যা পূর্বে আমজনতার কাছে একদমই অজানা ছিল অথচ আজ তা বহুল ব্যবহৃত। এটি যা দেখায় তা হলো মানব প্রজাতি অন্য প্রজাতিগুলোর মধ্যকার একটি নয়, বরং অন্য প্রজাতিগুলোর সঙ্গের একটি প্রজাতি যারা অন্যদের সাথে একই সাধারণ পরিবেশ ভাগ করে নেয় (এবং প্রতিযোগিতা করে)। এই জিনিসগুলোর মধ্যকার বিনিময় হওয়াটা প্রাকৃতিক বিবর্তনেরই অংশ। এবং শেষ পর্যন্ত তা একটি ‘দ্বিতীয় প্রকৃতি’ তৈরী করে, যা শুধুমাত্র মানুষের নয় বরং সকল প্রজাতিগুলোরই সম্মিলিত সম্পত্তি এবং যেটি একই সাথে তাদের দুর্ভাগ্যও হয়ে উঠতে পারে। এই বিনিময়গুলো অসম এবং ভারসাম্যহীন: পৃথিবী নামক গ্রহের সমস্ত ধরনের জীবন্ত পরিবেশে উপনিবেশ স্থাপন করে এবং সেগুলোকে বস্তুগত প্রয়োজনের অধীনে অন্তর্ভুক্ত করে, অপরাপর প্রজাতিগুলোকে শোষণ-দমন এমনকি নির্মূল করার মাধ্যমে আমাদের প্রজাতিটি জীবন’কে এমন এক বিন্দুতে নিয়ে গিয়ে হাজির করেছে যেখানে রূপান্তর পরিণত হয়েছে ধ্বংসযজ্ঞে, যেখানে বাসযোগ্যতা (habitability) এবং বংশ বিস্তার হুমকির মুখে পরে গেছে। যা-কিছু তাকে জীবন্ত রাখে মানবপ্রজাতি যদি সেসবকে পুরোপুরি ধ্বংস না করে, তাহলে মানবপ্রজাতিকে অবশ্যই তার পরিবেশ ও তার আদান-প্রদান বা বিনিময়গুলোকে চালনা করা (govern) শিখতে হবে এবং সেইজন্যে নিজেকেও পরিচালনা করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে; পরিচালনা করতে হবে এটার সমগ্রতা বিবেচনা করেই। জৈবরাজনৈতিক সমস্যাটি এভাবেই কসমো বা মহাবিশ্বের-রাজনৈতিক (cosmopolitical) সমস্যায় রূপ নেয়।


যাহোক, তবে এই জায়গায় এসে জটিলতাগুলোরও সংখ্যাবৃদ্ধি হয়। ঐক্যের প্রশ্নেরও উল্টো দিক রয়েছেঃ বিভেদ, এমনকি সহজাত বিভেদ বা অনৈক্য। মানব প্রজাতি কোন একটি কম্যুনিটি বা সম্প্রদায় নয়, একটি সমাজ নয়, কোন একটা জনতাও নয়। ফলে ‘নিস্ক্রিয়’ থেকে ‘সক্রিয়’ একতা বা ঐক্যে রূপান্তর কেবল কঠিনই নয়, বরং কাল্পনিক (utopian, অবাস্তব) বলেও মনে হয়। মানবতা যত বেশি একাট্টা হবে, ততই এটি নিজের বিরুদ্ধেই বিভক্ত-বিভাজিত হতে থাকবে। এখানে আমি সকল ধরনের সুষ্পষ্ট এবং অবশ্যই মৌলিক প্রসঙ্গগুলোকে (ক্রমবর্ধমান সামাজিক বৈষম্য, শ্রেণীগত পার্থক্য, জাতি ও ধর্মের বিরোধ ইত্যাদি) এড়িয়ে গিয়ে মহামারীটি ঠিক কী সামনে আনছে এবং প্রজাতির মানে বা অর্থবোধকতাকে কিভাবে টেনে এনেছে সে বিষয়ে মনোনিবেশ করছি।

আমি নিজেও বৈশ্বিক এই পার্থক্যগুলোকে ‘নৃতাত্ত্বিক’ বলছি, লিঙ্গ-বয়স-বর্ণ-সংস্কৃতি, নির্দিষ্ট কিছু পেশাগত পার্থক্যের মতো বিষয়গুলোর সীমানা ঠিক কোথায় নির্ধারিত হয় তা সঠিকভাবে বলতে না পারলেও বিরোধিতা করাকেই পছন্দ করা হয় অথবা ফরমান জারির মাধ্যমে এগুলো থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা করা হয়। আমাদের চোখের সামনেই নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে এই পার্থক্যগুলোই বৈষম্যে পরিণত হচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্যগুলোকে বরদাস্ত অথবা উৎসাহিত করা হচ্ছে, যা এই সর্বজনের ঝুঁকির মুহূর্তে এসে প্রজাতিগত একতাকেও প্রত্যাহার (undo) করে দিতে পারে। সেই ‘প্রথম সারির দেশ’গুলো যাদের সংখ্যা পৃথিবীতে এখনো অনেক বেশি, ‘ভবঘুরে’, ‘অভিবাসী’ বা ‘শরণার্থী’ সহ মানব প্রজাতির সেই ভ্রাম্যমাণ অংশগুলো যাদেরকে আমরা সুরক্ষা দিতে নয় বরং মরে যেতে দেয়ার জন্য একত্রিত করেছি— শেষপর্যন্ত এসবকিছুই সেখান থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। আশিল এমবেম্বের ভাষায়, ‘জৈবরাজনীতি’ যেখানে ‘নেক্রোপলিটিক্স (necropolitics) বা মারণরাজনীতি’ হয়ে ওঠে ।


জৈবরাজনীতি, কসমো বা মহাবিশ্ব-রাজনীতি এবং মারণরাজনীতি এক ও অভিন্ন জিনিস নয়, তবে তারা একই সমস্যার ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ যা আমাদের কাছে ‘আমাদের’ প্রজাতির মাধ্যমেই এসে পৌছোয় এবং এটি ‘কী হয়েছে’ ও ‘কী হতে পারে’ তা সম্পর্কে উভয়কেই প্রশ্ন করে। এটি অবশ্যই অনিশ্চয়তা ও প্যারাডক্সের রাজত্ব: যেভাবে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকে নিজের ফিরে আসার অবিকল আখ্যান নিয়ে লেখা [ফরাসি লেখক] রবার্ট অন্তেল্মের বই L’Espèce humaine (মানব প্রজাতি, ১৯৪৭) এর উপর [ফরাসি দার্শনিক] মরিস ব্লাঁশো মন্তব্য করেছিলেন, মানুষ হলো “সেই অবিনাশী যা ধ্বংস হতে সক্ষম (the indestructible that can be destroyed)”। তবে যাকে কোনভাবেই ধ্বংস হতে দেওয়া যাবেনা। একটি সমস্যা যাকে বর্তমানে আমাদের অবশ্যই প্রজাতিগত ‘সীমানা’র বাইরে বিস্তৃত করতে হবে এবং যেখানেই তা উত্থিত হবে সেখানেই চিহ্নিত অর্থাৎ সংস্থাপন করতে হবে।

____________

১৫ই এপ্রিল, ২০২১


অনুবাদকের টীকা:

[১] জিন-পুল: জিনপুল হলো একটি আন্তঃপ্রজননক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যকার বিভিন্ন জিনের/কৌলের সংকলন, জিনপুলের ধারণাটি সাধারণত একটি একক প্রজাতির প্রাণীর জিনের মধ্যে সমস্ত প্রকরণের জিনের এবং ক্রমোজমের ভেতরে তাদের অবস্থানের যোগফলকে বোঝায়। এর মধ্যে প্রকাশিত (প্রকট) ও অপ্রকাশিত (প্রচ্ছন্ন) উভয় রকমের জিনই অন্তর্ভুক্ত, মানুষকে ডিপ্লয়েড জীব বলা হয় কারণ এর প্রতিটি জীনগত অবস্থানে দুটি করে প্রকরণ থাকে।


প্রকাশঃ ৩০শে বৈশাখ, ১৪২৮:::১মে, ২০২১