দার্শনিকদের অবশ্যই পুনরায় ধর্মতন্ত্রের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হবে

জর্জিও আগামবেন



[করোনাভাইরাস মহামারী ও উদ্ভূত জরুরী অবস্থার প্রসঙ্গে দার্শনিক জর্জিও আগামবেন প্রায় নিয়মিত ছোট ছোট লেখা লিখে চলেছেন। [করোনাভাইরাস মহামারী ও উদ্ভূত জরুরী অবস্থার প্রসঙ্গে দার্শনিক জর্জিও আগামবেন প্রায় নিয়মিত ছোট ছোট লেখা লিখে চলেছেন। Quodlibet প্রকাশনীর ওয়েবসাইটে La medicina come religione (ধর্মতন্ত্র রূপে ঔষধ, Medicine as a religion) নামে প্রসঙ্গত আরেকটি লেখা গত ২রা মে প্রকাশিত হয়েছে। আগামবেনের নিজের অনুরোধেই অ্যাডাম কসকো(Adam kotsko) এই লেখাটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। “An und für sich” ব্লগে ইংরেজি অনুবাদটি Giorgio Agamben: Medicine as Religion নামে প্রকাশিত হয়েছে একই দিনে। আগামবেনের এই লেখাটি ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন কাব্য কৃত্তিকা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য মাস্টার্স শেষ করেছেন কাব্য কৃত্তিকা। অনুবাদটি সম্পাদনা ও পরিমার্জন করেছেন আবদুল্লাহ আল মামুন। আবদুল্লাহ আল মামুন পেশায় শিক্ষক, ঢাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান।]



ধর্মতন্ত্র রূপে ঔষধ


বিজ্ঞান আমাদের সময়ের ধর্মতন্ত্রেবিজ্ঞান আমাদের সময়ের ধর্মতন্ত্রে(ReligionReligion) রূপান্তরিত হয়েছে। এই বিজ্ঞানেই রয়েছে মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা। এই সময়ে বিষয়টা প্রকট ও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আধুনিক পশ্চিমে তিনটি বড়সড় বিশ্বাসের ধারা (খ্রিস্টধর্ম, পুঁজিবাদ এবং বিজ্ঞান) পাশাপাশি অস্তিত্বশীল রয়েছে। কিছুটা হলেও তারা এখনো সহাবস্থান করছে। আধুনিকতার ইতিহাসে, এই তিনটি “ধর্মতন্ত্র” প্রায়শই অন্তর্ছেদ রূপান্তরিত হয়েছে। এই বিজ্ঞানেই রয়েছে মানুষের বিশ্বাস ও আস্থা। এই সময়ে বিষয়টা প্রকট ও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আধুনিক পশ্চিমে তিনটি বড়সড় বিশ্বাসের ধারা (খ্রিস্টধর্ম, পুঁজিবাদ এবং বিজ্ঞান) পাশাপাশি অস্তিত্বশীল রয়েছে। কিছুটা হলেও তারা এখনো সহাবস্থান করছে। আধুনিকতার ইতিহাসে, এই তিনটি “ধর্মতন্ত্র” প্রায়শই অন্তর্ছেদ(intersect বা এফোড়-ওফোড়intersect বা এফোড়-ওফোড়) করেছে। সময়ে সময়ে এদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। পরবর্তীতে আবার বিভিন্ন উপায়ে মিলিত হয়েছে। একটা শান্তিপূর্ণ ও গোছানো সহাবস্থানে ধাপে ধাপে পৌঁছানো অব্দি এই এফোড়-ওফোড়চলেছে। মিলিত স্বার্থের অছিলায় যদি সাচ্চা ও খাঁটি মেলবন্ধন নাও থাকে, তবুও একটা শান্তিপূর্ণ ও গোছানো সহাবস্থানে তারা পৌঁছাতে পেরেছে।


নতুন ঘটনা’টা হল, আমাদের অলক্ষ্যেই বিজ্ঞান এবং বাঁকি দুটি ধর্মতন্ত্রের মধ্যে একটা চাপা ও অনমনীয় দ্বন্দ্ব চলছে। এই দ্বন্দ্বের চরিতার্থ ফলাফল হিসেবে প্রতিনিয়ত বিজ্ঞান আমাদের চোখের সামনে হাজির হচ্ছে। অপ্রত্যাশিতভাবে বিজ্ঞান আমাদের অস্তিত্বের সকল বিষয়কে নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। তত্ত্ব কিংবা সাধারণ মূলনীতি অতীতে ভাবনার বিষয়বস্তু ছিল, কিন্তু বর্তমানের এই দ্বন্দ্ব সেসবের ধার ধারেনা। তবে বলাই যায়, কাল্টিক (বা ধর্মসম্প্রদায়ের) যাগযজ্ঞের নতুন ঘটনা’টা হল, আমাদের অলক্ষ্যেই বিজ্ঞান এবং বাঁকি দুটি ধর্মতন্ত্রের মধ্যে একটা চাপা ও অনমনীয় দ্বন্দ্ব চলছে। এই দ্বন্দ্বের চরিতার্থ ফলাফল হিসেবে প্রতিনিয়ত বিজ্ঞান আমাদের চোখের সামনে হাজির হচ্ছে। অপ্রত্যাশিতভাবে বিজ্ঞান আমাদের অস্তিত্বের সকল বিষয়কে নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। তত্ত্ব কিংবা সাধারণ মূলনীতি অতীতে ভাবনার বিষয়বস্তু ছিল, কিন্তু বর্তমানের এই দ্বন্দ্ব সেসবের ধার ধারেনা। তবে বলাই যায়, কাল্টিক (বা ধর্মসম্প্রদায়ের) যাগযজ্ঞের (Cultic practiceCultic practice) ব্যাপারকে এটা বেশ পরোয়া করে। বিজ্ঞানও কিন্তু ধর্মতন্ত্রের মতো গলি ঘুপচি, ফাঁক-ফোকর ভালোই চিনে। ঐসব দিয়েই তো বিজ্ঞান নিজের কাঠামোকে সুসংহত করে। এই সুসংহত করার উদ্দেশ্য হচ্ছে গূঢ় ও কট্টর মতান্ধতার প্রসার ঘটানো। এই ব্যাপারটা আদিগন্ত বিস্তৃত কাল্টিক পরিসরের [চর্চা ও বিশ্বাস] সাথে কার্যত মিলে যায়। কৃৎকৌশল ব্যাপারকে এটা বেশ পরোয়া করে। বিজ্ঞানও কিন্তু ধর্মতন্ত্রের মতো গলি ঘুপচি, ফাঁক-ফোকর ভালোই চিনে। ঐসব দিয়েই তো বিজ্ঞান নিজের কাঠামোকে সুসংহত করে। এই সুসংহত করার উদ্দেশ্য হচ্ছে গূঢ় ও কট্টর মতান্ধতার প্রসার ঘটানো। এই ব্যাপারটা আদিগন্ত বিস্তৃত কাল্টিক পরিসরের [চর্চা ও বিশ্বাস] সাথে কার্যত মিলে যায়। কৃৎকৌশল(technologytechnology) বলতে আমরা যা বুঝি, তার সাথে আবার এই কাল্টিক পরিসর সাদৃশ্যপূর্ণ।


এই নতুন ধর্মযুদ্ধের নায়কএই নতুন ধর্মযুদ্ধের নায়কহবেহবেবিজ্ঞানের এমন একটা অংশ, যে অংশে মতান্ধতার গিঁট খুব বেশি আটোসাটো নয়। অবশ্য বিজ্ঞানের এই অংশের ব্যবহারিক(প্রায়োগিক) দিকটা হবে অধিক শক্তিশালী। এতে মোটেই আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এই প্রসঙ্গে ওষুধের উদাহরণ টানা যায়, যার সরাসরি লক্ষ্যবস্তু হলো মানুষের জীবন্ত শরীর। চলুন আমরা এই বিজ্ঞানের এমন একটা অংশ, যে অংশে মতান্ধতার গিঁট খুব বেশি আটোসাটো নয়। অবশ্য বিজ্ঞানের এই অংশের ব্যবহারিক(প্রায়োগিক) দিকটা হবে অধিক শক্তিশালী। এতে মোটেই আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এই প্রসঙ্গে ওষুধের উদাহরণ টানা যায়, যার সরাসরি লক্ষ্যবস্তু হলো মানুষের জীবন্ত শরীর। চলুন আমরা এই জয়ী বিশ্বাসের (victorious faith, বিশ্বাসই আমার জয়ী হবার কারণvictorious faith, বিশ্বাসই আমার জয়ী হবার কারণ)[i] মূল বৈশিষ্ট্য আগে স্থির করে নেই। এই জয়ী বিশ্বাসের সাথে আমাদের অবশ্যই উত্তরোত্তর বোঝাপড়া করে নিতে হবে।


[১] প্রথম বৈশিষ্ট্য হল, পুঁজিবাদের মত ওষুধেরও কোন বিশেষ মতাদর্শেরদরকার পড়ে না। বরং জীববিজ্ঞান থেকে মৌলিক ধারণাগুলো ধার নেয়া পর্যন্তই এটা নিজেকে সীমিত রাখে। যাইহোক, জীববিজ্ঞানের থেকে উল্টোভাবে, ওষুধ সেসব ধারণাগুলোকে সাজায় নস্টিক-মানিধর্মদরকার পড়ে না। বরং জীববিজ্ঞান থেকে মৌলিক ধারণাগুলো ধার নেয়া পর্যন্তই এটা নিজেকে সীমিত রাখে। যাইহোক, জীববিজ্ঞানের থেকে উল্টোভাবে, ওষুধ সেসব ধারণাগুলোকে সাজায় নস্টিক-মানিধর্ম[ii] অর্থে। অর্থাৎ অতিরঞ্জিত দ্বৈত বৈপরীত্য অর্থে। অর্থাৎ অতিরঞ্জিত দ্বৈত বৈপরীত্য (dualistic oppositiondualistic opposition) অনুসারে সেসব ধারণাগুলোকে সাজায়। একদিকে রয়েছে রোগ-বালাই নামের একটা ক্ষতিকর ঈশ্বর বা মূলতত্ত্ব। এই বর্গের প্রতিনিধি হল ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস। উল্টোদিকে, একটা উপকারী ঈশ্বর বা মূলতত্ত্ব আছে। এই উপকারী ঈশ্বর বা মূলতত্ত্ব কিন্তু মোটেই স্বাস্থ্য নয়, বরং স্বাস্থ্যের পুনরুদ্ধার বা সারিয়ে তোলা। এই বর্গেরপ্রতিনিধি হল ওষুধ ও থেরাপি। সকল নস্টিকবিশ্বাসের মতই এই দুটি মূলতত্ত্বও স্পষ্টত আলাদা। কিন্তু কাজকর্মে এরা পরস্পরকে সংক্রমিত করতে পারে। ডাক্তারেরা উপকারী মূলতত্ত্বের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। কিন্তু তারা ভুল করে ফেলতে পারে এবং অজান্তেই শত্রুর সহযোগী হয়ে উঠতে পারে। এই দুর্বলতা বাদ দিলে, অন্যকোন উপায়ে দ্বৈতবাদের বাস্তবতা ও কাল্টের প্রয়োজনীয়তার মারফতে উপকারী মূলতত্ত্বটি লড়াই লড়ে যায়। লক্ষণীয় যে, বিজ্ঞানের অর্থাৎ ভাইরাসবিদ্যারবিশ্বাসের মতই এই দুটি মূলতত্ত্বও স্পষ্টত আলাদা। কিন্তু কাজকর্মে এরা পরস্পরকে সংক্রমিত করতে পারে। ডাক্তারেরা উপকারী মূলতত্ত্বের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। কিন্তু তারা ভুল করে ফেলতে পারে এবং অজান্তেই শত্রুর সহযোগী হয়ে উঠতে পারে। এই দুর্বলতা বাদ দিলে, অন্যকোন উপায়ে দ্বৈতবাদের বাস্তবতা ও কাল্টের প্রয়োজনীয়তার মারফতে উপকারী মূলতত্ত্বটি লড়াই লড়ে যায়। লক্ষণীয় যে, বিজ্ঞানের অর্থাৎ ভাইরাসবিদ্যার(virologyvirology) প্রতিনিধি ধর্মতাত্ত্বিকেরা এই লড়াইয়ের কৌশলসমূহ নির্ধারণ করে। ভাইরাসবিদ্যার নিজস্ব কোন জায়গা নেই, কিন্তু জীববিজ্ঞান ও ওষুধের মাঝখানের সীমান্তে এটার বসবাস।


[২] এতদিন পর্যন্ত, সব আচার-অনুষ্ঠানের মত এই কাল্টিক যাগযজ্ঞ[২] এতদিন পর্যন্ত, সব আচার-অনুষ্ঠানের মত এই কাল্টিক যাগযজ্ঞ(cultic practicecultic practice)ও পর্যাবৃত্ত ছিল এবং নির্দিষ্ট কালে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আমরা এখন যেই অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছি, তা থেকে মনে হচ্ছে এই কাল্টিক যাগযজ্ঞ স্থায়ী এবং সর্বব্যাপী হয়ে উঠেছে। এটা এখন আর ওষুধ সেবন অথবা প্রয়োজনে ডাক্তার দেখানো কিংবা সার্জারি করানো’র মামলায় সীমিত নেইঃ প্রতিটি মুহুর্তে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাল্টিক[ধর্মানুষ্ঠান]উদযাপন করবার ক্ষেত্রভূমিতে পরিণত হবে মানবজাতির সমগ্র জীবন। শত্রুপক্ষ অর্থাৎ ভাইরাস সর্বদা বর্তমান এবং সম্ভাব্য যেকোন ধরনের বিরতি ছাড়াই এর বিরুদ্ধে আমাদের বিরামহীন লড়াই চালাতে হবে। ভাইরাসের অনুরূপ সর্বগ্রাসী প্রবণতা সম্বন্ধে খ্রিস্টধর্মও অবগত ছিল। কিন্তু গুটিকয়েক ব্যক্তির সর্বগ্রাসী প্রবণতার ব্যাপারেই খ্রিস্টধর্ম কেবল সজাগ থেকেছে। যেই সাধু-সন্ন্যাসীরা ‘অবিরত বন্দেগী করো’ নীতিতে তাঁদের সমগ্র জীবনযৌবন সঁপে দেয়, বিশেষত সেই সাধু-সন্ন্যাসীদের মাঝের সর্বগ্রাসী প্রবণতার ব্যাপারেই খ্রিস্টধর্ম সজাগ থেকেছে। (ধর্মতন্ত্র হিসেবে) ওষুধ সেন্ট পলের এই দেশনা উদযাপন করবার ক্ষেত্রভূমিতে পরিণত হবে মানবজাতির সমগ্র জীবন। শত্রুপক্ষ অর্থাৎ ভাইরাস সর্বদা বর্তমান এবং সম্ভাব্য যেকোন ধরনের বিরতি ছাড়াই এর বিরুদ্ধে আমাদের বিরামহীন লড়াই চালাতে হবে। ভাইরাসের অনুরূপ সর্বগ্রাসী প্রবণতা সম্বন্ধে খ্রিস্টধর্মও অবগত ছিল। কিন্তু গুটিকয়েক ব্যক্তির সর্বগ্রাসী প্রবণতার ব্যাপারেই খ্রিস্টধর্ম কেবল সজাগ থেকেছে। যেই সাধু-সন্ন্যাসীরা ‘অবিরত বন্দেগী করো’ নীতিতে তাঁদের সমগ্র জীবনযৌবন সঁপে দেয়, বিশেষত সেই সাধু-সন্ন্যাসীদের মাঝের সর্বগ্রাসী প্রবণতার ব্যাপারেই খ্রিস্টধর্ম সজাগ থেকেছে। (ধর্মতন্ত্র হিসেবে) ওষুধ সেন্ট পলের এই দেশনা (Pauline precept, ধর্মোপদেশPauline precept, ধর্মোপদেশ) গ্রহণ করেছে এবং একইসাথে সেই দেশনাকে উল্টে দিয়েছেঃ অবিরাম প্রার্থনা-ইবাদতবন্দেগী করতে কনভেন্টে গ্রহণ করেছে এবং একইসাথে সেই দেশনাকে উল্টে দিয়েছেঃ অবিরাম প্রার্থনা-ইবাদতবন্দেগী করতে কনভেন্টে(খ্রিস্টধর্মের সন্ন্যাসীদের খ্রিস্টধর্মের সন্ন্যাসীদের মঠ) একসময় সাধুরা জড়ো হত। আর বর্তমানে এই ধর্মীয় অনুশীলন আরও একাগ্রতা ও যত্নশীলতার সাথে পালন করতে হবে, কিন্তু সেসময়েও একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে আলাদা আলাদা হয়ে থাকতে হবে।


[৩] কাল্টিক যাগযজ্ঞ এখনআর উন্মুক্ত ও স্বেচ্ছাধীন নেই। এটা এখন এক ঐশ্বরিক আদেশের নিষেধাজ্ঞার কবলে পরেছে। কিন্তু পূর্বের আদর্শ নিয়মে পালনের অবস্থায় এই কাল্টিক যাগযজ্ঞকে ফিরিয়ে নেয়া বা প্রত্যাবর্তন করা অবশ্যকর্তব্য। ধর্মতন্ত্র এবং অপবিত্রআর উন্মুক্ত ও স্বেচ্ছাধীন নেই। এটা এখন এক ঐশ্বরিক আদেশের নিষেধাজ্ঞার কবলে পরেছে। কিন্তু পূর্বের আদর্শ নিয়মে পালনের অবস্থায় এই কাল্টিক যাগযজ্ঞকে ফিরিয়ে নেয়া বা প্রত্যাবর্তন করা অবশ্যকর্তব্য। ধর্মতন্ত্র এবং অপবিত্র(profaneprofane) ক্ষমতার মধ্যকার আঁতাত বা যোগসাজশ নিশ্চিতভাবেই কোন নতুন ঘটনা নয়। এখানে সম্পূর্ণভাবে নতুন ব্যাপার যেটা তা হল, এখন আর বিশ্বাসের স্বীকৃতির প্রশ্নে ধর্মতন্ত্র তেমনটা সচেতন না (ধর্মদ্রোহিতার ক্ষেত্রে [ইউরোপের মধ্যযুগে] যেমনটা ঘটেছিল)। একচেটিয়াভাবে, এটা বরং ধর্মীয় যাগযজ্ঞের উদযাপনেই অধিক মনোযোগী। অপবিত্র ক্ষমতা অবশ্যই নজরদারি জারি রাখবে, যাতে করে বস্তুত চিকিৎসাবিদ্যক ধর্মতন্ত্রের(medical religion, যা এখন জীবনের সবকিছুতে বিজড়িত) উপাসনাকে ক্ষমতার মধ্যকার আঁতাত বা যোগসাজশ নিশ্চিতভাবেই কোন নতুন ঘটনা নয়। এখানে সম্পূর্ণভাবে নতুন ব্যাপার যেটা তা হল, এখন আর বিশ্বাসের স্বীকৃতির প্রশ্নে ধর্মতন্ত্র তেমনটা সচেতন না (ধর্মদ্রোহিতার ক্ষেত্রে [ইউরোপের মধ্যযুগে] যেমনটা ঘটেছিল)। একচেটিয়াভাবে, এটা বরং ধর্মীয় যাগযজ্ঞের উদযাপনেই অধিক মনোযোগী। অপবিত্র ক্ষমতা অবশ্যই নজরদারি জারি রাখবে, যাতে করে বস্তুত চিকিৎসাবিদ্যক ধর্মতন্ত্রের(medical religion, যা এখন জীবনের সবকিছুতে বিজড়িত) উপাসনাকে(liturgyliturgy) পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। এটা বোঝাই যাচ্ছে যে, আমরা এখানে একটা কাল্টিক যাগযজ্ঞের সাথে বোঝাপড়া করছি। ইতোমধ্যেই সংশয়াতীত ও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত কোন যৌক্তিক বৈজ্ঞানিক দাবির সাথে আমরা বোঝাপড়া করছি না। এখনও পর্যন্ত আমাদের দেশে হৃদরোগসংক্রান্ত অসুখে বহুসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটে। এই ব্যাপারটাও সুবিদিত যে, যদি আমরা একটা স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারা অনুসরণ করি এবং নির্দিষ্ট খাদ্য গ্রহণ করি, তাহলে এই মৃত্যুর পরিমাণ কমানো সম্ভব। কিন্তু কোন ডাক্তারের মাথায় কখনো এই চিন্তাই আসেনি যে, এই জীবনধারা ও খাদ্য তালিকা (যা তারা রোগীকে পরামর্শ দেয়) একটা আইনী বিষয়বস্তু হয়ে পড়বে। তাঁদের মাথায় আসেনি যে, কি বস্তু খেতে হবে এবং কিভাবে জীবনযাপন করতে হবে—তাঁদের সেই পরামর্শ আইনীপুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। এটা বোঝাই যাচ্ছে যে, আমরা এখানে একটা কাল্টিক যাগযজ্ঞের সাথে বোঝাপড়া করছি। ইতোমধ্যেই সংশয়াতীত ও স্পষ্টভাবে প্রমাণিত কোন যৌক্তিক বৈজ্ঞানিক দাবির সাথে আমরা বোঝাপড়া করছি না। এখনও পর্যন্ত আমাদের দেশে হৃদরোগসংক্রান্ত অসুখে বহুসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটে। এই ব্যাপারটাও সুবিদিত যে, যদি আমরা একটা স্বাস্থ্যসম্মত জীবনধারা অনুসরণ করি এবং নির্দিষ্ট খাদ্য গ্রহণ করি, তাহলে এই মৃত্যুর পরিমাণ কমানো সম্ভব। কিন্তু কোন ডাক্তারের মাথায় কখনো এই চিন্তাই আসেনি যে, এই জীবনধারা ও খাদ্য তালিকা (যা তারা রোগীকে পরামর্শ দেয়) একটা আইনী বিষয়বস্তু হয়ে পড়বে। তাঁদের মাথায় আসেনি যে, কি বস্তু খেতে হবে এবং কিভাবে জীবনযাপন করতে হবে—তাঁদের সেই পরামর্শ আইনী(ex lege, আইনী বিষয়আইনী বিষয়) ডিক্রি হয়ে উঠবে। এটা আমাদের পুরো জীবনকে একটা স্বাস্থ্যসংক্রান্ত প্রয়োজনে পর্যবসিত করবে। অন্ততপক্ষে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে, অবিকলভাবে এটাই করা হয়েছে এবং মানুষ এটাকে মেনে নিয়েছে। মানুষ এমনভাবে মেনে নিয়েছে, যেন মনে হয় এটা সংশয়াতীত কোনো ব্যাপার। মানুষ নিজেদের চলাফেরার স্বাধীনতা, কাজকর্ম, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, সামাজিক সম্পর্ক, তাঁদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাসকে পরিত্যাগ করেছে।


এখানে আমরা দেখতে পাই, পশ্চিমের অন্য দুটি ধর্মতন্ত্র(খ্রিস্টের ধর্মতন্ত্র ও টাকার ধর্মতন্ত্র) দৃশ্যত কোন যুদ্ধ ছাড়াই ওষুধ ও বিজ্ঞানের কাছে তাঁদের মুখ্যতা(প্রথম স্থান) পরিত্যাগ করেছে। চার্চ তার মূলনীতি খুব সহজেই পুরোপুরি অস্বীকার করেছে। বর্তমান পোপ যেই সাধুর নাম[ফ্রান্সিস] ধারণ করেছেন সেই সাধু ফ্রান্সিস কিন্তু কুষ্ঠরোগীকে আলিঙ্গন করেছেন। অসুস্থ লোককে দেখতে যাওয়া পুণ্যের কাজ, ধর্মসংস্কার [দীক্ষাদান, বিবাহ, যীশুর স্মরণোৎসব, পবিত্র ভোজনোৎসব ইত্যাদি] পরিচালনা শুধু স্বশরীরে হাজির হওয়ার মাধ্যমেই সম্ভব—এইসব মূলনীতিকে চার্চ বেমালুম পরিত্যাগ করেছে, অস্বীকার করেছে। কিছুটা বিরোধিতা সহযোগে, পুঁজিবাদ উৎপাদনের ক্ষতিকে মেনে নিয়েছে। এই মুহুর্তে সেই বিরোধিতা অবশ্য একটা নিষ্পত্তিতে পৌঁছাতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে। উৎপাদনের ক্ষতি মেনে নেয়ার ব্যাপারটা পুঁজিবাদ আগে কোনোদিন ভেবে দেখার সাহস’ই করেনি। সম্ভবত, নতুন ধর্মতন্ত্রটির সাথে পরবর্তীতে কোন না কোন বোঝাপড়ার আশায় পুঁজিবাদ এই ক্ষতি মেনে নিয়েছে।


[৪] আখেরি বা শেষ বিচারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার[৪] আখেরি বা শেষ বিচারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার(eschatological urgencyeschatological urgency) বিষয়টিবিষয়টিচিকিৎসাবিদ্যক ধর্মতন্ত্র, খ্রিস্টধর্ম থেকে অকপটে গ্রহণ করেছে। এই বিষয়টি অবশ্য খ্রিস্টধর্ম ছেড়ে দিয়েছে, বাতিল করে দিয়েছে। নাজাতের ধর্মতত্ত্বীয় প্যারাডাইমকে সেক্যুলার করে তুলতে গিয়ে, ‘জমানার শেষ হয়ে যাওয়া’র ধারণাকে পুঁজিবাদ ইতোমধ্যে পরিত্যাগ করেছে। পুঁজিবাদ এর বদলে একটা স্থায়ী সঙ্কটপূর্ণ অবস্থা তৈরি করেছে যার কোন শেষ নাই বা প্রায়শ্চিত্য নাই। চিকিৎসাবিদ্যক ধর্মতন্ত্র, খ্রিস্টধর্ম থেকে অকপটে গ্রহণ করেছে। এই বিষয়টি অবশ্য খ্রিস্টধর্ম ছেড়ে দিয়েছে, বাতিল করে দিয়েছে। নাজাতের ধর্মতত্ত্বীয় প্যারাডাইমকে সেক্যুলার করে তুলতে গিয়ে, ‘জমানার শেষ হয়ে যাওয়া’র ধারণাকে পুঁজিবাদ ইতোমধ্যে পরিত্যাগ করেছে। পুঁজিবাদ এর বদলে একটা স্থায়ী সঙ্কটপূর্ণ অবস্থা তৈরি করেছে যার কোন শেষ নাই বা প্রায়শ্চিত্য নাই। Krisis[iii] মূলত একটা চিকিৎসাশাস্ত্রীয় ধারণা । Krisis হচ্ছে হিপোক্রেটীয় সংকলনেহচ্ছে হিপোক্রেটীয় সংকলনে[iv] মনোনীত সেই মুহূর্ত, যখন ডাক্তার সিদ্ধান্ত নেয় যে রোগী অসুখে বাঁচবে কি বাঁচবে না। ধর্মতাত্ত্বিকেরা এই পরিভাষাটিকে নিয়েছে শেষ বিচারকে বোঝাতে, যেটা সর্বশেষ দিনে ঘটবে। আমরা এক ব্যতিক্রমী [জরুরী]অবস্থায় দিন গুজরান করছি। যদি এই ব্যতিক্রমী অবস্থাকে পর্যবেক্ষণ করি, তবে আমরা এটা বলতে পারব যে পুঁজিবাদের ক্রমাগত সংকটের সাথে খ্রিস্টীয় শেষজমানার ধারণাকে সংযুক্ত করেছে চিকিৎসাবিদ্যক ধর্মতন্ত্র। চিকিৎসাবিদ্যক ধর্মতন্ত্র খ্রিস্টীয় কেয়ামতেরকে পর্যবেক্ষণ করি, তবে আমরা এটা বলতে পারব যে পুঁজিবাদের ক্রমাগত সংকটের সাথে খ্রিস্টীয় শেষজমানার ধারণাকে সংযুক্ত করেছে চিকিৎসাবিদ্যক ধর্মতন্ত্র। চিকিৎসাবিদ্যক ধর্মতন্ত্র খ্রিস্টীয় কেয়ামতেরকে পর্যবেক্ষণ করি, তবে আমরা এটা বলতে পারব যে পুঁজিবাদের ক্রমাগত সংকটের সাথে খ্রিস্টীয় শেষজমানার ধারণাকে সংযুক্ত করেছে চিকিৎসাবিদ্যক ধর্মতন্ত্র। চিকিৎসাবিদ্যক ধর্মতন্ত্র খ্রিস্টীয় কেয়ামতের(eschaton) ধারণাকেও সংযুক্ত করেছে। এই কেয়ামতের ধারণায়, চূড়ান্ত নিষ্পত্তি সর্বদাই চলছে এবং পরিসমাপ্তি একইসাথে ত্বরান্বিত ও প্রসারিত(দূরে সরে যাচ্ছে) হচ্ছে। চিরতরে সমাধা করবার প্রচেষ্টা বাদ দিয়ে, যদিও এই পরিসমাপ্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হওয়ার জন্য নিরবচ্ছিন্ন উদ্যোগ রয়েছে। এটা সেই পৃথিবীর ধর্মতন্ত্র যার ভাবই এমন যেন, এই বুঝি সময় ফুরোল ধারণাকেও সংযুক্ত করেছে। এই কেয়ামতের ধারণায়, চূড়ান্ত নিষ্পত্তি সর্বদাই চলছে এবং পরিসমাপ্তি একইসাথে ত্বরান্বিত ও প্রসারিত(দূরে সরে যাচ্ছে) হচ্ছে। চিরতরে সমাধা করবার প্রচেষ্টা বাদ দিয়ে, যদিও এই পরিসমাপ্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হওয়ার জন্য নিরবচ্ছিন্ন উদ্যোগ রয়েছে। এটা সেই পৃথিবীর ধর্মতন্ত্র যার ভাবই এমন যেন, এই বুঝি সময় ফুরোল(endend)। কিন্তু এই ধর্মতন্ত্র হিপোক্রেটীয় ডাক্তারদের মতো জোর গলায় বলতে পারেনা ঠিক বাঁচবে না মরবে।


[৫] চিকিৎসাবিদ্যক ধর্মতন্ত্র নাজাত ও প্রায়শ্চিত্যের(বা পাপমুক্তি) প্রত্যাশা দেয়না। (এই জায়গায় খ্রিস্টধর্মের সাথে অমিল রয়েছে, কিন্তু পুঁজিবাদের সাথে অবশ্য মিল রয়েছে।) উল্টোভাবে, এটা যে আরোগ্য খোঁজে তা শুধু সাময়িক সময়ের জন্য। কেননা খারাপ ঈশ্বর বা ভাইরাসকে একেবারে নির্মূল করা সম্ভব না। এটা ক্রমাগত পরিবর্তিত হতে থাকে এবং নতুনভাবে আরও বিপদজনক রূপ নেয়। মহামারী[৫] চিকিৎসাবিদ্যক ধর্মতন্ত্র নাজাত ও প্রায়শ্চিত্যের(বা পাপমুক্তি) প্রত্যাশা দেয়না। (এই জায়গায় খ্রিস্টধর্মের সাথে অমিল রয়েছে, কিন্তু পুঁজিবাদের সাথে অবশ্য মিল রয়েছে।) উল্টোভাবে, এটা যে আরোগ্য খোঁজে তা শুধু সাময়িক সময়ের জন্য। কেননা খারাপ ঈশ্বর বা ভাইরাসকে একেবারে নির্মূল করা সম্ভব না। এটা ক্রমাগত পরিবর্তিত হতে থাকে এবং নতুনভাবে আরও বিপদজনক রূপ নেয়। মহামারী(EpidemicEpidemic) পরিভাষাটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ, সর্বোপরি একটি রাজনৈতিক ধারণাকে নির্দেশ করে (গ্রীক ভাষায় demos হচ্ছে [রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান রূপে] জনগণ এবং polemos epidemios হোমারে উল্লেখিত হয়েছে গৃহযুদ্ধকে নামাঙ্কিত করতে)। এটা বৈশ্বিক রাজনীতির—(বা ন-রাজনীতির, non-politics) একটা নতুন এলাকা হিসেবে তৈরি হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যাইহোক, আমরা যেই মহামারীর মাঝে বসবাস করছি তা সম্ভবত এক বৈশ্বিক গৃহযুদ্ধকে বাস্তবায়ন করবে। সর্বোচ্চ সজাগ রাজনৈতিক তাত্ত্বিকদের মতে, এই বৈশ্বিক গৃহযুদ্ধ প্রথাগত বিশ্বযুদ্ধের স্থান দখল করে নিয়েছে। সকল জাতি ও সকল মানুষ এখন নিজেদের মধ্যে একটা যুদ্ধ করে টিকে আছে। কেননা, যে অদৃশ্য ও অধরা শত্রুর বিরুদ্ধে তাঁরা লড়াই করছে তা আসলে আমাদের ভেতরেই রয়েছে।


দার্শনিকদের অবশ্যই পুনরায় ধর্মতন্ত্রের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হবে। ইতিহাসের ধারায় এই ঘটনা বহুবার ঘটেছে। কিন্তু পূর্বের মত খ্রিস্টধর্মের সাথে নয়, এখন দার্শনিকদের বরং বিজ্ঞান বা তার সেই অংশের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হবে যা কিনা ধর্মতন্ত্রের আকার নিয়েছে।


অগ্ন্যুৎসবঅগ্ন্যুৎসব(bonfiresbonfires) আবার ফিরে আসবে কিনা এবং বইপত্তর নির্ঘন্টে ঠিকঠাক সাজিয়ে রাখা হবে কিনা তা আমি জানি না। কিন্তু এটা ঠিক জানি যে, যারা সত্যের সন্ধান চালিয়ে যাবে তাঁদের চিন্তাভাবনাকে এবং অধিপতিশীল যে মিথ্যাকথা চালু রয়েছে তার প্রত্যাখ্যান করাকে স্পষ্টতই নির্মূল করা হবে এবং গুজব বা ভুয়া খবর (খবর, চিন্তাভাবনা নয়, কারণ খবর বাস্তবের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ!) ছড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত করা হবে। ঠিক যেমনটা ইতোমধ্যেই আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। বাস্তব কিংবা বাস্তবের মত করে বানানো, যাইহোক না কেন, সকল জরুরী মূহুর্তে আমরা পুনরায় কিছু অগাচণ্ডী কুৎসাকারী দার্শনিক ও বজ্জাতদের দেখতে পাই। এরা এই বিপর্যয় থেকে মুনাফা খুঁজছে, যেই বিপর্যয় আবার তাঁরা নিজেরাই ডেকে এনেছে। এসবই ইতোমধ্যে ঘটেছে এবং ঘটতেই থাকবে। যারা সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দেয় তাঁরা কিন্তু তাঁদের কাজ থামাবে না। কেননা কেউতো অন্য কারো শাহাদাতের সাক্ষ্য দিতে পারেনা। আবার ফিরে আসবে কিনা এবং বইপত্তর নির্ঘন্টে ঠিকঠাক সাজিয়ে রাখা হবে কিনা তা আমি জানি না। কিন্তু এটা ঠিক জানি যে, যারা সত্যের সন্ধান চালিয়ে যাবে তাঁদের চিন্তাভাবনাকে এবং অধিপতিশীল যে মিথ্যাকথা চালু রয়েছে তার প্রত্যাখ্যান করাকে স্পষ্টতই নির্মূল করা হবে এবং গুজব বা ভুয়া খবর (খবর, চিন্তাভাবনা নয়, কারণ খবর বাস্তবের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ!) ছড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত করা হবে। ঠিক যেমনটা ইতোমধ্যেই আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। বাস্তব কিংবা বাস্তবের মত করে বানানো, যাইহোক না কেন, সকল জরুরী মূহুর্তে আমরা পুনরায় কিছু অগাচণ্ডী কুৎসাকারী দার্শনিক ও বজ্জাতদের দেখতে পাই। এরা এই বিপর্যয় থেকে মুনাফা খুঁজছে, যেই বিপর্যয় আবার তাঁরা নিজেরাই ডেকে এনেছে। এসবই ইতোমধ্যে ঘটেছে এবং ঘটতেই থাকবে। যারা সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দেয় তাঁরা কিন্তু তাঁদের কাজ থামাবে না। কেননা কেউতো অন্য কারো শাহাদাতের সাক্ষ্য দিতে পারেনা।[v]


______________

২রা মে, ২০২০


অনুবাদকের টীকা


[i] জয়ী বিশ্বাস (victorious faith): মোদ্দাকথায় বললে, আমার বিশ্বাসই আমাকে জয়ী করেছে— এই বোধ। বাইবেলে বর্ণিত আছে, “প্রত্যেক ঈশ্বরজাত সন্তান জগতকে জয় করে৷আমাদের বিশ্বাসই আমাদের জগতজয়ী করেছে৷ কে জগতের ওপরে বিজয়ী হতে পারে? যে বিশ্বাস করে যে, যীশুই ঈশ্বরের পুত্র৷”(১ যোহন ৪, ৫)


[ii] নস্টিক ধর্মসম্প্রদায়—গ্রিক শব্দ নসিস(Gnosis), যার অর্থ হচ্ছে ‘গুপ্ত অধ্যাত্ম রহস্যের জ্ঞান’। এই নসিস থেকে নস্টিক(Gnostic) শব্দের আবির্ভাব ঘটেছে। নস্টিক বলতে গুপ্ত আধ্যাত্মরহস্যের জ্ঞানবাদী গৌণধর্মকে বুঝায়। আর নস্টিসিজম(Gnosticism) হচ্ছে সেই প্রাচীন ধর্মীয় তত্ত্ব ও ব্যবস্থার সংকলন, খ্রিস্টের মৃত্যুর পরের প্রথম শতকে, শুরুর দিককার খ্রিস্টান ও ইহুদী উপ-সম্প্রদায়গুলোতে যার সূত্রপাত ঘটে। নস্টিসিজম মতবাদের বিশ্বতত্ত্ব দ্বৈতবাদী ছিল, অর্থাৎ তাঁদের মতবাদে মূলতত্ত্ব দুইটি। এর মূল শিক্ষা হচ্ছে, ঈশ্বর দুনিয়া সৃষ্টি করেননি, বরং একজন ত্রুটিযুক্ত মন্দ স্রষ্টা পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। নস্টিক’রা বিশ্বাস করত যে, প্রাকৃতিক সবকিছুই মন্দ এবং আত্মা-ই ভাল।


মানি ধর্ম—ইংরেজিতে Manichaeism, মানিকাইজম। সাসানীয় সাম্যাজ্যের কালে, পারস্যের(ইরানী) ধর্মপ্রচারক মানি (Mani, ২১৬-২৭৬ খ্রিষ্টাব্দ) প্রচার করেন এই ধর্মমত। মানি ধর্মে একটি দ্বৈত বিশ্বতত্ত্বের(মূলতত্ত্ব রয়েছে দুইটি) শিক্ষা বর্ণিত হয়েছে যেখানে ভালো (আলোকময় আধ্যাত্মিক জগত) এবং মন্দ (অন্ধকারময় বস্তুগত জগত) এর মধ্যে সঙ্ঘাতের কথা।


[iii]Krisis—রোগের ক্ষেত্রে সেই ক্ষণ বা পরিবর্তন, যা সুস্থ হয়ে ওঠা অথবা মৃত্যুর ইঙ্গিত দেয়। হিপোক্রিটাসে এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।


[iv] হিপোক্রেটীয় সংকলন(Hippocratic Corpous): গ্রিক চিকিৎসাবিদ্যার উপর হিপোক্রেটীয় সংকলন নামে একটা লিখিত দলিল পাওয়া যায়, যার সংকলক গ্রীক চিকিৎসাবিজ্ঞানের “জনক” দার্শনিক হিপোক্রেটস। তিনি মূলত, খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ থেকে ৪০০ অব্দ পর্যন্ত গ্রিক চিকিৎসা বিদ্যার উপর লিখিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রচনা নিয়ে এই সঙ্কলনটি করেন। প্রায় ৬০ টি রচনার সমন্বয়ে এই সঙ্কলনটিতে অন্তত ১৯ জন লেখকের রচনা স্থান পায়।


[v] আগামবেনের এই লেখাটির সর্বশেষ বাক্যের অনুবাদে সহায়তা করেছেন পারভেজ আলম।পাউল সেলানের “অ্যাশগ্লোরি” কবিতার শেষবাক্যকে আগামবেন এই লেখায় শেষবাক্যে ও তাঁর অন্যান্য কাজে ব্যবহার করেছেন। পাউল সেলানের কবিতাটার অনুবাদ করে দেয়ায় পারভেজ আলমের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে বোধিচিত্ত।


ছাইয়ের গৌরব

পাউল সেলান


অনুবাদঃ পারভেজ আলম


ছাইয়ের-গৌরব পেছনে

তোমার কম্পমান, বাধা

হাতগুলো তেমাথার মোড়ে।

পন্টিক সমুদ্র অন্য সময়েরঃ এখানে,

এক ফোটা,

পানিতে

ডুবন্ত রাডার ব্লেড,

গভীর

প্রস্তরিভূত ওয়াদায়।

(ঐ ঝুলন্ত

দমেরদড়িতে, তখন,

উঁচু থেকে আরো উঁচুতে,

দুই ব্যাথারগিটের মাঝে, যখন

ঝকঝকে তকতকে

তাতারচাঁদটা উঠে আসতো আমাদের কাছে,

আমি নিজেকে খুড়তাম তোমার ভেতরে এবং তোমার ভেতরে।)

ছাইয়ের-

মহিমা পেছনে

তুমি তেমাথার-

হাতগুলো।

তোমার সামনের, পূঁবের ঐ-

ছাচ, বড় ভয়ানক।

কেউতো

অন্য কারো শাহাদাতের

সাক্ষ্য দিতে পারেনা।



প্রথম প্রকাশঃ ১৮ই মে, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ১৮ই মে, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/365073281278876/