সাক্ষাৎকারঃ য়েনবি করোনাভাইরাস সিরিজ


অ্যান্থ্রোপোসিনের যুগে পশু-পক্ষীবাহী রোগজীবাণু, মানব জীবন এবং মহামারী প্রসঙ্গে দীপেশ চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার



[শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তীর এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল গত বছরের জুনে। দীপেশ চক্রবর্তীর এই সাক্ষাৎকারটি তর্জমা করেছেন মোহাম্মদ শাহিনশাহিন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।]




আমরা কীভাবে চলমান মহামারীকে অ্যান্থ্রোপোসিনের ডিসকোর্স বা রাজনীতির নিরিখে বিচার করতে পারি? অতিমারীটি কি কোনোভাবে ডিসকোর্সটির পরিবর্তন ঘটায় বা মানব সমাজের পরিবর্তন বা উন্নতির জন্য নয়া সম্ভাবনার পথ খুলে দেয়?


আসলে এই মহামারী বৈশ্বিক ইতিহাসের সেই সময়কালের সাথে সম্পর্কিত যেটাকে কিনা ভূ-পৃথিবী ব্যবস্থার বিজ্ঞানীরা এবং তাদের সহযোগীরা “মহা ত্বরণ” (The Great Acceleration) বলে আখ্যা দিয়েছেন—যার সময়কাল ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বর্তমান। কিন্তু এটি মানবতাকে নিশ্চিতভাবেই চমকে দিয়েছে। এটি অন্যসব দূর্যোগ, যেমন: বিধ্বংসী টাইফুন, ভূমিধ্বস বা অগ্নুৎপাতের মতো না—মানবসৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতার ক্ষতিকারক প্রভাব সম্পর্কে আমরা যেসব ধারণা রাখি সেখান থেকে যে-দূর্যোগগুলোকে কিনা আমরা এখন প্রত্যাশা করা শুরু করছি। অথচ, যে মুহূর্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কোভিড-১৯ কে মহামারী বলে ঘোষণা দিলো, জাতিসংঘের কর্মকর্তারা তাদের পরিবেশসংক্রান্ত বিভাগে অতিদ্রুত’ই বন উজার, বন্যপ্রাণের বাসস্থান ধ্বংস, বর্ধনশীল মানব প্রাচুর্য এবং মহামারীর মধ্যে একটা যোগসূত্র গেঁথে দেন। তাদের কেউ কেউ এমনকি এত দূরে চলে গিয়েছিলেন যে, অতিমারীটিকে মানবজাতির প্রতি প্রকৃতির “সতর্কবাণী” রূপে ব্যাখ্যা দেন। তাঁরা সহ আরও অনেকেও দেখান যে, গত বিশ বা এরকম বছরে মানবজাতির জন্য যেসব নতুন সংক্রামক ব্যাধির দেখা মিলেছে তার পঁচাত্তর ভাগই পশু-পক্ষীবাহক প্যাথোজেন বা রোগজীবাণু (zoonotic pathogens) ধরনের। যার মানে হচ্ছে, এসব ব্যাধি জন্মলাভ করেছিল যখন কোন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া, প্রজাতির শরীরে বাসা বাঁধে—বন্যপ্রানী থেকে মানবে স্থানান্তরিত হয়। পশু ও পাখির শরীর থেকে মানব-শরীরে ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার এই স্থানান্তর দ্রুততর হয়েছে বন্যপ্রাণের বাসস্থান ধ্বংসের মাধ্যমে। সেজন্য অবশ্য খনি খনন, বনের ধ্বংসযজ্ঞ, সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণ, বনভূমিকে কৃষিভূমিতে রূপান্তর, মানব-বাসস্থানের বর্ধনশীলতা, বন্যপ্রাণের বেআইনী বাণিজ্য এবং এরকম ইত্যাকার বিষয়াদির ফলে বন-নিধনের এই বর্ধনশীল গতিকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। এই প্রস্তাবগুলো ভাইরাসবিদ নাথান ওল্‌ফ (তাঁর The Viral Storm বইটি দেখুন) এবং Spillover-এর লেখক ডেভিড ক্যুয়ামেনের (David Quammen) মতো বিজ্ঞান লেখকদের গবেষণা দ্বারাও সমর্থিত। কার্যকরণসম্বন্ধের পারস্পর্য অ্যান্থ্রোপোসিন এবং মহামারীটির মধ্যে যোগসূত্রতা প্রকাশ করে। পারস্পর্যটা এরকম: সস্তা ও অঢেল শক্তির (energy) ক্রমবর্ধমান প্রতুলতা আরও অধিক মানবসংখ্যা ও সমৃদ্ধির দিকে ধাবিত করে, যা বদলা হিসেবে উন্নয়ন ও ভোগের জন্য ক্রমবর্ধমান মানবচাহিদা ফেরত দেয়। ফলে, পরিশেষে এটি বন্যপ্রাণের বাসস্থান ধ্বংস এবং মানব ও বন্যপ্রাণীর মুখোমুখি অবস্থানের ক্ষেত্র বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যায়। দুঃখজনকভাবে হলেও, সবগুলো ছক সুন্দরভাবেই মহা-ত্বরণের ভাষ্যটির সাথে মিলে যায়, যে ভাষ্যটি কিনা অ্যান্থ্রোপোসিন হাইপোথিসিসকে সমর্থন করে।


আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের ব্যাপারে বললে: অগ্রগতি সম্পর্কে নিশ্চিত না, তবে অতিমারীটি আমাদেকে অনেক কিছু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। যার মধ্যে এগুলো উল্লেখযোগ্য: (ক) অতিমারীটি দেখিয়েছে, যখন মানুষেরা তাদের উপস্থিতি এবং কার্যক্রম গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়, বিভিন্ন অঞ্চলে কীভাবে বাতাস আরও নির্মল হয়েছে, আকাশ আরও নীল হয়েছে এবং শহরগুলো কিছু পাখি ও প্রাণী ফিরে পেয়েছে যেগুলো তারা হয়তো হারিয়ে ফেলেছিল; (খ) দেখিয়েছে, আমরা হয়তো কম চলাচল এবং বেশী অনলাইন উপস্থিতি নিয়ে একটা বিশ্বে বাস করার জন্য প্রস্তুত হয়েছি; (গ) দেখিয়েছে, চলাচলের উপর এত নির্ভরশীল একটা বিশ্ব প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের ভবিষ্যত মহামারীর কাছে আমাদের দূর্বল করে রেখে দেয়; (ঘ) দেখিয়েছে, মানুষেরাই পৃথিবীর পরিবেশের সবচেয়ে বড় ধ্বংসকারী।