সাক্ষাৎকারঃ য়েনবি করোনাভাইরাস সিরিজ


অ্যান্থ্রোপোসিনের যুগে পশু-পক্ষীবাহী রোগজীবাণু, মানব জীবন এবং মহামারী প্রসঙ্গে দীপেশ চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার



[শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তীর এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল গত বছরের জুনে। দীপেশ চক্রবর্তীর এই সাক্ষাৎকারটি তর্জমা করেছেন মোহাম্মদ শাহিনশাহিন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।]




আমরা কীভাবে চলমান মহামারীকে অ্যান্থ্রোপোসিনের ডিসকোর্স বা রাজনীতির নিরিখে বিচার করতে পারি? অতিমারীটি কি কোনোভাবে ডিসকোর্সটির পরিবর্তন ঘটায় বা মানব সমাজের পরিবর্তন বা উন্নতির জন্য নয়া সম্ভাবনার পথ খুলে দেয়?


আসলে এই মহামারী বৈশ্বিক ইতিহাসের সেই সময়কালের সাথে সম্পর্কিত যেটাকে কিনা ভূ-পৃথিবী ব্যবস্থার বিজ্ঞানীরা এবং তাদের সহযোগীরা “মহা ত্বরণ” (The Great Acceleration) বলে আখ্যা দিয়েছেন—যার সময়কাল ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান। কিন্তু এটি মানবতাকে নিশ্চিতভাবেই চমকে দিয়েছে। এটি অন্যসব দূর্যোগ, যেমন: বিধ্বংসী টাইফুন, ভূমিধ্বস বা অগ্নুৎপাতের মতো না—মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতার ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে আমরা যেসব ধারণা রাখি সেখান থেকে যে-দূর্যোগগুলোকে কিনা আমরা এখন প্রত্যাশা করা শুরু করছি। অথচ, যে মুহূর্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কোভিড-১৯ কে মহামারী বলে ঘোষণা দিলো, জাতিসংঘের কর্মকর্তারা তাদের পরিবেশসংক্রান্ত বিভাগে অতিদ্রুত’ই বন উজার, বন্যপ্রাণের বাসস্থান ধ্বংস, বর্ধনশীল মানব প্রাচুর্য এবং মহামারীর মধ্যে একটা যোগসূত্র গেঁথে দেন। তাদের কেউ কেউ এমনকি এত দূরে চলে গিয়েছিলেন যে, অতিমারীটিকে মানবজাতির প্রতি প্রকৃতির “সতর্কবাণী” রূপে ব্যাখ্যা দেন। তাঁরা সহ আরও অনেকেও দেখান যে, গত বিশ বা এরকম বছরে মানবজাতির জন্য যেসব নতুন সংক্রামক ব্যাধির দেখা মিলেছে তার পঁচাত্তর ভাগই পশু-পক্ষীবাহক প্যাথোজেন বা রোগজীবাণু (zoonotic pathogens) ধরনের। যার মানে হচ্ছে, এসব ব্যাধি জন্মলাভ করেছিল যখন কোন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া, প্রজাতির শরীরে বাসা বাঁধে—বন্যপ্রানী থেকে মানবে স্থানান্তরিত হয়। পশু ও পাখির শরীর থেকে মানব-শরীরে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার এই স্থানান্তর দ্রুততর হয়েছে বন্যপ্রাণের বাসস্থান ধ্বংসের মাধ্যমে। সেজন্য অবশ্য খনি খনন, বনের ধ্বংসযজ্ঞ, সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, বনভূমিকে কৃষিভূমিতে রূপান্তর, মানব-বাসস্থানের বর্ধনশীলতা, বন্যপ্রাণের বেআইনী বাণিজ্য এবং এরকম ইত্যাকার বিষয়াদির ফলে বন-নিধনের এই বর্ধনশীল গতিকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। এই প্রস্তাবগুলো ভাইরাসবিদ নাথান ওল্‌ফ (তাঁর The Viral Storm বইটি দেখুন) এবং Spillover-এর লেখক ডেভিড ক্যুয়ামেনের (David Quammen) মতো বিজ্ঞান লেখকদের গবেষণা দ্বারাও সমর্থিত। কার্যকরণসম্বন্ধের পারস্পর্য অ্যান্থ্রোপোসিন এবং মহামারীটির মধ্যে যোগসূত্রতা প্রকাশ করে। পারস্পর্যটা এরকম: সস্তা ও অঢেল শক্তির (energy) ক্রমবর্ধমান প্রতুলতা আরও অধিক মানবসংখ্যা ও সমৃদ্ধির দিকে ধাবিত করে, যা বদলা হিসেবে উন্নয়ন ও ভোগের জন্য ক্রমবর্ধমান মানবচাহিদা ফেরত দেয়। ফলে, পরিশেষে এটি বন্যপ্রাণের বাসস্থান ধ্বংস এবং মানব ও বন্যপ্রাণীর মুখোমুখি অবস্থানের ক্ষেত্র বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যায়। দুঃখজনকভাবে হলেও, সবগুলো ছক সুন্দরভাবেই মহা-ত্বরণের ভাষ্যটির সাথে মিলে যায়, যে ভাষ্যটি কিনা অ্যান্থ্রোপোসিন হাইপোথিসিসকে সমর্থন করে।


আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের ব্যাপারে বললে: অগ্রগতি সম্পর্কে নিশ্চিত না, তবে অতিমারীটি আমাদেকে অনেক কিছু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। যার মধ্যে এগুলো উল্লেখযোগ্য: (ক) অতিমারীটি দেখিয়েছে, যখন মানুষেরা তাদের উপস্থিতি এবং কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়, বিভিন্ন অঞ্চলে কীভাবে বাতাস আরও নির্মল হয়েছে, আকাশ আরও নীল হয়েছে এবং শহরগুলো কিছু পাখি ও প্রাণী ফিরে পেয়েছে যেগুলো তারা হয়তো হারিয়ে ফেলেছিল; (খ) দেখিয়েছে, আমরা হয়তো কম চলাচল এবং বেশী অনলাইন উপস্থিতি নিয়ে একটা বিশ্বে বাস করার জন্য প্রস্তুত হয়েছি; (গ) দেখিয়েছে, চলাচলের উপর এত নির্ভরশীল একটা বিশ্ব প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের ভবিষ্যত মহামারীর কাছে আমাদের দূর্বল করে রেখে দেয়; (ঘ) দেখিয়েছে, মানুষেরাই পৃথিবীর পরিবেশের সবচেয়ে বড় ধ্বংসকারী।

https://www.repository.cam.ac.uk/handle/1810/281960



এই মহামারী যেসব আদর্শিক প্রায়োগিক চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়েছে সেসব সমন্বয় করতে কীভাবে আমাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চিন্তা-প্রকল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে বলে আপনি মনে করেন?


অর্থনীতির বিশ্ব নেতারা যে তাঁদের পদ্ধতি সংশোধন করবেন না, এটা মাথায় রেখেই একটা কথা বলতে হচ্ছে, এই মহামারী বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে— যদি সম্ভব হয়— ভবিষ্যৎ মহামারীর আবির্ভাব সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা এবং সেগুলোর বৈশ্বিক ব্যবস্থার তদারকির জন্য একটা তাৎক্ষণিক জরুরত তুলে ধরেছে। সেটা ন্যূনতম স্বল্পমেয়াদের জন্যে হলেও দরকার। গরীব দেশগুলোর অর্থনীতিতে এই মহামারী যে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে তা তাদের কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করার বিষয়টি ধনী দেশগুলোর জন্য সম্ভবপর করে তুলতে গুটিকয়েক অর্থনীতিবিদ একটি আন্তর্জাতিক সংহতি তহবিল গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। যার ফলে বিশ্বের দরিদ্রদের ক্ষুধা জ্বালায় মৃত্যু নাকি মহামারীতে মৃত্যু--এরকম ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য না হতে হয়। যখন মহামারীটি শেষ হবে (যেহেতু অপরিহার্যভাবে এটি শেষ হবেই), এটা আমাদের এমন একটা মুহূর্ত এনে দিবে যখন বৈশ্বিক কার্বন কর আদায় শুরু হবে, যাতে লকডাউনকাল চলাকালে বাধ্য হয়ে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ হ্রাসকরণের যে ফায়দা পাওয়া গেছে তা জারি রাখা যায়। বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য রক্ষার্থে এডওয়ার্ড ও. উইলসন তাঁর বই অর্ধ-পৃথিবী (Half-Earth)-তে যেসব প্রস্তাবনা হাজির করেছেন সেরকম প্রস্তাবনাগুলোকে প্রাধান্য ও গুরুত্ব দেয়ার জন্যও এই সময় উপযোগী।


এই মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ায় কোন কোন ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাস মাথায় রাখা উচিৎ বলে মনে করেন?


আমি দীর্ঘকাল প্রত্যাশা করেছিলাম যে, দক্ষিণ এশিয় আঞ্চলিক সহযোগিতার সংস্থা (সার্ক) ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো ফরমেশন [গঠন] নিয়ে এগিয়ে যাবে, যেখানে জাতি-রাষ্ট্রগুলোর সীমান্ত পেরিয়ে মূলধন, শ্রম, চিন্তা এবং মানুষের অবাধ আদান-প্রদান চলবে, যে ভাবনাগুলো কিনা সার্কের গঠনের ভিত্তি-ভূমি। সেজন্য অবশ্য জাতি-রাষ্ট্রগুলোকে অবিশ্বাস ও সন্দেহের জাল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, যে দুটি (অবিশ্বাস ও সন্দেহ) কিনা আবার বহুকাল থেকেই সবার সম্পর্কের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। কিন্তু উদাহরণ দিতে গেলে এখন এটাই মনে হয় যে, ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ এই পন্থায়ই কেবল ১৯৪৭ এর পার্টিশনের ঘা ভুলতে পারে এবং কাশ্মীর হয়তো দীর্ঘস্থায়ী শান্তি না হলেও কমপক্ষে একটু দীর্ঘকায়-শান্তি পেতে পারে। এর ফলে উপকূলীয় সাইক্লোনসহ জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাব আরও মজবুতভাবে মোকাবিলা করতে এই অঞ্চলটি সক্ষম হবে। চীনও এই আলাপে শামিল হওয়ার জরুরত আছে। পাকিস্তান থেকে ভিয়েতনাম অব্দি বেশ কয়েকটি এশীয় দেশের নদী ব্যবস্থাকে হিমালয় পর্বতমালার হিমবাহগুলো প্রাণ দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এসব হিমবাহগুলোর দেখভাল করার জন্য এই অঞ্চলে কোন বহুমূখী চুক্তির বা সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। মোদ্দাকথা, আমি মনে করি, এই অঞ্চলটি নিজেকে একটি অঞ্চল হিসেবে ভাবা এবং কার্যপ্রণালী ও একীভূত-তহবিল তৈরি করা উচিৎ। অন্যদিকে, কর্তা-ব্যক্তিদের জলবায়ু পরিবর্তন, পানির অভাব, সাইক্লোন, সুনামি এবং অন্যান্য ‘প্রাকৃতিক’ দূর্যোগ মোকাবিলা করতে ভাবনা-চিন্তা করা উচিৎ।


দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যক্তির শরীর বনাম যৌথ সত্তা (the body politic)- উপর প্রচারমাধ্যম-নীতি বা স্বাস্থ্য-নীতির প্রাধান্যকে (focus) আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন? আপনার অঞ্চলের রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাসের নিরিখে আমরা সেই প্রাধান্যকে কীভাবে বিচার করতে পারি?


এই মহামারীকালে ভারতে ঘটা সবচেয়ে দুঃখজনক দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে তথা-কথিত “পরিযায়ী শ্রমিক”দের শোচনীয় দশা। যখন কেবল চার ঘণ্টার নোটিশে দেশটি লকডাউনে চলে যায়, এই শ্রমিকেরা তাদের রোজগার হারায় এবং মুফতে মাথা গুজতে দিতে অনিচ্ছুক জমি-মালিক বা বস্তি-মালিকরা তাদের ডেরা থেকে তাদেরকে উচ্ছেদ করে দেয়। এরপর মাসের পর মাস ধরে তাদের স্বীকার হতে হয় অবর্ণনীয় লাঞ্চনা ও হয়রানির। কত শ্রমিককে “বাড়ি” ফেরার উন্মাদনায় প্রাণ হারাতে হয়! এই মহামারী ভারতের শ্রম শক্তি সম্পর্কে একটি গোপন-অথচ-প্রকাশ্য সত্যের (open secret) উন্মোচন করেছে—এমন একটি দেশ যেখানে প্রায় এর নব্বই ভাগ শ্রমিকই অপ্রাতিষ্ঠানিক (informal) খাতে জড়িত। এই শ্রমিকদের জীবনে সম্পর্কে প্রথম উন্মোচিত সত্য হচ্ছে: তাদের ঘর ছাড়ার (migrancy, অভিবাসন) ব্যাপারটা। আমরা সবাই এ সম্পর্কে অবগত কিন্তু কেউ কখনো—এমনকি কোনো নীতি-নির্ধারক গোষ্ঠীও—এই ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছেন বলে মনে হয় না। অথচ, উচ্চ-মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ-বিত্ত শ্রেণির সবরকমের চাকচিক্য এসব পরিযায়ী শ্রমিকের শ্রমের কবরে দাঁড়িয়ে।


এই কথা মার্জিনে রাখলেও, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জাতি-রাষ্ট্রগুলো জুড়ে কোভিড-১৯ রোগীর অপর্যাপ্ত পরীক্ষা করার সমস্যাগুলো ছিল এবং যার ফসল হিসেবে, সম্ভবত, অপর্যাপ্ত রিপোর্ট দেয়ার সমস্যাগুলো। জনতাত্ত্বিক (demographic, জনসংখ্যা-বিষয়ক) কারণগুলো—মূলত তরুণ এবং বিশাল গ্রামীণ জনগোষ্ঠী—আঞ্চলিক সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু যেখানে চরম সামাজিক কায়দায় (fashion) জীবন-যাপন করা হয় সেসব অঞ্চলে শারীরিক দূরত্বের প্রয়োজনীয়তা প্রয়োগ বা চর্চা করা অনেক কষ্টসাধ্য বটে। এটার কারণ কেবল শহরগুলোর ভিড়ের জন্য না—অবশ্যই এটা একটা সমস্যা বটে—বরং সাংস্কৃতিক নির্বাচন।


তারপর আসে নাগরিকদের মধ্যে দারিদ্রের প্রাদুর্ভাব ও চিকিৎসাবিদ্যক জ্ঞানের আপেক্ষিক অজ্ঞতা। এসব নিম্নবর্গের লোকেরা যৌথ সত্তার (body politic) বিস্মৃত সদস্য। তারপরও, এই অতিমারী মোকাবেলায় তাদের সাহায্য করার ব্যবস্থা করতে অঞ্চলটির সফলতা শোচনীয়। বোধ করি, অঞ্চলটিতে এটাই প্রশাসনের সামনে চরম গুরুত্বপূর্ণ করণীয়। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে, দেশটির যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক কাঠামোর সমস্যার কারণে এই কাজটি জটিল বটে।


যদি পশু-পক্ষীবাহিত প্যাথোজেন বা জীবাণুর দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখি, আমাদের বর্তমানকালের চেহারাটা কী রকম? এবং কোন কোন প্রশ্ন আমাদের উত্থাপন করা উচিৎ, যেগুলো এখনো আমরা করিনি?


এ দুটো প্রশ্নের উত্তর আমি একসাথে দেবো, কেননা আমার দৃষ্টিতে সেগুলো একে-অপরের সাথে সম্পর্কিত। মাথায় রাখতে হবে যে, বর্তমাকালটা কেবল মানব সমাজের বৈশ্বিক ইতিহাসের অংশ না; এটা এমন একটা সময়েরও প্রতিনিধিত্ব করে যেটা এই গ্রহের জৈবিক প্রাণের ইতিহাসের পৃষ্ঠা, এমন একটা সময়ের যখন মানব সন্তানেরা একটা ভাইরাসের বাহন হিসেবে কাজ করছে—যে ভাইরাসটির মূল আধার (host reservoir) হয়তো লক্ষ বছর ধরে বয়ে নিয়ে আসা চীনের কিছু বাদুড়। বাদুড় কিন্তু প্রাচীন এক প্রজাতি, তাদের প্রায় পঞ্চাশ মিলিয়ন বছরের (আমাদের ৩,০০,০০০ বছরের তুলনায়) সূত্রতা আছে। প্রাণের ডারউইনীয় ইতিহাস বলে সব রকমের প্রাণ তাদের টিকে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করতে চায়। এই নভেল করোনা ভাইরাসটি শরীরে বাসা বাধার প্রজাতি ঘরানার, যেটার জন্য চীনের উদ্ভট (exotic) মাংসের চাহিদাকে ধন্যবাদ(!) দিতেই হয়। একই সাথে এটি এখন চমৎকার বাহনও পেয়ে গেছে মানব সমাজে যেটা কিনা তাকে দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে যেতে সাহায্য করে। এটা কেন? কারণ অত্যন্ত সামাজিক প্রাণি খ্যাত মানব সন্তান এখন এমন একটি গ্রহে বিশাল সংখ্যায় বিদ্যমান, যেটি তাদের দ্বারাই জনাকীর্ণ এবং তাদের বেশীরভাগই প্রচণ্ড গতিময়। এককথায়, এটাই আমাদের বিশ্বায়নের (globalization) ইতিহাস। এবং অবশ্যই বলতে হয় যে, উপসর্গ দেখা দেয়ার আগেই আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টা ভাইরাসটির জন্যে সুবিধার জায়গা। সুতরাং জীবাণুর দৃষ্টিতে দেখলে, এটা একটা বিশাল পদক্ষেপ বা অগ্রগমন। মানুষ ভাইরাসটির বিরুদ্ধে জিতে যেতে পারে—আমি মন থেকে আশা করি, মানুষ জিতুক—কিন্তু ভাইরাসটি ইতোমধ্যে জিতে গেছে। নিঃসন্দেহে প্রাণের ডারউইনীয় ইতিহাসে এটি একটি পর্ব। একইসাথে, এটি যেসব পরিবর্তন ঘটাবে তা আমাদের বৈশ্বিক ইতিহাস (global history) এবং জৈবিক প্রাণের গ্রহগত ইতিহাস (planetary history) উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে।


আমাদের মূলত যে জটিল ও মৌলিক প্রশ্ন তুলতে হবে তা হচ্ছেঃ মানুষ হিসেবে আমরা কি এমন এক অর্থনীতিকে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে তুলতে থাকবো যেটা কিনা পশু-পক্ষীবাহিত প্যাথোজেন বা রোগজীবাণুর বৃদ্ধির সংকটের দিকে নিয়ে যায়? নাথান ওল্‌ফ (Nathan Wolfe)—যে ভাইরাসবিদের কথা আমি একটু আগে উল্লেখ করেছি—দেখান যে, ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া মানুষ ও গৃহপালিত পশুপাখির মধ্যে আদান-প্রদানজনিত মহামারীগুলো প্রায় ৫,০০০ বছর আগে একধরনের ভারসাম্যে পৌঁছে গেছে। তিনি বলেন যে, মহামারী আকার ধারণ করার মতো সম্ভাবনাময় সবচেয়ে সাম্প্রতিক সংক্রমণগুলো ঘটেছে মানুষের সাথে বন্যপ্রানীর বর্ধনশীল যোগাযোগের মাধ্যমে। বন্যপ্রাণীদের আমাদের প্রয়োজন পড়ে না; আমরা নিজেরাই যাই এবং তাদের বাসস্থান ধ্বংস করি, আমাদের সংস্পর্শে আসতে তাদের বাধ্য করি। বিভিন্ন ভূ-ব্যবস্থার বিজ্ঞানীরা, বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানী এবং অ্যান্থ্রোপসিন যুগের বিজ্ঞজনেরা আমাদের স্মরণ করিয়ে আসছেন যে, বৈশ্বিক অর্থনীতি আমাদের জীব-বৈচিত্র্য (bio-diversity) ধ্বংস করছে। মানুষের সময়ের নিরিখে জীব-বৈচিত্র্য একটি অ-নবায়নযোগ্য সম্পদ, যেটা কিনা আমাদের সহ সব প্রাণের সমৃদ্ধির পথে সংকটময় অধ্যায়। আগামীতে মানুষ কী ধরনের সভ্যতায় নিঃশ্বাস নিতে চাইবে, সেটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করার এখনই সময়। পুঁজিবাদ এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যে স্নায়ু যুদ্ধ যথেষ্ট হয়েছে এবং সেটা মূলত এখন অচল। কিন্তু তার মানে এটা না যে, পুঁজিবাদকে সমালোচনা করার প্রশ্ন তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমান-দিনের পুঁজিবাদের বিকল্প কেবল মাওবাদী বা লেনিনবাদী সমাজতন্ত্র হতে হবে, এমন না। যেহেতু মানব সন্তানেরা তাদের ভবিষ্যৎ এমন এক গ্রহে চিন্তা করে যেটাকে তারা নিশ্চিতভাবে অনন্তকাল টিকে থাকবে বলে ধরে রেখেছে, সেহেতু পৃথিবীর বাস্তু-সংস্থানকে ধ্বংস বা পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ না করে কীভাবে আধুনিক এবং গণতান্ত্রিক থাকা যায় সেটাই এখন একটি গুরুতর প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

___________

১৭ই জুন, ২০২০



টীকা:

[] অ্যান্থ্রোপোসিন (anthropocene): অ্যান্থ্রোপোসিন বলতে মনুষ্যকেন্দ্রিক এমন এক ভূতাত্ত্বিক কালপর্বের প্রতি ইঙ্গিত করা হয় যখন মানুষ তার সংখ্যা, ফসিল ফুয়েলের ব্যবহার অর্থাৎ মানুষী ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে পৃথিবীর সার্বিক স-জীব ও অ-জীব উপাদান, পরিবেশ প্রতিবেশ ও জলবায়ুর ভয়াবহ বিপন্নতার সম্ভাবনা তৈরি তথা খোদ একটি গ্রহের চেহারা পাল্টে দিতে সক্ষম এক ভূতাত্ত্বিক ক্ষমতা (geological agent) হয়ে উঠেছে। অ্যান্থ্রোপোসিন এমন এক যুগ যখন মানুষই পৃথিবী নামক এই গ্রহের একমাত্র ভূতাত্ত্বিক শক্তি।

হদিসঃ https://toynbeeprize.org/posts/interview-toynbee-coronavirus-series-dipesh-chakrabarty-on-the-pandemic-in-the-age-of-the-anthropocene/


প্রকাশঃ ১৭ই চৈত্র, ১৪২৭:::৩১শে মার্চ, ২০২১