পুঁজিবাদের ধ্বংসই কেবল পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে

জন বেলামি ফস্টার


[গত মার্চ মাসের শেষের দিকে, বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক সাময়িকী মান্থলি রিভিয়্যু’র সম্পাদক জন বেলামি ফস্টার করোনাভাইরাস মহামারী বিধ্বস্ত পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ফস্টার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অঁরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক। রাজনীতি, অর্থনীতি এবং প্রতিবেশ সংকট প্রসঙ্গে তাঁর বেশকিছু গ্রন্থ রয়েছে।সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ফারুক চৌধুরী*। মান্থলি রিভিয়্যু অনলাইনে এটি প্রকাশিত হয়েছে এই মাসের ১ তারিখে, শিরোনাম Catastrophe capitalism: climate change, COVID-19, and economic crisis (An interview of John Bellamy Foster)। এই সাক্ষাৎকারে ফরস্টার পুঁজিবাদের বর্তমান অবস্থা ও অর্থনৈতিক সংকটের সাপেক্ষে বৈশ্বিক মহামারী নিয়ে আলোচনা করেছেন। বৈশ্বিক মহামারীর সাথে পুঁজিবাদী অর্থনীতি, তার সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তনকে সম্পর্কিত করেছেন। এই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন অংশুমান রায়। অংশু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।]



আমরা জানি, কার্ল মার্ক্সের বিপাকীয় ভাঙন (Metabolic Rift) ধারণা নিয়ে আপনি দীর্ঘদিন ধরে বিচার-বিশ্লেষণ করে চলেছেন এবং একে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। করোনাভাইরাস মহামারীর এই বর্তমান অবস্থাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?


নিশ্চিতভাবেই, এই পরিস্থিতি হঠাৎ আবির্ভূত SARS-CoV-2 জীবাণুর সাথে সম্পর্কিত এবং কোভিড-১৯ মহামারী পুরো পৃথিবী জুড়েই এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। এর কারণ এবং পরিণাম উভয়ই পুঁজিবাদী সামাজিক সম্পর্কের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।


প্রতিবেশগত(Ecological) বা বিপাকীয় সম্পর্ক, এবং বিশেষভাবে বললে সমাজ ও প্রকৃতির পরস্পর নির্ভশীলতার জটিল আন্তঃসম্পর্ককে বোঝাপড়ার একটা তরিকা ছিল মার্ক্সের মেটাবলিক রিফট তত্ত্ব । এটা একটা পদ্ধতিগত দৃষ্টিভঙ্গি যা প্রতিবেশসংক্রান্ত পদ্ধতিগত আলোচনার বিকাশের বহু আগে থেকেই চালু আছে। বস্তুত একই ভিত্তি ভূমিতেই এটা দাঁড়িয়েছে। জার্মান রসায়নবিদ ইয়াস্টাস ফন লিবিগের গবেষণার ভিত্তিতে মার্ক্স মাটির বিপাকীয় ভাঙনে মনোযোগ দিয়েছিল। দেশ হতে শহরে, উৎপাদনের স্থান হতে হাজার মাইল দূরে খাদ্য ও তুলা চালান হওয়ার ফলাফলস্বরূপ মাটি হারাচ্ছিল তার প্রয়োজনীয় উপাদান যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পটাশিয়াম। এগুলো আর মাটিতে ফিরে আসছিল না, কিন্তু শেষমেষ গিয়ে শহরকে দূষিত করছিল। যাহোক, এই তত্ত্বের ব্যাপক প্রয়োগ করা হয়েছিল এটা বুঝতে যে, সরলরৈখিক পুঞ্জিভবনের মাধ্যমে পুঁজিবাদী উৎপাদন কিভাবে জন্ম দিচ্ছে বিচ্ছেদের বা বিচ্ছিন্নতার। এই বিচ্ছেদকেই মার্ক্স বলেছেন, “প্রকৃতির বৈশ্বিক বিপাক”।


বিপাকীয় ভাঙন দৃষ্টিভঙ্গি, আসলেই প্রতিবেশের একটি বৈপ্লবিক পদ্ধতির দৃষ্টিকোণ। এটা সমাজিক তথা পুঁজিবাদী সম্পর্ককে বিচার করে, যা বর্তমান বৈশ্বিক করোনা মহামারীতে বোঝা খুবই জরুরী। বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী ও ফাইলোজিওগ্রাফার রব ওয়ালেস, মান্থলি রিভিয়্যু প্রেস থেকে ২০০৬ সালে প্রকাশিত "বড় খামার বড় ফ্লু আনে" বইয়ের লেখক। তিনি ও তাঁর বৈজ্ঞানিক সহকর্মীদের দল মত দেন যে, কোভিড-১৯ এর উৎপত্তি ও বিস্তার পুঁজির সার্কিটের সাথে সম্পর্কিত।(ওয়ালেস ও অন্যান্য, কোভিড-১৯ ও পুঁজির সার্কিট, মান্থলি রিভিয়্যু, অনলাইনে প্রকাশ ২৭শে মার্চ, ২০২০) পুঁজিবাদ নিজেই সবচেয়ে বড় রোগ বিচ্ছুরক। ওয়ালেস ব্যাখ্যা করেন যে, SARS-CoV-2 ও সাম্প্রতিক নোবেল করোনাভাইরাসের উৎপত্তি প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে লাগামহীন কৃষিবাণিজ্যের অনুপ্রবেশের সাথে সম্পর্কিত, যা বাস্তুসংস্থানে ফাটল ধরাচ্ছে এবং নানা রকম বৈশ্বিক মহামারীর সম্ভাব্যতা তৈরী করছে। Notes on a novel Coronavirus (মান্থলি রিভিয়্যু, ২৯শে জানুয়ারি, ২০২০) এই লেখায় তিনি তুলে ধরেন যে, কাঠামোগত সমাধান হচ্ছে এক প্রতিবেশ-সমাজতন্ত্র নির্মাণ করা। এটা প্রতিবেশ ও অর্থনীতি, শহর এবং গ্রামীণ ও বন্যতার মাঝের বিপাকীয় ভাঙনকে সারিয়ে তোলে, মেরামত করে; এবং এসব ক্ষতিকর রোগজীবাণুর উত্থানকে ঠেকিয়ে রাখে।


এটা বোঝা খুবই জরুরি যে, প্রতিবেশ বা সংক্রমণসংক্রান্ত আলোচনা নতুন নয়। তারুণ্যে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসকে রোগব্যাধি ও শিল্পবিপ্লবের সময়ের মড়কের প্রাদুর্ভাব অবস্থা (বিশেষত তাদের শ্রেনী চরিত্র) নিয়ে গভীরভাবে বোঝাপড়া করতে হয়েছিল। ১৮৪৫ সালে প্রকাশিত তাঁর ইংল্যাণ্ডে শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা বইটিতে এর বিবরণ আমরা পাচ্ছি। এমন পরিস্থিতির ফলশ্রুতিতে ঘটা মৃত্যুকে “সামাজিক হত্যাকাণ্ড” হিসেবে এঙ্গেলস চিহ্নিত করেছেন। এর অনেক কিছুই মার্ক্সের পুঁজিতে আলোচিত হয়েছে। চার্লস ডারউইন ও থমাস হাক্সলির সাগরেদ এবং মার্ক্সের কাছের বন্ধু প্রাণীবিজ্ঞানী রে লেঙ্কেস্টার এক শতকেরও আগে তাঁর কিংডম অফ ম্যান (১৯১১) গ্রন্থের “প্রকৃতির প্রতিশোধ” শিরোনামের অধ্যায়ে সতর্ক করেন যে, প্রতিবেশগত পরিস্থিতির মানুষের অদলবদলের সাথে সকল আধুনিক মহামারীর যোগসূত্র রয়েছে।


তিনি লিখেন যে, ‘বিশাল পরিমাণে পশু ও শস্য উৎপাদনের লোভের বশে... মানুষ ক্ষেতে খামারে অস্বাভাবিক প্রজাতি ঝাঁকেঝাঁকে জড়ো (পুঞ্জিভূত) করছে এবং পশু প্রজননের বিশাল খামার, নিজেদের প্রজাতির অস্বাভাবিক ভীড় ও দালানকোঠা তৈরি করছে।’ এর ফলে জন্ম নিচ্ছে পরজীবী, জীবাণু ও ব্যাকটেরিয়ার সাথে সম্পর্কিত রোগ। লেঙ্কেস্টার পুঁজির একজন সুক্ষ্ম সমালোচক। তাঁর মতে, এই সমস্যা আসলে নির্ভর করে “বাজার” ও “আর্থিক যোগানের বহুজাতিক ডিলারদের” উপর। (এই বিষয়ে বিশদ আলোচনার জন্য আমার নতুন বইটি দেখুন, The Return of Nature: Socialism and Ecology [মান্থলি রিভিয়্যু প্রেস, ২০২০])।


“প্রকৃতির প্রতিশোধ” অধ্যায়ে লেঙ্কেস্টারের সতর্কতা মূলত সর্বতোভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। সেকারণে মান্থলি রিভিয়্যুের ২০০০ সনের সেপ্টেম্বর সংখ্যায় “পুঁজিবাদ কি একটি রোগ?” প্রবন্ধে রিচার্ড লেভিস মত দেন যে বিভিন্ন রোগের মহামারী জন্মের হুমকিকে বুঝতে না পারার কারণ হচ্ছে— বিশ্ব ইতিহাস, অন্যান্য প্রজাতি, বিবর্তন ও প্রতিবেশের দিকে সঠিক নজর দিতে আমাদের প্রচলিত জনস্বাস্থ্য ব্যর্থ হয়েছে। এই বিবেচনায়, ওয়ালেসের বড় খামার বড় ফ্লু আনে বইটাকে গুরুত্বপুর্ন সংযোজন বলতে হবে। এই বইয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, যদি উদীয়মান মহামারীকে বন্ধ করতে হয় তবে পুরো সাম্রাজ্যবাদী কৃষিবাণিজ্যের কাঠামোকে উল্টে ফেলতে হবে।


জলবায়ু-ও-পরিবেশের-উপর-মানুষের-দমনমূলক-হস্তক্ষেপের(Anthropocene) মাধ্যমে পুঁজিবাদ— প্রজাতি, বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশে অ্যান্থ্রোপোজেনিক(Anthropogenic) ভাঙন ডেকে আনছে, তা নিয়ে আজ আর কোনও সন্দেহ নাই। এবং এর মাধ্যমে পুঁজিবাদ এইকালে সামাজিক-প্রতিবেশগত সংকট সৃষ্টি করছে, যাকে আবার শেষ পর্যন্ত পুঞ্জীভবনের ব্যবস্থার দ্বন্দ্বেই শনাক্ত করা যাচ্ছে, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। পুঁজির এই একই শাসন আরও বৃহৎ শ্রেণী এবং সাম্রাজ্যিক অসমতা তৈরী করছে। সবচাইতে গরীব আর অধিক নাজুক লোকজনকে পরিবেশগত মারাত্মক বিপদে ঠেলে দেয়া নিশ্চিত করেছে, যেখানে ধনীরা থাকছে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। এটা এঙ্গেলসের “সামাজিক হত্যাক্যান্ডের”র দাবীকে নতুন অর্থ দিচ্ছে।


বিশ্বের পরিবেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে যখন আলোচনা হচ্ছে, কিভাবে পুঁজিবাদী অর্থনীতি আমাদের গ্রহের পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ধংস করছে এবং হুমকির মুখে ফেলছে গ্রহের সমস্ত প্রাণকে তা আপনার বই"দ্যা ভালনারেবল প্ল্যানেট" আমাদের জানাচ্ছে । এই ব্যবস্থা মুনাফার স্বার্থে বিজ্ঞানকে বলি দিচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান, প্রকৃতিবিজ্ঞানকে পুঁজির পুঞ্জীভবনের স্বার্থে বেগার খাটাচ্ছে, নিয়োজিত রেখেছে। মানুষের আবাসস্থলকে খুবই অযৌক্তিক ও অমানবিক উপায়ে গড়ে তুলেছে। এই মহামারীর কারণে দেশে দেশে এত এত জীবনহানির আজকের বাস্তবতাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?


আজ থেকে ২৫ বছর আগে যখন The vulnerable planet (মান্থলি রিভিয়্যু প্রেস, ১৯৯৪) বইটা লিখি, তখন জলবায়ু পরিবর্তন, পৃথিবীর প্রজাতিগুলোর বিলুপ্তি, পৃথিবীব্যাপী প্রজাতির বিলুপ্তি, বনভূমি ধ্বংস এবং ওজনস্তরের ক্ষতির প্রতি দৃষ্টিপাত আমার জন্যে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল । এটা পরিষ্কার যে, এই গ্রহের পরিবেশ সংকটকে গুরুত্বসহকারে সামনে আনতে পারতাম যদি আমরা এর পশ্চাতে লুকিয়ে থাকা পুঁজিবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতিকে বুঝতাম।


এর পেছনে প্রধান যুক্তি ছিল এটা, যে ‘পৃথিবীর অর্থনীতির উত্তরোত্তর বিকাশ হওয়ার সময়ে মানুষের এই অর্থনৈতিক ক্রমোন্নতির মাত্রা প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলো পৃথিবীর বাস্তুচক্রের, পুরোটা গ্রহজুড়ে প্রতিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিল, যেমনটা এর আগে কখনোই ঘটেনি।’ (পৃ-১০৮) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং সিনথেটিক(বিষ-পরিপূর্ণ) উৎপাদনের ফলে ব্যাপারটা আরও খারাপের দিকে গেছে।তলদেশে ছিল শুধু পুঁজি গোছানোর সংকীর্ণ ও একরৈখিক যুক্তি যা একচেটিয়া পুঁজিবাদের কাঠামোগত বাস্তবতায় তৈরী হয়েছিল। পুঁজিবাদ ও পরিবেশের সংঘাত বিংশ শতাব্দীর বিপর্যয়কেই কেবল দেখাচ্ছে, যদিনা মানবজাতি দ্রুত এর পরিবর্তন ঘটায়।


আমার কাছে এই যুক্তি নায্যভাবেই অবশ্যম্ভাবী মনে হয়েছে এবং এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও রয়েছে। কিন্তু যখন বইটি পরিবেশবাদী বাম মহলে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করলো, সেইসময়ে সমাজতান্ত্রিক বামপন্থীদের নানা ভাগগুলোতে এটার প্রস্তাবনা নিয়ে পূর্ব থেকে স্থিরীকৃত প্রতিরোধ দেখে আমি বেশ আশ্চর্য হলাম। উদাহরণস্বরুপ মার্ক্সবাদী ভূগোলবিদ ডেভিড হার্ভে তাঁর নায্যতা, প্রকৃতি এবং দূরত্বের ভূগোল (ব্লাকওয়েল, ১৯৯৬) বইটিতে আমার বইয়ের সমালোচনা করে বলেন, ‘প্রাকৃতিক পরিবেশের ধ্বংস অত্যাসন্ন—এমন কেয়ামতের আলামতের ঘোষণায় আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে।’ তিনি এই তর্ক তুলেন যে, বিশ্বের পরিবেশগত বিপদের ধারণা অতিরঞ্জিত। হার্ভে আরো বলেন, ‘খারাপ যাকিছু করছি তা হলো আমরা পরিবেশের বস্তুগত পরিবর্তন ঘটাচ্ছি, যাতে আগের থেকে মানুষ যেন আরও বেশি আরামদায়কভাবে জীবনযাপন করতে পারে।’ এটা আমার আর হার্ভের মধ্যে এক বিতর্কের সূচনা করে। এই তর্ক মান্থলি রিভিয়্যু’তে ১৯৯৮ সনের এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।


তবুও, আজ এত বছর পরে The vulnerable planet বইটার দিকে ফিরে তাকালে আমার প্রধান আত্মসমালোচনা যা হার্ভের সমালোচনার উল্টোপথে হাঁটছে তা হচ্ছেঃ প্রতিবেশগত বিপদের(যা চোখ রাঙাচ্ছিল, যদি সমাজ পুঁজিবাদী পথেই চলতে থাকে) অতিরঞ্জন করার চেয়ে বরং বলা যায়, বইটা কিছু পদ্ধতিগত দুর্বলতার(আজ আর যার ভিতর দিয়ে যাব না) ফলে এই গ্রহের আসন্ন ভাঙনকে(বা ক্ষতি) পূর্ণমাত্রায় ধরতে পারেনি। পাঁচ বছর পরে, ১৯৯৯ সনের সেপ্টেম্বরে আমেরিকান জার্নাল অব সোসিওলোজি'তে “মার্ক্সের মেটাবলিক রিফট তত্ত্ব” নামের আমার একটি প্রবন্ধে আরও বিকশিত ঐতিহাসিক-বস্তুবাদী পর্যালোচনায় উপনীত হওয়ার আগ পর্যন্ত অবশ্য এই বুঝ আসেনি।মার্ক্সের প্রতিবেশসংক্রান্ত আলোচনার পুনরাবিষ্কার ও বিকশিত করা ছিল এটার ভিত্তি যা পুঁজিবাদ ও পৃথিবীর সংঘাতকে আগাগোড়া বোঝার পথ খুলে দিয়েছে।


আসলে, বিপাকীয় ভাঙন(Metabolic Rift) বিশ্লেষণে শুরু থেকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা ছিল তা হচ্ছে, এটা আমাদের পুঁজিবাদ ও পরিবেশের নেতিবাচক দ্বন্দ্বতত্ত্বকে(negative dialectics, নঞর্থক দ্বন্দ্বতত্ত্ব) বুঝতে সাহায্য করেছে।এটি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রজাতি বিলুপ্তি, বনধ্বংস, শিল্পায়িত প্রাণীর অপব্যবহার, খনিজসম্পদ এবং অন্যান্য বিষয়ের ডেকে আনবার কর্তা, সেই সাথে ই. পি. থমসন যাকে বলেছেন “চরমপন্থা” ([exterminism (?)] নিয়ে একটি পদ্ধতিগত অনুসন্ধানে চালিত করে। এই কাজটি অনেক মার্ক্সবাদী পরিবেশবাদীই সম্পন্ন করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হচ্ছে ইয়ান আঞ্জুস, পল বুরকেট, ব্রেট ক্লার্ক, রেবেকা ক্লাউসেন, রায়ান গুন্ডারসন, হানা হোলমান, স্টিফানো লনজো, ফ্রেড ম্যাগডফ, আন্দ্রেস মালম, কোহেই সাইটো, ইয়ামন স্লাটার, ডেল ওয়েস্টন, এবং রিচার্ড ইয়র্ক। (আরও বিশদ জানতে মান্থলি রিভিয়্যু অনলাইনে রায়ান উইশহার্টের “The Metabolic Rift: A Select Bibliography” দেখুন)


তবুও পুঁজিবাদী পরিবেশগত দ্বন্দ্বের তত্ত্বকে এই ব্যবস্থার অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বে মনোযোগী তত্ত্বের বিকল্প হিসেবে ভাবা মারাত্মক ভুল হবে। বরং এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ যে এই গ্রহের পরিবেশ সংকট এবং সংশয়াপন্ন পুঁজিবাদী অর্থনীতি হচ্ছে পুঁজির কাঠামোগত সংকটের দ্বান্দ্বিকভাবে আন্তঃসম্পর্কিত উপাদান। সেই পুঁজির উপাদান যা আমাদের কালকে নির্ধারণ করছে।


এই বিশ্বের মানবজাতি পূর্বে কখনই এমন পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়নি। এর থেকে পরিত্রাণের রাস্তা কোনটা?


এর একটাই উত্তর, “জলন্ত ঘর হতে বের হতে হবে”, বার্টোল্ট ব্রেখট যা অনেক আগেই ঘোষণা দিয়েছেন । আজকালকার বামপন্থী মহলে সচরাচর শোনা যায় যে, পুঁজিবাদের ধ্বংস থেকে পৃথিবীর ধ্বংস কল্পনা করা সহজ। জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড-১৯ এবং বৈশ্বিক পুঁজিবাদী বিকাশমান অর্থনীতির সংকটের ফলে আজ তা শেষমেষ উল্টে গেছে। আকস্মিকভাবে, পুঁজিবাদের ধ্বংস পৃথিবীর ধ্বংস থেকেও কল্পনা করা সহজ হয়ে গেছে। এবং প্রকৃতপক্ষে পুর্বেরটাই পরেরটা ঘটা থেকে আমাদের রক্ষা করবে।


পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীনতাকে অপরিহার্য মেনে নিয়ে মনুষ্যজাতিকে আরও টেকসই সমানাধিকারের পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য আজ সংগ্রাম করতে হবে। ঐক্যবদ্ধতায় আস্থা রাখার বস্তুগত অর্থ হচ্ছে নতুন ও সৃজনশীল যাকিছু আমরা আনতে পারি তা আমাদের সমষ্টিগত শৃঙ্খলার মধ্যদিয়ে আনতে হবে। এটা আপনাআপনি হয়ে যাবে না। এর জন্য দরকার হবে,

“স্পর্ধা, আরও স্পর্ধা, সবসময় স্পর্ধা”


যেটা সামির আমিন তাঁর The Implosion of Contemporary Capitalism (মান্থলি রিভিয়্যু প্রেস, ২০১৩; পৃ-১৪৬) গ্রন্থে বলেছেন। বৈপ্লবিক ভাঙন অপরিহার্য কিন্তু তা সংকীর্ণ অর্থে কেবল পুঁজিবাদই নয়, বরং পুরো সাম্রাজ্যবাদী কাঠামোর ভাঙন। এই সাম্রাজ্যবাদী কাঠামোই আজকে পুঁজির পুঞ্জীভবনের মূল হিসেবে কাজ করে। সমাজকে নতুন করে আমূলভাবে পুর্নগঠিত করতে হবে। আমাদের সামনের কঠিন সত্যকে বেছে নিতে হবে আর তা হলোঃ

ধ্বংস অথবা বিপ্লব।

______________

১লা এপ্রিল, ২০২০


*ফারুক চৌধুরী ঢাকার লোক। বেশকিছু বইপত্র লিখেছেন, সম্পাদনা করেছেন ও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত তাঁর বইগুলো হচ্ছেঃ Micro Credit, Myth Manufactured (ed.), The Age of Crisis, and The Great Financial Crisis, What Next?: Interviews with John Bellamy Foster (ed.), Dhaka: Books (2012) ।


প্রথম প্রকাশঃ ২৮শে এপ্রিল, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ২৮শে এপ্রিল, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/2685311265118816/