Bessengue Douala. La passerelle (the small bridge) by Alioum Moussa. Photo by Sandrine Dole from Wikimedia Commons.
একটি প্লানেটারি (planetary)১ পারম্পর্য
যে বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা ও অবিচার এই বিশ্বের কাঠামো হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, এই অতিমারী তাদেরকেও উন্মোচন করেছে। বিচ্ছিন্ন প্রগতি সত্ত্বেও যে ‘চিরন্তন শান্তি’ ইমানুয়েল কান্ট আশা করেছিলেন, তা এখনো অধিকাংশ মানুষের কাছে মরীচিকা হয়েই রয়ে গেছে। যেকোন সময়ের মত এখনো অসংখ্য জাতির সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা শেষপর্যন্ত যুদ্ধ দিয়েই রক্ষা ও নিশ্চিত করা হয়। অন্যভাবে বললে: বাছবিচারহীন রক্তপাতের সম্ভাবনায়। এটারই গালভরা নাম—‘ক্ষমতার ভারসাম্য’। এমন একটি ক্ষমতা কাঠামোর উপস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সংহতির একটি ব্যবস্থা যা জাতীয় সার্বভৌমত্বকে অতিক্রম করে, তা এখনো অনেক দূরে। একই সাথে, স্বশাসিত সাম্রাজ্যের ধারণায় ফিরে যাওয়া একটি ফ্যান্টাসির বেশি কিছু না।
এরই মাঝে, বিভিন্ন শক্তির একটা বিশাল সমাবেশ যেগুলো যতটা ভৌত বা প্রাকৃতিক ততটাই জৈবিক বা যান্ত্রিক—প্রযুক্তি, গণমাধ্যম এবং পুঁজিবাজারসহ—সবাই বিশ্বের বিভিন্ন অংশের মাঝে ফাটলের জাল বুনতে ব্যস্ত।
একটি প্লানেটারি পারম্পর্য ইদানীং আকার ও শক্তি লাভ করছে যা রাষ্ট্রীয় সীমানাকে উপেক্ষা করে (এবং স্ববিরোধীভাবে এর উপর নির্ভরও করে) এবং প্রাতিষ্ঠানিক কার্টোগ্রাফির সাথে যার কোন সম্পর্ক নেই। আন্তঃনির্ভরতা ও আন্তঃসম্পর্ক দিয়ে গঠিত, এটি ঠিক বিশ্বায়নের (globalization) মত নয়; অন্তত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে শব্দটির যে অর্থ সেটা মাথায় রেখে। এটি বরং একটি বিস্ফোরিত সমগ্রতা: নেটওয়ার্ক, প্রবাহ ও সার্কিট যা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল গতিতে বিলীন হচ্ছে এবং বহুবিধ মাত্রায় পুনর্গঠিত হচ্ছে। এই সমগ্রতার উদ্ভব বিভিন্ন ধরনের জট থেকে, অন্তত বসতি এলাকা এবং বন্যতা ও তাদের নিজ নিজ সীমানার মধ্য থেকে নয়। এই পৃথিবীর বুনন অসংখ্য চরমতা এবং বহু বড় ও ছোট কেন্দ্র দিয়ে গঠিত। কোন কিছুই এর বাইরে না। সবকিছুই কোন না কোন সময় সবধরনের প্রবাহের দ্রুত সঞ্চালনের রিলে হিসেবে কাজ করে।
অবশ্যই, সবকিছু একই ছন্দে চলে না। তবে এর প্লানেটারি অস্তিত্বের সব ধরনের প্রকাশ (স্থলে, সমুদ্রে, বাতাসে, কক্ষপথে, ফাইবার-অপটিকে) এখন গতি ও বেগ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। শুধুমাত্র যে পুঁজির প্রবাহ চলাফেরা করে তা নয়। মানুষ, পশু-পাখি, জীবাণু ও বস্তু সবকিছুই চলনশীল, যেমনটা সবধরনের পণ্য ও তথ্য-উপাত্ত। কাঁচামাল এক স্থান থেকে নিষ্কাশন করা হয় আর পরিশোধিত হয় আরেক স্থানে। আবার উপাংশগুলোকে পণ্যে একত্রিত করা হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি স্থানে।
এগুলো যতই বিচ্ছিন্ন মনে হোক না কেন, যে রাস্তা এগুলো অনুসরণ করে তা অনেকটাই একই, স্থুলতম বাস্তবতা থেকে অতিসূক্ষ্ম বিমূর্ততা পর্যন্ত। আমরা এমন প্লানেটারি যৌগিকতার ক্রমশ উন্নতি প্রত্যক্ষ করছি যা ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় এবং নেটওয়ার্ক জুড়ে কাজ করলেও অল্পবিস্তর স্থানিকভাবে খন্ডিত।
নিষিদ্ধ রক্ত
কোভিড-১৯ যে কোন ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ট্রাজিক ভিত্তিগুলোর একটিকে উন্মোচন করে দিয়েছে, এবং নিঃসন্দেহে এমন একটিকে যেটি ভুলে যাওয়ার প্রবণতা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে জীবন উৎসর্গ করার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু কোন জীবন? কার দ্বারা, কখন, কেন এবং কোন পরিস্থিতিতে উৎসর্গীকৃত?
এমন কোন মানব সম্প্রদায় নেই যার ভিত্তিমূলে ‘নিষিদ্ধ রক্তের’ (যে রক্ত কেবল কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে ঝরানো যাবে) ধারণা নেই। উৎস, ধর্ম বা জাতি, যার মাধ্যমেই ঐক্যবদ্ধ থাকুক না কেন, সব সম্প্রদায়ই গভীরভাবে বিসদৃশ মানুষদের সম্ভার। রক্তপাতের নিষেধাজ্ঞা যেন অন্তর্কলহের বিপরীতে রক্ষাকবচের মত। এটি একই সম্প্রদায়ের মানুষদের খুনোখুনি না করেই সহাবস্থানের সুযোগ দেয়।
শেষ বিচারে, কিভাবে একটি সম্প্রদায় অস্তিত্বের প্রতি হুমকি মোকাবিলা করে সেটিই একটি সম্প্রদায়কে আরেকটি সম্প্রদায় থেকে আলাদা করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, সম্প্রদায়কে প্রাণে বাঁচাতে কোন জীবনগুলো ছুঁড়ে ফেলা যায়— এই জটিলতাকে কিভাবে সম্প্রদায়টি সুরাহা করে। এধরনের বলিদান কার্যকর করার এমন কোন উপায় কি আছে যা কোন না কোনভাবে অন্তর্কলহকে উসকে দেয়ার বা সামাজিক বন্ধনের ভেঙে যাওয়া বা রাজনৈতিক এককটিকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার দিকে নিয়ে যায় না?
খুব বেশি আগের কথা নয়, মহামারী ও দুর্ভিক্ষ এই দোটানাকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সার্বভৌম সিদ্ধান্ত হিসেবে নির্মাণ করে। যুদ্ধ ছিল এসব ঐতিহাসিক ঘটনার আর্কিটাইপ যার কিছু জীবন উৎসর্গ করার প্রয়োজন ছিল যেন অন্যরা বেঁচে থাকবে বা এমনকি সম্বৃদ্ধ হতে পারবে। বিপর্যয় সৃষ্টিকারী বিবাদগুলো নির্মম বলপ্রয়োগ দাবি করতো। লক্ষ্য ছিল সম্প্রদায়ের চলমান অস্তিত্বের হুমকি সৃষ্টির দায়ে অভিযুক্ত শত্রুকে খুন করা। কিন্তু যুদ্ধের মানে হচ্ছে এটা একটি সার্বজনীন মৃত্যুর বিনিময় এবং শত্রুর পিছনে ছোটা মানে এর বিপরীতে আক্রমণের মুখে পড়ার ঝুঁকি।
যে জীবন নিঃশেষের
উনিশ শতক থেকেই, জীবনের শুমারী ও মাপাজোঁকা— এবং এর ফলস্বরূপ বলিসংক্রান্ত সম্ভাবনাগুলোর পুনর্বন্টন— মূলত অর্থনীতির বিষয় ছিল। কার্ল পলান্যি মন্তব্য করেন যে, অর্থনীতি—বিশেষ করে বাণিজ্য—সবসময় শান্তির সাথে জড়িত ছিল না। অতীতে, তাঁর ব্যাখ্যায়, ‘বাণিজ্যের সংগঠন সবসময় সামরিক ও যুদ্ধ সংক্রান্ত ছিল; এটা ছিলো দস্যু, যাযাবর, সশস্ত্র কাফেলা, শিকারি, তরোয়াল-ধারী বণিক, শহরের অস্ত্রধারী প্রশাসক, অভিযাত্রী ও অনুসন্ধানকারী, উপনিবেশবাদী ও দিগ্বিজয়ী, মানুষ শিকারি ও দাস-ব্যবসায়ী, নিবন্ধিত কোম্পানির ঔপনিবেশিক সৈন্যের এক সংযোজন’। [i]
ইদানীং, জীবনকে আর সমাজে ব্যক্তির অবস্থানের নৈতিক বাধ্যবাধকতার আনুষঙ্গিকতার বিপরীতে আর মাপা হয় না। তাদের মাপা হয় হিসাবনিকাশের পরম্পরা অনুসারে। এসব হিসাবনিকাশ সবই একটি নির্দিষ্ট বিশ্বাস ও নির্দিষ্ট ধর্ম অনুসরণ করে। সমাজের এরকম সার্বভৌমত্ব আর নেই। এটা এখন কেবলই বাজারের একটা উপাঙ্গে পরিণত হয়েছে।
এটা বর্তমান সময়ের প্রধান মতবাদ (dogma) ও একই সাথে প্রধান বাজি। এই বাজির শর্তানুযায়ী, বাণিজ্যের মাধ্যমে (বা মাঝেমাঝে দখলদারির মাধ্যমে) অর্জিত মুনাফা সবসময় অন্য সকল মানবীয় অভিপ্রায়কে খর্ব করে। কিছু পণ্য বিক্রি করে পাওয়া লাভ ব্যতীত আর কোন লাভ নেই। জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় বাজারমূল্য দিয়ে।
প্রতিটি মানব জীবনই একটি সম্ভাব্যতা, এবং জীবনের হিসাব নিকাশ সম্ভাব্যতার হিসাব-নিকাশেরই অনুরূপ। এই হিসাব-নিকাশে একটিমাত্র যে বিষয়টির মূল্য আছে তা হলো দক্ষতা। যেখানে জীবনকে ব্যয় করা যাবে, সে পর্যন্তই জীবনের ব্যাপ্তি। অনেকের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে আমাদের অবশ্যই কিছু জীবন পরিত্যাগ করতে সম্মত হতে হবে।
যেহেতু অ্যানথ্রোপোসিন (anthropocene)২ আমাদের নতুন একটি ভাইরাস ও রোগজীবাণুর যুগে প্রবেশকে নির্দেশ করে, এখন কোন শরীরগুলো সম্প্রদায়কে সংক্রমিত করবে এবং অনেকের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে কোন জীবনগুলো ঝেড়ে ফেলতে হবে সেটা চিহ্নিত করার প্রশ্ন অদূর ভবিষত্যের প্রধান রাজনৈতিক প্রশ্ন হয়ে উঠতে প্রস্তুত।