জীবনের পত্তন

রবার্তো এসপোজিতো


[ইতালীয় দার্শনিক রবার্তো এসপজিতো বায়োপলিটিক্সে গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য মশহুর। কেউ কেউ মনে করেন এসপোজিতো’র কাজ বায়োপলিটিক্স বা জৈব-রাজনীতিতে [ইতালীয় দার্শনিক রবার্তো এসপজিতো বায়োপলিটিক্সে গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য মশহুর। কেউ কেউ মনে করেন এসপোজিতো’র কাজ বায়োপলিটিক্স বা জৈব-রাজনীতিতে immunitary turn ঘটিয়েছে। এক্ষেত্রে তাঁর Communitas (১৯৯৮), Immunitas (২০০২) এবং Bíos (২০০৪) গ্রন্থত্রয়ী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তিক্ত নিরাময়-এর পর করোনাভাইরাস মহামারী প্রসঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় লেখা Vitam instituere প্রকাশিত হয়েছে। এসপোজিতো’র লেখাটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে ইউরোপীয় মনঃসমীক্ষণ জার্নালে। ইতালীয় ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ইম্মা ক্যাথরিন গেইন্সফোর্থ(Emma Catherine Gainsforth)। ইম্মা ক্যাথরিনের অনুবাদ থেকে এসপোজিতো’র লেখাটি বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।]


করোনাভাইরাস আমাদের কোন কাজের দায়িত্ব দেয় সেটা বলতে গেলে আমি প্রাচীন ল্যাটিন অভিব্যক্তি vitam instituere (জীবন প্রতিষ্ঠা কর/institute life) এ ফিরে যেতে চাইবো। এই অভিব্যক্তি পাওয়া যায় ডিমোস্থিনের একটা অনুচ্ছেদে, যেটা রোমের আইনজ্ঞ মার্সিয়ানো ডাইজেস্টে উদ্ধৃত করেছেন। কিন্তু এর অর্থের একটা শক্তিশালী সমকালীন গুরুত্ব আছে। এই মুহুর্তে মানুষের জীবন যখন হুমকির সামনে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে, এমনকি মৃত্যু দ্বারা শাসিতও হচ্ছে, তখন জীবনকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করাই কেবল আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা হতে পারে। দিনশেষে, একটা চলমান পত্তন (সর্বদা নতুন তাৎপর্য তৈরি করা সক্ষমতা) বাদে জীবন আর কি বা হতে পারে ? হানা আরেন্ড অথবা তারও আগে [সেইন্ট] অগাস্টিন এই অর্থে এটাই বলেছেন যে আমরা মানুষেরা একটা শুরু, কারণ আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে দুনিয়ায় আসা। এমন কিছু শুরু করা, যা পূর্বে অস্তিত্বশীল ছিলনা। এই প্রথম শুরুর পরে আরেকটা শুরু হয়। আরেকটা পত্তনের কাজ। এই দ্বিতীয় শুরু গঠিত হয় ভাষার দ্বারা যেটাকে ফরাসী মনোসমীক্ষণবিদ পিয়ের লেজঁন্দ “দ্বিতীয় জন্ম” হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। এই দ্বিতীয় জন্ম থেকেই শহর ও রাজনৈতিক জীবনের জন্ম যা জীবের জীবনকে একটা ঐতিহাসিক দিগন্ত দেয়। এই দিগন্ত প্রকৃতির বিপরীতে নয়, বরং প্রকৃতির সকল প্রকার বিস্তৃতি জুড়ে। লোগোসের(Logos, শব্দব্রহ্ম) জমিন আর তারপরে নমোসের(nomos) জমিন নিজেদের গঠনের সমৃদ্ধিতে যতটা স্বনির্ভর হোক না কেনো, বায়োসের(bios) জমিন থেকে কখনো নিজেকে আলাদা করতে পারেনি। উল্টো বরং তাদের সম্পর্ক আরও এতটাই সন্নিকটে এসেছে যে, যেই পরিসর থেকে জীবন উৎপাদিত হয়েছে তার থেকে আলাদা করে রাজনীতি নিয়ে কথা বলাই সম্বব নয়।


প্রথম জন্ম দ্বিতীয় জন্মের ঘোষণা দেয়, ঠিক যেমন দ্বিতীয় জন্মের শেকড় প্রথম জন্মে। এই কারণেই জীবন পত্তন ঘটানো বন্ধ করা মানুষের পক্ষে অসম্ভব। কারণ জীবনই, একটা দুনিয়াতে বসানোর মধ্য দিয়ে মানুষের পত্তন ঘটায়। এই অর্থে মানুষকে কোনভাবে নিছক টিকে থাকাতে নামিয়ে আনা সম্ভব না।[ওয়াল্টার] বেঞ্জামিনের অভিব্যক্তি ব্যবহার করে বলা যায়, এই কারণেই মানুষকে “নেংটো জীবনে” নামিয়ে আনা সম্ভব না। গোড়া থেকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে আমাদের জীবন কখনোই পুরোপুরি জৈবিক বিষয়ের অনুরূপ হয়নি। এমনকি নির্মমভাবে যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দেয়া হয়, তখনও না। এমনকি এরকম পরিস্থিতিতে (অথবা বিশেষ করে এরকম পরিস্থিতিতে) যতক্ষণ পর্যন্ত জীবন আছে ততক্ষণ পর্যন্ত এরকম জীবন কোন না কোনভাবে একটা জীবনের রূপে থাকার নিজস্ব উপায় প্রকাশ করে। যতটা বিকৃত, আহত বা পদদলিতই হোক না কেন। এই গাঠনিক বৈশিষ্ট্য (যা নিছক জীববিদ্যার বিষয় না) জীবনকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রতিকী সম্বন্ধের যোগসাজশে নির্মিত একটা ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতের অন্তর্ভুক্ত করে। শুরু থেকে যা আমাদেরকে প্রতিষ্ঠা করেছে এবং যা আমরা ক্রমাগত নিজেরা প্রতিষ্ঠা করতে থাকি সেটাই হচ্ছে এই প্রতিকী জাল, যার মধ্য দিয়ে আমরা যা করি তা অর্থবোধকতা ও তাৎপর্য (আমাদের ও অপরের জন্য) পায়।


করোনাভাইরাস ঠিক পারস্পরিক সম্পর্কের এই সাধারণ জাল ভেঙ্গে ফেলার হুমকি দেয়। কেবলমাত্র প্রাথমিক জীবন নয়, বরং দ্বিতীয় জীবনও অর্থাৎ অপরের সাথে আমাদের সম্পর্কের সামাজিকতার যে জীবন। এটা পরিষ্কার যে অবশ্যই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে হলে এই দ্বিতীয় জীবন অটুট থাকতে হবে। নামিয়ে ফেলা যায় এমন কোন স্বর “টিকে থাকার” মধ্যে নেই, বরং conservatio vitae’ মহান ধ্রুপদী ও আধুনিক সংস্কৃতির কেন্দ্রে নিহিত। হবসের হাত ধরে যে মহান রাজনৈতিক দর্শনের জন্ম হয়েছে তার মতই, জীবনের পবিত্রতার যে খ্রীষ্টিয় ডাক সেখানে এর প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। এই ভাইরাস আমাদের এক মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করায় যেখানে দাঁড়িয়ে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখাই আমাদের প্রথম কাজ।


কিন্তু প্রথম জীবনের পরে এর সাথে মিলে আমাদের অবশ্যই দ্বিতীয় জীবনকেও রক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ আমাদের প্রতিষ্ঠিত জীবনকে বাঁচাতে হবে যাতে করে আমরা নতুন তাৎপর্য তৈরিকে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হই। অতএব, যখন বেঁচে থাকার জন্য স্বাভাবিকভাবেই আমরা সম্ভাব্য সকল কিছু করছি আমরা আমাদের অপর যে জীবন তার হাল ছেড়ে দিতে পারিনা। অপরের সাথে, অপরের জন্য, অপর হয়ে যে জীবন। এটা এই মুহুর্তে যথেষ্ট যৌক্তিকভাবেই অনুমোদিত না। কার্যত নিষিদ্ধ। যে মানুষটা হাসপাতালে নিজের এবং অপরের জীবন বাঁচাতে লড়ছে তার সাথে এই ছাড়টুকুকে তুলনা করা কেবল অসম্মানজনই না, রীতিমত হাস্যকর। যাইহোক, তাতে করে প্রতিষ্ঠিত জীবনের গুরুত্ব কোন অংশেই কমে যায়না। এবং এই জন্যেই, এসবকিছু সত্বেও চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে। যখন সামাজিক সম্পর্করা ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় রয়েছে, তখন একসাথে বাঁচার জন্যে আরও বেশি প্রয়োজন। এমনকি একাকী অবস্থায়ও। এরকম একাকিত্বকে একটা সাধারণ অর্থ দেয়ার জন্যে। দিনশেষে, ঠিক এটাই আজকের দিনে আমাদেরকে অপরের সাথে এক সূতায় গাঁথে। বাকি সকলের জন্য আজ যা গোটা মানবজাতির অর্ধেক, সম্ভবত এক মাসে তা পুরো মানবজাতিই হয়ে যেতে পারে। দিনশেষে, দূরত্ব তো গভীরভাবে একটা মানবীয় ডাইমেনশন। নৈকট্য থেকে ঠিক যেরকমভাবে এটা অর্থ তৈরী করে। ব্যক্তিমানুষ বলতে কখনোই সমাজের নিছক উল্টোটা বোঝায়নি। বরং ব্যক্তিমানুষই একটা সামাজিক নির্মাণ। আজকের দিনে, দূরত্ব ও নৈকট্যের মাঝের এই প্রতিকী সম্পর্ক (প্রতীক হচ্ছে ঠিক সেই আদল যা এদেরকে প্রকাশিত করে) আরও অধিকতর তাৎপর্য পেয়েছে।

বৈশ্বিক মহামারীর কালে একটা সাধারণ দূরত্বের মাধ্যমে মানবজাতি সংযুক্ত হয়েছে। যে অদৃশ্য শক্তি জীবনকে গিলে ফেলার ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে তার হাত থেকে জীবনকে রক্ষা করা জন্যে, জীবনের পত্তন ঘটানোর জন্যে এটাও একটা তরিকা। এটাই এই মুহুর্তে প্রয়োজনীয় তরিকা।


___________


***এই লেখাটির ভিন্ন আরেকটি ইংরেজি অনুবাদ রয়েছে। দেখুন, lareviewofbooks.org


প্রথম প্রকাশঃ ১০ই জুন, ২০২০

সর্বশেষ সংশোধনঃ ১০ই জুন, ২০২০

লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/notes/432622321037387/