দমনের-পীড়ন ডেকে আনবার মরাকান্নাঃ করোনার কালে লোকরঞ্জনবাদী এবং গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি

কারস্টেন শুবার্ট


[করোনা ভাইরাস মহামারীর এইকালে জৈব-রাজনীতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা শুরু হয়েছে। আগামবেনের লেখার সূত্র ধরে এই বিতর্ক দানা বেঁধেছে। আগামবেনের আলাপে জনস্বাস্থ্যের সঙ্কটের প্রসঙ্গকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে বলে অনেকেই অভিযোগ জানিয়েছে। প্যারাডাইম হিসেবেই জৈব-রাজনীতি এক দোটানায় পড়েছে এইকালে। জনস্বাস্থ্য সংকট আর স্বাধীনতা হরণের প্রসঙ্গ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলা না স্বাধীনতা রক্ষা, এই দোটানায় গিয়ে ঠেকেছে জৈব-রাজনীতি নিয়ে আলাপ। অনেকেই এই পাঁক থেকে জৈব-রাজনীতিকে উদ্ধারে নেমেছেন। জৈব-রাজনীতির ধারণার উদ্গাতা মিশেল ফুকোকে পুনর্পাঠের প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে। এই প্যারাডক্সিক্যাল পরিস্থিতি থেকে বেড়িয়ে আসতে অনেকেই ফুকোকে আবার নিবিড়ভাবে পড়তে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ইতোমধ্যেই গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির ধারণার প্রস্তাব তুলেছেন পানাজিওটিস সোটিরিস। এই দার্শনিক বিতর্কে যুক্ত হয়েছেন ফ্রাইবুর্গের আলবার-লুডভিগ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক তত্ত্বের অধ্যাপক কারস্টেন শুবার্ট(Karsten Schubert)। জৈব-রাজনীতির গতানুগতিক ভাষ্য এবং লোকসমাজের দাবীকৃত অর্থাৎ লোকরঞ্জনবাদী (populist) জৈব-রাজনীতির সঙ্কট দেখিয়ে তাঁর আলাপকে টেনে নিয়ে গেছেন। শুবার্টের লেখাটির শিরোনাম Crying for Repression: Populist and Democratic Biopolitics in Times of COVID-19, প্রকাশিত হয়েছে ‘Critical Legal Thinking’ ওয়েব পোর্টালে। শুবার্টের এই লেখাটির অনুবাদ করেছেন সজীব সাখাওয়াত। সজীব সাখাওয়াত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।]



আমরা এমন এক ফুকোডিয়ান সময়ে বাস করছি যখন জৈব-রাজনীতি(biopolitics) আর কোভিড-১৯ নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। এখনও যেটা লক্ষণীয়—জৈব-রাজনৈতিকভাবে—বর্তমান অবস্থার বড় অংশের অনেকটাই অলক্ষ্যে রয়েছেঃ আজকে আমরা জৈব-রাজনীতির যে ধরন দেখছি তাকে লোকরঞ্জনবাদী (populist) জৈব-রাজনীতি হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়। এই লোকরঞ্জনবাদী জৈব-রাজনীতি নিয়ে গড়ে উঠা সচেতনতা আজকের সময়ে আমাদের যা দরকার তার উপরে আলোকপাত করতে সাহায্য করেঃ সেটা হলো গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি।


জৈব-রাজনীতির গতানুগতিক বিশ্লেষণ মূলত রাষ্ট্র ও মেডিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধিক মনোযোগী। যেখানে প্রতিষ্ঠান কিভাবে ব্যক্তি আর জনগণের আচরণ পরিচালনা করে গতানুগতিক জৈব-রাজনীতি মূলত তার উপরই আলোকপাত করে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর উপর এ ধরনের জৈব-ক্ষমতার দমনমূলক(repressive) প্রভাবকেজৈব-রাজনীতির গতানুগতিক বিশ্লেষণ মূলত রাষ্ট্র ও মেডিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধিক মনোযোগী। যেখানে প্রতিষ্ঠান কিভাবে ব্যক্তি আর জনগণের আচরণ পরিচালনা করে গতানুগতিক জৈব-রাজনীতি মূলত তার উপরই আলোকপাত করে। ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর উপর এ ধরনের জৈব-ক্ষমতার দমনমূলক(repressive) প্রভাবকে[i] এইসব বিশ্লেষণ চিহ্নিত করে থাকে। মহামারীর এই সময়ে এসে জৈব-রাজনীতি তার শুদ্ধতমরূপে শাসন করে এবং দমনমূলক বাঞ্ছা বাস্তবায়নে রাষ্ট্র এইসব কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে— আগামবেনের (আগামবেন, ২০২০) এইরূপ ব্যাখ্যায় তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই। বর্তমান অবস্থার আরও মোলায়েম বিশ্লেষণ কিন্তু সরকারের এজেন্সীর উপরও আলো ফেলে। ফিলিপ সারাসিন (সারাসিন, ২০২০) আমাদের এটা মনে করিয়ে দেন যে, ফুকোর কাজে জৈব-রাজনীতির কোনো একাট্টা ধারণা নেই। বরং ক্ষমতার স্বতন্ত্র ধরনগুলোর এইসব বিশ্লেষণ চিহ্নিত করে থাকে। মহামারীর এই সময়ে এসে জৈব-রাজনীতি তার শুদ্ধতমরূপে শাসন করে এবং দমনমূলক বাঞ্ছা বাস্তবায়নে রাষ্ট্র এইসব কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে— আগামবেনের (আগামবেন, ২০২০) এইরূপ ব্যাখ্যায় তাই অবাক হওয়ার কিছু নেই। বর্তমান অবস্থার আরও মোলায়েম বিশ্লেষণ কিন্তু সরকারের এজেন্সীর উপরও আলো ফেলে। ফিলিপ সারাসিন (সারাসিন, ২০২০) আমাদের এটা মনে করিয়ে দেন যে, ফুকোর কাজে জৈব-রাজনীতির কোনো একাট্টা ধারণা নেই। বরং ক্ষমতার স্বতন্ত্র ধরনগুলোর[ii] মধ্যে ফুকো একটা সাবধানী বিভেদ টানার কথা প্রস্তাব করেন। মহামারীর প্রতিক্রিয়ায় প্রযুক্ত ক্ষমতার বিশিষ্ট ধরনকে আলাদা করে বিবেচনার প্রস্তাব করেন। এটা আবার করোনাভাইরাসের প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রের গৃহীত পদক্ষেপ নিয়ে মনোযোগী।


এই ধরনের জৈব-রাজনীতিক বিশ্লেষণগুলো ‘টপ-ডাউন’ ধরনের হয়ে থাকে। এসবে এজেন্সী, মুক্তি এবং গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত তৈরি সংক্রান্ত বিষয়ের জন্য কোনো জায়গা থাকে না। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো ও দমনমূলক ক্ষমতা প্রসঙ্গে জৈব-রাজনৈতিক তত্ত্বের এইযে আলাপ তা বিচারমূলক সামজিক বিশ্লেষণে ফুকোর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের এক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মাত্রঃ যেহেতু ক্ষমতার অধীন করে তোলার প্রক্রিয়াতে(Subjectification) আসলে কর্তাসত্তা গঠিত হয়, তাই দমনমূলক ক্ষমতা কর্তাসত্তা’রএই ধরনের জৈব-রাজনীতিক বিশ্লেষণগুলো ‘টপ-ডাউন’ ধরনের হয়ে থাকে। এসবে এজেন্সী, মুক্তি এবং গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত তৈরি সংক্রান্ত বিষয়ের জন্য কোনো জায়গা থাকে না। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো ও দমনমূলক ক্ষমতা প্রসঙ্গে জৈব-রাজনৈতিক তত্ত্বের এইযে আলাপ তা বিচারমূলক সামজিক বিশ্লেষণে ফুকোর গুরুত্বপূর্ণ অবদানের এক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মাত্রঃ যেহেতু ক্ষমতার অধীন করে তোলার প্রক্রিয়াতে(Subjectification) আসলে কর্তাসত্তা গঠিত হয়, তাই দমনমূলক ক্ষমতা কর্তাসত্তা’র[iii] মাঝেই কাজ করে—এই বিষয়টা দেখানোর জন্য। অধীন করে তোলার এইযে প্রক্রিয়া তার কাঠামোর মধ্যে এজেন্সী, স্বাধীনতা, প্রতিরোধ এবং মুক্তির ধারণা কিভাবে কাজ করে এটা (আপাতভাবে) অস্পষ্ট থেকে যায়। এই স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে এবং ফুকোর পান্ডিত্য নিয়ে এটিই বহুল আলোচিত সমালোচনা। (লেমকে, ২০১৯; শুবার্ট, ২০১৮).


দমনমূলক ক্ষমতায় অত্যধিক মনোযোগ দেয়াকে কমিয়ে এনে জৈব-রাজনীতির তত্ত্বে ভারসাম্য আনতে বর্তমান সময়ে ‘গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি’ ধারণাকে তত্ত্বায়িত করবার চেষ্টা হয়েছে। অংশগ্রহণকারী নাগরিক ও অ্যাক্টিভিস্টদের এজেন্সী নিয়ে কৈফিয়ত দিতে পারে গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি। এই গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির চরিত্র একইসাথে বিশ্লেষণমূলক (ক্ষমতা আসে নিচ থেকে, এবং জৈব-রাজনীতিক প্রক্রিয়াতে বিবিধ অংশগ্রহণকারীদেরকে বিবেচনা করতে হবে—ফুকোর এই অন্তদৃষ্টি অনুসারে) ও আদর্শমূলক (জৈব-রাজনীতির বিকাশে অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক ও নৈতিক ভাবনা হবে এমনকিছু যা কিনা মূল্যায়িত এবং সমর্থিত)।


HIV-Pre-Exposition-Prophylaxis (PrEP) সংক্রান্ত আলোচনায়, গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির এমন একটা ধারণা আমি দাঁড় করিয়েছি। আমি দেখিয়েছি যে, PrEP কেবল ফার্মাসিটিক্যালগুলোর টাকা কামানোর ফন্দিফিকির না। বরং এটা সক্রিয়ভাবেই সমকামী সমাজের চাওয়ার বিষয় এবং তাদের দ্বারাই বিকশিত হয়েছে (শুবার্ট, ২০১৯)। সমকামী সমাজে, লৈঙ্গিক সম্পর্কের নৈতিক বোঝাপড়ার একটি অংশবিশেষ হচ্ছে এই PrEP এবং এটি লৈঙ্গিক সম্পর্ককে স্টিগমাটাইজ করার যে প্রবণতা তাকে দূর করতে সহায়তা করে। সেইসাথে এটি সম-লৈঙ্গিক অধিকারের (homonormativity) জন্যও লড়াই করে। প্রভাবিত সমাজ ও মুক্তিদায়ী প্রভাবকের মাঝে জটিল সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্কের কারণেই সমকামীদের জীবনে এই জৈব-প্রযুক্তির প্রভাব রয়েছে। গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির ভাবনার বিকাশের জন্য PrEP একটি আদর্শ উদাহরণ। এবার কোভিড-১৯ প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। পানাজিওটিস সোটিরিস (সোটিরিস, ২০২০) সুপারিশ করেন যে, আগামবেনের দমনমূলক আখ্যানের বাইরে গিয়ে আমরা করোনাভাইরাস মহামারী সামলানোর জন্য গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির বিকাশ ঘটাতে পারি। সমকামী সমাজে যৌনসম্পর্কের ক্ষেত্রে নৈতিক বিবেচনা প্রসঙ্গে আমার বিশ্লেষণও একই ধরনের কথা বলে। এই পথেই, সোটিরিস বলপ্রয়োগ ও নজরদারির ব্যবস্থাগুলো ছাড়া এক সামষ্টিক যত্নআত্তিরের(care) কথা ভেবেছেন। এখানে সামাজিক দূরত্বের মতো চর্চাগুলো সচেতন ও গণতান্ত্রিক হবে। সামষ্টিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার এই প্রক্রিয়া কেবল ‘বিশেষজ্ঞদের আওতাভুক্ত’ হবে না, বরং ‘জ্ঞানের গণতান্ত্রিকীকরণে’র ভিত্তিতে করে গড়ে উঠবে।


দমনমূলক রাষ্ট্রে অধিক মনোযোগী গতানুগতিক জৈব-রাজনীতি আর অ্যাক্টিভিস্ট ও গোষ্ঠীর মুক্তিকামী এজেন্সীতে অধিক মনোযোগী গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি—এই দুই ধারণাই মহামারীর কালে হাজির হওয়া জৈব-রাজনৈতিক স্বাভাবিকীকরণ ও দমনের নতুন রূপের ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়ঃ এই নতুন রূপ হচ্ছে লোকরঞ্জনবাদী জৈব-রাজনীতি। লোকরঞ্জনবাদ যেহেতু গণতন্ত্রের অবক্ষয়, লোকরঞ্জনবাদী জৈব-রাজনীতিও সেহেতু গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির অবক্ষয়। এটি গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির দমনমূলক ও পিতৃতান্ত্রিক রূপ। অর্থাৎ রাষ্ট্রের বদলে এখানে সমাজের সদস্যরা জৈব-রাজনীতিতে(যা অন্যদের স্বাধীনতা সীমিত করে আর অন্যসব কিছুকে স্বাভাবিক করে তোলে) রত হয়। লোকরঞ্জনবাদী জৈব-রাজনীতি অনলাইন-অফলাইন দুই জায়গাতেই হাজির হয়। এটা ঘটে, যখন অনুমিত অযৌক্তিক ও অসংহতিমূলক আচরণের (যেমন ঘরের বাইরে যাওয়া, অন্যের সাথে দেখা করা ইত্যাদি) জন্য সমাজের সদস্যরা একে অপরকে অপমান করে, লজ্জা দেয়। #staythefuckathome এই এক কথাতেই ব্যাপারটা রয়েছে। জনগণের উপর কঠোর নিয়মনীতি আরোপের জন্য রাষ্ট্র যখন চাপ দেয়, সেই সময়ে আনুষ্ঠানিক রাজনীতির বয়ানে এই এক কথাতেই ব্যাপারটা রয়েছে। জনগণের উপর কঠোর নিয়মনীতি আরোপের জন্য রাষ্ট্র যখন চাপ দেয়, সেই সময়ে আনুষ্ঠানিক রাজনীতির বয়ানে[iv] এই লোকরঞ্জনবাদী জৈব-রাজনীতি আরও বেশি পরিমাণে দেখা যায় ।


রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন যেখানে তুলনামূলকভাবে কম(যেমন জার্মানিতে) সেখানেই লোকরঞ্জনবাদী জৈব-রাজনীতি সবচেয়ে দৃশ্যমান। সামাজিক মেলামেশায় নিষেধাজ্ঞার আইন পাস করার আগে থেকেই জার্মানিতে অধিক কর্তৃত্বপরায়ণ পদক্ষেপের ব্যাপক চাহিদা ছিল। এখানে অপরের সাথে সাক্ষাতের অধিকারের সদ্ব্যাবহার যারা করেছিল তাদেরকে দোষারোপ আর অপমান করেছে। উদাহরণস্বরূপ, অপমান করা ও কর্তৃত্বের চাহিদাকে একসাথেই দেখতে পাই যখন প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী আমরিন নাশেহি মিউনিখে একটি বাজারে জনসমাগমের ছবি টুইট করে মন্তব্য করেন, “দিনশেষে, কর্তৃত্ববাদী আচরণের আধুনিক সংস্করণ এখানে উদযাপিত হচ্ছেঃ সঠিক কাজটি কেবল তখনই করা হবে যখন এটির স্পষ্ট আদেশ দেয়া হবে”। (অনুমতি আছে এমন অবস্থায়) যেসব লোকজন দলবেঁধে একে অপরের সাথে দেখা করার অধিকার খাটায়, তাদেরকে কর্তৃত্ববাদী বলে নিন্দিত করাটা উদারনীতিবাদ সম্বন্ধে ভুলভাল বোঝাপড়াকেই ইঙ্গিত করে। উদারনীতিবাদ সক্ষম হয় সেই রাষ্ট্রের মারফতে যাকে কিনা মহামারী পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভরসা করা যেতে পারে। জার্মানির ক্ষেত্রে আমি এটাই বলতাম। যুক্তিযুক্ত নিয়ম প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রকে ভরসা করা, আমাদেরকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের পিতৃতন্ত্র(paternalism) থেকে মুক্ত জীবনযাপনে সক্ষম করবে। বিপরীতে, লোকরঞ্জনবাদী জৈব-রাজনীতি'র ‘সঠিক জিনিস’-এর প্রয়োগ ও লোকসমাজের বিচার-বিবেচনা খুবই ভয়ানক হবে। এমনটাই দেখা গেছে এইচআইভি আক্রান্ত লোকজনকে কলঙ্ক প্রদানের, স্টিগমাটাইজ করার ইতিহাসে।


যখন রাজনৈতিক তত্ত্বে আলোচিত লোকরঞ্জনবাদ আর গণতন্ত্রের ভাবগতির সাপেক্ষে বিবেচনা করব, করোনার লোকরঞ্জনবাদী জৈব-রাজনীতি তখন আমাদেরকে গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির নবীন ধারণার শান দেওয়াতে ঠেলে দিবে। মুলারের(মুলার, ২০১৬) মতে, লোকরঞ্জনবাদীরা দাবি করে যে তারা নৈতিক সত্যের একচেটিয়াকরণ এবং বহুত্ববাদকে খারিজ করার মাধ্যমে জনগণের সঠিক আগ্রহকে চিত্রিত করে। করোনাভাইরাসের এই সময়ে লোকরঞ্জনবাদী জৈব-রাজনীতি আমাদেরকে এইসব উপাদান দেখায়ঃ জনগণকে রক্ষা করার স্বার্থে আমরা কেবল নৈতিকভাবে সঠিক এমন কাজ করব। বলা হয়েছে, এটা কেবল ড্রাকোনীয়(Draconian) সামাজিক দূরত্ব সংক্রান্ত কঠোর আইন মেনে চলার মাধ্যমেই সম্ভব হবে। এই ছক বহুত্ববাদী বিবেচনা নয়। বরং জনগণের নামে নৈতিক ও রাজনৈতিক সত্য বলা। আমরা দেখতে পাব, হাঙ্গেরি ও ইসরাইলের মতো রাষ্ট্রগুলোতে কর্তৃত্ববাদী আচরণের প্রতিষ্ঠার জন্য সত্যিকারের লোকরঞ্জনবাদী নেতাদের হাতে এই ছককে কিভাবে অপব্যবহার করা হতে পারে।


উল্টোদিকে, গণতন্ত্র হচ্ছে বহুত্ববাদী। এই বহুত্ববাদ এবং ব্যক্তিক নৈতিকতা মেনে জীবনযাপনকে সাংবিধানিক আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এইরূপে, গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি হচ্ছে মজ্জাগতভাবে বহুত্ববাদী। রাজনীতিবিদ, ভাইরাস বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য বিষয়ে বিশেষজ্ঞ (উদাহরণস্বরূপ সমাজবিজ্ঞানী, নাগরিক সমাজের সদস্য) ইত্যাদি বহু প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণকে যুক্ত করে গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি। এটিকে বিভিন্ন নীতিমালার লক্ষ্যকে বিবেচনায় আনতে হয়, যেমন অর্থনীতির উপর প্রভাব কমিয়ে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভাঙন রোধ করা। সবশেষে, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে বলতে গেলে, গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির প্রয়োজন রয়েছে আইনের শাসনের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং এটা অবশ্যই সদাসর্বদা গৃহীত কর্মসূচির আনুপাতিকতা’কে(proportionality) প্রতিফলিত করবে।


এই মহামারি থেকে জৈব-রাজনীতির তত্ত্ব এই শিক্ষা নিতে পারে যে, জৈব-রাজনীতি মূখ্যত দমনমূলক রাষ্ট্র আর চিকিৎসাগত ক্ষমতার বিষয় নয়। বরং এটি গণতান্ত্রিক বিবেচনার একটি বিষয়। যাইহোক, এই ধরনের গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি ভুল পথে হাঁটতে পারে এবং লোকরঞ্জনবাদী জৈব-রাজনীতিতে পতিত হতে পারে। সোটিরিসের বিপরীতে কিংবা PrEP-এর গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির ক্ষেত্রে আমার আলোচনারও বিপরীতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মুক্তিকামী গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির দিকে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে কেবল সমাজের সংশ্লিষ্টতাই পর্যাপ্ত নয়। অপরদিকে, বিশেষত এই সংকটের সময়ে সাধারণ সমাজ(general community) লোকরঞ্জনবাদী জৈব-রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং ভয় দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তারা নৈতিক ফয়সালা করতে বসে যা আমাদের বন্দিদশার[আবদ্ধ থাকার পদক্ষেপ] সামাজিক প্রভাবকে উপেক্ষা করে। বিভিন্ন সামাজিক পর্যায়ে থাকা মানুষগুলোর ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তগুলো কীরকম অসম প্রভাব ফেলবে সেই বিষয়টিও উপেক্ষা করে। যখন জৈব-রাজনীতির অধিক গণতান্ত্রিক বিবেচনা প্রয়োজন, তখন এই মহামারি বিজ্ঞান ও যত্নবান রাজনীতির অভিবাবকত্বের দাবি করে যা আইনের শাসন দ্বারা প্রচন্ডভাবে সীমিত হবে। ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাই কর্তৃত্ববাদী আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করে। গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির ক্ষেত্রে দমনপীড়নের লোকরঞ্জনবাদী দাবির উত্তর হওয়া উচিত আইনী প্রপরশনালিটিএই মহামারি থেকে জৈব-রাজনীতির তত্ত্ব এই শিক্ষা নিতে পারে যে, জৈব-রাজনীতি মূখ্যত দমনমূলক রাষ্ট্র আর চিকিৎসাগত ক্ষমতার বিষয় নয়। বরং এটি গণতান্ত্রিক বিবেচনার একটি বিষয়। যাইহোক, এই ধরনের গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি ভুল পথে হাঁটতে পারে এবং লোকরঞ্জনবাদী জৈব-রাজনীতিতে পতিত হতে পারে। সোটিরিসের বিপরীতে কিংবা PrEP-এর গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির ক্ষেত্রে আমার আলোচনারও বিপরীতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মুক্তিকামী গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির দিকে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে কেবল সমাজের সংশ্লিষ্টতাই পর্যাপ্ত নয়। অপরদিকে, বিশেষত এই সংকটের সময়ে সাধারণ সমাজ(general community) লোকরঞ্জনবাদী জৈব-রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং ভয় দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তারা নৈতিক ফয়সালা করতে বসে যা আমাদের বন্দিদশার[আবদ্ধ থাকার পদক্ষেপ] সামাজিক প্রভাবকে উপেক্ষা করে। বিভিন্ন সামাজিক পর্যায়ে থাকা মানুষগুলোর ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্তগুলো কীরকম অসম প্রভাব ফেলবে সেই বিষয়টিও উপেক্ষা করে। যখন জৈব-রাজনীতির অধিক গণতান্ত্রিক বিবেচনা প্রয়োজন, তখন এই মহামারি বিজ্ঞান ও যত্নবান রাজনীতির অভিবাবকত্বের দাবি করে যা আইনের শাসন দ্বারা প্রচন্ডভাবে সীমিত হবে। ভারসাম্য প্রতিষ্ঠাই কর্তৃত্ববাদী আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করে। গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতির ক্ষেত্রে দমনপীড়নের লোকরঞ্জনবাদী দাবির উত্তর হওয়া উচিত আইনী প্রপরশনালিটি[v]। প্রথম দেখায় এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দাবি ফুকোডিয়ান মনে না হলেও, এটি আসলে স্বাধীনতার। প্রথম দেখায় এই রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দাবি ফুকোডিয়ান মনে না হলেও, এটি আসলে স্বাধীনতার[vi] সামাজিক পর্যালোচনার ফুকোর যে ভাবনা তাতে অন্তর্নিহিত রয়েছে। এই প্রসঙ্গে আমি অন্যত্র আলোচনা করেছি (শুবার্ট, ২০২০)। তবে এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে, বলিষ্ঠ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংস্থাপিত না হওয়া পর্যন্ত গণতান্ত্রিক জৈব-রাজনীতি সম্পূর্ণ অসার।

____________

১লা এপ্রিল, ২০২০


দোহাই


জর্জিও আগামবেন(২০২০), অকারণ জরুরতের ডেকে আনা জরুরী অবস্থা

থমাস লেমকে (২০১৯), Foucault’s analysis of modern governmentality. A critique of political reason. London, Brooklyn, NY: Verso.

ইয়ান ভারনার মুলার (২০১৬), What Is Populism? Philadelphia, Pa: University of Pennsylvania Press.

ফিলিপ সারাসিন (২০২০), Mit Foucault die Pandemie verstehen? – Geschichte der Gegenwart. https://geschichtedergegenwart.ch/mit-foucault-die-pandemie-verstehen/. Accessed 1 April 2020.

কারস্টেন শুবার্ট (২০১৮), Freiheit als Kritik. Sozialphilosophie nach Foucault. Bielefeld: transcript.

কারস্টেন শুবার্ট (২০১৯), The Democratic Biopolitics of PrEP. In Biopolitiken – Regierungen des Lebens heute, ed. Helene Gerhards and Kathrin Braun, 121–153. Wiesbaden: Springer Fachmedien Wiesbaden.

কারস্টেন শুবার্ট (২০২০), (accepted). Freedom as Critique. Foucault Beyond Anarchism. Philosophy & Social Criticism: ? Author’s Manuscripts: https://www.academia.edu/42463537/Freedom_as_Critique._Foucault_Beyond_Anarchism

পানাজিওটিস সোটিরিস (২০২০), আগামবেনের বিপক্ষে দাঁড়িয়েঃ গণতান্ত্রিক বায়োপলিটিক্স সম্ভব কি?


অনুবাদকের টীকা


[i] Repressive power বা দমনমূলক ক্ষমতা—ফুকো একে ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর ‘যৌনতার ইতিহাস’ গ্রন্থে। যৌনতাও কীভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের কলাকৌশল হয়ে ওঠে তা দেখানোর মধ্য দিয়ে ফুকো ক্ষমতার দমনমূলক চরিত্রকে বিশ্লেষণ করেছেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় ফুকোর ক্ষমতা সংক্রান্ত আলাপের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনটি মাত্রা পেয়েছেন- সার্বভৌমত্ব, অনুশাসন (discipline), আর প্রশাসনিকতা (governmentality) (পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ইতিহাসের উত্তরাধিকার, ২০০০)। ফুকোর দমনমূলক ক্ষমতা তাই কেবল সনাতন রাষ্ট্রক্ষমতা অর্থাৎ কেবল যে সার্বভৌমত্ব দিয়ে পরিচালিত হয় তা নয়, বরং অনুশাসনতন্ত্র এবং প্রশাসনিকতা দ্বারাও পরিচালিত হয়।


[ii] মহামারীকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার নতুন বিকশিত রূপ মূলত ফুকো কথিত অনুশাসন বা ডিসিপ্লিনের দিকেই ধাবিত করে। এই অনুশাসন শারীরিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে না, তা কাজ করে মানুষের চেতনায় (পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ইতিহাসের উত্তরাধিকার, ২০০০)। ফুকো দেখিয়েছেন, নজরবন্দী করতে পারলে তবেই অনুশাসনবদ্ধ করা যাবে। রাষ্ট্রগুলোর কোয়ারেন্টাইন নামক সামাজিক চুক্তি এই ক্ষমতার অনুশাসনের মাত্রা। যেখানে রাষ্ট্রগুলো তার নাগরিককে ঘরবন্দী করছে এবং একইসাথে তার উপর নজরদারির প্রক্রিয়া চালু করছে। ফুকো তাঁর শেষদিকের কিছু কাজে বলেছেন, ক্ষমতা সর্বত্র বিরাজমান।


[iii] Subject বা কর্তাসত্তা—এমন সত্তা যেটি আত্ম-সচেতন এবং কিভাবে ক্রিয়া করতে হবে তা বাছাই করতে সক্ষম। ফুকো উনবিংশ শতাব্দীর সার্বজনীন এবং অসীম কর্তাসত্তা সম্পর্কে ফেনোমেনোলজিকাল ধারণার বিরোধিতা করেন। ফুকো এবং ষাটের দশকের অন্যান্য চিন্তকরা মনে করতেন কর্তাসত্তা সংক্রান্ত এ ধরনের ধারণা মানুষের মধ্যে এমন কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যকে ঠিক করে দেবে যেগুলো পরিবর্তনযোগ্য নয়।


[iv] Discourse—কথকতা বা বয়ান। ফুকো কথা বলার একটা নির্দিষ্ট ধরনকে ডিসকোর্স হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এডওয়ার্ড সাঈদ বলছেন, ফুকো আমাদের দেখিয়েছেন ডিসকোর্স শুধুমাত্র সংগ্রাম আর কর্তৃত্বের পদ্ধতিকেই বর্ণনা করে না। বরং কাদের জন্য এই সংগ্রাম সংগঠিত হয় সেটাও দেখায় (পারভেজ হোসেন, মিশেল ফুকোঃ পাঠ ও বিবেচনা, ২০০৭)। ফুকোর ভাষাতেই ডিসকোর্সের সংজ্ঞা দেয়া যায় এভাবে “ডিসকোর্স হলো জ্ঞানের গঠনের একটি প্রক্রিয়া, যেটা সামাজিক অনুশীলনগুলোকে একত্রিত করে, আত্মনিষ্ঠা গঠন করে এই জ্ঞানের সহজাত ক্ষমতাসম্পর্ক গঠন করে এবং এর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে”। (Weedon, ১৯৮৭, পৃ-১০৮)


[v] Proportionality (আইন)— অপরাধ আইনের একটি সাধারণ নীতি যেটা অপরাধীর অপরাধের মাত্রা অনুসারে তার শাস্তির মাত্রা ঠিক হওয়ার ধারণা প্রদান করে।


[vi] ফুকোর ‘দৃঢ়ভাবে মানব স্বাধীনতা’য় বিশ্বাস করেন। তাঁর মতে, স্বাধীনতা কোনো লক্ষ্য নয় যেটা অর্জন করতে হবে। বরং স্বাধীনতা হলো একটা অনুশীলন। তিনি আরো মনে করতেন, ক্ষমতার চর্চার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা একটি শর্তমাত্র।


প্রথম প্রকাশঃ ২৪শে এপ্রিল, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ২৪শে এপ্রিল, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/2761415180787921/