ফুকো দিয়ে করোনাভাইরাস মহামারীকে বুঝা?
ফিলিপ সারাসিন
[এই প্রবন্ধটি সর্বপ্রথম জার্মান ভাষায় Geschichte der Gegenwart সাইটে প্রকাশিত হয় এবং পরবর্তীতে Verena Erlenbusch-Anderson দ্বারা অনূদিত হয়ে Understanding the Coronavirus Pandemic with Foucault? শিরোনামে foucaultblog-এ গত ৩১শে মার্চে প্রকাশিত হয়। করোনাভাইরাস মহামারীর প্রেক্ষিতে সরকারগুলোর গৃহীত পদক্ষেপ ও আগামবেনের এ প্রসঙ্গে ইন্টারভেনশন বায়োপলিটিক্স বা জৈব-রাজনীতি নিয়ে তীব্র বিতর্কের সূত্রপাত ঘটায়। এরই ধারাবাহিকতার ফিলিপ সারাসিনের এই লেখাটি প্রকাশিত হয়। সারাসিনের এই লেখাটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সজীব সাখাওয়াত। সজীব সাখাওয়াত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এই অনুবাদটি সম্পাদনা করেছেন রাষ্ট্রচিন্তা জার্নালের সহ-সম্পাদক সহুল আহমদ। ]
১. ভূমিকা
এটা অনেকটা জৈব-রাজনৈতিক স্বপ্নের মতো: চিকিৎসকদের পরামর্শমতো সরকারগুলো সমগ্র জনগণের উপর মহামারীকালীন স্বৈরতন্ত্র জারি করেছে। ‘স্বাস্থ্যের’ (এমনকি ‘টিকে থাকার’) অজুহাত দিয়ে সকল গণতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা হতে নিস্তার পেয়েছে এবং আধুনিকতায় কমবেশি তারা যেভাবে করতে চায় অবশেষে সেভাবেই জনগণকে পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে: শোষণের জন্য খাঁটি ‘বায়োমাস(biomass)’, ‘বেয়ার লাইফ বা নেংটো জীবন’ হিসাবে। এটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার না-যে এ ধরনের ভাবনা জর্জিও আগামবেনের (যিনি সমকালিন রাজনৈতিক তত্ত্বে ‘বেয়ার লাইফ বা নেংটো জীবন’ ধারণাকে পরিচিত করিয়েছিলেন) মতন মস্ত তাত্ত্বিকেরা ক্রমশ হাজির করেন। কিন্তু অনলাইনের সর্বত্র এইসব কাজের সমালোচনাধর্মী তাত্ত্বিকেরা রয়েছে যারা তাঁদের টুলবক্সে ‘ফুকো’ নিয়ে আসলে কি হচ্ছে সেই ব্যাখ্যার সারমর্ম দেন। ‘জৈব-ক্ষমতা’, ‘জৈব-রাজনীতির’ মতো শব্দগুলো বড্ড সম্মোহনী, এগুলো সময়ের বাঁধা বুলি হিসেবে আবির্ভূত হয় যেটার উজ্জ্বল আলোতে মহামারীর সময়ে শাসনের সত্য উন্মোচিত হয়।
কিন্তু সমস্যাটা হলো এই দাবি করা অসঙ্গত যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কোভিড-১৯ সময়ের দৃশ্যমান ব্যর্থতা--ফুকোর চিন্তার সাথে খুব অল্পই মেলে, যদি সেটা থেকেও থাকে তবুও। মিশেল ফুকো যখন ‘জৈব-রাজনীতি’ প্রত্যয়কে কয়েন করেন তখন তিনি যে কেবল বেশ দ্রুত এটি ছেড়েই দেননি, বরং তিনটি সংক্রামক রোগ সংক্রান্ত তাঁর চিন্তার তিনটা মডেলও দেন। এই মডেলগুলো শাব্দিকভাবে ‘জৈব-রাজনীতি’কে মুগুরের বদলে বরং মহামারীর মুখোমুখি অবস্থায় সরকারকে বুঝতে সহায়তা করে।
২. জৈব-রাজনীতি
কিন্তু প্রথমেই এই প্রত্যয়টাকে পরীক্ষা করে নেয়াটা দরকারি। ফুকো ‘জৈব-রাজনীতি’র প্রত্যয়কে সর্বপ্রথম পরিচয় করান ১৯৭৬ সালে তাঁর লিখিত La volonté de savoir (‘যৌনতার ইতিহাস’: প্রথম খন্ড) বইতে; উদ্দেশ্য ছিল আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইউরোপে নতুন রাজনীতির লক্ষ্য ও কৌশলকে চিহ্নিত করা। ফুকো লিখেন, এটি ইতিহাসে জীবনের প্রবেশ (the entry of life into history) এর চাইতে কমকিছু ছিল না, অর্থাৎ মানবপ্রজাতির জীবনের স্বতন্ত্র প্রপঞ্চগুলো জ্ঞান ও ক্ষমতার শৃঙ্খলে প্রবেশ করে, রাজনৈতিক কৌশলের পরিসরে ঢুকে পড়ে।১ আধুনিক সমাজগুলো এভাবে প্রজাতির জীবন নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রযুক্তিগত এবং রাজনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এইভাবে ফুকো যুক্তি দেন, ‘যখন প্রজাতির জীবন তার নিজস্ব রাজনৈতিক কৌশলের উপর ভর করে তখনই যাকে সমাজের ‘আধুনিকতার দোরগোড়া’ বলা যেতে পারে সেখানে সমাজ পৌছে যাচ্ছে’।২
যেটা তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, প্রথমত কোন রাষ্ট্রের জনসংখ্যা বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে সেখানে একদিকে জন্ম সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা (যেমন, গর্ভপাত এবং শিশুহত্যা নিয়ে কড়া শাস্তি) আছে, অন্যদিকে শিশুমৃত্যু নিয়ে আছে যথাযথ পদক্ষেপ। এছাড়াও সাধারণ রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যনীতি বিদ্যমান; সবশেষে বিশ শতকের প্রথমার্থে বিভিন্ন দেশের জনসংখ্যার ‘মান’ ‘বৃদ্ধি’র জন্য রয়েছে সুপ্রজননবিদ্যার সম্পূর্ণ ক্ষেত্র এবং ‘(বিশুদ্ধ) বর্ণগত স্বাস্থ্যবিধি’র(Racial hygiene) রাজনীতি। বিশ শতকের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি, এর উল্টোপাশ হচ্ছে বর্ণবাদ; অর্থাৎ, ফুকোর মতে ‘কে বাঁচবে আর কে মরবে’ তার মধ্যকার ফারাক।৩
জৈব-রাজনৈতিক ‘জীবনের লগ্নি’র উল্টোপাশে থাকা বর্ণবাদের ধ্বংসাত্মক আচরণ বোঝার জন্য খুব বেশি পরিমাণ ইতিহাস জানাটা দরকারি নয়। নিঃসন্দেহে আঠারো শতকের পরের প্রত্যেক আধুনিক ক্ষমতা, প্রত্যেক সরকার কমবেশি গভীরভাবেই তার জনগণের জীবন এবং স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করেছে। তারপরেও এইখান থেকে এই উপসংহারে আসাটা ভুল হবে যে, আধুনিকতা এবং উত্তর-আধুনিকতার সরকারগুলো সম্পূর্ণ এ বিবেচনা থেকেই উদ্ভূত হয়েছে এবং সরকারব্যবস্থাকে সরাসরি জৈব-রাজনীতি হিসেবেই বোঝা উচিৎ। এমন অনেক সরকারও থাকতে পারে যারা অনেকের জীবন ও স্বাস্থ্য নিয়ে খুব অল্প তদারকি করেছে—এই কারণে যে সম্পদ সৃষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য তাদের শরীরের প্রয়োজন ক্রমাগত কমছিল।
৩. সংক্রমণ চিহ্নিত করা
যদিওবা জৈব-রাজনীতির ধারণার বিশ্লেষণী মানকে অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়, তবে এটাও খেয়াল রাখা উচিত যে ফুকো কার্যকরীভাবে ১৯৭৯ সালে এটি ছেড়ে দেন। কিন্তু কেন? এটা বোঝার জন্য নতুন করে শুরু করাটা ফলপ্রসূ হবে এবং ফুকোর কাজের মধ্যদিয়ে সংক্রমণের পদাঙ্ক (trace of infection) অনুসরণ করতে হবে। আমি এখানে আলোকপাত করতে চাই, এই ঘটনার উপর যে ফুকো বারবার তিনটি সংক্রামক ব্যাধির কাছে ফিরে এসেছেন এবং তাদের নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিনটি ভিন্ন ধরনের সরকার ব্যবস্থার মডেল ব্যাখ্যা করেছেন: কুষ্ঠ, প্লেগ এবং গুটিবসন্ত।
ফুকোর সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘পাগলামির ইতিহাস’(History of Madness) ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয়। এর শুরু হয় এই বাক্য দিয়ে: ‘মধ্যযুগের শেষে কুষ্ঠরোগ পশ্চিমা দুনিয়া থেকে গায়েব হয়ে যায়’।৪ যদিওবা এটা সম্পূর্ণরূপে গায়েব হয়নি, কুষ্ঠরোগের হাসপাতালগুলো ক্রমশ খালি হয়ে যাচ্ছিল জায়গা করার জন্য; ফুকোর বিতর্কিত সন্দর্ভ অনুযায়ী, সমাজ থেকে গরীব, ভাদাইমা, অসুস্থ এবং পাগলদের বর্জন করার জন্য। আধুনিকতার প্রথমদিকে কুষ্ঠ ও কুষ্ঠরোগের হাসপাতালগুলো হয়ে ওঠেছিল গরীবের ঘর এবং পাগলা গারদ। এটি ছিল ফুকোর জন্য ক্ষমতার প্রথম মডেল: ক্ষমতা স্বাস্থ্যবান থেকে অসুস্থদের আলাদা করে, বিপথগামীদের ও পাগলদের সমাজ থেকে বর্জন করে। আদর্শিকভাবে নগরের বাইরে রেখে দেয়া হয় যেন কেউ তাদের সম্পর্কে আর চিন্তা না করে।
প্লেগ মডেল
তদপুরি ফুকোর মতে, আধুনিকতার শুরুর দিকে কুষ্ঠ মডেল প্লেগের ভয় থেকে উদ্ভুত ক্ষমতার নতুন মডেল দ্বারা বাতিল হয়েছে। ফুকো তাঁর এই মডেল বিস্তৃত করেন তাঁর ১৯৭৫ সালের Discipline and Punish: The Birth of the Prison বইতে। সেখানে তিনি যুক্তি দেন, সতের শতক থেকে ক্ষমতার নতুন এক রেজিম হাজির হয়: ডিসপ্লিনারি পাওয়ার। যারা স্বাভাবিক নয় [ডেভিয়েন্ট] তাদেরকে এখন আর সহজভাবে বর্জন করা হলো না, বা আটকেও রাখা হলো না। বরঞ্চ এর বদলে শিশু, সৈনিক, কর্মী, কয়েদী, গরীবসহ ‘সবাই’ কঠোর শৃঙ্খলার শিকার হলেন। শৃঙ্খলার কঠোর কাজের অনুশীলন হিসাবে এটা এভাবে তাদের শরীরকে ‘উৎপাদনক্ষম করে তোলে’।
আবারও ফুকো একটি সংক্রামক ব্যাধির প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়াকে একটি পুরোপুরি প্রশাসিত সমাজের অন্ধকারচ্ছন্ন অভীষ্ঠ হিসেবে প্রস্তাব করেন: ‘যদি এইটা সত্য হয় যে কুষ্ঠরোগ বর্জন রীতির জন্ম দিয়েছে যা কিনা একটা মাত্রা পর্যন্ত কারাগারের একটা সাধারণ আকার ও মডেল সরবরাহ করেছে, তাহলে প্রেগ ডিসিপ্লিনারি প্রকল্পের জন্ম দিয়েছে।’৫ আধুনিক প্লেগের প্রাথমিক প্রবিধানে তিনি একটা ডিজাইনের উল্লেখ করেন যা ছিল শহরগুলোর সীমান্ত ও পারাপারে বাধাহীন নিয়ন্ত্রণের একটা ব্যবস্থা এবং যা নাগরিকদেরকে নিজ ঘরেই কঠোর অবরোধের দাবি তুলেছিল: “এটা একটা খন্ডিত, অচল, জমাট স্থান। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তাঁর স্থানে নির্দিষ্ট থাকতে হবে। সে যদি চলাচল করে তবে তা নিজের জীবন, রোগ-সংক্রমণ এবং শাস্তির ঝুঁকি নিয়ে করবে”।৬
ফুকো যুক্তি দেন, ১৭শ শতকের কর্তৃপক্ষরা শৃঙ্খলার ‘রাজনৈতিক স্বপ্ন’ দেখেছিল, যেটা হলো “নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের গভীরতর এক সংগঠন, ক্ষমতার তীব্রতা এবং শ্রেণিবিভাগ”—এর রূপকল্প। ফুকো এমন শহরের কথা বলছেন না যেখানে প্লেগের বিস্তার ঘটেছে, বরং বলেছেন ‘নিখুঁতভাবে শাসিত শহরের [অথবা সমাজের] ইউটোপিয়া’র কথা যার জন্য ‘প্লেগ(অন্তত একটা সম্ভাবনা হিসাবে বিবেচনায় নিলেও) হলো ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতা চর্চা চলাকালীন একটি ট্রায়াল।’৭ রাষ্ট্রের আইনজ্ঞ ও তাত্ত্বিকরা আদর্শ আইন বিষয়ে চিন্তার উদ্দেশ্যে প্রকৃতির রাষ্ট্রকে যেভাবে কল্পনা করে ঠিক সেভাবেই ‘নিখুঁতভাবে শৃঙ্খলাকে কার্যকর অবস্থায় দেখার জন্য শাসকেরা প্লেগ অবস্থার স্বপ্ন দেখে’।৮
গুটিবসন্ত মডেল
এই তৃতীয় মডেলের পথটা কুষ্ঠ মডেলের থেকে প্লেগ মডেলের তুলনায় বেশি ঝামেলাপূর্ণ। এই সময়ে ফুকো তাঁর ক্ষমতার তমসাবৃত তত্ত্ব নিয়ে সন্দেহ পোষণ করতে থাকেন। একটা বৃহৎ শৃঙ্খলাবদ্ধ যন্ত্রের মডেলের ধারণা দিয়ে আধুনিক সমাজকে বোঝা(যেটা ডিসিপ্লিন এন্ড পানিশে তিনি প্রস্তাব করেছেন) তাঁর কাছে অকল্পনীয় হয়ে ওঠে--প্রায় যেন আধুনিক সমাজগুলো সম্পূর্ণরূপে নজরদারিতে আবদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রিত প্লেগ শহর…
আধুনিক শাসনতান্ত্রিক যৌক্তিকতা (governmental rationality) বিষয়ক তাঁর আলাপে ব্যক্তির স্বাধীনতা, প্রাথমিকভাবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এমন একটা নতুন উপায় হিসেবে উদ্ভব হয় যাকে আগ্রাহ্য করা অসাধ্য, ‘যা সম্পূর্ণরূপে মৌলিক’: আধুনিক খাঁটি লিবারেল শাসনতান্ত্রিকতা এমন এক ধরণের সরকারব্যবস্থা ‘যা কেবল প্রত্যেকের স্বাধীনতার উপর নির্ভর করে এবং এর মাধ্যমে’ সম্পন্ন হতে পারে।৯ এই ঐতিহাসিক রূপান্তরকে পরিষ্কার করার জন্য, ফুকো নতুন একটা মডেলের অবতারণা করেন: ‘গুটিবসন্ত অথবা টিকার চর্চা।’১০
এইখানে সমস্যাটি ভিন্নভাবে হাজির হয়েছে; এটা এখন আর প্লেগের সময়কার ডিসিপ্লিনের মতো নয়: ‘সমস্যাটি হলো কি পরিমাণ লোক গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছে, তাঁরা কোন বয়সের, কি কি প্রভাব রয়েছে, মৃত্যুহার কেমন, ক্ষত বা পরিণাম কি, টিকাদানের ঝুঁকি কি, টিকাদানের পরও একজনের গুটিবসন্তে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু এবং জনগণের উপর সাধারণভাবে পরিসংখ্যানের প্রভাব’। ফলে গুটিবসন্তের মুখোমুখি হয়ে এইটা হয়ে যায় ‘স্থানিক রোগ বা মহামারির মতো ঘটনা থামানোর জন্য মহামারিবিদ্যা ও স্বাস্থ্য অভিযান’ এর সমস্যা।১১
আঠারো শতকের কর্তাব্যক্তিরা গুটিবসন্তের ঘটনায় ব্যবস্থা নিয়েছেন রোগের ব্যপ্তি পরিমাপ করে পরিসংখ্যানগন পর্যবেক্ষণের মারফতে এবং টিকা দিয়ে জনগণকে সংক্রমণ থেকে রক্ষার প্রচেষ্টার মাধ্যমে। ফুকোর মতে এই দিকটা গুরুত্বপূর্ণ, উদার শাসনতান্ত্রিকতার (liberal governmentality) মধ্যে এই সমস্যার এমন ধরনের উপলব্ধির ভিত্তিতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ধরণটির এতদূর যাওয়া উচিৎ নয় যা কিনা ব্যক্তির ডিসিপ্লিনে রূপান্তরিত হয়ে যায়, কেননা এটা স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করবে, যে স্বাধীনতা এই ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন। ফলে, “অত্যধিক শাসন আসলে কোন শাসনই না।’১২ যে রাষ্ট্র অত্যধিক শক্তিশালী সে নিজেই তার লক্ষ্যকে ধ্বংস করে—এটার অবশ্যই সমাজের আপেক্ষিক অভেদ্যতার প্রতি শ্রদ্ধা থাকা উচিত, এমনকি সেটা সংক্রমণের ঝুঁকির মূল্যে হলেও।
অন্যভাবে বললে, ক্ষমতার গুটিবসন্ত মডেলটি মূলত পেথোজেন, অনুপ্রবেশকারী ও জীবানুকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা, প্লেগের মতো ‘গভীরভাবে’ সমাজকে নজরদারি করা এবং প্রত্যেক ব্যক্তির চলাচলকে ডিসিপ্লিন করার স্বপ্নকে বিসর্জন(abandonment) দেয়ার উপর ভিত্তি করে টিকে আছে। এর পরিবর্তে, রোগের জীবানুর প্রবেশ, এর অস্তিত্ব সম্পর্কে জেনে, তথ্য সংগ্রহ করে, পরিসংখ্যান সংকলন করে, ‘চিকিৎসাভিযান’ পরিচালনা করার মাধ্যমে এখানে ক্ষমতা সহাবস্থান করে। এটি নরমেশন(normation)১৩ এবং ব্যক্তির ডিসিপ্লিনারাইজেশনের (disciplinarization) একটি চেহারা ধারণ করে। তৎসত্ত্বেও কেবল যেখানে ক্ষমতা গুটিবসন্ত মডেল থেকে প্লেগ মডেলে ফেরত আসে তখন সেটা কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠে এবং সবশেষে টোটালিটেরিয়ান হয়ে উঠে।
৪. করোনা সংক্রান্ত কিছু উপসংহার
এটা স্পষ্ট যে ফুকো আসলে কোন বাস্তবিক মহামারীর কথা বলেননি, কিন্তু তিনি সংক্রামক ব্যাধিকে চিন্তার মডেল হিসেবে ব্যবহার করেছেন যাতে ক্ষমতার রূপগুলোকে আদর্শ-টিপিক্যাল ছাঁচে সাজাতে পারেন। আমরা একটা ভিন্ন পরিস্থিতিতে আছি: আমরা একটা মহামারীর কবলিত অবস্থায় আছি। ক্ষমতা ও সরকারব্যবস্থার বিভিন্ন ধরণের চেহারা মিডিয়ার মারফতে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে বা এসবের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তাহলে ফুকোর এই তিন মডেল আমাদের কি শিক্ষা দিতে পারে?
প্রথমত, বিভিন্ন রূপের মধ্যে অবস্থার পরিবর্তন(transition) ও ওভারল্যাপ(overlap) হচ্ছে। উহানের সম্পূর্ণ লকডাউন কঠোরভাবে প্লেগ মডেলকে অনুসরণ করে এবং প্রত্যেকটা কার্ফ্যুও চূড়ান্তভাবে তা-ই করে। এই মডেলগুলো দেখায় যে যখন উদার গুটিবসন্ত মডেল(liberal smallpox model) কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিসংখ্যানগত জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হয়না, তখন কার্ফ্যুগুলো দরকারি।
কেবল যখন সুশৃঙ্খল পরীক্ষা-নিরীক্ষা আক্রান্ত ও অনাক্রান্তদের সম্পর্কে প্রচুর পরিমাণ তথ্য সরবরাহ করে (যেটা দক্ষিণ কোরিয়া বা সিঙ্গাপুরে ঘটেছে), তাদের সরকারগুলোর পক্ষে সম্ভব হয় আক্রান্তদের আলাদা করে ফেলা এবং বাকি জনগণকে সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দেয়া। এটা তখন সম্ভব হয় কোনরূপ লকডাউন আরোপ করা ছাড়াই। শ্লেষ বা বিদ্বেষ ছাড়াই এটা বলা যায়: দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে জনজীবন সচল থাকা এবং অর্থনীতি কার্যকর থাকাটা আদতে গুটিবসন্ত মডেলের উদারনৈতিক প্রতিশ্রুতি’ই।
দ্বিতীয়ত, প্লেগ মডেল একটা হুমকিস্বরূপ রয়ে গেছে, এমনকি একটা বিপদও। এইটা অনেককিছুই অন্তর্ভুক্ত করে, উদাহরণস্বরুপ, মরক্কোর রাস্তায় করোনাসংক্রান্ত কার্ফ্যু আরোপ করা হচ্ছে ট্যাংক নামিয়ে এবং কঠোর সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে। ইসরায়েলের বিশিষ্টজনেরা নেতানিয়াহুর দ্বারা নিষ্পন্ন এক ক্যু-এর সতর্কবার্তা দিচ্ছেন এই কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনার ক্ষেত্রে। হাঙ্গেরিতে ভিক্টর অরবান সরকারের রূপান্তরের ফরমান জারির পরিকল্পনা করছে। আমেরিকার অ্যাটর্নি জেনারেল বার অনির্দিষ্টকাল ধরে বিচার ব্যতীত কয়েদীদের রাখার অনুমতি চাচ্ছে। কিন্তু এটা এও অন্তর্ভুক্ত করে যে যারা মোবাইল ফোন বহন করে তাদের চলাচল তথ্য সংরক্ষণ এবং মূল্যায়ন করাটা এই সংকট পরবর্তীকালে শুধু প্রযুক্তিগত সম্ভাব্যতা রূপে নাও থাকতে পারে। উদার গুটিবসন্ত মডেল মৌলিকভাবে এবং সবসময়ই চায় যে রাষ্ট্রের ক্ষমতা যেন সন্দেহের চোখে পর্যবেক্ষণ করা হয়।
তৃতীয়ত: ক্ষমতার গুটিবসন্ত মডেল (কমবেশি যাইহোক কিন্তু নিরপেক্ষভাবে সঠিকভাবে) মহামারীর সময়ে ইউরোপীয় সরকারগুলো বিভিন্ন পার্থক্য ও জাতিগত আত্মশ্লাঘা সত্ত্বেও সরকারের যে রূপ অবলম্বন করে তা ব্যাখ্যা করে। #flattenthecurve কৌশলের মানে হলো প্যাথোজেনদের গোনায় ধরা এবং জানা যে তাদের সমূলে ধ্বংস করা সম্ভব না, কিন্তু এটার বন্টন সময়ের সাথে বৃদ্ধি করার এমন এক পদ্ধতি বের করা সম্ভব যাতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা এটাকে সামলাতে পারে। বহু মানুষের জড়ো হওয়া রোধ করার কৌশল শৃঙ্খলা আনেনি—কি কারণে?—বরঞ্চ রাষ্ট্র ব্যক্তির আচরণের জন্য সংকীর্ণ কিন্তু ন্যায্য ও বোধগম্য একটা ফ্রেমওয়ার্ক ঠিক করে দেয়। সাধারণভাবে ‘সামাজিক দূরত্বের’ পর্যবেক্ষণ নিঃসন্দেহে সরকারের উদার [লিবারেল] কৌশল, যেটা মৌলিকভাবে ব্যক্তির স্বাধীনতার উপর নির্ভরশীল এবং অবশ্যই স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করা উচিত। নিজেদের খেয়াল রাখা, আত্মরক্ষা করা এবং বন্ধুভাবাপন্ন বা সংহতিমূলক সংগঠনের বিভিন্ন রূপ সন্ধান করাটা বিবিধ আত্মকোশল যা কিনা সামাজিক স্ব-সংগঠনের বাস্তব উপাদানসমূহ দিয়ে গুটিবসন্ত মডেলের উদার সীমাকে পূরণ করে।
চতুর্থত: ..... কিন্তু কুষ্ঠরোগের মডেল চুপিসারে লুকিয়ে আছে। বিভিন্ন স্থানে হাজির হওয়া ধারণার মধ্যে এই মডেলের আবির্ভাব হচ্ছে; যেমন ‘অর্থনীতি বাচানোর স্বার্থে’ বয়স্কদের মরতে দেয়া উচিৎ। অথবা এটা বাস্তবতা হিসেবে দেখা দিচ্ছে যখন অবসর ও নার্সিং হোমগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে দেয়া হচ্ছে এবং এর বাসিন্দাদেরকে একাকি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছেন, যেমনটা স্পেনে ঘটেছে বলে শোনা যায়।